দাম্ভিকতা ও রাশিচক্র

কারও দাম্ভিক বা আত্মম্ভরী মনোভাব কি আসলে নিজের প্রতি তার অবিচল আস্থার অভিব্যক্তি? বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত। অনেকে বলেন, এটি মানুষের ব্যক্তিত্বের বৈকল্য, এক ধরনের মানসিক ব্যাধি। একটি বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই যে ওইসব লোকজনই দাম্ভিক বা নার্সিসটিক (Narcissistic), যারা নিজেদের ভালোবাসেন এবং নিজেদের বিষয়াবলী ছাড়া অন্য কারও বিষয়ে তারা শুধু অমনোযোগীই নন, নিজের ওপর চরম আস্থার মুখোশের আড়ালে তারা তাদের সামান্য সমালোচনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ব্যাপারটি বেশ জটিল। দাম্ভিক লোকজন দৃশ্যত আন্তরিক হলেও আবেগশূন্য; ‘ইয়েস,’ ‘নো,’ ‘ভেরিগুড’ এর বাইরে অগ্রসর হন না; তারা আত্মমগ্নতা ও আত্মতৃপ্তির মাঝে থাকেন। দাম্ভিকতা বা আত্ম-অহমিকার প্রধান লক্ষণগুলোর একটি হলো, এ ধরনের মানুষ তাদের আচরণ সম্পর্কে অবহিত, কিন্তু তারা এটা নিয়ে মাথা ঘামান না, কারণ তারা তাদের বৈশিষ্ট বা স্বভাবকে অস্বাভাবিক বা অবাঞ্ছিত বলে মনে করেন না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সাবেক শিক্ষক প্রিয়ভাজন প্রফেসর আশরাফ আহমেদ, যিনি বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির মহাপচিালকের দায়িত্বও পালন করেছেন, তাঁর ‘আত্মঅহমিকা’ নিবন্ধটি সম্পাদনা করতে গিয়ে বিষয়টির ওপর আরও কিছুটা আলোকপাত করার ইচ্ছা জাগ্রত হলো। কারণ আমি ‘খুদী’ বা ‘আমিত্ব’ নিয়ে কবি আল্লামা ইকবালের কবিতার নিচের অংশটুকু আমি প্রায়ই উচ্চারণ করি, চর্চা করি এবং আমার ঘনিষ্টজনদের আমল করতে বলি। কবিতাংশ হচ্ছে:

“খুদী কো কর বুলন্দ ইতনা,
কে হর তকদীর সে পেহলে,
খুদা বান্দা সে খুদ পুছে,
বাতা তেরি রেজা ক্যয়া হ্যায়?”

(তোমার আমিত্বকে এত দৃঢ় করো,
যাতে প্রতিবার ভাগ্য নির্ধারণের আগে
আল্লাহ স্বয়ং তোমার কাছে জানতে চান
বলো, তুমি কি চাও?)

আমি জানি না, আমি দাম্ভিক অথবা বিনয়ী কিনা! সন্দেহ নেই যে যথেষ্ট বিনয়ী নই, দাম্ভিক বা আত্মম্ভরী কিনা, সেই রায় দিতে পারেন আমার ঘনিষ্টজনেরা। অনেকে বিশ্বাস করেন যে মানুষের এ ধরনের বৈশিষ্টের সঙ্গে তাদের রাশিচক্রের নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। রাশিচক্রে আমার তেমন আস্থা নেই। বহুকাল পর্যন্ত জানতামও না আমি কোন রাশির জাতক। বাংলাদেশের এক সময়ের বিখ্যাত জ্যোতিষী “মহাজাতক” আমার জন্ম তারিখ জেনে বলেন যে আমি ‘কুম্ভ’ রাশির জাতক। “মহাজাতক,” যার প্রকৃত নাম শহীদ আল বোখারী, আমার সিনিয়র বন্ধু, যার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ১৯৬৯ সাল থেকে। তিনি যেহেতু একজন সাংবাদিক ছিলেন, অতএব পরবর্তীতে পেশাগত সিনিওরিটির কারণে তিনি আমার শ্রদ্ধাভাজন। দেখা-সাক্ষাতে হাতের রেখা দেখে যা যা বলেছেন, তাতে আমি কখনও আমল দেইনি। কিন্তু আমার অনাস্থা ও অবিশ্বাসগুলোকে চারদিকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে আমার বিশ্বাসের প্রাচীরে বিরাট ফাটল ধরেছে। শুধু আমি নই, মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ভ্রান্ত বিষয়গুলোকেই সত্য বলে গ্রহণ করছে বা করতে বাধ্য হচ্ছে, কারণ শেষ পর্যন্ত তারা “দশ চক্রে ভগবানের ভূত” হওয়ার মতো মিথ্যার জনক জননীদেরই মানুষের জীবন থেকে শুরু করে সবকিছুর নিয়ন্তায় পরিণত হওয়া প্রত্যক্ষ করছে।

মানুষের আশা ও আকাক্সক্ষাগুলো যখন হতাশার তলাহীন সাগরে ডুবে যেতে থাকে তখন রাশিচক্রের মতো বিষয়ে মানুষের বিশ্বাস প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। এরই প্রেক্ষাপটে আজ মানুষের ব্যক্তিত্বের ওপর, বিশেষ করে কারও আত্মম্ভরী হয়ে ওঠার ওপর রাশিচক্রের ১২টি রাশির মধ্যে ৯টির প্রভাব সম্পর্কে কথাগুলোর অবতারণা করছি:

বৃশ্চিক রাশি (২৩ অক্টোবর-২১ নভেম্বর):
রাশিচক্র অনুযায়ী যারা বৃশ্চিক রাশির জাতক, তারা যদি জীবনে কখনও আহত বা প্রতারিত হন, তাহলে তারা অহঙ্কারী হয়ে ওঠতে পারেন এবং সাধারণভাবে তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া কঠিন হয়ে ওঠে। যদি তারা পরিতৃপ্ত থাকেন, তাহলে তারা অহঙ্কারী হন না এবং এটা নির্ভর করে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তিগত জীবনের ওপর। বৃশ্চিক রাশির লোকজনকে প্ররোচনা বা উস্কানিমূলক কিছু বলা থেকে যত এড়িয়ে থাকা যায় তত ভালো। কারণ তারা মূলত হৃদয়হীন, ধূর্ত ও আক্রমণাত্মক মনোভাব সম্পন্ন। তারা যদি মনে করেন যে আপনি তাদের সাথে ভুল কিছু করেছেন, তাহলে তারা জানপ্রাণ দিয়ে তা প্রমাণ করতে সচেষ্ট হবেন। নিজের স্বার্থোদ্ধারে তারা অন্য লোককে ব্যবহার করার অনৈতিক কাজ করতেও দ্বিধা করেন না। অন্য লোকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে তারা পটু।

বৃষ রাশি (২১ এপ্রিল-২০ মে)
যারা বৃষ রাশির জাতক তারা প্রত্যেকের ওপর নিজেদের সেরা ভাবেন। তারা যা করেন তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশে এবং বিশ্বাস করেন যে সবকিছুর সেরাটাই তাদের প্রাপ্য। অন্যের সঙ্গে তারা সামঞ্জস্য বিধান করতে অপরাগ এবং এক্ষেত্রে তারা কোনো আবেগ-অনুভূতির ধার ধারেন না। তারা তাদের প্রয়োজনের কথা ভাবেন সর্বাগ্রে। পরিবারের প্রতি তাদের সংলগ্নতা থাকে বেশি এবং পরিবারের কল্যাণে তারা সাধ্যের মধ্যে থাকা সকল শক্তি প্রয়োগ করেন। অন্যকে প্রভাবিত করতে তারা পারঙ্গম।

কুম্ভ রাশি (২০ জানুয়ারি-১৮ ফেব্রুয়ারি)
কুম্ভ রাশির কোনো জাতককে যদি দাম্ভিক বা আত্মাহঙ্কারী বলে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে তারা কখনও স্বীকার করেন না যে তারা অহঙ্কারী বা আত্মকেন্দ্রিক, বরং সজোরে এর প্রতিবাদ করেন। তারা বলেন যে তারা স্বতন্ত্র ও নিজ যোগ্যতায় আস্থাবান এবং এ দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সময় বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যেতে পারে। তাদের আত্ম-নির্ভরতার এই অনুভূতির কারণে তারা সবাইকে অগ্রাহ্য করেন এবং নিজেদের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দেন। তারা নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেন এবং এজন্য অন্যকে ব্যবহার করেন। আপনার মনোযোগ পেতে তারা সবকিছু করেন এবং সফলতায় আত্মতৃপ্তি বোধ করেন।

সিংহ রাশি (২১ জুলাই-২১ আগস্ট)
সিংহ রাশির জাতকরা সকলের মনোযোগের কেন্দ্রে পরিণত হতে চান। কিন্তু তারা কখনও তা স্বীকার করেন না। তারা আত্মমগ্ন ও আত্মতৃপ্ত। সিংহ রাশির লোকজন সচরাচর ভালো মানুষ, কিন্তু অনেক সময় তারা বিরক্তিকর হয়ে ওঠতে পারেন। তারা মনে করেন যে তারা যা করেন তা সবসময় প্রায় সঠিক ও সকল সন্দেহের উর্ধে। তারা জানেন, তাদের মধ্যে নেতৃত্বের সহজাত দক্ষতা রয়েছে এবং বিশ্বাস করেন যে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ রাখার সামর্থ আছে তাদের। এই রাশিতে জন্মগ্রহণকারীরা আত্মম্ভরী মানুষের সেরা দৃষ্টান্ত, কারণ তারা সবসময় প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যে তারা সবচেয়ে ভালো জানেন। তাদের ক্ষেত্রে ‘অতি-আস্থাবান’ শব্দটি অধিক প্রযোজ্য।

মেষ রাশি (২১ মার্চ-২০ এপ্রিল)
মেষ রাশির লোকজন তাদের নিজস্ব প্রয়োজন মেটানোর জন্য সম্পূর্ণ অবিবেচক। এমনকি ঘনিষ্ট বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের মাঝেও তারা কখনও দ্বিতীয় অবস্থানে থাকতে সম্মত নন এবং তারাই যে সেরা, এর পক্ষে সকলের অনুমোদন আশা করেন। এ ধরনের মানুষ আবেগ-অনুভূতির তেমন তোয়াক্কা করেন না। তাদের কাজকর্ম অন্যদের কিভাবে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে, তা নিয়ে তারা আদৌ মাথা ঘামান না। তবে সামান্য চেষ্টায় তারা ভালো বন্ধু হয়ে ওঠতে পারেন। তারা যা করতে চান তাতে সফল হওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে পিছপা হন না।

ধনু রাশি (২২ নভেম্বর-২০ ডিসেম্বর)
সাধারণভাবে ধনু রাশির জাতকরা সাহসী, কিন্তু একগুঁয়ে প্রকৃতির। পরিণতির কথা না ভেবে তারা মনের কথা বলে ফেলেন। সেজন্য যারা রাশির ভেদ জানেন, তারা পরামর্শ দেন ধনু রাশির লোকজনকে বেশি না ঘাটাতে। অন্য কারো ভালো-মন্দ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই এবং তাদের দম্ভ অন্যদের কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে সে সম্পর্কেও তাদের কোনো ধারণা নেই। তবে ধনু রাশির জাতকরা কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন না, কারণ বিদ্বেষ পোষণের ব্যাপারেও তারা অপরিপক্ক। তারা চান না যে কেউ তাদের আত্মমগ্নতায় বাধা সৃষ্টি করুক। তারা ভালো ও অনুগত বন্ধু হতে পারেন এবং তারা যখন কোনোকিছু হাসিল করতে চান তাহলে কাজটি যত কঠিন হোক, যত সময় লাগুক, তারা জানপ্রাণ দিয়ে কাজটি করেন।

তূলা রাশি (২৩ সেপ্টেম্বর-২২ অক্টোবর)
তূলা রাশির জাতকরা সাধারণত অসৎ ও হালকা চিন্তাভাবনার হয়ে থাকে বলে কুখ্যাতি রয়েছে। সবকিছু সত্বেও তারা ভালো মানুষ। কোনো বস্তু ও মানুষের আকর্ষণ তাদেরকে মুগ্ধ করে এবং তারা সেগুলোকে পেতে তাদের মুগ্ধতাকে কাজে লাগান। মানুষের ভিড়ে বা কোনো কাজে তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিক আচরণ পাওয়ার আশা করেন। কিন্তু আসলে তারা শীতল বা সেরা কোনোটাই নয়, তারা চৌকস ও কঠোর পরিশ্রমী। তারা যেকোনো মূল্যে দ্বন্দ্ব এড়াতে চেষ্টা করেন। তারা সকল বিষয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন, তবে বিতর্কে জড়াতে চান না। তারা নিজেদের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট এবং তারা যদি মনে করেন যে তার কথায় তার শ্রোতারা যথেষ্ট পরিমাণে সন্তুষ্ট হয়নি, তাহলে তারা তাদের বক্তব্যের প্রতি সকলের সম্মতি আদায় করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন।

কর্কট রাশি (২১ জুন-২০ জুলাই):
কর্কট রাশির লোকজন দাম্ভিক লোকদের মতোই সকলের মনোযোগের কেন্দ্র হতে ব্যগ্র এবং এজন্য তারা প্রয়োজনীয় সকল উপায় অবলম্বন করতে সচেষ্ট। অপরদিকে তারা নিজেদের প্রকৃত দাম্ভিক ও আত্মম্ভরী প্রমাণ করতে লোক দেখানো পরোপকারে নিয়োজিত হন। তবে কর্কক রাশির সকল জাতক একই রকমের নন, বেশির ভাগ নিজেদের জীবন নিয়ে এত অধিক ব্যস্ত থাকেন যে, আশপাশের সকলকে বিস্মৃত হন এবং অন্যের প্রয়োজনের দিকে দৃষ্টিপাত করেন না। তারা অহঙ্কারী ও আবেগহীন না হলেও অনেক সময় অন্যের ওপর নির্ভরশীল, নৈরাশ্যবাদী এবং অত্যন্ত সন্দেহপ্রবণ। এ ধরনের লোকজন আবেগজাত যন্ত্রণায় আহত হলে অন্তর্মূখী হয়ে নিজেদের অসহায়ত্ব ও হতাশার মধ্যে ডুবে যায়।

মকর রাশি (২১ ডিসেম্বর-১৯ জানুয়ারি):
মকর রাশির জাতকরা প্রকৃতপক্ষে দাম্ভিক নন, কিন্তু তারা যদি মনে করেন যে তারা কোনোকিছুর যথার্থ অধিকারী, তাহলে তারা দাম্ভিক হয়ে ওঠতে পারেন। তারা কিছু পেতে চাইলে শীতল ও হিসেবি হয়ে ওঠেন। মকর রাশির লোকজন তাদের আপন লোকজনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চান না, কিন্তু আপন লোকগুলো তার অপছন্দনীয় কিছু করে ফেললে দু:খবোধ করেন। তারা যদি দাম্ভিক হয়ে ওঠেন, তাহলে ধরে নিতে হবে যে এটা হয় তাদের কাজ বা পেশার কারণে।

প্রিয় পাঠকরা তাদের রাশির সাথে নিজেদের বৈশিষ্ট্য মিলিয়ে নিতে পারবেন যে তারা দাম্ভিক, আত্মমগ্ন বা বিনয়ী কিনা।