রেজরের প্রান্তসীমায় বাংলাদেশ

অভিনাশ পালিওয়াল

অভিনাশ পালিওয়াল

(অভিনাশ পালিওয়ালএসওএএস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের একজন শিক্ষক, ‘মাই ইনিমিস এনিমি: ইন্ডিয়া ইন আফগানিস্তান ফ্রম দ্য সোভিয়েত ইনভেসন টু দ্য ইউএস উইথড্রল বইয়ের লেখক। তার এই লেখাটি ১০ই ডিসেম্বর অনলাইন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত)

বাংলাদেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও সহিংসতা এতটাই নিয়মিত যে, সরকারের বিরোধীদের বিরুদ্ধে চলমান দমনপীড়নকে যেকোনো কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু নির্বাচনকেন্দ্রিক শোরগোল বিস্তৃত হতে পারে। বিরোধী বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করেছে। এই সরকার ব্যবস্থা স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে। তাদের এই দাবির প্রেক্ষিতে সরকার প্রধান ক্ষুব্ধ  প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন- কখনো তিনি আর ‘আগুন সন্ত্রাসীদের’ ক্ষমতায় আসতে দেবেন না। এটাই হলো বাংলাদেশের সূক্ষ্ম রাজনীতি। এরই মধ্যে পশ্চিমাদের সমালোচনা, সম্প্রতি দূত পর্যায়ে যৌথ বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে নীরব রয়েছে ভারত ও চীন। 

কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে, যেমনটা ২০০৯ সালের পর আর প্রত্যক্ষ করা যায়নি। এই ‘ওল্ড স্কুল’, সুপরিচিত দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে উচ্চমাত্রায় উত্তেজনা এবং রাজনীতিকীকৃত একটি সংস্থার উত্তেজনা থেকে যে সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে তা অপ্রত্যাশিত। এই সংকেত গভীর গোলমালের ইঙ্গিত দেয়।

একটি বিষয় হলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিষয়ে জনগণের হতাশা অনেক বিস্তৃত ও গভীর।

তা এতটাই যে, তাদের  ভেতর থেকে দমনপীড়নের ভয় সরে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিষয় হলো, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, সরকারের প্রধান মিত্ররা নির্বাচনের খরচের উৎস সংকুচিত হয়ে আসায় অপশন পুনর্বিবেচনা করছেন। তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি- কারও এই অর্থনৈতিক সংকটকে সমাধান করার কোনো উত্তর নেই এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণের কোনো উপায় নেই। বিএনপি’র এর আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশে বিস্ময়করভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু ঢাকায় বিএনপি’র গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা- দৃষ্টি সেদিকে নিবদ্ধ হয়েছে। এতে তাদের আগের ধারাবাহিক সমাবেশগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে। সরকার গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়ার পরও এসব জনসভা হয়েছে। এমনকি এই জনসমাবেশ হয়েছে আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটিতে। এর মধ্যে আছে খুলনা ও ফরিদপুর। 

সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মৃত বলে বিবেচনা করা হতো। কীভাবে তারা এত গণসমর্থন পেলো? কারণ, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সরকারের বিরুদ্ধে বৈসদৃশ এক অভিযোগের ‘ব্রোকার’ হিসেবে বিস্ময়করভাবে আবির্ভূত হয়েছে তারা। 
সর্বোপরি বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নতিকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয় এবং বিশ্বজুড়ে তা সেলিব্রেট করা হয়েছে। কিন্তু তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পদের পুনর্বণ্টন এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তরকে বোঝায় না। এটা সবসময়ই সামষ্টিক অর্থনীতির সমস্যা। এ সমস্যা প্রতিনিয়ত দুর্নীতিগ্রস্ত দল এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের কাছ থেকে রাজনৈতিক ক্ষতি ডেকে আনে, যা ছিল বর্তমান সরকারের ‘অ্যাকিলিস হিল’ বা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা। এ কারণেই সরকারের বাস ও ট্রেন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পরও জনগণ নৌকায় চড়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে যোগ দিয়েছেন খুলনার র‌্যালিতে। যা বিএনপি’র একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। 
এ ঘটনাগুলো যদি বিরোধীদের উজ্জীবিত করে, তাহলে সরকার আরও ক্ষুব্ধ হতে পারে। এতে আরও পুলিশি দমনপীড়ন চলতে পারে, মিডিয়াকে আরও ভীতি প্রদর্শন করা হতে পারে। এটাই ঢাকার সমাবেশকে বিপজ্জনক করে তুলেছে: এখানে সরকার দুটি উপায়ই হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে। সরকার প্রধান যদি প্রতিবাদ বিক্ষোভ  ভেঙে দিতে শক্তি প্রয়োগ করেন, তাহলে তিনি আরও মানুষকে বিরোধীদের দিকে ঠেলে দেবেন। কিন্তু যদি এসব প্রতিবাদ বিক্ষোভে বাধা না দেন, তাহলে তাতে সরকার প্রধানের ‘স্ট্রংপারসন’ ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে পারে। এতে বিরোধীদের রাজনৈতিক গতি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। এটা হলো একটি ক্ল্যাসিক ট্রাপ বা ফাঁদ। এক্ষেত্রে সরকার ও তার মিত্রদের কাছে প্রশ্ন হলো- মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে কি মুখ রক্ষা করা যায়? যদি না যায়, তাহলে কি সরকার আরও আগ্রাসী হয়ে উঠবে? 

এর উত্তর রয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির ভেতরে। করোনা মহামারির পর ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন- এই দুটি হতাশাজনক আঘাত ঢাকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে অন্যদিকে নিয়ে গেছে। সমঝোতাকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোর মডেল, মৌলিক সমাজকল্যাণে খরচ বৃদ্ধি এবং বিরোধী ও মিডিয়াকে নীরব থাকতে বাধ্য করা, এই সামষ্টিক অর্থনীতির কাহিনী শিগগিরই অথবা পরে নতজানু হয়ে যাবে। কিন্তু এসব বাহ্যিক ধাক্কা এবং সময়কালের হতাশা বিরোধীদের শক্তিকে আরও অনেকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে প্রমাণিত হচ্ছে। আর্থিক সংকোচন এখনো কোনো বৈদেশিক ঋণ সংকট নয়। কিন্তু কৃচ্ছ্রতাসাধনের পদক্ষেপগুলো শুধুই জীবনধারণের পরিস্থিতিকে আরও নাজুক অবস্থায় নিয়ে যাবে। উপরন্তু ব্যাংকিং খাতের সংকট সরকারের অভ্যন্তরীণ পৃষ্ঠপোষকতার নেটওয়ার্ককে জটিল করে তুলছে রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকার ক্ষেত্রে। 

এ নিয়ে চাপের লক্ষণ বোঝা যায় ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপের কয়েক বিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণ থেকে। কেন এই গ্রুপ সিঙ্গাপুরে হোটেল এবং মল কেনার জন্য বিপুল  লোন নেবেন যখন দেশের অর্থনীতি তীব্র সংকটের মুখোমুখি? এই পদক্ষেপটি বাংলাদেশের আর্থিক ভবিষ্যৎকে একটি একক ফার্মের সঙ্গে সম্পর্কিত করে এবং শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিক পতনের দিকে ইঙ্গিত দেয়। তদন্তের অধীনে থাকা এই মামলা নানা সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু তার  কোনোটিই আশাব্যঞ্জক নয়। যদি এস আলম গ্রুপ অনুমতি নিয়ে এটি করে থাকে, তবে এটি একটি ‘এক্সিট লোন’ হতে পারে। এটি অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তোলার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু যদি অনুমোদন ছাড়াই এটি ঘটে থাকে তাহলে এখানে ব্রুটাসের মতো বিশ্বাসঘাতক রয়েছে। 

এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন আসে, বিএনপি যদি কোনোভাবে ক্ষমতায় আসে তাহলে তারা কি করতে পারবে! এখানেই গল্পটি আরও জটিল হয়ে ওঠে। মূলত সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক মাত্রায় জনমত বৃদ্ধি পাওয়ায় বিএনপি পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। তাদের জনসভার অপ্রত্যাশিত সাফল্য দলটিকে এর নির্বাসিত নেতা তারেক রহমানের  পেছনে ঐক্যবদ্ধ করেছে। অসুস্থ খালেদা জিয়ার প্রতি জনসমর্থন এখনো অক্ষত রয়েছে। 

বিএনপি ক্ষমতায় এলে নিজের রাজনৈতিক ভিত্তি আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে যাতে করে আরও দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা যায়। দলটি প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা বা গণতান্ত্রিক শক্তিশালীকরণে কাজ করবে এমন সম্ভাবনা কম। আবার মাঝামাঝি সময়ে এটি ইসলামপন্থার দিকে মোড় নিতে পারে। অর্থনৈতিক অস্থিরতার রাজনৈতিক ঝুঁকি  মোকাবিলা করতে বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। 
অনিবার্যভাবেই বাংলাদেশের ইতিহাস এভাবে পুনরাবৃত্তি হয়ে চলবে, যা বর্তমান মুহূর্তটিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। ভারতের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে  বাংলাদেশে ঝড়ের পরবর্তী সময়ে পর্দার অন্তরালে হস্তক্ষেপের গুরুতর প্রয়োজন রয়েছে। যদি বর্তমান পন্থা কাজ না করে তবে  বিরোধীদের সঙ্গে নয়াদিল্লির যোগাযোগ রয়েছে।  সেক্ষেত্রে বিভিন্ন কৌশলের প্রয়োজন হতে পারে। বাংলাদেশিদের জীবন-জীবিকা ও আশায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটুক  সেটা কখনো এই উপমহাদেশের  দেশগুলো চায় না। কারণ, এটি শুধুমাত্র পূর্বদিকে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক সমস্যাকেই বৃদ্ধি করবে। ভারতের পূর্বাঞ্চলে স্থানীয় সহিংসতা এবং চীনের অনুপ্রবেশ নয়াদিল্লির ভূ-রাজনৈতিক আকাক্সক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। 

পাঠকের মতামত

আশা করি ভারতের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। বাংলাদেশের অত‍্যাচারিত নিপীড়িত জনগনের বিপক্ষে অবস্থান নেবে না।
 মোঃ হেদায়েত উল্লাহ


ভারতের মত বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের পক্ষে যা নিয়ে রাজপথে লড়াই করছে তারা। তাই ভারতের উচিৎ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট জনগনের চাওয়া পাওয়াকে সন্মান করে একাত্মতা পোষন করা নির্দিষ্ট কোনো দলের পক্ষে না যাওয়া। না হয় বাংলাদেশে ভারত বিদ্বষী মনোভাব আরো ভয়ংকর ও দৃঢ় হবে.-

ধ্রুব

নিজেদের দেশের খবর নাই আরেক দেশ নিয়ে মাথাব্যথা। ভারত কখনও বাংলাদেশের ভালো চাই নাই। এটা সব দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কেউ কখনো আরেক দেশের ভালো চাইতে পারে না। এটা কখনও হয় না। 

টিউলিপ


ভারতীয়রা নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশের নির্বাচিত একটি সরকারকে ফেসিস্টে পরিণত করেছে। 

কবীর সরকার

পাশাপাশি তিনটি দেশ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ।এক দেশে সংখ্যা গরিষ্ঠ হিন্দু ওপর দু’দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম। এক দেশ যুগের পর যুগ প্রবাহিত হচ্ছে গণতন্ত্রে জোয়ার, আর ওপর দুইদেশ শোষণ তন্ত্রের জোয়ার। দেশ দুটো বাপ দাদা , স্বামী স্ত্রীর, ছেলেমেয়ের শাসনতন্ত্রের ছোঁয়ায় জনগন অতিষ্ঠ। চুল ছেড়াছেরি, বকাবকি, চোখের আড় কোণে চাওয়া, কথায় কথায় বাপদাদা, স্বামী স্ত্রীর ছেড়া কাঁথায় শুয়ে অথবা কবরে গিয়েও জনগনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্বপ্ন দেখার গল্প কাহিনী বলা। হায় কমাক্কালার মানুষ, আক্কেল আর হবে কবে ! লজ্জা নেই,নেই শরম ক্ষমতা না যে পৈতৃক সম্পত্তি অথবা উত্তররিধকারি সূত্রে পাওয়া ? যে যখন ক্ষমতায় আসে বাপদাদাকে বিক্রি করে, গালি খায়,থাপ্পড় খায় কিন্তু কিছুই আসে যায় না, চাই ক্ষমতা, এর বিনিময় বিক্রি করবো বাপ মাকে, স্বামী স্ত্রীকে, বোনকে, ভাইকে আর এর বাহিরে চৌদ্ধগুষ্টিকে তবুও ক্ষমতা ছাড়বো না, পারলে তোরা কিছু করিস !

খোকন