বাতাস যখন ভয়ঙ্কর

মিলন কিবরিয়া

মিলন কিবরিয়া

এমনটা হয় আমাদের। কোন কোন বিষয় আমাদের জীবনে এতোটাই স্বাভাবিক আর নিয়মিত যে তার গুরুত্ব আলাদা ভাবে টের পাই না। এই যেমন বাতাস। বাতাস আমরা না দেখতে পাই, না ধরতে পারি। অথচ বাতাসের সমুদ্রে আমাদের বসবাস, আমাদের বেঁচে থাকা। বাতাস নেই মানে আমি নেই, তুমি নেই, আমরা নেই। প্রাণের অস্তিত্ব নেই।

বাতাসে আছে আমাদের জীবনের জ্বালানি অক্সিজেন। এই কোভিড সময়ে আমরা দেখেছি অক্সিজেন আমাদের কী ভাবে বাঁচিয়ে রাখে!

বাতাস নাক-মুখ দিয়ে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। শ্বাস তন্ত্রের বিভিন্ন নালি পেরিয়ে পৌছে যায় আমাদের ফুসফুসে। সেখানে আছে প্রায় ৬০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ছোট ছোট বায়ু থলি।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই বায়ু থলির নাম অ্যালভিওলাস (Alveolus, বহু বচনে Alveoli)। এই বায়ু থলিগুলোর দেয়াল খুবই সূক্ষ, বাতাস এই বায়ু থলি থেকে রক্তে পৌঁছে যায় অনায়াসে আর তার মাধ্যমে সারা দেহে। 

এই পুরো ব্যবস্থাপনা আমাদের সুস্থ থাকার, ভালো ভাবে বেঁচে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি আমাদের অসুস্থতার কারণ হয়।

অনেক সময় এই বায়ু থলি ফুটা হয়ে যায়। ফলে বায়ু থলির বাতাস ফুসফুস থেকে বের হয়ে আমাদের বুকের ভিতরে জমা হয়। ফুটা হলে বেলুন যেমন চুপসে যায় তেমনি ফুসফুসও চুপসে যায়, হতে পারে তা পুরোপুরি বা আংশিক।No description available.

এই চুপসে যাওয়া ফুসফুসে বাতাস থাকে না বা কম থাকে। ফলে শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণও যায় কমে। অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে আমাদের শ্বাস কষ্ট হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই অবস্থার নাম নিউমোথোরাক্স, সহজ বাংলায় বলতে পারি ‘বুকের ভেতর বাতাস জমা হওয়া’।

নিউমোথোরাক্সের তীব্রতর ধরণকে বলে ‘টেনশান নিউমোথোরাক্স’ । এই অবস্থায় বুকের ভেতরে ক্রমাগত বাতাস জমতে থাকায় বুকের ভিতরে থাকা হৃৎপিণ্ডের উপর চাপ পড়ে, রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। শ্বাসকষ্টও হয় ভয়ঙ্কর রকমের। রোগীর জীবন হয়ে পড়ে সংকটাপন্ন। জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা না নিলে মৃত্যু অবধারিত।

ফুসফুস আংশিক চুপসে থাকলে বা ‘টেনশান’ তৈরি না হলে অনেক সময় নিউমোথোরাক্স দেরিতে শনাক্ত হয়। রোগের লক্ষণের কম তীব্রতার কারণে এমনটি হয়। যেমন পরিশ্রমের কারণে শ্বাস কষ্ট বা হাঁপ ধরা, বুকে ব্যথা এবং কাশি।

যাদের ফুসফুস রোগাক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে নিউমোথোরাক্স হওয়া এবং লক্ষণ তীব্র হওয়ার ঝুঁকি বেশি। ধূমপানের কারণে হওয়া ফুসফুসের একটি রোগ সিওপিডি (COPD), এই রোগীদের নিউমোথোরাক্স বেশি হয়।

দুর্ঘটনা নিউমোথোরাক্সের আরেকটি অন্যতম কারণ। সড়ক দুর্ঘটনা, উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়া, মারামারি কিংবা ছুরি বা ধারালো কোন যন্ত্র বা অস্ত্রের জখমের ফলে এমনটি হয়।

যে একবার নিউমোথোরাক্সে আক্রান্ত হয়েছে তার দ্বিতীয়বার নিউমোথোরাক্স হওয়ার আশঙ্কা বেশি, দ্বিতীয় বার হলে তৃতীয় বার। এই কারণে প্রথম নিউমোথোরাক্সের পর রোগীকে সতর্ক করা হয়, পরামর্শ দেয়া হয়। ড্রাইভার, পাইলট, ডুবুরিদের বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়।

নিউমোথোরাক্সের চিকিৎসা করা হয় একটি  স্বল্প সময়ের ছোট্ট অপারেশনের মাধ্যমে, এই অপারেশনের নাম টিউব থোরাকোস্টমি (Tube Thoracostomy)। বক্ষব্যাধি সার্জনরা এই অপারেশনটি করেন।

দ্বিতীয় আরেকটি অপারেশনও করা হয়। সেই অপারেশনে ফুসফুসের রোগাক্রান্ত অংশ অপসারণ করা হয়। সাধারণত দ্বিতীয়বার নিউমোথোরাক্সের পর এই অপারেশন করা হয়। অনেক সময় প্রথমবার নিউমোথোরাক্সের পরও করা হয়, বিশেষ করে যারা রোগাক্রান্ত ফুসফুসের অধিকারী তাদের। 

ধূমপান ফুসফুসের মারাত্মক সব রোগের কারণ। সিওপিডি(COPD) তেমনই একটি রোগ। ধূমপান ছাড়া কাঠ, কয়লা, তেল, গ্যাস ও অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার এবং দূষণযুক্ত বায়ু সিওপিডির অন্যতম কারণ। এই রোগে ফুসফুসের বায়ু থলির ক্ষতি হয়।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বায়ু থলি ও তার মধ্যবর্তী সূক্ষ্ম পর্দা ধ্বংস হয়। পাশাপাশি থাকা বায়ু থলিগুলো এক হয়ে আকার-আয়তনে বড় হয়। ফলে ফুসফুসের কার্যক্ষম বাযু থলির সংখ্যা কমে যায়। একই সাথে ফুসফুসের বেলুনের মত চুপসে যাওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ফুসফুসের এই অবস্থার নাম এমফাইসিমা (Emphysema)।

ফুসফুসের মূল কাজই হচ্ছে বাতাসের অক্সিজেন রক্তের মাধ্যমে সারা দেহে পৌঁছে দেয়া আর দেহে তৈরি কার্বন-ডাই-অক্সাইড রক্তের মাধ্যমে ফুসফুসে এনে বের করে দেয়া। কার্যক্ষম বায়ু থলির সংখ্যা কমে যাওয়ায় এ কাজটি ব্যহত হয়। স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে বিঘ্ন ঘটে, শ্বাসকষ্ট হয়।
এমফাইসিমা আক্রান্ত ফুসফুসে বাতাসের পরিমাণ স্বাভাবিক ফুসফুসের চেয়ে বেশি, আর ফুসুফুসও এই কারণে আকারে বড় হয়। কিন্তু কর্মক্ষম বায়ু থলির অভাবে এই বাতাস আমাদের কাজে আসে না। 

এমফাইসিমা আক্রান্ত ফুসফুসে রোগ জীবাণুর সংক্রমণ প্রবল শ্বাস কষ্টের কারণ হয়। আমাদের স্বাস-প্রশ্বাসে পুরো ব্যবস্থাপনায় বড় ধরণের বিপত্তি ঘটায়। শ্বাস তন্ত্র তার কার্ককারিতা হারাতে থাকে।

কখনো কখনো পাশাপাশি থাকা অনেকগুলো বায়ু থলি ক্রমাগত একত্রিত হতে হতে অনেক বড় হয়ে যায়। তখন এর নাম হয় বুলা (Bullae)। বুলা আসলে বাতাস ভর্তি ফাঁপা বেলুনের মত। বুলার বেলুন যত বড় হতে থাকে কার্যক্ষম বায়ু থলির সংখ্যাও তত কমতে থাকে।

বুলা তার চারপাশের পূর্ণ বা আংশিক কার্যক্ষম বায়ু থলিগুলোতে চাপ দিয়ে তাদের চুপসে দেয়। চুপসে যাওয়া ফুসফসে রক্ত চলাচল ব্যহত হয়। বুলা ক্রমশঃ বড় হতে থাকলে হৃৎপিণ্ডের উপরও চাপ দেয়, হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।

সিওপিডি রোগ কখনো ভালো হয় না এবং এমফাইসিমা আক্রান্ত ফুসফুসও কখনো স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পায় না। ধূমপান থেকে বিরত থাকলে এবং আর যে সব কারণে সিওপিডি হয় তা পরিহার করলে সাথে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মত ওষুধ সেবন করলে এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

পর্যাপ্ত ওষুধ ব্যবহারের পরও আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া না গেলে আসে সার্জারির সিদ্ধান্ত। বক্ষব্যাধি সার্জন আর অবেদনবিদ মিলে সিদ্ধান্ত নেন কারা এই সার্জারির জন্য উপযুক্ত। এই ধরণের অপারেশনে ফুসফুসের অকার্যকর অংশ অপসারণ করা হয়।

আসলে বাতাস শরীরের মধ্যে নির্ধারিত চলাচলের বাইরে গেলেই বিপত্তি। শুধু যে বুকের ভেতরে এমনটি ঘটে তা নয়; উদরে হতে পারে, হতে পারে মাথার খুলির ভেতরে।

এমনকি ত্বক বা চামড়ার নিচে এসে ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো শরীরে। চিকিৎসকরা এই অবস্থার নাম দিয়েছেন সার্জিক্যাল এমফাইসিমা। ত্বকের নিচে অবস্থানের কারণে এই রোগের আরেক নাম সাবকিউটিনাস এমফাইসিমা।

সাধারণত রোগাক্রান্ত ফুসফুসে ক্ষত তৈরি হলে অথবা শ্বাসনালি ও ফুসফুস জখম হলে এমনটি হয়ে থাকে। চামড়ার নিচে বাতাস জমার কারণে সেই জায়গা ফুলে উঠে, হাত দিয়ে চাপ দিলে ‘পচ পচ’ শব্দ অনুভূত হয়।
মৃদু রোগ সহজেই সেরে যায়, ত্বকের নিচের বাতাস শরীরে মিলিয়ে যায়। চিকিৎসক বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে কারণ শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেন।

অনেক সময় কারণ শনাক্ত না হলে বা নিজে থেকে কারণের উপশম না হলে ত্বকের নিচে এই বাতাস বাড়তে থাকে, পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ঘাড়, গলা, চোখ, মুখ হাত,পা সব ফুলে উঠে। চেহারা বিকৃত হয়, দেখতে ভয় লাগে। রোগ গুরুতর আকার ধারণ করে। এই সময় দরকার হয় শল্য চিকিৎসা, এগিয়ে আসেন বক্ষব্যাধি সার্জন।

লেখক: চিকিৎসক , জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট হাসপাতালের থোরাসিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।