মেয়ে

মুজতাহিদ ফারুকী


দেখ দেখ, এর চোখ দুইটা; কী মায়াবী! শায়লা মন্ত্রমুগ্ধ স্বরে মাহতাবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।শায়লার কোলে বিড়ালের বাচ্চা। বুকের কাছে জড়িয়ে রেখেছে। ছোট্ট একটা প্রাণ। বড় বড় চোখ মেলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। কিছু কি বলতে চায়! জানার উপায় নেই। মুরাকামির কাফকা অন দ্য শোর উপন্যাসের বুড়ো নাকাতাই কেবল বিড়ালের ভাষা বোঝে। তাদের সঙ্গে কথা বলে। নবী সোলেমানের কথা আলাদা। তিনি সব প্রাণী ও জিনের ভাষা বুঝতেন। পিঁপড়ারও। কিন্তু জীবন ফিকশন না, ফ্যান্টাসিও না।
মাহতাব ডিভানে শুয়ে, চোখের সামনে খোলা বই। একবার চোখ ফিরিয়ে দেখে। মুচকি হেসে বলে, সত্যি, খুব মায়াময়। একদম নিশি বিড়ালীনী।
সে আবার বইয়ে মন দেয়।
শায়লার গালে আবিরের লালিমা! অস্পষ্ট। ‘নিশি বিড়ালীনী’র রহস্যে রঙিন। শুধু ওরা দুজনেই জানে। বছর ত্রিশেক আগে মাহতাবের গ্রামের বাড়ি। শীতের রাত। জীর্ণ টিনের ঘর। ফুটোফাটা দিয়ে আসে হিম বাতাস। লেপকাঁথা মানতে চায় না। হাড় কাঁপে। ঘন হতে হতে মাহতাবের বুকের মধ্যে ঢুকে পড়ে নতুন বউ শায়লা। দুটি শব্দ, নিশি, বিড়ালীনী, ধরে আছে সেইসব সোহাগ রাত, রোমাঞ্চের স্মৃতি! প্রথম বর্ষায় কদমের কুঁড়ি।
শায়লা শুধু মৃদু হাসে। এক পলকে কূপিত কটাক্ষ ছুঁড়ে চলে যায় ভিন্ন প্রসঙ্গে। বিড়াল ছানার মাথায় গলায় হাত বুলিয়ে আবার মুখ খোলে,
অ্যাই শোনো না, এটা ছেলে, নাকি মেয়ে?
একটু থমকায় মাহতাব। তাই তো! কথাটা তো মনেই আসেনি। লেজ সরিয়ে দেখে নাও তো!
আমি ঠিক বুঝি না। এত ছোট!
আচ্ছা, বড় হোক, তখন এমনিতেই বোঝা যাবে।
জিতু কিন্তু বলেছে, এটা মেয়ে বাচ্চা।
তাই নাকি? ও কি বিড়াল নিয়ে গবেষণা করছে এখন?
শায়লা অনুচ্চ শব্দে হাসে। করছে তো, নেট ঘেঁটে পেট ক্লাবের খবর নিচ্ছে। কুকুর বিড়াল নিয়ে কত যে গ্রুপ ফেসবুকে! ওদের যত্ন আত্তির নানা খবর খুঁজে বের করছে। তিন মাস বয়স না হলে ভ্যাকসিন দেয়া যাবে না। পাঁচ ছ মাস হলে লাইগেশন।
বাঃ, বেশ তো! তাহলে বিড়াল নিয়ে পুরান কথাও কিছু জেনে নিতে বোলো। মাহতাব পণ্ডিতি ঝাড়ার সুযোগ কখনও ছাড়ে না।
বিড়াল নিয়ে আবার পুরান কথা কী? শায়লার নিতান্তই সাধারণ কৌতুহল।
হিন্দু ধর্মশাস্ত্র বলে, অহেতুক কূট তর্ক করা, কুযুক্তি আর কূটচালে বিতণ্ডা সৃষ্টি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা ভয়ানক পাপকাজ। সেই পাপের শাস্তি সাংঘাতিক। ভগবান পরজন্মে এসব পাপীকে বিড়াল রূপে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। ভাষাহীন নির্বাক এক অনিশ্চিত ইতর জীবন। অবহেলা অনাদরে সেই জীবন কাটিয়ে তাকে পূর্বজন্মের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। এ বড় মর্মান্তিক শাস্তি।
শায়লা আবার হেসে ওঠে, তাহলে তো দুনিয়ার সব বিড়ালগুলো আগের জন্মে পলিটিশিয়ান ছিলো; তাই কি?
হা হা হা, হতেও পারে, শায়লার চিন্তার অভিমুখ দেখে মনে মনে বাহবা দেয় মাহতাব,
তবে এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীরা সম্ভবত এক কাঠি সরেস।
কথা শেষ করে মাহতাব ফের কালো হরফের জগতে চোখ বিঁধিয়ে দেয়। জিতুর বিড়াল-গবেষণা প্রসঙ্গ চাপা পড়ে যায়। 
জিতু ওদের ছেলে। বছরখানেক হলো চাকরি করছে একটি বড় প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে। মনটা এখনও শিশু। এখনও সে ছেলেবেলার পছন্দের খেলনা মিনি কার কিনে ঘর ভরায়। এই বয়সে রিমোট কন্ট্রোল গাড়িও কিনেছে দুই একটা। মাহতাব কিন্তু বাচ্চার জন্য খেলনা কেনায় কখনও কার্পণ্য করেনি। নিজের খেলনাহীন শৈশব তাকে ছেলের ব্যাপারে যথেষ্ট উদার করেছে। কিন্তু ঘর ভরতি খেলনা পেয়েও জিতুর নেশা কাটেনি। ছেলেবেলার পছন্দের খেলনাগুলো এখনও গুছিয়ে রেখেছে। পারতপক্ষে কাউকে হাত দিতে দেয় না।
খুব ছোট থাকতে জিতুর সখ হয়েছিল বিড়াল পোষার। শায়লা কিছুতেই রাজি হয়নি। ঘরে যেখানে সেখানে পেশাব পায়খানা করবে, সুযোগ পেলেই খাবারে মুখ দেবে, বাইরের ময়লা ঘেটে এসে ঘর নোংরা করবে। কে পরিষ্কার করবে সেসব! জিতুর সখ তখনকার মতো চাপা পড়ে যায়। কিন্তু তা যে মরে যায়নি, বোঝা গেল যেদিন অফিসফেরতা জিতু ব্যাগ থেকে ছোট্ট বিড়াল ছানাটি বের করে মেঝেয় নামিয়ে বলে, মা দেখ!
শায়লা দেখে। বাচ্চাটা সত্যি সুন্দর। ধবধবে সাদার মধ্যে হালকা হলুদের ছোপ। মায়াময় চোখ। সব বিড়াল ছানারই চোখ ভর্তি মায়া। সেটা কথা নয়। এই ছানাটি কেবল হাঁটতে শিখেছে। এখনও টলোমলো। দুপা গেলেই বসে পড়ে। তারপর টুলটুল করে তাকিয়ে থাকে। মিউ বলে অস্ফুট করুণ স্বরে ডেকে ওঠে। কারও অসহায়ত্ব শায়লা সইতে পারে না। মন নরম হয়ে যায়। তাও আবার এই রকম কিউট একটা বিড়াল ছানা। বিদেশের দামি ছানা নয়, নির্ভেজাল দেশি। জিতু বললো, খিলগাঁও আনসার হেডকোয়ার্টারের কাছে রাস্তার পাশে মিউ মিউ করছিলো। গাড়ির নিচে পড়তে পারতো, অন্য কুকুর বেড়াল বা মানুষের বাচ্চারাও মেরে ফেলতে পারতো। সে রেসকিউ করে এনেছে। জিতু স্কুলে কলেজে ইংরেজি ভার্সনে পড়েছে। বাংলার সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ছেদ যাতে না হয় সেজন্যে ওকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ানো হয়নি। তবে ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজিই ছিল একমাত্র ভাষা। কে জানে, ‘উদ্ধার’ শব্দটি সে আদৌ জানে কিনা! রেসকিউর মধ্যে একটা বিপন্নতার ইতিহাস ধরা আছে না! মন নরম করা!
হয়তো সেজন্যেই শায়লা আর বিড়াল ছানাটিকে বিদায় করে না। নীরবে মেনে নেয়। চায়ের দুধ গরম পানিতে গুলে এগিয়ে দেয়। বাচ্চাটা খেতে পারে না। অভ্যস্ত না। জিতু বেরিয়ে গিয়ে ওষুধের দোকান থেকে ড্রপার কিনে আনে। তাই দিয়ে খাওয়ানো হয়। এভাবেই চলতে থাকে। তবে এর চেয়েও বড় কারণ ছিলো এই ছানাটিকে মেনে নেবার। সেটা হলো শায়লার অখন্ড অবসর।
বছর দেড়েকের বেশি হলো রিটায়ার করে ঘরে বসেছে শায়লা। হাতে তেমন কাজকর্ম নেই। যদিও সংসারের প্রায় সব কাজ নিজেই করে। মাহতাব তো অফিসের সময়টুকু ছাড়া বই পড়ে বা টিভি দেখেই দিন কাটিয়ে দেয়। সংসারে তার কখনও তেমন মন ছিল না। এখনও নেই। কেন যে সংসার পাততে গিয়েছিল, শায়লার সেই জিজ্ঞাসার জবাব মেলে না। তবু শুরুর দিকে এবং ছেলেটা জন্মানোর পর শায়লার যে রুদ্ধশ্বাস কাজের চাপ ছিল সেটা কমেছে। এখন অবসরে নতুন নতুন কাজে মন দিচ্ছে। সম্প্রতি ইউটিউবে রেসিপির চ্যানেল খুলেছে। তার আগে ইউটিউবের হাজারও টিউটোরিয়াল ভিডিও দেখে শিখে নিয়েছে কীভাবে চ্যানেল খুলতে হয়, কীভাবে সেটা আকর্ষণীয় করা যায় এবং ইউটিউবের রেটিংয়ে আসা যায়। এখন প্রায় প্রতিদিন মনে মনে নতুন রেসিপির আইডিয়া ভাজে আর সেগুলো রান্না করে ভিডিও আপলোড দেয়। বছর বিশেক আগে চাকরি ঠিক রেখেই পর্যটনের স্কুলে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। দেশে তখন ওটাই ছিল রান্না শেখার একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ এবং সম্ভবত এখনও ওটাই সেরা। শেরাটন, সোনারগাঁওয়ের শেফরা ক্লাস নিতেন। সেই ট্রেনিং এখন কাজে লাগাচ্ছে। প্রতিটি রেসিপির নানা উপকরণের জোগাড়যন্ত্র থেকে শুরু করে, রান্না করা, ভয়েস দেয়া, এডিটিং এবং ভিডিও আপলোড,  প্রচুর কাজ। তার পরও একটা বিড়াল পোষার দায়িত্ব সে কেন নিলো সেটাই আশ্চর্য। এখন আবার ভিডিও দেখে দেখে জেনে নিচ্ছে বিড়ালের যত্ন আত্তির নানা তথ্য। খাবার-দাবার, অসুখ-বিসুখ, কী নয়! বিড়াল নিয়ে বেশ সময় কাটছে ওর।


দুই.
বাড়িতে নতুন উদ্বেগ। কিশমিশ হাঁটতে পারছে না। মা ছেলে মিলে বিড়ালছানার এই নাম দিয়েছে। নামটা জিতুর আবিষ্কার। সকালবেলা মাহতাব যখন নাশতা করছে, কিশমিশ ঘুরঘুর করছিল পায়ের কাছে। ওকে তুলে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দেয় মাহতাব। তারপর খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে যায় সিঙ্কে। এসে দেখে চেয়ারে কিশমিশ নেই। খুঁজে পাওয়া গেল বাইরের ঘরের সোফার নিচে। গুটিশুটি। তুলে এনে মেঝেতে ছাড়তে দেখা গেল বসেই থাকছে। দাঁড়াতে পারছে না। পেছনের পা ছেঁচড়ে চলার চেষ্টা করছে। পারছে না। কাতর স্বরে মিউ মিউ ডাকার চেষ্টা করে। গলায় স্বর ফোটে না। মাহতাব অবাক। চেয়ার থেকে পড়ে পা ভেঙ্গে গেছে এমন কখনও হয় বিড়ালের? কি জানি! ওর ডাকে রান্নাঘরের কাজ ফেলে ছুটে আসে শায়লা। কোলে তুলে নেয় ছানাটাকে, কী হয়েছে বাবা, কী? ব্যথা পেয়েছো? ওর চোখ বেদনার্ত।
গত একমাসে চারবেলা দুধ এবং শেষের দিকে সেদ্ধ করা মাছ খেয়ে একটু ঝরঝরে হয়েছে কিশমিশ। সে এখন পুরো বাড়ি জরিপ করে। নিঃশব্দে চক্কর দেয় এ ঘর ও ঘর। শায়লার পায়ের কাছে ঘুরঘুর করে। কখনও পাজামার ঘের, কখনও ঝুলে থাকা ওড়নার প্রান্ত ধরে খেলে। ক্ষুধা পেলে বারবার মিউ-মিউ-উ-উ শব্দ করে জানান দেয়। খাবার দিতে দেরি হলে সে যে অধৈর্য হয়ে উঠছে সেটাও প্রকাশ করে। তখন সে ওই একই মিউ-উ-উ-উ শব্দটাকে আরও দীর্ঘ করে তাতে ঊর্ধ্বটান দিয়ে অধৈর্যের লক্ষণ ফুটিয়ে তোলে। শায়লা হেসে লুটিয়ে পড়ে,
দিচ্ছি তো বাবা, এই তো, একটু গরম করে দিই মা।
মিউ-উ-উ-উ-ঊ-ঊ
হুঁ-উ-উ, দিচ্ছি রে মা-উ-উ!
খাবার গরম তো, একটু ঠান্ডা না হলে খেতে পারবে?
মিউ-উ-উ-উ-ঊ-ঊ,
হ্যাঁ, বুঝেছি, ক্ষুধা লেগেছে, না? এই তো মা, একটু সবুর, এক মিনিট।
ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করতে করতে দ্রুত হাতে খাবার রেডি করে বাটি নামিয়ে দেয় শায়লা, এই নাও, দেখি দেখি, হ্যাঁ, বিসমিল্লাহ করো, বিসমিল্লাহ। বাবারে বাবা, এত ক্ষুধা লেগেছে? তর আর সয় না!
যে কোনও কাজ বিসমিল্লাহ বলে শুরু করা আমাদের নিত্যদিনের সংস্কৃতি। খাবার আগে একদম অপরিহার্যের মত। জিতুকে ছোট থাকতেই শেখানো হয়েছে। শায়লা হয়তো নিছক অভ্যাসের বশেই বিড়ালকেও বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করতে বলে। মাহতাবের হাসি পায়। কিন্তু হাসে না। নিজের সংস্কৃতির প্রকাশ যেমনই হোক এ নিয়ে মশকরা করার মত রুচিবিকার তার নেই। সে নীরবে উপভোগ করে। 
বিড়াল ছানার সঙ্গে শায়লার একতরফা বাক্যালাপেও ভীষণ মজা পায় মাহতাব। বুঝতে পারে, ওর বুকের ভেতর অপত্য স্নেহের যে মহাসাগর চাপা পড়ে আছে সেটা শুকিয়ে যাওয়া কাস্পিয়ানের মত  বালু আর নুনে ভরে যায়নি। এখনও সজীব আছে আর তাতে দূরের হাওয়া এলে এখনও উত্তাল ঢেউ ওঠে। শায়লা প্রায়ই আফসোস করে জিতুকে নিজের হাতে আদর যত্মে মানুষ করে তুলতে না পারার জন্য। চাকরির পুরোটা সময় জিতু থেকেছে তার বড় খালার বাসায়। বলা যায়, সেখানেই মানুষ। খালাতো ভাই বোনরা প্রাণ ঢেলে জিতুকে আদর দিয়েছে। কোলে পিঠে করেছে। বড় খালাকেই সে আম্মা ডাকে। শায়লাকে মা।
শায়লা অফিস শেষে বড় বোনের বাসা হয়ে জিতুকে সঙ্গে করে ফিরে আসতো। রাতটুকু জিতুর কাটতো বাবা-মার সঙ্গে। ওই যে পুরো সময় ছেলেকে কাছে না পাওয়া, তাকে প্রতি মুহূর্তে চোখে চোখে রেখে বড় করে তুলতে না পারা সেইসব অপ্রাপ্তিগুলো এখনও ওর বুকের মধ্যে থমথমে বিশাল পাথরের মত চাপ ধরে আছে। মাঝেমধ্যে সেটা বলেও সে,
ছেলেটা একা একা মানুষ হলো, ওকে বুকে ধরে একটু আদর দিতে পারিনি, এমনই তো মা আমি!
এ এক গভীর হাহাকার। খাঁ খাঁ মরুর বুকে অবাধে বয়ে যাওয়া তপ্ত লু হাওয়া, যার কোনও উপসম নেই, শীতলতার সামান্য আশ্বাস নেই।
এখন একটি বিড়ালছানাকে কেন্দ্র করে স্নেহের সেই ফল্গুধারারই স্ফুরণ হয়তো দেখা যাচ্ছে। মাহতাব মনে মনে এভাবেই ব্যাখ্যা করে ব্যাপারটা। কিন্তু জিতুর জন্মের আগে মাহতাব আর শায়লার একটা মেয়েও হয়েছিল। জন্মের সময়ই তাকে খেয়ে দিয়েছিল পিজির গাইনির ইন্টার্ন ডাইনিগুলো। রোগীর পেটে বাচ্চা ইনহেল করেছে বা কি সমস্যা হয়েছে দেখার অবকাশ তাদের হয়নি। ডিউটিতে এসে বেঘোরে ঘুমিয়েছিল। ডেলিভারির পর সাকার মেশিন লাগিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে বটে কিন্তু শ্বাস ফেরেনি মেয়ের। সদ্যজাত মেয়ের লাশ নিয়ে বাসায় ফিরেছিল মাহতাব শায়লা। সেই মেয়ের প্রসঙ্গ তারা কেউই সহসা উচ্চারণ করে না। মেয়ে হারানোর শোক যেন এক পবিত্র কালো পাথর। শোকের সাগরের খুব গভীরে সযত্মে ডুবিয়ে রেখেছে। তুলে আনলেই উবে যাবে কর্পুরের মত। ওই প্রসঙ্গ তাই কদাচিৎ ওঠে।

তিন
পরিবারের এই নতুন সদস্য, কিশমশ ওদের প্রাত্যহিক কথাবার্তার অনেকটা অংশ দখল করে নেয়। ওর খাবার প্রসঙ্গ, ওড়না টেনে হুটোপুটি, পায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা বা হাত চেটে সন্তোষ প্রকাশ এসব আলোচনা অনেকটা সময়জুড়ে থাকে। শায়লা বলে,
জানো, আজ নিজে নিজে ডিভানে উঠেছে। দুই কুশনের ওপর বসে দারুণ ঘুম দিয়েছে।
তাই নাকি, কিভাবে উঠলো?
তা দেখিনি, সারা দিন ওখানেই শুয়ে বসে কাটিয়েছে।
কখনও বলে, তুমি যে লাল বল এনেছো ওটা দিয়ে কিশমিশ খেলতে পারে না। একটু নাড়ালেই গড়িয়ে ফ্রিজের বা বুক শেলফের নিচে চলে যায়। খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি ওকে কাগজ দলামোড়া করে বল বানিয়ে দিয়েছি। খুব খেলেছে সেটা দিয়ে। সত্যিই বিড়াল ছানাটা প্রাণবন্তু হয়ে উঠেছে। এখন মাহতাবের সঙ্গেও খেলে। অফিস থেকে ফিরে প্রথমেই কিশমিশকে নিয়ে কিছু সময় খেলা করে মাহতাব। ছানাটা লাফিয়ে, ঝাপিয়ে, ছোট্ট দাঁত ও নোখ দিয়ে আঁচড়ে কামড়ে আনন্দ প্রকাশ করে। কখনও শিকারী বাঘের মত গুটিশুটি মেরে ওৎ পেতে বসে। তারপর এক পা দুপা করে এগিয়ে হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে। আবার ছুটে কোথাও গিয়ে সোফার নিচে বা দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। সেখান থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে, যেন শিকারের অজ্ঞাতে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে এমনভাবে হুট করে ঝাপিয়ে পড়ে। দেখে অনাবিল আনন্দ পায় মাহতাব আর শায়লা। জিতুও অনেকটা সময় ছানাটাকে নিজের কাছে রাখে। বুকের ওপর বসিয়ে বা পেটের ওপর নিয়ে শুয়ে থাকে। ওর নোখ ছেঁটে দেয়। কখনও ভেজা রুমালে গা মুছে দেয়। নিজের হাতে খাওয়ায়ও।
মাহতাবের মনে পড়ে, জিতু যখন হাসতে শিখছে, বালিশে হেলান দিয়ে বসতে শিখছে, টলোমলো পায়ে বা ওয়াকারে হাঁটছে অথবা মুখে এক দুটো বোল ফুটছে তখনও প্রতিটি নতুন ঘটনায় তাদের সে কী বিস্ময়, সে কী উত্তেজনা! যেন একটা আস্ত মানুষ পুতুল, যা তাদের একান্ত অস্তিত্ব দিয়ে গড়া। শুধুই তাদের দুজনের। এ যে কী অপূর্ব আনন্দ, কী অপার প্রশান্তি! সেটা অক্ষুন্ন ছিলো ওর বেড়ে ওঠার পুরো বছরগুলো। শায়লা ওকে কোলে নিয়ে টিভি দেখতে বসতো। অনুষ্ঠান যতক্ষণ চলে ততক্ষণ জিতুর মনোযোগ নেই টিভিতে। যেই না বিজ্ঞাপন শুরু, অমনি চোখ সেঁটে গেল।
শায়লা ডাকে, জিতু, এই যে দুদু, খাবে? জিতুর সাড়া নেই। সে টিভিতে মগ্ন। বিজ্ঞাপনে ছবি ও শব্দ দ্রæত পাল্টে যায়। জিতুর মনোযোগ আটকে রাখে। একটু বড় হলে ছেলের মন কাড়ে কার্টুন। মুগলি সিরিজে মজে যায়। তবে হিন্দির চেয়ে ইংরেজি কার্টুন তার বেশি প্রিয়। বাইরের ঘরে হঠাৎ শোনা যায় জিতুর হাহা হিহি হাসি। বাবা মা ছুটে আসে। কী, না ছেলে টম অ্যান্ড জেরি দেখতে দেখতে খিলখিলিয়ে হাসছে। মাহতাব ও শায়লার কাছে এ যেন বেহেশতী নিয়ামত। ছেলেটার খুব সাধারণ সব কাজকর্ম দেখেও কতদিন ওরা পরস্পরকে জড়িয়ে আনন্দ শেয়ার করেছে তার শেষ নেই। এ সৌন্দর্য শুধু উপলব্ধি করা যায়, বর্ণনা করা যায় না।
প্রায় ত্রিশ বছর পর সেই বিস্ময়ানন্দ যেন আবার ফিরেছে কিশমিশকে কেন্দ্র করে। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে যখন সপ্তাহখানেকের ট্রেনিংয়েই কিশমিশ নিজের পটি করার জায়গা চিনে ফ্যালে। শুরুর দিকে খাওয়ার পর তাকে একটি প্লাস্টিকের গামলায় বালুর ওপর বসিয়ে দেয়া হতো। সেখানেই সে প্রশ্রাব পায়খানা করতো। সপ্তাহের মধ্যে সে জায়গাটা চিনে নেয়। সময় হলে গুটি গুটি পায়ে ঠিক গামলায় গিয়ে ওঠে। কাজ হয়ে গেলে একাই নেমে আসে। এতটুকু একটা অবোধ অবলা প্রাণী কীভাবে এটা মনে রাখে আর এতটা নিয়ম মেনে  চলে তাই দেখে দুজনে হতবাক। মাহতাব যখন বই পড়ে বা কোনও কাজ করে তখন কিশমিশ কাছে আসে। তারপর এমন এক সুরে মিউ মিউ করতে থাকে যাতে বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না, সে কোলে উঠতে বা একটু আদর পেতে চাচ্ছে। মাহতাব ওকে তুলে কোলের কাছে বসিয়ে দেয়। গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। চুপ করে আদর খায় কিশমিশ। অবলা প্রাণীর ভাষা বোঝা যায় না এমন ধারণা দূর হয়ে গেছে মাহতাবের। সাত/আট বছর বয়স পর্যন্ত জিতুও সব সময় বাবার গায়ে গা লাগিয়ে পেটের কাছে বসতো।
কিশমিশ হাঁটতে পারছে না আজ। শায়লার চোখে বাস্প ঘনায়। সে আগের দিনের  ঘটনার বিবরণ দেয়। কিচেনে সিঙ্কের নিচে ময়লার মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছিলো বলে কিশমিশকে র্ধ র্ধ বলে ধাওয়া দিয়েছিলো। নিছক মজা করে। ছানাটাকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু মারাত্মক ভয় পেয়েছিল কিশমিশ। সে তিন লাফে পড়িমরি করে জিতুর খাটের নিচে লুকিয়ে পড়ে। সারাদিন ডেকেও ওকে আর বের করা যায়নি। অনেক চেষ্টার পর সম্ভবত ক্ষুধার্ত হওয়ায় দুপুরের দিকে এক পা দুপা করে বেরিয়ে আসে। আর আজকেই এই দুর্ঘটনা। এখন কী করা যায়! ডাক্তার দেখানোর অনেক খরচ। হাজার টাকার মামলা। মাহতাব বিড়ালটার ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক। কিন্তু তারও সীমাবদ্ধতা আছে। সে অনেকটা সমর্পনের ভঙ্গিতে বলে, ডাক্তার হয়তো দেখানো যায়, কিন্তু এক্স রে বা প্লাস্টার-ফ্লাস্টার যদি করতে বলে সে তো বিরাট খরচের ব্যাপার হয়ে যাবে। পারব না যে! শায়লা স্বামীর আর্থিক অবস্থা জানে। বেশি টাকা লাগে বলে দাঁতের ডাক্তারের কাছে সহজে যায় না মাহতাব। বছর ঘুরতে যাচ্ছে, তুলে ফেলা তার তিনটি দাঁত আর লাগানো হয়নি। শায়লা আর কিছু বলে না।  

ঢাকা শহরে পশু চিকিৎসক বা ভেট-এর বিরাট চাহিদা। কিন্তু ডাক্তার কম। যে কজন আছেন তাদের ভিজিট মানুষের চিকিৎসকদের মতই। ঢাকায় প্রাণী পোষা এখন রীতিমত জনপ্রিয় কালচার। বহু পরিবার বিড়াল, কুকুর, খরগোশ, পাখি, মাছ ইত্যাদি পোষে। এমনকি বানর,  বেজিও। শখের এই চলটা স্বাভাবিকভাবেই ধনীদের মধ্যে বেশি। বাংলা ভাষায় তো বাগধারাই আছে, ‘সখের তোলা আশি টাকা’। এখন অবশ্য সেটা লাখ টাকায় পৌঁছেছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে বউরা বেশিরভাগই বিদেশি প্রাণী পোষে। নানা জাতের বিচিত্র সব দামি কুকুর বা বিড়াল তাদের পছন্দ। অনেক টাকা দিয়ে সেগুলো বিদেশ থেকে আনা হয়। এসব পশুর চিকিৎসা করাতে কিংবা বিদেশি খাবার, পথ্য, ওষুধ এবং বিনোদনের আয়োজনে টাকাঅলা মানুষের কার্পণ্য নেই। পোষা প্রাণীর জন্য প্রয়োজনীয় সবই পাওয়া যায় ঢাকায়। এমনকি লিটারেচারও। সম্প্রতি এক শো রুমে পারফেক্ট পাপি ইন সেভেন ডে’জ, ডোন্ট শুট দ্যা ডগ: দ্য নিউ আর্ট অব টিচিং অ্যান্ড ট্রেনিং ইত্যাদি বই দেখে মাহতাব রীতিমত অবাক। ভেবে রেখেছে, দরকারি দুয়েকটা বই সুবিধাজনক সময়ে কিনে নেবে।


চার
আজ শায়লা নতুন নির্দেশনা জারি করে। কিশমিশকে কোনওভাবেই খাটে, সোফায় বা অন্য কোনও উঁচু জায়গায় একা ছেড়ে দেয়া যাবে না। তাহলে নামতে গিয়ে আবার ব্যথা পাবে। যেমন তারা শুরুতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঘরের মধ্যে খেয়াল না করে এক পা-ও ফেলবে না। কিশমিশ নিঃশব্দে পায়ের কাছে ঘোরে। পায়ে চাপা পড়লে তো বাঁচবে না। সবাইকে সতর্ক হয়ে পা ফেলতে হবে। সবাই এই নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিশমিশকে নিয়ে ভাবনা বাড়তেই থাকে। সপ্তাহে পেরিয়ে যায়, ও আর হাঁটতে পারে না। এর সাথে আবার যোগ হয় নতুন সমস্যা। খেতে পারে না। যা খায়, বমি হয়ে যায়। পায়খানা প্রশ্রাবও কেন যেন গেছে বন্ধ হয়ে। কোনও বাসি খাবার বা ঝালটাল দেয়া হয়নি। ভাজাপোড়া বা মশলাদার খাবারও না। তবু। ছোট্ট প্রাণীটা নেতিয়ে পড়েছে একেবারে। উঠে দাঁড়ায় না, ছোটে না, খেলে না, পায়ে পায়ে ঘোরে না। শুধু পুরনো রোগীর মত শুয়ে থাকে। অসহায় দুটি চোখে রাজ্যের আকুলতা টের পায় শায়লা। ওষুধ আনায় জিতুকে দিয়ে। একজন ভেট-এর সঙ্গে ফোনে কথা বলে নেয় জিতু। তিনদিন ধরে নিয়মিত ওষুধ খাইয়েও কোনও উপকার হলো না। ভেট বললেন, ডোজ বাড়িয়ে দিন। সেটাও দেয়া হলো দু তিনদিন। কোনও ফল নেই। এরই মধ্যে চলে এলো রজমানের ঈদ। ঈদের ছুটিতে কিশমিশকে নিয়েই গ্রামের বাড়ি যায় তারা।

আশা ছিল গ্রামে গিয়ে খোলা জায়গায় হয়তো ভাল থাকবে কিশমিশ। চওড়া ঘরে, বারান্দায় ছুটে বেড়াবে। যেমনটা করতো জিতু বেড়াতে গেলে। হাঁটতে শেখার পর থেকেই পার্কে বা কোনও খোলা মাঠে নিয়ে গেলে দারুণ আনন্দ হতো ওর। টলোমলো পায়ে ছুটে যেতো সবুজ ঘাসের ওপর। দূর থেকে ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়তো বাবা মায়ের কোলে, তাদের বাড়িয়ে দেয়া হাতের ভেতর। কিশমিশও ছুটে বেড়াবে ধারণা করেছিল শায়লা ও মাহতাব। সেটা হলো না।

বরং অসুস্থ কিশমিশের সেবা করেই ঈদ পেরুলো। কতবার যে বমি করলো কিশমিশ, কতবার জোরে জোরে পটি করার চেষ্টা করতে গিয়ে কাত হয়ে পড়লো তার ইয়ত্তা নেই। খুব চেষ্টা করতে গিয়ে অশক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না ছানাটা। কাত হয়ে পড়ে যায়। তবু সে চেষ্টা করে। পেছনের বাম পাসহ শরীরের পেছনটা মাটিতে ছেঁচড়ে নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে ওঠে পটির গামলায়। তারপর খুব চেষ্টা করে যাতে পটি হয়। কিন্তু হয় না। মানুষের বাচ্চা হলে চিৎকার করতো, কাঁদতো; ব্যতিব্যস্ত করে তুলতো সবাইকে। কিন্তু বিড়াল ছানা এই চরম অসুস্থতা আর শারীরিক প্রতিবন্ধিতা নিয়েই পটি করার নির্ধারিত জায়গা খুঁজে নেয়। মিউ মিউ করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে সে। 
শায়লার ঈদের আনন্দ প্রায় মাটি। এ ঘরে ও ঘরে যাচ্ছে গল্প করতে আবার ঘুরে ঘুরে এসে কিশমিশের খবর নিচ্ছে। খাবার দিচ্ছে, ওষুধ দিচ্ছে। কোলে করে বসে থাকছে। জিতুর চাচাতো ফুফাতো ভাই বোনেরাও বেশ মেতে থাকে কিশমিশকে নিয়ে। কোলে নেয়, আদর করে। কিন্তু অসুস্থ বলে মাতামাতিটা জমে না। ওরা একটু উহু আহা করে সমবেদনা জানায়।
দুই সপ্তাহের বেশি হলো কিশমিশের পটি হচ্ছে না। খাচ্ছে সামান্য। সবটাই বমি করে দিচ্ছে। এখানে ডাক্তারও নেই। মাহতাব, জিতু চেষ্টা করেছে পেটে মালিশ দিয়ে, একটু একটু প্রেসার দিয়ে পটি করাতে। হয়নি। ওর পেট কেমন শক্ত হয়ে আছে। শায়লা খাবারে পরিবর্তন আনে। দুধ খাওয়ায় একটু ঘন করে। তাতে ফল হয় না।
ঈদের তৃতীয় দিন বিকেলে কিশমিশ গামলায় উঠে খুব চেষ্টা করছে পটি করার। ওর পেট ফুলে উঠছে প্রেসারে। চাপটা নিতে পারে না ওর জখমী পা। কাত হয়ে পড়ে যায় গামলার মধ্যে। শায়লা ছুটে গিয়ে ওকে উঠিয়ে নেয়। করুণ বিষণœ চোখে মাহতাবকে প্রশ্ন করে, 
বাচ্চাটা কী পরিমাণ কষ্ট পাচ্ছে দেখেছো? কি করি বল তো!

মাহতাবেরও খারাপ লাগছে। গত কয়েক মাসে ওদের প্রচুর আনন্দ দিয়েছে কিশমিশ। ভালোভাবে চিকিৎসা করানো দরকার। সে বলে, 
চলো ঢাকায় ফিরে যাই, ডাক্তার দেখাতে হবে। ও তো আমাদেরই একজন। খরচা নিয়ে ভাবলে হবে না।
হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। আর কোনও উপায় নেই। দেরি হয়ে গেছে অনেক। 
পরের দিন ঢাকায় ফেরার জন্য জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয় ওরা। কিশমিশ সন্ধ্যাবেলা খেয়ে আরও দুবার বমি করেছে। তারপর খাটের নিচে ঢুকে গেছে। গ্রামে আসার পর থেকে খাটের নিচে ট্রাভেল ব্যাগের ওপর শুয়ে ঘুমায় সে। তার নিজের বেছে নেয়া জায়গা।

পাঁচ
সকাল সকাল রওনা হবার জন্য রেডি হচ্ছে সবাই। মাহতাব বাথরুমে। জিতু এখনও ওঠেনি, ডেকে তুলতে হবে। শায়লা কিশমিশের জন্য খাবারের বাটি নিয়ে ঘরে ঢোকে, 
কিশমিশ, কোথায় কিশমিশ? কোথায় বাবা? ঘুম ভাঙেনি এখনও? দেখি তো কী অবস্থা এখন!
ডাক শুনলে কিশমিশ সব সময়ই ‘মিউ’ বলে সাড়া দেয়। তারপর গুটি গুটি পায়ে কাছে আসে। আজ সাড়া দিচ্ছে না। ঘুমিয়ে আছে ভেবে শায়লা মেঝেয় বসে খাটের নিচে উঁকি দেয়। ঠিকই লাল ব্যাগের ওপর শুয়ে আছে কিশমিশ। কিন্তু কেমন যেন অন্যরকম লাগে। সে ব্যাগটা টেনে বের করে। কিশমিশের গায়ে হাত বুলিয়ে বলতে যায়,
কী, খেতে হবে না? বাসায় ফিরতে হবে তো? তারপর আমরা ডাক্তারের কাছে যাবো, কেমন!
একটা কথাও বলা হয় না। শায়লা চিৎকার করে ওঠে,
অ্যাই, কই তুমি, কিশমিশের কি হয়েছে? দেখ!
শায়লার আর্তনাদের শব্দ পেয়ে মাহতাব দ্রুত বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে,
কি, কি হয়েছে ওর? বলতে বলতে মেঝেয় বসে পড়া শায়লার হাতে বিড়ালটাকে দেখতে পায়। মরে শক্ত হয়ে গেছে।
সজোরে কেঁদে ফেলে শায়লা। কিশমিশ নেই, মরে গেছে। ও রে আল্লাহ!
কান্নার শব্দে বাড়ির সবাই ছুটে আসে। বিড়াল ছানা মরে গেছে শুনে সবাই আফসোস করতে থাকে। ঘুম ভেঙে জিতুও স্তব্ধ। কেউ বলে, আচ্ছা, কাঁদতে হবে না, আরেকটা বাচ্চা নিয়ে নিও শিগগিরই। কতই তো পাওয়া যায়! গ্রামের মেয়েদের কেউ কেউ মুখ টিপে হাসে। কাজের মেয়ে ফতি মুখে একটু মেকি শোকের ভাব ফুটিয়ে বলে, কাক্কি যে কি, বিলাই কি নাজাই পড়সে? কাইলই আইনা দেইরো এডা!
সবাই একে একে যার যা ঘরে চলে যায়।
শায়লা কারও কথার জবাব দেয় না। কাঁদতেই থাকে। তার হাতে কিশমিশের ঠান্ডা জমে যাওয়া শরীর। তার সব কষ্ট ফুরিয়েছে।
মাহতাব শায়লার পাশে বসে পড়ে। কাঁধে আলতো হাত রাখে। সান্ত¡না দেয়া বৃথা। তবু একটু পর ধরা গলায় বলে, কেঁদো না, হয়তো এটাই খোদার ইচ্ছা। আমরা নাহয় আরেকটা… । না, না, লাগবে না। শায়লা গা ছেড়ে দেয় মাহতাবের বুকে। কান্নাজড়ানো অস্পষ্ট স্বরে বলে, আরেকটা এনে কি হবে, আমার মেয়েটা তাতে ফিরবে?

One comment

Comments are closed.