আমি বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নই”

খাজা আহমদ আব্বাস (ক’দিন আগেই আশি বছর বয়স পূর্ণ করলেন বলিউডের ‘শাহেনশাহ’ অমিতাভ বাচচান। ছায়াছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার ঘটনাও বেশ নাটকীয়। দৈহিক উচ্চতা তাঁর অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেসব পরিচালকের কাছেই গেছেন, তারা তাকে বিদায় করেছেন যে নায়িকাদের জন্য তিনি অতি দীর্ঘ। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি কথা সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক খাজা আহমদ আব্বাসের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। পরিচালক তখন “সাত হিন্দুস্থানি” নামে একটি ছায়াছবি নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁকে কীভাবে “সাত হিন্দুস্থানি’র মধ্যে মুসলিম চরিত্রের একজনের অভিনয়ের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে খাজা আহমদ আব্বাস তাঁর আত্মজীবনী “আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ড” এ বর্ণনা করেছেন। এ ছায়াছবি দিয়ে অমিতাভ বাচচানের চলচ্চিত্রাভিনয়ের শুরু। এর আগে তিনি মৃণাল সেনের একটি ছবিতে শুধু কণ্ঠ দিয়েছিলেন। —আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু) খাজা আহমদ আব্বাস আত্মজীবনীতে লিখেছেন: “—- একজন ‘হিন্দুস্থানি’ রয়ে গেল, মুসলিম গোঁড়া উর্দুভাষী। আমি যেহেতু এই ছেলেগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন বয়সের ও ভিন্ন উচ্চতা বিশিষ্ট চেয়েছিলাম, অতএব একজন দীর্ঘ ও সুদর্শন তরুণের স্থান শূন্য ছিল। তাকে ছিপছিপে গড়নের হতে হবে। একদিন কেউ এক দীর্ঘ তরুণের ছবি এনে আমাকে দেখালো। আমি বললাম, “আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে দেখতে চাই।” “তিনি আগামী পরশু সন্ধ্যায় এখানে আসবেন।” আমার আবারও ধারণা হলো যে লোকটি বোম্বেতেই (মুম্বাই) আছেন, নিশ্চয়ই কোথাও চাকুরি করেন এবং সন্ধ্যার আগে কাজ থেকে অবসর পান না। তৃতীয় দিবসে সন্ধ্যা ঠিক ছ’টায় এক জন দীর্ঘদেহী তরুণ উপস্থিত হলেন। চুড়িদার পাজামা ও জওহর জ্যাকেট পরিধান…

সাত হাজার বছর আগে ভারতে মুসলিম ছিল না, সংঘাত ছিল

সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায় 5 হাজার বছর আগে ইসলামের জন্ম হয়নি। 5 হাজার বছর আগে পৃথিবীতে একটাও মুসলমান ছিল না। মাত্র দেড় হাজার বছর আগেই পৃথিবীতে একজনও মুসলমান ছিল না। অর্থাৎ পাঁচ হাজার বছর আগে এই ভারতবর্ষেও কোন মুসলমান ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু পাঁচ হাজার বছর আগে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধটা হয়েছিল। কাদের মধ্যে হয়েছিল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ? কৃষ্ণের সময়, দ্বাপর যুগের শেষে সনাতন ধর্মাবলম্বী একই পরিবারের রক্ত সম্পর্কিত ভাইয়ে– ভাইয়ে যে যুদ্ধ হয়েছিল, যে নারকীয় আত্মীয় নিধন নির্বিচারে আসমুদ্রহিমাচলের মানুষের চোখের সামনে সংঘটিত হয়েছিল তারই নাম কুরুক্ষেত্র। ইগোর লড়াই, ক্ষমতার লড়াই, কুৎসা, ষড়যন্ত্র, সিংহাসন দখলের রাজনীতি, প্রেম, যৌন ঈর্ষা, ব্যভিচার, বহুগামীতা, হত্যাযজ্ঞ– মহাভারত এই, বা হয়ত তার থেকে অনেক, অনেক বেশি কিছু, কিন্তু যাইইহোক, যে রক্ত গঙ্গা বয়েছিল তাতে মুসলিমদের কোন হাত ছিল না। রাম। আজ যে নামটাকে জপমালা বানিয়ে ভারতবর্ষ ক্রমশ সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ, দাঙ্গাবাজ হয়ে উঠছে, সেই রামের সময়, রামায়ণের সময়ও ভারতবর্ষে একজনও মুসলমান ছিল না। প্রায় 7000 বছর আগে রামের জীবনে কোন মুসলমান না থাকা স্বত্তেও রামকে প্রাসাদ রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজের পরিবারকে ফেলে, রাজসুখ ফেলে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। একে বলে Palace Ordeals. পৃথিবীতে একজন মুসলমান না থাকা স্বত্তেও রামকে স্বধর্ম, স্বজাতির মানুষের হাতে হেনস্থা হয়ে বনবাসে গিয়ে পর্ণ– কুটিরে থেকে, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, হিংস্র জন্তু জানোয়ারদের মাঝখানে সীতাসহ বসবাস করতে হয়। রাজা দশরথ মুসলমান ছিলেন না, কিন্তু তাঁর তিনজন রানী ছিলেন। এবং তিনি তার লিবিডোর কারণে বলুন, হৃদয়ের দুর্বলতার কারণে বলুন, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে বলুন সন্তানকে সাপ, শ্বাপদের মধ্যে, দৈত্য, দানো, রাক্ষস, খোক্ষসের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলেন। পার্টিসানের পর পূর্ব পাকিস্তান আর পাকিস্তান মিলে তৈরি হল একটা রাষ্ট্র। দুটো দেশই তৈরি হল মুসলমানদের জন্য। ভারতের মূল ভূখণ্ড হিন্দুদের ( সাংবিধানিক সেকুলার)। পূর্ব পাকিস্তান আর পাকিস্তান মুসলমানদের। কিন্তু ধর্মের মিল কী তাদের এক দেশ, এক জাতি হিসেবে বাঁচিয়ে রাখতে পারল? পারল না। ধর্মীয় ঐক্য বলে আদৌ যদি কিছু থাকে তা একটা প্রতিপক্ষ তৈরি করে নিয়ে কিছুকাল বজায় থাকে ঠিকই, কিন্তু সেই প্রতিপক্ষ সরে যাওয়ার পর ধর্মীয় ঐক্য ভূলুন্ঠিত হতে দশ মাস সময় লাগে না। ইতিহাস কি দেখাচ্ছে আমাদের? মুসলমানকে মুসলমানের হাতে তুলে দিয়ে কি হল তার পরিণতি? 30 লক্ষ হত্যা। 7 লক্ষ নারী ধর্ষণ। একটা এমন মুক্তি যুদ্ধ যার স্মৃতি এখনো গোটা বাংলাদেশকে তাড়া করে বেড়ায়। মুসলমান মানেই তার মানে মুসলমানের রক্ষাকর্তা নয়! মুসলমান মানেই তার মানে মুসলমানের মান, সম্মান, ধন, প্রাণের জিম্মা নয়! মুসলমানও মুসলমানের দুঃস্বপ্নের কারণ হতে পারে। নারী পুরুষের মধ্যে প্রেম, প্রীতি, শরীর, মন জড়িয়ে কি যে একটা ব্যাপার হয়। কিন্তু আবার ছাড়াছাড়িও হয়ে যায় কেমন। হিন্দু ছেলে, হিন্দু মেয়ে। তাও ডিভোর্স হয় কেন? মুসলিম ছেলে, মুসলিম মেয়ে। তাও তালাক হয় কেন? তার মানে হিন্দু বা মুসলিম হওয়াটাই এক সঙ্গে থেকে যাওয়ার একমাত্র ক্রাইটেরিয়া নয়? হিন্দু বা মুসলিম হওয়াটাই সম্পর্কে টিকে থাকার একমাত্র যোগ্যতা নয়? ধর্ম এক হওয়ার পরও এত বিরোধ তৈরি হয়? ধর্ম এক হয়েও এত বিশ্বাসঘাতকতা করে মানুষ একে অন্যের সঙ্গে? এত ক্ষতি করে? এত আঘাত দেয়? দেয়। কারণ ধর্মের মিল আসলে একটা মিথ্যে মিল। সাজানো ব্যাপার। ধর্মের মিল বলে আসলে কিছুই হয় না। ধর্মের মিল মনের মিল তৈরি করতে পারে না। একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যদি নিজেকে জিজ্ঞাসা করি সমস্ত জীবনে যতবার অপমানিত হয়েছি, যতবার প্রবঞ্চিত হয়েছি, যতবার আমার মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে গেছে, যতবার আমার স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যত অন্যায় হয়েছে আমার সঙ্গে, অফিসে, কলেজে, কোর্ট–কাছারিতে, বাসে, ট্রামে, পুলিশ স্টেশনে, পরিবারের ভেতরে,বাইরে– সমস্ত খারাপ ব্যবহার, যাবতীয় অসভ্যতা, কূটকচালি, নোংরা সম্ভাষণ – যা যা সহ্য করতে করতে আমাকে পথ চলতে হয়েছে, সব কিছুই কি আমার কাছে মুসলিমদের কাছ থেকে এসেছিল? তাই কি আসে? নাহ! মুসলমানরাও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এই একই প্রশ্ন করুন নিজেকে। দেখবেন উত্তর হবে একই। না। না। আর না। দেখবেন আপনার জীবনের যাবতীয় অভিশপ্ত ঘটনার দায় হিন্দুর নয়। দেখবেন আপনার চারপাশের যে মানুষ গুলোর ব্যবহারে কান্না গলায় এসে আটকে গেছিল তারা সবাই হিন্দু ছিল না। 7000 বছর আগেও ভাইয়ে ভাইয়ে মিল ছিল না। আজও নেই। পরেও থাকবে না। ক্ষমতা, অর্থ, ধনসম্পত্তি, নারী– এসব নিয়ে মানুষে মানুষে ক্ষমতা দখলের প্রলয় চলবেই। তারপরও শুধু রাজনীতি পয়েন্ট আউট করে দেবে Hindu’s eniemy Muslim, Muslim’s eniemy Hindu.

কোথায় যাবো, কী হবে, কী খাবো

গোলাম মাওলা রনি ব্যক্তিগত জীবনে আমি খুবই আশাবাদী মানুষ। হতাশা-ভয়-আতঙ্ক আমাকে সচরাচর তাড়া করে না। সব পরিস্থিতি মেনে নেয়া ও সর্বদা সন্তুষ্ট থাকার যে নীতিকথা আমি সারাটি জীবন অনুসরণ করেছি তা হাল আমলে এসে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা খাচ্ছে। প্রকৃতি-পরিবেশ-অর্থনীতি-রাজনীতি-সমাজ-পরিবার ও নিজের শরীর স্বাস্থ্যের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রবল চেষ্টা প্রায় প্রতিদিন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জীবন-জীবিকার প্রতিটি উপসর্গ ও অনুসর্গ পরস্পরবিরোধী হয়ে পড়েছে। আহার-বিশ্রাম-নিদ্রা ও কাজকর্মের মধ্যে সমন্বয় হচ্ছে না। আয়ের সাথে ব্যয়ের অমিল ও নিজের পাঁচটি ইন্দ্রিয় যেভাবে ক্ষমতাধর মিথ্যুকদের দিয়ে হররোজ বলাৎকারের শিকার হচ্ছে তাতে করে আমার মনুষ্য জীবন ও বনবাদাড়ের অন্য প্রাণীদের জীবনের মৌলিক পার্থক্যগুলো ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। আমি আমার ব্যক্তিগত সমস্যার সাথে প্রায়ই পাড়া প্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যাগুলো মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। কাঁচাবাজারের মুদির দোকানি, ফুটপাথের হকার, রিকশাওয়ালা, সরকারি কর্মচারী, সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী-আমলা-সাংবাদিক-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীসহ অন্যান্য শ্রেণিপেশার মানুষের সাথে যতই মতবিনিময় করি ততই ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। কারো মুখে কোনো সান্ত্বনার বাণী অথবা সাম্প্রতিক সময়ে কারো চমকপ্রদ সফলতার কথা শুনতে পাই না। সবার মনে সীমাহীন বেদনা-অজানা আশঙ্কা। অনিশ্চয়তা ও ক্ষোভ ক্রমেই বাড়তে বাড়তে এখন প্রতিটি আদম সন্তানকে দেখলে মনে হয়- তারা জীবন্ত ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের ওপর বসে আছে। কয়েক দিন আগে রিকশায় বাসায় ফিরছিলাম। মাত্র মাসখানেক আগে রিকশা ভাড়া ছিল সর্বোচ্চ ৭০ টাকা। কিন্তু সেদিন যে ক’জন রিকশাওয়ালার সাথে দরাদরি করছিলাম তারা সবাই বললেন, ১২০ টাকার নিচে কেউ যাবেন না। রংপুর…


যে কল্পকাহিনি নিছক কল্পনা নয়

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বিশ শতকে লেখা দুটি কল্পকাহিনির নাম আমরা অনেকেই জানি। একটি জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ এবং আরেকটি অল্ডাস হাক্সলির ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’। দুটিই ডিসটোপিয়া অর্থাৎ আমরা যাকে ইউটোপিয়া বা স্বর্গরাজ্য বলি, তার উল্টোটা। তবে এই দুটি বইয়ের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। এর কারণ, অরওয়েলের মাথায় ছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র আর হাক্সলি ভেবেছেন প্রযুক্তিশাসিত রাষ্ট্রের কথা। সেই হিসেবে হাক্সলিই এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। এর ঘটনাগুলো ঘটে ভবিষ্যতের প্রযুক্তিশাসিত লন্ডন শহরে। সেখানে মানুষের জন্মটাও নিয়ন্ত্রিত। কে কোন জাতের মানুষ হবে, সেটা জন্ম থেকেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয় বৈজ্ঞানিকভাবে। সে অনুযায়ী, তাদের বুদ্ধিমত্তা, চাকরি-বাকরি, ভোগবিলাসের ধরনও ঠিক হয়ে যায়। সেই সমাজে একগামিতা অবৈধ এবং শারীরিক সুখভোগই সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বার্নার্ড মার্ক্স একজন আলফা প্লাস মানের উচ্চ শ্রেণির বিশেষজ্ঞ। একসময় তার আর এ সমাজকে ভালো লাগে না। সে শহর থেকে বেরিয়ে ‘স্যাভেজ রিজার্ভেশন’ বলে একটা জায়গায় যায়। ওখানে জন নামের একজন তরুণের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে সে জানতে পারে, সে তাদের ডিরেক্টরের সন্তান। একগামিতা অবৈধ বলে জনকে ডিরেক্টর তার সন্তান বলে পরিচয় না দিয়ে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে। জনকে বার্নার্ড তাদের মূল সমাজ ‘ওয়ার্ল্ড স্টেট’-এ নিয়ে আসে। জন এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না এবং সে এমন কিছু কাজ করে, যার কারণে বার্নার্ড ও তার বন্ধুকে নির্বাসনে যেতে হয়। আর সে নিজে আত্মহত্যা করে। বলাবাহুল্য, এই সামান্য বর্ণনা বই দুটো বোঝার জন্য…

ফেরাউনের আমলা আর বাংলাদেশের আমলা

ডা. জাহেদ উর রহমান আমলা প্রসঙ্গে ফেরাউনের কথা আমাদের সামনে এনেছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী, মনে আছে আমাদের? মন্ত্রীর এই উক্তি প্রসঙ্গে আলোচনায় আসবো কলামের শেষদিকে। আমলাদের প্রসঙ্গে তার উক্তি মাথায় এলো কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে আমলারা নানা কারণে আলোচনায় আসছেন, আলোচনায় থাকছেন। ৪৩ কোটি টাকা দিয়ে দু’টি বাড়ি তৈরি করার প্রস্তাব সার দেশে অকল্পনীয় রকম সাড়া ফেলেছিল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বারংবার দেয়া দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাসকে সামনে রেখে বাড়ি দু’টির যে বর্ণনা আমাদের সামনে এসেছে, সেটাকে ছোটখাটো প্রাসাদ বলাই যায়। না, আমার এই কলামে এই প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করছি না। প্রসঙ্গটি নিয়ে নানা বিশ্লেষণ এবং মতামত প্রকাশিত হয়েছে নানা পত্রিকায়। আমি বরং এই বাহানায় গত বেশ কয়েক বছরে মূলত প্রশাসনের আমলাদের কিছু প্রবণতা এবং তাদের বিষয়ে রাজনৈতিক সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলাপ করতে চাই। বছর দেড়েক আগে বেশ হাঁকডাক করে ৫০টি মডেল মসজিদ উদ্বোধন করা হয়েছিল। এই রকম মসজিদ নির্মাণ করা হবে সর্বমোট ৫৬০টি। মসজিদগুলো নির্মিত হচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে। সে সময়ে এগুলো পরিচালনার জন্য ‘মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সংস্কৃতি কেন্দ্র পরিচালনা নীতিমালা-২০২১’ তৈরি করা হয়। এতে দেখা যায় উপজেলা, জেলা পর্যায়ে অবস্থান অনুযায়ী মসজিদ পরিচালনা কমিটির প্রধান হবেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা প্রশাসক। তারাই মসজিদ পরিচালনা করবেন এবং তারাই মসজিদের জনবল নিয়োগ দেবেন। এই সিদ্ধান্তে তখন তীব্র নাখোশ  হয়েছিল ইসলামিক ফাউন্ডেশন। স্বভাবতই সংস্থাটির লোকজন ভেবেছিলেন মসজিদগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব তারাই পেতে যাচ্ছেন। তারা দাবি করেছিলেন দেশের প্রতি জেলায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অফিসের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। ইসলামিক মিশন,…

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ডা. ওয়াজেদ খান  সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি নিতান্তই আপেক্ষিক। রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক আচরণে কতোটা অভ্যস্থ; আইনের শাসন ও সামাজিক ন্যায় বিচারের ভিত্তি কতোটা মজবুত; মানবিক মর্যাদা বোধের সার্বিক মুল্যায়নের উপর নির্ভর করে বিষয়টি। এসবের অভাবে আধুনিক তথ্য প্রবাহের যুগেও হোঁচট খায় বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা। ফলে দেশে দেশে সাংবাদিকরা নিপীড়ন, নির্যাতন ও গুম-হত্যার শিকার হচ্ছেন। রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারস’র তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে বিশ্ব জুড়ে ৫০ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। সর্বশেষ সাংবাদিক নির্যাতনের নজিরবিহিন ঘটনা ঘটেছে ইউরোপে। বেলারুশ সরকারের সমালোচনা করায় দেশটির সাংবাদিক রোমান প্রোতোসেভিচকে লিথুনিয়াগামী বিমান থেকে নামিয়ে নিয়েছে। এজন্য বেলারুশের আকাশ সীমায় বিমানটিকে জরুরী অবতরণে বাধ্য করা হয় বোমা বহনের মিথ্যা অভিযোগে। অপরদিকে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গোপন নথি চুরির অভিযোগে গ্রেফতার ও কারাবরণ করতে হয় সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে। প্রথম আলো’র সিনিয়র ও অনুসন্ধানী রিপোর্টার রোজিনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি সংক্রান্ত কয়েকটি রিপোর্ট করেছেন সম্প্রতি। এসব কারণে মন্ত্রণালয়টির বিরাগভাজন আমলাদের কড়া নজরদারিতে ছিলেন রোজিনা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আরো অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে সম্প্রতি সচিবালয়ে গেলে তাকে আটকে ফেলেন আমলারা। দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা ধরে চলে নির্যাতন তার উপর। এমনকি আক্রোশ থেকে চেষ্টা করা হয় রোজিনার কন্ঠরোধের। রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরির অভিযোগে গ্রেফতার হন রোজিনা। মামলা, থানা হাজতের পর তার গন্তব্য হয় কাশিমপুর কারাগার। রোজিনা ইসলামের সাথে রাষ্ট্রীয় এ ধরণের আচরণ নূতন কিছু না হলেও দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সাংবাদিক সমাজ রুখে দাঁড়ায় এ ঘটনার প্রতিবাদে। রোজিনার নিঃশর্ত মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে…

জালালুদ্দীন রুমির মসনবী’র গল্প

জালালুদ্দীন রুমি অনুবাদ : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু জ্ঞানী পাগলএক তরুণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে এখন তার বিয়ে করার সময়, কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলেন না। যেহেতু তিনি গুরুতর কোনো ভুল করতে চান না এবং যেহেতু তিনি জানেন যে বিয়ে করার জন্য একজন কনে নির্বাচন করা কারও জীবনের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, অতএব তিনি এ ব্যাপারে তার চেয়ে বিজ্ঞ কারও সঙ্গে পরামর্শ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তিনি পুরো শহর অনুসন্ধান করলেন এবং পরিচিত সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। অবশেষে একজন তাকে বললেন: “আমাদের শহরে মাত্র একজন জ্ঞানী ব্যক্তি আছেন এবং তিনি বৃদ্ধ মানুষ, যিনি বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধূলা করেন!”লোকটিকে খুঁজে পেতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়নি, তাকে না পাওয়া গেলেই বরং কঠিন মনে হতো। শহরের কেন্দ্রস্থলের মূল চত্তরে তিনি একটি দীর্ঘ বাঁশের লাঠিতে ওঠে, যেন বুনো ও উচ্ছৃঙ্খল ঘোড়া দাবড়ে বেড়াচ্ছেন এমন ভান করে একদল ছোট বাচ্চাকে তাড়া করে তার দিন কাটিয়ে দেন। তরুণ তাকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে সতর্কতার সঙ্গে তার কাছে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবলেন। “হে মহান ঘোড়সওয়ার, আপনি কি মেহেরবানি করে আপনার ঘোড়াটি মুহূর্তের জন্য আমার কাছে আনবেন,” অনেকটা মরিয়া হয়েই তিনি অনুনয় করলেন।“জলদি করো এবং তোমার কাজের কথা বলো,” লোকটি আনুষ্ঠানিকতার সুরে উত্তর দিলেন। “তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো যে, আমার ঘোড়া বুনো এবং বেপরোয়া। তুমি যদি সামান্য নড়াচড়া করো, তাহলে ঘোড়াটি তোমাকে লাথি মারবে,” তিনি সতর্ক করলেন।“আমি বিয়ে করতে চাই, কিন্তু এ সম্পর্কে আমি অনভিজ্ঞ, সেজন্য আমার…

কবি মীর তকী মীর

কবি মীর তকী মীর

খুশবন্ত সিংঅনুবাদ: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু আমি জানিনা, আমার মধ্যে কোন্ গুণটি অধিক- একজন প্রেমিকের, না একজন কবির। আমার মধ্যে প্রেম ও কবিত্ব দুটোই আছে। হৃদয়ঘটিত একটি ব্যাপার আমার বদনামের কারণ হয়েছে। কবিতা গোটা হিন্দুস্থানে আমার সুনাম ছড়িয়েছে। প্রেম আমাকে দিয়েছে মানসিক যন্ত্রণা আর কবিতা আমার মধ্যে উত্তেজনার সুড়সুড়ি দিয়েছে। প্রেম বা কাব্যচর্চা হতে যে বস্তুটি আমি পাইনি, তা হচ্ছে অর্থ। আমি যা আয় করেছি তা আমার কথামালার সূত্র ধরে। আমি উপলব্ধি করেছি, সুন্দরভাবে কাঁটা হীরকখন্ড এবং কাঁচের টুকরার মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারে না এমন লোকের সমাজে বাস করে আমাকে কী ভোজন করতে হবে তা স্থির করার কৌশল সুচারুভাবে রপ্ত করার চাইতেও আমার পৃষ্ঠপোষকের মর্জিই অধিক কার্যকর। আমার দরবেশতুল্য আব্বা মীর মোহাম্মদ আলী একদিন আমাকে বলেছিলেন, “বেটা, আমি তোমার ভবিষ্যত সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। তোমার হৃদয়ে একটা আগুন জ্বলছে। আমার ভয় হচ্ছে, এই আগুন তোমাকে কী করে ফেলে।” আমার বয়স তখন মাত্র নয় বছর। তার কথা শুনে আমি হেসে ফেলেছিলাম। তার মধ্যে বয়সের প্রজ্ঞা ছিল। তিনি কেঁদেছিলেন, কারণ, তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, আমার মধ্যে প্রেমের যে আগুন জ্বলছে তা আমাকে প্রতিষ্ঠিত এবং ধ্বংস করবে। একদিন আসর নামাজ শেষে সন্ধ্যার দিকে আব্বা বললেন, “বেটা, পৃথিবীটা দ্রুত বদলায় এবং এর সাথে পাল্লা দেয়ার সময় খুব কম। তাছাড়া জিন্দেগীর রাস্তাটা বড়ই বন্ধুর। তোমাকে প্রতিটি কদম ফেলতে হবে হিসেব করে। যে সময়টুকু আছে তা নিজেকে জানতে কাজে লাগাও।” তখন আমার বয়স মাত্র দশ বছর। যা খুশি করার…

রবি কিরণ

বিলেকাসা ভোলার সাথে আমার পরিচয় অনেকদিনের। বলতে গেলে শিশুকাল থেকেই। ভোলা ছিল খুব কৌতূহল প্রিয়। যে কাজ অন্যে করতে ভয় পায় সেটা তার করা চায়ই। ভয় বলে ওর মনে কিছু ছিল না। আর ছিল উদার – চিন্তায় কোন ফাঁক ছিল না। ও আমার কাছে প্রায়ই আসতো। আমি চা বানাতাম বেলি ফুল ভেজানো পানি দিয়ে। চাটা আমরা খেতাম হালকা আর ঠাণ্ডা করে। বরফ মেশানো পানিতে বেলি ফুল ভিজিয়ে রাখতাম কতক্ষণ। তারপর কড়া চা ঢেলে দিতাম। চা-টা হয়ে যেত ঠাণ্ডা আর হালকা। এটা আমাদের দুজনেরই খুব প্রিয়। ভোলা সবসময় হাসিখুশি থাকলেও আজ ওকে দেখাচ্ছে কেমন বিষণ্ণ আর ক্লান্ত। চা বানিয়ে দিলাম, তাতেও কোন উৎসাহ পাচ্ছে না। বললাম এত চিন্তা কিসের। চা-টা খাও তারপর বল। এতক্ষনে বুঝতে পারলাম ওর কেন এত চিন্তা। চা খাওয়া শেষ হলে ও আর বসলো না। আমিও আর জোর করিনি। শুধু বললাম রবিকে আমার কাছে একবার পাঠাতে। যদিও আমরা কাছাকাছি বয়সের, ভোলা আমাকে খুব মানত। ও যখন ঠিক করলো কালাপানি পাড়ি দিয়ে ইংরেজদের দেশে যাবে, প্রথমেই এসে আমাকে বলল। আমি বললাম বেশত ঘুরে আসো। ও খুশী মনে চলে গেল। মনে হল ও সিদ্ধান্তটা আগেই নিয়েছে। আমার কাছে এসেছিল মরাল সাপোর্টের জন্য। ও ঠিকই একদিন ইংরেজদের দেশে গেল। ফিরে এসে ওর গল্প আর গল্প। তিনমাস ধরে একটানা বলে গেল ইংরেজদের কথা, মেমসাহেবদের কথা। আমার জন্য এনেছিল পশমি একটা সাদা সুয়েটার। যেমন সুন্দর আর তেমনি মোলায়েম। একদিন বিকালে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল।…

মা’র কাছে ফেরা

মুজতাহিদ ফারুকী বাঁ হাতের কব্জিতে ঝকঝকে রুপালি চেনে আটকানো রোলেক্সের অস্তিত্ব একটু আগেও অনুভব করছিলাম। কেউ একজন কেবলই সেটা খুলে নিলো। ব্যাক পকেট হাতড়ে নিয়ে নিলো অল লেদার ডানহিল মানিব্যাগটাও। ওতে হাজার দশেক টাকা আছে। কিছুই করার নেই। নকিয়া এন-৭০ সেটটা কেড়ে নিয়েছে একদম শুরুতে। বিভীষিকাময় এই দুঃস্বপ্নের রাতের তখনই শুরু। এখন ক’টা বাজে আমি জানি না। একটাও হতে পারে। দু’টোও।সবশেষ যখন বাঁ হাতের কব্জি উল্টেছি, রোলেক্সের বড় ডায়ালে মিনিটের কাটা তখন মধ্যরাতের জুড়ি ভেঙ্গে মাত্র পাঁচ ঘর এগিয়েছে। তারও প্রায় দশ মিনিট আগে থেকে ধানন্ডির ২ নম্বর সড়কের একটি গলিতে দাঁড়িয়ে আমি। খুব বিরক্ত লাগছে। ড্রাইবার খোকন জানিয়েছে, রাত সাড়ে ন’টায় সে মা’কে নামিয়েছে উত্তরায় নাজলির বাসায়। ছোট মেয়ের কাছে যাবার জন্য মা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। পাঠিয়ে দিয়েছি। ক’টা দিন নাজলির পুঁচকেগুলোর সঙ্গে কিটিকুটি খুনসুটি করে এলে একঘেঁয়েমি কাটবে। কিন্তু রাত সাড়ে ন’টার পর উত্তরা থেকে ধানমন্ডি দুই নম্বরে আসতে তো ১২টা বাজার কথা নয়। কেন দেরি হচ্ছে? হলোই যদি, জানাবে না! মোবাইলটা আছে কি করতে! চাকা পাঙচার, যানজট বা অন্য কোনো সমস্যা হলে ফোন তো করতে পারে! তা-ও করছে না। এর আগে ওকে অনেকবার বলা হয়েছে, কাজ হয়নি। ছেলেটা ফোন করতে ভুলে যায় অথবা কে জানে, হয়তো গরজই করে না ! এই নবাবপুত্রকে আজই ফাইন্যাল ওয়ার্নিং দিয়ে দেবো। হয় প্রয়োজনের সময় ফোনটা ব্যবহার করবে, না হয় চাকরি নট্। তার আগে, একবার ফোন করে দেখি। সেলফোনটা চোখের সামনে…