Category ছোটগল্প

বিয়ে বাড়ির রোস্ট

বিয়ে বাড়ির মুরগীর রোস্ট ছিল রবিউলের অত্যাধিক পছন্দের। বলা যায় তখন একটা মুরগীর রোস্টের জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারতো ও! কিন্তু হলে কি হবে বরযাত্রী দলে তো নেয়া হয়নি ওকে। রবিউল বরযাত্রী দলে জায়গা পায়নি বলে বাড়িতে সবচেয়ে বেশী কষ্ট পেলেন দাদীমা। উনি নাতির মাথায় হাত দিয়ে স্বান্ত্বনার সুরে বললেন, ‘ভাই তোমার লাগি আমি রোস্ট বানায়া দিমু।’ রবিউল দাদীর কথায় বিশেষ গুরুত্ব দিল না। নয় বছর বয়সেই ও বুঝে গিয়েছিল, বাড়িতে দাদীর কথার কোন দাম নেই। তাছাড়া দাদী কি ভবিষ্যদ্বানী করেন, নিজেই সেটা পরে মনে রাখতে পারেন না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, বাড়ির বানানো রোস্ট বিয়ে বাড়ির রোস্টের মতো কখনই এতো মজা হয় না। গ্রামের কাদের গাজীর ছেলে কবির গাজীর বিয়েতে এক পরিবার থেকে একজন হিসেবে দাওয়াত পেয়েছে রবিউলের বাবা শফিকুল ইসলাম। মেয়েপক্ষ থেকে বরযাত্রী সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। সেই সংখ্যা ধরে রাখতে হিমশিম খাওয়ার মতো অবস্থা কাদের গাজির। যে সময়ের কথা বলছি তখন বিয়ের সময় জিজ্ঞাসা করা হত, কয়টা কোস্টার যাবে? কোস্টার মানে পরিবহণ রুটের বাস। কারো বিয়েতে দুইটা কোস্টার ভাড়া করা মানে তারা বেশী ধনী, দাপট আছে। আর তিনটা করা মানে বিদেশে আত্মীয় স্বজন আছে।। কবির গাজীর বিয়েতে একটা কোস্টার ভাড়া করা হয়েছিল, কারণ তারা মধ্যবিত্ত। একটা কোস্টার হওয়াতে জায়গা পর্যাপ্ত ছিল না। যে কারণে বাড়ি গুনে শুধু পরিবারের প্রধানকে বলা হয়েছিল। ছোটদের কাউকে বলা হয়নি। পরিবারের প্রধান হিসেবে দাওয়াত পেয়েছিল রবিউলের বাবা। দাওয়াত দিয়ে গাজি বাড়ির…

একজন আপোষহীন খলি মন্তাজ

বিলেকাসা ঝলমলে বিশাল হলরুম। মানুষে ঠাসা, কিন্তু কোন ফিসফাস নেই, অন্য কোন শব্দ নেই। শব্দ শুধু একজনের কথার, সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছেন। তার প্রতিটি শব্দ যেন সবাই গিলে খাচ্ছেন। যিনি কথা বলছেন তিনিই খলি মন্তাজ। অনেকেই তাকে দেখেছে, হয়ত এই প্রথম তাকে শুনছে। অনেকে তাকে শুনেও থাকতে পারে, কিন্তু এই প্রথম তাকে দেখছে। কিন্তু আমি তাকে এই প্রথম দেখলাম, তাকে এই প্রথম শুনলাম, এবং আমি আনন্দে কাঁপলাম। খলি মন্তাজ, দৈনিক কালিত কালিমা পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। পত্রিকা জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কি অদ্ভুত সুন্দর তার কথা, পত্রিকা বুঝবে শুধু দেশ এবং মানবতা, একটি পত্রিকা হল সমাজ এবং দেশের জন্যে এক কলুষমুক্ত দর্পণ, সাংবাদিক হবেন সত্যের বাহক, দেশ এবং মানবতার খাতিরে একজন সাংবাদিক কখনোই মিথ্যার সঙ্গে আপোষ করতে পারেন না, একটি পত্রিকার সম্পাদক … আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি দৈনিক কালিত কালিমা পত্রিকার আপোষহীন সম্পাদক খলি মন্তাজকে। এত দিনেও কোন শিক্ষক আমাকে সাংবাদিকতা বা পত্রিকা নিয়ে এরকম কথা বলতে পারেননি। খলি মন্তাজের প্রতিটি কথা আমার হৃদয়ে নতুন ভাবে বাজতে থাকে। আমি ঠিক করে ফেলি, পাশ করেই আমি খলি মন্তাজের দৈনিক কালিত কালিমা পত্রিকায় জয়েন করব, খুব কাছ থেকে সাংবাদিকতা শিখব খলি মন্তাজের কাছে। অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে আমার ঘুম আসে না। এত বড় অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার কথা না। আমার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান স্যারের কারণে আমি এই সুযোগ পেয়েছি। বিশেষ একটি কারণে তিনি আমাকে খুবই পছন্দ করেন। খলি মন্তাজের কথায় এখনো মোহাবিষ্ট…

সেই দৃষ্টি

মোহাম্মদ কামরুজ্জামান আপনারা বিশ্বাস করুন বা না-ই করুন, আমি চাইনে কোন মানুষ আমার ততোটা প্রিয় হয়ে উঠুক যার প্রতিচ্ছবি আমার মনের মুকুরে অবরে সবরে প্রতিফলিত হবে। সেটা আমার সবচেয়ে বড় আপ্তজন মা-বাবারও না। কারণ আমি চাই না তাঁদের কারও প্রতিচ্ছবি আমার অন্তরে গেঁথে থাকুক। তাঁদের অবর্তমানে তাঁদের কথা স্মরণ করে আমি কষ্ট পাই। অথবা আমার অবর্তমানে তাঁরা কোন রকম আমার অভাববোধ করুন। যদিও আমি সেজদায় পড়ে আমার মা-বাবার জন্য দোয়া করি, রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।তবে সেজদায় পড়ে দোয়ার সময় ক্ষণিকের জন্য মা-বাবার আশীর্বাদাচ্ছন্ন মুখচ্ছবি আমার অন্তরে বাঙ্ময় হয়ে উঠে। আবার মুছে যায়। আমি তাঁদের মনে রাখতে চাই না। তাই কখনও তাঁদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলি না। কারণ চোখের দৃষ্টিই সর্বনাশা। সে মিথ্যে বলতে জানে না। সে সবসময় অকপট সত্য বলে। আমি যে আমার মা-বাবাকে জগতের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তা গোপন রাখার জন্যই তাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলি না।এমনকি আমার বাবা কোন কারণে আমার প্রতি ক্রোধান্ধ হলেও তাঁর চোখের দিকে তাকাই না। অথবা আমার মা আমার জন্য দোয়া করে কেঁদে বুক ভাসালেও তাঁর মুখের দিকে তাকাই না। অথচ আমি জানি এবং মানি যে, মা-বাবার চোখের দিকে শ্রদ্ধাপূর্ণ ও মমত্ববোধের দৃষ্টিতে তাকালে চোখের জ্যোতি বাড়ে। পরম করুণাময় আল্লাহ্ পাকের করুণা লাভ করা যায়। আমি এমনই পামর যে জানি তবে মানি না। এর পরের স্তরের আমার আপ্তজন আমার সুপ্রিয় ভাই-বোন। আমি বড় কি ছোট, কোন ভাই-বোনের চোখের দিকে তাকাই না। অথচ…

মেয়ে

মুজতাহিদ ফারুকী দেখ দেখ, এর চোখ দুইটা; কী মায়াবী! শায়লা মন্ত্রমুগ্ধ স্বরে মাহতাবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।শায়লার কোলে বিড়ালের বাচ্চা। বুকের কাছে জড়িয়ে রেখেছে। ছোট্ট একটা প্রাণ। বড় বড় চোখ মেলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। কিছু কি বলতে চায়! জানার উপায় নেই। মুরাকামির কাফকা অন দ্য শোর উপন্যাসের বুড়ো নাকাতাই কেবল বিড়ালের ভাষা বোঝে। তাদের সঙ্গে কথা বলে। নবী সোলেমানের কথা আলাদা। তিনি সব প্রাণী ও জিনের ভাষা বুঝতেন। পিঁপড়ারও। কিন্তু জীবন ফিকশন না, ফ্যান্টাসিও না।মাহতাব ডিভানে শুয়ে, চোখের সামনে খোলা বই। একবার চোখ ফিরিয়ে দেখে। মুচকি হেসে বলে, সত্যি, খুব মায়াময়। একদম নিশি বিড়ালীনী।সে আবার বইয়ে মন দেয়।শায়লার গালে আবিরের লালিমা! অস্পষ্ট। ‘নিশি বিড়ালীনী’র রহস্যে রঙিন। শুধু ওরা দুজনেই জানে। বছর ত্রিশেক আগে মাহতাবের গ্রামের বাড়ি। শীতের রাত। জীর্ণ টিনের ঘর। ফুটোফাটা দিয়ে আসে হিম বাতাস। লেপকাঁথা মানতে চায় না। হাড় কাঁপে। ঘন হতে হতে মাহতাবের বুকের মধ্যে ঢুকে পড়ে নতুন বউ শায়লা। দুটি শব্দ, নিশি, বিড়ালীনী, ধরে আছে সেইসব সোহাগ রাত, রোমাঞ্চের স্মৃতি! প্রথম বর্ষায় কদমের কুঁড়ি। শায়লা শুধু মৃদু হাসে। এক পলকে কূপিত কটাক্ষ ছুঁড়ে চলে যায় ভিন্ন প্রসঙ্গে। বিড়াল ছানার মাথায় গলায় হাত বুলিয়ে আবার মুখ খোলে, অ্যাই শোনো না, এটা ছেলে, নাকি মেয়ে?একটু থমকায় মাহতাব। তাই তো! কথাটা তো মনেই আসেনি। লেজ সরিয়ে দেখে নাও তো! আমি ঠিক বুঝি না। এত ছোট! আচ্ছা, বড় হোক, তখন এমনিতেই বোঝা যাবে।জিতু কিন্তু বলেছে, এটা মেয়ে বাচ্চা। তাই নাকি?…

অচিন গ্রাম

বিলেকাসা আমার জন্যে ঢাকা শহর এক করুণ রসিকতা! ঢাকাকে কখনোই আমি আমার শহর বলে ভাবতে পারি না। এখানে সবই আছে, শুধু প্রাণ ভরানো আনন্দ নেই; আবার বেশি টাকা পাই বলে আমি ঢাকা ছাড়তে চাই না, কম টাকায় চলতে পারব না বলে গ্রামেও যাই না। তবে গ্রাম দেখার জন্যে প্রাণ সব সময়ই ছটফট করে। সুযোগ পেলে আর ছাড়ি না। এবার আমন্ত্রণ পেলাম আমার বন্ধু সুমনের কাছ থেকে। সুমন থাকে গ্রামে। কিছুদিন আমাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিল। কিন্তু শেষ করতে পারেনি। ফিরে গেছে গ্রামে। যে কয়দিন হলে ছিল তাতেই ওর সঙ্গে ভালো একটু বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এই বন্ধুত্ব এখনো টিকে আছে। ঢাকায় এলে সুমন আমার বাসায় উঠে। তখন ওর চোখে আমি দেখতে পাই লাউ ডগার লকলকে সবুজ সুখ, ওর চেহারায় থাকে দিগন্ত ছোঁয়া সবুজ মাঠের উপর সোনালি রোদের ঝিলিক। বেশ কয়েকবারই আমাকে ওদের বাড়িতে যেতে বলেছে, আমিও যেতে রাজি হই, আমি মন থেকেই রাজি হই, কিন্তু শেষে আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। এবার আর না গিয়ে পারলাম না। শরীর মন দুটোই ঢাকা ছাড়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছে। ও বলা মাত্র চলে গেলাম ওদের গ্রামে। আমার মেয়েটাও আসতে চেয়েছিল, কিছু একটা কিছু ভেবে ওকে না করেছি। সবাইকে রেখে আমি একাই এসেছি। দুইদিন মাত্র থাকব, আমার ইচ্ছা এর মধ্যে যত রকম করে পারি গ্রাম চেখে দেখব। জার্নির ধকলে একটানা লম্বা ঘুম। ঘুম ভেঙ্গে শুনি বাইরে চাপ কলের শব্দ। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি ভোর পাঁচটা বাজে। সুমনকে…