জালালুদ্দীন রুমির মসনবী’র গল্প

জালালুদ্দীন রুমি
অনুবাদ : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

জ্ঞানী পাগল
এক তরুণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে এখন তার বিয়ে করার সময়, কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলেন না। যেহেতু তিনি গুরুতর কোনো ভুল করতে চান না এবং যেহেতু তিনি জানেন যে বিয়ে করার জন্য একজন কনে নির্বাচন করা কারও জীবনের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, অতএব তিনি এ ব্যাপারে তার চেয়ে বিজ্ঞ কারও সঙ্গে পরামর্শ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তিনি পুরো শহর অনুসন্ধান করলেন এবং পরিচিত সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। অবশেষে একজন তাকে বললেন: “আমাদের শহরে মাত্র একজন জ্ঞানী ব্যক্তি আছেন এবং তিনি বৃদ্ধ মানুষ, যিনি বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধূলা করেন!”
লোকটিকে খুঁজে পেতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়নি, তাকে না পাওয়া গেলেই বরং কঠিন মনে হতো। শহরের কেন্দ্রস্থলের মূল চত্তরে তিনি একটি দীর্ঘ বাঁশের লাঠিতে ওঠে, যেন বুনো ও উচ্ছৃঙ্খল ঘোড়া দাবড়ে বেড়াচ্ছেন এমন ভান করে একদল ছোট বাচ্চাকে তাড়া করে তার দিন কাটিয়ে দেন। তরুণ তাকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে সতর্কতার সঙ্গে তার কাছে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবলেন। “হে মহান ঘোড়সওয়ার, আপনি কি মেহেরবানি করে আপনার ঘোড়াটি মুহূর্তের জন্য আমার কাছে আনবেন,” অনেকটা মরিয়া হয়েই তিনি অনুনয় করলেন।
“জলদি করো এবং তোমার কাজের কথা বলো,” লোকটি আনুষ্ঠানিকতার সুরে উত্তর দিলেন। “তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো যে, আমার ঘোড়া বুনো এবং বেপরোয়া। তুমি যদি সামান্য নড়াচড়া করো, তাহলে ঘোড়াটি তোমাকে লাথি মারবে,” তিনি সতর্ক করলেন।
“আমি বিয়ে করতে চাই, কিন্তু এ সম্পর্কে আমি অনভিজ্ঞ, সেজন্য আমার পরামর্শ প্রয়োজন। নারীদের সম্পর্কে আপনি আমাকে কী বলতে পারেন। আমার জন্য কোন্ নারীকে নির্বাচন করা সর্বোত্তম হবে?” তরুণ বিনয়ের সঙ্গে বললেন। একটি মার্জিত উত্তর পাওয়ার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন।
“পৃথিবীতে তিন ধরনের নারী রয়েছে,” অশ্বারোহী বিচক্ষণতার সঙ্গে উত্তর দিলেন। “দুই ধরনের নারী বাস্তবিকপক্ষেই বিরাট সম্পদ, কিন্তু তৃতীয় ধরনের নারী ইহলোক ও পরলোকের সকল সম্পদের সেরা।”
তরুণ লোকটি তার প্রতি কৃতজ্ঞ, কিন্তু দ্ব্ধিাগ্রস্থ। “আপনি কি মেহেরবানি করে আপনার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেবেন?” তিনি বিনয়ের সঙ্গে বললেন।
“আমি প্রধম ধরনেরটা দিয়ে শুরু করছি, যিনি সারা জীবনের জন্য পুরোপুরি তোমারই হবেন; দ্বিতীয় ধরনের নারী শুধু আংশিকভাবে তোমার হবেন এবং তৃতীয় ধরনের নারী আদৌ তোমার হবেন না! আমার ঘোড়া তোমার পায়ে আঘাত করে তোমাকে খোঁড়া করে দেওয়ার আগে তুমি সরে দাঁড়াও,” বৃদ্ধ ঘোষণা করে তার বাঁশের ঘোড়া বাচ্চাদের দিকে ঘুরিয়ে লাফ দিলেন।
“মেহেরবানি করে একটু অপেক্ষা করুন,” তরুণ অনুনয় করলেন বৃদ্ধকে। কারণ তখনও তার দ্বিধা কাটেনি। “আপনি আমাকে আপনার অমূল্য জ্ঞানে ধন্য করেছেন। এবার মেহেরবানি করে আমাকে বলুন যে আপনি সঠিক অর্থে আমাকে কী বলেছেন?”
অশ্বারোহী তার লাগাম টানলেন এবং প্রশ্নকর্তার দিকে ফিরলেন। “ঠিক আছে, আমি আরেকবার এবং শেষবারের মত তোমাকে সুস্পষ্টভাবে বলছি। যে নারীর হৃদয় তোমার, কিন্তু তা মাত্র অর্ধেকটা হৃদয়, তিনি বিধবা। যদিও তিনি নি:সন্তান, কিন্তু সবসময় তার মনে পড়বে সাবেক স্বামীর মধুর স্মৃতি। আরেক ধরনের নারী তোমার সঙ্গে কখনও তার হৃদয় বিনিময় করবেন না এবং তিনি হবেন সন্তানসহ বিধবা। যতবার তিনি তার সন্তানদের দিকে তাকাবেন, ততবার সন্তানদের পিতা যে তাকে ভালোবাসতেন সেই স্মৃতি তার মনে পড়বে। নি:সন্দেহে সকল নারীর মধ্যে তিনিই সর্বোত্তম, যার হৃদয় চিরদিনের জন্য তোমার হবে, তিনি তোমার আগে কখনও আর কারও সঙ্গে তার হৃদয় বিনিময় করেননি। আমার ঘোড়া তোমাকে লাথি মেরে ফেলে দেওয়ার আগে তুমি কেটে পড়ো।”
“প্রিয় বয়োবৃদ্ধ সজ্জন, আপনার কাছে আমার একটি শেষ প্রশ্ন আছে। আমি কি প্রশ্নটি করতে পারি?”
“তাহলে বলো,” কিছুটা বিরক্তির সঙ্গে তিনি উত্তর দিলেন।
“আপনার জ্ঞানের কোনো তুলনা হয় না; আপনি পাগলামির ভান করেন কেন?”
“শহরের বাসিন্দারা আমাকে তাদের প্রধান কাজী হিসেবে নির্বাচন করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি তা হতে বার বার অস্বীকার করেছি,” তিনি স্বীকার করলেন। “তবুও তারা বলতে থাকে যে শহরে আমার চেয়ে আর কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি নেই, যার ওপর তারা আস্থা স্থাপন করতে পারেন। তারা আমাকে কিছুতেই ছাড়বে না। অতএব, আমি পাগল হয়ে গেছি এমন ভান করা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। যদিও অন্তর থেকে আমি আগের মতই আছি। আমার মন হচ্ছে আমার আধ্যাত্মিক সম্পদ এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমি কখনই আমার মনকে ভাগ করবো না!”
তার অমূল্য রহস্য তরুণকে জানতে দিয়ে জ্ঞানী পাগল বাচ্চাদের দলের দিকে ঘোড়া চলালেন, যারা তাদের অসমাপ্ত লড়াই শেষ করার জন্য অধৈর্য হয়ে ওঠেছিল।

নামাজরত চার হিন্দুস্থানি মুসলিম
সূর্য মধ্য গগণে এবং যোহর নামাজ আদায় করতে চার হিন্দুস্থানি মুসলিম এক মসজিদে প্রবেশ করলেন। প্রত্যেকে তাদের হৃদয়ে ভিন্ন ভিন্ন আশা নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ শুরু করলেন। তারা যখন নামাজে অর্ধেক পর্যায়ে ছিলেন তখন মুয়াযযিনের কণ্ঠে আযানের শব্দ শোনা গেল এবং তারা সন্দেহের মধ্যে পড়ে গেলেন যে তারা তড়িঘড়ি নামাজ শুরু করেছেন কিনা। তাদের একজন মুয়াযজিনের দিকে ফিরে জানতে চাইলেন, “প্রিয় মুযাযযিন সাহেব, আপনি কি নিশ্চিত যে আজ আপনি আযান দিতে দেরি করে ফেলেননি?”
হিন্দুস্থানিদের মধ্যে একজন দ্রুত তার বন্ধুকে সম্বোধন করে বললেন, “প্রিয় বন্ধু, তুমি এটা কী করলে? নামাজের মধ্যে তুমি কথা বলেছো এবং তোমার নামাজ ভেঙে গেছে!” তৃতীয় হিন্দুস্থানি দ্বিতীয় জনের দিকে ফিরে বিস্ময় প্রকাশ করলেন, “আরে, তুমি তাকে দোষ দিচ্ছো কেন? তুমি তো ঠিক একই কাজ করে তোমার নিজের নামাজ ভেঙেছো!”
“আল্লাহর শুকরিয়া! আমি এই তিন জনের মত অপ্রয়োজনীয়ভাবে কথা বলে উঠিনি!” চতুর্থ হিন্দুস্থানি বললেন। “আমি এ ধরনের কান্ডজ্ঞানহীন ভুল না না করার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক। আমার নামাজ ঠিক আছে!” নিজের একই ধরনের ভুল সম্পর্কে অসচেতন হয়ে তিনি অহঙ্কারের সঙ্গে বললেন।
চার ব্যক্তির নামাজ ছিল এ ধরনের, যারা নিজ নিজ বিবেচনায় একজন অন্যজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ওই সময়ে নামাজ ভঙ্গ করেছিলেন।

দৃষ্টান্ত স্থাপন করা
ওঘুজ তুর্কম্যানরা (তুরস্কের পশ্চিমাঞ্চল ও আজারবাইজানের কিছু এলাকার অধিবাসী) যোদ্ধা হিসেবে ছিল কঠোর ও ভয়ঙ্কর। তারা পারস্যে অভিযান চালায় এবং দেশের উত্তরাঞ্চলের ভূখণ্ডগুলো ধ্বংসলীলা পরিচালনা অব্যাহত রেখেছিল। এক পর্যায়ে তাদের সেনাবাহিনী দূরবর্তী এক গ্রামে পৌঁছলো, তাদের উদ্দেশ গ্রামের বাসিন্দাদের হত্যা ও তাদের মালামাল লুণ্ঠন করে সমগ্র এলাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া।
তারা ছোট ছোট জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরগুলো তল্লাশি করার সময় দু’জন বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিকে দেখতে পায়। তাদের একজন ছিলেন গ্রাম প্রধান এবং অপরজন তার প্রতিবেশি। তুর্কম্যানরা চটজলদি তাদের একজনকে বেঁধে ফেলে তাকে হত্যা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলো।
“আমাদের যুগের সেরা যোদ্ধাবৃন্দ, আপনারা কেন আমার মত একজন অসহায় বৃদ্ধকে হত্যা করতে চান?” বিধ্বস্ত লোকটি অনুনয় করলেন। “কেন আমার মত একজন নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাবেন? আপনারা কি দেখছেন না যে আমি এত দরিদ্র যে আমি প্রকৃতপক্ষে প্রায় নগ্ন? আমার মৃত্যুতে আপনাদের কী কল্যাণ সাধিত হবে?” সৈন্যরা তার হাত ও পা বাঁধতে শুরু করলে তিনি কাতরভাবে বললেন।
“আমরা তোমার গলা কেটে ফেলবো এবং একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবো, যাতে অপর লোকটি আমাদের জানায় যে কোথায় সে তার সোনা পুঁতে রেখেছে,” এক সৈনিক উত্তর দিল।
“কী বলছেন, সোনা? সে তো আমার চেয়েও হতদরিদ্র।”
“আমাদের গুপ্তচরেরা নিশ্চিত খবর দিয়েছে যে সে তার ধন-ভান্ডার লুকিয়ে রেখেছে।”
“আমরা দু’জনই একই পরিস্থিতির শিকার। তাহলে আপনারা আমার পরিবর্তে তাকে হত্যা করছেন না কেন। আমি কোথায় আমার সোনা লুকিয়ে রেখেছি, তা আপনাদের দেখিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি!” অনিবার্য মৃত্যু এড়ানোর উদ্দেশে কৌশলে যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করলেন।

বৃদ্ধ ব্যক্তি ও হেকিম
এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধিতে ভুগছিলেন, বার্ধক্যে উপনীত হলে একজনে সাধারণত যা হয়ে থাকে। একদিন তিনি নিজেকে কোনোভাবে সামলে স্থানীয় হেকিমের কাছে গেলেন তার উপদেশ নেওয়ার আশায়। হেকিম ও তাদের উপদেশের ওপর তার তেমন আস্থা ছিল না। কিন্তু তিনি তার যাতনার চরমে পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং পুরো দুর্বল শরীরে ছড়িয়ে পড়া যন্ত্রণা তার পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না। ক্ষীণ কণ্ঠে তিনি বলতে শুরু করলেন, “প্রিয় হেকিম, আমি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলছি। কিছুই আর মনে রাখতে পারি না।”
“বয়সের কারণে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়, মাননীয় সজ্জন,” তরুণ হেকিম ঘোষণা করলেন।
“আমি আমার দৃষ্টিশক্তি দ্রুত হারিয়ে ফেলছি। কী করতে পারি আমি?” তিনি বলে চললেন।
“বার্ধক্যের কারণে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়,” হেকিম উত্তর দিলেন।
“আমার পিঠের ব্যথা অসহনীয়,” গোঙানির মত বললেন বৃদ্ধ।
“মাননীয় সজ্জন, বয়সের কারণে পিঠে ব্যথা হয়,” হেকিম শীতল কণ্ঠে বললেন।
“্আমি যা কিছু খাই, সেগুলো আর উপাদেয় বলে মনে হয় না,” বৃদ্ধ রোগী অভিযোগ করলেন।
“বার্ধক্যের সঙ্গে পাকস্থলীর দুর্বলতাও আসে।”
“আমি যখন নি:শ্বাস নেই তখন আমার ফুসফুসে পর্যাপ্ত বাতাস টেনে নিতে পারি বলে মনে হয় না,” তিনি একটির পর একটি সমস্যা বলে চলেছেন।
“বয়সের সঙ্গে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হয়,” তরুণ হেকিম প্রকৃত সত্য বলে যাচ্ছিলেন। “বার্ধক্য অসংখ্য যন্ত্রণা নিয়ে আসে আমার প্রবীণ বন্ধু।”
বৃদ্ধ লোকটি এতক্ষণ পর্যন্ত তার রাগ দমন করে রেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তার মেজাজ স্থির রাখতে পারলেন না এবং হেকিমকে ধমক দিয়ে বললেন, “তুমি একটা মূর্খ! অনেক বছরের হেকিমি বিদ্যায় তুমি বুঝি এসবই শিখেছো? তুমি কি জানো না যে আল্লাহ প্রতিটি রোগের নিরাময় সৃষ্টি করেছেন? তুমি আস্ত মূর্খ, কোনোকিছু শিখতে পারোনি!
ঠাণ্ডা মেজাজের হেকিম বিরক্ত হয়েছেন, কিন্তু বৃদ্ধের অপমানে দৃঢ়তার সঙ্গে সাড়া দিলেন; “আপনার বয়স ষাট বছর এবং ক্রোধ ও উত্তেজনাও বার্ধক্যের ফল! সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর কার্যকারিতা বিনষ্ট হতে শুরু করে এবং একজন মানুষের মধ্যে ধৈর্য বা উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখার সামান্য সহনশীলতাও রেখে যায় না। বৃদ্ধ লোকের ক্রুদ্ধ মন্তব্য অগ্রাহ্য করে হেকিম পাল্টা বললেন, “সেজন্য আমি এমন ভান করবো যে, আমি আপনার অপমানসূক কথার কিছুই শুনিনি।”
হেকিমের হৃদয়ে সামান্য সহানুভূতি সৃষ্টির সুযোগ হারানোর পর তাকে আর কখনও তরুণ হেকিমের কাছে আসতে দেখা যায়নি।

জানাজায় জুহি
স্বল্পবয়স্ক জুহি পিতার সঙ্গে তার এক সহকর্মীর শবযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিল। মৃত ব্যক্তির পুত্র শবমিছিলের সামনে খাটিয়ার আগে আগে হেঁটে যাচ্ছিল। সে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিল এবং তার শ্রদ্ধাভাজন পিতার মৃত্যুর শোকে বিলাপ করছিল:
“আমার পরম প্রিয় পিতা, আপনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তারা? তারা কি আপনার প্রিয় দেহটিকে একটি কবরে দাফন করবে এবং মাটির স্তুপ দিয়ে ঢেকে দেবে? তারা কি আপনার দেহকে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন সংকীর্ণ বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে মেঝে ঢাকার জন্য কোনো গালিচা নেই, এমনকি খড়ের মাদুরও নেই? তারা কি আপনাকে এমন একটি ঘরে রাখবে, যে ঘরে কখনও আলোতে উজ্জ্বল হয়নি, যেখানে কোনো রুটি পাকানো হয় না? তারা কি আপনাকে এমন এক স্থানে রেখে যাবে, যেখান থেকে কখনও রান্নার খুশবু বাতাসে ছড়িয়ে পড়েনি; এটি কেমন বাড়ি যেখানে প্রবেশ করার যথাযথ দরজা নেই, ছাদে ওঠার কোনো সিঁড়ি নেই? তারা কি আপনাকে এমন কোনো স্থানে শয়ন করাবে, যেখানে আপনার খোঁজ নেওয়ার জন্য আপনার দরজার কড়া নাড়ার জন্য কোনো প্রতিবেশি নেই? আপনি এত বিপুলভাবে সম্মানিত ও শ্রদ্ধাভাজন, আপনার পক্ষে কীভাবে এমন একটি অন্ধকার ও নির্দয় আবাস সহ্য করা সম্ভব?
পিতার মৃত্যুতে ছোট ছেলেটিকে এই কথাগুলো উচ্চারণ করতে শুনে জুহি তার নিজ পিতার দিকে ফিরে ভীরুকণ্ঠে তাকে প্রশ্ন করলো, “আব্বা, তারা কি লাশটিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে?”
“আহম্মকের মত কথা বলো না। এটা কী ধরনের মূর্খতাপূর্ণ প্রশ্ন!”
“কিন্তু আব্বা, ছেলেটি যে বিস্তারিত বর্ণনা করছে তা আমাদের বাড়ির সঙ্গে মিলে যায়। মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনুন, তাহলেই আপনি বুঝতে পারবেন যে আমি কী বোঝাতে চাইছি। সে বলছে যে বাড়িটিতে আলো নেই এবং সেখানে কখনও কোনো খাবার রান্না করা হয়নি; বাড়ির দরজা ভাঙা এবং এর কোনো বাগান বা ছাদ নেই! আমাদের বাড়িটি তেমনই!” বালক জুটি জোর দিয়ে বললো। কিন্তু জুহির কথার প্রতি তার অমনোযোগী পিতা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলেন।

মূল্যবান উপদেশ
নবী মুহাম্মদের জীবদ্দশায় বহু দূরবর্তী দেশ থেকে লোকজন পথের আসতেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই দীর্ঘ সফরে তাদেরকে সীমাহীন কষ্ট সহ্য করতে হতো। সাধারণ লোকজন তাদের সমস্যা নিয়েই আসতেন এবং সবসময় মূল্যবান উপদেশ নিয়ে ফিরে যেতেন, যা সার্বিক কল্যাণের জন্য তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতো। একদিন নবী তাঁর পুরনো এক সাহাবির সঙ্গে নিয়মিত প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন, যার সঙ্গে বেশ কিছুদিন যাবত তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি। তিনি তাঁর কাছে এগিয়ে গেলেন। সাহাবি প্রথমে মহান ব্যক্তির কাছে নিজের দুরাবস্থা নিয়ে কথা বলছে অনিচ্ছুক ছিলেন, কারণ তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ত্রুটিগুলো স্বীকার করতে বিব্রত বোধ করছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার পর অবশেষে তিনি তাঁর সমস্যার কথা বললেন।
“আমার সম্মানিত বন্ধু, আপনার অন্তর্দৃষ্টি সম্পর্কে জানা আমার ভীষণ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে,” অস্বস্থির সঙ্গে নিজের অহঙ্কারকে চেপে রেখে তিনি বললেন। “আমি একজন ব্যবসায়ী ছিলাম। কিন্তু যখনই আমি কোনোকিছু কিনতাম, আমার আর্থিক ক্ষতি হতো! আমি ক্রয় করছি বা বিক্রয় করছি তা কোনো ব্যাপার নয়; যেন আমি মুগ্ধ হয়েছি এবং আমার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি; বিশেষ করে যখন ব্যবসায়িক বিষয় আসে তখন আমি ভুল থেকে সঠিক দেখতে পারি না। আমার ব্যবসায়িক অংশীদাররা সবাই আমার চেয়ে ভালো করছে এবং সবসময় আমার কোনো না কোনো সমস্যা হচ্ছে। এই দুষ্ট চক্র থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমি কী করতে পারি?”
মূল্যবান সময় নষ্ট না করে নবী মুহাম্মদ তাঁর বন্ধুকে উপদেশ দিলেন: “যখন আপনি দেখবেন যে আপনার সুযোগ নেওয়ার সময় এসেছে, কিন্তু আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত পারছেন না, তখন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। বাস্তব ক্ষেত্রে অন্তত তিন দিন অপেক্ষা করুন। কারণ ধৈর্য হচ্ছে আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ গুণগুলোর মধ্যে অন্যতম। আর সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাড়াহুড়ো করা শয়তানের কাজ!” এরপর তিনি বললেন, “আপনি যখন ক্ষুধার্ত কুকরের সামনে এক টুকরা রুটি ছুঁড়ে দেন, কুকুর কি সঙ্গে সঙ্গে তা খেয়ে ফেলে? অবশ্যই না। প্রথমে সে রুটির গন্ধ শুঁকে নিশ্চিত হয় যে এটি তার জন্য নিরাপদ কিনা, এরপর সে রুটির টুকরাটি খায়। কুকুর তার নিজের সম্পর্কিত যথার্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তার গন্ধ নেওয়ার ক্ষমতা ব্যবহার করে, এক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীদের ব্যবহার করতে তাদের মন ও জ্ঞান।”
সাহাবির চোখে গভীরভাবে তাকালেন নবী এবং সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করলেন যে তাঁর উপদেশ লোকটির বিবেকে গভীর ছাপ ফেলেছে। তিনি তাঁর হৃদয়ে আশ্বস্ত যে তাঁর কথাগুলো শীঘ্রই লোকটির ভাগ্য বদলে দেবে।