মুমিনের নিদ্রা

মুহাম্মাদ আনওয়ার হুসাইন

ঘুম আল্লাহতায়ালার অনেক বড় নেয়ামত। বান্দার প্রতি আল্লাহতায়ালার এক বিশেষ অনুগ্রহ ও দান। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য ঘুমের বিকল্প নেই। শারীরিক-মানসিক ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করতে এই পৃথিবীতে আল্লাহতায়ালা ঘুমকে অন্যতম প্রধান মাধ্যম বানিয়েছেন।

আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন : আর আমি তোমাদের নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী। রাত্রিকে করেছি আবরণ। (সূরা নাবা : ৯-১০)। অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে : তিনিই তোমাদের জন্য রাত্রিকে করেছেন আবরণ, নিদ্রাকে বিশ্রাম এবং দিনকে করেছেন বাইরে গমনের জন্যে। (সূরা ফুরকান : ৪৭)।

দিনভর ক্লান্তিকর চলাফেরার পর মানুষ যখন নিস্তেজ হয়ে পড়ে; কর্মক্ষম মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে, শক্তিমান মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে, সে সময় এ নেয়ামতই হয়ে ওঠে তার একমাত্র অবলম্বন, যার মাধ্যমে সে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করে। ফিরে পায় পরবর্তী দিবসের জন্যে নতুন প্রাণশক্তি ও নবতর উদ্যম।
কোনো ব্যক্তি যত প্রখর মেধারই অধিকারী হোক, যত শক্তিশালীই হোক শুধু দু’একটি রাত বিনিদ্র কাটলে বা নিয়মতান্ত্রিক ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে মেধাশক্তি অকেজো হয়ে যায়। আচার-আচরণে, চলাফেরায় এবং কথাবার্তা ও কাজকর্মে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। বস্তুত এ নিআমতের কদর সেই সর্বাধিক বুঝতে পেরেছে, যার রাত কাটে নিদ্রাহীন; বিভিন্ন ব্যবস্থাপত্র গ্রহণের পরও আরামের বিছানায় এপাশওপাশ করে যার রাত ভোর হয়।

আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, আল্লাহতায়ালার কী মহান নেয়ামত নিয়মিত ভোগ করে যাচ্ছি? অবিরত তাঁর কত বড় অনুগ্রহ লাভ করে যাচ্ছি! কুরআন মাজীদে ঘুমকে বান্দার প্রতি আল্লাহতায়ালার রহমতের বহিঃপ্রকাশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন : তিনিই স্বীয় রহমতে তোমাদের জন্যে রাত ও দিন করেছেন, যাতে তোমরা তাতে (রাতে) বিশ্রাম গ্রহণ কর ও (দিনে) তার অনুগ্রহ অন্বেষণ কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সূরা ক্বাসাস : ৭৩)।

সূরা রূমে আল্লাহতায়ালা রাতের ঘুমকে তাঁর নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন : আর তাঁর নিদর্শনাবলীর একটি হল রাতে ও দিনের নিদ্রা এবং তাঁর কৃপা অন্বেষণ। নিশ্চয় এতে মনোযোগী সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। (সূরা রূম : ২৩)।
কি সেই নিদর্শন? কি সেই শিক্ষা? বস্তুত চিন্তাশীল ব্যক্তি সহজেই তা উপলব্ধি করতে পারে। খুঁজে পায় আল্লাহতায়ালার কুদরতের এক অবাক নিদর্শন। কীভাবে তিনি মুখরিত ও কোলাহলময় বিশাল এক অশান্ত পৃথিবীকে সময়ের সামান্য পরিবর্তনে নিস্তব্ধ-নীরব করে দেন। প্রাণবন্ত মানুষকে নিষ্প্রাণ ও নির্জীবের মতো করে দেন। হাদীস শরীফে ঘুমকে মৃত্যুতুল্য গণ্য করা হয়েছে। ঘুমের বড় শিক্ষা হল, ঘুম আমাদেরকে প্রতিদিন মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় আমরা একদিন মৃত্যুবরণ করব এবং মাওলায়ে পাকের সম্মুখে উপস্থিত হব। হিসাব-নিকাশের সম্মুখীন হব।

আমাদের কর্তব্য হলো আল্লাহতায়ালার দেয়া এ নেয়ামতকে যথাযথ উপলব্ধি করা। বস্তুবাদীদের মতো এটাকে গতানুগতিক জীবনধারা বা নিয়ম না ভাবা; বরং ঘুম মুমিনের জীবনের একটি আমল। গুরুত্বপূর্ণ আমল। জীবনের প্রতিটি ক্ষণই মুমিনের আমলের অংশ। মুমিনের সবকিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য নিবেদিত, উৎসর্গিত। তার জাগ্রত থাকাও আল্লাহর জন্য, আবার ঘুমও তাঁর জন্য।

হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা.) একবার আবু মূসা আশআরী (রা.) কে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে আবদুল্লাহ! আপনি কীভাবে কোরআন তিলাওয়াত করেন? তিনি বললেন, আমি (দিবা-রাত্রি) কিছুক্ষণ পরপর কিছু অংশ করে তিলাওয়াত করতে থাকি। তিনি বললেন, আর আপনি কীভাবে তিলাওয়াত করেন হে মুয়ায? উত্তরে তিনি বললেন, আমি রাতের প্রথমাংশে শুয়ে পড়ি এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঘুমিয়ে উঠে পড়ি। এরপর আল্লাহ আমাকে যতটুকু তওফীক দান করেন তিলাওয়াত করতে থাকি। এতে আমি আমার নিদ্রার অংশকেও সাওয়াবের বিষয় বলে মনে করি, যেমন আমার দাঁড়িয়ে তিলাওয়াতকেও সওয়াবের বিষয় বলে মনে করি। ঘুমের সুনান ও আদাব এবং নিয়তের প্রতি লক্ষ রাখা হলে ঘুমের প্রতিটি মুহূর্তই বান্দার আমলনামায় সওয়াব হিসাবে জমা হতে থাকে।

সুন্নাহর শিক্ষা হলো এশার নামাজের পর অহেতুক গল্প-গুজব ও আলাপচারিতায় লিপ্ত না হয়ে দ্রুত শুয়ে পড়া। যেন ফজরের নামাজ যথাসময়ে জামাতের সাথে আদায় করা যায়। আরো একটু আগে ওঠা সম্ভব হলে দু-চার রাকাত তাহাজ্জুদও যেন পড়া যায়।

হযরত আবু বারযা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইশার পূর্বে নিদ্রা যাওয়া এবং ইশার পর অহেতুক আলাপচারিতায় লিপ্ত হওয়া অপছন্দ করতেন। (সহীহ বুখারি : ৫৪১)। সুনানে ইবনে মাজাহয় আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইশার পূর্বে ঘুমাতেন না এবং ইশার পর আলাপচারিতায় লিপ্ত হতেন না। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৭০২)।

আলেমগণ বলেন, এশার পর বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কিংবা দ্বীনী বা দুনিয়াবী কোনো কল্যাণকর বিষয় ছাড়া অযথা আলাপচারিতায় লিপ্ত হওয়া মাকরূহ। এটি এতটাই অপছন্দনীয় কাজ যে, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) যারা রাতের প্রথম ভাগে অযথা গল্প-গুজবে লিপ্ত হত তাদেরকে প্রহার করতেন এবং বলতেন, রাতের প্রথমাংশে গল্প-গুজব আর রাতের শেষে ঘুমে কাটানো! (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ৬৬৮১)।

এর কারণ সুস্পষ্ট। কেননা অযথা আলাপচারিতা ও গল্প-গুজবে লিপ্ত হওয়ার ফলে যখন রাতের উল্লেখযোগ্য অংশ নষ্ট করে দেয়া হল তাহলে এটি খুবই স্বাভাবিক যে, শেষ রাতে ওঠা এ ব্যক্তির পক্ষে কষ্টকর হবে; বরং প্রবল আশঙ্কা রয়েছে ফজরের নামাজই কাযা হয়ে যাওয়ার।

এ ছাড়াও রাত্রি জাগরণের কারণে দিনের বেলা অলসতা ভর করে। ফলে পূর্ণ উদ্যমের সাথে দ্বীনী-দুনিয়াবী দায়-দায়িত্ব পালন ও কাজ-কর্ম যথাযথভাবে পালন করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। রাত মুমিনের জীবনে অতি মূল্যবান। শেষ রাতের কান্নাকাটি, তাওবা ইস্তিগফার, জিকির আজকার দু-চার রাকাত নামাজ আল্লাহ তা’আলার কাছে খুবই প্রিয়।

সহীহ বুখারিতে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রতি রাতে শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে বলতে থাকেন, কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আছে এমন, যে আমার নিকট চাইবে? আমি তাকে তা দিব। কে আছে এমন আমার নিকট ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব। (সহীহ বুখারি : ১১৪৫)।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যারা প্রিয় বান্দা তারা এ ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারে না। আর তা সম্ভবই বা কী করে? প্রিয় মাওলা যে ডাকছেন! আহা একদিকে আসমান থেকে মহান রবের ডাক আর অন্য দিকে বান্দার পক্ষ থেকে তার সাড়া! কী চমৎকার এক মুহূর্ত! এ নিয়ামতের নূর ও বরকত এবং মাধুর্য থেকে কি ওই শ্রেণীরা বঞ্চিত নয়, যারা রাতের প্রথম অংশ গল্প-গুজবে আর শেষ অংশ নিদ্রাতুর হয়ে কাটায়?

আল্লাহ তা’আলার নিকট যুবক বয়সের ইবাদত বন্দেগী অনেক প্রিয়। যে সাত শ্রেণীর লোকদেরকে আল্লাহর ছায়াতলে আশ্রয় দান করবেন তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হল ওই যুবক যে তার যৌবন কালকে আল্লাহ তা’আলার ইবাদত-বন্দেগীতে কাটিয়েছে। গুনাহের প্রবল স্রোতে যে গা ভাসিয়ে দেয়নি।