রোকেয়া হলের দিনগুলি

শিরিন হোসেন সেই কবেকার কথা। আটচল্লিশ বছর হতে চললো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ১৯৭৪-৭৫ সনের সেশনে অনার্সে ভর্তি হলাম। আমার স্কুল, কলেজ সবই ছোট ছিমছাম জেলা শহর কুমিল্লায়। মনে ভয় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় টিকবো তো? তাছাড়া দেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। সেশন জট কমানোর লক্ষ্যে মাত্র ছয়মাস উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস করেই সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা দিয়েছি। এই লেখাপড়া দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য হবে কি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলাম, বাংলা আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান। দেখলাম দুটোতেই টিকে গেছি। শুধু টিকে যাওয়াই নয়, বেশ ভালোভাবে টিকেছি, নাম উপরের দিকে আছে। সিদ্ধান্ত নিলাম রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ব। এই সিদ্ধান্তের পেছনেও স্মরণীয় এক ঘটনা রয়েছে যা আজ বলার লোভ সামলাতে পারছি না। ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বাংলারটাই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। আমি দারুণ আনন্দিত। সদ্য স্বাধীন দেশ, দেশের প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি তীব্র ভালোবাসা থেকে বাংলায় পড়ার ইচ্ছে জন্মেছিল। সেই সময় শুধু আমি নয়, এই আকাঙ্ক্ষা আরো অনেকেরই ছিল। বাংলায় আমার ভাইবা বোর্ডে ছিলেন স্বনামধন্য প্রয়াত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। তিনি জানতে চাইলেন আমি আর কোন ডিপার্টমেন্টে পরীক্ষা দিয়েছি কি না। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কথা জানালাম। তিনি মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বললেন, আমি তো শিক্ষক মানুষ, উপদেশ দিতে অভ্যস্থ, তোমাকে কি একটা উপদেশ দেবো? আমি বললাম, খুব খুশি হবো স্যার। তিনি যেটা বললেন তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি বললেন, আমি তোমাকে বলবো, তুমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা কর। যদি সে…

একটি পুত্র সন্তানের জন্যে

মূল: খুশবন্ত সিং অনুবাদ: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ঈশ্বর ও ধর্মের ব্যাপারে দেবীলালের গভীর আগ্রহ। তরুণ বয়সেই তিনি অস্তিত্বের সংকট নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। এ ব্যাপারে বন্ধুবান্ধব, মন্দিরের পূজারি ও মসজিদের ইমাম সাহেবদের সাথে যুক্তিতর্কে লিপ্ত হতেন। প্রশ্ন করতেন, আসলেই কি ঈশ্বর আছেন? একেক জনের ভিন্ন ভিন্ন উত্তর পেতেন। কোনো ব্যাখ্যাই দেবীলালকে সন্তুষ্ট করতে পারতো না। দেবী লাল উপসংহারে পৌছলেন, ঈশ্বর খামখেয়ালি। দেবীলাল কীভাবে বিশ্বাসীতে পরিণত হলেন, সেটি নিয়েই এই কাহিনী। দেবীলালের বাবা জলন্ধরের শহরতলিতে অবস্থিত এক সরকারি স্কুলে উর্দু ও ইতিহাস পড়াতেন। পরিবারের চাহিদা পূরণের জন্যে বাবাকে সংগ্রামরত দেখতে দেখতে দেবীলাল বড়ো হয়েছেন। তাদের সব আত্মীয়স্বজন সম্পন্ন মানুষ এবং তারা তাদেরকে দেখত করুণার দৃষ্টিতে। ফলে তিনি ঈশ্বরের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। কিন্তু ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে পড়াশোনার জন্যে বৃত্তি লাভ করার পর তিনি সর্বশক্তিমানকে তার সন্দেহ থেকে মুক্তি দেন। গ্যাজুয়েশন লাভের পর দেবীলাল পাঞ্জাবের রাজধানী চণ্ডীগড়ে ড্রাফটসম্যানের চাকরি পেলেন মাসিক দু’শ টাকা বেতনে। এক বছর পর তিনি জানকী নামে সাদামাটা চেহারার একটি মেয়েকে বিয়ে করলেন বাবা মার ইচ্ছায়। ধনী পরিবারের একমাত্র কন্যা জানকী সাথে নগদ অর্থসহ অনেক যৌতুক আনেন। নিজের সঞ্চয় এবং যৌতুকের অর্থে চণ্ডীগড়ের পাশেই মোহালিতে জমি কিনে একটি বাড়ি তৈরি করে জানকীকে নিয়ে সেখানে উঠলেন। দেবীলালের স্ত্রী হিসেবে জানকী গর্বিত। স্বামীর প্রয়োজনের ব্যাপারে তিনি সতর্ক ও যত্নশীল। হিন্দু স্ত্রী হিসেবে বেশি কামুকতা প্রদর্শন করেন না, কিন্তু স্বামী সঙ্গমে আগ্রহ দেখালেই বিছানায় শুয়ে সালোয়ার খুলে দুই পা প্রসারিত করে…

যেদিন নেতাকে হত্যা করা হয়

নাগিব মাহফুজ অনুবাদ: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু [নাগিব মাহফুজ: আরবি সাহিত্যে একমাত্র নোবেল বিজয়ী নাগিব মাহফুজ আরব জগতে শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যিক। ১৯১১ সালে তিনি মিশরের রাজধানী কায়রোতে জন্মগ্রহণ করেন। সতেরো বছর বয়স থেকে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। তিনি উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেছেন দর্শন শাস্ত্রে। ১৯৩৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি সরকারি চাকুরিতে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৩৯ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘হিকমাহ খুফু (খুফু’স উইজডম) প্রকাশিত হয়। তাঁর ‘কায়রো ট্রিলজি’ সাহিত্যিক হিসেবে তাঁকে বিশ্বখ্যাতি এনে দেয়। ১৯৮৮ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৬ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।] মুহতাশিমি জায়েদ সামান্য ঘুম হয়েছে। এরপর ভারি চাদরের নিচে উষ্ণতায় ভরা আকাক্সক্ষার মুহূর্ত। জানালা দিয়ে আসা ম্লান আলো রুমের গাঢ় নিষিদ্ধ অন্ধকারকে প্রবলভাবে ভেদ করেছে। হে প্রভু, আমি তোমার আদেশেই নিদ্রা যাই এবং তোমার আদেশেই জাগ্রত হই! তুমিই সবকিছুর মালিক। ফজর নামাজের আজান আমার জন্য একটি নতুন দিন সূচনার ঘোষণা করে। নীরবতার গভীর থেকে ডাকা হয় তোমার নাম। হে প্রভু, আমাকে সাহায্য করো, যাতে আমি আমার উষ্ণ শয্যা থেকে নিজেকে ছিন্ন করতে এবং এই দীর্ঘ শীতের কনকনে শীতলতার মুখোমুখি হতে পারি! আমার প্রিয়জন অন্য বিছানায় গভীর নিদ্রায় ডুবে আছে। অন্ধকারে আস্তে পা ফেলবো যাতে সে জেগে না ওঠে। ওজুর পানি কী ঠাণ্ডা! কিন্তু তোমার অনুগ্রহ থেকে আমি উষ্ণতা আহরণ করেছি। নামাজ হচ্ছে মিলন এবং নির্বাণ। আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা তাঁর সঙ্গে মিলিত হতে ভালোবাসে। যেদিন আমি আল্লাহর নিকটতর হতে না পারি, সেদিন আমার জন্য অনুগ্রহের…

বিচিত্র

যুক্তরাষ্ট্রে এক ধর্মীয় নেতার ২০ স্ত্রী অনলাইন ডেস্ক :যুক্তরাষ্ট্রে একজন তথাকথিত ধর্মীয় নেতার ২০ টিরও বেশি স্ত্রী ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজনের বয়স ছিল ১৮ বছরের কম। আদালতে জমা দেওয়া হলফনামায় কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার (এফবিআই) তথ্যের বরাত দিয়ে এ খবর জানায় বিবিসি। এফবিআই জানিয়েছে, স্যামুয়েল রাপেলি বেটম্যান নামের ওই ব্যক্তি ঈশ্বরের ইচ্ছায় তার স্ত্রীদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছিলেন বলে দাবি করেন। গত সেপ্টেম্বরে ৪৬ বছর বয়সী বেটম্যানের বিরুদ্ধে নথি নষ্ট করা ও ন্যায়বিচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল।  শিশু যৌন কার্যকলাপের জন্য এফবিআই তাকে তদন্ত করছে। আদালতে জমা দেওয়া এফবিআইয়ের হলফনামায় এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। বেটম্যান জেসাস ক্রাইস্ট অফ ল্যাটার-ডে সেন্টস (এফএলডিএস চার্চ) এর মৌলবাদী চার্চের সদস্য। এটি মরমন সম্প্রদায়ের একটি শাখা। পরে বেটম্যান নিজেই আলাদাভাবে একটি অনুসরণ তৈরি করতে শুরু করেন। এফবিআই জানিয়েছে, পুরুষ অনুসারীরা বেটম্যানকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন। এমনকি তারা তাদের স্ত্রী ও কন্যাদেরও তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়। বেটম্যান তার অনুসারীদের কাউকে শাস্তি দিতেন যদি তারা নবীর মতে তাকে উপাসনা না করে। ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সী তিনটি মেয়েকে একটি ট্রেলার ট্রাকে নিয়ে যাওয়ার সময় গত আগস্টে বেটম্যানকে গ্রেপ্তার করা হয়। মুচলেকায় জামিন পান তিনি। কিন্তু পরবর্তীতে নথি নষ্ট ও ন্যায়বিচারে বাধার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এই বছরের শুরুতে অ্যারিজোনা চাইল্ড সার্ভিসেস বেটম্যান থেকে নয়টি মেয়েকে উদ্ধার করেছিল। পরে তাদের গ্রুপ হোমে (নিঃস্ব মেয়েদের জন্য বিশেষ আবাসন) রাখা হয়েছিল। কিন্তু নভেম্বরে তাদের আটজন সেখান থেকে পালিয়ে…

৭২-এর সংবিধান: একটি পর্যালোচনা

শহীদুল্লাহ ফরায়জী সংবিধান প্রতিষ্ঠার পর আপনা আপনি গণতন্ত্র বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না। শাসক দলের উচ্চতম নৈতিকতাবোধ, গণতন্ত্রের প্রতি নিঃস্বার্থ আনুগত্য এবং ত্যাগের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের পথে আগানো, সকল ধরনের দমনমূলক পথ পরিহার করা, সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক পন্থায় রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা, শক্তিশালী বিরোধী দল গড়ে তুলতে আইনগত ও নৈতিক সহায়তা প্রদান করা, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা এবং সম্মোহনী শক্তির অধিকারী নেতৃত্বকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান না দেয়ার উপর নির্ভর করে সংবিধানের অপরিহার্যতা ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর গণপরিষদে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’ গৃহীত হয়। এবার এ দিবস ৫০ বছর পর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলো। ‘সংবিধান দিবস’ উপলক্ষে ৭২ এর সংবিধানের ইতিহাস ও সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা। ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল, ঐতিহাসিক মুজিবনগরে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ গণপরিষদ গঠিত হয়।গণপরিষদের কাজ ছিল দুটি:১) জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সময় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়ন ও এর ভিত্তিতে সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা এবং২) বিজয় অর্জিত হওয়ার পর বাংলার মানুষের রাজনৈতিক অধিকারের দলিল হিসেবে সংবিধান প্রণয়ন করা।১০ই এপ্রিল’৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটিই (Proclamation of Independence) বাংলাদেশের ‘অন্তবর্তীকালীন’ সংবিধান। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ২২শে মার্চ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ’ জারি করেন, ১) ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর ও পরবর্তী বিভিন্ন তারিখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আসনগুলোতে বিজয়ী বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘গণপরিষদ’ গঠিত হবে।২) পরিষদ প্রজাতন্ত্রের জন্য একটি ‘সংবিধান’ প্রণয়ন করবে।এভাবেই শুরু হয় প্রজাতন্ত্রের সংবিধান প্রণয়ন…

মোগলদের ভোজন বিলাস ও খান-ই-সামান

মাহমুদুর রহমান খানসামা একটি খুবই পরিচিত শব্দ। সাহিত্য থেকে শুরু করে নানা উৎসে শব্দটি পাওয়া যায়। খানসামা মূলত একজন পুরুষ রাঁধুনিকে বোঝায়। তবে তার কাজ কেবল পাকশালেই শেষ হয় না। তিনি ঘরদোরের দায়িত্বেও থাকতে পারেন। বাবুর্চি ও খানসামার মধ্যে এখানেই পার্থক্যটা তৈরি হয়। বাবুর্চির কাজ রেসিপি অনুসারে খাদ্য তৈরি করা আর খানসামা সেসবের পরিকল্পনা থেকে আরম্ভ করে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করেন। খানসামার দায়িত্ব পাকশাল থেকে খাবার ঘরেও বিস্তৃত। খানসামা পদটি যখন সৃষ্টি হয় তখন ডাইনিং বা টেবল ম্যানার এখনকার মতো ছিল না, তবে ছিল নিজস্ব রীতি। সে রীতিতে খাবার পরিবেশনে খানসামার দায়িত্ব থাকত। তার তত্ত্বাবধানে খাবার সময় সবকিছু পরিচালিত হতো। খানসামা শব্দটি উর্দু। একে বিশ্লেষণ করলে দুটি অংশ পাওয়া যায়—খান ও সামান। খানসামা আসলে খান-ই-সামান। এখানে খান অর্থটি মালিক বা তত্ত্বাবধায়ক এবং সামান বলতে গৃহস্থালি জিনিসপত্রকে বোঝানো হয়। মোগল শাসনামলে নানা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের এ ধারার নামকরণ করা হতো। মীর-ই-বহর ছিলেন নৌবাহিনীর প্রধান, তেমনি খান-ই-সামান ছিলেন প্রয়োজনীয় নানা পণ্যের রক্ষণাবেক্ষণকারী। সেখান থেকেই ক্রমে বিবর্তিত হয়ে খানসামা শব্দটি এসেছে। ধীরে ধীরে গৃহস্থালির সঙ্গে রসুই যুক্ত হয়ে যায় এবং খানসামা রসুইয়ের সঙ্গে মূলধারায় যুক্ত হয়ে পড়েন। তার দায়িত্ব হয় রসুইঘরের দেখভাল। সেখান থেকে ক্রমে আরো কিছু পরিবর্তন আসে। ধনী পরিবারের তিনি হয়ে ওঠেন তত্ত্বাবধায়ক ও রক্ষণাবেক্ষণকারী। আজকের দিনের কেয়ারটেকার বললে ভুল হয়, খানসামাকে আসলে বলা যায় ‘বাটলার’। কোনো কোনো সূত্রে খানসামাকে প্রধান রাঁধুনি বলে উল্লেখ করা হয়। আদতে ব্যাপারটি পুরোপুরি তা নয়। মোগল শাসনামলে মোগল প্রাসাদের নিয়ম অনুসারে শাহি খানসামা, শাহি বাবুর্চির সঙ্গে মিলে নির্দিষ্ট দিন বা কয়েকদিনের রান্নার আয়োজন সম্পর্কে পরিকল্পনা করতেন। এই পরিকল্পনায় তার অন্তর্ভুক্তি ছিল অবশ্যম্ভাবী ও অবশ্যকর্তব্য। কেননা রসুইসহ অন্যান্য সব ‘সামান’ থাকত তারই অধীনে। সুতরাং শাহি বাবুর্চি তার কাছ থেকেই ‘রসদ’ সংগ্রহ করতেন। রসদের পরিমাণ ও প্রয়োজন সম্পর্কে তাদের যৌথ প্রয়াস ব্যতিরেকে এ কাজ সম্ভব ছিল না। বিশেষত মোগল হারেমে বাদশাহসহ অন্যদের জন্য প্রতিদিন প্রচুর খাদ্য রান্নার প্রয়োজন হতো। এ ছিল এক স্বতন্ত্র বিস্তৃত কর্মযজ্ঞ। তবে খানসামাও রন্ধন বিষয়ে জ্ঞান রাখতেন। সে হিসেবে কখনো কখনো প্রধান বাবুর্চিও খানসামা হতেন। উল্টো করে বলা যায়, খানসামাই হতেন প্রধান বাবুর্চি। মোগল আমলে বাদশাহের খিদমতগারদের মধ্যে অনেক ভাগ ছিল। প্রত্যেক আলাদা কাজের জন্য ছিলেন একজন করে আলাদ্য খিদমতগার। পানিবাহক, কলমবাহকের জন্যও ছিল আলাদা আলাদা পদ। খানসামার বর্তমান যে পরিচয় বা পরিচিতি সেকালে বিষয়টি এমন ছিল না। হারেমের খাবার বা বাদশাহের জন্য তৈরি হওয়া খাবারের সঙ্গে কেবল বাবুর্চি নন, যুক্ত থাকতেন শাহি হেকিম। তিনি যুক্ত থাকতেন দুটো কারণে। প্রথমত বাদশাহের স্বাস্থ্যগত দিকটি লক্ষ রাখতেন। কোন ধরনের খাদ্য তার জন্য ক্ষতিকর তা লক্ষ রাখা ছিল হেকিম সাহেবের একটি অন্যতম দায়িত্ব। দ্বিতীয় কারণটি ছিল খাদ্যে কোনো প্রকার বিষ প্রবেশ করানো হলো কিনা তা দেখা। এ কাজটি মূলত খাদ্য পরিবেশনের পর হতো। মোগল আমলে খাদ্য কেবল প্রস্তুত করলেই হতো না। সেটি পরিবেশনের ছিল আলাদা রীতি। খানসামা ও বাবুর্চি যেমন শুরু থেকে যুক্ত হতেন, পরিবেশনের সময় বাদশাহের সামনে তাদের উপস্থিতি ছিল বাধ্যতামূলক। বাদশাহের খাবার নিরাপদ কিনা তা দেখা নয়, বরং প্রমাণ করা ছিল এদের দায়িত্ব। মূলত বাদশাহকে পরিবেশিত প্রতিটি পদ প্রধান বাবুর্চি খোদ সামান্য পরিমাণে খেয়ে প্রমাণ দিতেন যে ওই পদগুলো সব ধরনের বিষক্রিয়ামুক্ত। এরপরই বাদশাহ খাবার গ্রহণ করতেন। পরিবেশনের সময় খানসামার দায়িত্ব হতো পরিবেশনার সৌন্দর্য রক্ষা এবং যাবতীয় বিষয়াদি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে যাওয়া। খানসামারা ছিলেন সবাই মুসলিম। তাদের কেউ কেউ শেখ আর কেউ পাঠান গোত্রের ছিলেন। পরবর্তী সময়ে অনেক পার্সিও খানসামা হয়েছেন। হাওয়ার্ড স্টকলারের মতে, খানসামারা ছিলেন ‘বুদ্ধিমান, তাদের ব্যবহার সুন্দর ও তারা অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’। এরা লিনেনের সাদা পোশাক পরতেন, মাথায় বাঁধতেন পাগড়ি। বাকল্যান্ড তার মেন–সার্ভেন্টস ইন ইন্ডিয়া প্রবন্ধে লিখেছেন ‘সে একটি বৃহৎ পাগড়ি বাঁধে এবং তার কোমরে থাকে মসলিনের একটি কাপড়।’ বাকল্যান্ড বা তার মতো সিভিল সার্ভেন্টরা খানসামা সম্পর্কে লিখেছেন কিন্তু তারও আগে লিখেছেন ফ্রান্সিস বার্নিয়েরের মতো পর্যটক। মোগল ভারতে আসা এ ইউরোপীয় পর্যটকের দৃষ্টিতে খানসামারা ছিলেন ইউরোপের ভিত্তিতে প্রাচ্যের গ্র্যান্ড চ্যাম্বারলেইন। তারা ছিলেন গৃহস্থালি কাজ ও শৃঙ্খলা দেখভালের সার্বিক দায়িত্বে। মোগল আমলের পর নবাবি আমলে খানসামারা অপরিহার্য হয়ে ওঠেন। অনেকে নিজ দায়িত্ব পালন করার মধ্য দিয়ে পদোন্নতি লাভ করে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদেও অধিষ্ঠিত হয়েছেন। একটি উদাহরণ পাওয়া যায় অযোধ্যায়। সেখানে নবাব সাদাত আলী খানের পুত্র গাজিউদ্দিন হায়দার শাহ ১৮১৪ সালে নবাবির দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি নবাব হলে পিতার খানসামা আগা মীরকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করেন। লন্ডনের কিংস কলেজের ইংরেজির প্রফেসর জাহানারা কবির বলেন, ‘খানসামারা ছিলেন সামন্ততান্ত্রিক ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষত যেসব ধনী ও অভিজাত গৃহে গার্হস্থ্য একটি বিস্তৃত বিষয় ছিল। ভারতে ব্রিটিশরা এই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার সার্বিক চেষ্টা করেন। মধ্যযুগীয় এ ব্যবস্থা আরো শাণিত করে এমন একটা পর্যায়ে নেয়া হয় যাকে আমি ওরিয়েন্টাল গথিক আড়ম্বর বলে অভিহিত করি।’ তার মতে দরবার, ‘হাজিরা, নজরানা ও অন্যান্য রীতিনীতির মতো খানসামা-সংস্কৃতিও ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে।’ খানসামা পদ ও তার কর্মের উত্পত্তি মোগল আমলে হলেও এর সঠিক পরিচয় বা বর্তমান পরিচিতি তৈরি হয় ব্রিটিশ আমলে। এখানে অনেকে ব্রিটিশ শাসনের দৃষ্টিভঙ্গির কিছু বিষয় তুলে ধরেন। যেমন আকবর আহমেদ মনে করেন মুসলিমদের খলিফা ও খানসামা শব্দটিকে ব্রিটিশরা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছে। ২০০২ সালে প্রকাশিত Discovering Islam: Making sense of Muslim history and Society বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘খলিফা—মুসলিম শাসনের শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও খানসামা—মোগল ভারতের অন্যতম শীর্ষ রাজনৈতিক পদকে ব্রিটিশ শাসনকাঠামোতে সর্বনিম্ন পদে নিয়ে আসা হয়: নাপিত, কনিষ্ঠ মাঠকর্মী কেরানিরা হয়ে গেল খলিফা আর রাঁধুনিদের বলা হলো খানসামা।’ এখান থেকে দুটো বিষয় প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত ব্রিটিশরা এ দুটো শব্দ ব্যবহার করেছিল ভুলভাবে। দ্বিতীয়ত, খানসামার উদ্ভব মোগল আমলেই এবং সেখানে তার দায়িত্ব ‘রান্না করা’ ছিল না। নবাব গাজিউদ্দিনের উদাহরণ থেকেই বোঝা যায় খানসামারা রাজনৈতিক দায়িত্বের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। আগা মীর কেবল বাবুর্চি হলে তাকে প্রধানমন্ত্রী করা হতো না। কিন্তু ব্রিটিশদের বিবরণ থেকে তাদের পরিচয় পরিবর্তিত হতে শুরু করে। বাবুর্চিরা খানসামা হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করেন। অন্যদিকে বলা যায়, মোগল কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার পর তাদের কাজের ধারা বদলে যায় এবং খানসামারা বাবুর্চির কাজ করতে বাধ্য হন। তবে মোগল আমলের অব্যবহিত পরে অর্থাৎ নবাবি আমলে তাদের সম্মানের কমতি হয়নি। খানসামারা গার্হস্থ্য দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি উদ্ভাবনের দিকে নজর রাখতেন। বাবুর্চি হন বা না হন তারা স্বাদু পদের মধ্যে নতুন কিছু না কিছু আনার চেষ্টা করতেন। নবাবি আমলের খানসামাদের ক্ষেত্রে নতুন নতুন ‘ডিশ’ উদ্ভাবনের কৃতিত্বের কথা শোনা যায়। কিছু কিছু তারা নিজেরা তৈরি করতেন আর কিছু কিছু তৈরি হতো তাদের চাকরিদাতার মর্জিমাফিক। শিক কাবাবের নাম আমরা কেবল জানিই না, অনেকের রীতিমতো প্রিয় খাবার এটি। শিক ব্যবহার করে এ কাবাব বানানোর কারণে এহেন নামকরণ করা হয়েছে। কথিত আছে নবাব সিরাজদ্দৌলার জন্য শেখ শাহনেওয়াজ কাবাবটি তৈরি করেছিলেন। বলা বাহুল্য, শেখ শাহনেওয়াজ ছিলেন নবাব সিরাজদ্দৌলার খানসামা। ঔপনিবেশিক তথা কোম্পানি ও ব্রিটিশরাজের সময়েও খানসামারা ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ, তবে তাদের কাজের ক্ষেত্র বদলে গিয়েছিল। সে সময়কার খানসামাদের সম্পর্কে এক ইংরেজ চিত্রকর লিখেছিলেন, ‘Khansamanship like Malvoilo’s greatness, commeth in three wise: some are born Khansamans–some achieve Khansamanship and others have Khansamanship thrust upon them.’ খানসামার আরো একটি পরিচয় রয়েছে। বাংলা উপন্যাসে ‘বাজার সরকার’ কথাটি বেশ পরিচিত। এ ব্যক্তির কাজ মূলত বাড়ি কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় পণ্য ইত্যাদির তালিকা তৈরি ও খরচের একটি অনুমান করা। অনেকটাই ম্যানেজারিয়াল। মূলত মোগল আমল থেকে নবাবি আমল অবধি তারা এ কাজই করতেন। তাদের সব দায়িত্বের মূলে ছিল ব্যবস্থাপনা। খানসামা কারা হতেন সেটিও একটি আলোচনার বিষয়। বিনয় ঘোষ তার কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত বইয়ের প্রথম খণ্ডে লিখেছেন, ‘খানসামাগিরি তিন উপায়ে করার সৌভাগ্য হয়। কেউ খানসামা হয়ে জন্মায়, কেউ খানসামাগিরির যোগ্যতা অর্জন করে, আবার কারো স্কন্ধে সেটা চাপিয়ে দেয়া হয়। মোট কথা, খানসামাগিরি রীতিমতো একটা লোভনীয় পেশা, যা ইংরেজ আমলে মুসলমানদেরই একচেটে ছিল। খানসামারাই ছিল ইংরেজ নবাবদের ঘরের গিন্নি। শুধু রান্নাঘরের নয়, ভাঁড়ারের চাবিকাঠিও তাদের হাতে থাকত। বাড়ির অন্যান্য চাকরবাকর সকলে খানসামার হুকুমের অধীন থাকত এবং তার মন জুগিয়ে চলত। খিদমতগার আর খানসামার তফাত আছে, পদমর্যাদার তফাত। খিদমতগার খানা টেবিলের চাকর, সাহেবদের টেবিলে খানা “সার্ভ” করাই তার প্রধান কাজ। কাজ করে সাহেব-প্রভুকে খুশি করতে পরলে খিদমতগিরি থেকে খানসামাগিরিতে পদোন্নতি হত। ঘরের ব্যাপারে খানসামা হল মুখ্যমন্ত্রী, আর তার ডেপুটি হল খিদমতগার। তারপর অবশ্য মন্ত্রী মণ্ডলীর মধ্যে পদের তারতম্য আছে গুরুত্ব হিসেবে। খিদমতগারের পরেই বাবুর্চি। মুসলমান ছাড়াও মগ, পর্তুগিজ ও কেওড়া জাতির হিন্দুরা বাবুর্চির কাজ করত।’ খানসামার ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে সেখানে হিন্দুদের নাম নেই। মুসলিমরাই হতেন খানসামা। এর একটি কারণ হতে পারে যে হিন্দুরা বাবুর্চি হতো না। স্টকলার জানিয়েছেন, মগ বাবুর্চিরা কোনো ধরনের কাজে আপত্তি করত না। মূলত হিন্দুরা গরু তো দূর মুরগিও কাটতে চাইত না। সেক্ষেত্রে মুসলিমদের সমস্যা ছিল শুয়োরে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় যে খানসামাদের মধ্যে মুসলমানেদর প্রাধান্য কীভাবে হয়? এর উত্তরও বিনয় ঘোষের লেখার মধ্যেই রয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, খানসামা হওয়ার একটি উপায় হলো ‘কেউ খানসামা হয়ে জন্মায়।’ কথাটির অর্থ হলো এটি পারিবারিক পেশা। মোগল ও নবাবি আমলে মুসলিমরাই খানসামার কাজ করতেন। ফলে পরবর্তী সময়ে তাদের পরিবারের সদস্যরাও এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করে। তাই ইতিহাসে খানসামাদের লক্ষ করলে তাদের মধ্যে মুসলিমদের নামই বেশি পাওয়া যায়। সেকালে মোগল বাদশাহ ও তার পরিবারের খাবার পরিবেশনে খানসামাদের ছিল গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। মোগল মিনিয়েচার ও অন্যান্য চিত্রকর্মে দেখা যায় বাদশাহর দস্তরখানের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন খানসামা। ১৫৯০ সালের একটি মোগল চিত্রকর্মে বাবরের ভোজের আয়োজনে খানসামাদের উপস্থিতি স্পষ্ট। নবাবি আমলেও নবাবের রসুইয়ের পাশাপাশি ভাণ্ডারের দেখভাল করতেন খানসামারা। মোগল ও নবাবি আমলের পর তাদের সেই দায়িত্বভার কমে যায়। তারা পরিণত হন কোম্পানি ও ব্রিটিশ রাজের কর্মচারীতে। খানসামাদের গার্হস্থ্য দায়িত্ব আসলে সে সময় থেকেই শুরু হয়। কেননা ভারতে ব্রিটিশরা যখন পরিবার নিয়ে থাকতে শুরু করেন তখন প্রয়োজন হয়েছিল দক্ষ কর্মী, যে গৃহস্থালি কর্মে দক্ষ। মেমসাহেবদের পক্ষে তো পুরো ঘর সামলানো সম্ভব নয়। তবে তারা সে সময়েও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। বিনয় ঘোষের ভাষায়, ‘নবাবি আমলের হারাম বা দরবারি পরিবেশে খানসামা-খিদমতগাররা কী অভিনয় করত, তা নিয়ে কোনো রঙিন রূপকথা রচনা করতে চাই না। নবাবি আমল তখন অস্তাচলে, মুসলমান নবাবি আমল। তার সঙ্গে ঢাকাই ও মুর্শিদাবাদি কালচারও অস্ত যাচ্ছে। কিন্তু তার অস্তগামী বর্ণচ্ছটা নতুন ইংরেজ-নবাবি আমলের কলকাতা কালচারের ওপর প্রতিফলিত হচ্ছে। খানসামারা আর মুর্শিদাবাদের বাবুর্চিখানার নায়ক নয়, কলকাতার ইংরেজদের কিচেনের নায়ক। ইংরেজ নবাবদের এই আদি যুগটাকে প্রায় খানসামাদের যুগ বলা চলে।’

পানি-অস্তিত্বের এক দৈব উপাদান

আবদুল আউয়াল মিন্টু দৈব, অদ্ভুত ও বিচিত্রতা হলো পানির অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের গ্রহের বিবর্তনের মৌলিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। পানির ভৌত এবং রাসায়নিক প্রকৃতি, আকৃতি, আচরণ ও চরিত্র এবং এর বহুমুখী ব্যবহার আমাদের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য। তাই পানি, প্রাণের জন্ম ও বিকাশ এবং বাস্তুতন্ত্রের (Ecosystems) জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ। অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের কারণেই প্রাণের সাথে পানির একটি মিথোজীবী (Symbiotic) সম্পর্ক আছে। প্রতিটি জীবের প্রতিটি জীবন্ত কোষের (Cell) অন্ত:স্থলের কাজ থেকে শুরু করে, গোটা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র সৃষ্টি ও টিকিয়ে রাখা, এ সবই পানির ওপর নির্ভরশীল। জীবনের অস্তিত্ব রক্ষার চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, মহাবিশ্বের সাধারণ দু’টি উপাদান যেমন; হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মিলে পানির সৃষ্টি। পানি এক অনন্য, অসাধারণ ও নিখুঁত পদার্থ, যা আমাদের জীবনকে টিকিয়ে রাখে। পানির বৈশিষ্ট্যপানির বৈশিষ্ট্য একেবারেই অনন্য। এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্য অন্য সব পদার্থ থেকে একেবারেই আলাদা। এই বৈশিষ্ট্যগুলো পানিকে তরল অবস্থা থেকে বরফের কঠিন অবস্থা; বরফ থেকে তরলে পরিণত; আবার তরল থেকে বাষ্পে পরিণত করতে পারে। তারপর আবার বাষ্প থেকে তরল অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। আর এই তরল পানি হলো; আমাদের পৃথিবীর সব জীবের প্রাণের কেন্দ্রবিন্দু। মূলত এই “একক, অসাধারণ ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের শক্তিগুণে” একদিকে যেমন পানির প্রতিটি অণু (Molecule) এককভাবে কাজ করতে পারে, আবার একইসাথে অন্য পদার্থের অণুর সাথে ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় লিপ্ত হয়ে একত্রে কাজ করার ক্ষমতা রাখে। পানির এই অনন্য বৈশিষ্ট্য অন্য যেকোনো পদার্থ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বতন্ত্র।…

মুমিনের নিদ্রা

মুহাম্মাদ আনওয়ার হুসাইন ঘুম আল্লাহতায়ালার অনেক বড় নেয়ামত। বান্দার প্রতি আল্লাহতায়ালার এক বিশেষ অনুগ্রহ ও দান। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য ঘুমের বিকল্প নেই। শারীরিক-মানসিক ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করতে এই পৃথিবীতে আল্লাহতায়ালা ঘুমকে অন্যতম প্রধান মাধ্যম বানিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন : আর আমি তোমাদের নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী। রাত্রিকে করেছি আবরণ। (সূরা নাবা : ৯-১০)। অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে : তিনিই তোমাদের জন্য রাত্রিকে করেছেন আবরণ, নিদ্রাকে বিশ্রাম এবং দিনকে করেছেন বাইরে গমনের জন্যে। (সূরা ফুরকান : ৪৭)। দিনভর ক্লান্তিকর চলাফেরার পর মানুষ যখন নিস্তেজ হয়ে পড়ে; কর্মক্ষম মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে, শক্তিমান মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে, সে সময় এ নেয়ামতই হয়ে ওঠে তার একমাত্র অবলম্বন, যার মাধ্যমে সে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করে। ফিরে পায় পরবর্তী দিবসের জন্যে নতুন প্রাণশক্তি ও নবতর উদ্যম।কোনো ব্যক্তি যত প্রখর মেধারই অধিকারী হোক, যত শক্তিশালীই হোক শুধু দু’একটি রাত বিনিদ্র কাটলে বা নিয়মতান্ত্রিক ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে মেধাশক্তি অকেজো হয়ে যায়। আচার-আচরণে, চলাফেরায় এবং কথাবার্তা ও কাজকর্মে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। বস্তুত এ নিআমতের কদর সেই সর্বাধিক বুঝতে পেরেছে, যার রাত কাটে নিদ্রাহীন; বিভিন্ন ব্যবস্থাপত্র গ্রহণের পরও আরামের বিছানায় এপাশওপাশ করে যার রাত ভোর হয়। আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, আল্লাহতায়ালার কী মহান নেয়ামত নিয়মিত ভোগ করে যাচ্ছি? অবিরত তাঁর কত বড় অনুগ্রহ লাভ করে যাচ্ছি! কুরআন মাজীদে ঘুমকে বান্দার প্রতি আল্লাহতায়ালার রহমতের বহিঃপ্রকাশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন :…

আমেরিকান তরুণদের আত্মহত্যার প্রবণতা

বিল ব্রাইসন ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের ‘টিনএজার’ বলা হয়। ১৯৫০ এর দশকে বেশ জনপ্রিয় হয় ‘টিনএজার’ শব্দটি। এই বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুতর পরিবর্তন ঘটে ও প্রভাবিত হয়। বিল ব্রাইসন তার স্মৃতিকথা ‘দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অফ দ্য থান্ডারবোল্ট কিড’ এ লিখেছেন, এই বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীরা বাড়ির বাইরে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়ে। মাতাল হওয়া, গর্ভধারণ করা বা গাড়ি দুর্ঘটনা এসব আমেরিকান নাগরিকদের টিনএজারদের নিয়ে মূল আতঙ্কের বিষয়। আজকাল, আমেরিকান কিশোর-কিশোরীরা যে ঝুঁকির সম্মুখীন হয় তা ভেতর থেকে আসে। ছেলেদের এখন দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার চেয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি। অপরিকল্পিত গর্ভাবস্থার মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে মেয়েদের আত্মহত্যার প্রবণতা প্রায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। দেশটিতে দুর্ঘটনার পর এখন ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের মৃত্যু হয় আত্মহত্যা করার কারণে। অর্থাৎ মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা। কিশোর-কিশোরীদের মানসিক সমস্যা তরুণ বয়সে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধিতে প্রবল ভূমিকা রাখে। করোনা মহামারির আগে কম থাকলেও দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এই প্রবণতা। ২০২১ সালে প্রায় অর্ধেক আমেরিকান মাধ্যমিক পড়ুয়া বলে তারা বিগত বছরে ক্রমাগত দুঃখ ও হতাশা অনুভব করেছে, যার পরিমাণ ২০০৯ সালের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেড়েছে। পাঁচজনের মধ্যে একজনের আত্মহত্যা করার কথা চিন্তা করে এবং এই হার প্রায় ১৪ শতাংশ। অন্যদিকে, ৬ শতাংশের চেয়ে ৯ শতাংশের জীবন শেষ করে ফেলার প্রবণতা বেড়েছে। তবে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের জন্য এই প্রবণতা অভূতপূর্ব ঘটনা নয়। তবে দশ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের জন্য আত্মহত্যার প্রবণতার হার আগের…

কিংবদন্তি তুর্কি স্থপতি মিমার সিনান

জুইফা পারভীন (কিংবদন্তি তূল্য তুর্কি স্থপতি মিমার সিনান সাড়ে তিনশ’র অধিক ভবনের নকশা তৈরি ও সেসব নকশা অনুসরণে স্থাপনা নির্মাণ তদারকি করেছেন। তাঁর পুরো নাম কোকা মিমার সিনান আগা। তিনি ১৪৮৯ অথবা ১৪৯০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫৮৮ সালের ১৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। অটোম্যান সুলতান সুলায়মানের শাসনামলে তিনি তাঁর অধিকাংশ স্থাপত্যকর্মের নকশা তৈরি করেন। এর মধ্যে রয়েছে ৮২টি গ্র্যান্ড মসজিদ, ৫২টি ছোট মসজিদ, ৫৫টি মাদ্রাসা, ৭টি দারুল কুররা বা গবেষণা কেন্দ্র, ২০টি মাযার, ১৭টি ইমারেত বা উসমানীয় লঙ্গরখানা, ৩টি দারুস শিফা বা হাসপাতাল, ৬টি জলপথ, ১০টি ব্রিজ, ২০টি কারাভানসেরাই বা সরাইখানা, ৩৬টি প্রাসাদ, ৮টি ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার, ৪৮টি গোসলখানা বা হাম্মাম।) অটোমান বা উসমানীয় স্থাপত্যশিল্পের দুনিয়ায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম হল মিমার সিনান যাকে অনেকেই ‘স্থপতি সিনান’ বলে চেনেন। স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে উসমানীয় সুলতানদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিভা তাঁর সুনামকে সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিল। সিনানের ৪৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করছেন তুরস্কসহ আরও বহু দেশের আধুনিক স্থপতি ও ইতিহাসবিদরা। জানা যায়, ১৪৯০ খ্রিস্টাধে তুরস্কের কায়সেরি প্রদেশের আগিরনাস গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সিনান। এরপর ইয়াভুজ সুলতান সেলিমের শাসনামলে তাঁকে ‘দেভশিরমে’ বা সুলতানের সেবক হিসাবে ইস্তান্বুলে নিয়ে আসা হয়। সুলতান ইয়াভুজের সঙ্গে মিশর অভিযানে গিয়ে সিনান স্থাপত্য ও শহরের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, সেলজুক ও সাফাবিদ আমলের স্থাপনা ও ভবনগুলি পরীক্ষা করে দেখে তাঁর জ্ঞানের বহর বাড়তে থাকে। ১৫২০ সালে ‘সুলেইমান…