সেই দৃষ্টি

মোহাম্মদ কামরুজ্জামান

আপনারা বিশ্বাস করুন বা না-ই করুন, আমি চাইনে কোন মানুষ আমার ততোটা প্রিয় হয়ে উঠুক যার প্রতিচ্ছবি আমার মনের মুকুরে অবরে সবরে প্রতিফলিত হবে। সেটা আমার সবচেয়ে বড় আপ্তজন মা-বাবারও না। কারণ আমি চাই না তাঁদের কারও প্রতিচ্ছবি আমার অন্তরে গেঁথে থাকুক। তাঁদের অবর্তমানে তাঁদের কথা স্মরণ করে আমি কষ্ট পাই। অথবা আমার অবর্তমানে তাঁরা কোন রকম আমার অভাববোধ করুন। যদিও আমি সেজদায় পড়ে আমার মা-বাবার জন্য দোয়া করি, রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।
তবে সেজদায় পড়ে দোয়ার সময় ক্ষণিকের জন্য মা-বাবার আশীর্বাদাচ্ছন্ন মুখচ্ছবি আমার অন্তরে বাঙ্ময় হয়ে উঠে। আবার মুছে যায়। আমি তাঁদের মনে রাখতে চাই না। তাই কখনও তাঁদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলি না। কারণ চোখের দৃষ্টিই সর্বনাশা। সে মিথ্যে বলতে জানে না। সে সবসময় অকপট সত্য বলে। আমি যে আমার মা-বাবাকে জগতের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তা গোপন রাখার জন্যই তাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলি না।
এমনকি আমার বাবা কোন কারণে আমার প্রতি ক্রোধান্ধ হলেও তাঁর চোখের দিকে তাকাই না। অথবা আমার মা আমার জন্য দোয়া করে কেঁদে বুক ভাসালেও তাঁর মুখের দিকে তাকাই না। অথচ আমি জানি এবং মানি যে, মা-বাবার চোখের দিকে শ্রদ্ধাপূর্ণ ও মমত্ববোধের দৃষ্টিতে তাকালে চোখের জ্যোতি বাড়ে। পরম করুণাময় আল্লাহ্ পাকের করুণা লাভ করা যায়। আমি এমনই পামর যে জানি তবে মানি না। 
এর পরের স্তরের আমার আপ্তজন আমার সুপ্রিয় ভাই-বোন। আমি বড় কি ছোট, কোন ভাই-বোনের চোখের দিকে তাকাই না। অথচ তাদের সঙ্গে কত কথা বলি। হাসি-তামাশা করি। অভাব-অভিযোগের কথা জানাই। তাদের কাছে প্রয়োজনের জিনিসটি চাইতে লজ্জাবোধ করিনে। তারা আমার দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকলেও আমি দৃষ্টি নত করে থাকি। কারণ আমি চাই না তাদের কারও প্রতিচ্ছবি আমার অন্তরে গেঁথে থাকুক। তাদের অবর্তমানে তাদের কথা স্মরণ করে আমি কষ্ট পাই। অথবা তারা আমার অবর্তমানে কোন রকম আমার অভাববোধ করুক।
আমার ভাতিজা-ভাতিজি-ভাগিনা-ভাগিনি সবার ক্ষেত্রেও একই সূত্র প্রয়োগ করি। এখন তাদের ঘরে সন্তাদি আছে। ওদের সঙ্গে তুই-তুকারি করে কথা বলি। যেন ওরা সবাই আমাকে অপছন্দ করে এবং আমার কথা স্মরণ হলে আমার প্রতি ওদের বিতৃষ্ণভাব জাগে। কারণ আমি চাই না ওদের কারও প্রতিচ্ছবি আমার অন্তরে গেঁথে থাকুক। ওদের অবর্তমানে ওদের কথা স্মরণ করে আমি কষ্ট পাই। অথবা ওরা আমার অবর্তমানে কোন রকম আমার অভাববোধ করুক।
বিশ্বাস করুন বা না-ই করুন, আমার স্ত্রীর চোখের পুতলি কাকের মতো কালো নাকি পীতাভ নীল, নাকি তিনি বিড়ালাক্ষী সেটাও আমি বলতে পারবো না। তার চুলে পাক ধরেছে কি ধরেনি তা খেয়াল করি না। তার ঠোঁট জোড়া গোলাপের পাঁপড়ির মতো কিনা তাও কখনও খেয়াল করিনি। তার মুখের হাসি কতটা মোহনীয় সেটাও আমি জানি না। তার দৃষ্টিতে কতটা গভীর মমত্ববোধ বা প্রচ্ছন্ন উদাসীনতা সেটাও আমি বোঝার চেষ্টা করি না।
সবার ঘরে যেমন একজন স্ত্রী না থাকলেই নয় তিনিও তেমনই আমার ঘরে আছেন। তিনি ঘরে থাকলে বোঝাও মনে হয় না। আবার তিনি ঘরে না থাকলে তার অভাব প্রকট হয়ে দেখা দেয় না। সেই স্ত্রীধনের চোখে চোখ রেখেও আমি কথা বলি না। তার কাছে লুকানোর কিছু নেই। তবু যেন সেই সত্য প্রকাশিত না হয় যে তাকে আমি ভালোবাসি। কারণ আমি চাই না তার প্রতিচ্ছবি আমার অন্তরে গেঁথে থাকুক। তার অবর্তমানে তার কথা স্মরণ করে আমি কষ্ট পাই। অথবা তিনি আমার অবর্তমানে কোন রকম আমার অভাববোধ করুন।
আমার তিন মেয়ে ও এক ছেলের ব্যাপারে কি-ই বা বলি। ওদের সঙ্গে আমার আচরণ যাচ্ছেতাই। ওদের মুখের দিকে তাকিয়েও আমি কথা বলি না। ওরা সবসময় সভয়ে ও ঘৃণায় আমার দূরে দূরে থাকে। আমি চাই না ওরা আমাকে বাপের মতো ভালোবাসুক। কারণ আমি চাই না ওদের কারও প্রতিচ্ছবি আমার অন্তরে গেঁথে থাকুক। ওদের অবর্তমানে ওদের কথা স্মরণ করে আমি কষ্ট পাই। অথবা ওরা আমার অবর্তমানে কোন রকম আমার অভাববোধ করুক। আমি চাই আমার মৃত্যুর পর ওরা সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেন বলে, যাক! বাপের অত্যাচার থেকে বেঁচে গেলাম। এমন বাবা যেন কারও না থাকে।
জগত সংসারে আমার কোন বন্ধু নেই। তবে বিবিধ বিদ্যাপিঠে আমার কিছু সহপাঠী অবশ্যই ছিল। ওদের কারও সঙ্গে আমার কখনও মনের মিল দূরের কথা মতেরও সামান্যতম মিল হয়নি। সবার সঙ্গে আমার আচরণ গর্হিত ও রূঢ় ছিল। কেউ আমার সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে আসেনি। আমিও কারও কাছে যাইনি। আমি কারও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলিনি। তারাও বলেনি। কারণ আমি চাইনি ওদের কারও প্রতিচ্ছবি আমার অন্তরে গেঁথে থাকুক। ওদের অবর্তমানে ওদের কথা স্মরণ করে আমি কষ্ট পাই। অথবা ওরা আমার অবর্তমানে কোন রকম আমার অভাববোধ করুক।
খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য হাট-বাজার ও দোকানে যেতে বাধ্য হই। আমি কোন দোকানীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলি না। আমার উপুশ করতে হলেও কোন দোকান থেকে বাকিতে কিছু কিনি না। আমি প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট দোকান থেকেও কিছু কিনি না। যদি আজ বাজারের এই প্রান্তের কোন দোকান থেকে কিছু কেনা হয় তবে পরের দিন বাজারের অপর প্রান্তের অপরিচিত এক নতুন দোকান থেকে জিনিস কিনি। এবং আমি জিসিস কেনার সময় কোন দোকানীর চোখের দিকে তাকাই না। কোন দোকানী আমাকে বেশি সম্মান দেখানোর চেষ্টা করলে ওর দোকানে আর কখনও যাই না।

আরও ব্যাপার আছে। কোন কোন দোকানে দ্বিতীয় দিন গেলেই তারা আমাকে বাধা খদ্দের ভাবে। তারা ভেজালযুক্ত ও কম দামী জিনিস ব্যাগে ভরে দিয়ে খাঁটি জিনিসের দোহাই পেড়ে বেশি দাম আদায় করে। আর তারা প্রকৃতই কেউ আমার আপন নয়। তাই আমি চাই না ওদের কারও প্রতিচ্ছবি আমার অন্তরে গেঁথে থাকুক। ওদের দোকান থেকে কোন জিনিস কেনা না হলে আমি কষ্ট পাই। অথবা ওরা আমার কোন জিনিস বিক্রি করতে না পারলে কোন রকম কষ্টবোধ করুক।

কাপড়-চোপড় কেনার ব্যাপারেও আমি একই সূত্র মেনে চলি। আমরা প্রতিদিন কাপড় কিনি না। আমরা অনেকে ছয় মাসে একবার হয়তো কোন বস্ত্রালয়ে যাই। আমি আজ কোন বিখ্যাত দোকান থেকে পোশাক কিনলে পরের বছর অলিগলির অখ্যাত দোকান থেকে কাপড় কিনি। আর যখন কোন দোকানী বলে, আসলে এই কাপড়ের দাম এক হাজার টাকা। আপনার জন্য শুধু কম দাম চেয়েছি। আপনাকে কেনা দামে মাত্র ছয় শত টাকায় বস্ত্রটি দিচ্ছি।
এমন বেশ কয়েকজন দোকানীর মুখের উপর আমি কাপড় ছুঁড়ে মেরে চলে এসেছি। কারণ আমার চৌদ্দ পুরুষের কেউ কাপড়ের ব্যবসা করেনি। সেই দোকানী আমার শ্বশুর পক্ষেরও কেউ না। তাহলে তার সঙ্গে আমার কিসের সখ্য! এবং এসব লোকের চোখের দিকে আমি কখনও তাকাই না। কারণ আমি চাই না আমার মন্দ আচরণের ফলে ওদের কারও মলিন মুখের প্রতিচ্ছবি আমার অন্তরে গেঁথে থাকুক। ওদের অবর্তমানে ওদের কথা স্মরণ করে আমি কষ্ট পাই। অথবা ওরা আমার হাতে একটি কম দামের পোশাক ধরিয়ে দিয়ে বেশি টাকা নেওয়ার সুযোগ পাক।
জগতের অনেকে রিক্সাওয়ালা ও সিএনজি চালকের সঙ্গে খাতির জমানোর চেষ্টা করে। ওতে তাদের লাভ আছে, মোটেও কোন ক্ষতি নেই। আমি সেই নিজের লাভও বোঝার চেষ্টা করি না। আমি একই রিক্সায় অথবা সিএনজিতে একবারের বেশি চড়েছি বলে মনে পড়ে না। তাদের সঙ্গে আমার দৃষ্টি বিনিময়ও হয়নি। আমি ভাড়া চুকানোর সময়ও ওদের মুখের দিকে তাকাই না। কারণ আমি চাই না একজন রিক্সা ও সিএনজি চালক আমাকে মনে রাখুক। অথবা নিরাপদ ও আরামদায়ক যাত্রার জন্য তাদের আমি খুঁজে বেড়াই।
এমনকি অনেকে নাপিতের সঙ্গেও সখ্য গড়ে তুলে। অনেকে সেলুনে ঢুকে শূন্য চেয়ার পেলে আয়নার সামনে বসে নিজের চেহারা ঘুরে ফিরে দেখে আর নাপিতের সঙ্গে গল্প করে। আমি মাসে একবার চুল কাটাই। এ বছর জানুয়ারিতে যে সেলুনে চুল কাটাই তার দেড় বছর পর জুলাই মাসে সেই সেলুনে আবারও যাই। কারণ শহরে সেলুনের সংখ্যা সীমিত। তারা আমার কথা স্মরণ রাখতে পারে না।
আর আমি ভুলেও চাই না কোন নাপিত আমার চুল কাটতে কাটতে রাষ্ট্রের অথবা রাজনীতির গল্প, কারও প্রেম কাহিনী শোনানোর চেষ্টা করুক। অথবা আমার চুল কোন বিখ্যাত নায়কের মতো এমন আজগুবি গল্প শোনাক। তাছাড়া যতক্ষণ সে চুল কাটে ততক্ষণ আমি চোখ বুজে থাকি। কারণ তখন তার এবং আমার প্রতিচ্ছবি এক সমতলে প্রতিফলিত হয়। সুতরাং চোখে চোখ পড়াটা অস্বাভাবিক নয়- যা আমি কোনভাবেই প্রত্যাশা করি না।
জীবনে বাসের একজন সুপারভাইজারের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেছিলাম। সেদিন আমার নিজ শহর শেরপুর থেকে ঢাকায় যাচ্ছিলাম। আমার টিকেট কাটা হয়নি। নকলা পেরিয়ে বাসের সুপারভাইজার আমার সিটের পাশে দাঁড়িয়ে সালাম জানিয়ে বললো, ভালো আছেন স্যার! অনেকদিন পর আপনাকে দেখলাম। ভালো লাগলো। ভাড়াটা দিন স্যার।
সুপারভাইজারের এমন কথা শুনে আমার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল। কেননা আমি সুনিশ্চিত এই বাসে আমি এর আগে কখনও যাত্রা করিনি। তার কণ্ঠস্বরও আমার পরিচিত নয়। আমি তার মুখের দিকে এমন ভাবে তাকালাম যেন তোর চোখে চোখ না পড়ে। ওর দৃষ্টির সঙ্গে আমার দৃষ্টি একরেখায় সমপাতিত না হয়। কিন্তু হলো না। আমার অপাঙদৃষ্টিতে তার চোখের বিচ্ছুরিত দ্যোতিতেও হাসির ঝিলিক দেখতে পেলাম। আমি সহ্য করতে পারলাম না। তাকে আমি যা-তা বলে গাড়ি থামিয়ে পথেই নেমে গেলাম এবং তাকে ভুলে গেলাম। আমি পরে বহু কষ্ট স্বীকার করে ঢাকায় পৌঁছুলাম।
আমি পথ চলার সময় মাথা নীচু করে হাঁটি। আমি কাউকে সালাম জানাই না এবং কারও সালামের প্রত্যাশা করি না। কোন যানবাহনে যাত্রার সময় পাশের সহযাত্রীর সঙ্গেও কথা বলি না। সে নারী না পুরুষ, যুবক না বৃদ্ধ, কালো না ধলো, স্বদেশী না ফিরিঙ্গি- সেসব চিন্তাও করি না। এমনকি পাশের যাত্রী উপযাচক হয়ে যেন এটাসেটা জিজ্ঞেস না করে তাই আমার মুখে রাজ্যের বিরক্তির চিহ্ন ফুটিয়ে রাখি। 
হ্যাঁ। আমি শতভাগ সত্য বলছি। বিশ্বাস করুন আমি হলফ করে বলছি। আমি এমনই মন্দ চরিত্রের একজন মানুষ। আমার সহকর্মীরাও আমাকে কেউ পছন্দ করে না। তারা প্রয়োজনের খাতিরে আমার কাছে আসেন। অথবা আমি তাদের কাছে যাই। সেই প্রয়োজন মিটে গেলে কারও কথা মনে রাখি না। কারণ তারা কেউ আমার চোখের দিকে তাকানোর দুঃসাহস করেন না। আমিও কারও দিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করি না। একদিন এক মহিলা সহকর্মী অনেকটা ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না কেন!
আমি তার এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনও প্রয়োজনবোধ করিনি। কারণ তিনি শুধুই আমার একজন মহিলা সহকর্মী। যিনি আমার কাছে আর দশজন পুরুষ সহকর্মীর মতোই। আমার কোন দোষের জন্য তার কাছে জবাবদিহিতা যেমন নেই ঠিক তেমনই তার মুখে আমার কোন গুণের প্রশংসা শোনারও অবকাশ নেই। আমি আমার অফিসটাকে অফিসই মনে করি। এখানে কারও সঙ্গে আন্তরিকতা বা ঘনিষ্ঠতারও তাগিদ অনুভব করি না। আমি কাজে বিশ্বাস করি। আমি সখ্য গড়ে কাজে ফাঁকি দেওয়া ঘৃণা করি।
সুতরাং আমি কারও চোখের দিকে তাকাই না। কাউকে আমার চোখের দিকে তাকানোর অবসর দেই না। আমি ভুলেও চাই না কারও অন্তরে আমি আসন গেড়ে বসি। আবার এটাও চাই না কারও মুখচ্ছবি দিবানিশি আমার মনের মুকুরে প্রতিফলিত হোক। আমি আবারও বলছি এই মুখচ্ছবি আমার গর্ভধারিণী মা, জন্মদাতা বাবা, স্নেহময়ী বোন, আদুরে ভাই, মমতাময়ী স্ত্রী, স্নেহের পুতলি সন্তান, বংশধারার স্বজন, রক্ত বন্ধনহীন আপনজন বন্ধু-বান্ধব কারও নয়, কারও নয়, কারও নয়।
তবুও সেই আমি একটি অবিশ্বাস্য সত্য বলছি। সেই দৃষ্টির কথা বলছি। যে দৃষ্টির কথা আমার প্রিয়তমা স্ত্রীরও জানা নেই। যে দৃষ্টির কথা জগতের দ্বিতীয় কোন প্রাণি জানে না। বিয়াল্লিশ বছর আগের এক অন্তরভেদী দৃষ্টির দ্যোতির কথা বলছি। যা আমার অন্তরে আঁক কেটেছিল। যা বহুবার বহু চেষ্টা করেও অবলোপন করা সম্ভব হয়নি। সেই সাদামাটা এক দৃষ্টির মাঝে কি ছিল আজও বুঝতে পারিনি।
তখন কৈশোর পেরিয়ে সবে যৌবনে পা পড়েছে। আমার এক সহপাঠীর বাড়ি ভায়াডাঙ্গা। চার বন্ধু ও আমি পাঁচজন বাইসাইকেল চালিয়ে প্রথমে শেরপুর থেকে ভায়াডাঙ্গায় বন্ধুর বাড়ি গেলাম। পরদিন ভোরে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতে গেলাম। সেই সহপাঠীর বাবা অস্বচ্ছল মানুষ। তিনি শুধু রাতে আমাদের জন্য একমুঠো ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করেছিলেন। তবু তাকে আমরা ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম।
সকালে আমরা সবাই অভুক্ত অবস্থায় বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তখন আম-কাঁঠালের মৌসুম ছিল। এক পাহাড়ে একজন শুধু কাঁঠাল ও পেয়ারা চাষ করেছিল। আমরা সেখানে যাওয়ার পর সেই লোক দুটো গাছপাকা সুমিষ্ট ও অতুলনীয় স্বাদের কাঁঠাল ও সামান্য চিড়া খেতে দিয়েছিল। তাছাড়া অনেকগুলো পেয়ারাও দিয়েছিল। তার আতিথেয়তায় আমরা বিমুগ্ধ হয়েছিলাম। সেসব আমরা পেট পুরে খেয়েছিলাম।
তাছাড়া অপর এক পাহাড়ে এক গারো আমাদের এক ডজন কলা বিনামূল্যে দিয়েছিল। সে পাঁচটি কাসাভাও দিয়েছিল। সেসব আমরা পাঁচজন ভাগাভাগি করে খেয়েছিলাম। এরপর মধ্যাহ্ন পর্যন্ত এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ঘুরেছিলাম। কিছুক্ষণ পর পর ঝর্ণার স্বচ্ছ্ব ও শীতল পানি খেয়েছিলাম। আমরা প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলাম। তবে আমাদের পকেটে কোন কিছু কেনার মতো পয়সা ছিল না। পাহাড় থেকে সরাসরি শেরপুরে ফেরার পথে আমরা চোখে ধুঁয়াশা দেখছিলাম।
আমাদের দেহে বাইসাইকেল চালানোর মতো বল ছিল না। আমরা মাঝে মাঝেই পথের পাশে গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। বেলা পড়ে আসছিল। শেরপুরে ফেরার তাড়া ছিল। আমরা একটি কালভার্টের পাশে বটগাছের ছায়ায় ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। আমি পথচারীদের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলাম। একটি রিক্সা সেই পথে যাচ্ছিল। সেই রিক্সায় একজন বৃদ্ধ ও একটি কিশোরী মেয়ে ছিল। ওর বয়স কতই বা হবে। বড়জোর তের বা চৌদ্দ। তার পরনে সাদামাটা একটি রঙিন শাড়ি ছিল। সাধারণত গ্রামের এই বয়সী মেয়েরা যেমন আটপৌড়ে শাড়ি পরে তেমনই একটি শাড়ি সে পরেছিল।

আমি আগেই বলেছি আমি পথচারীদের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলাম। তখন আমার দৃষ্টিতে উদাসীনতাও ছিল। সেই মেয়েটির মুখাবয়বও অনিন্দসুন্দর বা তিলোত্তমা সদৃশ কিছু ছিল না। তার দুটো চোখও পটোলচেরা বা পদ্মলোচনের ন্যায় ছিল না। তার দৃষ্টিতেও অতলান্ত গভীরতা ছিল না। তার মুখে মনোহরা হাসিও ছিল না। তার ঠোঁটের কোণেও দুষ্টুমিভরা হাসি লুকানো ছিল না। ওর চোখে আমার চোখ পড়লো। আমার ভিতরে কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। আমার বন্ধুরা ওর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
তখন কনে দেখার বেলা। পড়ন্ত সূর্যের সোনালী রোদের আভা সেই মেয়েটির মুখে পড়েছিল। রিক্সাটা আমাদের পেরিয়ে গেল। আমার বন্ধুরা তবুও ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি বাইসাইকেল নিয়ে রওনা হতে চাইলাম। ঠিক তখনই আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও নিকৃষ্টতম অঘটনটি ঘটে গেল। সেই মেয়েটি আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো। ওর দৃষ্টি আমার দৃষ্টির সঙ্গে একাকার হয়ে গেল। মনে হলো আমার বুকে কে একজন অদৃশ্য তীর ছুঁড়ে মারলো। আমি তৎক্ষণাৎ শরাহত বিহগের ন্যায় ছটফট করতে লাগলাম।
কিন্তু রিক্সা বেশ দ্রুত এগিয়ে গেল। যতক্ষণ রিক্সাটি আমার দৃষ্টি সীমায় ছিল সে ততক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর সেই দৃষ্টিতে কি ছিল আমি আজও তার ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। ওর মতো করে আর কেউ কখনও আমার চোখে চোখ রাখেনি। ওর মতো করে আরও কারও দৃষ্টি আমার দৃষ্টির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়নি। আর ওর সঙ্গে এ জীবনে আর কখনও দেখা হয়নি। অথচ সেই অভিশপ্ত দৃষ্টি আমার দৃষ্টিকে আজও সমাচ্ছন্ন করে রেখেছে। আমি আমার দৃষ্টির মাঝে অহর্নিশি সেই দৃষ্টিকে দেখতে পাই।
লেখক: মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল