সকলি গরল ভেল

মো. কামরুজ্জামান

আমার চোখের সমুখে অনেক মানুষের অনেক পরিবর্তন দেখেছি। অনেকে ছোট থেকে বড় হয়েছে। অনেকে কৃশকায় থেকে স্থুলকায় হয়েছে। অনেকে যুবক থেকে বৃদ্ধ হয়েছে। অনেকে ধনী থেকে দরিদ্র আবার অনেকে দরিদ্র থেকে প্রভূত বিত্তশালী হয়েছে। কতজন অসুস্থ থেকে সুস্থ জীবন ফিরে পেয়েছে আবার কত সুস্থ মানুষ সহসা অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। কিন্তু আমার চোখের দেখা দু-জন মানুষ তাদের মৃত্যুর আগ-পর্যন্ত কোন পরিবর্তন দেখিনি। দুই জনই আমার অত্যন্ত প্রিয়জন। একজন আমার দাদী। অপরজন আমার শাশুড়ি।

আমার দাদী ও শাশুড়ির মাঝে অনেক বেশি মিল ছিল। আমার দাদীর চেহারা গোলগাল ছিল। মুখে কোন দাঁত ছিল না। বেঁটে-খাটো মানুষ ছিলেন। তিনি সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন এবং কথায় কথায় মানুষের জন্য দোয়া করতেন। তিনি মানুষকে খাওয়াতে ভালোবাসতেন। কোন ভিক্ষুককে খালি হাতে দরজা থেকে ফিরিয়ে দিতেন না। তিনি নিজে যেমন হাসতেন তেমন অপরকেও হাসাতে পারঙ্গম ছিলেন। অহংকার কাকে বলে তা তিনি জানতেন না। তবে বেশ অভিমানী ছিলেন। যে কোন মানুষের প্রতি তাঁর অগাধ মমত্ববোধ ছিল। জীবনের প্রথম দিন তাঁকে যেভাবে দেখেছি বলে মনে পড়ে মৃত্যুর পরও তাকে তেমনই দেখেছি।

আমার শাশুড়ির চেহারা খানিকটা লম্বাটে ছিল। মুখে কোন দাঁত ছিল না। তিনিও বেঁটে-খাটো মানুষ ছিলেন। তবে তিনি সামনে ঝুঁকে হাঁটতেন। তিনি সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন এবং কথায় কথায় মানুষের জন্য দোয়া করতেন। তিনি মানুষকে খাওয়াতে ভালোবাসতেন। কোন ভিক্ষুককে খালি হাতে দরজা থেকে ফিরিয়ে দিতেন না। তিনি নিজে যেমন হাসতেন তেমন অপরকেও হাসাতে পারঙ্গম ছিলেন। তিনি নিরহংকারী মাটির মানুষ ছিলেন। তিনিও বেশ অভিমানী ছিলেন। যে কোন মানুষের প্রতি তাঁরও অগাধ মমত্ববোধ ছিল। শ্বশুরবাড়ি প্রথম দিন গিয়ে তাঁকে যেভাবে দেখেছি বলে মনে পড়ে তাঁর মৃত্যুর এক মাস আগে তাঁকে শেষবারের মতো ঠিক তেমনই দেখেছি।   

আমার শ্বশুরবাড়ি নিতান্তই এক অজগাঁয়ে। সেই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর ও কৃষক। অনেকে দিন আনে দিন খায়। আমার বিবাহিত জীবনের তেত্রিশ বছরে শ্বশুরবাড়ির কারও সঙ্গে চেঁচামেচি করেছি বা কারও সঙ্গে কোন বৎসা হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না। দুই হরফ বিদ্যে জানি বলে সে বাড়ির ছোট-বড় সবাই যেমন সমীহ করেছেন, আমিও কারও মনঃকষ্ট হতে পারে এমন কথা বলিনি- এই কথাটি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলতে পারি। আমার দুই সমন্ধী ব্যতিত সবাই আমাকে ‘আপনি’ বলেন। এমনকি আমার শ্বশুর-শাশুড়িও আমাকে ‘আব্বা’ সম্বোধন ও ‘আপনি’ বলতেন।

আমার শ্বশুরকে খুব বেশিদিন পাইনি। আমাদের বিয়ের বছর সাত-আট পরই তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন হাঁপানিতে ভূগে মৃত্যু বরণ করেছেন। তিনি আমার বড় ছেলে (সে মারা গেছে) ও বড় দুই মেয়েকে দেখেছেন। কোলে পিঠে নিয়ে হাসি-তামাশা ও দোয়া করেছেন। কিন্তু ছোট মেয়ে ও ছোট ছেলের মুখ দেখেননি। যখন আমি ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজে চাকুরি করতাম তখন তিনি সেই ক্যাম্পাসের বাসায় বেশ কয়েকবার বেড়াতে এসেছেন। তিনি অসুস্থ হলে ময়মনসিংহে চিকিৎসার জন্যও এসেছেন।

অতিথিকে আমি সবসময় আশীর্বাদ মনে করি। একবার আমার শ্বশুর গুরুত্বর অসুস্থ হলেন। তাঁকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। আমার শ্বশুরবাড়ির অনেক আত্মীয়-স্বজন উনাকে দেখার জন্য এসেছেন। তারা আমার বাসায় খানা-দানা খেয়েছেন ও রাত্রিযাপন করেছেন। খাটে ঠাঁই হতো না। মেঝেতে বিছানা পেতে গণহারে শুয়েছেন। আমি এটা দাবি করতে পারি যে তখন আমার স্বল্প আয় এবং সাংসারিক টানাপোড়েন সত্বেও কোন অতিথির সঙ্গে মন খারাপ করিনি। শুধু তাই নয়। আমি পান-বিড়ি খাইনে। অতিথিদের যারা পান ও বিড়ি খেয়ে অভ্যস্ত ছিলেন আমি তাদের সেসবও কিনে দিয়েছি।

আমার স্ত্রীর জন্যই আমি আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে ভুলেও অসম্মান করিনি। এর কারণ স্ত্রীকে ভয় নয়। স্ত্রীর প্রতি সম্মান। তাই আমার শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি আমার সম্মান ও কৃতজ্ঞতা। সম্মান এই জন্য যে শ্বশুর যেমন পিতৃতুল্য শাশুড়ি তেমন মাতৃতুল্য। কৃতজ্ঞতা এই জন্য যে তাদের কারণেই আমি আমার স্ত্রীকে আমার জীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছি। যার সঙ্গে প্রতিনিয়ত অকারণে মনোমালিণ্য, অপ্রয়োজনীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করে অহেতুক খুনসুটি ও খেলাচ্ছলে উস্কানিমূলক ঠোকাঠুকির মাঝেও অসীম আনন্দ ও সুখ খুঁজে পেয়েছি।     

আমার শ্বশুর দুইবার মৃত্যু বরণ করেছেন। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল। পত্রালাপের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হতো। সে যুগে এক ডিসেম্বর মাসে খবর পেলাম আমার শ্বশুর মারা গেছেন। তখন আমার দুই মেয়ে একেবারেই ছোট। হাড়-কাঁপুনি শীত উপেক্ষা করে শেরপুর গিয়ে শুনতে পেলাম তিনি বেঁচে আছেন। এরপর তিনি বছর কয়েক বেঁচে ছিলেন। পরে এক বোরো ধান-কাটার মৌসুমে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। গাঁয়ের রাস্তায় খড় ও বিঁচালি বিছানো ছিল। আমরা বহু কষ্টে সে বাড়িতে পৌঁছে ছিলাম। শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে আমার সমন্ধী ও অন্যান্য অনেকে উনার জানাজায় শরীক হতে পারেননি।

আমি অত্যন্ত রাগী মানুষ। শ্বশুরের মৃত্যুর পর আমার শাশুড়িকে আমাদের সঙ্গে রাখার চেষ্টা করতাম। যখন তিনি আমার বাসায় থাকতেন তখন আমার রাগ নিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম। আর আমার শাশুড়ি আমাকে স্নেহের তুলনায় সম্মানই বোধহয় বেশি করতেন। অথচ আমি উনার চার জামাতার মধ্যে ছোট জামাতা ছিলাম। তিনি নিরক্ষর মানুষ হলেও অত্যন্ত শান্ত ও ধীসম্পন্ন ছিলেন। তিনি ভুলেও আমার সঙ্গে কখনও রাগ করেননি। এবং যখন তিনি আমার কাছে দাঁড়াতেন তখন অবশ্যই আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করতে ভুলতেন না।

আমার শাশুড়ি আমাকে এতো বেশি স্নেহ করতেন যে এজন্য তার অন্যান্য জামাতারা আমার প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন। আমি যা যা খেতে পছন্দ করি তিনি তা জানতেন এবং আমি শ্বশুরবাড়ি গেলে তিনি যে কোন মূল্যে সেসব প্রস্তুত অথবা রেঁধে খাওয়াতেন। আবার যখন তিনি আমার বাসায় বেড়াতে আসতেন তখনও সেসব পর্যাপ্ত পরিমাণে নিয়ে আসতেন। সেসব তিনি ফ্রিজে মজুদ রেখে নিজ হাতে রেঁধে খাওয়াতেন। যদি কোন কারণে আমি সেসব কম খেতাম তবে তিনি হেসে জিজ্ঞেস করতেন, কি নিয়ে রাগ করেছেন আব্বা!

শ্বশুরবাড়ির একটি গাছের কাঁঠালের স্বাদ অসাধারণ ও অতুলনীয়। ওর কোষ যেমন নরম ও সুগন্ধযুক্ত তেমনই সুমিষ্ট। ওটা চিতই পিঠার সঙ্গে খেতে আমি পছন্দ করতাম। তখন আমি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে ছিলাম। আমার বাসায় এতো কাঁঠালগাছ যে সেসব শেয়ালও খেয়ে শেষ করতে পারতো না। কাঁঠাল নিয়ে সবাই বিরক্ত হতো। আমার শ্বাশুড়ি সেই বাসায় দুটো কাঁঠাল, কিছু আম ও চিড়া-পিঠা পাঠাতেন। ওর অর্থমূল্য সামান্য। হয়তো দু-তিন শ’ টাকা। অথচ শেরপুর থেকে ঝিনাইদহ যাতায়াতে একজনের জন্য কমপক্ষে পনের শত টাকা ব্যয় হতো। তিনি আমাকে কত স্নেহ করতেন তা বোঝানোর জন্য এসব করতেন। আর আমি অসীম আনন্দ পেতাম ও সহকর্মীদের সঙ্গে গর্বসহকারে গল্প করতাম।

আমি হাঁসের মাংস ও ডিম পছন্দ করি। একদিন কয়েকজন বন্ধু নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলাম। আমার শাশুড়ি চারটি হাঁস একত্রে জবাই করলেন। আমি সে বাড়ি গেলে তিনি প্রতিদিন অন্তত দুটো হাঁসের ডিম খেতে বাধ্য করতেন। আমি পুকুরে বড়শি ফেলে বসলেই তিনি হাঁস অথবা দেশি মুরগির সেদ্ধ ডিম নিয়ে আমার কাছে গিয়ে ধমকের সুরে খেতে বলতেন। কারণ আমি মাছ ধরতে বসে কিছু খেতে গিয়ে সময় ও মনঃসংযোগ নষ্ট করিনে। তাছাড়া তিনি কিছুক্ষণ পরপর এক গ্লাস পানি ও এক টুকরো সুপারি নিয়ে আমাকে খেতে দিতেন। মাছ ধরার সময় আমি এর বেশি কিছু খাইনে।

আমার শাশুড়ির আরও একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি কিছু টাকা সঞ্চয় করতেন। সেসব টাকা হয়তো ধান অথবা চাল বিক্রি করে পেতেন। আমি সে বাড়ি গিয়ে যখন মাছ ধরতে পুকুরপাড়ে বসতাম তখন তিনি সর্বদৃষ্টির অগোচরে আমার পাশে বসে আমার মাথায় ও পিঠে হাত বুলিয়ে দোয়া করতে করতে শার্টের পকেটে হাত দিয়ে বলতেন, আব্বা, আপনার যাতায়াত ভাড়া দিলাম। আর কখনও দিতে পারবো না। অল্প টাকা দিলাম বলে রাগ করবেন না।

ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন

আমি ঐ আশীর্বাদ পেয়ে ধন্য হতাম। আমার এই স্নেহধন্য হওয়ার গল্প অনেক সহকর্মী জানেন। আমার শাশুড়ির প্রতি আমার শর্তহীন সম্মান ব্যতীত কোন প্রকার অভাব, অভিযোগ বা রাগ-ক্ষোভ ছিল না। তবে আমার ধারণা তিনি একটি কারণে আমার প্রতি মনঃক্ষুন্ন ছিলেন। কারণটি বলছি। বিয়ের কিছুদিন পর আমার স্ত্রীর দেনমাহর কড়ায় গণ্ডায় পরিশোধ করেছি। আর বিভিন্ন সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে এটাসেটা দিতে চাইলেও আমি গ্রহণ করিনি। আমি শুধু তাদের দোয়া প্রার্থনা করেছি।

আমার শ্বশুরের অনেক জমি-জমা ছিল। তিনি তার তিন ছেলে ও চার মেয়েকে সেসব নিয়মানুসারে ভাগ করে দিয়েছেন। তিনি তাঁর বড় তিন জামাতাকেও কিছু জমি দান করেছেন। আমাকে পাঁচ কাঠা (সে অঞ্চলে পাঁচ সতকে এক কাঠা) জমি লিখে দিতে চেয়েছেন। আমি নিতে রাজি হইনি। আমার শ্বশুরের মৃত্যুর পর সেই জমি লিখে নেওয়ার জন্য আবারও আমার শাশুড়ি চাপ প্রয়োগ করলেন। আমি নেইনি। এতে তিনি মনঃক্ষুন্ন হয়েছেন বলে শুনেছি।       

আমার শাশুড়ির বাতের ব্যথা ছিল। তিনি সেই ব্যথায় রাতে ঘুমোতে পারতেন না। তিনি এরজন্য অনেক ঔষধ সেবন করলেও কাজ হয়নি। আমি একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলাম। চিকিৎসক এক মাস খাওয়ার মতো ঔষধ দিলেন। তিনি সুস্থ হলেন। উনার চোখে ছানি পড়লো। আমি ছানি কাটা এবং চোখে ল্যান্স লাগানোর ব্যবস্থা করলাম। তিনি কানে কম শুনতে পেতেন। আমি চিকিৎসা করালাম এবং হিয়ারিং এইড কিনে দিলাম। অবশ্য পরে তিনি এই হিয়ারিং এইড আর ব্যবহার করেননি। তিনি অন্য কোনভাবে অসুস্থ হলেও আমার স্ত্রী তার কাছে ছুটে যেতেন। তাকে আমি কখনও বাধা দেইনি। বরঞ্চ আমার সাধ্যমতো ফল-ফলান্তি কিনে দিতাম।

আমার মা’র জন্য খুব বেশি শাড়ি-কাপড় কিনিনি। তবে যতবার আমার মা’র জন্য শাড়ি-কাপড় কিনেছি ততবার আমার শাশুড়ির জন্যও কিনেছি। এই ব্যাপারে আমার স্ত্রী কখনও কথা বলার সুযোগ পেতেন না। আমার শাশুড়ি খাবার-দাবার একেবারেই পছন্দ করতেন না। গরু-খাসির মাংস, দুধ ও দুধের তৈরি খাবার স্পর্শ করতেন না। একটু জিলাপি খেতে পছন্দ করতেন। এটা আমার মা’রও পছন্দ। যখন এসব কিনতাম তখন উভয়ের জন্য কিনতাম। কারণ আমি সম্মানের ক্ষেত্রে আমার মা আর আমার শাশুড়িকে অভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতাম। আমার স্ত্রী এখনও বেঁচে আছেন। আমার বিশ্বাস এই ব্যাপারে আমার স্ত্রী আমাকে মিথ্যেবাদী আখ্যা অথবা অতিরঞ্জিত কিছু বলার অপবাদ দিবেন না।

আমার শাশুড়ি বার্ধক্যজনিত কারণে দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন। বিগত কয়েক মাস একেবারেই সয্যাশায়ী ছিলেন। তিনি নিজে কিছু করে খেতে পারতেন না। ছেলে, ছেলের বউ, নাতি, নাতির বউ যা তার মুখে তুলে দিতো তাই অনিচ্ছা সত্বেও খেতেন। মাঝে মাঝে আমার স্ত্রী অথবা তার বোনেরা গিয়ে দু-এক দিন কাছে থেকে মায়ের সেবা করতেন। তিনি আরও বেশি প্রত্যাশা করলেও তাদের কারও পক্ষেই সর্বক্ষণ পাশে থাকা সম্ভব হয়নি।

গত নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এক ভোরে আমি সস্ত্রীক-সকন্যক-সপুত্রক শেরপুর গিয়েছিলাম। শাশুড়ি আমার ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। দুটো কথা বলেছিলেন। আমি ক্ষমা চেয়েছিলাম। তিনি আমাকে কম্পিত হাতে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন। দোয়া করেছেন। ক্ষমা চাওয়ায় তিনি উলটো ক্ষমা চেয়েছেন। যখন তিনি আমার মাথা-মুখ-কপালে হাত বুলাচ্ছিলেন তখন ছোট মেয়ে কিছু ছবি তুলেছিল। আর আমার ছেলেটি অবাক বিষ্ময়ে দেখছিল। আমি বহু কষ্টে অশ্রু সংবরণ করেছিলাম। সন্ধ্যায় স্ত্রীকে শাশুড়ির পাশে রেখে ছোট মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছিলাম।

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে শাশুড়ির অবস্থা চূড়ান্তভাবে খারাপ হয়। আগে তিনি তবুও কিছু খেতেন, মাসাধিককাল যাবৎ কিছু খেতেও পারতেন না। আমার স্ত্রী এই সময়ের মধ্যে তিন দিন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শাশুড়ির সঙ্গে এক রাত করে কাটিয়ে ফিরে এলেন। তার বেশি সময় না থাকার কারণ ছেলের পরীক্ষা চলছিল। ওদিকে কলেজে অধ্যক্ষ মহোদয় নিজ ইউনিটে ফিরে যাওয়ায় কলেজের সার্বিক দায়িত্বভার আমার কাঁধে অর্পিত হলো। আমিও আগের চেয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

ক্যাডেট কলেজসমূহে ডিসেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততায় কাটে। তদুপরি এ বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা পেছানো ও সপ্তম শ্রেণির ক্যাডেটদের বছরের শেষে কলেজে যোগদানের ফলে অনেক স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত ও অসময়ে অনুষ্ঠিত হলো। আমি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে হিমশিম খেলাম। কলেজে লাগাতার অনুষ্ঠানাদি চললো। আন্তঃহাউস ফুটবল ও বাস্কেটবল প্রতিযোগিতা, তৃতীয় পর্বান্ত পরীক্ষা, ৬০তম ব্যাচের নভিসেস ড্রিল, জাতীয় দিবস, আন্তঃহাউস ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও আন্তঃক্যাডেট কলেজ ম্যাথ অলিম্পিয়াড একাধারে অনুষ্ঠিত হলো। কারও দম ফেলার ফুসরৎ ছিল না।

কলেজের তৃতীয় পর্বান্ত পরীক্ষা ও আন্তঃহাউস বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শেষে ২৩ ডিসেম্বর ক্যাডেটবৃন্দ শীতকালীন ছুটিতে গমন করে বটে আবার সেদিনই আন্তঃক্যাডেট কলেজ ম্যাথ অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের জন্য এগারো ক্যাডেট কলেজের প্রতিযোগী ক্যাডেট, এ্যাডজুটেন্ট ও গণিতের শিক্ষক মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে এলো। গণিত অলিম্পিয়াড পরিচালনা কমিটির সদস্যবৃন্দ এলো। পুরো কলেজ বর্ণিল সাজে সুসজ্জিত করা হলো। সাজ সাজ রব। ২৪ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো আন্তঃক্যাডেট কলেজ গণিত অলিম্পিয়াডের উদ্বোধন করা হলো।

ওদিকে আমার শাশুড়ির খবর পেয়ে স্ত্রী ভীষণ মন খারাপ করে থাকেন। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম ২৮ ডিসেম্বর আন্তঃক্যাডেট কলেজ ম্যাথ অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার পরদিনই ২৯ ডিসেম্বর সস্ত্রীক শেরপুর গিয়ে শাশুড়ির শিয়রে বসে আবারও ক্ষমা চাইবো। ২৬ ডিসেম্বর কলেজ থেকে বাসায় ফিরে স্ত্রীকে কান্নারত অবস্থায় দেখে কোন প্রশ্ন করার অবকাশ পেলাম না। তিনি বললেন, আজ মা পানিও খাচ্ছেন না। আমি বাড়ি যাবো কি!

তখন বেলা তিনটে বাজে। শেরপুর হয়ে আমার শ্বশুরবাড়ি যেতে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন। যদি গাড়ি পেতে বিলম্ব অথবা যানজটের ধকল সইতে হয় তবে অধিক রাত হওয়ার আশঙ্কা আছে। শীতের রাত। তাই স্ত্রীকে বললাম, আজ নয়। আগামীকাল ভোরে যাও।

তিনি তাতেই সম্মত হলেন। পরদিন ভোর সাড়ে ছয়টার গাড়িতে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তিনে শেরপুর গেলেন। দুপুরে কলেজ থেকে ফিরে খবর পেলাম শাশুড়ির অবস্থা তথৈবচ। আমি পোশাক পাল্টাতে গিয়ে আলনার কোণা ধরে দাঁড়িয়ে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করলাম, হে সর্বশক্তিমান! হে দয়ালু! হে পরম করুণাময়! তুমি আমার শাশুড়িকে সুস্থতা ও পুণ্যময় হায়াত দান করো। তুমি উনাকে এই অসহনীয় রোগ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও।

২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পরও আন্তঃক্যাডেট কলেজ ম্যাথ অলিম্পিয়াডের আনুষ্ঠানিকতা চলছিল। এই মেগা ইভেন্টের প্রধান অতিথি কলেজে এসেছেন। ২৮ ডিসেম্বর সমাপনী দিবসের অনুষ্ঠানে আরও আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ, ক্যাডেট কলেজ পরিচালনা পরিষদের সম্মানিত সদস্যগণ ও বরিশাল ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় যোগদান করবেন। আমরা সবাই তাদের বরণ, থাকার সুব্যবস্থা ও আপ্যায়নের বিষয়ে ব্যস্ত রইলাম। এর ফাঁকে ফাঁকে শাশুড়ির অবস্থার অবনতির খবর পেলাম। আমি একা বাসায় থাকায় খুব অস্বস্তিবোধ হতে লাগলো।

আমার আত্মা ধুকপুকানি প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেল। কারণ আজ আমার শাশুড়ির জন্য যেরূপ দোয়া করেছি তেমন দোয়া আরও একজনের জন্য করেছিলাম। আল্লাহ্ আমার মতো পাপীর সেই প্রার্থনা কবুল করেছিলেন। সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ আমাদের ঘরে প্রথম একজন পুত্র-সন্তান দান করেছিলেন। সে শেরপুর সদর হাসপাতালে জন্মেছিল। কিন্তু জন্মের কিছুক্ষণ পর থেকে তার খিঁচুনি শুরু হয়েছিল। চিকিৎসক একের পর এক ইঞ্জেকশন পাল্টালেন।  রাতে তার অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে গেলাম।

ময়মনসিংহ হাসপাতালে গিয়েও কোন লাভ হলো না। তার কষ্ট আরও বাড়লো। এটা আমার জন্য এক অসহনীয় দৃশ্য ছিল। আমার স্ত্রীর অবস্থাও সঙ্গীণ ছিল। তাকে শেরপুরে বাসায় রেখে গিয়েছিলাম।  আমার মা, আমার একজন বন্ধুর মা ও আমার বন্ধু আমার সঙ্গে সেখানে ছিলেন। আমি ছেলের আর্তচিৎকার সহ্য করতে না পেরে দোতলা থেকে নীচে নেমে একা একা দাঁড়িয়ে দোয়া করেছিলাম, হে সর্বশক্তিমান! হে দয়ালু! হে পরম করুণাময়! তুমি আমার ছেলেকে সুস্থতা ও পুণ্যময় দীর্ঘ হায়াত দান করো। তুমি তাকে এই অসহনীয় রোগ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও।

সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ আল্লাহ্ এই পাপী বান্দার দোয়ার দ্বিতীয়াংশ কবুল করেছিলেন। এর ক্ষণিক পর আমার বন্ধু এসে আমার কাঁধে হাত রেখে অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না। কম্পিতকণ্ঠে বললেন, চলো। শেরপুর ফিরতে হবে। আর কিছু করার নেই।

সেদিন আমার মা ও বন্ধুর মা পালাক্রমে কোল পাল্টিয়ে মৃত নাতিকে নিয়ে শেরপুর ফিরলেন। সেটা ছিল ২৪ নভেম্বর, ১৯৯১-এর রাত। গত ২৭ ডিসেম্বর রাতে আমি বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ ছটফট করলাম। একাধারে অসুস্থ শাশুড়ির জন্য দুশ্চিন্তা এবং পরদিন সমাপনী অনুষ্ঠানের ভাবনা আমাকে ব্যতিব্যস্ত রাখলো। মাঝরাত পর্যন্ত আমার চোখে ঘুম এলো না। এরপর ক্ষণিকের জন্য ঘুমিয়ে একটি দুঃস্বপ্ন দেখলাম। আমার জীবনে এই স্বপ্ন যতোবার দেখেছি ততোবার আমার কোন ঘনিষ্ঠজনের মৃত্যু খবর পেয়েছি। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তার দুই অথবা তিন মিনিট পরেই মোবাইলে রিং হলো। স্ত্রী কল করেছেন। একটি দুঃসংবাদ পাওয়ার ব্যাপারে আমার মনে কোন সন্দেহ রইলো না। আমি কলটি রিসিভ করতেই তিনি বললেন, মা আর নেই।

আমি ইন্না লিল্লাহ্ পাঠ করলাম। এর পরপরই বড় মেয়ে কল করলো। সে আমার কণ্ঠস্বর শুনেই বললো, তুমি বিশ্রাম নাও আব্বু। দুশ্চিন্তা করো না। শেরপুর যাওয়ার সুযোগ পাবে কি!

আমি বাকরুদ্ধ। আমার শাশুড়ির অতুলনীয় আদর-স্নেহের কথা আমার মনে একে একে বাঙ্ময় হতে লাগলো। আমার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়াতে লাগলো। ফজরের আযান হলো। আমি উঠে নামাজ পড়লাম। খবর পেলাম, আমার বড় দুই মেয়ে, জামাতা ও শ্বশুরপক্ষের অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন শেরপুর রওনা হয়েছেন। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমি সহসা সকল আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতার সম্পূর্ণ দায়িত্ব কার কাঁধে দিয়ে শেরপুর চলে যাবো তা ভেবে পেলাম না। যদিও আমি বিশ্বাস করি যে কারও অনুপস্থিতির জন্য দুনিয়ার কোন কার্যক্রম থেমে থাকে না। আমি হার্ট-এ্যাটাকে তৎক্ষণাৎ মারা গেলেও আমার লাশ এক পাশে সরিয়ে রেখে সুন্দরভাবে অনুষ্ঠানাদি শেষ করা হবে। তারপর সবাই যার যার গন্তব্যে ফিরে যাবে। হয়তো আমার জন্য দোয়া করা অথবা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলার অবকাশও কেউ পাবে না।

আমি চোখ বন্ধ করে ভাবলাম, এই মৃত্যুর সংবাদ আপাতত কাউকে জানাবো না। আমি সবাইকে দাওয়াত করে এই কলেজে এনেছি। এখন তিন শতাধিক অতিথি আমার ঘরে। তাদের রেখে আমার চলে যাওয়া কতটা সমীচীন হবে এবং শাশুড়ির জানাজায় অংশগ্রহণ না করলে কতটা অবিবেচকের কাজ হবে- তা ভেবে কূল-কিনারা পেলাম না। ভাবলাম সব কার্যক্রম হাসিমুখে শেষ করে সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমি শেরপুর রওনা হবো। কিন্তু ততক্ষণে জানাজা ও দাফন হয়ে যাবে। কি করবো! ওদিকে বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন বারংবার আমাকে মোবাইলে কল করছেন। সাত-পাঁচ ভেবে কোন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে না পেরে ক্যাম্পাসের সবাইকে দুঃসংবাদটি জানানোর জন্য ভাইবার-এ মেসেজ দিলাম।

সর্ব প্রথম কলেজ এ্যাডজুটেন্ট আমাকে কল করলেন। তার কণ্ঠে সুস্পষ্ট অসহায়ত্ব। তবুও তিনি বললেন, আপনি যেতে চাচ্ছেন কি স্যার! আমি এএজি (এসিস্টেন্ট এ্যাডজুটেন্ট জেনারেল, ক্যাডেট কলেজ) স্যারকে জানাবো কি স্যার?

ততক্ষণে সম্মানিত এএজি আমাদের ক্যাম্পাসে পৌঁচেছেন। তাকে আমরা ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করলাম। তিনি কলেজ এ্যাডজুটেন্টের মুখে আমার দুঃসংবাদ শুনে চমকে উঠলেন এবং আমার সঙ্গে করমর্দন করে অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে বললেন, আপনি ইচ্ছে করলে এক্ষুণি রওনা হতে পারেন স্যার।

এমন কথা আমাদের প্রধান অতিথিও বললেন। আমিই মন থেকে সায় পেলাম না যে তিন শতাধিক অতিথি ঘরে রেখে আমি একা শেরপুরে ছুটে যাই। যারা এসেছেন তারা অনেকে আমার পরিচিত হলেও কেউ আত্মীয় নন। আমার বিশ্বাস কলেজে অনুষ্ঠানাদি চলাকালে কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু কোন সমস্যা হলে সবাই আজীবন আমাকে দোষারোপ করবে। কারণ সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার কাঁধে অর্পন করা আছে। এই অসময়ে হঠাৎ আমার দায়িত্ব অন্যের কাঁধে চাপানো কতটুকু যৌক্তিক!

রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সগিরা

অপরপক্ষে আমার শাশুড়িকে চিরদিনের মতো বিদায় জানানো আত্মিক, সামাজিক, নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। আমি সেখানে না গেলে আমার স্ত্রী আমৃত্যু আমার প্রতি মনঃকষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকবেন। আমার প্রতি ঘৃণা পোষণ করবেন। হয়তো আমার মানবিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলবেন। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন স্তম্ভিত হবে ও নানাবিধ কানাঘুষা করবে। তারা আমাকে আর আগের মতো ভালো মানুষ মনে করবে না। আমার ভাবনা স্থির হয় না। আমি ঝড়ের রাতে মহাসাগরে ঢেউয়ের তাণ্ডবে ডিঙ্গি নৌকার মতো দুলতে থাকি। আমার ভিতরটা হু হু করে কাঁদলেও মুখে হাসি ধরে রেখে বললাম, না। আমি হঠাৎ কারও উপর বোঝা চাপিয়ে দিয়ে শেরপুর যাবো না। আমি জানাজায় অংশগ্রহণ না করতে পারলেও পরে গিয়ে দোয়ায় শরিক হবো।

আমার এই কথায় অনেকের মাঝে স্বস্তির ভাব পরিলক্ষিত হলো। অনেকে এগিয়ে এসে সৌজন্য রক্ষার খাতিরে হলেও সহানুভূতি প্রকাশ করলো। কারও কথা শুনে একটু ভালো লাগলেও কারও কারও কথা কষ্টকর মনে হলো। কারণ তারা আমাকে একজন ষণ্ড, ভণ্ড, পাষণ্ড ও নিষ্ঠুর হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলেছেন। তারা আমার চাকুরির আগে মানবিক দিক নিয়ে ভাবতে বললেন। আমি আবারও দুদোল্যমানতায় ভূগতে লাগলাম। আমার দায়িত্বের গুরুত্ব বেশি, নাকি আমার মনুষত্বের গুরুত্ব বেশি। আমার কাছে এর উত্তর খুব কঠিন মনে হলো। এটা আমার কাছে ডিম আগে, না মুরগী আগে- সেই জটিল প্রশ্নের আকার ধারন করলো।

আমি আবারও ক্ষণিক ভাবলাম। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন হয়তো আমার অসহায়ত্ব ও চাকুরি বা দায়িত্বের গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করবে না। তারা জানবে তাদের ছোট জামাতা দাফন-কাফনে অংশ নেয়নি। তাদের হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ আজ আমাকে মন্দ বলে দু-দিন বাদে ভুলে যাবে। কিন্তু এই কলেজে যাদের নিমন্ত্রণ করে এনেছি তারা আমাকে সারা জীবন মনে রাখবে। আমাকে ক্ষমা করবে না। এটাকে তারা পলায়নপর মনোবৃত্তি মনে করবে। তারা অবরে-সবরে আমাকে গাল-মন্দ করবে।

আর আমার স্ত্রী! আমার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ তিনি। তার সবচেয়ে বড় প্রিয়জন হারানোর শোকের মুহূর্তে আমি পাশে নেই। অথচ তিনি আমার সুখের জন্য রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা প্রাণাতিপাত পরিশ্রম করেন। তিনি আমার সঙ্গে তেত্রিশ বছর আছেন। তিনি বিগত ঊনত্রিশ বছর যাবৎ ক্যাডেট কলেজে আমার চাকুরির ধারা, আমার কর্তব্যনিষ্ঠা ও দায়িত্বপালনে একাগ্রতা সম্পর্কে জানেন। তিনি আজ ভীষণ কষ্ট পাবেন বটে কিন্তু কাল হয়তো আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। নয়তো আমি চিরকাল তার ঘৃণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকবো। আমি শেরপুরে না যাওয়ার আমার সিদ্ধান্তে অটল রইলাম।

জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না। নিয়তির নির্মম পরিহাস অনেকবার দেখেছি। যখন এক বাড়িতে কারও স্বজন হারানোর আর্তনাদ শোনা যায়, তখন তার পাশের বাড়িতে বিয়ের সানাই বাজে। শেরপুরে যখন আমার শাশুড়ির লাশ সামনে রেখে আমার সমন্ধীর ছেলে বিজাতীয় ভাষা আরবিতে জানাজা পড়াচ্ছিল তখন আমি মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে আরেক বিজাতীয় ভাষা ইংরেজিতে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখছিলাম। যখন আমার শাশুড়ির দাফন সম্পন্ন হচ্ছিল তখন আমি সকলের হাতে পুরস্কার ও উপহার তুলে দিচ্ছিলাম। আর দাফন শেষে সবাই যখন হাত ধুয়ে ঘরে ফেরার জন্য পা বাড়াচ্ছিল তখন আমি অভ্যাগত অতিথিদের সঙ্গে কাঁটাচামচ ব্যবহার করে দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলাম।

আন্তঃক্যাডেট কলেজ ম্যাথ অলিম্পিয়াড -২০২২ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হলো। অতিথি ও ক্যাডেটবৃন্দ একে একে নিজ গৃহে ফিরে চললেন। অনেকে নিখুঁত আয়োজনের জন্য আমাকে খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানালেন। আবার অনেকে আমার শাশুড়ির জন্য দোয়া করলেন এবং আমাকে সমবেদনা জানাতে ভুললেন না। অনেকে আমার স্ত্রীর জন্য দোয়া ও শুভেচ্ছা জানালেন। আমি অসহ যন্ত্রণা বুকে চেপে রেখে কোন প্রকার ঝুট-ঝামেলা ছাড়াই সবকিছু সমাপ্ত হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

কলেজ এ্যাডজুটেন্ট এগিয়ে এসে আবারও আমাকে শেরপুর যাত্রার অনুরোধ করলেন। রাতে ঘুম হয়নি। সারাদিন শারীরিক ও মানসিক ধকল সয়েছি। আমার শাশুড়ি বস্তু জগতের ঊর্ধ্বে সবার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন। এখন জীবিতরা তার জন্য শুধু দোয়াই করতে পারে। এই দোয়ার জন্য স্থান-কাল-পাত্রের প্রয়োজন পড়ে না। এই দোয়ার জন্য কোন কবর বা কারও সামনে উপস্থিত হতে হয় না। সুতরাং আমার এই মুহূর্তে শেরপুর যাওয়া আর না যাওয়া সমান কথা। আমার জন্য যতটুকু ক্ষতি ততটুকু হয়ে গেছে। আমি অনেকের সামনে এক অমানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছি। ওরা আমাকে গ্রাম্য ভাষায় চামার বা কসাই বলেও হয়তো গালি দিবে।

আমার স্ত্রীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য শুধু আমি কাছে নেই। তার বড় মেয়ে ও জামাতা আছে। তার মেজো মেয়ে আছে। তার ছোট মেয়ে পরীক্ষার কারণে ঢাকা থেকে শেরপুর যেতে না পারলেও ক্ষণে ক্ষণে মোবাইলে সান্ত্বনা দিয়েছে। তার ছেলে পাশে আছে। সৌভাগ্যক্রমে আমার বড়ভাই শেরপুর ছিলেন। তিনি জানাজায় শরিক হয়েছেন এবং তিনিও আমার স্ত্রীর পাশে আছেন। শুধু আমি এক মূর্তিমান পাষণ্ড হয়ে তার সামনে অনুপস্থিত রইলাম। আমি কম্পিত পায়ে বাসায় ফিরে এলাম। শ্বশুরবাড়িতে অনেককে মোবাইলে কল করলাম। কেউ আমার কল রিসিভ করলো না। এমনকি আমার স্ত্রী, কন্যা ও পুত্রও না।

আমি আমার ভুলের মাশুল গোনার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হলাম। ‍ওজু করে আসরের নামাজ পড়লাম। আমি সাধারণত নামাজের পর আমার সকল মৃত আত্মীয়ের সঙ্গে সম্পর্ক এবং ক্ষেত্র বিশেষ নাম উচ্চারণ করে তাদের ক্ষমা ও বেহেস্ত প্রাপ্তির জন্য দোয়া করি। আজ সেই তালিকায় আরও একজন সংযোজন হলেন। আগে শুধু শ্বশুরকে স্মরণ করতাম। আজ নামাজের পর দোয়ায় শাশুড়িকেও উল্লেখ করলাম। তখন আমার চোখের কোণে পানি এলো। আমি সেজদায় পড়ে আমার শাশুড়ির জীবনের গুণাহ খাতা মুছে দেওয়া ও তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দানের জন্য পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্ পাকের দরবারে কায়মনোবাক্যে দোয়া করলাম।

বিকেল সোয়া চারটার দিকে বড় মেয়ে মোবাইলে কল করে জানালো তারা শেরপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছে। তারা মির্জাপুর হয়ে যাবে। মাইক্রোবাসে দশজন আছে। তাদের জন্য রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হবে। একটু পর আবারও কল করে সে দশ জনের হিসাব দিল। আমার বড়ভাই, বড়বোন, আমার স্ত্রী, আমার সমন্ধীর ছেলে-মেয়ে, আমার দুই মেয়ে, ছেলে, ভায়রার ছেলে ও গাড়িচালক আছে। আমি অপরের সহায়তা নিয়ে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করলাম। ইতোমধ্যে খবর পেলাম, কলেজ থেকে সবাই ফিরে গিয়ে আমার অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতা দেখে অনেকে আমাকে ধিক্কার জানাচ্ছে। খুব কম সংখ্যক মানুষ আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে নিষ্ঠার বিষয়ে প্রসংশা করছে।

রাত পৌণে দশটার দিকে মাইক্রোবাস বাসার সামনে এসে থামলো। একে একে সবাই গাড়ি থেকে নামলো। তারা আমাকে পাশ কাটিয়ে বাসায় ঢুকলো। কেউ আমার সঙ্গে কথা বললো না। আমার স্ত্রী আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। শুধু আমার বড়বোন অনিচ্ছাতেও জিজ্ঞেস করলেন, ভালো আছিস ভাই?

তারা বাসায় ঢুকে যার যার মতো মুখ-হাত ধুয়ে খেতে বসলেন। আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার সমন্ধীর মেয়ে ক্ষোভ চেপে রাখতে পারছিল না। তাই সে কোন খাবার স্পর্শ করলো না। সবার খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে সর্ব প্রথম সেই মেয়েই প্রশ্ন করলো, এটা কিভাবে সম্ভব যে আপনি আপনার শাশুড়িকে শেষবারের মতো দেখতে গেলেন না! আপনার চাকুরি আগে, নাকি আপনার সংসার আগে!

আমি উত্তর দেওয়ার আগেই আমার মেজো মেয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়লো। সে কেঁদে ফেলে বললো, তুমি সারাজীবন চাকুরি করেছো। তোমার কাঁধে অর্পিত সকল দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছো। শুধু সংসারটাকে অহেতুক ও এক বড় বোঝা মনে করেছো। আম্মুর যত্ন নাওনি। আমাদের খোঁজ নাওনি। আজ তুমি কোন অজুহাত খাড়া করো না। আমরা কোনভাবেই তোমার নিষ্ঠুরতা মেনে নিতে পারছি না। আজ দাদী মারা গেলে তুমি কি করতে! দাদীকে শেষ দেখার জন্য শেরপুর যেতে না!

বড় মেয়ে নীরব রইলেও চেখের পানি সামলাতে পারলো না। বুঝলাম তার কণ্ঠেও একই অভিযোগ শুনতে হবে। ছেলেও আমার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ভায়রার ছেলেও কঠিন ভাষায় যা বললো তা তিরষ্কারের মতো শোনালো। বড়ভাই শুধু একটি কথা বললেন, এটা অন্যায়। কাজটি মোটেও ঠিক করিসনি।

আমাকে নির্বাক ও আমার চরম অসহায়ত্ব দেখে বড়বোন প্রথমত সবাইকে থামানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু কেউ থামতে চায় না। সবাই আমাকে কথার বাণে জর্জরিত করলো। আমার স্ত্রীও ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তুমি শেরপুর না গেলেও আমার মাকে দাফন করা সম্ভব হয়েছে। আজ আমি মরলেও হয়তো তুমি কবর দিতে যেতে না।

অন্যরা থামতেই বড় বোন বললেন, আমরা কোনভাবেই তোর এই আচরণ মেনে নিতে পারছি না। তোর কাছে আপনজনের চেয়ে অতিথি বড় হলো! তুই কলেজের অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকলে কি-ই বা আসতো যেতো!

আমার মা আমাকে মোবাইলে কল করে বললেন, তুমি এতোটা অমানবিক কেন! তুমি তোমার শাশুড়ির জানাজায় গেলে না। আমার মৃত্যুর পর যেতে পারবে তো!

যেহেতু কেউ আমার কথা শুনতে চাইলো না তাই আমিও মুখ খুললাম না। তারা যার যার মতো আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ও প্রচণ্ড ঘৃণা প্রকাশ করলো। আমার মেজো মেয়ে আমার মুখের দিকে তাকালো না। সে ঢাকায় যাওয়ার জন্য সবার আগে গাড়িতে গিয়ে বসলো। এরপর ভাই-বোন ও অন্যরা বেরিয়ে গেলো। তাদের বিদায় জানানোর জন্য আমি বাইরে গেলাম না। মাইক্রোবাস চলে গেল। স্ত্রী, বড় মেয়ে ও ছেলে দোতলায় উঠে গেল। আমি দীর্ঘক্ষণ একা একা সোফায় বসে রইলাম। আমার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো। আমার কানে ভোঁ ভোঁ শব্দ শুনতে লাগলাম।

আমি আবারও বিছানায় শুয়ে ছটফট করলাম। চোখে ঘুম এলো না। কুর’আন ও হাদিসের কথা স্মরণ হলো। শুক্রবারে খুৎবায় ঈমাম-মুয়াজ্জিনের বয়ান কানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো। অনেক মুরব্বীজনের উপদেশ বাণী্ও কানে কানে বাজতে লাগলো। অনেক গল্প-কবিতাও মনে এলো। আমার ভালো-মন্দ বিচার ক্ষমতা একেবারেই লোপ পেয়েছে বলে মনে হলো। আমি অতিথির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে গিয়ে পারিবারিক, সাংসারিক ও সামাজিক দায়িত্বপালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে সকলের ধিক্কার আর ধিক্কার শুনতে লাগলাম। 

আমি কিছু ভাবার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। আমি কিছু লেখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। আজ গদ্যের একটি লাইনও আমার মনে এলো না। কবিতা বা ছড়ার কোন পঙক্তি মনে এলো না। কোন হাসি-তামাশা, সুখ-দুঃখ নিয়েও কোন সংলাপ মনে এলো না। অথচ আমি প্রতিদিন কত কিছু লেখি। 

কবিগণ প্রেম-বিরহ, ঘাত-প্রতিঘাত, ভালোবাসা-নিষ্ঠুরতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি নিয়ে গল্প-কবিতা-নাটক-উপন্যাস লিখেন। আজ প্রাচীন কবি জ্ঞানদাসের কবিতার কয়েকটি পঙক্তি মনে পড়লো। মনে হচ্ছে সুদূর অতীতের কবি আমাকে উদ্দেশ্য করেই এসব লিখে গেছেন :

সুখের লাগিয়া                    এ ঘর বাঁধিনু

            অনলে পুড়িয়া গেল।

অমিয়-সাগরে                    সিনান করিতে

            সকলি গরল ভেল।


মো. কামরুজ্জামান

উপাধ্যক্ষ, মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ।