প্রেমের তালায় জর্জরিত বিশ্বের বিখ্যাত সব সেতু

জবরদস্তি করে কি প্রেম হয়? জাদু-টোনা করেই বা কে কবে প্রেমে সফল হয়েছে? তবুও প্রেমের খাতিরে প্রেমিক-প্রেমিকা কি না করে। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে জীবন দেওয়ার ঘটনা অনেক। প্রেম হয়ে গেলে তা অটুট রাখার পদ্ধতিও অনেক। ইউরোপ আমেরিকায় গত দুই দশকে প্রণয়রতদের প্রেম অটুট রাখা, অথবা অন্তত প্রেমের স্মারক হিসেবে বিখ্যাত সব সেতুতে তালা লাগিয়ে তালার চাপি পানিতে নিক্ষেপ করার ঘটনা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল এবং এর সেরা সাক্ষীতে পরিণত হয়েছিল ‘সেইন’ বা ‘সিন’ নদীর ওপর বিখ্যাত সেতু ‘ পন ডিজ আ” (Pont des Arts) যে সেতুর রেলিং, বেস্টনি জুড়ে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে প্রেমপাগল যুগলেরা ৭ লক্ষাধিক তালা লাগিয়ে সেতুটির অস্তিত্ব বিপন্ন করে ফেলেছিল। নগর কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপে ২০১৪ সালে সেতুটি তালামুক্ত হয়ে স্বস্তির দম ফেলেছে। তালা সরানোর কাজ করতে সেতুটি এক সপ্তাহের জন্য লোকজনের চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল। পরে ব্রিজে নিরাপত্তামূলক কাচের প্যানেল লাগানো হয়েছে, যাতে তালা লাগানোর কোনো সুবিধা নেই।

বহু ভাষায় কবিতা ও গানে তালা-চাবি প্রেমের ক্ষেত্রে রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও ইউরোপ আমেরিকায় প্রেমে তালা-চাবির প্রয়োগ ব্যাপক এবং অনেকটা সংক্রামক। শেষ পর্যন্ত প্রেমের পরিণতি যাই হোক না কেন, যখন একটি যুগল প্রেমে মত্ত তখন প্রেমকে আটকে রাখতে সেতুতে তালা ঝুলায়। শুধু প্রেমিক প্রেমিকা যুগল, বিবাহিত দম্পতিরাও এত তালা লাগায় যে নতুনরা আর তালা লাগানোর ঠাঁই পায় না। তারা তালার ওপর তালা লাগায়। তারা বিশ্বাস করে তাদের প্রেম সুপার গ্লুর মতো আটকে যাবে।

কিন্তু ব্রিজ কর্তৃপক্ষ বা নগর কর্তৃপক্ষগুলো বড়ই বেরসিক। তাদের মতে “বাছারা প্রেম করো, তবে, তালা ছাড়া প্রেম করো!” কারণ প্রেমিক-প্রেমিকার তালার কবলে ব্রিজের স্থাপত্য সৌন্দর্য বিনষ্ট হওয়া ছাড়াও ব্রিজের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। প্যারিসের সেইঁন নদীর ওপর ছোটবড় ৩৫টি ব্রিজ আছে। এর মধ্যে ১৫৫ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার প্রশস্ত “পন ডিজ আ” প্রেমিক-প্রেমিকাদের তালা লাগানোর জন্য খুবই জনপ্রিয় ছিল। ছয় বছরে তারা ৭ লক্ষাধিক তালা লাগিয়েছিল। নগর কর্তৃপক্ষ হিসাব করে বলেছে তালাগুলোর মোট ওজন পূর্ণ আকারের ২০টি হাতির ওজনের সমান। তালার ভারে ব্রিজের রেলিং, বেষ্টনি ভেঙে পড়ার উপক্রম। প্যারিসে আরও ১০টি সেতু এখনও প্রেম-বন্ধনী তালা লাগানোর উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচিত।

সেঁইন নদীর ওপর সেতুগুলো যে তালার ভারে জর্জরিত, তার জন্য দায়ী ছিল ট্যুর অপারেটর, ট্যুর গাইড এবং সেতুগুলোার আশপাশে সস্তা তালার বিক্রেতা ফেরিওয়ালারা, যারা সেতুতে তালা লাগানোর ফজিলত বয়ান করে যুগল পর্যটকদের উৎসাহিত করতো। অতএব, ব্রিজগুলোকে তালামুক্ত করা আদৌ সহজ কোনো কাজ ছিল না। কর্তৃপক্ষ তালা অপসারণ অনেক সেতুকে তালামুক্ত করলেও নতুন নতুন প্রেমিক-প্রেমিকা আবির্ভূত হয়ে নতুন তালা লাগায়। কিন্তু প্যারিসের সেতুগুলোতে, এমনকি সিটির মাইলফলক আইফেল টাওয়ারে এখনও দশ লক্ষাধিক তালা লটকে আছে। তালার সমস্যা থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে প্যারিস নগর কর্তৃপক্ষ রোমের মতো তালা চর্চার ওপর স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

প্রেম পাগলদের তালা লাগানোর বাতিক প্রথমে শুরু হয় ইটালির রাজধানী রোমে এবং রোগের বিস্তার ঘটতে থাকে। কয়েক বছর আগে সিএনএন এর খবরে প্যারিসের সেতুগুলোতে প্রেমের তালা অপসারণ প্রসঙ্গে বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইটালির ঔপন্যাসিক ফেডেরিকো মোতসা’র (Federico Moccia) বেস্ট সেলিং উপন্যাস “ও ভোলিয়া ডি তে”র (Ho Voglia de Te– ‘আমি তোমাকে চাই’) কাহিনিকে কেন্দ্র করে ২০০৬ সালে একটি ছায়াছবি নির্মিত হওয়ার পর থেকে প্রেমরোগীরা তালা মারার জন্য ব্রিজকে বেছে নিতে শুরু করে। উপন্যাসটিতে প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের প্রেমকে অবিভাজ্য, অলঙ্ঘনীয় ঘোষণা করতে রোমের ‘পন্তে মিলভিয়ো” (Ponte Milvio) ব্রিজে একটি তালা লাগায়, তখন থেকে বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার প্রেমপাগলরা তাদের প্রেমকে অটুট রাখার জন্য বিখ্যাত ব্রিজগুলোকে বেছে নেয়। ইটালির ছায়াছবিটি হয়তো প্রেমের তালা লাগানোর কর্মকে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু বিশ্বের বহু দেশে প্রেমের তালা লাগানোর শতবর্ষ প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে।

সার্বিয়ার ভ্রানজাকা বাঞ্জা’র (Vrnjačka Banja) মোস্ত জুবাভ (Most Ljivave)ব্রিজ প্রেমের তালা লাগানোর জন্য খ্যাত এবং ধারণা করা হয়, এই ব্রিজেই সর্বপ্রথম তালা লাগানোর সূচনা। প্রথম যুদ্ধ চলাকালে নাদা (Nada) এক স্কুল শিক্ষিকা সার্বীয় সেনা অফিসার রেলজা’র (Relja) প্রেমে পড়েন। তারা পরস্পরের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। রেলজা যুদ্ধ করতে গ্রিসে যান, এবং সেখানে করফু (Corfu) নামে এক এলাকার মেয়ের প্রেমে পড়েন। ফলে নাদা ও রেলজা’র প্রণয় ভেঙে যায়। প্রেমের এই পরিণতি নাদা’র জন্য প্রচণ্ড এক আঘাত ছিল এবং কিছুদিন পর নাদা মৃত্যুবরণ করেন। এ কাহিনি জানাজানি হওয়ার পর থেকে ভ্রানজাকা বাঞ্জা’র মেয়েরা তালার ওপর তাদের ও তাদের প্রেমিকদের নাম লিখে নাদা ও রেলজা যেখানে মিলিত হতেন, ব্রিজের সেই স্থানে রেলিংয়ে ঝুলিয়ে থাকে। সেখানে এই ঐতিহ্য এখনও চলছে।

পৃথিবীর আরও বহু দেশের ব্রিজে তালা লাগানোর ঐতিহ্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনবহুল নগরী নিউইয়র্কে ইস্ট রিভার ও হাডসন রিভারের ওপর ছোটবড় ২০টি ব্রিজ রয়েছে। এর মধ্যে ১৩৯ সালের প্রাচীন ৫,৯৮৯ ফুট দীর্ঘ ব্রুকলিন ব্রিজ দীর্ঘদিন পর্যন্ত প্রেম-পাগলদের তালা লাগানোর আদর্শ স্থান ছিল। নগরীর পরিবহন বিভাগের মতে ব্রুকলিন ব্রিজে তালা ঝুলতে শুরু করে ২০০৯ সাল থেকে এবং তারা ২০১৩ সালে তালা গুনে ৩৪,২০০টি তালা পায়। অনেক তালায় যুগলের নামসহ প্রেম বার্ষিকী বা বিবাহ বার্ষিকীর দিন-তারিখেরও উল্লেখ আছে। তারা ২০১৫ সালে ৮ হাজারের বেশি তালা অপসারণ করে, ২০১৫ সালে অপসারিত হয় ১১ হাজার তালা এবং এ বার্ষিক ব্যয়ের পরিমাণ লক্ষাধিক ডলার। ২০১৬ সালে তালা সরাতে নগরীর ব্যয় হয়েছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ডলার

তালা-প্রেমিক লাইলি-মজনুদের উদ্দেশ্যে নগরী হুশিয়ারি জারি করে: ব্রুকলিন ব্রিজের কোনো জায়গায় কাউকে তালা লাগাতে দেখলেই ১০০ ডলার জরিমানা। কিন্তু হুশিয়ারি সত্ত্বেও আগ্রহী প্রেমিক-প্রেমিকা জীবনভর প্রেম টিকিয়ে রাখতে লুকিয়ে-ছাপিয়ে সেই ব্রিজে তালা লাগিয়ে যায়।

উপমহাদেশের সাহিত্যে প্রেমের কবিতায় তালা চাবির অস্তিত্ব আছে। অনেক ছায়াছবিতে তালা-চাবি নিয়ে গানও আছে। বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী রুনা লায়লার গাওয়া একটি গানের বক্তব্য হচ্ছে, “এই দিলের তালা খুললো কে, এক চাবিওয়ালা/জং ধরা মরচে পড়া তালার হিকমত জানতো কে/এক হিকমতওয়লাা-চাবিওয়ালা —” ইত্যাদি। গানটির রচয়িতা আহমদ জামান চৌধুরী। অনেক জনপ্রিয় গানের গীতিকার তিনি। তিনি দীর্ঘকাল জনপ্রিয় সিনে সাপ্তাহিক ‘চিত্রালি’র সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতাও করেছেন। চিরকুমার ছিলেন তিনি। প্রচুর মদ্যপান করতেন। চরম দুর্দশার মধ্যে ২০১৩ সালে তিনি মারা যান। এ সম্পর্কে কখনো লেখার আশা রাখি।

হিন্দি ছায়াছবিতেও তালা-চাবির অনেক গান আছে এবং অলকা ইয়াগনিকের গাওয়া একটি গান হলো: “খোল জেরা তালে ও চাবিওয়ালে” (ছায়াছবি: পাত্থর, ১৯৯৫), ‘লাল বাদশাহ’ (১৯৯০) নামে এক মুভির গানের প্রথম লাইন হলো, “ও তালা খোল দে চাবি সে পরদেসি বালমা।” কলকাতার বাংলা মুভি ‘কুমারী মা’ (১৯৯৫) এর একটি গানের বক্তব্য: “আমার কাছে চাবি আছে, তোমার কাছে তালা/দু’দিনের পিরিত রসে যাবেই তবে খোলা।” তালা-চাবি বিষয় অনেক বাংলা-হিন্দি গান অতি অশ্লীল।

আমাদের উপমহাদেশের লোকজন হিসেবি, কৃপণ বা সাশ্রয়ী, মনোকামনা পূরণের আশায় বড় জোর গাছে, মাজার-মন্দিরে সূতা-ফিতা ইত্যাদি বাঁধে। প্রেম আটকানোর জন্য তালা কিনে অর্থ বরবাদ করতে চায় না বলেই হয়তো শব্দের ওপর বেশি ভরসা করে। উর্দু-হিন্দিতে তালা-চাবির অনেক চমৎকার কবিতা আছে। একজন লিখেছেন: “আগার হোতা জোর তুম পর, তো দুনিয়া সে তুমহে চুরা লেতে/দিল কে মকান মে তালা লগাকর চাবি পানি মে বাহা দেতে” (তোমার ওপর যদি জোর খাটাতে পারতাম, তাহলে পৃথিবী থেকে তোমাকে চুরি করে নিতাম/ হৃদয়ের ঘরে তালা মেরে চাবি ফেলে দিতাম পানিতে।) আরেকটি কবিতার অংশ হচ্ছে: “মেরে দিল পর দর্দ কা তালা লাগাকর, খুশিয়াঁ কি চাবি আপনে সাথে লে গই,” (আমার হৃদয়ের ব্যথায় তালা মেরে, সে সাথে নিয়ে গেছে আনন্দের চাবি)।

জোর করে, তালা লাগিয়ে, তাবিজ-মাদুলি প্রয়োগ করে প্রেম হয় না। কবি গালিব বলেছেন: “ইশক পর জোর নেহি হ্যায়, ইয়ে ও আতিশ গালিব/কি লাগায়ে না লাগে আউর বুঝায়ে না বনে,” প্রেমের ওপর কোরো জোর খাটে না গালিব, এ এমন এক আগুন, লাগিয়ে দিলেও লাগে না, আর নেভাতে চেষ্টা করলেও নেভে না।”