বাঙালি মুসলমানদের ‘স্বাধীনতা’

সাঈদ তারেক

প্রতিবেশী দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থানের প্রেক্ষাপটে ‘বা্ঙালি মুসলমান’ কথাটা আবার নতুন করে উঠে এসেছে। কতটা সমীচিন কতটা উচিত অনুচিত সে বিতর্ক ছাপিয়ে বাস্তবতা হচ্ছে নানা মহলে এ নিয়ে কানাঘুষা ফিসফাস আলোচনা সমালোচনা থেমে নেই। সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় নানা মত হতাশা ক্ষোভ। কেউ বলবেন ‘বা্ঙালি তো ‘বা্ঙালিই, তাকে আবার হিন্দু মুসলমান বলে ভাগ করা কেন। না, জাতিগতভাবে কোন বিভক্তি নেই। তবে ধর্মবিশ্বাষের ভিত্তিতে এমন একটা পরিচয় তো আছেই। এটা বাস্তবতা। এই বাস্তবতা কখনও কখনও প্রকট হয়ে ওঠে যখন সমাজে বৈষম্যের সৃস্টি হয়। এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে আমি কিছুটা আলোচনা করার চেষ্টা করেছি বাঙালির জাতিগত ও ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের উদ্ভব এবং বিকাশের। তাদের গড়ে ওঠা স্ব-অধীনতা এবং হাজার বছরের পথচলার।

ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় বঙ্গ বাঙালা বা প্রাচীন চায়নীজ পূঁথিসাহিত্যে উল্লেখিত মাঙ্কালা অঞ্চলের ইতিহাস অনেক পুরনো হলেও বঙ্গ রাজ্য গঠনের শুরু মাত্র হাজার বছর আগে। আজকের যে বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ মিলে বৃহত্তর বাংলা- গোড়াতে এটা কোন একক দেশ বা এক রাজ্য ছিল না। অঙ্গ বঙ্গ সমতট হরিকেল পুন্ড্রবর্ধন তিরাভুক্তি রাধা প্রাগজোতিষি গঙ্গার্দী সুহমা- প্রভৃতি অঞ্চল ভিন্ন ভিন্ন রাজা বা শাষকরা শাষন করতেন। এদের মধ্যে প্রতিযোগীতা ছিল, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হতো, এক রাজা অন্য রাজ্য দখল করে নিতো। সপ্তম শতকে রাজা শশাঙ্ক এই রাজ্যগুলোকে একীভূত করে গৌড়িয় সাম্রাজ্য গঠনের মাধ্যমে বৃহত্তর বাংলা রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গোটা দেশে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃস্টি হয়। উদ্ভব ঘটে গৌড়িয় পাল সাম্রাজ্যের। কিন্তু কালের চক্রে এই সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা এবং আরাকানে চন্দ্র বংশ রাজত্ব শুরু করে, উত্তর-পূর্ব বাংলা এবং আসামঅঞ্চলে বর্মন বংশ, পাল বংশের প্রধান উত্তরসুরী সেন বংশ বাংলার অধিকাংশ অঞ্চল এবং দেব বংশ কিছু কিছু অঞ্চল শাষন করে। এই সময়কালে আরব বনিকদের দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় মেঘনা অববাহিকা অঞ্চলে ব্যাবসা বাণিজ্য করার প্রমান পাওয়া যায়। ধারনা করা হয় চায়না যাওয়ার জন্য এই পথকে তারা ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করতো। সপ্তম শতকে আরবে যখন ইসলাম ধর্মের অভ্যুদয় ঘটে তখনও আরব মুসলিম বনিকরা এই পথে যাতায়ত করতো। মূলত: এ সময় থেকেই বাংলায় কিছুকিছু করে ইসলাম ধর্মের প্রচারের কথা জানা যায়। উত্তরাঞ্চলে একটি পুরনো মসজিদের প্রত্নতাত্বিক গবেষণা থেকে ধারনা করা হয় রাসুলুল্লাহর (স:) জীবদ্দশায়ই এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের অনুসারি ছিল।

১২০৪ সালে আফগান জেনারেল ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি গৌড়িয় সেন রাজাকে পরাস্ত করে বাংলা অধিকার করে নিলে বাংলায় ব্যপকভাবে ইসলাম ধর্ম প্রচারের পথ সুগম হয়। পরবর্তী দেড় শ’ বছর বাংলা দিল্লী সালতানাতের অধীনে ছিল। পরের দেড় শ’ বছরের মত ইলিয়াস শাহ বংশের শাসন। এর পর প্রায় চার শ’ বছর মোঘলরা। ১৭৫৭ সালের পর ইংরেজ বনিকরা বাংলার কার্যকর শাষক হিসেবে আবির্ভূত হয়। এক শ’ বছর পর স্বাধীনতার দাবীতে গড়ে ওঠা সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে বৃটিশরাজ শাসন ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। তার পর নব্বই বছর।

মুসলিম শাসনামলে বাংলায় ইসলাম প্রচারের কাজ ব্যপকভাবে চালু হলে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলে। পারশ্য অঞ্চল আরব দেশসমূহ উজবেকিস্তান- প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ইসলাম ধর্ম প্রচারকরা এসে স্থানীয় ধর্মাবলম্বিদেরকে ব্যপকভাবে ধর্মান্তরিত করার মাধ্যমে এ কাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। এ দেশে স্থানীয় বা সনাতন ধর্মাবলম্বিদের মধ্যে কথিত নীচু জাত বা নম:শুদ্ররাই মূলত: ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে মুসলমান হন। সনাতন ধর্মালম্বিদের মধ্যে জাতপাতের প্রথা কঠিনভাবে প্রচলিত থাকায় নিম্নবর্ণের হিন্দুরা উঁচু বংশীয় বা ব্রাহ্মনদের হাতে নানাভাবে নিগৃহিত হতেন। অনেকক্ষেত্রে তাদেরকে মানুষ বলেই গন্য করা হতো না। দীর্ঘকালের শোষন বঞ্চনা বৈষম্যের কারনে সৃষ্ট পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকেই এরা ইসলাম ধর্ম গ্রহন করতো। এভাবেই বাংলায় মুসলমান সম্প্রদায়ের সৃস্টি। কাজেই মুসলমানরা বহিরাগত কেউ না।

তুর্কী বীর শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ-ই মূলত: ঐক্যবদ্ধ বাংলার প্রতিষ্ঠাতা। শাসনকাজ পরিচালনার সুবিধার্থে দিল্লীর সুলতানশাহী বাংলাকে তিনটি প্রদেশে ভাগ করেছিলো। দক্ষিণ বাংলায় সাতগাঁও পূর্ব বাংলায় সোনারগাঁও এবং উত্তর বঙ্গে লখনৌতি। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সাতগাঁওয়ের গভর্ণর নিযুক্ত হয়েছিলেন। চতুুর্দশ শতকের মধ্যভাগে এই তিন গভর্ণর যার যার মত করে স্বাধীনতা ঘোষনা করে এবং নিজেদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়। ইলিয়াস শাহ অপর দু’জনকে পরাস্ত করে গোটা বাংলার শাসনকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। দিল্লীর অধীনতা থেকে মুক্ত হতে তিনি সালাতানাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধও পরিচালনা করেন। এই বংশ বাংলায় প্রায় দেড় শ’ বছর রাজত্ব করে। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ’র আমলেই বাংলা ভাষার উন্নতি ঘটতে থাকে। তার রাজত্বে বসবাসকারিদের পরিচয় নির্দ্ধারন করেন বাংগালী। মূলত: এখান থেকেই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের সূচনা। ইতিহাসবিদরা সে জন্য শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে বাঙ্গালী জাতির জনক হিসেবে অভিহিত করেছেন।

১৫৭২ সাল থেকে বাংলায় মুঘল শাসনের সূত্রপাত। ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে মোঘল বাহিনী চূড়ান্তভাবে সুলতানশাহীকে পরাজিত করার মাধ্যমে এ অঞ্চল নিজেদের করায়ত্ব করে নেয়। বাংলাকে তারা একটি প্রদেশ হিসেবে ঘোষনা করে। কিন্তু শাষক বদল হলেও বাংলায় ইসলাম প্রচারের কাজ থেমে থাকে নি। দিনে দিনে মুসলিম জনসংখ্যা বেড়ে চলে। এ সময়কালে ইসলাম ধর্মাবলম্বিদের প্রাথমিক পরিচয় ছিল ‘বা্ঙালি। তখনও হিন্দু মুসলমানের পার্থক্য মূখ্য কোন বিষয় ছিল না। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই যার যার ধর্ম পালন করে একত্রে বসবাস করতো। এ সময়কালে ধর্ম নিয়ে মাতামা‌তি বা হানাহানির কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। কারন হতে পারে সনাতন ধর্মাবলম্বি এবং স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়- উভয়ই ছিল ভিনদেশী ভিনভাষী কর্তৃক শাষিত শোষিত নির্যাতিত এবং নিষ্পেষিত। জুলুম বঞ্চনার মুখে নিজেদের টিকে থাকার প্রয়োজনেই তারা এক থাকতো।

অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ইংরেজ বনিকরা বাংলার কার্যকর শাসক হিসেবে আবির্ভূত হলে সনাতন ধর্মাবলম্বিরা স্বস্তিবোধ করতে থাকে। মুসলিম মোঘল শাসকদের বদলে নব্য ইংরেজ শাসন তাদের কাছে অধিক গ্রহনযোগ্য হয়। উনবিংশ শতকের মধ্যভাগে পুরো ভারতবর্ষ ইংরেজ শাষকদের করতলগত হলে বাংলায় হিন্দু মুসলমানের সম্পর্কেও তার প্রভাব ফেলে। নতুন শাসনকালে সনাতন ধর্মাবলম্বিরা চাকুরি ব্যবসা শিক্ষা বা ক্যারিয়ার গঠনে সরকারি আনুকূল্য গ্রহনে এগিয়ে আসে পক্ষান্তরে মুসলিম শাষনের অবসানে হতোদ্যম মুসলিমরা অভিমানে দুরে সড়ে থাকে। এ সময়কালে বাংলায় চীরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা জমিদারী প্রথা চালু হলে এ সুযোগ গ্রহনেও এগিয়ে আসে অর্থ বিত্ত বা প্রভাবশালী হিন্দু অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা। সমাজে মধ্যস্বত্বভোগী একটি নতুন শ্রেণীর উদ্ভব হলে তার প্রভাব সাধারন জনগনের মধ্যে পড়ে। নব্য ধনী ও জমিদারদের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির কারনে ‘বা্ঙালি এ সময় থেকে দুইভাগে ভাগ হয়ে যেতে থাকে। ইংরেজ আনুকূল্যে ফুলেফেপে ওঠা নব্য ধনিক বনিক সুবিধাবাদী শ্রেণীটি ছিল মূলত: বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের। সমাজে তাদের প্রভূত্ব কায়েম হয়। ‘বা্ঙালির সংজ্ঞাও তারা নিজেদের মত করে দাঁড় করায়। মুসলমানদেরকে বহিরাগত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ‘বা্ঙালি বলতে নিজেদেরকে বোঝানো শুরু করে। এ সময়কালে মুসলমানরা ‘বা্ঙালি বলেই গন্য হতেন না। ‘বা্ঙালি বলতে কেবল বর্ণহিন্দুদেরকে বোঝানো হ‌তো। এমনকি নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও ‘বা্ঙালি সমাজে অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। মুসলমানদেরকে বলা হতো ম্লেচ্ছ যবন বা মোছলমান। মনে করা হতো এরা ভিনদেশী। এই ধারনা গত শতকের মধ্যভাগ পর্যন্তুও প্রচলিত ছিল।

পরবর্তী অর্দ্ধ শতক বাংলায় হিন্দু পুনর্জাগরনের ঢেউ বয়ে যায়। গনমাধ্যম শিল্প-সংষ্কৃতি সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে এই জাগরনকে মহিমাম্বিত এবং বেগবান করা হতে থাকে। এই প্রবনতার পাল্টা হিসেবে মুসলিম সম্প্রদায়েরও কয়েকজন সাহিত্যিক কবি অভিজাত ঘরের মানুষ এগিয়ে আসেন। ততদিনে সমাজে একটা নীরব পরিবর্তন সাধিত হয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি। বাংলার পূর্বাংশে মুসলিমরা সংখ্যাগুরু হয়ে যায়। শাষনকাজ পরিচালনার সুবিধার্থে, কিছুটা কলকাতাকেন্দ্রিক ‘বাবুসমাজকে’ সাইজ করতে লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বাংলাকে দুই ভাগ করলে সুবিধাভোগী শ্রেণীটি ক্ষোভে ফেটে পরে। বঙ্গভঙ্গ রদ করতে ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করে ব্যপক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। তাদের আন্দোলনের চাপে ১৯১১ সালে বৃটিশ রাজ বঙ্গভঙ্গ বাতিল করে।


বঙ্গভঙ্গের কারনে ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানী হওয়ায় এ অঞ্চলের সংখ্যাগড়িষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ভাগ্যের চাকা ফিরতে শুরু করেছিল, বঙ্গভঙ্গ রদে সে সুযোগ তিরোহিত হয়ে যাওয়ায় তারা হতাশ এবং ক্ষুব্ধ হয়। এই হতাশা আর ক্ষোভ থেকেই বাঙালি মুসলমানরা নিজেদেরকে একটা পৃথক সম্প্রদায় হিসেবে ভাবতে শুরু করে। পরবর্তী তিন দশক হিন্দু-মুসলমানের এই বিভক্তি এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে, ১৯৪০এর মার্চে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পৃথক রাষ্ট্রের দাবী তোলেন।

ততদিনে গোটা বাংলায় মুসলমানরা সংখ্যাগড়িষ্ঠ হয়ে গেছে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে শেরে বাংলা বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন। পরের দুই টার্মও মুসলমানদের ভোটে খাজা নাজিমুদ্দিন এবং সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী। এই প্রেক্ষাপটেই নতুন করে আবার বাংলা ভাগের দাবী তোলা হয়। এবার ধর্মের ভিত্তিতে। ’৪৬ ’৪৭এ স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের দাবীতে সোহরাওয়ার্দী, শরৎ বসু, কিরন শংকর রায়, আবুল হাশিমরা যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তাতে বাধ সাধেন হিন্দু মহাসভা নেতা শ্যামাপ্রসাদ মূখার্জী, পন্ডিত নেহেরু, সরদার প্যাটেল এমন কি খোদ গান্ধীজীও। তারা ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ চান। হিন্দু মহাসভা নেতা ডা: শ্যামাপ্রসাদ মূখার্জী দিল্লীর এক জনসভায় প্রকাশ্যে ঘোষনা করেছিলেন, ‘পৃথক হওয়াটা পাকিস্তান হওয়ার সাথে সম্পর্কিত নয়, এমন কি যদি পাকিস্তান নাও হয়, কোন প্রকার দূর্বল ও শিথিল কেন্দ্রের ব্যবস্থাযুক্ত কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা মুসলিম লীগ গ্রহণও করে তবুও আমরা বাংলার হিন্দুপ্রধান অঞ্চল নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ দাবী করবো।’

শেষ পর্যন্ত সংসদ অধিবেশনে বঙ্গীয় কংগ্রেসের বড় অংশ, হিন্দু মহাসভা এবং জ্যোতি বসুর কম্যুনিষ্ট পার্টি হিন্দুপ্রধান অঞ্চল নিয়ে পৃথক ‘হিন্দু বাংলা’ গঠনের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। পক্ষান্তরে মুসলিম লীগ ও তফশিলী জাতি ফেডারেশন অখন্ড বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে দৃড় অবস্থান নেয়। মিলিত ভোটে স্বাধীনতাকামীরা সংখ্যাগড়িষ্ঠতা পেলেও মাউন্টব্যাটনের কূটচালে ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ হয়ে যায়। ‘হিন্দু বাংলা’ ভারত ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হয় ‘মুসলিম বাংলা’কে পাকিস্তানে যোগ দিতে হয়। এই ঘটনার পর থেকে পশ্চিম বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় ‘‘বা্ঙালি’ থেকে যায়, পূর্ব বাংলার সংখ্যাগড়িষ্ঠ ধর্মবিশ্বাষীর পরিচয় দাঁড়ায় ‘বাঙালি মুসলমান’।

পাকিস্তান আমলের গোড়ার দিকে পুর্ববঙ্গবাসীরা দুইভাগে পরিচিত হতো, বাঙ্গালী মুসলমান আর ‘বা্ঙালি হিন্দু। একইভাবে অন্যান্ন ধর্মাবলম্বিরা। ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে এই বিভক্তির অবসানে ‘বা্ঙালি নেতারা উদ্যোগী হন। নবগঠিত রাজনৈতিক দল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে মুসলিম শব্দটা কেটে ’৪৭পূর্ব একক ‘বা্ঙালি জাতিসত্বা প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন। ’৬৬তে ছয় দফা ঘোষণার মাধ্যমে ‘বা্ঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া হয়, ’৭১এ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যা পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে গৃহিত হয়। সে থেকে ধর্মীয় পরিচয়টা ছিল গৌন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ দেশের অধিবাসীরা ‘বা্ঙালি হিসেবেই গন্য হয়ে এসেছে।

’৭৫ পরবর্তী রাজনীতিকরা জাতিসত্বার পরিচয় নির্দ্ধারণে সংখ্যাগড়িষ্ঠ ধর্মবিশ্বাষীর আবেগ অনুভূতি সন্নিবেশিত করলে প্রসঙ্গটা আবার উঠে আসে। সমাজে ‘বা্ঙালি মুসলমান কথাটা সব সময়ই প্রচলিত ছিল, কিন্তু রাজনীতির গতিধারা, শাসকদের নীতি-নৈতিকতা বিশেষ করে নানা স্বার্থান্বেষী কর্মকান্ডের ফলশ্রুতিতে সংখ্যাগড়িষ্ঠ ধর্মবিশ্বাষীরা এক পর্যায়ে নিজেদের ধর্ম পরিচয়টাকে প্রধান করে দেখতে শুরু করে। আবার প্রচলিত হয়ে যায় ‘‘বা্ঙালি মুসলমান’।

ইসলাম ধর্ম আরব দেশে প্রবর্তিত হলেও বাংলায় এটা যারা গ্রহন করেছেন তারা কিন্তু এই দেশেরই লোক। প্রথম দিকে প্রচারকরা বাইরে থেকে এলেও গ্রহনকারিরা সবাই স্থানীয়। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ’র আমলে নির্দ্ধারিত জাতীয় পরিচয় অনুযায়ী সবাই ‘বা্ঙালি।

বংশ পরম্পরায় এই শাসকরা বাঙ্গালীই ছিলেন, ধর্মবিশ্বাষের দিক থেকে ‘বা্ঙালি মুসলমান। ইলিয়াস শাহ নিজে ‘বা্ঙালি ছিলেন না। তার বংশধররা মাঝখানে চার বছর রাজা গনেশের রাজত্বকাল বাদে এক শ’ বিয়াল্লিশ বছর বাংলা শাষন করেছে। বংশধররা কেউ বাইরে থেকে আসেনি। এ দেশেই জন্ম। সে হিসেবে তারা স্থানীয়, ‘বা্ঙালি এবং মুসলমান। ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকে ধরলে দেখা যায় এই কালটাই ছিল ‘‘বা্ঙালি মুসলমানের’ নিজস্ব শাসনকাল। এর পর মোঘল শাসন। এরা কেউ ‘বা্ঙালি ছিলেন না। এমনকি বাংলা বিহার উড়িষ্যায় যে মুর্শিদকুলী খাঁ আলীবর্দী খাঁ সিরাজউদ্দৌলার শাসন, তাও বাঙ্গালী মুসলমানের শাসন ছিল না, কারন এরাও কেউ ‘বা্ঙালি ছিলেন না। এইসব শাসকরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রিয়ভাজনও ছিল না। যে কারনে ক্লাইভ সিরাজকে পরাজিত করলে সাধারন মানুষ শুধু চেয়েচেয়ে দেখেছে। এক শ’ নব্বই বছর বৃটিশ শাসনের পর বাঙ্গালী মুসলমানরা যে স্বাধীন হলো, দেখা গেল তাও ভূয়া। ধর্মের নাম দিয়ে পশ্চিমারা প্রভু হয়ে বসেছে।

মাঝে মাঝে আমার মনে হয় ‘‘বা্ঙালি মুসলমান’ বুঝি একটা হতভাগা জাতিগোষ্ঠী! বারবার শুধু এক শাসকের হাত থেকে আর এক শাসকের খপ্পরে গিয়ে পড়েছে! ’৪৭এ মুসলমান হওয়ায় ‘বা্ঙালি হতে পারলো না, আবার ’৭১এ বাঙ্গালী হবার কারনে মুসলমানও হতে পারলো না।