Category স্মৃতিচারণ

কিছু এর রেখে যাই

আলী আহমাদ রুশদী আলী আহমাদ রুশদী প্রায় বারো বছর আগে একবার মনে হয়েছিল দিন ফুরিয়ে আসছে, অথচ কোথাও কি তেমন করে আমার চিহ্ন থাকবে? বহু বছর পর কেউ কি জানবে যে আমিও ছিলাম? সে সময় প্রথম শুরু করেছিলাম এই স্মৃতিকথা লেখা। মনে হয়েছিল আমার জীবন থেকেও হয়তো কারো জানার কিছু থাকবে, অথবা নিছক সময় কাটানোর জন্যই কেউ হয়তো পড়ে দেখবে। কিন্তু তারপরে সাংসারিক নানা ব্যস্ততায় লেখাটা আর শেষ করা হয় নি। কিছুদিন ধরে আমার স্ত্রী, তিন মেয়ে এবং জামাতা আশিক জানতে চাইতো লেখাটা কতদূর হলো। তারা প্রায়ই উতসাহ দিত লেখাটা শেষ করার জন্য। আমি খুব একটা যে আমল দিতাম তা না, মনে হতো এই সাধারণ একটা জীবনের গল্প জেনে কার কি লাভ হবে? এই ব্যস্ত সময়ে কার অবসর আছে অবিখ্যাত অপরিচিত কাউকে জানবার? তবুও মানুষ তো নিজের ছায়া দেখতে ভালোবাসে। অন্যদের চোখে পরিচিতির আভাস দেখতে চায়। মাঝেমাঝেই আমার লেখার কিছু অংশ ফেসবুকে শেয়ার করেছি। কিছু কিছু প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল অথবা খবরের কাগজে। সবসময়েই দেখেছি বহু মানুষ লেখাগুলো আগ্রহের সাথে পড়ছেন, সুন্দর মন্তব্য করছেন। এতে করে খুব উতসাহ পেলাম, মনে হলো এবার ঠিকঠাকভাবে শেষ করি লেখাটা। আমার বড় নাতনি করিমুন্নেসা এখন মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। সে লেখাপড়া করছে সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে। আমার জীবন, আমার অতীত, আমার কাজ নিয়ে তার প্রবল আগ্রহ। তার জন্ম এই দেশে, এই সময়ে, অথচ তার পূর্বসূরীদের সময় নিয়ে সে জানতে চায়। আমার ছোট…

সকলি গরল ভেল

আমার চোখের সমুখে অনেক মানুষের অনেক পরিবর্তন দেখেছি। অনেকে ছোট থেকে বড় হয়েছে। অনেকে কৃশকায় থেকে স্থুলকায় হয়েছে। অনেকে যুবক থেকে বৃদ্ধ হয়েছে। অনেকে ধনী থেকে দরিদ্র আবার অনেকে দরিদ্র থেকে প্রভূত বিত্তশালী হয়েছে। কতজন অসুস্থ থেকে সুস্থ জীবন ফিরে পেয়েছে আবার কত সুস্থ মানুষ সহসা অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। কিন্তু আমার চোখের দেখা দু-জন মানুষ তাদের মৃত্যুর আগ-পর্যন্ত কোন পরিবর্তন দেখিনি। দুই জনই আমার অত্যন্ত প্রিয়জন। একজন আমার দাদী। অপরজন আমার শাশুড়ি। আমার দাদী ও শাশুড়ির মাঝে অনেক বেশি মিল ছিল। আমার দাদীর চেহারা গোলগাল ছিল। মুখে কোন দাঁত ছিল না। বেঁটে-খাটো মানুষ ছিলেন। তিনি সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন এবং কথায় কথায় মানুষের জন্য দোয়া করতেন। তিনি মানুষকে খাওয়াতে ভালোবাসতেন। কোন ভিক্ষুককে খালি হাতে দরজা থেকে ফিরিয়ে দিতেন না। তিনি নিজে যেমন হাসতেন তেমন অপরকেও হাসাতে পারঙ্গম ছিলেন। অহংকার কাকে বলে তা তিনি জানতেন না। তবে বেশ অভিমানী ছিলেন। যে কোন মানুষের প্রতি তাঁর অগাধ মমত্ববোধ ছিল। জীবনের প্রথম দিন তাঁকে যেভাবে দেখেছি বলে মনে পড়ে মৃত্যুর পরও তাকে তেমনই দেখেছি। আমার শাশুড়ির চেহারা খানিকটা লম্বাটে ছিল। মুখে কোন দাঁত ছিল না। তিনিও বেঁটে-খাটো মানুষ ছিলেন। তবে তিনি সামনে ঝুঁকে হাঁটতেন। তিনি সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন এবং কথায় কথায় মানুষের জন্য দোয়া করতেন। তিনি মানুষকে খাওয়াতে ভালোবাসতেন। কোন ভিক্ষুককে খালি হাতে দরজা থেকে ফিরিয়ে দিতেন না। তিনি নিজে যেমন হাসতেন তেমন অপরকেও হাসাতে পারঙ্গম ছিলেন। তিনি নিরহংকারী…

রুয়ান্ডার স্মৃতি

নাসিরুজ্জামান নাসির জগন্ময় মিত্রের গাওয়া সেই বিখ্যাত কালজয়ী গান (তুমি আজ কত দূরে..) থেকে সুরটাকে যদি আলাদা করে ফেলেন তাহলে গানের যে কথাটা বা কম্পোজিশনটা পাবেন সেটা বলতে গেলে অনেকটাই সাধারণ মানের। কিন্তু এমন একটা সাধারণ মানের গীতের সাথে যখন ওই ভূবনজয়ী সুর আর অপূর্ব গায়কি ভঙ্গি যোগ হলো তখনই ওই গান হয়ে উঠলো হৃদয় ছোঁয়া, কালজয়ী। গীতা দত্তের গাওয়া “তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার….” গানের ক্ষেত্রে সেই একই কথা খাটে। ফলে মূল কথা হলো সুর আর গায়কি ভঙ্গি, কথাটা মোটামুটি হলেও ভাল গান হতে বাধা নাই। ২০১২ সালে আমেরিকায় অভিবাসী হবার পর যখন অনেক চড়াই-উৎরাই পার হচ্ছিলাম এমন সময় ২০১৪ সালের জুনে ইউএস এইড রুয়ান্ডা মিশনে সিনিয়ার পাবলিক হেল্থ এ্যাডভাইজার হিসেবে চাকরির ডাক পরলো। সব আয়োজন শেষে যাবার দিন-ক্ষণ এলো। বিদায় বেলায় দরজার চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে সহধর্মিনী ধরা-ধরা গলায় বললো “ফোন করো, চিঠি দিও, খাওয়া-দাওয়া ঠিক করে করো, শরীরের দিকে বিশেষ যত্ন নিও” এমনি আপাত অর্থহীন অগুনতি কথা। কিন্তু অতিমাত্রার এ সাধারণ কথাগুলোর সাথে ওই মুহূর্তে তার গায়কি (বলার) ভঙ্গি আর সুরের যে pathos (উদ্দীপনা) যোগ হলো সেটা জগন্ময় মিত্রের ওই সাধারণ কথার অপূর্ব গানের মতো কালজয়ী না হলেও রুয়ান্ডায় অবস্থানকালে করোনা ভাইরাসের মতো সে কথা আমার ফুঁসফুঁসের মধ্যে গেঁথে  গেলো। তার আগে ঠান্ডা মাথায় সে আমাকে to do and not-to-do এর একটা নাতিদীর্ঘ তালিকা মৌখিক ভাবে দিয়েছিলো। সে not-to-do গুলোর তালিকার একটা ছিল “পারলে হালাল মাংশ…

রোকেয়া হলের দিনগুলি

শিরিন হোসেন সেই কবেকার কথা। আটচল্লিশ বছর হতে চললো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ১৯৭৪-৭৫ সনের সেশনে অনার্সে ভর্তি হলাম। আমার স্কুল, কলেজ সবই ছোট ছিমছাম জেলা শহর কুমিল্লায়। মনে ভয় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় টিকবো তো? তাছাড়া দেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। সেশন জট কমানোর লক্ষ্যে মাত্র ছয়মাস উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস করেই সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা দিয়েছি। এই লেখাপড়া দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য হবে কি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলাম, বাংলা আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান। দেখলাম দুটোতেই টিকে গেছি। শুধু টিকে যাওয়াই নয়, বেশ ভালোভাবে টিকেছি, নাম উপরের দিকে আছে। সিদ্ধান্ত নিলাম রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ব। এই সিদ্ধান্তের পেছনেও স্মরণীয় এক ঘটনা রয়েছে যা আজ বলার লোভ সামলাতে পারছি না। ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বাংলারটাই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। আমি দারুণ আনন্দিত। সদ্য স্বাধীন দেশ, দেশের প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি তীব্র ভালোবাসা থেকে বাংলায় পড়ার ইচ্ছে জন্মেছিল। সেই সময় শুধু আমি নয়, এই আকাঙ্ক্ষা আরো অনেকেরই ছিল। বাংলায় আমার ভাইবা বোর্ডে ছিলেন স্বনামধন্য প্রয়াত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। তিনি জানতে চাইলেন আমি আর কোন ডিপার্টমেন্টে পরীক্ষা দিয়েছি কি না। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কথা জানালাম। তিনি মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বললেন, আমি তো শিক্ষক মানুষ, উপদেশ দিতে অভ্যস্থ, তোমাকে কি একটা উপদেশ দেবো? আমি বললাম, খুব খুশি হবো স্যার। তিনি যেটা বললেন তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি বললেন, আমি তোমাকে বলবো, তুমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা কর। যদি সে…