মসজিদে বসে মদ পান করতে দাও (মির্জা গালিব)

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষার সকল বিখ্যাত মুসলিম কবি তাদের অসংখ্য কবিতায় মদ (শরাব) ও মদ পরিবেশনকারী বালিকাদের (সাকি) কথা বলেছেন। সূফি কবিতায় দুটিরই উপস্থিতি আরো বেশি। অথচ শরাব ও সাকির সঙ্গে ইসলামের দূরতম সম্পর্কও নেই। কবিরা মদ ও মাতাল হওয়াকে রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন, প্রকৃত মদ ও মাতলামির কথা বলেননি। প্রেমের মদ বা সুরা পানকে উল্লেখ করা হয়েছে আধ্যাত্মিকতার উন্মোচন এবং চিরন্তন সত্তাকে স্বীকার করার উপায় হিসেবে, যা আল্লাহর প্রতি পরম ভালোবাসার অভিব্যক্তি। আমি বেশ ক’জন বিখ্যাত উর্দু কবির কবিতাংশ তুলে ধরছি। আশা করি পাঠকদের ভালো লাগবে।


“জাহিদ, শরাব পিনে দে মসজিদ মে বৈঠ কর,
ইয়া ও জাগাহ বাতা’ জাহা পর খুদা না হো।”
— মির্জা গালিব
(পরহেজগার, মসজিদে বসে মদিরা সেবন করতে দাও,
তা না হলে বলো, কোথায় খোদা নেই?)


“গো হাথ কোন জামবিশ নেহি আখোঁ মে তো দম হ্যায়,
রেহনে দো আভি সাগর-ও-মীনা মেরে আগে।”
—- মির্জা গালিব
(আমার হাত স্থবির হয়ে গেলেও আমার চোখ এখনো দেখতে পায়,
আমার সামনে এখন রেখে দাও সুরাভর্তি সোরাহি ও পানপাত্র।)


“ওহ চিজ জিস কে লিয়ে হাম কো বেহিশ হ্যায় আজিজ
সিবায়ে বাদা-এ-গুফতাম-এ-মুশক-বু ক্যয়া হ্যায়।
— মির্জা গালিব
(যে বস্তুর জন্য এমনকি বেহেশত আমাদের এত প্রিয়,
সুরার এই সুগন্ধির কাছে মৃগনাভির সুবাসও ম্রিয়মান।)

৪.
“পিয়োঁ শরাব আগার খুম ভি দেখ লু দো চার,
ইয়ে শিসা-ও-কাদা-ও-কুজা-ও-সুবু ক্যয়া হ্যায়।”
—- মির্জা গালিব
(মদিরা পান করো, এবং দু’চার কলসি পান করে ফেলো,
কাঁচের ছোট্ট পানপাত্র, সোরাহির কথা বলে কী লাভ?)


“গালিব ছুট্টি শরাব পর আব ভি কভি কভি
পীতা হুঁ রোজ-এ-আবর-ও-শব-এ-মাহতাব মে।”
—মির্জা গালিব
(গালিব মদ্য পান বর্জন করেছে, তবে মাঝে মাঝে,
মেঘলা দিনে ও চাঁদনি রাতে এখনো পান করে।)


“পিলা দে ওআক সে সাকি জো হাম সে নফরত হ্যায়
পিয়ালা গর নেহি দেতা, না দে, শরাব তো দে।”
— মির্জা গালিব
(আমাকে ঘৃণা করলে তোমার অঞ্জলি দিয়ে পান করিয়ে দাও,
পানপাত্র দিতে না চাইলে দিয়ো না, কিন্তু সুরা তো দাও।}


বোতল খুলি হযরত-এ-ওয়াইজ কে ওয়াস্তে,
মারে খুশি কে কাগ ভি দো গজ উছাল গ্যয়ে।”
—-মির্জা গালিব
(আমি ধর্ম প্রচারকারীর সম্মানে বোতলের মুখ খুললাম,
খুশিতে বোতলের মুখ খুলে দুই গজ ওপরে ওঠে গেল।)


“কাহাঁ ম্যায় খানে কা দরওয়াজা ‘গালিব’ আউর কাহাঁ ওয়াইজ?
পর ইতনা জানতে হ্যায়, কাল ও জাতা থা কে হাম নিকলে।”
—মির্জা গালিব
(গালিব, পানশালার দরজা কোন দিকে, আর ধর্ম প্রচারকারী কোথায়?
কিন্তু এটা জানি, কাল তিনি যাচ্ছিলেন, আর আমি বের হয়ে আসছিললাম।)


“নিকলে হো ম্যায়-কাদে সে আভি মুহঁ ছুপা কে তুম
দাবে হুয়ে বগল মে সুরাহি শরাব কি।”
— ইব্রাহিম জওক
(পানশালা থেকে চলে যাচ্ছো মুখ আড়াল করে,
কিন্তু বগলে লুকিয়ে রেখেছো সুরাভর্তি সোরাহি।)

১০
“জওক জো মাদরাসে কে বিগড়ে হুয়ে মুল্লাহ
উন কো ম্যায়খানে মে লে আও সাম্ভার জায়েঙ্গে।”
—ইব্রাহিম জওক
(জওক তো মাদ্রাসার বিভ্রান্ত মোল্লা ছিল,
তাকে পানশালায় নিয়ে এসো, শুধরে যাবে।)

১১
“তওবা তওবা! শেখ জি, তওবা কা ফির কিসকো খ্যায়াল
জব ওহ খুদ কেহ দে কে পি, থোড়ি সি পি, মেরে লিয়ে।”
—–হাফিজ জলন্ধরী
(তওবা তওবা শেখ সাহেব, কার জন্য এই তওবার প্রশ্ন,
তিনি যখন নিজেই বলেন, পান করো, আমার জন্য একটু পান করো।

১২
“ইয়ে জনাব-এ-শেখ বা ফালসাফা ভি আলাগ হ্যায় সারে জাহা সে,
জো ওয়াহাঁ পিয়ো তো হালাল হ্যায় জো ইয়াহা পিয়ো তো হারাম।”
—- জিগর মোরাদাবাদী
(শেখ সাহেব, সারা দুনিয়ার দর্শন কেমন ভিন্ন ভিন্ন,
ওখানো পান করলে হালাল, এখানে পান করলে হারাম।)

১৩
“রাত হাস হাস কে ইয়ে কেহতি হ্যায় কি ম্যায় খানে মে চল
ফির কিসি শাহনাজ-এ-লালা-রুখ কে কাশিয়ানে মে চল।”
—-আসরার-উল-হক মজাজ
(হাসতে হাসতে রাত বলে, চলো পানশালায় যাই,
এরপর চলো কোনো সুন্দরীর গালিচায় যাই।)

১৪.
“আয়ে কুচ আবর কুচ শরাব আয়ে
উস কে বাদ আয়ে জো আজব আয়ে।”
—- ফৈজ আহমেদ ফৈজ
(আকাশ ছেয়ে গেছে মেঘে, কিছু মদিরাও এসেছে,
এরপর যা এসেছে, তা শাস্তির মতো এসেছে।)

১৫
“ইয়ে নও-এ-বাহার ইয়ে আবর-এ-হাওয়া ইয়ে রং-এ-শরাব
চলো জো হো সো হো আব তো গুনাহ কর লুঙ্গা।”
—- আখতার শিরানি
(এই নতুন বসন্ত, এই সুন্দর মওসুম এবং সুরার রং,
এসো, যা হওয়ার হবে, এখন তো পাপ করে নেই।)

১৬
“ওহ ছাত ডুন্ড কারে না মাজাম্মাত শরাব কি
ওয়ায়েজ কে মুঁহ মে মোহর লাগা দুঁ কাবাব কি।
—–আমির মিনাই
(সে যে ছাদে বসে গোপনে পান করে না, তাতে সুরার দোষ নেই,
ধর্ম প্রচারকের মুখ বন্ধ করে দেব, তার মুখে কাবাব ভরে।)

১৭
“কাজী আয়ে কি মুসতাহাব আয়ে
আব তো হাম ম্যায় কাদে মে আ ব্যয়ঠে।”
— আমির মিনাই
(কাজী এসেছেন, সাথে নিয়ে এসেছেন সৎকর্মের উপদেশ,
আমি তো এখন শুড়িখানায় এসে বসেছি।)

১৮.
“শেখ জি থোরি সে পি লো আজ তো
কৌন দেখে গা আন্ধেরি রাত হ্যায়।”
—-আদুল হামিদ আদম
(শেখ সাহেব, আজ একটু সুরা পান করুন,
এই অন্ধকার রাতে কে পান করতে দেখবে?)

১৯
“এ্যয় রহমত-এ-তামাম, মেরি হর খা’তা মাফ,
ম্যায় ইনতিহা-এ-শউক মে ঘাবড়া কে পি গ্যয়া।”
—কলিম আজিজ
(আমার সকল অপরাধ মার্জনা করো হে সকল অনুগ্রহের প্রভু,
আমি তো পান করে ফেলেছি আকাক্সক্ষার পরীক্ষার ভয়ে।)

২০
“মেরি তাবাহি কা ইলজাম আব শরাব পে হ্যায়
ম্যায় আউর করতা ভি কিয়া, তুম পে আ রাহি থি বাত।”
—বশির বদর
(আমার ধ্বংসের অভিযোগ এখন আসছে মদিরার ওপর,
কী করবো বলো, অভিযোগ তোমার ওপর আসতে শুরু করেছিল।)

২১
“নিকাল কর দায়ের-ও-কাবা সে আগার মিলতা না মায়খানা,
তো ঠুকরায়ে হুয়ে ইনসান, খুদা জানে কাহা জাতে।”
—-কাতিল শিফাই
(মহান কাবা’ থেকে বের হয়ে যদি পানশালা না পাওয়া যায়,
তাহলে শুধু খোদাই জানে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ কোথায় যায়)