একজন আপোষহীন খলি মন্তাজ

বিলেকাসা

ঝলমলে বিশাল হলরুম। মানুষে ঠাসা, কিন্তু কোন ফিসফাস নেই, অন্য কোন শব্দ নেই। শব্দ শুধু একজনের কথার, সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছেন। তার প্রতিটি শব্দ যেন সবাই গিলে খাচ্ছেন। যিনি কথা বলছেন তিনিই খলি মন্তাজ। অনেকেই তাকে দেখেছে, হয়ত এই প্রথম তাকে শুনছে। অনেকে তাকে শুনেও থাকতে পারে, কিন্তু এই প্রথম তাকে দেখছে। কিন্তু আমি তাকে এই প্রথম দেখলাম, তাকে এই প্রথম শুনলাম, এবং আমি আনন্দে কাঁপলাম। খলি মন্তাজ, দৈনিক কালিত কালিমা পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। পত্রিকা জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কি অদ্ভুত সুন্দর তার কথা, পত্রিকা বুঝবে শুধু দেশ এবং মানবতা, একটি পত্রিকা হল সমাজ এবং দেশের জন্যে এক কলুষমুক্ত দর্পণ, সাংবাদিক হবেন সত্যের বাহক, দেশ এবং মানবতার খাতিরে একজন সাংবাদিক কখনোই মিথ্যার সঙ্গে আপোষ করতে পারেন না, একটি পত্রিকার সম্পাদক …

আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি দৈনিক কালিত কালিমা পত্রিকার আপোষহীন সম্পাদক খলি মন্তাজকে। এত দিনেও কোন শিক্ষক আমাকে সাংবাদিকতা বা পত্রিকা নিয়ে এরকম কথা বলতে পারেননি। খলি মন্তাজের প্রতিটি কথা আমার হৃদয়ে নতুন ভাবে বাজতে থাকে। আমি ঠিক করে ফেলি, পাশ করেই আমি খলি মন্তাজের দৈনিক কালিত কালিমা পত্রিকায় জয়েন করব, খুব কাছ থেকে সাংবাদিকতা শিখব খলি মন্তাজের কাছে।

অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে আমার ঘুম আসে না। এত বড় অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার কথা না। আমার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান স্যারের কারণে আমি এই সুযোগ পেয়েছি। বিশেষ একটি কারণে তিনি আমাকে খুবই পছন্দ করেন। খলি মন্তাজের কথায় এখনো মোহাবিষ্ট হয়ে আছি। তিনি খুব সুন্দর করে বলেছেন, সত্য বলতে গিয়ে কাউকে খোঁচা দিলে চলবে না, এমন ভাবে কলম ধরতে হবে যেন একটি ফুলের গায়েও আঁচড় না লাগে। কলম ধরার আগে অনন্ত এক শ বার ভাবতে হবে, দেশ এবং মানবতার কি হবে, সবার আগে …

যতই খলি মন্তাজের কথা ভাবি ততই আমি রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি। আমার ঘোর কাটে না। আমার রেজাল্ট অনেক ভালো আছে, তার ওখানে চাকরি পেতে কষ্ট হবে না। এখন শুধু আর দেড়টি বছর পার করতে পারলেই হল। আমার সত্যিকারের সাংবাদিক জীবন শুরু হবে। ক্যাম্পাসের সাংবাদিকতা যেন এর ওর ফরমাশ খাটা! এ ডেকে বলছে, আজ এই নিউজটা করে দাও, কাল ডিন বলছেন, বিকেলে একটু এসো, ভালো একটি নিউজ করতে হবে, … এর মাঝে আছে নানান হম্বিতম্বি, যেন আমি ওদের …

আমার দেড় বছর যেতে সময় লাগে না। পুরোটা সময়ই ঘোরে কাটিয়ে দিলাম। খলি মন্তাজ, দৈনিক কালিত কালিমা পত্রিকার প্রধান সম্পাদক, একজন আপোষহীন সাংবাদিক। দৈনিক কালিত কালিমার প্রতি আমার তেমন কোন মোহ নেই, যদিও বিশ্বাস যোগ্যতা এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে ওরা একটি বিশেষ অবস্থান করে নিয়েছে। কিন্তু আমার মোহ খলি মন্তাজ। পাশ করার আগে থেকেই চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে। তিনিও আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন, বিশ্বমানের সাংবাদিক হতে গেলে খলি মন্তাজের বিকল্প নেই। একটি সুন্দর সিভি বানিয়ে চলে এলাম খলি মন্তাজের কাছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে সেদিন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। আমার মাথা ছিল ভেজা। কিন্তু খলি মন্তাজের ঘরে ঢুকার পর আমার বিশ্ব বদলে যায় এক মুহূর্তে। এপয়েন্টমেন্ট আগেই করা ছিল, আমার চেয়ারম্যান স্যার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। খলি মন্তাজের অভ্যর্থনায় আমি মুগ্ধ হলাম বললেও ভুল হবে, আমি রীতিমত বিস্মিত। বড় কাপে কফি খেতে খেতে সাংবাদিকতা নিয়ে অনেক কথা হল; এতদিন আমি যে কফি টেলিভিশনে দেখেছি।

সেদিন খলি মন্তাজ বলছিলেন, সাংবাদিকতা সুধু দেখিয়ে দেয়া নয়, সেটা আলোর কাজ, একজন সাংবাদিকের কাজ হচ্ছে … এতদিন আমি শুনেছি, পত্রিকা হচ্ছে সমাজের দর্পণ, খলি মন্তাজের কাছে সুনলাম, আসলে তা নয়, এটা হচ্ছে একই সঙ্গে সমাজের ব্রেইন, লানক্স, কিডনি, লিভার, … পত্রিকার কাজ হল মানুষকে জাগিয়ে রাখা, মানুষের চিন্তার … খলি মন্তাজ আমাকে বললেন, এখানে কেউ কারো বস বা কেউ কারো অধীনে নয়, সবাই সমান, সততা আর নিষ্ঠা ধরে  রাখবে, তাহলেই তুমিই তোমার নিজের বস।

এক অদ্ভুত আনন্দ আর উত্তেজনায় দৈনিক কালিত কালিমায় আমার জীবন শুরু হয়ে গেল। আমার প্রথম নিউজ ছিল গলিমোর্চা ফার্নিচারের সামনের একটি ঘটনা নিয়ে। ভোর বেলায় তাদের হেড অফিসের সামনে একটি লাশ পাওয়া যায়। আমি পুরো ব্যাপারটা তুলে ধরি একজন দর্শকের দৃষ্টি থেকে। ধারণা করেছিলাম আমার বর্ণনাটা খলি মন্তাজের অনেক পছন্দ হবে, তিনি খুশি হয়ে আমার পিঠ চাপড়ে দিবেন। কিন্তু ঘটনা ঘটল উল্টা, নিউজটা পড়ে বললেন, এটা কি লিখেছ, পড়ে মনে হচ্ছে মেঘ এল বৃষ্টি পড়ল, আর কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না, এটা কোন নিউজ হতে …

প্রথমেই এত বড় ধাক্কা। কিন্তু একটু পরেই তিনি সুন্দর করে গুছিয়ে বললেন, কি করতে হবে। খুনের ঘটনায় চারপাশটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে কিছু প্রশ্নে উত্তরের দিকে ইঙ্গিত থাকতে হবে, যেমন গলিমোর্চা ফার্নিচারের সামনেই কেন এই লাশ পড়ে থাকবে, ঢাকায় কি জায়গার অভাব আছে, কত ডাস্টবিন, কত ড্রেন, আর অত বড় বুড়িগঙ্গা তো পড়েই আছে। এই ধরণের খবরে কি হতে পারে তারও একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত থাকতে হবে। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় ক্রাইমের সুরাহা পাওয়া গেছে পত্রিকার সংবাদের সূত্র ধরে। আমাকে বলা হল, গলিমোর্চা ফার্নিচারের ভেতরের কিছু খবর বের করে আনতে, একই সঙ্গে কার কাছে গেলে এগুলো পাওয়া যাবে তাও বললেন।

পরের ছয় ঘণ্টায় সুন্দর একটি স্টোরি লিখে ফেললাম, সঙ্গে বড় একটি রঙিন ছবি, লাশ আর গলিমোর্চা ফার্নিচার এক ফ্রেমে, ছবি দেখে খলি মন্তাজ পর্যন্ত মুগ্ধ! বাইরের লাশের সঙ্গে গলিমোর্চা ফার্নিচারের ভেতরটা মিলে বেশ একটা রিপোর্ট। আমাদের নিউজটা বেশ একটু তোলপাড় করেছে, বিশেষ করে সোশাল মিডিয়ায়। এই দেখে খলি মন্তাজ আমার পিঠ চাপড়ে বলেছিল, বলত দেখি, একটি দেশের সব কিছু নষ্ট হলেও, শুধুমাত্র কোনটা ঠিক থাকলে একটি দেশ ভেসে যেতে পারে না? আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলাম, শিক্ষা। খলি মন্তাজ হেসে বললেন, হয়নি, আরেকবার ভেবে উত্তর দাও। আমি আবার ভাবলাম, এবার উত্তর দিলাম, রাজনীতি। একটু হতাশার সুরে খলি মন্তাজ বললেন, নাহ, তাও হল না, উত্তরটা হল সংবাদ পত্র, একটি দেশে যত অনাচারই হোক না, সব কিছু অন্যায়ে ডুবে গেলেও দেশটা ভেসে যায় না, যদি সে দেশের কয়েকটি সংবাদ পত্র সততার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশন করে।

আমাদের সততা আর সাংবাদিকতার পুরষ্কার পেতে বেশি দেড়ি হল না। খোদ গলিমোর্চা ফার্নিচার বিজ্ঞাপন নিয়ে আমাদের সঙ্গে বেশ কিছু চুক্তি করে ফেলে। যদিও ওদের নিজেরও একটি পত্রিকা আছে, চলে না তেমন। এগুলো আসলে ভালো কিছু নয়। এই দেশে ব্যবসায়ীদের টাকা হলেই কেউ একটি পত্রিকা, কেউ একটি টিভি চ্যানেল, কেউবা একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের খুলে ফেলতে চায়, অনেক বেশি টাকা থাকলে তো কথাই নেই, এক সঙ্গে পত্রিকা, টিভি, বিশ্ববিদ্যালয় সব কিছুর মালিক হতে চায়। তবে পত্রিকা হিসেবে দৈনিক কালিত কালিমা শুধু বিশ্বাস যোগ্যতায় নয়, বস্তুনিষ্ঠতাতেও সবার কাছে গ্রহণ যোগ্য একটি পত্রিকা, আর এখানে একমাত্র অবদান খলি মন্তাজের।

দৈনিক কালিত কালিমার অফিসটা সত্যিই এক মুক্ত পরিবেশ। এখানে কার পদবি কি কিছুই যায় আসে না। খলি মন্তাজ নিজেও কফির মগ নিয়ে ডেস্কে ডেস্কে ঘুরে যান। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে গল্প করেন, এই ফাঁকে কাজটাও সেরে নেন। তার হিউমারগুলো অসাধারণ, এই হিউমার দিয়েই দেশ বা সমাজের অনেক কিছুই এক সঙ্গে তুলে ধরতে পারেন। সেদিন বলছিলেন, সাধারণ মানুষের কথা। তাদের ধারণা নাকি, নিরীহের দিকে থেকে সবার প্রথমে সাধারণ মানুষ, তারপর পুলিশ, পুলিশের উপরে আমলা, আমলার উপরে রাজনীতিবিদ, তাদের উপর সাংবাদিক, … তার উপরে শয়তান, এবং শয়তানের উপরে একজন সম্পাদক। তার এই কথায় আমি রীতিমত স্তব্ধ, পরের কয়েকদিন এটাই ভেবেছি, কত পরিস্কার করেই না সমাজের চিত্রটা বলে গেলেন নিছক একটি হিউমার দিয়ে। তবে তিনি একই সঙ্গে এও বলেছেন, একজন যথার্থ সাংবাদিক হলেন শিশুর মত, যে শিশু সরল মনে সত্যের সঙ্গে থাকবেন, এবং সমাজ ও দেশের স্বার্থে সেই সত্য তুলে ধরবেন।

খলি মন্তাজের মনটাও যে শিশুর মত এটা টের পেলাম কিছুদিন পর। কি একটা কাজে তার ঘরে গেছি। আমার কফিতে চিনি কম হয়েছে বলে আবার একটু চিনি চাই। ছেলেটা আমাকে চিনি দিয়ে গেছে। কাজ শেষে চলে আসব, খলি মন্তাজ আমাকে বললেন, একটু বস। আমি বসার পর বললেন, তুমি দিনে কয় কাপ কফি খাও? প্রশ্নটা কি ধরণের বুঝতে পারছি না, তারপরেও বললাম, এই পাঁচ সাত কাপ।

একবার একটু চিনি কম খেলে কি হয়, পাঁচ কাপের মধ্যে একবার এক কাপে চিনি কম!

চিনি একটু বেশি হলে কফি খেতে খুব ভালো লাগে।

আমার কথায় তিনি একটু হাসলেন। তারপর বললেন, ও যে তোমাকে কষ্ট করে এক কাপ কফি দিয়েছে, এটা কিন্তু ওর জন্যে অনেক বড়, ও আশা করে তুমি খেয়ে বলবে ভালো হয়েছে।

জি, ও তো কফি খুবই ভালো বানায়, তবে মাঝে …

এখানে কফি বা চিনি কোনটাই গুরুত্বপূর্ণ না, এখানে হল দুটো মানুষের মাঝে সম্পর্ক, এর জন্যে সামান্য চিনি …

এবার বুঝতে পারি, লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে। সত্যিই তো, একটু চিনি কম বা বেশি তাতে কিছুই যায় আসে না। এবং খলি মন্তাজ বললেন, ওর বানানো চা বা কফি নিয়ে কোনদিন তিনি নেগেটিভ কিছু বলেননি, সব সময়ই বলেছেন ভালো হয়েছে, শুধু তাই না, এটা তার সব সময়ই ওর বানানো কফি ভালো লাগে, ব্যাপারটা পুরোটাই মনের।

খলি মন্তাজকে দেখছি, তার সঙ্গে যত মিশছি, তত বেশি অবাক হচ্ছি। সুযোগ পেলেই তিনি চা বানানো ছেলেটার কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলেন। মানুষের মন যে কত বড় হতে পারে তা খলি মন্তাজকে না দেখলে বুঝা যায়। আসলে তার গুণের শেষ নেই। তার আরো একটা বড় গুণ হল, সবার পরিবারের খবর রাখা। স্বামী স্ত্রী সন্তান থেকে মা বাবা ভাই বোন সবারই খবর তিনি রাখেন। একজন মানুষ, কিভাবে এতটা পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে আমি ভেবে পাই না। অথচ দেখে মনে হয় তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান দৈনিক কালিত কালিমা এবং স্বচ্ছ সাংবাদিকতা! তার লেখা দেখে আমার মনে হয় তিনি যেন পুরো বুরিগঙ্গার ময়লা ছেঁকে ছেঁকে দুই এক বিন্দু হীরের মত শিশির তুলে আনেন, যেখানে আছে শুধু শুভ্রতা আর স্বচ্ছতা, ভোরের আলোতে যার রঙিন দিপ্তি ছড়িয়ে যায় চার পাশে।

আমি ভেবেছিলাম সাংবাদিক মানেই যেন আড্ডা দেয়ার অফুরন্ত সময়। আমার একটা বড় স্বপ্ন ছিল প্রতিদিন অফিস শেষে ক্যাম্পাসে যাব, সবার সঙ্গে আড্ডা দেব। জুনিয়রদের বুঝিয়ে বলব সত্যিকারের সাংবাদিকতা কি জিনিস। কিন্তু দৈনিক কালিত কালিমায় জয়েন করে আমি দুই মাসেও একদিন ক্যাম্পাসে যেতে পারলাম না। ডোবেলিয়া খেলভেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, আমার প্রিয় ক্যাম্পাস, যেখানে আমার সমস্ত স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল আমি সাংবাদিক হব, … সেখানে আমি যেতে পারছি না। এই নিয়ে দুঃখ করব সে সময়ও আমার নেই। খলি মন্তাজ যেন আমার চিন্তা চেতনা সবই দখল করে নিয়েছেন!

এর মাঝে হত্যমালি ফুড ইন্টারন্যাশনালে বড় একটি ঘটনা ঘটে গেছে। এই নিউজও আমার আওয়তায়। আমি নিউজটা করেই চলে যাই। আমি নিশ্চিত ছিলাম এটা প্রথম পাতায় যাবে। পুরোটাই ভালো করে বর্ণনা করেছি সঙ্গে ঝকঝকে রঙিন ছবি। খুব বীভৎস একটি খুন। হত্যমালি ফুড ইন্টারন্যাশনাল কম্পাউন্ডের ভেতরের ঘটনা। এর সঙ্গে উপরের একজন অবশ্যই জড়িত থাকা উচিৎ। আমি নিজে গিয়েছি, বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথাও হয়েছে। পুলিশের সঙ্গেও কথা হয়েছে। সুতরাং আমার নিউজে কোন ফাঁক ফোঁকর নেই।

রাতের বেলায় বারবার দেখছি দৈনিক কালিত কালিমা প্রকাশিত হয়েছে কি না, ভেতরে ভেতরে বেশ কাঁপছি, প্রথম পাতার লিড নিউজ আমার জন্যে এটাই প্রথম! কিন্তু পত্রিকা প্রকাশ পাওয়ার পর দেখি প্রথম পাতায় আমার করা নিউজ নেই। শেষ পাতায় দেখি, তাও নেই, এবং অন্য কোন পাতাতেও নেই। আমি বুঝতে পারি না কি হল, খলি মন্তাজের শেখানো উপায়েই এই নিউজ করেছি। শেষে থাকতে না পেরে সোহেল ভাইকে ফোন নেই, তিনি অফিসেই ছিলেন। আমাকে শুধু বললেন, কাল অফিসে এসেই যেন খলি মন্তাজের সঙ্গে দেখা করি! এর পর কাজ করব কি, পুরো রাত আমার ঘুমই এল না।

সকাল এগারোটায় আর থাকতে পারি না। অফিসে চলে এলাম। যদিও আমার অফিস দুটো থেকে, খলি মন্তাজ নিজেও আসেন দুটোর দিকে। সোহেল ভাইয়ের ডেস্কে উঁকি দিয়ে দেখি তিনি নেই। সামনে পেলাম নিউজের রকিব ভাইকে। তাকে বললাম, আমার নিউজের কি হল! রকিব ভাই বললেন, নিউজের কথা বাদ দাও, কাল ছিলে না বলে বেঁচে গেছ। আমি বললাম কেন, আমি তো অনেক যত্ন করে নিউজটা করেছি, যেন লিড নিউজ … তোমার ভাগ্য ভালো এই খবর ছাপা হওয়ার আগেই খলি ভাই দেখেছেন, এই খবর ছাপা হলে তুমি আমি দুজনের কেউই আজ এখানে থাকতে পারতাম না।
আমি সত্যিই ভেবে পাচ্ছি না। অথচ নিউজটা তিন কলামে প্রথম পাতার কোথায় হবে তাও আমি জানতাম। সোহেল ভাই নিজে আমাকে বলেছেন। ডেস্কে থাকা পত্রিকা তুলে দেখি সেখানে ম্যাড়মেড়ে একটি নিউজ, যেগুলো দিনের পর দিন পত্রিকা অফিসে পড়ে থাকে, সাধারণত পাতা ভরতে হলেই এগুলো ছাপা হয়। আমার একদিকে ভয় লাগছে, অন্য দিকে দুঃখও হচ্ছে, এরকম একটি সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল, প্রথম পাতায় লিড নিউজ …

ডেস্কে পড়ে থাকলেও কাজে মন বসাতে পারছি না। এর মাঝে খবর পেয়েছি খলি মন্তাজ অফিসে এসে গেছেন। বুক ঢিপঢিপ করছে। যদিও পত্রিকা অফিসে সম্পাদককে আমরা ভাইই বলি, কিন্তু এই ভাই মায়ের পেটের ভাই না, পাড়াত ভাইও না, এই ভাই হল সেই ভাই যার হাতে আমাদের …

সাড়ে তিনটায় খলি মন্তাজের ঘরে আমার ডাক পড়ল। ঘরে ঢুকেই তাকে সালাম দিলাম। কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজেই একটি চেয়ারে বসে পড়লাম। খলি মন্তাজের চোখ পড়ে আছে তারপর ডেক্সটপ মনিটরে। আমি অপেক্ষা করছি, ভেতরে ভেতরে শীতল অনুভূতি টের পাচ্ছি। একটু পর তিনি বেল টিপলেন। বেলের শব্দে দরজা দিয়ে কে এল বুজলাম না, তিনি বললেন, তাকে এক কাপ কফি দিতে। এবার আমি বুঝলাম, ব্যাপার খুবই সাংঘাতিক, তা না হলে খলি মন্তাজ আমার জন্যেও কফির কথা বলতেন।

কফি এল, তিনি কিছুটা কফি খেয়ে বললেন, হলুদ সাংবাদিকতা সম্পর্কে তুমি কিছু জান?

আমি আমতা আমতা করে বললাম, জি আমি পড়েছি।

তুমি জান এখন বাজারে কালো সাংবাদিকতা চলে এসেছ।

আমি শুধু বললাম, জি!

এগুলো কারা করে জান?

জি না!

সে সমস্ত সাংবাদিকদের কোন শিক্ষা নেই, কোন এথিকস নেই, ওরা চায় শুধু দেখিয়ে দিতে, ওরা সাংবাদিক নয়, ওরা সন্ত্রাসী, ওদের হাতের কলম এক ভয়ানক অস্ত্র, তোমার কি মনে হয় আমি বা আমার পত্রিকা কোন সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত?

জি না!

তাহলে নিউজ করতে গেলে এথিকস মনে রাখবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যা পড়ে এসেছ তা দিয়ে পরীক্ষায় পাশ করা যায়, কিন্তু ঐ দিয়ে সাংবাদিক হওয়া যায় না!

আমি চুপ করে বসে আছি। এখানে আমার ভুলটা কোথায়!

খলি মন্তাজ বললেন, একটা বিড়ালের মুখে রক্তাক্ত ইঁদুর দেখলে কি নিউজ করবে, বিড়ালটা ইঁদুর মেরে ফেলেছে?

আমি বললাম, জি।

একবারের জন্যেও ভাবলে না, এখানে হয়ত ইঁদুরের সঙ্গে বিড়ালটাও ভিক্টিম! এখানেই অন্য দশটা পত্রিকা থেকে দৈনিক কালিত কালিমা একেবারেই আলাদা, আমাদের এথিকস আছে, অন্য দশটা পত্রিকার যা নেই, তুমি চাইলেই অন্য পত্রিকার মত করে এখানে …

খলি মন্তাজ কথাগুলো বলছেন আর রাগে কাঁপছেন। তাঁকে এই অবস্থায় আমি কোনভাবেই আশা করতে পারিনি। কাঁপতে কাঁপতেই তিনি বলছেন, একজন চোর কেন, একজন খুনিরও একটা সম্মান আছে, আমি সেই সম্মানে আঘাত করতে পারি না, আমার এথিকসে বাঁধে, যে নিউজে মানুষের সম্মান …

এর মধ্যেও আমি আমতা আমতা করে বলে ফেলি, আমি যে অনেকের সঙ্গে কথা বলেই গতকালের খুনের …

এটা রিপোর্ট হিসেবে ঠিক থাকতে পারে, কিন্তু নিউজ হিসেবে এটা না, আমরা …

তাহলে এখানে কি লিখতে পারতাম, আমি কি …

এখানে লেখার চেয়েও বড় হল অপেক্ষা করা, একজন মানুষের সম্মান রক্ষার্থে দরকার পড়ে আমি পত্রিকা বন্ধ করে দেব, তবুও কারোর সম্মানহানি হতে দেব না, এটাই কলম এবং পত্রিকার প্রতি আমার অঙ্গীকার।

খলি মন্তাজের যুক্তি গ্রাহ্য কথায় আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, একই সঙ্গে ঠিক ভাবে ভাবতে না পারার কারণে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। আসলে গতকাল খুব বেশি মাত্রায় এক্সাইটেড ছিলাম, আর ভালো ছাত্র বলে গর্বে হয়ত একটু বেশীই করে ফেলেছি। তবে দুঃখটাও যাচ্ছে না, এত সুন্দর লেখাটা লিড নিউজ হতে পারল না। তাই বলে নিউজ হবে না তাতো না, পরদিন সারাদেশ পাতায় এক কলামের ছোট্ট একটি লেখা ছাপা হল – রাজধানীতে অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার।

আমরা এক সপ্তাহ অপেক্ষা করলাম, কিন্তু হত্যমালি ফুড ইন্টারন্যাশনালের নামে কোন খবর আমরা ছাপলাম না। অন্য পত্রিকাগুলো ব্যাপারটাকে ঠিকই লিড নিউজ করে ছেপেছে। এবং যতগুলো লেখা পড়েছি, তার মধ্যে কোনটাই আমারটার মত ডিটেইলস বলে মনে হল না। এত দুঃখের পরেও একটা সান্তনা, আমি বুঝলাম একজন মানুষের সম্মান সবার আগে, এখানেই সাংবাদিকতার মূল এথিকস! খলি মন্তাজের প্রতি নতুন করে কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে উঠে। পরের তিন সপ্তাহ রুটিন কাজ করে যাই। যা কিছু কথা সব সোহেল ভাইয়ের সঙ্গেই হয়। খলি মন্তাজের সঙ্গে আমার কোন কথা হচ্ছে না। আমিও যেমন একটু ভয় আর কষ্টে দূরে আছি, তেমনি তিনিও আমাকে ডাকছেন না। তবে সবার কাজই ঠিক ভাবেই হচ্ছে। দৈনিক কালিত কালিমায় অনিয়মের কোন সুযোগ নেই!

Copyright has expired on this artwork. From my own archives, digitally restored.

বেশ কিছুদিন পর আবার খলি মন্তাজের ঘরে আমার ডাক পড়ে। মনটা খুশিতে ভরে গেল, যাক আর এরকম এড়িয়ে কাজ করতে হবে না। ঘরে ঢুকতেই দেখি তার হাসি মুখ, এত দিনের সমস্ত গুমোট ভাব উধাও। তার সামনে দু কাপ কফি। নিজেরটা হাতে নিয়ে আমার দিকে আরেকটা বাড়িয়ে দিলেন। মনটা একেবারে ঝলমল করে উঠে। খুব আয়েশ করে কফি খেতে খেতেই আমার সব খোঁজ খবর নিলেন।

শেষে গিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয়! আমি বললাম কি কাজ?

হত্যমালি ফুড ইন্টারন্যাশনালের মালিকের একটি ইন্টার্ভিউ নিলে কেমন হয়?

আমি আমার বই পড়া জ্ঞান দিয়ে বললাম, তিনি তো একজন ব্যবসায়ী, তার শুধু টাকা আছে, কিন্তু তার …

ঠিক এই কথাটাই আমি ভাবছিলাম, কিন্তু একটু অন্য ভাবে ভেবে দেখ, তাদেরও কিন্তু অনেক কিছু বলার থাকতে পারে, দেশ সমাজ অর্থনীতি … শুনে দেখ না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন থেকেই হত্যমালি ফুড ইন্টারন্যাশনাল সম্পর্কে আমি অনেক কথাই শুনেছি, এটাই তাদের মূল ব্যবসা না, এর পেছনে তাদের অন্য কিছু আছে, যদিও ওদের বেশিরভাগ বিজ্ঞাপন দৈনিক কালিত কালিমায় ছাপা হয়, তাই বলে তো আমি মানের সঙ্গে আপোষ করতে পারি না, এটা তো খলি মন্তাজের নিজেরই কথা, কিন্তু এগুলো না বলে আমি বললাম, তাদের কথা কি দৈনিক কালিত কালিমায় ছাপা হওয়ার …

তুমি একটা সাক্ষাৎকার নিয়েই দেখ না, ছাপানোর মত না হলে ছাপাব না, এক কাজ কর, আমি বলে দিচ্ছি, তুমি বরং আজ সন্ধ্যায় তার সঙ্গে দেখা কর, পুরো সন্ধ্যেটা তার সঙ্গে কাটিয়ে দেখ, তার ভেতর কিছু আছে কি না, যা দেশের মানুষের জানা দরকার!

আজ সন্ধ্যায় যে আমার শিল্প কলায় যাওয়ার কথা, সেখানে সংস্কৃতি মন্ত্রীকে …

আজ সন্ধ্যায় যে আমার শিল্প কলায় যাওয়ার কথা, সেখানে সংস্কৃতি মন্ত্রীকে …

এটা সোহরাবকে বলে দাও, ও পারবে, এটা অত গুরুত্বপূর্ণ কিছু না!
আমি আর কিছু বললাম না। আমি বুঝে গেছি খলি মন্তাজ চান, আমি হত্যমালি ফুড ইন্টারন্যাশনালেই যাই। যে সম্পাদকের মাথায় দেশ আর পত্রিকা, তাঁকে এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য কি আমার আছে! তিনি আমাকে শুধু বললেন, সবার মাঝেই অনেক বড় কিছু থাকে, একমাত্র একজন ভালো সাংবাদিকই পারে তার ভেতরের বড়টা টেনে বের করতে! (অসমাপ্ত)

[গল্পের অবশিষ্টাংশ আপলোড করা হবে জানুয়ারি ২০২৩ এর শেষ সপ্তাহে।]