রোকেয়া হলের দিনগুলি

শিরিন হোসেন


সেই কবেকার কথা। আটচল্লিশ বছর হতে চললো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ১৯৭৪-৭৫ সনের সেশনে অনার্সে ভর্তি হলাম। আমার স্কুল, কলেজ সবই ছোট ছিমছাম জেলা শহর কুমিল্লায়। মনে ভয় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় টিকবো তো? তাছাড়া দেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। সেশন জট কমানোর লক্ষ্যে মাত্র ছয়মাস উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস করেই সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা দিয়েছি। এই লেখাপড়া দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য হবে কি?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলাম, বাংলা আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান। দেখলাম দুটোতেই টিকে গেছি। শুধু টিকে যাওয়াই নয়, বেশ ভালোভাবে টিকেছি, নাম উপরের দিকে আছে। সিদ্ধান্ত নিলাম রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ব। এই সিদ্ধান্তের পেছনেও স্মরণীয় এক ঘটনা রয়েছে যা আজ বলার লোভ সামলাতে পারছি না।

ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বাংলারটাই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। আমি দারুণ আনন্দিত। সদ্য স্বাধীন দেশ, দেশের প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি তীব্র ভালোবাসা থেকে বাংলায় পড়ার ইচ্ছে জন্মেছিল। সেই সময় শুধু আমি নয়, এই আকাঙ্ক্ষা আরো অনেকেরই ছিল। বাংলায় আমার ভাইবা বোর্ডে ছিলেন স্বনামধন্য প্রয়াত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান।

তিনি জানতে চাইলেন আমি আর কোন ডিপার্টমেন্টে পরীক্ষা দিয়েছি কি না। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কথা জানালাম।

তিনি মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বললেন, আমি তো শিক্ষক মানুষ, উপদেশ দিতে অভ্যস্থ, তোমাকে কি একটা উপদেশ দেবো? আমি বললাম, খুব খুশি হবো স্যার। তিনি যেটা বললেন তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি বললেন, আমি তোমাকে বলবো, তুমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা কর। যদি সে ডিপার্টমেন্টে তোমার হয়ে যায়, তবে সে বিষয়েই ভর্তি হইয়ো।

আমি বললাম, ‘স্যার, শেষ পর্যন্ত যদি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে না হয়, আর ততদিনে যদি বাংলা ডিপার্টমেন্টের ভর্তি শেষ হয়ে যায় তখন আমি কী করবো’?

স্যার বললেন, ‘কোন ভয় নেই, আমি তোমাকে কথা দিলাম, না হলে আমি তোমাকে বাংলাতে ভর্তি করে নেব। তবে আমার বিশ্বাস, তুমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও ভর্তির সুযোগ পাবে’। স্যারের কথা সত্যি হয়েছিল। স্যারের পরামর্শ অনুযায়ী আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানেই ভর্তি হলাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, প্রশাসনিক সুবিধার জন্য প্রত্যেক ছাত্র ছাত্রীকেই কোন একটা হলের সাথে এটাচড হতে হয়। টিউশন ফি সহ যাবতীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম হলকে ঘিরেই হয়।

আমার বাবা সে সময় ঢাকায় সরকারের মন্ত্রণালয়ে চাকুরি করলেও উনাকে সম্প্রতি নতুন স্থাপিত ‘পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, বগুড়া’ এর পরিচালক (বর্তমান মহাপরিচালক) পদে বদলি করা হয়েছে। আমার পরিবারও বগুড়া চলে যাবে, তাই আমাকে হলে আবাসিক ছাত্রী হিসেবে থাকতে হবে।

তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের তিনটি হল ছিল, রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল আর সমাজকল্যান ডিপার্টমেন্টের জন্য নিউমার্কেটের কাছে পৃথক আরেকটি হল। ভাবলাম রোকেয়া হলের ঐতিহাসিক মূল্য আছে, শামসুন্নাহার হল নতুন, তাই সুযোগ – সুবিধা ভালো হবে। আমি কোন হলে থাকব? মনে প্রশ্ন আসতেই সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমে হল দুটি দেখব, তারপর সিদ্ধান্ত নেবো।

ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হতে চাইলে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকেই যে কোন একটি হলের সাথে এটাচড হতে হয়। আমি দ্বিধায় পড়লাম, কোন হলে এটাচড হব? রোকেয়া হল আর শাসুন্নাহার হল পাশাপাশি। সিদ্ধান্ত নিলাম, দুটি হলই দেখব, তারপর ঠিক করব কোথায় থাকবো।

একদিন এলাম হল দুটি দেখতে। গেট দিয়ে হলে ঢুকতে দিবে, কিন্তু ভিতরে যাবার পারমিশন নেই। তখন সম্ভবত বসন্তের শুরু। দেখা শুরু করলাম শামসুন্নাহার হল থেকে। লাল সাদা মিশেল ইটের সুন্দর হল। হলটা হয়েছে বেশিদিন হয় নি তাই, নতুন নতুন ভাবটা আছে। সামনে ছোট্ট বাগান, বাগানে হাওয়ার দোলা। সদ্য তরুণীদের আনাগোনা। তাদেরকেও ফুলের মতই লাগছে। কেউ উচ্ছল, কেউ শান্ত, কেউ শাড়ি পড়া, কেউ সেলোয়ার কামিজ, কেউবা জিন্স, কুর্তা। সব মিলিয়ে ভালো লাগলো। এবার রোকেয়া হলে যাওয়ার পালা।

রোকেয়া হলের বড় গেইটের ছোট অংশ দিয়ে ঢুকেই চমকিত হলাম। চুম্বকের মত চোখকে টেনে নিল ফুলের বাগান। মেইন গেইট থেকে সরু রাস্তা চলে গেছে বিভিন্ন বিল্ডিং এর দিকে, আর সরু রাস্তার দুধারে চমৎকার সব বর্ণিল ফুল ফুটে আছে। ডালিয়া, কসমস, জিনিয়া, ডায়ান্থাস আর গাঁদা ফুল। সমস্ত মাঠ যেনো ফুলের রঙের ছটায় রঙীন হয়ে উঠেছে। ডালিয়া ফুলগুলো বাতাসের দোলে দুলছে; যেন গাইছে,

“ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে”।

গেট থেকে সোজা চোখে পড়ে নজরকাড়া স্থাপত্যশৈলীর মেইন বিল্ডিং। লাল ইটের তৈরি। গেইট থেকে ডানে সামান্য গেলেই সেই বিখ্যাত চামেলি হাউজ। চামেলি হাউজ যেন পুরাতন অভিজাত কোন বাড়ি। কেমন চোখ আর মন দু’টোই টানে। দেখি, কী সুন্দর মাধবীলতা, গ্রীবা বাঁকিয়ে, ফুলের সৌন্দর্য ছড়িয়ে, ভালোবাসায় চামেলি হাউজকে জড়িয়ে উঠে গেছে উপরের দিকে। একদিন এই চামেলি হাউজেই গড়ে উঠেছিল নারীদের প্রথম আবাসিক হল।

হাতের ডানে দারোয়ানদের রুম, বামে ভিজিটর্স রুম। ভিজিটর্স রুমের সাথে বিশাল রেইন ট্রি। গাড় কালো গাছের কান্ড, কালো শাখা প্রশাখার মাঝে সবুজ চিরল পাতা। কালোও যে এত সুন্দর হয় জানা ছিল না। গাছে ফুটে আছে গোলাপি রঙের শানপাপড়ির মত চিরল পাপড়ির ফুল। গাছ ছাপিয়ে চোখ চলে গেল অবাক করা এক দৃশ্যে, যা ভাবনার অতীত। দেখছি বিরাট শান বাঁধানো ঘাটের এক বিশাল দিঘি, সেখানে কাক চক্ষু জলের মত টলটল করছে জল। ঘাটে বৈঠাসহ একটা ছোট নৌকাও বাঁধা আছে। পুকুরের কোনায় ফুটে আছে লাল শাপলা। এর চাইতে অপূর্ব কোন দৃশ্য আর হতে পারে না।

প্রকৃতিপ্রেমী আমি মনে মনে রোকেয়া হলে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। আর শুধু কী সৌন্দর্য ? এ হলের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস।

সাল ১৯৩৮ এ মাত্র ১০/১২ জন ছাত্রী নিয়ে চামেলি হাউজে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই উইমেনস হোস্টেলের। সাল ১৯৫৬ এ এটি “উইমেনস হল” নামে স্বীকৃতি পায়। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাক-ভারত উপমহাদেশের নারী জাগরণ এবং নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্মরণে এ হলের নামকরণ করা হয় “রোকেয়া হল”। এ হলের প্রথম প্রভোস্ট হিসেবে নিয়োগ পান দর্শন বিভাগের অধ্যাপক বেগম আখতার ইমাম। ১৯৬৪ সালেই এ হলের দৃষ্টিনন্দন পাঁচতলা ভবনটি আমেরিকান সরকারের অনুদানে তৈরি করা হয় যা মেইন বিল্ডিং নামে পরিচিত।

বাংলাদেশের ইতিহাসে রোকেয়া হলের ছাত্রীদের নাম চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। সাল ১৯৬৬ এর ছয়দফা আন্দোলন, ‘৬৯ এর এগারো দফা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে রোকেয়া হলের ছাত্রীরা ছিলেন আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে। সাল ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় এ হলের ছাত্রীরা পাক আর্মি এবং তার দালালদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন।

আজ থেকে প্রায় ৫০ বছরেরও আগে ১৯৭২ সালের ২৪ মার্চ রোকেয়া হল প্রাঙ্গণে উন্মোচিত হয়েছিল পাক বাহিনীর নির্মমতার এক নিদর্শন। হলে পাওয়া গিয়েছিল গনকবর। সে গনকবর খুঁড়ে সেদিন আবিষ্কার করা হয়েছিল পনেরোটি মাথার খুলি, সোনার চুড়িসহ বহু হাড়গোড়। পঁচিশে মার্চে ঢাকায় থাকা তৎকালীন মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড

এর অবমুক্ত হওয়া গোপন দলিলে জানা যায় রোকেয়া হলের সিলিং ফ্যানে ছয়টি ছাত্রীর হাত-পা বাঁধা মৃতদেহ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় তাদেরকে শারিরীক ভাবে নির্যাতন করার পর গুলি করে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

মনে মনে শ্রদ্ধা জানালাম এই বীরকন্যাদের। মুক্তিযুদ্ধ আমরাও দেখেছি। পাকসেনা, তার দোসর রাজাকার, আলবদরদের অত্যাচারের কথা আমাদের অজানা নয়। নয়মাস ছিলাম অবরুদ্ধ। সদ্য স্বাধীন দেশে পড়তে এসেছি স্বাধিকার আন্দোলনের কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সব বিবেচনা করে আবাসিক হল হিসেবে রোকেয়া হলে থাকার সিদ্ধান্তই অবশেষে চূড়ান্ত করলাম।
লেখক: উন্নয়ন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ