কবি মীর তকী মীর

খুশবন্ত সিং
অনুবাদ: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

আমি জানিনা, আমার মধ্যে কোন্ গুণটি অধিক- একজন প্রেমিকের, না একজন কবির। আমার মধ্যে প্রেম ও কবিত্ব দুটোই আছে। হৃদয়ঘটিত একটি ব্যাপার আমার বদনামের কারণ হয়েছে। কবিতা গোটা হিন্দুস্থানে আমার সুনাম ছড়িয়েছে। প্রেম আমাকে দিয়েছে মানসিক যন্ত্রণা আর কবিতা আমার মধ্যে উত্তেজনার সুড়সুড়ি দিয়েছে। প্রেম বা কাব্যচর্চা হতে যে বস্তুটি আমি পাইনি, তা হচ্ছে অর্থ। আমি যা আয় করেছি তা আমার কথামালার সূত্র ধরে। আমি উপলব্ধি করেছি, সুন্দরভাবে কাঁটা হীরকখন্ড এবং কাঁচের টুকরার মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারে না এমন লোকের সমাজে বাস করে আমাকে কী ভোজন করতে হবে তা স্থির করার কৌশল সুচারুভাবে রপ্ত করার চাইতেও আমার পৃষ্ঠপোষকের মর্জিই অধিক কার্যকর। আমার দরবেশতুল্য আব্বা মীর মোহাম্মদ আলী একদিন আমাকে বলেছিলেন, “বেটা, আমি তোমার ভবিষ্যত সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। তোমার হৃদয়ে একটা আগুন জ্বলছে। আমার ভয় হচ্ছে, এই আগুন তোমাকে কী করে ফেলে।” আমার বয়স তখন মাত্র নয় বছর। তার কথা শুনে আমি হেসে ফেলেছিলাম। তার মধ্যে বয়সের প্রজ্ঞা ছিল। তিনি কেঁদেছিলেন, কারণ, তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, আমার মধ্যে প্রেমের যে আগুন জ্বলছে তা আমাকে প্রতিষ্ঠিত এবং ধ্বংস করবে।

কবি মীর তকী মীর

একদিন আসর নামাজ শেষে সন্ধ্যার দিকে আব্বা বললেন, “বেটা, পৃথিবীটা দ্রুত বদলায় এবং এর সাথে পাল্লা দেয়ার সময় খুব কম। তাছাড়া জিন্দেগীর রাস্তাটা বড়ই বন্ধুর। তোমাকে প্রতিটি কদম ফেলতে হবে হিসেব করে। যে সময়টুকু আছে তা নিজেকে জানতে কাজে লাগাও।” তখন আমার বয়স মাত্র দশ বছর। যা খুশি করার মতো প্রচুর অবসর ছিল। নিজের কোন ব্যাপারে আমি অজ্ঞ, কোনদিনই আমার এমন মনে হয়নি। আমার পিতা নিজের ভিতরের সত্যটাকে অনুসন্ধান করতে গোটা জীবন অতিবাহিত করেছেন এবং তিনি জানেন যে, তার অনুসন্ধান শিগগিরই শেষ হবে।
আমরা আকবরাবাদের (আগ্রা) উপকণ্ঠে এক খানকায় বাস করতাম। আব্বার দুই বিবির সন্তানরা ছাড়াও আমাদের সাথে থাকতেন চাচা আমানুল্লাহ, তিনি আব্বার মতোই অধিকাংশ সময় ইবাদত-বন্দেগী ও ধর্মীয় আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত থাকতেন। তারা যখন ইবাদত করতেন না তখন প্রেম বিষয়ে যুক্তিতর্ক করতেন। আব্বা বলতেন, ‘তুমি যদি আল্লাহকে ভালোবাসো তাহলে আল্লাহর সৃষ্টি সবকিছুকেই ভালোবাসো।’ চাচা কথাটা বলতেন এভাবে ঘুরিয়ে : ‘তুমি যদি আল্লাহর সৃষ্টিকে ভালোবাসো, তার অর্থ আল্লাহকে ভালোবাসা।’ আমি বুঝতে পারতাম না যে, কী করে দু’জন বৃদ্ধ মানুষ একই বিষয় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন আলোচনা করতে পারেন। চাচা আমানুল্লাহর মনে যে প্রেম ছিল তা আমি পরবর্তী সময়ে উপলব্ধি করেছি। আমি কখনো কখনো বিস্মিত হতাম যে, চাচা আমানুল্লাহ, যিনি আল্লাহর সৃষ্টিকে ভালোবাসার কথা এতো আলোচনা করতেন, তিনি কোনো নারীর উপস্থিতিতে মাটি থেকে তাঁর দৃষ্টি ওপরে তুলতেন না। এরপর এক সন্ধ্যায় তিনি আগ্রার বাজারে ঘুরে বেড়ানোর সময় এক সুদর্শন বালকের সাথে তাঁর দৃষ্টি বিনিময় হলো এবং পাগলের মতো তাঁর ভালোবাসায় পড়লেন। এই ঘটনার পর খাদ্যের জন্য তাঁর ক্ষুধা এবং মনের শান্তিও হারিয়ে গেল। কয়েকদিন পরই সেই বালকের প্রেমে দিশেহারা চাচার মৃত্যু ঘটলো।
আমার আব্বার কাছে প্রেমের অর্থ কিছুটা ভিন্ন ছিল। একদিন তিনি আমাকে বললেন, ‘তোমার একমাত্র সঙ্গীর সাথেই প্রেম করবে। প্রেমই বিশ্বকে টিকিয়ে রাখে। পৃথিবীতে তুমি যা কিছু দেখছো, সবই প্রেমের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। আগুন হচ্ছে প্রেমের উত্তাপ, মাটি হচ্ছে এর ভিত্তি, বায়ু হচ্ছে বিরামহীনতা, রাত স্বপ্নের রাজ্য এবং দিবস হচ্ছে জাগ্রত অবস্থা।’ তখন আমার কাছে তাঁর কথার কোনো মর্ম ছিল না। যা হোক, নিজের অজান্তেই আমার শৈশব হতেই প্রেমের একটি অনুসন্ধিৎসা আমার সাথে জড়িত হয়ে গিয়েছিল এবং সেটাই হয়েছিল আমার জীবনের ধ্রুবতারা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার চাচা আমানুল্লাহ যে প্রেমে আপ্লুত হয়েছিলেন বা আব্বা যে প্রেমের আলোচনা করতেন সে প্রেম আমার জীবনে আসেনি। বরং আমার মধ্যে সেই প্রেম এসেছিল যা একজন নারীর কাছে একজন পুরুষের মাথা ও হৃদয়কে আবৃত করার মতো।
আব্বা দু’বার বিয়ে করেছিলেন। তাঁর প্রথম বিবি ছিলেন দিল্লীর খ্যাতিমান কবি আরজুর বোন। তাঁর এক পুত্র ছিল হাফিজ মোহাম্মদ। আমার মা ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় বিবি। মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে আমিই বড়। আমার বৈমাত্রেয় ভাই হাফিজ মোহাম্মদের তাঁর পিতা, সৎ মা অথবা তাঁর সন্তানদের প্রতি কোন ভালোবাসাই ছিল না। তদুপরি সে আমাকে ঘৃণা করতো। আব্বা ব্যাপারটি ভালোভাবে জানতেন। সে জন্যে তিনি জীবদ্দশাতেই তাঁর যা কিছুই ছিল তা ভাগ করে দেয়ার কথা ভাবলেন। গ্রীষ্মের এক বিকেলে সূর্যতাপ যখন অতি প্রচন্ড এবং উত্তপ্ত বাতাস বইছিল, তখন তিনি তাঁর কিছু অসুস্থ মুরীদকে দেখতে আগ্রা গমন করলেন।
ফিরে এসেই তিনি গরমজনিত রোগে শয্যাশায়ী হলেন। তাঁর নাসিকায় বেহেশতের মৃদুমন্দ বাতাসের সুগন্ধ। হাফিজ মোহাম্মদ এবং আমাকে কাছে ডেকে তিনি বললেন, ‘বেটা, আমি একজন ফকির। আমার কোনো অর্থ, জমি বা অন্য সম্পত্তি নেই। থাকার মধ্যে আছে শ’তিনেক কেতাব! তাছাড়া মহাজনদের কাছে তিনশ টাকার দেনাও আমার আছে। দুনিয়া থেকে বিদায় নেবার আগে আমি আমার কেতাব ও দেনা সমানভাবে তোমাদের দু’জনের মধ্যে ভাগ করে দিতে চাই।’ আমার সৎ ভাই সাথে সাথে বললো, ‘আব্বাজান আপনি ভালোভাবেই জানেন যে, পরিবারের মধ্যে আমিই একমাত্র শিক্ষিত এবং কেতাবগুলো পড়ে যদি কেউ লাভবান হয়, সেটা আমিই। কেতাবের পাতা ছিঁড়ে ঘুড়ি তৈরি করে উড়ানো ছাড়া তকী সেগুলো দিয়ে আর কি করবে?’ তার কথায় আব্বা বিরক্ত হলেন। কিন্তু মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে তিনি তাকে মৃদু তিরস্কার করা ছাড়া আর কী করতে পারেন। তিনি বললেন, ‘হাফিজ মোহাম্মদ, মন দিয়ে আমার কথাগুলো শোন। শিক্ষার আলো কোনদিনই তোমার ঘর আলোকিত করবে না, কিন্তু তকীর ঘরকে উজ্জ্বল করবে।’ আমার দিকে ফিরে তিনি বললেন, ‘বেটা, মহানজনদের দেনা পরিশোধ করার পূর্বে আমার লাশ দাফন করো না। ঘাবড়িও না, তোমার কাছে টাকা আসবে।’
আল্লাহর নাম জপতে জপতেই আব্বা দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিলেন। তার ইন্তেকালের খবর আগ্রায় পৌঁছলে লোকজন দলে দলে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আমাদের খানকায় আসছিল। তাদের মধ্য থেকে কিছু হিন্দু দোকানদার আমাকে টাকা দিতে চাইলো। আমি তাদের থেকে অর্থ নিতে অস্বীকার করার পর যখন আব্বার মুসলিম মুরীদরা পাঁচশ টাকার একটা থলে আমার কোলে রাখলো, তখন আমি হিন্দুদের টাকাগুলোও গ্রহণ করি। মহাজনদের কাছে আব্বার সমুদয় ঋণ পরিশোধ করে চাচা আমানুল্লাহর কবরের পাশেই তাঁর লাশ দাফন করলাম। এগার বছর বয়সেই বিধবা আম্মা, ছোটভাই ও বোনের দেখাশোনার দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর। দাফনের খরচ মিটানোর পরও আমার কাছে একশ’ টাকা ছিল। এছাড়া ছিল আমার জন্যে পিতার রেখে যাওয়া অভিজ্ঞান।
চাচা আমানুল্লাহ আমাকে উর্দু, ফার্সিতে তালিম দেয়া ছাড়াও কবিতা লেখার কায়দা শিখিয়েছিলেন। আমি এই ক্ষুদ্র জ্ঞান ধনী পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা দেয়ার কাজে ব্যবহার করতাম। মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় আমি মুশায়রায় হাজির হয়ে আগ্রা ও দিল্লীর বিখ্যাত কবিদের কবিতা শুনতাম। তাদের কবিতা আবৃত্তিও করতাম। খেয়াল করলাম, তাদের অধিকাংশ কবিতাই নতুন কোনো ভাব আনতে পারছে না। ছন্দের ক্ষেত্রেও এক স্থানে এসে স্তব্ধ হয়ে গেছে। মাসুদ নামে একজন গায়ক, মুশায়রাতেও যিনি সবার প্রিয়, তিনি আমাকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করলেন। মাসুদ দেখতে সুদর্শন। চেহারায় দুষ্ট প্রকৃতির ছাপ। তিনি তাঁর বিশ্রী কবিতাগুলো সুমধুর কণ্ঠে গাইতেন। মুশায়রা শুরু হওয়া মাত্র শ্রোতার ‘পরওয়ানার’ (পতঙ্গ) জন্যে চীৎকার করতো। ‘পরওয়ানা’ ছিল তাঁর ছন্দমান। (অবশ্য আমি সব সময় তাঁকে পতঙ্গ বলতাম) রমণীরা তাঁকে খুব পছন্দ করতো। প্রত্যেক সমাবেশেই লক্ষ্য করেছি, তাঁর রচিত গান গাওয়ার অনুরোধ সম্বলিত চিরকুট দিয়ে পর্দার আড়াল থেকে মহিলারা তাদের দাসীদের পাঠাতো। সবাই কামনা করতো ‘পরওয়ানার’ প্রেমের শিখাটা, যে শিখায় সে নিজেই জ্বলে পুড়ে গেছে। পরওয়ানার একটি ব্যাপার আমাকে বিরক্ত করতো, তাহলে খেলো ভাবের উদয় হলেও কবিতায় সে নতুন পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারেননি। স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নেই, অপদার্থ হলেও ‘পরওয়ানার’ পক্ষে হিংসা করারই ব্যাপার যে, সেই আমার মধ্যে কবিতার দীপ জ্বালিয়েছিল।
সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি একটা তেলের বাতির সামনে বসে কবিতা লিখতাম। তাসনীম ঝর্ণার পানির মতো আমার ভিতর থেকে কবিতা বেরুতো। লোকজনের সামনে কবিতা আবৃত্তি করতে আমার ভীষণ লজ্জা লাগতো। অবশ্য কবিতাগুলো সেইসব কবিদের দেখাতাম, যাদের কবিতা আমার কাছে একেবারে তুচ্ছ মনে হতো না। তারা বিস্মিত হতেন যে, একজন ছোট্ট বালকের শব্দমালায় এতো অন্তরঙ্গতা আছে। কেউ কেউ সন্দেহ করতেন যে, আমি কারো লেখা চুরি করছি। অনেকে মন্তব্য করলেন, “এই কবিতা সত্যিই যদি তোমার হয়, তাহলে ‘পরওয়ানার’ দিন শিগগিরই ফুরিয়ে যাবে। একটি শিখার মধ্যেই তাকে লাফালাফি করতে হবে।” আমি বিজ্ঞের বললাম, “আপনারা কী বলতে চান, ‘পতঙ্গ’ একজন কবি? সে পুরুষ বেশি খোজার কণ্ঠধারী সামান্য একজন ‘তুকবাজ’ ছাড়া কিছু নয়।” গল্পটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো যে, মুশায়রা সম্রাটের প্রতি অপমানসূচক শব্দ ব্যবহার করার মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছে বারো বছর বয়সী এক ছোকরা। আমি কী বলেছি, ‘পরওয়ানা’ তা যথাসময়ে জানতে পারলেন। তিনি গর্জে উঠলেন, “কে এই ছোকরা, মীর তকী? আমি তাকে এমনই শিক্ষা দেব যে, জীবনে ভুলবে না।” তার পরিচিত আগ্রার কয়েকটি পরিবারে আমি গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি সবার সামনে আমাকে অপমান করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
আগ্রার শ্রেষ্ঠ ধনী নওয়াব রঈস মিয়ার বেগম ‘পরওয়ানার’ প্রেমে পাগল বলে বলা হতো। তারই হাভেলিতে আয়োজিত এক মুশায়রায় কে যেন তাঁর কানে কানে বললো যে, আমিও সমাবেশে হাজির। দেখলাম, তাঁর চোখ শ্রোতাদের মধ্যে আমাকে খুঁজে ফিরছে। তাঁর তথ্য সরবরাহকারী ইশারায় আমার দিকে দেখাচ্ছিল। এক সময় সে মাথা নাড়লো এবং জোরেশোরেই সবাইকে শুনিয়ে বললো, ‘দাঁড়াও তামাশা দেখাচ্ছি।’ একজন কবির আবৃত্তি শেষ হবার পরই তাঁর ভক্তরা চীৎকার শুরু করলো, ‘পরওয়ানা’। সে দুই হাত উপরে তুলে লোকদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বললো, ‘আমার মেধার প্রশংসা করার জন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আপনাদের হুকুম অনুযায়ী কাজ করার জন্যেই আমি নিবেদিত। অবশ্য আজকের শুভ সন্ধ্যায় আপনাদের এই অনুগত দাসের মুখ খোলার আগে আমি হিন্দুস্থানের উদীয়মান তারকার জন্যে আপনাদের শান্ত থাকার অনুরোধ করছি। ‘পরওয়ানা’ তাঁর কাছে সামান্য এক ‘পতঙ্গ’। আপনারা যে এখনো তাঁর নাম জানেন না, সে জন্যে আপনাদের কোনো দোষ দেয়া যায় না। কারণ দুনিয়া এখনো তাঁর কালাম শোনেনি। নাক টিপলে এখনো তাঁর দুধ বেরোয়। কিন্তু সে নিজেকে উস্তাদের উস্তাদ মনে করে।’ তার কণ্ঠে ব্যঙ্গ। তাঁর ভক্তরা আনন্দে চীৎকার করে উঠছিল। শ্রোতাদের একজনের দিকে ফিরে উচ্চকণ্ঠে সে বললো, ‘তুমি কী বলতে পারো, সেই লুন্ডার (ফচকে ছোকরা) তার নাম কী? হ্যাঁ মনে পড়েছে-মীর। পুরো নাম মীর তকী মীর। আজকের এই মহান সমাবেশে তাঁর সামনে মোমবাতি রাখা হোক।
আমি ঘাবড়ে গেলাম। কখনো কোনো মুশায়রায় মুখ খুলিনি। আমার কোনো কবিতাও সঙ্গে নেই। এরই মধ্যে আমার সামনে বাতি এনে রাখা হলো। কয়েকশত চোখ আমার ওপর নিবদ্ধ। কপাল থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে। চোখ বন্ধ করে আমি আব্বার কথা চিন্তা করলাম। প্রার্থনা করলাম, ‘ইয়া আল্লাহ তুমিই আমার সাহায্য ও আশ্রয়দাতা।’ কোনো চিন্তা মাথায় ঢুকছিল না। ‘শামা-পরওয়ানা’ সম্পর্কে যে কবিতাটি লিখেছিলাম, সেটির কয়েক ছত্র ছাড়া আর কী আবৃত্তি করতে পারি। এটা লিখতে হয়েছিল আমাকে অপমান করার জবাব দেয়ার জন্যে। আমি আমার সকল বিনয় জড়ো করে বললাম, ‘পরওয়ানা সাহেব, কবিতা পেশের আগে আমি আপনাকে একটা ক্ষুদ্র উপহার দেয়ার জন্যে অনুমতি প্রার্থনা করছি। দয়া করে আপনি গ্রহণ করুন।
এরপর আমি স্পষ্টভাবে আবৃত্তি করলাম-
“আগুনের শিখাটা চেয়ে আছে
কিন্তু এরপর বাঁকা রেখার
পাশে আর কিছুই থাকে না
আগুনের জিহ্বার লাফানোর মধ্যেই
পতঙ্গ আগুনে পতিত হয়।”
শ্রোতারা এর মধ্যে প্রেমের স্বাদ পেলো না। কিন্তু অর্থ উপলব্ধি করার পর হর্ষধ্বনি করে উঠলো। ‘মারহাবা! সোবহান আল্লাহ! কেমন চমৎকার ছন্দ!’ প্রশংসায় সাহস সঞ্চয় করে আমি প্রেমের একটা কবিতা আবৃতির অনুমতি চাইলাম যেটি মাত্র পূর্ব রাত্রে রচনা করেছি এবং এখনো আমার মনে আছে।
“যেভাবেই দেখো, এ হচ্ছে প্রেম
শুধুই প্রেম
প্রেম সংগৃহীত হয়েছে মাটি থেকে
উপরে আকাশ।
প্রেম তো প্রেমের জন্যে
প্রেমিকের জন্যেও
সংক্ষেপে, প্রেম নিজেই প্রেমের সঙ্গে
প্রেমে নিমগ্ন।
প্রেম ভিন্ন কেউ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না
প্রেম আকাক্সক্ষা, প্রেমই আকাক্সক্ষার শেষ লক্ষ্য।
প্রেম দুঃসহ যাতনা, প্রেমের ব্যথায়
প্রেমই নিবারক
জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ, তোমরা কী জানো
প্রেম কী?
প্রেম ছাড়া বিশ্বের নিয়মরীতি ভেঙ্গে পড়বে
কবিরা যথার্থই বলে গেছেন
প্রেম হচ্ছে আল্লাহ।”
আমার আবৃতিতে শ্রোতৃমন্ডলী অভিভূত। প্রতিটি লাইনের পর তারা প্রশংসা করছিল, ‘বাহ্ বাহ!্ মোকাররার।’ তাদের উৎসাহে লাইনগুলো আমাকে বার বার আবৃত্তি করতে হলো। অনেকেই কাছে এসে আমার সামনে রৌপ্যমুদ্রা ছুঁড়ে দিচ্ছিল। একজন দাসী সোনার আশরফীর সাথে একটি কাগজের টুকরো আমার হাতে গুঁজে দিল। তাতে আমাকে নিজ হাতে কবিতার একটি অনুলিপি লিখে পরদিন সকালে ব্যক্তিগতভাবে হাভেলিতে পৌঁছে দেয়ার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছে। অনুরোধটা এসেছিল হাভেলির বেগমের নিকট হতে। এভাবেই কবি ও প্রেমিক হিসেবে আমার জীবনের সূচনা হলো।
সে রাতে আমি ঘুমোতে পারিনি। প্রশংসাগুলো আমার কানে বাজছিল। মিথ্যা ভানকারী ‘পরওয়ানাকে’ আমি অপমান করতে পেরেছি। এরপর আমি যেখানে থাকবো, সেই মুশায়রায় সে আর মুখ দেখাতে পারবে না। কিন্তু কে এই নারী যিনি আমার কবিতা চেয়ে পাঠিয়েছেন। মাথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। সারারাত বিনিদ্র কাটানো সত্ত্বেও সকালে বেশ সতেজ ও বিজয়ী বলে অনুভব করলাম। রাতে যা-যা ঘটেছিল তার সবই মাকে বললাম। সোনার আশরফী ও রৌপ্য মুদ্রাগুলো তার হাতে দিলাম। তিনি বললেন, “সব কিছু হয়েছে তোমার মরহুম আব্বার জন্যে। তোমাকে তিনি দেখছেন। একদিন তিনি দেখবেন যে, তুমি হিন্দুস্থানের সেরা কবি হবে।”
আমি আমার কবিতার একটি অনুলিপি তৈরি করলাম। নওয়াব রঈস মিয়ার হাভেলিতে হাজির হয়ে ভিতরে পয়গাম পাঠালাম। নওয়াব সাহেব ঘোড়াকে ব্যায়াম করাতে বাইরে গেছেন। খানিক পরেই একজন দাসী এসে আমাকে হেরেমে নিয়ে চললো। সে ধৃষ্টতার সাথে বললো, ‘তুমি এখনো ছোট্ট বালক। তোমার ঠোঁটের উপরে এখনো লোম গজায়নি। জেনানার মধ্যে তোমার উপস্থিতিতে কেউ আপত্তি করবে না।’ আমি এক সময় নিজেকে আবিষ্কার করলাম জাঁকজমকপূর্ণ অন্ধকার এক কক্ষে। সে কক্ষে পারস্যের গালিচার উপরে দেয়ালের সাথে ঠেস দেয়া কয়েকটি তাকিয়া। কয়েক মুহূর্ত পর বেগম সাহেবা কক্ষে প্রবেশ করলেন। আমি মাথা নত করে তাকে কুর্ণিশ করলাম এবং দুই হাত সামনে বাড়িয়ে আমার লেখা কবিতাটা পেশ করলাম। ‘আমার সামান্য মেধা সম্পর্কে আপনার প্রশংসা আমাকে সম্মানিত করেছে।’ তিনি প্রতিবাদ করলেন, ‘তোমার উপস্থিতিতে বরং আমি নিজেকে সম্মানিত বোধ করছি। তুমি যখন হিন্দুস্থানের সবচাইতে বড় কবি হবে তখন তুমি স্মরণ করতে পারবে যে, আমার মতো ক্ষুদ্র সৃষ্টি তোমার শ্রেষ্ঠত্বের প্রথম মূল্য দিয়েছে।’
তাঁর কণ্ঠ আমার কানে স্বর্গীয় সুরের দ্যোতনা সৃষ্টি করেছিল। তাঁকে এক নজর দেখার জন্যে আমি সাহস করে চোখ তুললাম। তিনি গালিচায় বসে তাকিয়ায় হেলান দিয়েছিলেন। তাঁর চোখ দুটি আমার উপর স্থির-নিবদ্ধ। তাঁর দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকাতে পারলাম না। তিনি খাটো মোটা আকৃতির প্রায় ত্রিশ বছর বয়সী রমণী। দেখতে সুশ্রী, গোলগাল মুখ, দীর্ঘ কুচকুচে কালো তার চুল। অন্য যে জিনিসটি লক্ষ্য করলাম, তা হচ্ছে তার সুপুষ্ট স্তন এবং বিশাল সুগোল নিতম্ব, যা আঁটসাট পায়জামায় প্রায় ফেটে বেরুচ্ছিল। তার স্থির দৃষ্টিতে আমি খুব অসহায় বোধ করছিলাম। মনে হচ্ছিল, তিনি আমাকে দু’চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছেন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি আমাকে বসতে বললেন এবং দাসীকে নির্দেশ দিলেন নাশতা আনতে। আমার সামনে রক্ষিত খাবারের স্তূপ থেকে আমি যখন গলধঃকরণ করছিলাম, তখনো অনুভব করলাম যে, তাঁর চোখ আমার ওপর ঘোরাফেরা করছে। তিনি তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের ‘বিসমিল্লাহ’ অনুষ্ঠানে আমাকে দাওয়াত করলেন। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন, আমি যেন তাঁর লেখা কিছু কবিতা দেখে সেগুলো কিভাবে আরো উন্নত করা যায় সে বিষয়ে উপদেশ দেই। তাঁর সন্তানদের গৃহশিক্ষকের পদে আমাকে বহাল করতে চাইলেন। হঠাৎ আমার মনে হলো, একটি পাখির ওপর রেশমী ফাঁদ পড়তে যাচ্ছে। আমি যথেষ্ট আনন্দিত হয়েছি সন্দেহ নেই, কিন্তু কিছুটা উদ্বিগ্নও হয়েছিলাম। আমার দৈন্যের দিনগুলোর অবসান ঘটলো, কিন্তু সেই সাথে ফুরিয়ে এসেছিল আমার স্বাধীনতার দিন।
আম্মার কাছে যখন এই সাক্ষাতের কথা বললাম তিনি আমার আনন্দ ও উদ্বেগে শরীক হলেন। তিনি বললেন, “এই বেগম সাহেবা সম্পর্কে অনেক কিছু কানে এসেছে। এক দরিদ্র পরিবার থেকে উনি এসেছেন। যখন তাঁর বয়স বড় জোর ষোল, তখন তাঁকে তুলে নেয়া হয় নওয়াব রঈসের কাছে। এখন নওয়াবের বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধে। তাঁর প্রথম বেগমের অনেকগুলো সন্তান তাঁর স্বামীর নয়, কবি পরওয়ানার। এই কবিকে কিছুদিনের জন্যে উস্তাদ হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। নওয়াব রঈস বৃদ্ধ ও কমজোর হয়ে গেছেন। তাছাড়া প্রায়ই তিনি দিল্লী চলে যান।” একটু থেমে তিনি বললেন, ‘বেটা, তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে। তোমার জন্যে সুন্দরী একটা মেয়ে খুজবো।’ যদিও আমার বয়স মাত্র পনের, আমি বুঝতে পারলাম, তাঁর মনের মধ্যে কী উদ্বেগ কাজ করছে। তিনি ভাবলেন যে, বেগম সাহেবার সাথে সাক্ষাত করে তাঁকে ধন্যবাদ দেয়ার সঙ্গে আমার জন্যে উপযুক্ত পাত্রীর ব্যাপারে পরামর্শ নেয়া খুব ভালো হবে।
বেগম সাহেবা আম্মার সাথে ভালো ব্যবহার করলেন। তিনি তাঁকে রেশমী পোশাক উপহার দিলেন এবং তাঁর কাছে আমার প্রশংসা করলেন যে, তাঁর পুত্র খুব শিগগির কাব্যজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হতে যাচ্ছে। আম্মা যখন তাঁর কাছে আমার জন্যে পাত্রী অনুসন্ধানের বিষয় উত্থাপন করলেন। বেগম সাহেবা সাথে সাথে উত্তর দিলেন যে, ‘ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। আমার কাছেই তাঁর উপযুক্ত মেয়ে রয়েছে। আপনি কী ওকে দেখতে আগ্রহী?’ আম্মা বাধা দিলেন, ‘বেগম সাহেবা, আপনার যদি পছন্দ হয়, তাহলে আমাদের দেখার বা কী থাকতে পারে। আপনার পছন্দ কল্যাণকর হোক।’
পরদিন বেগম সাহেবা আমাকে খোঁচা দিয়ে বললেন যে, তিনি আমার জন্যে একটা মেয়ে দেখেছেন। সে কোন হুরী নয়, নিতান্তই সাধারণ মেয়ে। শ্বেতপাথরের মতো শুভ্র তার চরিত্র। তার মতো স্ত্রী হলে বদনাম কোনোদিনই তোমার বাড়িতে প্রবেশ করবে না। তার পিতা কোনো ধনী ব্যক্তি নয়। কিন্তু আমরাই বিয়ের খরচ এবং উপযুক্ত যৌতুক দেবো। আমার পছন্দে তুমি নিশ্চয়ই নারাজ হবে না।’
সেই মেয়ের নাম সালিমা। ওকে বিয়ে করার পর আমার কাছে বেগম সাহেবার উদ্দেশ্যে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠলো। আমার বিবি বাস্তবিক পক্ষে কোন হুরী ছিল না। বাঁশের মতো শুকনো সে। হাতের আঙ্গুল দিয়ে ওর কোমর আঁকড়ে ধরতে পারতাম। ওর স্তনের অস্তিত্ব বুঝাই যেতো না; মুখ বন্ধ করে থাকলেও ওর সামনের দাঁতগুলো বেরিয়ে থাকতো। কথা বলার সময় সহজেই ওর মাড়ি দৃষ্টিগোচর হতো। শ্বেতপাথরের মতো চরিত্রের শুভ্রতা বজায় রাখা ছাড়া ওর আর কোন পছন্দ ছিল না। ওর নিস্পৃহভাব আমাকে অসৎ পথ অবলম্বনের জন্যে প্রলোভিত করতো। আমার বিবির পিতা বেগম সাহেবার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তাঁকে নওয়াব সাহেবের এক বাগানে তত্ত্বাবধায়কের কাজ দেয়া হয়েছিল।
বেগম সাহেবা একজন চক্রান্তকারী এবং কর্তৃত্বশীল নারী, যিনি তাঁর ইচ্ছামত সবকিছু পাওয়ার পথ করে নিতেন। বৃদ্ধ হলেও নওয়াব রঈস তাঁর স্বামী ছিলেন। খন্ডকালীন এক প্রেমিককে কামনা করে সে বাসনা পূরণ করেছেন। একজন কবি সুনাম অর্জন করলে তার উপর নির্ভর করে বেগমের কাব্যপ্রীতি। কবিতার অন্তর্নিহিত ভাব উপলব্ধি করে নয়। মীর তকীর নক্ষত্র যখন উদিত হচ্ছিল, তখন তিনি তার পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবিকা হতে স্থির করলেন। তিনি তকীর জন্যে এমন একজন স্ত্রী সংগ্রহ করেছিলেন, যাকে তিনি অনায়াসে অবজ্ঞাও করতে পারেন।
আমি এখানে বেগম সাহেবার নাম প্রকাশ করতে চাই না। ধর্ম শাস্ত্রে যতগুলো অপরাধ তালিকাবদ্ধ আছে, তার মধ্যে জঘন্যতম হচ্ছে, যে রমণী স্বেচ্ছায় নিজেকে কারো কাছে নিবেদন করেছে তাকে প্রত্যাখ্যান করা। তাঁর সুন্দর ও গোলগাল মুখের জন্যে যে নামটি দিয়েছিলাম, সে নামটিই আমি প্রকাশ করতে চাই-‘কামরুন্নিসা’, পূর্ণ চাঁদের মতো। এই তুলনায় তিনি অত্যন্ত তুষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর মাঝে হাজার বছরের রমণীয়তা। তিনি জানতেন, কেমন করে পুরুষকে বিপথগামী করতে হয়। নিজের পছন্দের মায়াজালে পরপুরুষকে প্রলোভিত করতে হয়। তিনি স্বেচ্ছায় হৃদয় সমর্পণের সাথে প্রেমিকের কাছে দেহও সমর্পণ করেছেন। যখন থেকে তিনি আমার কর্ত্রী, তখন থেকে আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, তিনি আমাকেই তাঁর ঈশ্বর হিসেবে জানেন এবং আমার কবিতার প্রতিটি বাক্য তার কাছে পবিত্র কোরআনের সুরার মতো। তিনি এক সাথে আমার মা, কর্ত্রী, সেবিকা ও সঙ্গিনীতে পরিণত হলেন। আমার সাথে মুহূর্তের বিচ্ছেদও তিনি সইতে পারতেন না। আমার আরো বন্ধু-বান্ধব থাকুক তা সহ্য করতে না পেরে তিনি মাত্র কয়েকজনকে অনুমোদন করেছিলেন। তিনি আমার বর্তমান জীবন এবং ভবিষ্যত জীবনকে নাস্তিক্যে পর্যবসিত করেছিলেন। আমি নিজেকে হাতবাঁধা এবং তার দ্বারা শৃঙ্খলিত মনে করতাম। শৃঙ্খল একটু শিথিল হোক তাও চাইতাম। একই সময়ে এটাও অনুভব করতাম যে, দীর্ঘ রেশমী বেণী দিয়ে তিনি যে আমাকে বেঁধেছেন, তা প্রেমিকের জন্যে মানুষের শাশ্বত অনুসন্ধানের মতোই আল্লাহ প্রদত্ত। তিনি আমাকে যখন তাঁর ছেঁড়া চপ্পলের মতো পরিত্যাগ করলেন এবং আরেক ছন্দস্রষ্টার প্রতি তার দৃষ্টি ফেরালেন, যার যোগ্যতা শুধু এতটুকু যে, আমি দিল্লীর উদ্দেশ্যে প্রস্থান করলে তিনি আগ্রায় মুশায়রায় প্রিয় প্রজাপতিতে পরিণত হয়েছিলেন। এই নারী আমাকে সৃষ্টিও করেছে, ধ্বংসও করে দিয়েছে। সংক্ষেপে এই হলো, কবি ও প্রেমিক মীর তকী মীরের জীবনের ইতিহাস।
আমি এরই মধ্যে বলে ফেলেছি যে, কিভাবে নওয়াব রঈসের বাড়িতে নিমন্ত্রিত এবং তাঁর পুত্রদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হই। বেগম সাহেবা পড়ানোর সময় সর্বদা হাজির থাকতেন। আমি বাচ্চাদের যখন পড়াতাম, তাঁর চোখ নিবদ্ধ আমার ওপর। পড়ানো শেষ হলে আগের রাতে কি লিখেছি, তা আবৃত্তি করার জন্যে আমাকে পীড়াপীড়ি করতেন। আবৃত্তির সময় প্রতিটি লাইন শুনে ‘সোবহানআল্লাহ’ বলে বিস্ময় প্রকাশ করতেন। যে কাগজে লিখেছি আমার হাত থেকে সে কাগজটি নিয়ে তাঁর নিজের রচনা আমাকে দেখতে দিতেন। সেগুলোর ছন্দ খুব দুর্বল, কিন্তু স্পষ্টতঃই আমাকে লক্ষ্য করে লেখা। আমি তাঁর কবিতার প্রশংসা করতাম। কিভাবে ছন্দ ও বাক্যের উন্নতি করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দিতাম। কখনো কখনো তাঁর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে কপালে স্থাপন করতাম। তিনি আমাকে দুপুরে খেতে দিতেন। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখতাম, তিনি সবার জন্যে বিরিয়ানী এবং অন্যান্য উপাদেয় খাবার পাঠিয়েছেন। এভাবে তিনি আমাকে বুঝিয়েছেন, মোগল সাম্রাজ্যে আমিই সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। রাতে আমার হাড্ডি চর্মসার স্ত্রীর সাথে বিছানায় শুয়ে বেগম সাহেবার বিশাল নিতম্বের প্রসঙ্গ তুলে মস্করা করতাম, যা আমাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।
একদিন বেগম সাহেবা কোনো কিছুর চাহিদার ষড়যন্ত্রের জাল বুনলেন, যা সংশ্লিষ্ট সকলে উপলব্ধি করলো। তিনি প্রধান পুতুল নাচিয়ে, যার আঙ্গুলে সবকটা সুতার মাথা। তাঁর ষড়যন্ত্রের অসহায় শিকারদের পুতুলের মতো তার হুকুম তামিল করা ছাড়া উপায় ছিল না। কাব্য বিনিময়ের মধ্য দিয়ে তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে, আমি ছিলাম তার স্বেচ্ছা শিকার। তিনি তাঁর ছলচাতুরী প্রয়োগ করলেন স্বামীর ওপর। নওয়াব সাহেবকে তিনি বুঝালেন যে, তাঁর নিজের ভবিষ্যতের জন্যই দিল্লী যাওয়া জরুরী। কারণ কারণ পারস্যের নাদির কুলী খান হিন্দুস্থান আক্রমণ করতে আসছে এই গুজবের সত্যতা কতটুকু তা দেখা উচিত। সেই সাথে তিনি নওয়াব সাহেবকে বললেন, শাহী খাজাঞ্চী দিল্লীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি নওয়াব শামসামুদ্দৌলার কাছে আমার ব্যাপারে তদবীর করতে, যাতে তিনি আমাকে সম্রাটের কাছে পেশ করতে পারেন। এর ফলে নওয়াব রঈসের মনে এমন সন্দেহও হতে পারে যে, বেগম আমাকে আগ্রা থেকে বিদায় করতে চাচ্ছেন। তার স্বামী যে শুধু উভয় প্রস্তাবে সম্মত হলেন তাই নয়, তাঁর অনুপস্থিতির সময় আমাকে হাভেলিতে থাকার জন্য চাপ দিলেন। তাহলে তিনি অন্ততঃ স্বস্তিবোধ করবেন যে তার বাড়িতে একজন বিশ্বস্ত লোক দেখাশোনা করছে, আর পুত্রদের পড়াশোনাও ব্যাহত হচ্ছে না।
নওয়াব রঈস তাঁর অশ্বারোহী অনুচরবৃন্দসহ দিল্লী রওয়ানা হলেন। হাভেলিতে নতুন করে থাকার ব্যবস্থা গুছানো হলো। পুত্রদেরকে তাদের পিতার শয়নকক্ষে স্থানান্তরিত করা হলো যাতে পুত্রদের কক্ষটা আমাকে দেয়া যায়। এই দুই কক্ষের মাঝেরটাই বেগম সাহেবার শয়নকক্ষ। তিনি মূল্যবান সময় অহেতুক নষ্ট করায় বিশ্বাসী ছিলেন না।
বেগম সাহেবার প্রতারণা তাঁর ধৃষ্টতার মতোই ভীতিজনক ছিল। সকালে তিনি বৃদ্ধ স্বামীকে অশ্রুসজল চোখে বিদায় দিয়েছিলেন। বিকেলে তিনি তাঁর পদযুগল, বগল ও গোপনস্থানের কেশ বিনাশ এবং সুগন্ধী তেল দ্বারা শরীর মর্দন করানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। নৈশ ভোজনের ঘণ্টা খানেক পর পুত্র-কন্যারা নিদ্রামগ্ন হলো। ভৃত্যরাও কাজ সেরে তাদের কক্ষে প্রস্থান করলো, তখন আমার কাছে সকল রহস্য উদঘাটিত হলো। তিনি আমার কাছে এমনভাবে আগমন করলেন, যেন শয্যায় প্রতীক্ষারত স্বামীর কাছে আসছেন। দীর্ঘদিনের বিবাহিত লোকদের মতো আমরাও প্রেমের বাক-বিনিময়ে অহেতুক কালক্ষেপণ করলাম না। প্রেমের পূর্বে প্রেমিক-প্রেমিকারা যেসব বাক্যালাপ করে আমরা উভয়ে কবিতার মাধ্যমেই তা শেষ করেছিলাম। আমাদের চোখ প্রথম সাক্ষাতের দিন থেকেই কথা বলে আসছে।
বাতি নিভানোর ব্যাপারটাকে তোয়াক্কা না করেই তিনি একে একে তাঁর সকল বসন পরিত্যাগ করলেন। আমারগুলোও খুলে দুই হাত দিয়ে আমাকে নিষ্পেষণ শুরু করলেন। যতক্ষণ সাধ্যে কুলোয়, আমরা একে অন্যের মুখে মধু পান করলাম। তিনি আলতোভাবে আমাকে বিছানায় ফেলে আমার ওপর তাঁর দেহ ছড়িয়ে দিলেন। গ্রীষ্মের ভোরে গোলাপ পাপড়ির ওপর শিশির বিন্দুর মতো তার দুই উরু সিক্ত। আমার দন্তে ব্যথা পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি আমার মুখে মুখ চেপে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরই তিনি উত্তেজনায় গোঙাতে শুরু করলেন। সারা শরীরে তার অদ্ভুত কম্পন অনুভব করলাম। দেহ ঘামে সম্পূর্ণ ভিজে গেছে। এ ধরনের উত্তেজনা সম্পর্কে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই এবং ভাষায়ও এর প্রকাশ সম্ভব নয়।
তিনি উঠতে চেষ্টা করলেন। আমি তাঁকে আঁকড়ে রেখেছিলাম। ফলে তিনি নড়তে পারলেন না। এ খেলায় তিনি পাকা খেলোয়াড়। তাঁর অভিজ্ঞতাও অনেক। বয়সে আমি তরুণ, কামনাও অধিক। বেগম সাহেবা আমাকে অনুমোদনের হাসি উপহার দিয়ে অধীনতা স্বীকারের দৈহিক ভাব প্রকাশ করলেন এবং এবার চিৎ হয়ে আমাকে পুরো ভূমিকা পালনের সুযোগ দিলেন। আমি তার মুখমন্ডল, গলা, স্তনে কামড় বসালাম এবং জিভ দিয়ে কানে সুড়সুড়ি দিলাম। এবার আমি নিঃশেষিত হবার আগে তিনি বহুবার চরমে উঠে গেলেন। অর্ধ ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার প্রেমের খেলা শুরু করলাম। এভাবে সারারাত চললো। আমার মনে নেই, কখন এর সমাপ্তি ঘটলো অথবা তিনি কখন আমার কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে তার কক্ষে বিশ্রাম নিতে গেলেন। যখন জাগ্রত হলাম, মনে হচ্ছিল চোখের পাতা আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো। কিন্তু ক্লান্তির বদলে নিজেকে অনেক ঝরঝরে মনে হ্িচ্ছল। তাঁর স্বামীর বিশ্বাসের প্রতি প্রতারণা এবং আমার স্ত্রীর কাছে অবিশ্বাসী হওয়ার জন্যে অপরাধবোধের বদলে আমার মনে হলো, অন্তর্যামী আমাদের হৃদয় ও দেহের এই মিলনে তুষ্ট হয়েছেন এতে পাপ নেই, বরং এ হচ্ছে স্বর্গীয় প্রেম।
আমি হাভেলির আঙ্গিনায় নেমে গেলাম। দেখলাম, বেগম সাহেবা একটা মোড়ায় বসে আছেন। দু’জন দাসী তার পা মর্দন করছে। আঙ্গিনায় তার স্বামীর পেখম ছড়ানো পায়রাগুলো আশেপাশে ঘুরে ঘুরে ডাকছে। আমি তাঁকে কুর্ণিশ করলে তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘আমার বিশ্বাস, আমাদের কবি বন্ধুর সুন্দর রাত কেটেছে।’ তিনি দাসীকে নাশতা পরিবেশনের নির্দেশ দিলেন। স্বামীর প্রেরিত চিঠিটা পাঠ করলেন। সেকেন্দ্রায় রাত্রি যাপনের জন্যে যাত্রা বিরতির সময় তিনি চিঠিটি লিখেছেন। তিনি আমাকে জানালেন যে, আমার স্ত্রীর জন্যে একঝুড়ি শুকনো ফল পাঠিয়ে দিয়েছেন।
বেগম সাহেবা তাঁর মর্জি মাফিক আমাদের জীবনের পরিকল্পনা রচনা করেছিলেন। তাঁর পুত্রদের পড়ানোর জন্যে যে টাকা আমাকে দিতেন তা আমার বিবি ও আম্মা আগে যা দেখে এসেছেন তাঁর চাইতে অনেক বেশি। আমার বিবিকে তিনি বলতেন, ‘আমার পুত্ররা কী তোমার পুত্র নয়? তোমার স্বামীকে তাদের পড়ানোর সুযোগ দিয়ে আমাকে চিরকৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ করছো। এর পরিবর্তে আমি যা দিচ্ছি তা পান চর্বণের মতোই যৎসামান্য। উপহার দিয়ে তিনি আমার বিবিকে সন্তুষ্ট রেখেছিলাম। তিনি তাঁর স্বামীকে লিখলেন, শুধু তাঁর সন্তানদের পড়ানোর কাজে লাগানো ছাড়া অন্য কোন কাজে নিয়োজিত না হতে দিয়ে আমার ওপর কতটা কর্তৃত্ব চালাচ্ছেন।
আমার সাথে বেগম সাহেবার আচরণ অতি বিশ্বস্ত। দুনিয়ার আর সবার সাথে মিথ্যা বললেও আমার সাথে কখনো মিথ্যা বলতেন না। রঈস মিয়ার সাথে তার শাদীর কথা বললেন যে, প্রথম বিবির ঘরে নওয়াবের সন্তান ছিল। তাকে এবং তার কাজগুলো দেখাশোনা করার জন্যে তিনি কাউকে প্রয়োজন ভেবেছিলেন। বেগম সাহেবা এসে সন্তান ও সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব নিলেন। ঘোড়াকে ব্যায়াম করানো এবং পায়রাকে প্রশিক্ষণ দেবার পর নওয়াব সাহেবের যথেষ্ট সময় পড়ে থাকতো। কয়েক মাস অন্তর হঠাৎ একদিন মদ্যপান করে উত্তেজিত হয়ে উঠলে বেগম সাহেবার সাথে তাঁর দৈহিক মিলন ঘটতো। তার আত্মচেতনা জাগ্রত করার জন্যে প্রেমের তীব্রতা প্রদর্শন করার পর এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, বেগম সাহেবা এমন ভানও করতেন। তিনি ‘পতঙ্গের’ সাথে তাঁর সম্পর্ক এবং তাঁর দ্বারা যে গর্ভ সঞ্চারিত হয়েছিল সেই ভ্রƒণকে নষ্ট করে দেয়ার বিপদের কথাও স্বীকার কররেন। আমাদের মধ্যে না বলা আর কিছুই ছিল না। তিনি আমার এতো ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন যে, নিজের বিবির কাছে গেলে অপরাধী মনে হতো। বেগম সাহেবা আমাকে এমনও প্ররোচিত করতেন যে, আমাদের সম্পর্কের জন্যে তাঁর স্বামীর সাথে ভালোবাসার ছলনা করা জরুরী হলেও আমার স্ত্রীর সাথে বসবাসের কোন প্রয়োজন নেই। ব্যাপার খুব স্পষ্ট যে, আমাকে তাঁর যথেষ্ট প্রয়োজন। এর মাঝেও তিনি আমাকে একটি সন্তান জন্ম দেয়ার সুযোগ দিয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস যে, আমার সকল শক্তি কবিতা লিখা ও বাচ্চাদের তামিল দিতে নিঃশেষ হচ্ছে।
বেগম সাহেবার সান্নিধ্যে আমি পরম সুখের দিনগুলো কাটিয়েছি। তার আঁটসাট পোশাক, সুকোমল দেহবল্লবীর মাঝে আমি জীবনের সত্যিকার অর্থ খুঁজে পেয়েছি। আমাদের হৃদয় ও দেহের কামনা পূরণের জন্যে দীর্ঘ প্রহর আমরা এই আশায় অতিবাহিত করেছি যে, আমাদের পরস্পরের আবার চির পরিতৃপ্তি ঘটবে। কিন্তু হায়, প্রতিবার বিচ্ছিন্ন হবার পর যখন আবার মিলিত হতাম, মনে হতো, এই বুঝি প্রথম। আমরা সারারাত একে অন্যের বাহুতে মাথা রেখে শয়ন করতাম। ভোর হওয়ার সাথে সাথে নববধূর মতো লাজনম্র ভঙ্গিতে তিনি মুখমন্ডল আবৃত করতেন। তাঁর পর্দার রহস্য উন্মোচন করার একটা বাসনা আমার মধ্যে জাগ্রত হতো। আমি যতো তাঁকে দেখেছি, তার দেহের জন্যে আমার আকাক্সক্ষা ততো তীব্র হয়েছে। তাঁর সৌন্দর্য স্বচ্ছ পানিতে মুক্তার মতো। যখন তার চাঁদমুখের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়, তখন আসল চাঁদকে মাকড়সার জালের মতোই বিবর্ণ মনে হয়।
“জলন্ত আগুন আমাদের হৃদয়কেও জ্বালিয়ে গেছে
আমরা ডুবে গেছি, আর আমার হৃদয় যন্ত্রণায় বিদগ্ধ
ভোরের সাথে বাতির সলতের শেষ বিন্দু তেল
নিঃশেষিত হয় এবং নিভে যায়।”
আমি দুনিয়াদারী; আমার আম্মা, বিবি ও বাচ্চার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়লাম। আত্মীয়-স্বজনরা আমার প্রতি বিমুখ হলেন। প্রেমের জন্যে যন্ত্রণা পাওয়ার চাইতে সুখ আর কী আছে? চোখ বন্ধ করে মরে যাওয়ার মধ্যে বৈচিত্র্য নেই। আমার সুখ ও দুঃখগুলো আমাকে একাই ভোগ করতে হতো। কারণ এমন কেউ ছিল না, যাকে বিশ্বাস করতে পারি।

একমাস পর নওয়াব রঈস দিল্লী থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন। ততোদিনে আমার ধারণা হয়েছে যে, বেগম সম্পর্কে তিনি কোনো সন্দেহই পোষণ করবেন না এবং বেগম সাহেবা তাঁকে পুনরায় অন্য কাজে পাঠাতে সক্ষম হবেন। কিভাবে নওয়াবকে সাদর অভ্যর্থনা জানানো হবে, তা দেখাতে আমাকে নেয়া হলো এবং তাঁর সাক্ষাতে আমাকে কী সম্বোধন করা হবে তা আগেই জানানো হলো। উত্তম বস্ত্রে তিনি নিজেকে সজ্জিত করেছিলেন। কাজল দিয়ে চোখকে কালো এবং মিশি দিয়ে ঠোঁট রঞ্জিত করে তাঁকে একাকী ফেলে যাওয়ার কারণে তাঁর মধ্যে যে ব্যাকুলতা সৃষ্টি হয়েছে নওয়াবের সামনে তিনি যথার্থই তা ব্যক্ত করলেন। মধ্যাহ্ন ভোজের সময় তিনি ঘোষণা করলেন যে, দীর্ঘ পথ শ্রমের পর নওয়াব সাহেবের বিশ্রাম প্রয়োজন। তিনি তাঁর বৃদ্ধ স্বামীর অনুগমন করে তাদের একান্ত কামরায় প্রবেশ করলেন। কলম হাতে আমি একাকী রয়ে গেলাম।
আমি মন থেকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। আমাদের সম্পর্ক যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, এরপর কারো পক্ষেই অন্য কারো সংস্পর্শ সহ্য করা সম্ভব নয় বলেই মনে হতো। ঁতার স্বামীর সাথে যে নির্লজ্জ ছল-চাতুরীর মহড়া তিনি দেখালেন, তার মর্ম আমি উপলব্ধি করতে পারলাম না। পড়ন্ত বিকেলে যখন কক্ষের বাইরে এলেন, তাঁর চেহারা দেখে আমি আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। তার কেশ আলুলায়িত, চোখের কাজল গালে মাখামাখি হয়ে আছে। আমাকে গোমড়া মুখে দেখে তিনি উৎকণ্ঠিতভাবে আমার সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ নিলেন। তার স্বামীর সামনে আমাকে বলেছিলেন যে, আমাকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে আগ্রায় থাকতে হবে বলে তিনি আমার বিবির কাছে খবর পাঠিয়েছেন। তিনি বললেন, “আমার স্বামী তোমাকে বলবেন যে, নওয়াব শামসামুদ্দৌলা ও তাঁর মধ্যে কী আলাপ হয়েছে।” নওয়াব রঈস যোগ করলেন, “হ্যাঁ, আমাকে যথাশীঘ্র দিল্লী ফিরে যেতে হবে। কারণ পারস্য বাহিনীর ভারত অভিযানের গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। গুজব যদি সত্য হয়, তাহলে আমাদের কোমরে আবার তলোয়ার ঝুলাতে হবে। আর যদি সত্য না হয়, তাহলে আমি মাস খানেকের মধ্যেই ফিরে আসবো। এ সময়টায় তুমি এখানেই থাকবে এবং জেনানাদের দেখাশোনা করবে।” তাঁর বেগম ওকালতি করলেন, “তোমার অনুগ্রহ, আমি তোমার মাথার চুল স্পর্শ করে ওয়াদা করছি, আমাদের সানুনয় নিবেদনে সম্মত না হলে আমরা তোমার সাথে আর কখনো কথা বলবো না।”
যদিও আমি মনে মনে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, তবু আমার নিজের পছন্দ অপছন্দের বালাই ছিল না। অতএব আমি তাদের কথায় রাজি হলাম। সেই সন্ধ্যায় আগ্রার বহু সম্ভ্রান্ত নাগরিক নওয়াব রঈসের সাথে সাক্ষাৎ করতে এলো এবং তার কুশলাদি ও দিল্লীর খবর জিজ্ঞাসা করলো। উত্তর দিতে তিনি খুব সতর্কতা অবলম্বন করলেন এবং দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললেন। “দিল্লীর লোকজন কী বললো সে বিষয় নিয়ে অহেতুক উদ্বিগ্ন হবেন না। আজ শুকনো রুটি ও ডালের দাওয়াত গ্রহণ করুন, আর তকী সাহেবের কবিতা শুনে যান। তকী মীরের ‘কালাম’ যদি না শুনে থাকেন, তাহলে আপনারা কিছুই শোনেননি।”
প্রচুর খানাপিনার পর শুরু হলো মুশায়রা। কোন মন্তব্য না করে দীর্ঘক্ষণ অত্যন্ত নিম্নমানের কবিতা শুনলাম। একজন ভৃত্য আমার হাতে এক টুকরা কাগজ এনে দিলো। বুঝতে পারলাম বেগম সাহেবার লেখা, “তোমার কালাম যেন বাজে না হয়।” আমার সামনে মোমবাতি স্থাপন করা হলো। মনে হলো পর্দার পেছন থেকে তাঁর দৃষ্টি আমার ওপর নিবদ্ধ হয়ে আছে। আমার কালাম শুনতে তিনি কান খাড়া করে আছেন :
“রাতের আঁধারে মীর তকী
বিধ্বস্ত হৃদয় এক মানব
তার মুখে যা উচ্চারিত হয়
তা যেন আর্তনাদ
কিন্তু যখন সে প্রেমের পথে
যাত্রা শুরু করেছিল
তখন সে ছিল
আগুনের মতো জীবন্ত
এখন সবকিছু নিঃশেষিত এবং
মীর চিতার তল দেশের
ভস্মের মতো।”
আমার কালামের জন্যে পুনঃ পুনঃ অনুরোধের কারণে শেষ রাত পর্যন্ত মুশায়রা চললো। যতক্ষণ মুশায়রা চলছিল, ততক্ষণ ধরে আমার উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছিল প্রশংসার মদিরা। এরপর সবাই চলে গেলে আমি ছাদে একটা খাটিয়ার উপর একাকী শুয়ে পড়েছিলাম। অসংখ্য তারকা আমার দুঃখকে অবলোকন করছিল। আমার ভিতরে ক্রোধের বাষ্প জমে আছে। যে ছাদে শুয়েছিলাম তার নিচেই সেই রমণী তার দুই উরুর মাঝে অন্য এক পুরুষকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। সে তো আমাকেও তাঁর শয্যাসঙ্গী করেছিল। স্বামীর সাথে তাঁর সম্পর্কের কোনরূপ পরিবর্তন না করলেও সে আমাকে বিবির কাছে আগন্তুকে পরিণত করেছে। আমার নিজেকে পরিত্যক্ত ও প্রতারিত মনে হলো। নিজের সাথে আমার আচরণ যথার্থ মনে হচ্ছিল না এবং বহুদিন পর্যন্ত বেগম সাহেবা আমাকে ডেকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেও অন্যদিকে চেয়ে উত্তর দিতাম।
নওয়াব রঈস রাজধানীতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, আমি তাঁর সঙ্গে দিল্লী দরওয়াজা পর্যন্ত গেলাম। তাঁকে বিদায় দিয়ে হাভেলিতে ফেরার পরিবর্তে আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে চললাম।
অপরাহ্নে আমি বিবিকে শয্যায় টেনে নিয়ে বর্বরের মতো তাঁকে উপভোগ করলাম। প্রথমবারের পর এভাবে আমি আর কখনো ওর ওপর উপগত হইনি। নিরীহ রমণী কৃতজ্ঞচিত্তে আমার দলনকে সহ্য করলো। কারণ আমি প্রমাণ করতে পেরেছি যে, তাকে আমি ভালোবাসি। (সেই বিকেলেই সে আমার দ্বিতীয় সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে) সন্ধ্যায় বেগম সাহেবার দাসী খাদ্য ও ফলমূল ভর্তি ঝুড়ি নিয়ে হাজির হলো। নাসিমা নামের দাসীটি বেগম সাহেবার প্রেরিত পত্র আমার হাতে দিলো। আমার কবিতা দিয়েই চিঠির শুরু-‘দীর্ঘদিন ধরে কোন চিঠি বা বার্তা পাঠানো হয়নি; বিশ্বস্ততার রীতি শেষ হয়ে গেছে।’ চিঠিতে বলা হয়েছে, আমাকে ছাড়া তাঁর বিশ্ব নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে। আমি যদি সকালের মধ্যে ফিরে না যাই, তাহলে তিনি বিষপান করবেন এবং তাঁর মৃত্যুর জন্যে আমিই দায়ী হবো। আমার ক্রোধ সহসাই নির্বাপিত হলো। মনস্তাপে হৃদয় পরিপূর্ণ হলো। দাসীকে বলে পাঠালাম যে, আমি সকালেই তাঁর খেদমতে হাজির হবো।
ক্ষমা প্রার্থনার আপীল করতে আদালতে হাজিরা দেয়ার অপরাধীর মতো আমি হ্যাভেলিতে গেলাম। আমার দিকে দৃষ্টি না দিয়েই বেগম সাহেবা নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, ‘মীর সাহেব আমাদের সাথে ভিক্ষুকের মতো ব্যবহার করেন। যখন তিনি খুশি থাকেন, তখন আমাদের ভিক্ষাপাত্রে তাঁর অনুগ্রহের কিছুটা ছুড়ে দেন।” আমি নিরুত্তর ছিলাম। তাঁর পুত্রদের পড়াতে আমি কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম। তিনি কোন বাক্য ব্যয় না করে দুঃখ ভারাক্রান্ত দৃষ্টিতে আমার পানে তাকিয়ে ছিলেন। বিকেলে নাশতা সেরে আমি আমার কক্ষে চলে গেলাম। বালিশের উপর রক্ষিত এক টুকরো কাগজ চোখে পড়লো। তাতেও বেগম সাহেবার কাছে আবৃতি করা আমার কবিতার ক’টি লাইনÑ
“জীবন হচ্ছে রেখা টানার মতো
অবয়ব এক ধরনের বিশ্বাস
কালের অনুগ্রহকে আমরা বলি বয়স
এ হচ্ছে প্রতীক্ষার আরেক রূপ।”
সারাটা বিকেল আমি তাঁর প্রতীক্ষা করলাম। বেগম সাহেবা এলেন না। সন্ধ্যায় আঙ্গিনায় তাকে একা পেয়ে শুকনো কণ্ঠে জানতে চাইলাম যে, আমার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার এজাজত আছে কিনা? তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমার জানাযায় আসতে দ্বিধা করো না।’ কথাটা বলেই দোপাট্টা দিয়ে মুখ ঢেকে তিনি দৌড়ে ভিতরের দিকে চলে গেলেন।
কোন উত্তেজনাপূর্ণ নাটকে আমি প্রতিপক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হইনি। আমার ইচ্ছা ছিল, নওয়াব রঈস আমাকে তাঁর সাথে দিল্লী নিয়ে যাবেন এবং আমি এই নারীর ছোবলমুক্ত হতে পারবো। কারণ তিনি আমাকে এমন করে তুলেছেন, যেন আমি মধুর হাড়ির চারদিকে ঘুর ঘুর করা মাছি। অন্য মাছিরা এখনো আসেনি। রাতের খাবার শেষে ভৃত্যরা ধোয়ামোছার কাজ করছিল, তখনই বেগম সাহেবা আমার কক্ষে প্রবেশ করলেন। ভিতর থেকে দরজার খিল লাগিয়ে আমার কাছে এলেন। আমি তাঁকে বাধা দেবার আগেই তিনি আমার পায়ে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। আগ্রার শ্রেষ্ঠ ধনী নওয়াবের বেগম একজন দরিদ্র শিক্ষক ও কবির পায়ে পড়ে কাঁদছিলেন!
চোখে তাঁর অশ্রুর বন্যা। জড়িত কন্ঠে তিনি বললেন, ‘তুমি আমার ওপর রাগ করেছ, যেভাবে খুশী আমাকে শাস্তি দাও্ আমাকে আঘাতে জর্জরিত করো, যা খুশী করো, কিন্তু আমার ওপর রাগ করো না।’ আমি জোর করে তাঁকে খাটিয়ার ওপর তুলে এনে হাত দিয়ে অশ্রু মোচন করলাম। তিনি আমার মাথা তাঁর বুকের ওপর চেপে ধরলেন। তাঁর চোখ ও ঠোঁটে চুমু দিলাম। তিনি অনুনয়ের সুরে বললেন, ‘চলো এখান থেকে অন্য কোথাও গিয়ে আমরা বিয়ে করি। আমি আমার স্বামীকে ঘৃণা করি। আমি চাই না যে, সে আর আমাকে স্পর্শ করুক।’ আমি বললাম, ‘আপনার সন্তানদের কী হবে? আর বদনাম?’ গভীর দৃষ্টিতে তিনি আমার চোখে চোখ রাখলেন, ‘তোমার সাথে থাকতে এবং তোমার খেদমত করতে আমি সবাইকে, সবকিছুকে পরিত্যাগ করবো। আমার সাথে শুধু ওয়াদা করো যে, আমাকে বিয়ে করবে। আমি ওয়াদা করলাম। আমি তখন চরমে, প্রত্যাহার করতে সচেষ্ট, তাঁর দুই পায়ের বাঁধনে বেগম সাহেবা আমাকে আঁকড়ে ধরে ফ্যাস ফ্যাসে গলায় চীৎকার করে বললেন, ‘যা খুশি ঘটুক, আজ রাতে আমি তোমার।’
প্রথম দফা শেষ হলে আমি শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলাম যে, তিনি কী তাঁর স্বামীর প্রতি অনুরক্ত। রাগত সুরে তিনি বললেন, ‘তুমি আমাকে কী ধরনের রমণী হিসেবে গ্রহণ করেছো। আমি যখন তোমার সাথে ভালোবাসায় লিপ্ত, তখন কী করে আমার দেহ অন্যকে দিতে পারি? জানি, এমন হলে আমাকে দেখে তোমার খারাপ লাগবে। অনেক সময় পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে চলতে হয়, তাই নয় কি? আমার ব্যাপারে তুমি কী তোমার বিবির কাছে অবিশ্বাসী?’ প্রশ্নটা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিলাম, ‘আপনার কী মনে হয়, তা সম্ভব?’
আমরা আবার প্রেমের খেলায় ফিরে গেলাম। কামশাস্ত্রে এ যাবত যা লিখা হয়েছে এবং যেসব প্রক্রিয়া কোথাও লিখা নেই, সবই আমরা একে অপরের ওপর প্রয়োগ করতাম।
আমাদের নিজস্ব কিছু পরিভাষা ছিল। তিনি ছিলেন আমার কাছে ‘কামার’ বা চাঁদ, আমি তাঁর ‘জান’ অর্থাৎ জীবন। এমনকি আমরা আমাদের যৌন অঙ্গের নিজস্ব নামকরণ করেছিলাম। আমারটা ‘রাজা বাবু’, তাঁরটা ‘বহুরাণী’। মাসের অপরিচ্ছন্ন অবস্থাকে তিনি বলতেন ‘আলাপচারিতা ও পরিদর্শনের সময়’। বার্ধক্য তিনি পছন্দ করতেন না। আমরা একটা ব্যাপারে স্থির করেছিলাম যে, প্রতিটি সংযোগ পরিপূর্ণভাবে সফল হতে হবে। আমি যদি বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ি, তাহলে তিনি ধৈর্যের সাথে আমার কামনা পূরণ করতেন। তাঁর স্বাভাবিক পথটা ক্লান্ত হয়ে পড়লে বেগম সাহেবা আমার উপভোগের জন্যে উদারভাবে অন্যান্য উপায়ের সন্ধান দিতেন। কিন্তু এরপরও কী কোন পুরুষ কোন নারীকে ভালো করে জানতে পেরেছে? অথবা কোন নারী পুরুষকে? আমি কয়েকটা লাইন লিখে ফেললামÑ
“আবেগ আমাদেরকে নশ্বর করেছে
মানুষ যদি আবেগের দাস না হতো
তাহলে তো ঈশ্বরই হতো।”
এভাবেই দিন ও রাতগুলো অতিবাহিত হচ্ছিল। যখন আমরা একত্রিত হতাম, পরস্পর অতীতের কথা বলে কাটাতাম। নিজের সম্পর্কে বলার মতো আমার তেমন কিছুই ছিল না। বেগম সাহেবা আমার কাছে বলার কিছুই বাকি রাখেননি। অপদার্থ ‘পতঙ্গের’ সঙ্গে তিনি জড়িত হয়েছিলেন। সে গান গেয়েছিল শুধু একথা প্রমাণ করতে যে, সে একজন প্রেমিক। বিজয়ের পথে এগিয়ে গিয়ে বেগম সাহেবার সাথে প্রতারণা করেছিল। আমাদের দু’জনের মধ্যে এমন কিছু ছিল না, যা আমরা জানি না। নারীর সাথে সম্পর্কের পর একজন পুরুষের পক্ষে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব। কিন্তু নারীর জীবন এলোমেলো হয়ে গেলে সে চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায়। বেগম সাহেবার মতো নারী নিজেকে আমার কাছে পেশ করে এ কথা প্রমাণ করতে সচেষ্ট যে, তাঁর জীবনে আমিই একমাত্র পুরুষ। আমি নারীর কতটুকু জানতে পেরেছি?
লোকজন যে কানাঘুষা শুরু করেছে তা খুব বেশিদিন হয়নি। স্বামীর কানে তাঁর বদনাম করা হচ্ছে কিনা, এই বিষয়টি ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে বেগম সাহেবার কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হলো না। তাঁর ভৃত্যরা জানতো যে, বেগম সম্পর্কে কথার সামান্য এদিক সেদিক হলে তা তাদের পরিবারের ধ্বংস ডেকে আনবে। নওয়াব রঈসকে বলার জন্যে তারা একটা কথাই স্থির করে রেখেছিল যে, তাঁর বিদায়ের পর বেগম সাহেবা খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন এবং তাঁর ঘরে ফিরে আসার জন্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে প্রার্থনা করতেন। বৃদ্ধ স্বামী অত্যন্ত উৎকণ্ঠা অনুভব করতেন। এমনই হচ্ছে মানুষের অসারতা। যা হোক, হাভেলি আর আগ্রা শহর এক নয়।
যখন আমি বাজারে যেতাম, যারা আমাকে চিনতো, তারা দুইভাবে আমাকে গ্রহণ করতো। “মীর ভাই, আপনার কলমের কী ক্ষমতা। এ কলম হৃদয়কে ছিন্ন করে, পাজামাকেও বটে।” অথবা পিঠে চাপড় দিয়ে বলতো, ‘মীর তকী, ভাগ্য তোমার ওপর কত প্রসন্ন।’ একদিন সন্ধ্যায় আমি পরিবারবর্গের কাছে গিয়েছি। আম্মা একপাশে নিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘বেটা তকী, নানা মুখে তোমার সম্পর্কে বহু গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের মুখে কেউ তালা লাগাতে পারে না। আগ্রার সবাই বেগম সাহেবা ও তোমার সম্পর্কে বলে বেড়াচ্ছে। আমি এর একটাও বিশ্বাস করি না। কিন্তু এই কথাগুলো যদি তাঁর স্বামীর কানে যায়, অনুমান করতে পারো, তিনি তোমাকে কী করতে পারেন? তার রাগ ভয়ানক। আমাদের সবাইকে হত্যা করতে তিনি মোটেও দ্বিধা করবেন না। হাভেলিতে যাওয়া বন্ধ করার জন্যে আমি তোমাকে অনুরোধ করছি। কিছু একটা অজুহাত দেখাও। বলে দাও, তোমার মা মরণাপন্ন। যা খুশি একটা কিছু বলে দাও।’
আম্মা আমাকে যা বলেছিলেন, আমি বেগম সাহেবাকে বললাম। তিনি আবার চিন্তিত হয়ে পড়লেন, ‘মানুষের মন এতো নোংরা!’ এরপর তাঁর আবেগে তেমন উচ্ছ্বাস দেখা গেলো না। তিনি বলতে লাগলেন, মোগল দরবারের আমার স্বীকৃতি লাভ কত গুরুত্বপূর্ণ। একমাস পর তিনি তাঁর স্বামীর একটা চিঠি পড়ে শুনালেন। তাতে বলা হয়েছে যে, তিনি আমাকে রাজ দরবারে প্রেরণের ব্যবস্থা চূড়ান্ত করেছেন এবং সেই পদ গ্রহণের জন্যে আমার দিল্লী যাওয়া প্রয়োজন। বেগম সাহেবা বললেন, ‘আমার জীবন নিঃসঙ্গতায় ভরে যাবে। কিন্তু যখন আমি দেখবো যে, হিন্দুস্থানে তোমার তারকা উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে, তখন বলতে পারবো, এই লোকটি আমার প্রেমিক ছিল, আমি তাঁর প্রেমিকা।’
আমার বিদায়ের দিনে তিনি সবুজ রেশমী রুমালে জড়ানো কিছু সোনার আশরফী এনে আমার কাদের কাছে ঠোঁট রেখে বললেন, ‘ফালাহু খাইরুম হাফিজা ওয়াহুয়া আরহামুর রাহিমিন।’ আল্লাহ সর্বোত্তম রক্ষাকর্তা, তিনি দয়ালু ও ক্ষমাশীল।’ আমার হাত জড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, ‘যেখানেই যাও, আল্লাহ তোমার সঙ্গে আছেন। কোনো ক্ষতি থেকে তিনি তোমাকে রক্ষা করুন।’ অবশ্য ‘আল্লাহ তোমাকে আবার ফিরিয়ে আনুক’- তাঁর দোয়ায় এ কথা ছিল না।
বিদায় নেবার আগে আমি কয়েকটা লাইন রচনা করে আমার স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে তাঁর কাছে দিয়ে গেলাম-
“তুমি এসেছিলে আপন অস্তিত্ব নিয়ে
যা তোমার মধ্যেই হারিয়ে গেছে
জানি না তুমি কি এবং কাকে
সন্ধান করছো?
আমি যদি কাউকে চাই, সে তুমি
কাউকে যদি দেখতে চাই, সে তুমি
তুমি আমার হৃদয়ের আকাক্সক্ষা
আর দৃষ্টির প্রার্থনা!”
আমার আগ্রা পরিত্যাগে বেগম সাহেবা দুঃখ অনুভব করবেন, না স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। এমন কী তাঁর ব্যাপারে আমার নিজস্ব অনুভূতিও ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। প্রথমতঃ আমার মনে হলো, আমি পিঞ্জরমুক্ত এক বিহঙ্গ। মুক্তির আনন্দে আমি গান গাইতে যাচ্ছিলাম। এক সময় সোনার পিঞ্জরটা হারানোর অনুতাপও হলো। দু’বছরের অধিক সময় ধরে বেগম সাহেবা এই পিঞ্জরে আমাকে আটকে রেখে শুনিয়েছেন প্রেম সঙ্গীত। মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন এবং আমার পরিচর্যা করেছেন। জানি না, আমি তাঁর প্রেমে পড়েছি কি না। হয়তো তাঁর প্রেমই আমাকে আমার মূল্য সম্পর্কে সচেতন করেছে, আর আমি নিজেই আমার প্রেমে পড়েছি। মথুরায় আমাদের তৃতীয় যাত্রা বিরতির সময় আমার ব্দ্ধৃা মা, ছোট ভাই, যার ওপর আমার স্ত্রী ও দুই বছর বয়স্ক পুত্র কাল্লুর দায়িত্ব অর্পণ করেছি, তাদের সবার চাইতে আমার কামরুন্নিসার কথাই বারবার উদিত হচ্ছিল মনে।
সময়টা গোলযোগপূর্ণ। জাঠ, গুজ্জার, মারাঠা এবং রোহিলারা দলবদ্ধভাবে দেশের সর্বত্র অসহায় যাত্রীদের ওপর চড়াও হয়ে সর্বস্ব লুণ্ঠন করছিল। এমনকি আগ্রা হতে দিল্লী পর্যন্ত দীর্ঘ রাজপথও হামলার আশঙ্কামুক্ত ছিল না। নিজেই প্রশ্ন করলাম, “ওহে মীর, যাত্রালগ্নেই কণ্টকের অভিযোগ কেন, দিল্লী এখনো বহুদূর।” আমি সশস্ত্র অশ্বারোহী ও পদাতিক বেষ্টিত শকটের আরোহী। সামনে পিছনে প্রহরা। আমাদের ভ্রমণ শুধু দিবাভাগে। রাতে সুরক্ষিত সরাইখানায় বিশ্রাম। গিয়াসপুরে পৌঁছে আমি সহযাত্রীদের ছেড়ে হযরত নিজামুদ্দিন আওলিয়া এবং যাঁর কবিতা আমার অনুপ্রেরণার উৎস, সেই খাজা আমীর খসরুর মাজারে গেলাম আমার ভক্তি নিবেদন করতে। সম্রাট হুমায়ুনের স্মৃতিসৌধের কাছে আরব সরাই-এ দু’দিন দু’রাত অতিবাহিত করলাম। শ্বেত পাথরের স্তম্ভ থেকে আমি মহান মোগলদের পত্তন করা নগরীর দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করলাম। অনাগত দিনগুলোতে আমাকে এই নগরীতেই কাটাতে হবে।
নগরীতে প্রবেশ করলাম দিল্লী দরওয়াজা দিয়ে। আমাকে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার জন্য নওয়াব রঈস প্রহরারত হাবিলদারকে পূর্বাহ্নেই নির্দেশ দিয়েছিলেন। নওয়াব রঈস যে প্রাসাদে অবস্থান করছিলেন, সেখানে পৌঁছে দেয়ার জন্য হাবিলদার আমার সাথে একজন প্রহরী দিলো। নওয়াব আমার ব্যাপারে অত্যন্ত দয়ালু। কিন্তু আমি তাঁর নিমক খেয়ে তাঁর বেগমের প্রেমিক হয়ে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছি। তাঁর অনুপস্থিতিতে বেগম সাহেবা ও সাহেবজাদারা কেমন পীড়া অনুভব করেন, তা তাঁকে বলেছি বেশ গুছিয়ে।
নওয়াব রঈসের আনুকূল্যে ফতেপুরী মসজিদের কাছে এক বাজারে দুটি কক্ষ ভাড়া করতে সক্ষম হলাম। জায়গাটি নোংরা এবং সুবিধাজনক নয়। আমার কাছে যে অর্থ আছে সে তুলনায় এটাই আমার জন্য উত্তম। আমি বলতাম. ‘অহঙ্কারীদের কবর।’ দিনপঞ্জীতে একটা বর্ণনাও লিখে ফেললাম। ‘গৃহের প্রাচীর ছিদ্র ও ফাটলে পরিপূর্ণ। ধুলো ঝরছে সব জায়গা থেকে। এক কোণায় ছুঁচো। আরেক গর্ত হতে বের হচ্ছে ইঁদুর। চামচিকা আমার নিত্যসঙ্গী। মশকের গুণগুণ শব্দ সারাক্ষণ। মাকড়সার জাল ঝুলছে দেয়ালে। রাতে বিচিত্র সব আওয়াজ। ঘরের প্রান্তদেশ কাঁত হয়ে আছে। দরজা জানালা যেন খুলে খুলে যাচ্ছে। দেয়ালের প্রস্তরখন্ড বেরিয়ে পড়েছে। ছাদের কড়ি-বরগা মরচে ধরে জীর্ণ হয়ে গেছে। এই হলো মীর তকীর নিকুঞ্জ। এখানে সে কাটিয়েছে প্রহরের পর প্রহর।’
কয়েক দিবস পর নওয়াব রঈস আমাকে নওয়াব শামসামুদ্দৌলার ভ্রাতুষ্পুত্র মোহাম্মদ ওয়াসিতের কাছে নিয়ে গেলেন। মোগল সিংহাসনের পশ্চাতে তার অপরিসীম ক্ষমতা। মুশায়রায় আমার কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে পারলে তিনি আমাকে সহযোগিতা করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিলেন। সেই মুশায়রায় তাঁর পিতৃব্য সম্মানিত অতিথি হিসেবে হাজির থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছিল। ফৈয়াজ বাজার, যাকে দরিয়াগঞ্জও বলা হয়, সেখানে এক বিশাল প্রাসাদের ছাদে মুশায়রা আয়োজিত হলো। পূর্ণিমা রাত। মনে বারবার উদয় হচ্ছিল আমার কামরুন্নিসার কথা। গোলাপ ও জেসমিন পত্র খচিত তুষারশুভ্র চাদরে গালিচা আচ্ছাদিত প্রান্তের দিকে রাখা হয়েছে তাকিয়া। সারি বাধা শরবতের সোরাহী। যমুনার দিক হতে মৃদুমন্দ বায়ু প্রবাহমান। তাতে গোলাপ ও জেসমিনের খুশবু। আমন্ত্রিত হয়েছেন শুধু নগরীর ওমরাহরা। এক ডজনের অধিক বিশিষ্ট কবি উপস্থিত। তাদের মধ্যে আমার বিমাতার ভ্রাতা খ্যাতনামা কবি সিরাজুদ্দিন আলী খান আরজুও উপবিষ্ট। শ্রোতৃমন্ডলীর অধিকাংশই আমার নাম শ্রবণ করেছেন। কিন্তু আমাকে দর্শন করেননি এবং কবিতাও শোনেননি। আমি খুব অসহায় বোধ করছিলাম এবং তালু শুষ্ক রাখার জন্য বারবার জামার হাতে ঘষছিলাম। এ ধরনের সমাবেশে কোন কবিতাটি আবৃতি করবো ভেবে ঠিক করতে পারছিলাম না।
দরবারের নওয়াবদের আগমন শুরু হলো। তাদের প্রত্যেকের নাম ঘোষণার সাথে আমরা দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করছিলাম। সবশেষে এলেন নওয়াব শামসামুদ্দৌলা। সকলে শির অবনত করে তাকে কুর্নিশ করলো। তিনি সবার অভিবাদন গ্রহণ করে সবাইকে আসন গ্রহণ করতে ইশারা করলেন। একটু পরে গৃহকর্তা ঘোষণা করলেন যে, মুশায়রা শুরু হবার আগে কবি ও মেহমানরা গোঁফ ভিজিয়ে নিলে নওয়াব শামসামুদ্দৌলা কৃতার্থ হবেন। এ ঘোষণায় সবাই প্রীত হলেন। জীবনে এই প্রথম কোনো মুশায়রায় আমাকে শরবত ছাড়াও শরাব পরিবেশন করা হলো। হাতে হাতে ঘুরছিল পান পাত্র। কিছুক্ষণের মধ্যে সবার মওজ এসে গেল। এর আগেও আমি শরাব পান করেছি। কিন্তু এতো চমৎকার নয়। এ শরাব কান্ধার আঙ্গুরের তৈরি। আমার উদর শরাবের উপয্ক্তু নয়। উপলব্ধি করলাম, দিল্লীতে আমার প্রথম মুশায়রায় আমি আহম্মক প্রতিপন্ন হবো। নগরীতেও সবার হাসির পাত্রে পরিণত হবো। অতএব কবিতা শেষে আমার পানপাত্র পূর্ণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
দিল্লীর কবিদের আবৃত্তি মধ্য দিয়ে মুশায়রা শুরু হলো। তাদের কবিতার বিষয়বস্তু পতঙ্গ, আগুনের শিখা, বুলবুল, গোলাপ, লায়লা ও মজনু। নতুন কোনো ভাব বা ছন্দ নেই। তবু উচ্চকণ্ঠে তাদের প্রশংসা উচ্চারিত হলো। দীর্ঘ মুশায়রার শেষভাগে আমার সামনে বাতি স্থাপন করা হলো। গৃহকর্তা আমার নাম ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন, বয়সে আমি নবীন হলেও আগ্রার ঘরে ঘরে আমার নাম এবং এই প্রথম দিল্লীর মুশায়রার হাজির হয়েছি। তাঁর সৌজন্যের কারণে তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বললাম যে, আমি যে কবিতা আবৃত্তি করতে চাই তা প্রেমের পুরনো একটি কবিতা এবং আগ্রায় এটি উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। মুশায়রার অবস্থা লক্ষ্য করে আমি সেটি আবৃতির অনুমতি প্রার্থনা করলাম। শরাবের ছড়াছড়ি দেখেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। (সত্যি বলতে কী, একরাতে বেগম সাহেবা আমার ওপর শুয়ে তাঁর মুখের শরাব আমার মুখে ঢেলে দিচ্ছিলেন, তখন কবিতাটা রচনা করেছিলাম।) আওয়াজ উঠলো ‘ইরশাদ! ইরশাদ!’ শরাব পানের আচ্ছন্নতার উপর রচিত কবিতা আবৃত্তি শুরু করলাম-
“বন্ধুরা, ক্ষমা করো। তোমরা তো দেখেছো!
আমি মাতাল হয়ে গেছি
তোমাদের পাত্র যদি শূন্য থাকে
তাহলে পূর্ণ করে দাও
কারণ আমি মাতাল।
যদি বাজে কিছু বলে ফেলি, তা শুধু
পান করার কারণে
আমাকে যদি নাম ধরেও ডাকো, আর
আমার সম্পর্কে যাই ভাবো
তা আমার মাতাল হবার কারণেই
হয় আমাকে ধরে রাখো, যেমন করে
তুমি পান পাত্র ধরো
কিংবা আমার কাছে একটু এসে
আমাকে তোমার সঙ্গ দাও
কারণ আমি মাতাল।
আমার কিইবা করার আছে
যদি হাঁটতে চেষ্টা করি
তাহলে হোঁচট খাই
আমার সাথে তর্ক করো না, দয়া করো
অসন্তুষ্ট হয়ো না
কারণ আমি মাতাল।
শুক্রবারের জুম’য়ার নামাজ কখনো
দৌড়ে পালাবে না
তুমি যদি একটু থাকো
আমি তোমার সাথে আসবো
কারণ আমি মাতাল।
মীর তকীর মর্জি হলে সে নরকের মতো
স্পর্শকাতর হতে পারে
সেতো ভঙ্গুর কাঁচের মতো
তাঁর সাথে স্বাধীনতা খুঁজো না
কারণ সে মাতাল।
মুশায়রা অভিভূত হয়ে পড়েছিল। ওমরাহদের প্রত্যেকে আমাকে আলিঙ্গন করছিল। হাতে গুঁজে দিচ্ছিল মুদ্রা। আমাকে নওয়াব শামসামুদ্দৌলার কাছে নেয়া হলো। তিনি আমাকে তার হস্ত চুম্বন করতে দিয়ে উদারভাবে আমার সাথে কথা বললেন। ‘বেটা, আমি তোমার আব্বার মুরিদদের একজন। তোমাকে দিল্লীতে দেখে অনুমান করেছি, তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমি তাঁর কাছে অনেক ঋণী। তোমার কাছেই সে ঋণ পরিশোধ করতে চাই। সকালে আমার বাসভবনে এসো। আমরা দেখবো, তোমার জন্য কি করতে পারি।’
আমি পুনরায় তাঁর হস্তচুম্বন করে উপবেশন করলাম। পানপাত্র বারবার পূর্ণ করে আমি পানির মতো শরাব পান করলাম। আমার মাথায় নানা প্রশ্ন। অন্য কবিরা কী বলেছিল, আমি তা শুনিনি। রাতের খাবার পরিবেশনের পূর্বেই আমি মুশায়রা থেকে বেরিয়ে এলাম। দুনিয়া মাতালকে মার্জনা করে দেয়। আলোকোজ্জ্বল নগরীতে আমি হাঁটছি। কান্ধারী শরাবের প্রভাবে সবকিছুই সুন্দর লাগছিল। রাজপথ আচ্ছাদিত। গভীর নীলাকাশে তারার ঝিকিমিকি। আমার পদদ্বয় একটু টললেও ফৈয়াজ বাজার হতে জামে মসজিদ, গণিকালয়ের রাস্তা, চৌরী বাজার হয়ে হিজড়া পল্লী হুয়াজ কাজী পর্যন্ত পৌঁছতে কোন বিঘ্ন ঘটলো না। আমি ভাবছিলাম, আমার সাথে যদি শুধু কামরুন্নিসা থাকতো তাহলে দু’জন কতটা সুখী হতাম এবং অন্য কবিদের ওপর আমার বিষয়কে কিভাবে উপভোগ করতাম। একটি পান দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। পান ক্রেতাদের ভিড় ঠেলে আদেশ দিলাম, তোমার সেরা পান আমাকে দাও। পানওয়ালা আমাকে এক নজর দেখে বললো, ‘মীর সাহেব, আপনাকে এমন পান দেব, যা আগে কখনো খাননি। তাহলে হয়তো, আপনি আমার পানের উপর কাসিদা লিখে তাতে আমার নামটাও জুড়ে দেবেন।’ সে আমাকে চিনতে পেরেছে দেখে প্রীত হলাম। প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি আমাকে চিনলে কী করে?’ সে হেসে বললো, দিল্লীতে এমন কে আছে যে মীরের কালাম শোনেনি। সবার মুখে মুখে আপনার নাম।’
পানওয়ালা তার তাম্রপাত্র হতে এক গুচ্ছ পানপাতা বের করে সুন্দর পানটা বাছাই-এর পর তাতে চুন ও খয়ের মাখালো। এরপর সুগন্ধি ও জর্দা রাখলো। অতঃপর মুক্তাভস্ম, সুবর্ণভস্ম ছড়িয়ে দিলো পানের ওপর। পানটা নিপুণতার সাথে ভাঁজ করলো। সবশেষে সোনালী তবকে পানটা মুড়িয়ে আমার হাতে দিলো-‘দিল্লীতে আমরা এ পানকে বলি ‘পালং তোর,’ শয্যাবিলাসী। আপনি খেয়ে পরীক্ষা করুন। আমার কথা যদি সত্য না হয়, তাহলে আমার নাম শাহজাহানাবাদের বিখ্যাত পানওয়ালা হরিরাম চৌবাসিয়া নয়।’
অন্য লোকদের উপস্থিতিতে আমার সাথে এ ধরনের বাক্য-বিনিময় প্রীতিকর মনে হচ্ছিল না। তাঁকে একটা রজত মুদ্রা দিয়ে লাল কুয়ানের দিকে অগ্রসর হলাম। পানটা মুখে পুড়েছি। পানের মধ্যে কড়া সব উপাদান। আমার সারাদেহে ঘাম ছুটলো। হঠাৎ নজরে পড়লো পান দোকানে দেখা এক ব্যক্তি আমাকে অনুসরণ করছে। ঘুরে প্রশ্ন করলাম, ‘আমার সাথে কী আপনার প্রয়োজন আছে?’
অত্যন্ত বিনয় প্রকাশ করে লোকটি বললো, ‘মীর সাহেব এমন সুন্দর রজনী তো প্রেমের জন্যে। জনশূন্য রাজপথে পদচারণা করার জন্যে নয়। আমি দিল্লীর সেরা সুন্দরীর কাছে আপনাকে নিয়ে যেতে পারি। রাজরক্তের অধিকারী রাজকুমারীর চাইতে কোন অংশেই কম নয় সে। আর ওর বয়স বড়জোর ষোল বছর। সে যদি আপনার জীবনের কিমত না দিতে পারে তো আমার নাম চপ্পন মিয়া নয়।’
জানিনা না শরাব, পান অথবা চন্দ্রমুখী কামরুন্নিসা, কোনটির প্রভাব আমাকে সকল সতর্কতা সত্ত্বেও সেই গণিকার দালালের পিছু পিছু লাল কুয়ানের অন্ধকার সংকীর্ণ গলিপথে নিয়ে গেল। আলো আঁধারির মধ্যে সে এক দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিল। কর্কশ নারীকণ্ঠে ভিতর থেকে জানতে চাইল, ‘এতো রাতে দরজায় কে?’ চপ্পন জানালো, ‘দরোজা খোল, সঙ্গে খদ্দের আছে।’
এক বৃদ্ধা দরজা উন্মুক্ত করে আমাদেরকে ভিতরে প্রবেশ করতে দিল। বৃদ্ধা আমাকে সালাম জানিয়ে বললো, ‘বড় বিলম্বে এসেছেন। একটু অপেক্ষা করুন। আমার কন্যাকে জাগ্রত করে আপনাকে স্বাগত জানাতে পাঠাচ্ছি। হুজুর কী পান কিনে আনার জন্যে কিছু দিতে পারেন?’ সান্ধ্য মুশরায় আমাকে যে আশরফী দেয়া হয়েছিল তা থেকে একটা বৃদ্ধার হাতে তুলে দিলাম সে আমার উদারতায় অবাক হয়ে থাকবে। কিন্তু অভিজ্ঞ রমণী আঙ্গুলের ফাঁকে মুদ্রাটি আমার দিকে বাড়িয়ে বললো, ‘আপনার মতো শরীফ লোকের কাছে আমার আরো বড় আশা ছিল।’ আমি তাঁকে আরেকটি আশরফী দিলাম। সে দালালকে বিদায় করে আমাকে অন্দরে নিয়ে গেল।
আলো জ্বললো। বৃদ্ধা শুকনো ফলপূর্ণ একটি ঝুড়ি আমার সামনে আনলে আমি হাতের ইশারায় তাকে নিবৃত্ত করলাম। কয়েক মুহূর্ত পর তার কন্যা চোখ কচলাতে কচলাতে কক্ষে প্রবেশ করলো। তার বয়স কম এবং সুন্দরী। আমার কামরু্িননসাও এই বয়সে সম্ভবত দেখতে এমনই ছিল। সুদর্শনা, গোলগাল মুখ। কিন্তু একটু লাজুক।’ ‘একটু রয়ে সয়ে তার সাথে আচরণ করো, এখনো সে বালিকা-’বলেই বৃদ্ধা রমণী কক্ষ ত্যাগ করলো।
আমি বালিকাকে একটি সুবর্ণ আশরফী দিয়ে বললাম, এটি তোমার। তোমার মা বা দালালকে বলো না। সে মুদ্রাটি গ্রহণ করে ও মাথা আমার কোলে রেখে কাঁদতে আরম্ভ করলো। আমি প্রথম ওর চুলে, এরপর পিঠে হাত বুলিয়ে যাচ্ছি। আমি তার ঘাগড়ার ভিতর দিয়ে হাত গলিয়ে তার সুগোল পুষ্ট নিতম্বে চাপ দিলাম। আমার উত্তেজনা জাগছে। সে আমার পাজামার গিট খুললো। তাকে বিছানায় ফেলে তার ভিতরে প্রবিষ্ট হলাম। আমি কী কামরুন্নিসার কাছে বিশ্বাসভগ্ন করলাম? না, মোটেই না। এই ছোট্ট বালিকার মধ্যে আমি তো তাকেই উপভোগ করছি। আমরা উভয়ে দীর্ঘক্ষণ শায়িত ছিলাম। শরাব এবং পানের উপাদান আমাকে সুদীর্ঘ সময় উত্তেজিত রাখার জন্যে যথেষ্ট ছিল।
সে বার বার চরমে উঠলো এবং যখন তার দেহের মধ্যে আমার উত্তাপ ঢেলে দিলাম তখন সে ঘেমে সম্পূর্ণ ভিজে গেছে। সে উঠে নিজেকে ধৌত করলো এবং একটা ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে আমার মধ্যাঙ্গ মুছে দিলো। আমার পাশে বসে সে বললো, ‘চপ্পন বলেছে, আপনি এক মশহুর কবি। এই দাসীকে উপহার হিসেবে কয়েক ছত্র লিখে দিন।’ কবিতা রচনার মতো মানসিক অবস্থা না থাকলেও বালিকার অনুভূতিতে আঘাত দিতে ইচ্ছে হলো না, ‘আমাকে এক টুকরো কাগজ, কলম আর কালি এনে দাও। তোমার জন্যে কিছু একটা লিখে দেব।’ নোট বই থেকে সে এক টুকরা কাগজ ছিঁড়ে আনলো। নলের একটা কলম দিলো এবং মাটির দোয়াত এনে হাতে ধরে রইলো। কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে লিখলাম ঃ
‘বর্ষার মৌসুমে সোরাহীর মদও
মেঘের মতো
গোলাপ উদ্যানে গোলাপগুলো
দেখতে তোমারই মতো।’
ফতেপুরীর সেই বাড়িতে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় ভোর। প্রচন্ড ব্যথায় মাথা ঢিবঢিব করছে। মুখ ঝলসে গেছে। কাপড় খোলার সময় খেয়াল করলাম তোহফা হিসেবে যে সুবর্ণ ও রজত মুদ্রা লাভ করেছিলাম তার একটাও নেই। মোগল রাজকুমারী হতে আগ্রহী ষোল বছরের বালিকা ছাড়া আর কে এই কাজটা করতে পারে। সন্ধ্যায় যখন ঘর ছেড়েছি, তখন আমার পকেট শূন্য ছিল। রাতে তা ছিল সুবর্ণ ও রজত মুদ্রায় পূর্ণ। পরদিন সূর্যোদয়ের পূর্বেই পকেট আবার পূর্ববৎ হয়ে গেছে। এই হচ্ছে কবির জীবন। ‘মীর তকী, তার চেয়ে ভালো, নিজ উপত্যকায় ফিরে যাও। এটা যেমন তেমন জনপদ নয়। এ হচ্ছে দিল্লী।’
নওয়াব শামসামুদ্দৌলার সামনে যখন হাজির হলাম, তখন আমার দীনহীন অবস্থা। নওয়াব অবস্থা উপলব্ধি করলেন। তার ভ্রাতুষ্পুত্র আমার জন্য একটা ভাতা মঞ্জুর করার সুপারিশ করলেন। নওয়াব রক্তবর্ণ চোখ মেলে আমার পানে তাকালেন, ‘হ্যাঁ, গতরাতে ওর কালাম শুনেছি। তাঁর বিষয়টা বিবেচনা যোগ্য। তাছাড়া ওর মরহুম আব্বার কাছে আমি ঋণী। ওকে দৈনিক এক রূপেয়া করে দেয়া হোক। এরপরের বিষয় কী?’
পরবর্তী কর্মসূচীতে যাওয়ার পূর্বে আমি তার সামনে একটা কাগজ তুলে ধরে আরজ করলাম-‘আদেশটা লিখিত দিলেই বোধহয় নওয়াব সাহেব বেশি সন্তুষ্ট হবেন। বয়সে নবীন হলেও আমি বেসামরিক আমলাদের কাজের তরিকা জানতাম। তারা লিখিত দলিল ছাড়া কিছুই করেন না।
আমার ক্ষুদ্র নিবেদনে নওয়াব সাহেবের আত্মমোহিতের ভাবটা দূরীভূত হলো। তিনি ফার্সিতে বললেন, ‘ওয়াক্ত-ই কলাম দান নেস্ত’- এখন তো দলিল লেখকদের সময় নয়।’ আমি দাঁড়িয়ে আরজ করলাম, ‘আমি বুঝতে অক্ষম যে, আপনি কিভাবে আপনার বাক্য গঠন করেন। আপনি যদি এ কথা বলেন যে, এখন দস্তখতের সময় নয়, কিংবা দলিল লেখকের এখন দায়িত্ব নেই তাহলে কথাটা বুঝতে পারবো। কিন্তু ‘দলিল লেখকের সময় নেই’ কথাটা ভালো শোনায় না। এটা সজীব কোন বস্তু নয়। ফলে এর যথার্থ সময়ের প্রশ্ন আসে না। আপনার হুকুমেই তাঁকে এখানে আনা যায়।’
নওয়াবের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। তিনি বললেন, ‘মীর তকী, তুমি ধৃষ্ট বালক। আমি আনন্দের সঙ্গে আমার প্রতিশ্রুতি লিখতে প্রস্তুত। তিনি স্বহস্তে আমার ভাতার কথা লিখলেন এবং তার স্বাক্ষরযুক্ত অঙ্গুরীয় দিয়ে তাতে মোহর লাগালেন, ‘যাও, সুনাম অর্জন করো। তোমার কালাম তোমার আব্বার নাম উজ্জ্বল করুক। সেই সঙ্গে তোমারও খ্যাতি বয়ে আনুক।’
দিল্লীতে তখনকার জীবন কতো চমৎকার ছিল। লোকেরা তাদের কবিতা সম্পর্কে আমার মতামত জানতে আমার ঘরে হানা দিতো। যেখানেই গমন করতাম, নগরবাসী আমাকে চিনে ফেলতো এবং প্রশংসা করতো। যেখানেই মুশায়রা আয়োজিত হতো, সেখানেই আমি হাজির থাকতাম উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে। শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করতে হাজির হতাম মসজিদে। যদিও আমি নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করি না এবং বিশ্বাসী ও পৌত্তলিকের মধ্যে আমার দৃষ্টিতে বড় কোন তফাৎ পরিলক্ষিত হয়নি। তবুও নামাজ শেষে সমবেত মুসল্লীদের নিকট হতে তোষামোদ পাওয়ার ব্যাপারটিকে জুমার জামাতে হাজিরা দেয়ার কারণ হিসেবে স্থির করে নিয়েছিলাম। দিল্লীর বাসিন্দারা আমাকে ভালোবেসেছিলো, আমিও তাদেরকে এবং দিল্লী নগরীকে ভালোবেসেছিলাম।
কিন্তু হায়! আমার সুখের দিনগুলো চিরস্থায়ী হলো না। শোনা গেলো পারস্যবাসী নাদির কুলী খান আফগানিস্তান কব্জা করে সিন্ধু নদীর তীরে শিবির স্থাপন করেছে। হামলাকারীকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেলো। ভীতি ছড়িয়ে পড়লো দিল্লীতে। ধনী ব্যবসায়ীরা নগর ত্যাগ করতে লাগলো। আমার বিবি তার পত্রে আমাকে আগ্রা প্রত্যাবর্তন করতে অনুনয় করছিল। বেগম সাহেবা যে তাদেরকে খাদ্য ও উপঢৌকন পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন, সে কথাও সে লিখেছে। তাঁর পুত্রের জন্য নতুন ওস্তাদ নিয়োগ করা হয়েছে। আগ্রা থেকে স্বাগত লোকজন আমাকে বলেছে যে, যার কাছে আমার হৃদয় বিক্রি করেছি, সেই বেগম সাহেবা নতুন ওস্তাদের প্রেমে মাতোয়ারা। তাঁর প্রেমের উপর এখন উপঢৌকনের বৃষ্টি ঝরছে। গল্পগুলো আমার বিশ্বাস হলো না। সংক্ষিপ্ত সফরে দিল্লীতে অবস্থানরত নওয়াব রঈসের দিল্লী ত্যাগের পূর্বেই তার সাথে সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তিনি পারস্য বাহিনীর হামলা মোকাবেলায় তাঁর সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধির তদবির করতে এসেছিলেন। আমার স্থলাভিষিক্ত ওস্তাদের উচ্ছসিত প্রশংসা করে তিনি বললেন, ‘লোকটি কবি নয়, কিন্তু ওস্তাদ হিসেবে উত্তম।’ তাঁর পুত্ররাও তাঁর খুব ভক্ত। সে মহলের একজন সদস্যই বনে গেছে এবং আগ্রা থেকে নওয়াবের অনুপস্থিতির সময় হাভেলিতেই কাটায়।’
আগ্রার ঘটনা প্রবাহে মনটা আরো বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লো। যতক্ষণ দিল্লী নিরাপদ, আমি দিল্লীতেই কাটালাম। দিল্লী আমাকে প্রতিপাল করছিল। নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম, কোনো নারী যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে তাহলে তাকে মৃত বিবেচনা করাই উত্তম। তার চিন্তায় বিনিদ্র রজনী কাটাবার পরিবর্তে তাকে বিস্মৃত হওয়াই ভালো। কিন্তু তাঁকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে যত চেষ্টা করছি, সে ততো ফিরে এসে ব্যথা দিয়েছে। আগুনে দগ্ধ হৃদয়ের জ্বালা জুড়াতে প্রয়োজন অশ্রুর ঝর্ণাধারা। দু’এক ফোঁটা অশ্রু আগুনকে আরো ভয়াবহ করবে। তাঁকে আমার ছন্দে এমনভাবে জড়িয়ে নিয়েছি যে, অন্যের চোখে তাকে দেবীতে পরিণত করেছি। আমার শব্দমালা যাকে স্বর্গীয় জ্যোতিতে দীপ্যমান করেছে, সেই নারী আমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাঁর সাথে আমি দেহ বিনিময় করেছি এবং তার কারণেই আমার বিবেক আমাকে মানবতার বিরুদ্ধে পরিচালিত করেছে। আমি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাম।
১৭৩৮ সালের শরৎকালে নাদির কুলী খান পাঞ্জাবের সমভূমি পর্যন্ত অগ্রসর হলো। তাদের বাধা দিতে মোগল বাহিনী দিল্লী থেকে ধাবিত হলো। সেনাপতিদের বিজয় এবং নিরাপদে আমার পৃষ্ঠপোষকের কাছে ফিরে যাওয়ার প্রার্থনা করলাম। ১৭৩৯ সালের বসন্তকালে দুই বাহিনী কর্নালে যুদ্ধে লিপ্ত হলো। আল্লাহ পারসিকদের বিজয়ী করলেন। মোগল বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। হাজার হাজার মৃতের স্তূপে মীর তকী মীরের পৃষ্ঠপোষক, শাহী খাজাঞ্চী নওয়াব শামসুমাদ্দৌলাও ছিলেন। তাঁর মহত্ত্ব ও উদারতার মূল্যায়নসূচক কোন স্তূতি আমি রচনা করিনি। ঔদার্যের মেঘমালার মতো আমার মাথার ওপর তিনি ছায়া বিস্তার করেছিলেন। আল্লাহ তাঁর রূহকে শান্তি দিন। ঈর্ষাপরায়ণ কলমবাজদের নোংরামি থেকে আমাকে রক্ষা করার মতো কেউ আর অবশিষ্ট রইলো না। অথবা এমন কেউই নেই, যার কাছে আমার দৈন্য তুলে ধরতে পারি। আমি দরিদ্র, দুর্বল, অসহায় ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লাম।
কর্নালের বিপর্যয়ের খবর শোনার পর কালবিলম্ব না করে একটা ঘোড়া ভাড়া নিয়ে আমি আগ্রার পথ ধরলাম। কোন কাফেলার সাথে যোগ দেয়ার প্রয়োজন পড়েনি। কারণ গোটা পথই দিল্লী থেকে পার্শ্ববর্তী শহর ও গ্রামের দিকে পলায়নপর জনতার দীর্ঘ কাফেলায় পরিণত হয়েছিল। পারস্যবাসী হামলাকারীদের চাইতে তারা স্বদেশবাসী মারাঠা, জাঠ, গুজ্জার লুটেরাদের ভয়ে সন্ত্রস্ত। তারা লুণ্ঠন, হত্যা এবং তাদের কবলে পতিত নারীদের ধর্ষণ করতো। আগ্রা পৌঁছতে পাঁচদিন লাগলো। নাদির কুলী খানের বাহিনী তখন দিল্লী লুণ্ঠনে ব্যস্ত। নিজেকে বললাম, ‘একটা নগরীর পুনঃনির্মাণ সম্ভব, পুনঃবসতি স্থাপনও হতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর কোন শক্তিই ভেঙ্গে যাওয়া হৃদয়কে জোড়া লাগাতে পারে না।’
আমার হৃদয়কে ভেঙ্গে দেয়া শহরের নাম আগ্রা। নিজ চোখে ধ্বংসস্তূপ দেখার জন্য আমি আগ্রায় ফিরে এসেছিলাম। বন্ধুরা, কান্না আমার সহজাত হয়ে গেছে। আর কতোদিন তোমরা আমার চোখ থেকে অশ্রু মোচন করবে?
আমি আমাদের যোগসূত্র এবং প্রেমের গভীরতার কথা স্মরণ করলাম যে, কিভাবে খরস্রোতা ঝর্ণায় কাগজের নৌকার মত আমরা ভেসে চলেছিলাম। প্রেম এমন এক যন্ত্রণা, যা কাউকে ক্ষমা করে না। হোক সে বৃদ্ধ বা তরুণ, বিবাহিত কিংবা কুমার। আমি মোহগ্রস্তের মতো তার পায়ে পুষ্প ছড়িয়ে দিয়েছি। প্রথম দর্শনে যে নারীকে তেমন সুন্দরী বলে বিবেচনা করিনি, আমার প্রেমিকা হওয়ার পর সে কেমন করে আমার চোখে বিশ্বের সেরা সুন্দরীতে পরিণত হলো। সুন্দরীদের কোন সমাবেশে সে তারকারাজির মাঝে পূর্ণিমার চাঁদের মতো। তাঁর হাসি প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো। তাঁর কেশ গুচ্ছ ভোরের নির্মল বায়ুতে সুগন্ধি ছড়াতো। সে আমার এতো প্রিয় বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। কারণ সে ছিল আমার বাসনা। এই নারী কী করে আমার কাছে মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে? এমনকি আমার অগোচরে নতুন প্রেমিকও নির্বাচন করতে পারে?
কিন্তু এখনো তাঁকে কামনা করি এবং সে জন্যই আমি আগ্রায় ফিরে এসেছি। আমার মধ্যে আবেগের আগুন জ্বলছে। ভেবেছিলাম আগুন নিভে ছাই হয়ে যাবে, কিন্তু নিভু নিভু আগুনটা আবার জ্বলন্ত শিখায় পরিণত হলো।
শূন্য হাতে বাড়ি ফিরেছি। তবুও আমার পরিবার অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আমাকে স্বাগত জানালো। এই প্রথম আমার দ্বিতীয় সন্তানের মুখ দর্শন করলাম। শুনে ক্ষুব্ধ হলাম যে, আমার আগ্রা ত্যাগের মাস খানেক পর থেকেই বেগম সাহেবা আমার পরিবারের প্রতি উদাসীন। তারা যখন শেষবার হাভেলিতে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিল, তখন তিনি অসুস্থতার ভান করে সাক্ষাৎ দেননি। আমার বৈমাত্রেয় ভাই, যিনি আমাকে খুঁচিয়ে আনন্দ পান, শ্লেষ মিশিয়ে তিনি আমাকে বলেছিলেন, নতুন ওস্তাদের সাথে বেগম সাহেবের সম্পর্ক কী। সন্তানদের জন্যে তাঁকে নিয়োজিত করা হলেও ওস্তাদের সাথে তাঁর ঢলাঢলি সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। তার কথা তীরের মতো বিদ্ধ হয়েছে আমার হৃদয়ে।
পরদিন সকালে আমি নওয়াব রঈসকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গেলাম। পারস্যের সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সৈন্য বৃদ্ধির পরিবর্তে নাদির কুলী খানের সঙ্গে সন্ধিতে উপনীত হওয়ার জন্য তিনি মোগলদের সমালোচনা করলেন। তার বিশ্বাস জন্মেছে যে, নাদির কুলী খান ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি এবং খাঁটি মুসলমান। তাঁর দ্বারাই হিন্দুস্থান থেকে মূর্তিপূজার অবসান সম্ভব। তিনি আমাকে জেনানা মহলে নিয়ে গেলেন। মহল যেমন দেখে গিয়েছিলাম, সবই তেমন আছে। শুধু আমার পরিবর্তে নতুন ওস্তাদ বাচ্চাদের তালিম দিচ্ছে। বেগম সাহেবা মোড়ায় বসে তাদের অবলোকন করছেন। বাচ্চারা আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যর্থনা জানাল। ওস্তাদও স্বাগত জানাল। তার কুৎসিৎ চেহারায় আমি বিজয়ীর ভাব লক্ষ্য করলাম।
বেগম সাহেবার ওজন বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাকে দর্শনমাত্র তাঁর চোখের দীপ্তি নিভে গেল। আমার প্রতি তাঁর দৃষ্টি এমন নির্লিপ্তের যেন তিনি কোন অচেনা লোকের সামনে উপনীত। নির্বাপিত প্রদীপের মতো স্থির তাঁর হৃদয়। তিনি বললেন, ‘আমরা শুনেছি দিল্লীতে আপনার নাম প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এটাতো আগ্রাাবাসীদের জন্য গৌরবের বিষয়, অবাক হলাম যে, উপস্থিত তিনজন লোকেরই শয্যাসঙ্গী এই মহিলা নিজেকে কতটা শান্ত রাখতে সমর্থ হয়েছেন। আমার চোখমুখে ক্রোধ ও অভিযোগের ছায়া। ইচ্ছে হলো, এখান থেকে ছুটে গিয়ে চীৎকার করে আগ্রাবাসীর কাছে প্রকাশ করি যে, এই নারী শুধু তার স্বামীর কাছেই বিশ্বাসহন্তা নয়, প্রেমিকের কাছেও। তাহলে নগরবাসী তাকে প্রস্তর নিক্ষেপ করবে, এক বার নয়, তিন তিনবার। কিন্তু আমি মুখ খুলতে পারিনি। একটা অজুহাত দেখিয়ে হাভেলি ত্যাগ করলাম। আমার জন্য গৌরববোধ করা তো দূরের কথা, আগ্রাবাসী আমার বিরুদ্ধে যেন রুখে দাঁড়াল। যারা আমার দরবেশতুল্য আব্বাজানের পদধূলিকে সুরমার মতো পবিত্র গণ্য করতো, তারা পাশ দিয়ে গেলেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতো। ঘণ্টার প্রতিধ্বনির মতো আমার কণ্ঠস্বর অজ্ঞাত গন্তব্যে হারিয়ে যাচ্ছিল। ছয়মাস ধরে অব্যাহত নিপীড়নের পর আমি আগ্রা পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম।
১৭৩৯ সালের গ্রীষ্মের মাঝামাঝি আমি আবার দিল্লীতে প্রত্যাবর্তনে করলাম। আমি হতবাক হয়ে গেছি, যে নারী গত দিনগুলোতে আমার জীবনসঙ্গিনী হিসেবে থাকার ওয়াদা করেছিল, এখন সে আমার সঙ্গে প্রতিশোধমূলক আচরণের চিন্তা করছে। তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার তিক্ততার কারণে আগ্রা ত্যাগ করলেও তাঁকে মন থেকে নির্বাসিত করতে পারলাম না। দিল্লীর ধ্বংসস্তূপের সর্বত্র আমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছি। তার কৃপালাভের আশায় ঘুরে ফিরেছি ভিক্ষাপাত্র হাতে। প্রতিটি দিবসের সূচনার ভোরের বাতাসের মতো সব রাজপথের গৃহদ্বারে ধাক্কা দিয়ে ফিরেছি। ভোরের বাতাসের ঝাপটায় আমি কম্পমান মোমবাতির শিখা হয়ে গেছি। ভিতরে ভিতরে জ্বলে গলে নিঃশেষিত এবং মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে উপনীত। অদ্ভুত এক উন্মাদনা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। অনেকে বললো, আমার পাগলামি বংশগতভাবে প্রাপ্ত। এটা আমার রক্তে ছড়িয়ে পড়েছে। রক্ত বের করে ফেলাই নিরাময়ের একমাত্র উপায়। তারা উত্তপ্ত লৌহ শলাকা দ্বারা আমাকে দগ্ধ করলো। আমার দেহের নানাস্থানে জোঁক লাগিয়ে দিলো। পাগলা গারদের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ করে রাখলো। চিকিৎসক আমার অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে বললো, ‘প্রেমের যন্ত্রণায় দগ্ধ এই লোকের জন্য আমি কী ব্যবস্থাপত্র দিতে পারি?’ যে ব্যক্তিটি আমার প্রতি সামান্য সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন, তিনি আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয়া, ব্দ্ধৃা রমণী। তিনি আমার কাপড় বদলে দিতেন, খাবার তুলে দিতেন এবং সান্তনার বাণী শুনাতেন। আল্লাহ তাকে শান্তিতে রাখুন।
হতাশাগ্রস্ত হয়ে আপন মনেই বলছিলাম, কামনা ও প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ার চাইতে অন্ধকার কারাকক্ষে শৃঙ্খলিত বা আটকে থাকা বরং শ্রেয়। নিজের হতাশার উপর একটা কবিতা রচনা করলামÑ
‘আমার হৃদয়ের অভিযোগ,
চোখই আমাকে ধ্বংস করেছে
চোখ বললো,
হৃদয় আমাকে সর্বস্বান্ত করেছে।
জানি না, কার কথা সত্য
আর কারটা মিথ্যা
মীর তকী দুটোর মাঝেই আছে
যার মৃত্যু হয়েছে।’
আমি নিজেকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যেই আমার অন্তিম ইচ্ছাগুলো লিপিবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ‘বন্ধু মীর, তোমার হৃদয় যা চায়, সবই করো। কিন্তু হৃদয়কে প্রেমে পড়তে দিও না। প্রেম প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা কাউকে ছাড়ে না।’
অবশেষে আমাকে তারা কারা-প্রকোষ্ঠ থেকে ছেড়ে দিলো। অনেকগুলো সপ্তাহ ধরে অলি-গলিতে ঘুরাঘুরি করে বহু সময় অতিবাহিত করলাম। যেদিকেই দৃষ্টি ফিরিয়েছি, নাদিরের পারস্য বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত ধ্বংসের নজির দেখেছি। একটি বাড়িও বাদ পড়েনি। মৌলা কিল্লার প্রাচীর হতে মূল্যবান প্রস্তর ও সাজসজ্জা খুলে নেয়া হয়েছে। রাজপুত্রদের ভিখারীর পর্যায়ে আনা হয়েছে। তাদের অনেককে অভুক্ত থাকতে হয়েছে দিনের পর দিন। আমি এ ব্যাপারে অভিযোগ করার কে? সেই যে এক রজনীতে জীর্ণ এক কুটিরে বালিকার কাছে গিয়েছিলাম, তার বাহুলগ্না হতে গেলাম। গলির একটি ঘরও আস্ত নেই। বৃদ্ধা ও বালিকার ভাগ্যে কী ঘটেছে কেউ আমাকে বলতে পারলো না। সম্ভবতঃ বৃদ্ধা নিহত এবং পারসিক সৈন্যরা বালিকাকে ধরে নিয়ে গেছে ক্রীতদাসী হিসেবে।
কী দুর্ভাগ্য আমার প্রিয় নগরীর। শিখ, মারাঠা, চোর, পকেটমার, ব্যবসায়ী শাসক সকলের অসহায় শিকার আমরা। যার সহায়-সম্পদের কোনো বালাই নেই, সেই সুখী। সম্পদই একমাত্র দারিদ্র। সবকিছুর বিচারে আমি ধনী শ্রেষ্ঠদের চাইতেও ধনী। একই সাথে দরিদ্রতমের চাইতেও দরিদ্র।
একদিন নগর মাঝে ঘুরতে ঘুরতে সদ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন সারির কাছে এলাম। এলাকাটি আমার পরিচিত। কিন্তু ঘরগুলো শনাক্ত করতে পারছিলাম না। কারণ, খুব কম ঘরই খাড়া ছিল। এলাকাবাসী সম্পর্কেও জানতে পারিনি। যখন কারো নাম ধরে প্রশ্ন করেছি, তারা উত্তর দিয়েছে, সে আর এখানে থাকে না। তারা কোথায় গেছে জানতে চাইলে উত্তর পেয়েছি ‘তারা কোথায় গেছে’ এ সম্পর্কে আমি কিছু জানি না।’ সারি সারি ঘরবাড়ি মাটিতে মিশে গেছে। প্রাচীরগুলো আর খাড়া নেই। আশ্রম সন্যাসী শূন্য, শরাবখানা মাতালশূন্য। যদ্দুর চোখ যায়, বিস্তীর্ণ প্রান্তর। বাজারের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন। অবাধে চড়ে বেড়াচ্ছে শূকর। সৌন্দর্য অবলোকন করতে এখন আমি কোনদিকে চোখ ফেরাব। আমার গতকালের প্রেমের সঙ্গী, সকল সুখ শান্তি কোথায় পালিয়ে গেল? উচ্ছল তরুণ, জ্ঞানী বয়োজ্যেষ্ঠ সবাই নিশ্চিহ্ন। একটি কবিতা মনে পড়েছে, জানিনা কার-
‘একদিন এই বিধ্বস্ত নগরীর মাঝ দিয়ে
আমি অতিক্রম করেছি।
গাছের ডালে নিঃসঙ্গ এক পাখিকে
দেখে প্রশ্ন করলাম,
এই নিরানন্দ জীবনের হেতু কী?
সে বললো, দুটো শব্দে
আমি মনের কথা ব্যক্ত করতে পারি
“হায়! হায়!”
নাদির কুলী খানের হামলায় দিল্লী মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার পরও অল্পসংখ্যক লোকের মধ্যে আমি দিল্লীতে ছিলাম। আমি আমার বৈমাত্রেয় ভাই-এর মামা সিরাজুদ্দিন আলী আরজুর সাহচর্য কামনা করলাম। আমার দিল্লী আগমনের পূর্ব পর্যন্ত তিনি মশহুর কবি ছিলেন। প্রথমদিকে আমার ব্যাপারে তিনি ছিলেন বেশ আগ্রহী এবং আমার জন্য পৃষ্ঠপোষকও অনুসন্ধান করেছেন। তার পরামর্শেই আমি ফার্সিতে লেখা ত্যাগ করলাম এবং সাধারণ মানুষের ভাষায় কবিতা রচনার পরিবর্তে জামে মসজিদের সিঁড়িতে ভিড় করা লোকদের জন্যে লিখতে শুরু করলাম। এর ফলে আমার জনপ্রিয়তা এতো বৃদ্ধি পেলো, যা শুধুমাত্র শিক্ষিত আমীর-ওমরাহদের প্রাপ্য বিবেচিত হতো। আশ্চর্যজনক যে, আরজু আমার বিরোধিতা শুরু করলো। ভাবলাম, আমার বৈমাত্রেয় ভাই আমার পৃষ্ঠপোষকের বিবির সাথে আমার প্রেম সম্পর্কে তাকে অবহিত করেছে। অথবা তিনি ভাবছেন, যেহেতু আমার মা শিয়া, অতএব, আমার সঙ্গেও শিয়া মতবাদের সম্পর্ক রয়েছে। অপরদিকে আরজু সুন্নী মতাবলম্বী।
আমি আমার বিশ্বাস সম্পর্কে সত্য কথাটাই বলছি-
‘আমি মন্দির এবং মসজিদের
অনেক উর্ধে
আমার হৃদয়কে পরিণত করেছি
এক অভয়াশ্রমে
এই কণ্টকাকীর্ণ পর ধরেই
আমার সকল ভ্রমণ ও অভিযাত্রা।’
মীর তকীর বর্ণ বা ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করার মতো কিছু আছে কী? সে শিয়াও নয়, সুন্নীও নয়। মুসলিম বা হিন্দু নয়। মুসলমানদের মতো মীর তকী প্রতি শুক্রবার মসজিদে যায়। হিন্দুদের মতো কপালে চিহ্ন আঁকে এবং বহু বর্ষ পূর্বে ইসলাম ধর্মে পরিত্যক্ত মূর্তিপূজা করে মন্দিরে গিয়ে। আমার ওপর আরজুর ক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভাব্য কারণ ছিল আমার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা। সে দেখতে পাচ্ছিলো যে, ‘সুলতান-উল-শোয়ারা’ কবিদের রাজমুকুট তার মাথা থেকে খসে আমার মাথায় বসছে। হিংসা-বিদ্বেষ বন্ধুত্বকে তরবারির আঘাতের চেয়েও দ্রুত বলি দেয়।’ আরজুর শত্রুতা আমার পৃষ্ঠপোষককে বিরূপ করলো এবং আমার জীবনকে দুঃসহ করে তুললো। আমার নিয়মিত আয়ের কোন উৎস ছিল না। ফলে আমি মহাজন, সব্জী বিক্রেতা, দুধওয়ালাদের কাছে কর্জ নেয়া শুরু করলাম।
উঁচু লালকিল্লার প্রাসাদ থেকে শুরু করে পাহাড়গঞ্জের জীর্ণ বস্তি পর্যন্ত বিস্তৃত নগরীর সর্বত্র যখন বিলাপের শব্দ, তখন মীর তকী, নিজের দুর্ভাগ্যের এতো হাহুতাশ করছে কেন? অভিশপ্ত নাদির শাহ ১৭৩৯ সালের ১৬ই মে দিল্লী পরিত্যাগ করলেন। পশ্চাতে ফেলে গেলেন হাজার হাজার বিধবা, যারা মৃত স্বামীর পাশে বুক চাপড়াচ্ছিল এবং হাজার হাজার এতিমকে ভিক্ষা করতে রাস্তায় ঠেলে দিচ্ছিল। সরকার সম্পর্কে কম বলাই শ্রেয়। মোহাম্মদ শাহ আমাদের সম্রাট। এ ছাড়াও তিনজন শাসক প্রধান উজির নওয়াব সফদার জং, খাজাঞ্চী নওয়াব ইমাদুল মুলক এবং নওয়াব ইনতিজামুদৌলা। সম্রাটের আইন তার হেরেমেও অচল। তার হিন্দু বিবি-যিনি সাবেক নর্তকী ও তাঁর উপদেষ্টা ছিলেন, তিনি সর্বেসর্বা। হেরেমের তত্ত্বাবধায়ক জাভেদ খান একজন খোজা, নপুংসক। তার অযোগ্যতার কারণে হিন্দু সম্রাজ্ঞীই ক্ষমতা প্রদর্শন করতেন। অতএব মীর তকীর অভিযোগ করার কী থাকতে পারে? জাভেদ পুরুষত্বহীন হতে পারে। কিন্তু সে আমার সকল নিন্দা ও বদনাম উপেক্ষা করে আমার ওপর দান-শীতলতার ছায়া বিস্তার করে তার পুরুষত্ব প্রমাণ করেছে। আমাকে দিনে এক বেলা আহার্য এবং যে কাপড়টি পরিধানে আছে, তা ছিড়ে গেলে সেটি বদলে দেয়ার আশ্বাসও আমাকে দেয়া হয়েছে।
সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য নওয়াব সফদর জং-এর ভাগ্য প্রসন্ন হলো। ১৭৪৩ সালের ১৫ই এপ্রিল মোহাম্মদ শাহের ইন্তেকালের পর সম্রাটের একুশ বছর বয়সী পুত্র আহমদ শাহ মোগল সিংহাসনে অভিষিক্ত হলেন। আহমদ শাহ রাজকার্য অপেক্ষা সুন্দরী নারীসঙ্গ এবং পানপাত্রের প্রতি বেশি আসক্ত ছিলেন। রাজকার্যের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল তাঁর মা ও মায়ের বিশ্বস্ত অনুচর নওয়াব জাভেদ খানের উপর।
নওয়াব জাভেদ খান সফদর জংকে পছন্দ করতেন না এবং তিনি ইমাদুল মুলক ও নওয়াব ইনতিজামুদ্দৌলার সাথে যোগ দিলেন। কয়েক মাস পর সফদর জং প্রধান উজির পদে উন্নীত হলে তাঁর জীবনের উপর হামলা এলো (নভেম্বর ১৭৪৮)। নিগমবোধ ঘাটের কাছে তার প্রাসাদের সামনে তাকে লক্ষ্য করে বন্দুকের গুলি ছোঁড়া হলো। সফদর জং ঘোড়া থেকে মাটিতে পতিত হয়ে প্রাণে রক্ষা পেলেও তার বেশ কয়েকজন অনুচর নিহত হলো। তিনি নিকটস্থ সকল বাড়ি উচ্ছেদ করে ও জ্বালিয়ে দিয়ে তাঁর ক্রোধ প্রশমিত করলেন এবং যমুনার অপর তীরে একটি সেনা ছাউনি ফেললেন। তাঁর সন্দেহ হলো যে, এই ষড়যন্ত্রের পশ্চাতে জাভেদ খানের হাত আছে। জাভেদ খানের সঙ্গে মিত্রতার ভান করে তিনি একদিন অমীমাংসিত বিষয়সমূহ নিষ্পত্তির জন্য ভরতপুরের রাজা সুরাজ মল জাঠের সঙ্গে প্রাতঃরাশের আমন্ত্রণ জানালেন। আহার পর্ব সমাধার পর তিনি জাভেদ খানকে এক কোণায় ডেকে নিয়ে গেলে তাঁর একজন অনুচর তার পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করলো। তার মাথা দেহ হতে ছিন্ন করে যমুনা তীরের বালুকায় নিক্ষেপ করা হলো। সম্র্জ্ঞাীর শোক বিলাপ শুরু হলো। আমি আর একজন পৃষ্ঠপোষক হারালাম।
এ ঘটনার পর নওয়াব সফদর জং-এর অনুসারী বাহিনী এবং সম্রাজ্ঞীর বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত খন্ড যুদ্ধ শুরু হলো। প্রতিদিন তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হতো। বন্দুকের গুলি চলতো, তরবারী ঝলসে উঠতো, রাজপথে প্রবাহিত হতো রক্তের স্রোত। তারা রোহিলা, জাঠ, মারাঠা ও শিখদেরকে তাদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য ভাড়া করলো। ভাড়াটে সৈন্যরা দিবাভাগে তাদের মনিবদের জন্যে লড়তো, আর রাতের অন্ধকারে ভাগ্য বিড়ম্বিত দিল্লীবাসীর ওপর চড়াও হয়ে লুণ্ঠন করতো। গৃহাভ্যন্তরেও লোকেরা নিরাপদ বোধ করতো না। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তারা সম্রাজ্ঞীর কাছে আবেদন করলো। হাজার হাজার পরিবার চাঁদনী চকের পাশে সাঈদাবাদ উদ্যানে উদ্যানে উন্ম্ক্তু আকাশের নিচে জড়ো হলো। সৌভাগ্যবশত আবহাওয়া অনুকূল ছিল। এভাবে কাটানোর ফলে বেশি লোক মারা পড়েনি। বৃষ্টিতে ভিজে মরা, তরবারির আঘাতে নিহত হওয়ার চেয়ে উত্তম বিবেচিত হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত নওয়াব সফদর জং টিকতে পারলেন না। তিনি নিজে শিয়া মতাবলম্বী। কিন্তু তাঁর বাহিনীতে অধিক সংখ্যক শিয়া ছিল না। জাঠ ও মারাঠাদের বিরুদ্ধে বিজয়লাভের চেষ্টা করে তিনি নিরাশ হয়ে গেলেন। সে সময়টুকু তিনি রায়সিনা ও কুতুব-এর সংযোগ সড়কের পাশে অন্তিম আবাস নির্মাণের জন্য ব্যয় করলেন। এ সময় তিনি অযোধ্যায় তাঁর জায়গীরও দেখাশোনা করতেন।
আহমদ শাহের শাসনের অবসান ঘটেছিল তার মাধ্যমেই। তখনো তারা দুর্গের প্রাসাদেই বাস করতেন। হোলকারের নেতৃত্বে মারাঠাদের দিল্লীর শহরতলী লুটতরাজের পর নয়া সরকার হিসেবে সম্রাট আওরঙ্গজেবের দৌহিত্র মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিনকে স্থলাভিষিক্ত করার ব্যাপারে সম্মত হলো। তিনি সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর নাম ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করলেন জুন ১৭৫৪ সালে। এই বিশ্ব বিজেতা সুরম্য দুর্গের লাল প্রস্তরের প্রাচীরের বেষ্টনী অপেক্ষা বৃহত্তর কোন স্থানে শাসন করেননি। অতএব সম্রাটের দুঃখজনক পরিণতির কাহিনী বয়ানের পরিশ্রম নিরর্থক।
পারস্যের হামলাকারীদের হাতে দিল্লীর প্রাণ সংহারের পর নগরী আর পূর্বের মতো ছিল না। রাজন্যবর্গ, ওমরাহ এবং তাদের ভাড়াটেরা নগরীর লাশের উপর শকুনির ঝাঁকের মতো চড়াও হতো। আমি দিল্লীতেই ছিলাম। কারণ দিল্লীর বাইরে আগ্রা ছাড়া আমার যাওয়ার আর কোনো জায়গা ছিল না। কিন্তু একজন রমণীর বিশ্বাসঘাতকতা আমাকে সেই নগরী থেকেও চিরতরে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছিল। দিল্লীতে ভয়াবহ হত্যাকান্ড ও ধ্বংস সত্ত্বেও আমার স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্কে জানতে চেয়ে সে একটা চিঠি পাঠাবার কথাও ভাবেনি। এ ধরনের লোকের কথা বিস্মৃত হওয়াই উত্তম। আমার বিবি ও সন্তানরা (ইতিমধ্যে আমার দুই পুত্র ও এক কন্যা জন্মগ্রহণ করেছে) দিল্লীতে আমার কাছে হাজির হয়েছে। আমরা চরম দারিদ্রের মধ্যে বাস করছি। আমার নাম ও খ্যাতির বিনিময়ে আয় হতো স্বল্প। সন্তানদের নিজেই তালিম দিতাম। লক্ষ্য করলাম, অর্থাগম হতে পারে এমন কোন কাজ করার চাইতে ওরা তিনজনই কবিতা লেখার প্রতি বেশি আগ্রহী।
১৭৫৮ সালের শরৎ কালে নাদির শাহের উত্তরাধিকারী একজন আফগান আহমদ শাহ আবদালী মোগল সাম্রাজ্যের উপর তার অধিকার দাবি করে বসলেন। আফগানরা পাঞ্জাব হয়ে অগ্রসর হলো এবং বিনা প্রতিরোধে দিল্লী দখল করলো। আবদালী দিল্লীবাসীদের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু নৃশংসতা ছাড়া রজনী অতিবাহিত হয়েছে, এমন নজির বিরল। শহরে অগ্নিসংযোগ শুরু হলো। ঘরবাড়ি লুণ্ঠন ও জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছিল। দরজা ভেঙ্গে লুটেরার দল ঘরে প্রবেশ করতো। লোকদের বেঁধে ফেলতো। জীবন্ত পুড়িয়ে মারতো অথবা মস্তক ছিন্ন করতো। সর্বত্র চলছিল রক্তপাত ও ধ্বংসলীলা। কারো পরনে একটা কাপড়, একবেলা খাবারও ছিল না। মজলুমের কান্না আরশ পর্যন্ত পৌঁছে যেতো। আবদালী নিজেকে মনে করতো ‘দুর ই দওরান’ ‘মুক্তার মধ্যে মুক্তা’ এবং বিশ্বাসের স্তম্ভ। আসলে আবদালী ক্ষুধার্ত সিংহের মতো সর্বগ্রাসী। বিপুল সংখ্যক লোক দিল্লী পরিত্যাগ করলো এবং অনেকে গ্রামের দিকে পালিয়ে গিয়ে পথে মারা পড়লো। আমি দরিদ্রের মধ্যে নিমজ্জিত ছিলাম। আমার দৈন্যতা আরো বৃদ্ধি পেলো। প্রধান সড়কের পাশে আমার বাড়িটি মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হলো। ‘হে খোদা, তুমি কোথায় মুখ লুকাবে? তোমাকে অšে¦ষণ করার পথ যে আমি হারিয়ে ফেলেছি।’
এ পৃথিবী আমার বেঁচে থাকার সকল প্রয়াসকে চিরতরে বিঘ্নসংকুল করে দিয়েছে। মুসলিম নওয়াবদের দরবার হতে বিমুখ হয়ে ফেরার পর আমি হিন্দু রাজন্যবর্গের মধ্যে আমার পৃষ্ঠপোষক পেলাম। রাজা যুগল কিশোর ও রাজা নাগর মল কাব্যরসিক ছিলেন। উভয়েই আমার কাছে তাদের কবিতা পাঠালেন সংশোধনের জন্য। যাদের কৃপার ওপর নির্ভর করতো আমার আহার্যের সংস্থান, সে সব ধনবান বিলাসী ছন্দকারের কবিতা সংশোধনের কাজ তো আমার নয়। যাদের অনুগ্রহ ভিক্ষায় আমি হস্ত প্রসারিত করতাম তাদের অনুপস্থিতিতে আমার হাত তো অবশ হয়ে আছে।
দিল্লী এখন অভিশপ্ত নগরী। ১৮৫৯ সালের শীতকালে নওয়াব ইমাদুল মুলক এর দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ পুত্র মির্জা আবদুল্লাহ আলী গওহর অযোধ্যায় পালিয়ে নিজেকে দ্বিতীয় শাহ আলম হিসেবে ঘোষণা করলেন (সম্রাট বাবরের সপ্তদশ উত্তরাধিকারী)। হে, বিশ্ব সম্রাট, কোথায় তোমার সাম্রাজ্য।
চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিল্লীতে আমার দিনগুলো কাটছিল। আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে স্থির করলাম যে, দিল্লীতে বাস করার চাইতে গ্রামের দিকে হিন্দু জাঠদের মধ্যে বাস করা নিরাপদ। প্রতি ছয় মাসে ছন্নছাড়ার মতো স্থান পরিবর্তনের চেয়ে এটা উত্তম।
সুরাজ মল জাঠের শাসনাধীন ভরতপুরে গেলাম। মারাঠা বাহিনী আহমদ শাহ আবদালীর অগ্রাভিযান প্রতিহত করার জন্য দিল্লীর দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে রওয়ানা হবার পূর্ব পর্যন্ত আমি সেখানেই ছিলাম। ১৭৬১ সালের ১৭ই জানুয়ারি খবর পেলাম যে, মাত্র দু’দিন পূর্বে পানিপতে আফগানরা মারাঠাদের পরাজিত করে তাদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে পালিয়ে আসা মারাঠারা গুজ্জার ও জাঠদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নিহত ও লুণ্ঠিত হলো। আফগানদের দিল্লী ত্যাগ এবং দিল্লীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত ভরতপুরেই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিলাম। ছয় মাস পর আমি গৃহে প্রত্যাবর্তন করার উদ্যোগ গ্রহণ করলাম।
১৭৬১ সালের গ্রীষ্মকালের ঘটনা আমি দিনপঞ্জীতে এভাবে বর্ণনা করেছি, “আমি আমার প্রিয় নগরীতে ফিরে এলাম। সর্বত্র ধ্বংসলীলার দৃশ্যে আমার চোখ অশ্রুসজল হলো। প্রতিটি পদক্ষেপে আমার শোক ও উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কোন গৃহ শনাক্ত করার উপযোগী কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অথচ এসব তো আমার পরিচিত স্থান। সাবেক বাসিন্দাদের কোনো খোঁজ নেই। ঘরবাড়ি ধ্বংসস্তূপ। প্রাচীর ভেঙ্গে পড়েছে। মন্দির ও পানশালা পরিত্যক্ত। চারদিকে ভয়াবহ শূন্যতা। এক সময় নিজেকে সেই ভিটার ওপর আবিষ্কার করলাম, যেখানে কিছুদিন আগেও বাস করেছি। পিছনে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা স্মরণ করলাম। বন্ধুদের সঙ্গে সান্ধ্য সমাবেশ, কবিতা আবৃত্তি, প্রেমিকের ভূমিকা পালন, স্ন্দুরী রমণীর প্রেমে কাতর হয়ে ক্রন্দন, তাদের উদ্দেশ্যে কবিতা রচনা এবং যাদের দীর্ঘ বেণী আমাকে বন্দী করে রেখেছিল তাদের সাহচর্যের কথা মনে উঁকি দিলো। তখন সত্যিই আমি জীবন কাটিয়েছি, প্রেম করেছি। সেখানে আর কী অবশেষ আছে? এমন কোন হৃদয় নেই, যার সাথে বাক্য বিনিময়ে আনন্দঘন কয়েকটা মুহূর্ত অতিবাহিত করি। গলি হতে বের হয়ে আমি জনহীন রাস্তায় দাঁড়ালাম। ধ্বংসের দৃশ্য আমাকে নিথর করে দিয়েছে। প্রতিজ্ঞা করলাম, যতদিন বেঁচে থাকবো, এখানে আর ফিরে আসবো না। নগরীর পরিত্যক্ত গলিতে ধুলির পুরু স্তর পড়েছে। অথচ এমনও দিন গেছে, যখন নগরবাসী পথে সোনা কুড়াতো। রাজা নাগর মল আমার প্রতি অনুগ্রহ প্রত্যাহার করলেন। তাতে আমার কিছু আসে যায় না। তাদের সংশোধনের অযোগ্য কবিতাগুলো আমাকে আর সংশোধনের বৃথা চেষ্টা করতে হবে না। আমার কোন সহায় সম্পদ নেই। আমি রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতাম। অভিজাতদের গৃহদ্বারে করাঘাত করতাম। কবি হিসেবে আমার খ্যাতিই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
প্রার্থনা করলাম, দিল্লী নগরীকে আর যেন অভিশপ্ত আফগানদের দেখতে না হয়। আবদালীর সৈন্যরা আটক করা উট ও হাতির বহন ক্ষমতার চেয়ে বেশি লুট করেছিল। তাদের রাজাকে তারা বলেছিল যে, ‘তিনি যদি নিতান্তই হিন্দুস্থানে থাকতে চান তাহলে তাকে স্বীয় উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় থাকতে হবে। আবদালী বুদ্ধিমানের মতোই কেটে পড়লেন। তার আগে বিধ্বস্ত ভূখন্ডের শাসন পরিচালনার একটা ব্যবস্থাও করলেন।
হামলাকারী আফগানরা এতো উদ্ধত ও অহঙ্কারী হয়ে পড়েছিলো যে, আল্লাহ তাদেরকে সমাজের নিম্নশ্রেণীর জনগোষ্ঠী শিখদের হাতে লাঞ্ছনার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে মনস্থ করেছিলেন।
চল্লিশ হতে পঞ্চাশ হাজার শিখের এক বিশাল বাহিনী আফগানদের পশ্চাদপসারণের রাস্তা বন্ধ করে দিল। যুদ্ধে তারা এমন সাহসিকতা প্রদর্শন করলো, যার নজির খুবই কম আছে। গুরুতর আহত শিখও পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেনি। দলবদ্ধ শিখরা ক্ষিপ্রগতিতে কাজ সম্পন্ন করেছিল। বিক্ষিপ্ত আফগান সৈন্যদের ঘেরাও করে শিখরা তাদের ওপর তরবারি চালাতো। সূর্য অস্তমিত হওয়ার সাথে সাথে তারা ঝাঁপিয়ে পড়তো আফগানদের উপর আর ভোরের আলো ফোটার সাথে অদৃশ্য হয়ে যেতো। আফগান জীবনকে তারা নরকতুল্য করে তুলেছিল। পালিয়ে জীবনরক্ষা করাটাও অসম্ভব ব্যাপার। শিখদের কেশ ও শশ্রƒ দীর্ঘ। ফলে দেখতে তারা অস্বাভাবিক। কখনো কখনো তারা এলোচুলে আফগানদের সামনে হাজির হয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতো। রাতভর অদ্ভুত কান্নায় আচ্ছন্ন করে রাখতো। শিখ পদাতিক লড়ছে আফগান অশ্বারোহীর সংগে। আফগান অশ্বের জিন দ্বিখন্ডিত হচ্ছে শিখের তরবারির আঘাতেÑএই ছিল সাধারণ দৃশ্য। সংক্ষেপে বলা যায়, আফগানরা শিখদের হাতে এমনভাবে পর্যুদস্ত হলো, যা ইতিপূর্বে কখনো শ্রুত হয়নি বা দেখাও যায়নি। শেষ পর্যন্ত আফগানদের যুদ্ধ-সাধ পূরণ হলো। তাদের জন্য সর্বোত্তম পথ উন্ম্ক্তু ছিল জীবন নিয়ে পলায়ন এবং হিন্দুদের হাতে রাজ্যের শাসনভার অর্পণ।
শিখ সৈন্যরা তাদের মর্জি মোতাবেক রাজমুকুট ও সিংহাসনের দায়িত্ব ন্যস্ত করার লক্ষ্যে আফগানদের উপর চড়াও হয়ে তাদেরকে আটক নদী পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে গেল। অতঃপর তারা পাঞ্জাবে প্রত্যাবর্তন করে আবদালীর নিয়োজিত পাঞ্জাবের হিন্দু শাসককে হত্যা ও নিজেদের হাতে শাসনভার গ্রহণ করলো। এরপর দিল্লীর দিকেও তারা রক্ত চক্ষু ফেরালো। ভাগ্য বিড়ম্বিত সুন্দর নগরীর উপর বারবার বর্বরতার আগমনের চাইতে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে।
ভারি মেঘের মতো আমি ভেসে বেড়াচ্ছিলাম বছরের পর বছর ধরে। দিল্লীতে একসময় আমার আবাস ছিল। কিন্তু আমার ও পরিবারের জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় আহার্য দিল্লী আমাকে দিতে পারলো না। আমি ভরতপুরে দ্বিতীয়বার আশ্রয় নিলাম। আমাকে একনজর দেখার আশায় দক্ষিণ-পূর্ব ও পশ্চিম থেকে লোকজনর আগমন হচ্ছিল। আমার কবিতা শুধু উত্তরের সমতলেই সীমাবদ্ধ ছিল না। দাক্ষিণাত্যেও সজীব হয়ে বিকশিত হয়েছিল। লোকেরা আমার কবিতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলো।
কিন্তু শুধু প্রশংসা বাক্য দিয়ে ক্ষুধা নিবারিত হয় না। আমি জানতাম, বেঁচে থাকার জীবন আমার মাত্র একটি। কিন্তু আমার আকাক্সক্ষা ও বাসনা শত সহস্র। কী করে আমি সে সব পূরণ করবো? আমি অনুভব করছি, আমার বয়সের বোঝা বাড়ছে এবং প্রবল বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠা মোমবাতির শিখার প্রতিও আমার আগ্রহ বেড়েই চলছে।
পারস্যবাসী, আফগান ও মারাঠাদের হামলার পর এবার জাঠদের পালা। আমার ভরতপুর অবস্থানকালেই রাজা সুরাজ মল তার বর্বর অনুচর বাহিনী নিয়ে আগ্রা ও দিল্লী লুণ্ঠন করলো। দিল্লীতে লুণ্ঠন করার মতো কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। বন্ধুদের চিঠিতে জানতে পেলাম, জাঠ বর্বরতা পারস্যবাসী নাদির শাহের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিল। দিল্লীর একমাত্র ভরসা নওয়াব নজীবুদ্দৌলা। তিনিই শিখ ও জাঠদের কোণঠাসা করে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
১৭৭০ সালে নজীবুদ্দৌলার ইন্তেকালের পর দিল্লীরও আর কোন আশা রইলো না। মাত্র চার বছর পূর্বে আবদালীর হাতে পানিপতে চরমভাবে নিগৃহীত মারাঠারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। জাতি হিসেবে মারাঠা ও শিখরা অভিশপ্ত হলেও দৃশ্যত: মনে হ্িচ্ছল তারাই দিল্লীর শাসক হবে। আল্লাহ নিশ্চয়ই এ ধরনের বিপর্যয় থেকে আমাদেরকে রক্ষা করবেন। দীর্ঘ দশটি বছর ধরে গৃহহীন যাযাবরের মতো আমি এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরছিলাম। সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম যখন দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করলেন, তখন আমি প্রধান উজীর মির্জা নজফ খানের কাছে আমার বাসনার কথা নিবেদন করলাম। তিনি পারস্যবাসী শিয়া মুসলমান। মায়ের শিয়া মতবাদের প্রতি আস্থার কারণে আমিও নিজেকে তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবলাম। মির্জা একজন খ্যাতনামা ‘জুলফিকারুদ্দৌলা’-তরবারির যাদুকর। তিনি আগ্রাকে জাঠমুক্ত করলেন। শিখ ও রোহিলাদেরকে বাধ্য করলেন পিছু হটতে। মারাঠারা তাঁর সাথে তরবারির মোকাবিলা করতে সাহসী হচ্ছিল না। আল্লাহ তাঁর তরবারিকে চিরবিজয়ী রাখুন। কিন্তু আল্লাহর তেমন ইচ্ছা ছিল না। ১৭৮২ সালের গ্রীষ্মে মির্জা নজফ খান ইন্তেকাল করলেন। তাঁকে নওয়াব সফদর জং-এর স্মৃতিসৌধের সামনাসামনি এক উদ্যানে দাফন করা হলো। ধ্বংসের রক্তমাখা ছুরিকা আরেকবার খাপমুক্ত হলো। মির্জা নজফ খানের পালিত পুত্র মির্জা আফরাসিয়াব এর নিকট হতে ক্ষমতা কেড়ে নিলেন। নজফ খানের ভ্রাতুষ্পুত্র মির্জা শফি আফসারিয়াবের ভাড়াটে ঘাতকের হাতে নিহত হলো। এরপর শুরু হলো হত্যালীলা। খুন খারাবি ছাড়া একটা দিনও যেতো না। কয়েক মাস পর মির্জা শফির ভাই এর হাতে নিহত হলো আফসারিয়াব। কারো নিরাপত্তা ছিল না।
দিল্লী আমাকে খ্যাতি দিলেও ভাগ্য খুলে দেয়নি। ক্ষুধা, নিরাপত্তাহীনতা আমাকে প্রিয় নগরী দিল্লী থেকে লক্ষেèৗতে যেতে বাধ্য করলো। নওয়াব আসাফুদ্দৌলা অনুগ্রহ দেখিয়ে আমাকে স্বাগত জানালেন। তিনি আমার পরিবারের জন্য কিছু ভাতাও মঞ্জুর করলেন। নিজেদের শিষ্টাচার ও মার্জিত ভাষণের জন্যে গর্বিত লক্ষেèৗবাসীর প্রথম মাহফিলে আমার পানে ফিরেও তাকালো না। তারা আমার বিরাট পাগড়ী ও শিথিল বেশবাসের প্রতি অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখছিল এবং জানতে চাইছিল, কোত্থেকে এ ভুবনে আমার উদয় হলো। আমার সামনে যখন মোমবাতি রাখা হলো, আমি তাদের উপযুক্ত জবাব দিলাম-
“তোমরা, এই পূর্বাঞ্চলের লোকগুলো
আমাকে ভিখারীর দশায় দেখে
বিদ্রƒপ করছো-এবং জানতে চাইছো
পৃথিবীর কোথা হতে তুমি এলে?
কোত্থেকেÑ
আমাকে বলতে দাও
এক সময় সেখানে সুন্দর এক নগরী ছিলো
বিশ্বের সকল সেরা নগরীর মধ্যে
এর খ্যাতি ছিল সর্বোচ্চ
সে নগরী এখন ধ্বংস এবং নিঃসঙ্গ
আমি যে নগরীর অধিবাসী
তার নাম দিল্লী।”
লক্ষেèৗবাসীরা আমাকে বুঝতে পারলো না। আমিও তাদের বুঝলাম না। কিভাবে আমি এই অদ্ভুত ভূখন্ডে আমার কাহিনী বয়ান করবো? যে ভাষায় আমি কথা বলি, তারা তার মর্ম বুঝতে পারে না। তারা জানে না যে, মীর তকীর প্রতিটি শব্দের অর্থ ছাড়াও ভিন্ন একটি অর্থ আছে। দিল্লীর সাধারণ মানুষ আমার ভাষা সহজে বুঝতো। ও মীর, এই মৃতের সমাবেশে কথা বলতে দ্বিধা কেন? আমার ক্রন্দসী চোখ হতে নদীর ধারার মতো অশ্রু ঝরছিল। আমার হৃদয়ও দিল্লীর মতো বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। গোলাপ ফুল নতুন করে প্রস্ফুটিত হলেও আমাকে কোন আনন্দই দিতে পারবে না। গোলাপ কণ্টকও পারে না আমাকে ব্যথা দিতে। মন বলছিল, আমাকে দিল্লী ফিরতে হবে, যেখানে আমি প্রেমে নেশাগ্রস্তের মতো কাটিয়েছি এবং হৃদয় শোনিতের গোলাপ-লাল শরাব পান করেছি। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমার রচিত কবিতা স্মরণ করলাম-
‘তোমার ফোস্কা পড়া পা নিয়ে
বিলাপ করছো-
আমার প্রিয় বন্ধু
দিল্লী এখনো বহু দূরে!”
দিল্লীর যে কোনো খবর সবার চোখে পানি আনার জন্যে যথেষ্ট। নাদির শাহ বা আবদালী নয়, মারাঠা, জাঠ কিংবা শিখরাও নয়। নাজিবুদ্দৌলার দৌহিত্র অত্যাচারী গোলাম কাদির এবং তার রোহিলা বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ আর সবাইকে ছাড়িয়ে গেল। এই যুদ্ধলিপ্সু দ্বিতীয় শাহ আলমকে অপমান ও সিংহাসনচ্যুত করে তাঁর চক্ষু উৎপাটন করলো। আল্লাহ তাঁকে জাহান্নামের আগুনে ভস্মীভূত করুক। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই বলতে পারেন আর কতদিন দিল্লীতে হত্যা ও লুটতরাজ চলবে। এভাবে চলতে থাকলে তো হত্যা করার জন্য নিহতদের পুনরুজ্জীবিত করতে হবে এবং পুনরায় লুটপাট করার জন্যে লুটের মাল ফিরিয়ে আনতে হবে। দিল্লী যেন জীবন্ত এক কঙ্কালে পরিণত হয়েছিল।
‘ভস্মে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত
প্রতিটি ভবন অগ্নিশিখায় জ্বলছিল
কতো সুন্দর একটি নগরীর
হৃদয়ের প্রেমে আগুন লেগেছিল।’
মারাঠাদের হাতে রোহিলারা চরমভাবে পরাজয় বরণ করলো। গোলাম কাদির জীবিত ধরা পড়লো। নিপীড়নের পর তাঁর শিরোñেদ করা হলো। তার জন্য কেউ এক ফোটা অশ্রুও বিসর্জন করলো না। দীর্ঘদিন পর আমার প্রতিপক্ষের জীবনাবসানে আমি শান্তি লাভ করলাম। এই ব্যক্তিটি আমার প্রিয় নগরীকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। সে কি তার সাজা পেয়েছে? দিল্লী কী আবার তার ঐশ্বর্যমন্ডিত দিনে ফিরে আসবে? একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন।
এই শোকার্ত বেদনার্ত পৃথিবীতে আমি ৮৮টি গ্রীষ্ম ও শীত প্রত্যক্ষ করেছি। আমার চোখের জ্যোতি ঘোলাটে হয়ে এসেছে। তিন বছরে আমি আমার পরিবারের তিনজন সদস্যকে হারিয়েছি। আমার পুত্র, কন্যা ও বিবি। এখন আমি লিখতে ও পড়তে অক্ষম। আমার এমন কেউ নেই, যার জন্যে আমার জীবিত থাকা প্রয়োজন। দিল্লী নগরীর ধূলিকণার সঙ্গে আমি আমার দেহের ধূলিও মিশিয়ে দিতে চাই। আমার সেই অন্তিম বাসনাও অস্বীকৃত হয়েছে। ভাগ্য আমাকে লক্ষেèৗর মাহফিলে নিয়ে এলো। সেখানে সাকী শরাব পরিবেশন করছিল। কিন্তু আমার পাত্রে বিষ ঢেলে দেয়া হলো। মীর তকী এখানে অবসর নেয়ার সুযোগ পেল না। তাঁকে পৃথিবীর উদ্যানগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহমান পানির মতোই চলতে হবে।
মৃত্যুর পথে যাত্রা সম্পর্কে মানুষ ভীতি সঞ্চারক কাহিনী কেন বলে, যখন এ পথে অনেকেই সঙ্গ দিতে চলেছে। মরণে আমার ভয়। আমার জীবনে দু’টি প্রেম এসেছিল- কামরুন্নিসা বেগম আর দিল্লী নগরীর সাথে। এক প্রেম আমাকে ধ্বংস করেছে। আরেকটি আমার জন্যে ধ্বংস হয়েছে। কোন কিছুর জন্যেই আমার আর জীবিত থাকার প্রয়োজন নেই। আমার দ্বৈত প্রেমের উদ্দেশ্যে ক’টি ছত্র রচনা করেছি-
“জীবনাবসানে আমি যখন
চোখ খুলবো,
আমার একমাত্র বাসনা হবে
তোমার মুখটা আরেকবার দেখার
আমার হৃদয়ের অলিন্দে
তোমার আবাস।
আমি লুণ্ঠিত স্থানে কোথায়
চোখ মেলবো।”
[মীর তকী মীর ১৮১০ সালে লক্ষেèৗতে ইন্তেকাল করেন। যেখানে তাকে দাফন করা হয়েছিল, এখন আর তার অস্তিত্ব নেই।]