রুয়ান্ডার স্মৃতি

নাসিরুজ্জামান নাসির

নাসিরুজ্জামান নাসির

জগন্ময় মিত্রের গাওয়া সেই বিখ্যাত কালজয়ী গান (তুমি আজ কত দূরে..) থেকে সুরটাকে যদি আলাদা করে ফেলেন তাহলে গানের যে কথাটা বা কম্পোজিশনটা পাবেন সেটা বলতে গেলে অনেকটাই সাধারণ মানের। কিন্তু এমন একটা সাধারণ মানের গীতের সাথে যখন ওই ভূবনজয়ী সুর আর অপূর্ব গায়কি ভঙ্গি যোগ হলো তখনই ওই গান হয়ে উঠলো হৃদয় ছোঁয়া, কালজয়ী। গীতা দত্তের গাওয়া “তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার….” গানের ক্ষেত্রে সেই একই কথা খাটে। ফলে মূল কথা হলো সুর আর গায়কি ভঙ্গি, কথাটা মোটামুটি হলেও ভাল গান হতে বাধা নাই।

২০১২ সালে আমেরিকায় অভিবাসী হবার পর যখন অনেক চড়াই-উৎরাই পার হচ্ছিলাম এমন সময় ২০১৪ সালের জুনে ইউএস এইড রুয়ান্ডা মিশনে সিনিয়ার পাবলিক হেল্থ এ্যাডভাইজার হিসেবে চাকরির ডাক পরলো।

সব আয়োজন শেষে যাবার দিন-ক্ষণ এলো। বিদায় বেলায় দরজার চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে সহধর্মিনী ধরা-ধরা গলায় বললো “ফোন করো, চিঠি দিও, খাওয়া-দাওয়া ঠিক করে করো, শরীরের দিকে বিশেষ যত্ন নিও” এমনি আপাত অর্থহীন অগুনতি কথা।

কিন্তু অতিমাত্রার এ সাধারণ কথাগুলোর সাথে ওই মুহূর্তে তার গায়কি (বলার) ভঙ্গি আর সুরের যে pathos (উদ্দীপনা) যোগ হলো সেটা জগন্ময় মিত্রের ওই সাধারণ কথার অপূর্ব গানের মতো কালজয়ী না হলেও রুয়ান্ডায় অবস্থানকালে করোনা ভাইরাসের মতো সে কথা আমার ফুঁসফুঁসের মধ্যে গেঁথে  গেলো।

তার আগে ঠান্ডা মাথায় সে আমাকে to do and not-to-do এর একটা নাতিদীর্ঘ তালিকা মৌখিক ভাবে দিয়েছিলো। সে not-to-do গুলোর তালিকার একটা ছিল “পারলে হালাল মাংশ খেয়ো।”

মধ্য-আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে রুয়ান্ডায় ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস সব থেকে কম। দূতাবাসের Executive Officer নিজারের এক মুসলিম ভদ্রমহিলা। তাকে হালাল মাংশের কথা জিজ্ঞেস করলাম। আমাকে অবাক করে তিনি জানালেন পৃথিবীর মধ্যে রুয়ান্ডাই একমাত্র দেশ যেখানে সব মাংশই হালাল। এরপর গল্পটা বললেন।

১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় যে গণহত্যা সংগঠিত হয়, তাতে মাত্র তিন মাসে আট লক্ষ লোক প্রাণ হারায়। টুটসিরাই ছিল প্রধানতঃ এ গণহত্যার শিকার। কিন্তু কোন টুটসি মসুলিম কিংবা হুটু মুসলিম এ গণহত্যায় অংশ গ্রহন তো করেই নাই বরং শতশত অমুসলিম টুটুসির জীবন বাঁচিয়েছিল। মসজিদ হয়ে উঠেছিল টুটসিদের অভয়াশ্রম। অন্যদিকে খ্রিস্টান হুটু পাদ্রীরা সক্রিয়ভাবে এ গণহত্যায় অংশ নেয়। ফলে গণহত্যা পরবর্তি সময়ে অনেক হুটু-ট্টুসি ধর্মান্তারিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে।

বর্তমান প্রেসিডেন্ট পল কাগামি যখন ক্ষমতা দখল করলো তখন সে সব মুসলিমদের ষ্টেডিয়ামে ডেকে তাদের এ কাজের প্রশংসা করে জানতে চেয়েছিল তারা আর কি চায়। অনেক দাবির মধ্যে মুসলমানেরা তাদের জন্যে হালাল মাংশের ব্যবস্থা করবার অনুরোধ করেছিল। কাগামি মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল মুসলিমদের Slaughter House এর দায়িত্ব দিলে খ্রিস্টানদের কোন আপত্তি আছে কিনা। খ্রিস্টানরা বলেছিল তাদের কোন আপত্তি নাই। সে দিন থেকে কাগামি কিগালিতে Slaughter House এর দায়িত্ব মুসলিমদের দিয়ে দিয়েছলো। আর কিগালিতে সব পশুই Slaughter House এ প্রক্রিয়াজাত হয়। ফলে তখন থেকে রুয়ান্ডার সব মাংশই হালাল হয়ে গেল।

কিগালির মত এমন পরিচ্ছন্ন শহর আমি তৃতীয় বিশ্বের কোথাও দেখিনি। প্রত্যেক মাসের শেষ শনিবার উমুগান্ডা। রুয়ান্ডার ভাষা কেনিয়ারুয়ান্ডায় উমুগান্ডার ইংরেজি অর্থ Coming Together For Common Purpose. সেদিন সকাল থেকে দুপুর ১২ টা পযন্ত দোকান-পাট, গাড়ি-ঘোড়া চলাচল সব কিছু বন্ধ থাকে। সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে লোকজন ঝাঁড়ু কোদাল নিয়ে তার এলাকায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে লেগে যায়। এ কাজে প্রেসিডেন্ট ও নিয়মিত অংশ নেয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তার নিজ নিজ এলকায় এ কাজের সমন্বয় করে থাকেন। উমুগান্ডা এদের মাসিক উৎসবের মতো। তাছাড়া আমার আট মাস অবস্হান কালে খুব কম লোককেই দেখেছি বাইরে সিগারেট খেতে। প্লাস্টিকের ব্যাগ এখানে আক্ষরিক অর্থেই নিষিদ্ধ। যেখানে সেখানে ময়লা ছুড়ে ফেলছে না কেউই। ফলে শহরগুলো অপেক্ষোকৃত পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন।

রুয়ান্ডায় আমাকে প্রায়ই অফিসের কাজে দেশের নানা প্রান্তে যেতে হতো। কাকতালীয় ভাবে বেশিরভাগ সময় একই ড্রাইভার আমার সাথে যেতো। নাম রসুয়াইয়েনগা। নিজে খ্রিস্টান। বাবা ছিলেন মুসলমান। তারা পাঁচ ভাই। তিন ভাই মুসলমান আর দু-ভাই খ্রিস্টান। যার যার পছন্দ মত ধর্ম বেছে নিয়েছে। এ ড্রাইভারের সাথে একদিন আমি তার বাড়িতে গেলে এক হিজাব পরা মহিলা এসে আমাকে সালাম দিলেন। ড্রাইভার পরিচয় করিয়ে দিল তার স্ত্রী। একই ঘরের মধ্যে ধর্মের এ বিভাজন এবং শান্তিপূর্ণ বসবাস আজকের এ হানাহানির যুগে অবাক করার মতো।

শনি রবিবার অফিস বন্ধের দিনে আমার তেমন কাজ থাকতো না। তাই একটা মুসলিম গ্রুপ যারা ওই দুÕদিন সামাজিক কাজকর্ম করতো তাদের সাথে নানান কাজ করতে বেড়িয়ে পড়তাম। একদিন শনিবারে কাজে গেলে তারা সেদিন কাজ না করে এক বাড়িতে নিয়ে গেল। গিয়ে দেখি সাজ-সাজ রব। সবাই বাড়িঘর লাল-নিল কাগজ দিয়ে সাজাচ্ছে। বাড়ির গৃহিণী এক বারে নতুন সাঁজে সেঁজেছেন। যারা তার বাসায় এসছেন তাদের সবার পড়নেই নতুন জামা-কাপড়। ভাবলাম কোন বিয়ের আয়োজন। জিজ্ঞেস করলে বললো, না কোন বিয়ে না। গৃহকর্তা হজ্ব করে আজ দেশে ফিরছেন তাই এ আয়োজন। সবাই গাড়ির মিছিল নিয়ে গিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে তাকে নিয়ে আসলো। রুয়ান্ডা এখনও একটা গরীব দেশ। হাতে গোনা মাত্র জনা-কয়েক লোক প্রতি বছর হজ্বে যান। তাই যারা হজ্ব করে ফেরেন ওখানকার মুসলিম সমাজ তাদেরকে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখে। আমাদের দেশে ষাটের দশকে অনেকটা এরকম দেখেছি।

এ এক অদ্ভুত ব্যাপার! অনেক দেশেই ভাল খাবারের হোটেল মানেই হাজি সাহেবের হোটেল। বাংলাদেশে হাজির বিরিয়ানীতো আছেই। এছাড়া আমি ভারতের লখনউ, হায়দরাবাদ, পাকিস্তানের করাচি, কেনিয়ার মোম্বাসা, নেপালের নেপালগঞ্জে (জেলার নাম) হাজি সাহেবের নামকরা হোটেল দেখেছি। এ সব দেশের কথা না হয় মানলাম, তাই বলে রুয়ান্ডায়? অফিসের কাজে যাচ্ছিলাম অন্য এক জেলা শহরে। নাম রুসিজু। ড্রাইভারকে খাবারের দোকানের কথা জিজ্ঞেস করতেই বললো স্যার এখাানকার বিখ্যাত খাবারের জায়গা হলো হাজি সাহেবর দোকান। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, চলো। গিয়ে দেখি সে এক এলাহি কান্ড। আফ্রিকার পুরনো গাছের গুড়ির গনগনে আগুনে কোনটা আস্ত খাঁশি, কোনটা চার ভাগ করা আবার কিছু শিকে গাথা কাবাব হচ্ছে। সাথে বড় কড়াই এর টগবগে তেলে বড় বড় আলু অর্ধেক করে কেটে ভাঁজছে। যার যার অর্ডার মত কাবাব নিচ্ছে, সাথে ওই ভাজা আলু আর আতরের শিশির মত এক শিশি চিলি অয়েল, যাকে বলে মরিচের তেল। ভীষণ ঝাল সে তেল। সে দোকানে আরও বিক্রি করে cow oil আর fermented milk অর্থ্যাৎ এক ধরনের ঘি এবং তরল দই। এখানে ছোট্ট করে একটা কথা বলে রাখি আমার সহকর্মীরা বলেছিল এর সাথে combination নাকি বেলজিয়ামের Mutzig beer. আমার দেখা রুয়ান্ডাই একমাত্র দেশ যেখানে গরুর মাংশের থেকে খাশির মাংশের দাম কম।

আমাদের যেমন উপজেলা ওদের তমনি সাব সেক্টর। প্রতি সাবসেক্টরে একটা করে হাসপতাল। সে হাসপতালে মোট জনবল ৩৫ জন। আমি সকাল ৯টায় গিয়ে ৩৫ জন পেয়েছি, একই হাসপতালে দুপুরে এবং বিকাল ৪টায় যেয়েও ৩৫ জনই পয়েছি। ভূ-ভারতের এবং আফ্রিকার আর কোনো দেশে এটা কল্পনার বাইরে। পোস্ট ভ্যাকেন্ট, ট্রেনিং এ আছেন, অসুস্থ, জরুরী কাজে বাইরে, আর স্যারের আসতে একটু দেরী হবে সব মিলিয়ে এ দেশে কোন উপজেলা হাসপাতালে প্রায় অর্ধেক লোকের কোন খোঁজ থাকে না। রুয়ান্ডায় শতকরা ৮০ জন লোকের হেল্থ ইনসিওরেন্স আছে এবং সেটা কাজ করে। এটা ছিল আমার কাছে এক বিস্ময়।

ডিসেম্বর মাসের শেষে বেশ কতদিন অফিস ছুটি। আমার রুয়ান্ডার সহকর্মী ছুটিতে আমাকে তাদের উগান্ডার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেল। রুয়ান্ডার অনেকেরই বাড়ি আছে উগান্ডায়। একেবারেই অজ পাড়াগাঁ। চারিদিকে স্বল্প উঁচু উঁচু পাহাড়। অনেকটা সাগরের বড় ঢেউয়ের মত, দোল খেলানো। তার নিচের দিকে অথবা গায়ে-গায়ে সব বাড়ি। বেশির ভাগই চারণভুমি। বাড়িতে মা থাকেন আর এক ভাই, ভাবি আর তাদের দুই বাচ্চা। একটা বিল্ডিং করছে ও। মা আর ভাই থাকেন আফ্রিকার সেই দৃষ্টিনন্দন গোল করে বানানো মাটির ঘর আর ওপরে খড়ের ছাউনিতে। ওর ভাইয়ের গরু আছে ১৬০টা । এখানে যার যত গরু আছে সে তত বড়লোক। তার ভাই জীবনে একবারই নাকি পানি খেয়েছে। তাও হাসপাতালে ওষুধ খেতে গিয়ে খেতে হয়েছিলো। তাছাড়া সে পানির বদলে দুধ খেয়ে থাকে। চমৎকার মানুষ।

ওদের বাড়ি থেকে মাইল দশেক দূরে ওর এক বোন থাকে। এক সন্ধ্যায় তাদের বাসায় দাওয়াত। অপেক্ষেয়াকৃত উঁচু পাহাড়ের উপর চমৎকার বাংলো ধরনের বাড়ি। দেখলেই বোঝা যায় অবস্থা সম্পন্ন ঘর। বাড়ির এক দিকে কোন লোকালয় নাই। আদিগন্ত খোলা। তাদের নাকি ৮০০ গরু আছে। সন্ধ্যার একটু পর লোকজন আসতে শুরু করল। বেশির ভাগই মহিলা। তাদের পরনে উগান্ডার স্থানীয় পোশাক। সবাই ভদ্র, মার্জিত। রাতের খাবার শেষ হোল।এবার হল ঘরে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবার পালা আর রাতের অনুষ্ঠান। এক জন আরেক জনের হাত ধরে গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে গান গাইছে আর নাচছে। আর এক জন করে মাঝে এসে আমাকে মাঝখানে দাঁড় করিয়ে প্রার্থনা করছে। ভারি ছন্দময় সে নাচ আর গান । নাচটা অনেকটা আমাদের সাঁওতালিদের নাচের মতো। আর গানগুলো রাঢ় অঞ্চলের ঝুমুর গানের কায়দায়। সে আসর ভেঙে অনেক রাতে ঘরে ফিরলাম। অমলিন হয়ে থাকলো ওর বোন আর পরিবারের আন্তরিকতা।

তিন দিন ছিলাম আমি ওদের গ্রামের বাড়িতে। সে দিন ফিরে আসার পালা। আমার সে সহকর্মীর মা বাড়ির দাওয়ায় বসে আছেন কাঠের ফ্রেমের সাথে দড়িতে বোনা টুলে। কাছে গিয়ে বিদায় চাইতে গেলাম। মাথায় হাত দিলেন। তারপর শুন্যে দু হাত তুলে উঁচু স্বরে আমার জন্যে দোয়া করতে শুরু করলেন। আমি খানিকটা আবেগ তাড়িত হয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকলাম। ভাবলাম মায়ের তো জাত হয় না! ওনার প্রার্থনা শেষ হলে আবার মাথায় হাত দিয়ে বললেন আবার এসো। বলেছিলাম আসবো। সে কথা আমার রাখা হয়নি। হবে কিনা জানিনা।

লেখক: ওয়াশিংটন ডিসি’তে ইউ্এস এইডে কর্মরত