অচিন গ্রাম

বিলেকাসা

আমার জন্যে ঢাকা শহর এক করুণ রসিকতা! ঢাকাকে কখনোই আমি আমার শহর বলে ভাবতে পারি না। এখানে সবই আছে, শুধু প্রাণ ভরানো আনন্দ নেই; আবার বেশি টাকা পাই বলে আমি ঢাকা ছাড়তে চাই না, কম টাকায় চলতে পারব না বলে গ্রামেও যাই না। তবে গ্রাম দেখার জন্যে প্রাণ সব সময়ই ছটফট করে। সুযোগ পেলে আর ছাড়ি না। এবার আমন্ত্রণ পেলাম আমার বন্ধু সুমনের কাছ থেকে।

সুমন থাকে গ্রামে। কিছুদিন আমাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিল। কিন্তু শেষ করতে পারেনি। ফিরে গেছে গ্রামে। যে কয়দিন হলে ছিল তাতেই ওর সঙ্গে ভালো একটু বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এই বন্ধুত্ব এখনো টিকে আছে। ঢাকায় এলে সুমন আমার বাসায় উঠে। তখন ওর চোখে আমি দেখতে পাই লাউ ডগার লকলকে সবুজ সুখ, ওর চেহারায় থাকে দিগন্ত ছোঁয়া সবুজ মাঠের উপর সোনালি রোদের ঝিলিক। বেশ কয়েকবারই আমাকে ওদের বাড়িতে যেতে বলেছে, আমিও যেতে রাজি হই, আমি মন থেকেই রাজি হই, কিন্তু শেষে আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। এবার আর না গিয়ে পারলাম না। শরীর মন দুটোই ঢাকা ছাড়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছে। ও বলা মাত্র চলে গেলাম ওদের গ্রামে। আমার মেয়েটাও আসতে চেয়েছিল, কিছু একটা কিছু ভেবে ওকে না করেছি।

সবাইকে রেখে আমি একাই এসেছি। দুইদিন মাত্র থাকব, আমার ইচ্ছা এর মধ্যে যত রকম করে পারি গ্রাম চেখে দেখব। জার্নির ধকলে একটানা লম্বা ঘুম। ঘুম ভেঙ্গে শুনি বাইরে চাপ কলের শব্দ। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি ভোর পাঁচটা বাজে। সুমনকে ডাকলাম। আমার এক ডাকেই ওর সাড়া পেলাম। সুমন জানতে চাইল, আমি উঠে পড়ব কি না। কোন কারণ ছাড়াই বলে বসলাম, হ্যাঁ। দরজা খুলে বাইরে আসতেই আবছা আলোতেও চোখে পড়ল সুন্দর উঠান। আর চারদিকে অনেক গাছ। রাতে ভালো করে দেখা হয়নি। উঠোনে কয়েক পা ফেলতেই চোখে পড়ল, মাথার উপরে আধখানি চাঁদ। কেমন যেন অন্য রকম লাগছে, আকাশ পরিষ্কার, আর শীতের মাঝে চাঁদকে কেমন বিষণ্ণ লাগছে। আমার মনেও কেমন যেন লাগছে। একটু ঘোর লাগা দিশেহারা ভাব।

সুমন জানতে চাইল, আমি ফজরের নামাজ পড়ব কি না। ফজরের নামাযের কথা শুনে আমি একটু অন্য রকম হয়ে গেলাম। কবে শেষ ফজরের নামাজ পড়েছি জানি না। চাকরি জীবনে কখনো এত ভোরে উঠেছি বলেও মনে হয় না। আমি সুমনকে বললাম, উঠোনের ঠিক এখানেই আমি নামাজ পড়তে চাই। সুমন একটি জায়নামাজ এনে দিল। আমি উঠোনের মাঝে চাঁদের আলোতে ফজরের নামাজ পড়লাম। নামাজ শেষ হলেও জায়নামাজেই বসে আছি। খুব কষ্ট হচ্ছে কেন জানি, বুঝতে পারছি না। চারদিকের আবছা আলো আরো একটু স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে মেয়েটাকে না এনে বড় ভুল করেছি। এতো সুন্দর একটি সকাল ও দেখতে পেল না।

নাস্তা খেয়ে বের হলাম সুমনের সঙ্গে। ওকে বলেছি আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটব না। ক্ষেতের ভেতর দিয়ে হাঁটব। আর ক্ষেতে ফসল থাকলে, ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটব। অল্প একটু হেঁটেই স্যান্ডেল হাতে তুলে নিয়েছি। ঘাসের উপর হাল্কা শিশির জমে আছে। ইচ্ছে করেই ভালো করে পায়ে মাখিয়ে নিচ্ছি শিশির, কি সুন্দর শীতের অনুভূতি। কিছু কিছু ক্ষেতের ধান কাটা হয়ে গেছে। আবার একটু পড়েই দেখি অনেক সবজির ক্ষেত। আর আছে সর্ষের ক্ষেত। আমি আমার চোখ কান সহ সমস্ত শরীর দিয়েই চাখতে শুরু করেছি। ওদিকে সূর্যের আলোও লাল থেকে হলুদ হতে শুরু করেছে।

খালের কাছে এসে দেখি একটি ছোট মাঠ। এক দিকে ছোট ঈদের নামাযের জন্যে দেয়াল দেয়া। দেয়ালের ভেতরেই সুন্দর একটি বট গাছ। বেশি বড় না। দুজনেই বসে পড়লাম খালের দিকে মুখ করে। খালে খুব একটা পানি নেই। দুই একটা জায়গায় পানি আছে। যেখানে পানি সেখানে দেখি অনেক কচুরি পানা, আর বাঁশ ফেলে রাখা। দেখেই মনে হচ্ছে কিছু না কিছু মাছ সেখানে আছে। গ্রামের মানুষ এভাবেই খালের মাছ নিজের দখলে রাখার চেষ্টা করে। পানি আর একটু কমলে হয়ত সব মাছ ধরে ফেলবে।

এসব দেখে এত ভাল লাগছে যে বলার মত না। খালের ওপারে দৃষ্টি যেতেই চোখে পড়ল বাঁশের ঝাড় আর বড় বড় গাছের সারি। মনে হচ্ছে এক অপরূপ মায়ায় ঘেরা একটি গ্রাম। আমার খুব ইচ্ছে করছে খাল পাড় হয়ে চলে যাই সেই গ্রামে। কিন্তু অনেক দিন পর একটানা হাঁটায় বেশ ক্লান্ত লাগছে। সেই সঙ্গে রোদও বেড়ে গেছে খানিকটা।

খাল পাড়ে বসেই সুমনের সঙ্গে অনেক কথা হল। ওর একমাত্র ছেলে কলেজে পড়ে। এর পর ওকে কোথায় পড়ানোর ইচ্ছা জানতে চাইলাম। সুমন বলল, যেখানে চান্স পায়, আর না পেলে শহরের কলেজে ডিগ্রী পড়বে। তারপর, আমি জানতে চাইলাম। সুমন খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল, একটা না একটা কিছু করবে, আমাদের ছোট জীবন, এটা পাড় করতে পারলেই হল। খেয়াল করে দেখি ওর কথায় কোন দুঃখ বোধ নেই, দুশ্চিন্তা নেই। ছেলে যে ভাবে আগাচ্ছে তাতেই ও খুশি। অন্যদিকে মেয়েকে নিয়ে আমাদের চিন্তার শেষ নেই। ক্লাস সেভেনেই ভাবছি বুয়েটে চান্স না পেলে বাইরে পাঠাব, কানাডায় অথবা অ্যামেরিকায়। নিতুর বড় বোন থাকে কানাডায়, সেখানে সিটিজেন হতেও সহজ হবে, দেশের যা অবস্থা, কোন ভদ্রলোকের পক্ষে দেশে থাকাটাই একটা ঝক্কি!

রোদ আরেকটু বাড়তেই খালের পানির ঝিকমিক শুরু হয়ে গেছে। এই দেখে আমি আর থাকতে পারলাম না। সুমনকে বললাম, আম খালের পানিতে নামতে চাই এবং খাল পাড় হয়ে ঐ গ্রামে যাব। আমার কথা শেষ না হতেই সুমন উঠে পড়ল। তারপর ওর সঙ্গে নেমে গেলাম খালের পানিতে। ঝকঝকে রোদে কোমল আর ঠাণ্ডা খালের পানি। এক অপূর্ব অনুভূতি। খালের ভেতর কোন কাঁদা পেলাম না। একেবারে ঝিকঝিকে বালু। বালুর উপর পা দিয়ে বেশ হাঁটলাম। তারপর উঠে গেলাম ওপারে। খালের পর দুটো ক্ষেত। ঢুকে পড়লাম সেই গাছ ঘেরা গ্রামে। এবার হাঁটতে হচ্ছে মাটির রাস্তা ধরে। এখানে ক্ষেতের চেয়ে বাড়ি ঘর বেশি। মাটির রাস্তা, বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেছে। রাস্তার দুই পাশেই আম কাঁঠালের গাছে ভরা, আর রাস্তার উপর একটু পর পর ঝুঁকে এসেছে বাঁশের ঝাড়। সব কিছু দেখে আমার মন ভরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে অনন্ত কাল এভাবে হেঁটে বেড়াই। গাছে গাছে পাখির ডাকে একেবারেই অন্য রকম লাগছে।

কিন্তু মন এরকম, আর শরীর অন্যরকম। অনেকদিন ধরে এরকম করে হাঁটিনি। মনে হচ্ছে একটু বসে চা খেতে পারলে ভালো হত। সুমনকে চায়ের কথা কিছু বলছি না। অলস শরীরেও হাঁটছি। আরও কিছুদিন হাঁটার পর বেশ কিছু লোক এক সঙ্গে দেখতে পেলাম। তাদের একজন সুমনের হাত ধরে বলল, বাবা তুমি এসে খুব ভালো করেছ, বাড়ির ভেতরে আসো, বলে সুমনের হাত ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল, পেছন পেছন আমি।  

বাড়ির ভেতর ঢুকে দেখি উঠোনে বেশ কিছু মানুষ বসে আছে। আমাকে একটি চেয়ার ছেড়ে দেয়া হল। কিন্তু কাউকে উঠিয়ে দিয়ে বসার অভ্যাস আমার কখনোই ছিল না। পাশেই দেখি সুন্দর একটি মাটির ঢিবি, চুপ করে ওখানেই বসলাম। একটু কথা শোনার পড়েই বুঝতে পারলাম, জমি জমার ভাগ বাটোয়ারা হচ্ছে। একটু পর পর আরো লোকজনও আসছে। ব্যাপারটা আমার যথেষ্ট অবাক লাগছে। কোথায় কত জমি আছে, কোনটায় আবাদ ভালো হয়, কোনটায় আবাদ একেবারেই হয় না, বাড়ির ভিটা … সব কিছুই আস্তে আস্তে ভাগ হয়ে গেল। এর মধ্যে আমি মুড়ি গুড়ের সঙ্গে লাল চাও পেয়েছি। খিদে পেটে এসব খেয়ে মনটাও ভরে গেল।

সবার শেষে ভাগ হল ঘরের কিছু জিনিস পত্র। আমি বুঝলাম না, একজন আমাকে একটা চাদর দিয়ে বলল, বাবাজি, আমরা গরিব মানুষ, আপনাকে ভালো কিছু দেয়ার নেই, আপনি এটাই নেন। কি বলব, বা কি করব কিছুই ভাবতে পারছি না। এরকম অভিজ্ঞতা আমার একেবারেই নেই। সুমনের হাতে দেয়া হল একটি কাঁসার গ্লাস। ও কিছু না বলেই নিয়ে নিল, তাই আমিও চাদর পেয়ে আর কিছু বলতে গেলাম না। কিন্তু ব্যাপারটা মনে মধ্যে কেমন যেন লাগছে, বেশ একটু আনন্দের, অপরিচিত মানুষকেও এভাবে আদর করে কেউ চাদর দিতে পারে!

ভাগ বাটোয়ারা শেষ হতেই আমরা উঠে পড়লাম। গ্রাম দেখা এবং হাঁটার জন্যে পথ ধরলাম। শরীর মন দুটোই চাঙ্গা! চা মুড়ি খেয়ে যথেষ্ট শক্তি পেয়েছি। চাদরের আনন্দটা মনের মধ্যে কেমন কেমন লাগছে। সুমনকে বললাম, ও বাড়িতে কীসের এত ভাগাভাগি হল?

ওদের বাবার রেখে যাওয়া সব কিছুর ভাগ হল ভাই বোনের মধ্যে!

বোনরাও পেল?

হ্যাঁ, দেখলি না, ঐ যে মহিলারা ছিল, তারাও তো ভাগ পেল, ভিটের অংশও পেয়েছে, তুই কি ধরতে পারিসনি!

ঠিক বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমি যতদূর জানি, গ্রামের লোকেরা বোনদের জমি দিতে চায় না, বোনের জমি আটকে রেখে মাঝে মাঝে ফসল …

এই গ্রামে এগুলো হয় না। মাত্র পাঁচ দিন হল ওদের বাবা মারা গেছে, আর আজ সব কিছুই ঠিক ঠাক ভাগ হল, আমি এসেছি বলে দেখ কি সুন্দর একটা গ্লাস দিল, তোকে দিল চাদর!

কিন্তু আমাদের কেন দিল?

এত কিছু ভাগ হচ্ছে, সামান্য একটু দিল, আমাদেরকেও সম্মান দেখানোর জন্যে!

সত্যিই ব্যাপারটা আনন্দের। কিন্তু আমার ধারণা ছিল যে গ্রামের মানুষ বোনদের জমি দিতে চায় না, এখানে কিভাবে …

এখানেও তাই ছিল, কিন্তু কয়েক বছর ধরে এখন কেউ কাউকে ঠকানোর চেষ্টা করে না।

কি বলিস, ঝগড়াও হয় না?

ঝগড়া হয়, কিন্তু ভাগের সময় গ্রামের অনেকেই থাকে বলে ঝগড়া বেশিদূর গড়ায় না, দেখা গেছে, যে যার অংশ পেয়ে খুশিই থাকে। 

কিভাবে সম্ভব, আমার ধারণা ছিল পুরো দেশই বুঝি অধিকার বঞ্চিতের অভিশাপে অভিশপ্ত। আমাদের দেশের মানুষরা অধিকারের সঙ্গে টাকাকে এক করে ফেলেছে। যার ফলে যে যেভাবে পারে এরটা ওরটা কেড়ে নেয়, ভায়েরা মিলে বোনদেরটা, একভাই আরেক ভাইয়েরটা, … সম্পত্তি দেখলে আমরা আর হিসেব রাখতে পারি না, কোনটা আমার আর কোনটা আমার না। আর এই গ্রামের মানুষ না কি বাবা মা মারা যাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই সব কিছুই ভাগ করে ফেলে। মনে মনে ভাবছি, এটা কিভাবে সম্ভব, এরা কি জানে না দেশের মানুষেরা …

বছর দশেক আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল!

সুমনের কথা কানে যেতেই আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। জানতে চাইলাম, কি ঘটেছিল।

এক ভয়ানক ঘটনা। তুই কল্পনাও করতে পারবি না।

কি হয়েছিল?

এক বয়স্ক মহিলার দুই ছেলে ছিল। তার স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই ছেলেই জমির ভাগ পাবে, কিন্তু কোন এক ছেলে চালাকি করে পুরোটা নিজের নামে লিখে নেয়। অন্য ভাই মাকে অনেক ধরেছিল, এটা ঠিক করে দেয়ার জন্যে। কিন্তু ওদের মা রাজি হয়নি।

কিন্তু কেন?  

সেই ছেলে মাকে বুঝিয়েছে, এখানে হাসপাতাল বানাবে, মানুষের উপকার হবে! মা ভেবেছে, তার নামে হাসপাতাল হবে, মানুষে তার নাম জানবে, গ্রামের মানুষের উপকার হবে, ওরা দোয়া করবে, বুঝিসই তো, গ্রামের মানুষ যেভাবে ভাবে!

তাহলে তো সে যথেষ্ট বড়লোক ছিল, আর অন্যজন?

অন্যজনের অবস্থাও ভালো ছিল, ওদের কারোরই গ্রামের জমির দরকার ছিল না। যে ছেলেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, সে এখানে থাকতো না।

তাহলে আর মন খারাপের কি আছে, সে কেন জমিটা ছাড়তে চায়নি?   

তার কথা ছিল, এটা তার অধিকার, তার অধিকার যেন তার ভাই কেড়ে নিতে না পারে!

তাই বলে হাসপাতালের জন্যে নিলেও?

সে কিছুতেই তার অধিকার ছাড়তে চায়নি! 

এটা নিয়ে অনেক কিছুই হয়েছে। অনেক লম্বা একটা কাহিনী।

বল দেখি শুনি। কেমন অন্যরকম লাগছে।

আমার উৎসাহ দেখে, সুমন ধীরে ধীরে পুরোটাই বলল। দুই ভাইয়ের ঝগড়ার এক পর্যায়ে ওদের মা একজনকে আর বাড়িতে ঢুকতে দেয় না।

কোন জন, যে জমির ভাগ পায়নি?

ঠিকই ধরেছিস। তারপর জমি দখল করা ভাই সেখানে একটি হাসপাতাল বানায়। গ্রামের লোকেরাও অনেক খুশি, যাক গ্রামের লোকের চিকিৎসা হবে। এর মধ্যে একটি মসজিদও বানানো হয়েছে, গ্রামের লোকের আনন্দের শেষ নেই। তাদের মুখে চালাক ভাইয়ের কত কি গুণগান! কিন্তু এটা বেশি দিন চলল না। কি একটা কারণে একদিন ভাইটা মাথা ঘুরে পড়ে যায়। মাথাটা পড়ে অর্ধকে একটা ইটের উপর। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান। নিজের হাসপাতালে নিয়ে অনেক চেষ্টা করা হল। কিছু করতে না পেরে শহরে নিয়ে যাওয়া হল। শহরের হাসপাতালে নেয়া মাত্র ডাক্তার বলে দিয়েছে রোগী অনেক আগেই মারা গিয়েছে! এই খবরে গ্রামের লোক অনেক কেঁদেছে।

গল্পটা এরকম ভয়ানক হতে পারে আশা করিনি। মনের ভেতর ঘৃণা বা করুণা জমতে শুরু করেছে, কিন্তু ঠিক কোনটা আমি বুঝতে পারছি না। এটুকু শুনে আমি  বল্লাম, গল্পটা এই!

সুমন বলল, এটা গল্পের কেবল শুরু। ভেতরে আরো অনেক কথা আছে। খারাপ লাগলেও গল্পটা না শুনে পারছি না। ওদিকে সুমন বলতে শুরু করেছে –

ঝামেলা হল সেই ছেলের জানাজা পড়াতে গিয়ে। নিজেদের মসজিদের ইমাম জানাজা পড়াবেন। শুরুতে জানতে চাইলেন, মৃতের কাছে কারো কোন পাওনা আছে কি না। সবাই বলল নাই। ইমাম আরেকবার পাওনার কথা জিজ্ঞেস করলেন, আবার উত্তর এল নাই। ইমাম জানাজা শুরু করবেন, ঠিক তখনই দেখা গেল লাশের উপর পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একজন। ইমাম ভালো করে তাকিয়ে দেখে, এটা সেই ভাই, যার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। গ্রামের লোকেরাও এটা দেখে হতভম্ব! ইমাম কিছু বলতে যাবেন, তখনই সেই ভাইটা বলল, আমার পাওনা আছে, আমার ভাগের জমি সে আত্মসাৎ করেছে! এরপরেই ভীষণ কোলাহল!

লোকটা পাগল না কি?

পাগল হবে কেন, সে তার অধিকার পায়নি বলেই এত কাণ্ড!

এরপর?

এরপর অনেক হট্টগোল। ইমাম এর মধ্যেই বলে দিয়েছেন, তিনি এই জানাজা পড়াতে পারবেন না। এই কথা চলে গেল তার মায়ের কাছে। মা এসে জীবিত ছেলেকে অভিশাপে অভিশাপে জর্জরিত করে ফেললেন। সেই সঙ্গে ইমাম কে, গালি গালাজ, তোকে আমি চাকরি দিয়েছি, আর তুই আমার পোলার জানাজা পড়াবি না, তোর ভাত কে দেয়, …

কিন্তু ইমাম, কিছুতেই সে জানাজা পড়ালেন না। শান্ত স্বরে বললেন, আমার রিজিক এখানে আর নেই, আমি এই জানাজা পড়াতে পারব না, যে অন্যের অধিকার কেড়ে নেয়, সে জালিম, আমি একজন জালিমের জন্যে আল্লাহ্‌র কাছে সুপারিশ করতে পারি না।

তারপর, জানাজা কি হয়নি!

হয়েছে, অনেক কিছুর পর হয়েছে।

সেই বৃদ্ধ মহিলা! তার কি হল!

তারপর সে একা হয়ে গেল, এক ছেলে কবরে, আরেক ছেলেকে সে বাড়িতে ঢুকতে দেয় না। এমন করেই মহিলাও একদিন মরে গেল।

তার ছেলে তার জানাজায় আসেনি?

না!

গ্রামের মানুষ তাকে কিছু বলেনি?

গ্রামের মানুষ জোর করে ধরেছিল, কিন্তু ছেলে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, একজন জালিম এবং অধিকার বঞ্চনাকারীর জানাজা আমি পড়ব না।

এত পাষণ্ড ছেলে হয়?

পাষণ্ড কি, পশু, একটা ভাইয়ের অধিকার কেড়ে নিয়ে পশু হয়েছে, আরেকটা এর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে পশু হয়েছে। অথচ দুজনেই অনেক লেখাপড়া করেছে, টাকা পয়সাও করেছে।

সে কি এই গ্রামে আসে, মানে গ্রামের লোক তাকে আসতে দেয়?

সে আসে, গ্রামের লোকও চায় সে গ্রামে এসে থাকুক।

কেন, এরকম একজন পাষণ্ডকে কেন গ্রামে এসে থাকতে বলবে?

তাকে যতটা খারাপ ভাবছিস, সে হয়ত অতটা খারাপ নয়। ওর মা মারা যাওয়ার পর সবাই ওকে ধরেছিল, এখন তো সব তোমারই হল, এগুলোর দেখাশোনা তুমি কর, আর গ্রামেই থাক, কিন্তু সে কিছুই নেয়নি, এবং গ্রামেও থাকেনি, গ্রামের লোকদের বলেছে, আমি আমার অধিকারের জন্যে এরকম করেছি, জমি বা সম্পত্তির জন্যে না। গ্রামের লোক তখন বুঝতে পারে, সে আসলে লোভী ছিল না।  

তারপর?

সে এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে, তার ভাইয়ের কবরে থুথু দেয়ার জন্যে মানুষকে টাকা দিতে শুরু করে।

কি অমানুষ!

অমানুষই বটে! কিন্তু গ্রামের লোক কিছুদিন পর থুথু দেয়া বন্ধ করে দেয়।

কেন, কবর বলে, কিন্তু টাকা পেলে …

হয়ত কবর বলে, এর চেয়ে বড় ছিল, এখানকার লোকেরা তো ভাই বোন যে যাকে পারে তাকেই ঠকায়, একদিন গ্রামের লোক বুঝতে পারে, এই থুথু আসলে তাদের বাপ চাচাদের কবরেও পড়ছে। তার পরেই আস্তে আস্তে কবরে থুথু দেয়া বন্ধ হয়ে যায়, এবং তারও কিছু দিন পর থেকে শুরু হয় বাপ দাদার জমির ঠিকঠাক বণ্টন, এবং কারো বিরুদ্ধে অধিকার কেড়ে নেয়ার অভিযোগ থাকলে তার মৃত্যুর পর এই গ্রামের কেউ তার জানাজায় যায় না।   

বলিস কি?

হ্যাঁ, গ্রামের লোক দেখতে পেয়েছে ওদের বাড়ি ঘর হাসপাতাল সবই পড়ে আছে, কিন্তু মানুষ নেই, যে মহিলা সন্তানের জন্ম দিল, সেই মহিলাকেই কিভাবে মরতে হল একা, তার জানাজাতেও …

সুমনের গলা ধরে আসে, কথা শেষ করতে পারে না। জিজ্ঞেস করলাম, মহিলা ওর কে হয়! বেশ কয়েকবারই জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু সুমন কোন উত্তর দিল না। উলটা আমাকে জিজ্ঞেস করল, ওদের বাড়িটা দেখতে যাবি, বেশি দূরে না। আমি রাজি হয়ে গেলাম। অনেক প্রাচীন ইতিহাসের মত লাগছে, অভিশপ্ত এক রাজ প্রাসাদ, সব কিছু পড়ে আছে, কিন্তু কোন মানুষ নেই, প্রাণ নেই।

বেশিদূর যাওয়া হয়নি, আমার মনে হল আমার ঠাণ্ডা লাগছে, অথচ রোদ বেশ করা, সেই সঙ্গে যোগ হল ক্লান্তি, আর পা চালাতে ইচ্ছে করছে না, একটু একটু ভয়ও লাগছে। আমি সুমনকে বললাম, সুমন আমার অনেক ক্লান্ত লাগছে, সেখানে যাব না, চল বাড়িতে ফিরে যাই।           

সুমন হ্যাঁ না কিছু না বলেই বাড়ির পথ ধরল। কিন্তু আমার ভয় যাচ্ছে না, ঠাণ্ডা লাগছে আরো বেশি। হাতের চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিলাম। সুমন বলল, কি ব্যাপার, এই রোদের মধ্যে চাদর গায়ে দিলি যে?

কেমন যেন ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে!

আচ্ছা বলে সুমন থেমে গেল। চাদরটা পরাতে বেশ ভালো লাগছে। ভয়টাও যেন নাই, সুমনকে বললাম, হাসপাতালটা থাকলে গ্রামের মানুষের ভালো হয়!

সুমন বলল, লোকটা মরে যাওয়ায় হাসপাতাল বেশিদিন চলেনি। ডাক্তার নার্স, যে যার মত জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছে, গ্রামে কে থাকতে চায়।

সেই চিরায়ত দুর্ভাগা গ্রাম, যেখান থেকে সবার খাবার আসে, সেখানের মানুষই থাকে সবচে অবহেলিত! আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু সেই মহিলা সুমনের কি হয়! ভাবনাটা থামাতে পারছি না। তার কথা বলতে গিয়ে সুমনের গলা কেন ধরে এসেছিল!

সুমনকে বেশ শক্ত ভাবেই ধরলাম, মহিলা ওর কি হয়। এবার সুমন উত্তর দিল, ওর কেউ হয় না।

তাহলে তার কথা বলতে গিয়ে কেন তোর খারাপ লাগছিল?

মহিলাকে ঠিক ভাবে কবরে নামানো হয়নি।

মানে, তার জানাজায় লোকজন ছিল না, তারা তাকে কবরে নামায়নি?

সবই ছিল, কিন্তু যারা ছিল তারা তাকে কবরে ফেলতে পারলেই বাঁচে।

কিন্তু কেন?

আরে সে তো ওদের কেউ হয় না, লাশটা ওরা যত দ্রুত পারে কবরে ফেলে ঘরের জিনিসপত্র নিয়ে  নেবে। এটা আমি মানতে পারিনি।

কেন?

আমার আম্মাকে আমরা তিন ভাই খুব আদর ভালোবাসা দিয়ে কবরে শুইয়ে দিয়েছি, প্রত্যেকটা মানুষকে এভাবেই কবরে শুইয়ে দিয়ে আসতে হয়। নিজের সন্তান ছাড়া এটা কেউ করে না।

কিন্তু সে তো তোর কেউ হয় না।

তাতে কি, সে তো একজন মা!

সুমনের কথাটা একেবারে বুকে গিয়ে লাগল! প্রত্যেকটা মায়েরই এরকম একটি ছেলে থাকলে ভালো হত, কি সুন্দর কথা, মৃত্যুর পর মাকে আদর ভালোবাসায় কবরে শুইয়ে দিয়ে আসা!

সত্যিই প্রাচীন ইতিহাসের ভেতর দিয়ে চলছি যেন। কেমন করে একটি পরিবার মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে গেল। যার পেছনে ছিল লোভ। শুধুমাত্র এই লোভের কারণেই … কিন্তু কেড়ে নিয়ে সবাই কি সব কিছু খেতে পারে, মানুষের পেট কত বড়! আশ্চর্য। সুমনকে বললাম, আচ্ছা সুমন, ছেলেটা না হয় কেড়ে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু মা কি বুঝতে পারেনি, দুটোই তো তার ছেলে! সুমন হেসে বলল, মানুষকে যখন লোভে পেয়ে বসে, তখন মানুষ রীতিমত পশু হয়ে যায়, যে পশুর আত্মায় কিংবা বোধে ভালো কোন অনুভূতি পৌঁছায় না, সে চায় শুধু পেতে, কিভাবে পেল, পেয়ে কি করবে এর কিছুই সে বুঝে না।