যে কল্পকাহিনি নিছক কল্পনা নয়

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক

বিশ শতকে লেখা দুটি কল্পকাহিনির নাম আমরা অনেকেই জানি। একটি জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ এবং আরেকটি অল্ডাস হাক্সলির ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’। দুটিই ডিসটোপিয়া অর্থাৎ আমরা যাকে ইউটোপিয়া বা স্বর্গরাজ্য বলি, তার উল্টোটা। তবে এই দুটি বইয়ের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। এর কারণ, অরওয়েলের মাথায় ছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র আর হাক্সলি ভেবেছেন প্রযুক্তিশাসিত রাষ্ট্রের কথা। সেই হিসেবে হাক্সলিই এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।

‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। এর ঘটনাগুলো ঘটে ভবিষ্যতের প্রযুক্তিশাসিত লন্ডন শহরে। সেখানে মানুষের জন্মটাও নিয়ন্ত্রিত। কে কোন জাতের মানুষ হবে, সেটা জন্ম থেকেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয় বৈজ্ঞানিকভাবে। সে অনুযায়ী, তাদের বুদ্ধিমত্তা, চাকরি-বাকরি, ভোগবিলাসের ধরনও ঠিক হয়ে যায়।

সেই সমাজে একগামিতা অবৈধ এবং শারীরিক সুখভোগই সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বার্নার্ড মার্ক্স একজন আলফা প্লাস মানের উচ্চ শ্রেণির বিশেষজ্ঞ। একসময় তার আর এ সমাজকে ভালো লাগে না। সে শহর থেকে বেরিয়ে ‘স্যাভেজ রিজার্ভেশন’ বলে একটা জায়গায় যায়। ওখানে জন নামের একজন তরুণের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে সে জানতে পারে, সে তাদের ডিরেক্টরের সন্তান। একগামিতা অবৈধ বলে জনকে ডিরেক্টর তার সন্তান বলে পরিচয় না দিয়ে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে। জনকে বার্নার্ড তাদের মূল সমাজ ‘ওয়ার্ল্ড স্টেট’-এ নিয়ে আসে। জন এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না এবং সে এমন কিছু কাজ করে, যার কারণে বার্নার্ড ও তার বন্ধুকে নির্বাসনে যেতে হয়। আর সে নিজে আত্মহত্যা করে।

বলাবাহুল্য, এই সামান্য বর্ণনা বই দুটো বোঝার জন্য যথেষ্ট নয়। তবে নেইল পোস্টম্যানের ‘অ্যামিউজিং আওয়ারসেলভস টু ডেথ’ থেকে পড়লে কিছুটা আন্দাজ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা ১৯৮৪-এর দিকে চোখ রাখছিলাম। যখন বছরটা এল এবং ভবিষ্যদ্বাণীটি ফলল না, সচেতন আমেরিকানরা আত্মপ্রশংসায় তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন। লিবারেল গণতন্ত্রের জয় হয়েছে। অন্য যেকোনো জায়গায় যদি কিছু ঘটে থাকে তো ঘটুক, আমরা তো অরওয়েলিয়ান দুঃস্বপ্নের মধ্যে পড়িনি।’ কিন্তু ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’-এর কথাটা একেবারে মিথ্যা হয়নি। সেখানে বলা হচ্ছে, আমাদের স্বাধীনতা, পরিপক্বতা কিংবা ইতিহাসকে কেড়ে নেওয়ার জন্য কোনো ‘বড় ভাই’-এর প্রয়োজন নেই। এমন দিন আসবে, মানুষ শোষিত হতেই বেশি ভালোবাসবে। যে প্রযুক্তি তার চিন্তার ক্ষমতা কেড়ে নেবে, তাকেই সে বেশি পছন্দ করবে।

অরওয়েল ভেবেছিলেন, শাসকেরা বইকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে। হাক্সলি বললেন, বই নিষিদ্ধ করার কোনো প্রয়োজনই হবে না, কারণ মানুষ আর বই পড়তেই চাইবে না। অরওয়েল ভেবেছিলেন, শাসকেরা আমাদের তথ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে। হাক্সলি বললেন, ব্যাপারটা হবে উল্টো। আমাদের এত তথ্য দেওয়া হবে যে আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাব। অরওয়েল ভেবেছিলেন, আমাদের কাছ থেকে সত্যকে লুকিয়ে রাখা হবে। হাক্সলি বললেন যে, না, সত্য প্রকাশ্যেই থাকবে, তবে তা এত অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের সঙ্গে মিশে যাবে যে তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। অরওয়েল ভেবেছিলেন, সংস্কৃতি হবে নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু হাক্সলি বলেন, না, তা হবে ঠুনকো। ‘১৯৮৪’-তে বলা হয়েছে কষ্ট দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। আর ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’-এ বলা হলো, মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে আনন্দদানের মাধ্যমে। মোট কথা, অরওয়েল ভেবেছিলেন, আমরা যা ভয় পাই, তাই আমাদের ধ্বংস করবে। আর হাক্সলির কথা হচ্ছে, আমরা যা আকাঙ্ক্ষা করি, সেটাই আমার শত্রু হয়ে দাঁড়াবে।

আমরা যদি নিজেদের জীবনের দিকে একবার ফিরে তাকাই, তো দেখব হাক্সলির কথাই বহুলাংশে ফলে যাচ্ছে। ফেসবুক, ইন্টারনেট, গুগলের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের চিন্তাচেতনা বা পছন্দ-অপছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেটা আমাদের খারাপ লাগছে না; বরং এত ভালো লাগছে যে আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে আমাদের দাসত্বকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমাদের যে চিন্তাক্ষমতা কমে যাচ্ছে, আমরা তাতেও খুশি। রাশি রাশি বিনা পয়সার সত্য-মিথ্যা তথ্যভারে আমরা এখন এমন ভারাক্রান্ত থাকি যে মনে হয় দম ফেলারই ফুরসত নেই, বই পড়া তো দূরের কথা। সেই বিশাল তথ্যভান্ডারে যে মিথ্যা তথ্যের সঙ্গে সত্য তথ্য মিশে নেই, তা নয়। তবে তাকে আলাদা করে চিনতে পারি না। এই বড় প্রতিষ্ঠানগুলো যখন আমাদের সময় নষ্ট করে, চিন্তাক্ষমতা কমায়, রুচি-আশা-আকাঙ্ক্ষা-প্রেম-ভালোবাসা নিয়ন্ত্রণ করে, আমরা চাইলেও কিছু করতে পারি না। কারণ, আমাদের দিকে নিরন্তর ধেয়ে আসা চটুল আনন্দপ্রবাহে আমাদের শরীর ও মন উভয়ে অবশ ও আবিষ্ট হয়ে থাকে।

‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শুধু যে অনেক বেশি সমসাময়িক তা–ই নয়, দিন দিন এর প্রাসঙ্গিকতা বাড়ছে। বইটা নিয়ে আমাদের দেশে আরও আলোচনা হওয়া উচিত। এর নিষ্ঠ পাঠে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও আমরা যে যন্ত্রের সম্মোহন থেকে মুক্ত হয়ে আমাদের যাপিত জীবনকে অল্পবিস্তর বুঝতে পারব, সেটা নিশ্চিত।

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক