উম্মে তাসবিহ’র দিনলিপি

উম্মে তাসবিহ

২৭ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার ২০২২

ইদানীং ভাই-বোনে একটা মজার খেলা পেয়েছি। গুগল ম্যাপ দিয়ে নানান জায়গা জুম করে করে খুঁজে দেখি। আমাদের নানী বাড়ি, দাদা বাড়ি, আমাদের বাসা, আমার দাদার বাড়ির নদী, আমার নানার বাড়ির কাছে স্টেডিয়ামে যেখানে প্রতি বছর বৈদ্যরা আসে, এমনকি পেয়ারাবাগ রেইলগেট! আজ সন্ধ্যায় আমার ভাই এক বিহ্বল সংবাদ নিয়ে এলো। স্ক্রিণের দিকে তাকিয়ে দেখি সেই ছোট, শান্ত দেলদুয়ার বাজারে আমার খালুর দোকান দেখা যায়। সেখানে সব দৃশ্য স্বাভাবিক, দোকানে মালের স্তুপ, কিছু গাঠরি গামছা দিয়ে ঢাকা, বোধহয় নতুন মাল কেনা হয়েছিল তখন কিন্তু গোছানো হয়ে ওঠেনি। দোকানে আমার খালু তখন অনুপস্থিত। কে জানে কোথায় গিয়েছেন! সব কিছু স্বাভাবিক। আশেপাশে গুটিকয়েক মানুষ দেখা যায়, আরেকটু জুম করলে বৈদ্যুতিক খাম্বার গায়ে আমার খালুর চাচা, মেম্বার পদপ্রার্থী ‘মেনহাজ খান সাহেব’ এর নির্বাচনী পোস্টারও দেখতে পাওয়া যায়- এই সবের মাঝে শুধু বুকের মধ্যে খচ করে লাগে একটা বাজারের ব্যাগ।

জায়েদ আল- সাবিদ ফ্যাশন, আমার খালুর দোকানে সারি করে রাখা লাল রঙের টুলগুলোর একটার উপর রাখা আমার নানার বাজারের ব্যাগ। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিটা দশ মাস আগের। আমার নানা মারা গেছেন প্রায় চার মাস হয়ে এলো। দশ মাস আগে কি আমার নানা বাজারে যেতে পারতেন? না! এই ব্যাগটা নিয়ে আমার নানা যখন সুস্থ ছিলেন, বাজার করতে যেতেন। অর্ধেক বাজার হলে আমার খালুর দোকানে ব্যাগ রেখে কখনো বাকি বাজার করতে যেতেন, কখনো বসে জিরোতেন। দশ মাস আগে যখন এই ছবি তোলা হয় তখন সেই সময় কেউ আমার নানার ব্যাগ নিয়ে বাজার করতে এসেছিলেন, ঠিক সেইভাবেই ব্যাগ ভর্তি বাজার রেখে কোনো কাজে গিয়েছিলেন। সেই কেউ একজনটা আমার মামাই হওয়ার কথা।

হতে পারে আমরা যা ভাবছি তা ভুল, আমার খালুরও হয়তো অমন একটা ব্যাগ আছে। কিন্তু বাজারে চলতি ব্যাগ থেকে এই ব্যাগটা আলাদা দেখতে ছিল। আমার নানী ঐ রকম দেখতে একটা ব্যাগ থেকে বাজার ঢালতেন, শূণ্য অবস্থায় ব্যাগটা ঝোলানো থাকত, এইসব দৃশ্য কোনোদিন মনোযোগ দিয়ে না দেখলেও মনে সেঁটে গেছে কোন অজান্তে।

গুগল ম্যাপের এই ছবি জুম করে এই রাস্তা, দোকান, বাজারের ব্যাগের সজনে ডাটা অথবা কচুর লতি দেখে দুজনেই চুপ করে থাকি। যার যার মনে তার তার মতো একই বিষণ্ণতা এসে জমা হয়।

অনেক কথা আজ এলোমেলোভাবে মনে পড়ছে, অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই হয়তো চায়, সে যদি তার মনের গহীন থেকে কথা তুলে আনে তবে তা যেন পরিচিত কেউ না পড়ে।


১৩ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার ২০২২

খুবই শিষ্টাচার পরিপন্থি এক ইচ্ছা আমার মনে উদয় হয়। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে, ছাদে উঠলে, বারান্দায় গেলে যার ঘরের জানালা, পর্দার ফাঁক দিয়ে যতখানি দেখা যায়, ততখানি দেখতে ইচ্ছা হয়। বিষয়টা এমন না যে আমি মূলত মানুষ দেখি। আমার দেখতে ভালো লাগে গৃহস্থালি। নিজের ঘরে আমি টিভি দেখি না, কারো ঘরের পর্দার আড়াল থেকে চলন্ত টিভির দিকে তাকিয়ে আমার মনে যত স্বয়ংক্রিয় গল্প রচিত হতে থাকে। একটা মিটসেফ, প্লাস্টিক রেক, আলু-পেঁয়াজ অথবা পড়ার টেবিলের দৃশ্যমান এক কোণা সারাদিনের মাথার যোগান দিয়ে দেয়। খুবই খারাপ অভ্যাস এবং হাদিসে বর্ণিত পাপসমূহের একটি। নিজেকে এই বাজে স্বভাব থেকে নিশ্চয়ই বিরত রাখতে হবে। তবে আজ রেইল লাইনের পাশের এই আধভাঙা বাড়ির ভাঙা সিঁড়ির ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে বোধহয় কারো ঘরের ভেতর উঁকি দিইনি। ভেতরে সম্ভবত একটা মাদ্রাসা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ধর্মীয় পরিচয় বহন করে এমন পোশাকে ভেতরে ঘোরাঘুরি করছে। এমন সময় পাঞ্জাবি টুপি পরা ফুটফুটে একটা বাচ্চা সিঁড়ির ফাঁকের এই জানালায় দাঁড়িয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা তার শিক্ষককে চিৎকার করে ‘স্যার’ ‘স্যার’ বলে ডাকতে লাগল।
রেলরাস্তার কাজ এবং রাস্তা খোড়াখুড়ির চক্করে বাড়ি-ঘর, রাস্তা ভেঙে একাকার, নয়তো এই রাস্তায় চলতে বরাবর উপর দিকে, ডাইনে-বায়ে হা করে তাকিয়ে দেখতে দেখতে গিয়েছি।এখন তো নিচে তাকিয়ে দেখেশুনে চলতে হয়। আজ এই শিশুর চিৎকারে উপরে তাকিয়ে আবার দেখি ভাঙা পড়েছ টিনের দোতলার দন্ত চিকিৎসালয়। দুনিয়ায় কত কী হয়ে যায়!


২১ সেপ্টেম্বর, বুধবার ২০২২

তৌহিদ আফ্রিদির মায়ের একটা সাক্ষাৎকার দেখলাম যেখানে তিনি মাই টিভি দাঁড় করাতে ঋণ নেয়ার জন্য সন্তানদের বন্ধক রাখতে চাওয়ার স্মৃতিচারণ করে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ছেন। বড়লোক হলেই মানুষের জীবনে কষ্ট কম থাকবে এমন তো নয়। বরং আমার তো মনে হয় বড়লোকের জীবনেই এই ধরণের হৃদয়বিদারক কষ্ট বেশি। কষ্ট বরং কম গরীবের জীবনে। অথবা মাছ সারাদিন পানিতে থাকলেও তাদের যেমন সর্দি হয় না সেইরকম ব্যাপার।
গত পরশু বাসায় এসেছি। বাসায় এলেই মাঝে মাঝে চাঁদ (ছদ্মনাম) নামে একটি কিশোর বয়সী ছেলে ব্যাগ নিয়ে উপরে উঠিয়ে দিতে চাইত। চাঁদ স্বেচ্ছায় স্কুলে যেত না। তার বাবা মায়েরও এই ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। খুচরা কাজ পেলে চাঁদ করত, বাকি সময় মোবাইলে ওর মতো করে ও বিনোদন খুঁজে নিত আর নয়তো এরকমই ঘুরে ফিরে খাওয়া কাছাকাছি বয়সের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিত। কারো ফাই ফরমায়েশ খেটে দিলে যা কিছু টাকা পেত সেটা দিয়ে কী করত সে জানে। চাঁদের বাবা অটোরিকশা চালায়, মা বোধহয় গার্মেন্টস কর্মী। চাঁদের বাবাও বেটাকা বাপ, চায়ের দোকানে প্রায়ই তিন চারজন রিকশাওয়ালার সাথে জড়ো হয়ে মোবাইলে লুডু খেলতেন। কোনো কিছু নিশ্চিত না হয়ে বলা মিথ্যার সামিল তবে অনেকে সন্দেহ পোষণ করতেন যে আসলে জুয়া খেলতেন।


এবার এসে শুনলাম চাঁদকে রিকশার গ্যারেজে ধরে এনে আটকে রেখেছিল কারণ চাঁদের বাপ রিকশা বেঁচে পগারপার। টাকা না দিলে ছেলেকে ছাড়া হবে না। না ছেড়ে আসলে শেষ পর্যন্ত কী করত এটাও আমার জানার খুব শখ। যাই হোক, চাঁদের মা কিস্তিতে আনা ফ্রিজ বেঁচে আরও কিছু টাকা জমা দিয়ে চাঁদকে ছাড়িয়ে নিয়ে সেও পগারপার। বাড়িওয়ালার তিন মাসের ভাড়া বাকি। ঘরের টিভিটাও বাকি টাকায় কেনা। সমিতির কিস্তির টাকাও বোধহয় বাকি। বাড়িওয়ালাকে প্রায়ই চাঁদের মা ফোন করে খোঁজ নেন, রেখে যাওয়া চৌকি টৌকি, ফ্যান, চুলা বেঁচে তিনি কত টাকা উঠাতে পারলেন। বাকি টাকা পরিশোধ করার আশ্বাস দেন। রিকশা মালিকের কী খবর জানি না।

আমার মনে হয় টিভি, ফ্রিজ, চকি, ফ্যান চলে যাওয়াতে তারা খুব একটা দুঃখিতও না। আবার নতুন কোনো এলাকায় একটা ফ্রেশ স্টার্ট দিলেই হয়।


২৭ আগস্ট, শনিবার ২০২২
আজকের থম মারা বিকেলে চাচীদের রান্নাঘর থেকে পাটখড়ি পোড়ার ঘ্রাণসমেত ধোয়া উড়ে গিয়ে এ গ্রামের চকের সীমানায় থাকা বাড়িটার কোলের কাছের তালগাছের মাথার উপরের রেখায় মিলিয়ে যেতে থাকলে নদীর পাড়ে গেলাম। সূর্য তখন লাল টকটকে। আজ সারাদিন ভাপ বের করা গরমের পর সন্ধ্যার মুখে নদীর ওপর হালকা কুয়াশার মতো ঘোলা ভাব দেখে মনে পড়ে গেল, এইখানে আমি শেকড় গেড়ে বসতে আসিনি। চলে যাওয়ার দিন সন্নিকটে। পাশে দাঁড়ানো গ্রামের একজন বললেন, ভাদ্র মাসের পনেরো দিন গেলেই আল্লাহ চাইলে শীতের আমেজ পড়া শুরু হবে। চারিদিকে মোনাজাত, ক্ষেতের পানি যেন এখনই না শুকায়। এখন আমন ধানের সময়। সামনে সরিষা। ক্ষেত শুকালে বড় ক্ষতি।
সামনের গ্রামের সংযোগ রাস্তাটি নদী খেয়ে সরে এসেছে এ গ্রামের বুকের কাছে। ভাঙা ব্রিজের গোড়ায় স্রোত এসে বাড়ি খেয়ে বড় ঘূর্ণি তৈরি করে সারাদিন। সেখানে একটা ছোট্ট দোকানে গুটিকয়েক প্রজাতির সদাই পাতি। আমার হঠাৎ কান্না আসে। যেতে ইচ্ছা হয় না। আম, হিজল গাছের তলায় তলায় এখনো নৌকা বাঁধা। কিন্তু এই এক সপ্তাহে পানি কমে গেছে দুই হাত বোধহয়। শীতের সন্ধ্যায় আমার নদীর উপরের কুয়াশা দেখতে ইচ্ছা হয়। বিলের পাড়ের শেষ মাথার কদম গাছে এখনো ভগ্ন স্বাস্থ্য কদম ফুল। সে শেষ ফুল ঝরানো পর্যন্ত, সরিষা বোনা পর্যন্ত আমার থাকতে ইচ্ছা হয়। আল্লাহ চাইলে আর কয়দিন পর পানি শুকিয়ে কাউলজানি গ্রামের রাস্তা জাগবে। আহা! দুই পাশে হলুদ ক্ষেত নিয়ে বয়ে যাওয়া যে পথ না জানি কত সুন্দর দেখাবে!


২২ জুলাই, শুক্রবার ২০২২
আপনি দাওয়াতে উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে মন মাতানো মিষ্টি হয় এমন পরিমাণ চিনি সহযোগে শরবত পরিবেশন করা হবে। সাথে থাকতে পারে ঘরে বানানো কিংবা বাইরে থেকে আনা তেল চপচপে নাস্তা, চানাচুর, বিস্কুট ইত্যাদি। সেইগুলো হজম হওয়ার আগেই মূল খাবার টেবিলে থরে থরে সাজানো পাবেন পোলাও, মুরগীর রোস্ট, গরু, খাসি, ইলিশ মাছ, চিংড়ি, কখনো রূপচাদা, ডিমের কোরমা……… ইত্যাদি। সাথে থাকবে গ্লাসের গায়ে বিন্দু বিন্দু জল জমে অত্যন্ত আবেদনময় হয়ে ওঠা শীতল কোমল পানীয়। বেসিন থেকে হাত ধুয়ে সোফায় বসতে না বসতে চলে আসবে আপনার আনা মিষ্টি, ফল, সাথে আপ্যায়নকারীর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জোগাড় করা আরও কিছু মিষ্টান্ন। এইসবের ফাঁকে চলবে প্রচুর সহাস্য, হৃদ্যতাপূর্ণ জোরাজুরি। যতই বলবেন আপনার পেট খারাপ, আপনার পেটে মজুদ গ্যাসের পরিমাণ একটি পরিবারের গ্যাস সঙ্কট মেটাতে পারে বলে মাঝে মাঝে আপনার সন্দেহ হয়, কিংবা আপনার হাই ব্লাড প্রেশার বা ডায়াবেটিস, তারা আপনাকে আদর করে আরেকটু পাতে তুলে দিয়ে বলবে, আরে একদিন খান! দাওয়াতে এসে এতো কন্ট্রোল করতে নেই! বাসায় যাইয়া কম খাইয়েন!
তারপর কিছুক্ষণ আড্ডা-গল্প শেষে আসবে ধূমায়িত, দুধ-চিনি সহযোগে ঘন চা অথবা কফি। সে এক ভালো চা বানানোর প্রতিযোগিতা আর কি! সাথে আরেক দফা বিস্কুট, চানাচুর, নুডুলস-ফুডুলসও চলতে পারে।
 এইসব প্রচুর ভোজন শেষে আপনিও যখন তাদের পাল্টা পাশবিক ভোজন দ্বারা টাইট দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রতি দাওয়াত দিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিতে যাবেন, তখন তারা বলবে,

আর মোটা হইও না/ একটু এক্সারসাইজ কইর/ অল্প বয়সে ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার হয়ে গেলে অনেক সমস্যা/ অমুকের এই এই সমস্যা ছিল, সেই সেই ভাবে ভুগছে…… ইত্যাদি ইত্যাদি। লে হালুয়া!