খাজা আহমদ আব্বাস
(ক’দিন আগেই আশি বছর বয়স পূর্ণ করলেন বলিউডের ‘শাহেনশাহ’ অমিতাভ বাচচান। ছায়াছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার ঘটনাও বেশ নাটকীয়। দৈহিক উচ্চতা তাঁর অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেসব পরিচালকের কাছেই গেছেন, তারা তাকে বিদায় করেছেন যে নায়িকাদের জন্য তিনি অতি দীর্ঘ। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি কথা সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক খাজা আহমদ আব্বাসের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। পরিচালক তখন “সাত হিন্দুস্থানি” নামে একটি ছায়াছবি নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁকে কীভাবে “সাত হিন্দুস্থানি’র মধ্যে মুসলিম চরিত্রের একজনের অভিনয়ের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে খাজা আহমদ আব্বাস তাঁর আত্মজীবনী “আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ড” এ বর্ণনা করেছেন। এ ছায়াছবি দিয়ে অমিতাভ বাচচানের চলচ্চিত্রাভিনয়ের শুরু। এর আগে তিনি মৃণাল সেনের একটি ছবিতে শুধু কণ্ঠ দিয়েছিলেন। —আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু)
খাজা আহমদ আব্বাস আত্মজীবনীতে লিখেছেন:
“—- একজন ‘হিন্দুস্থানি’ রয়ে গেল, মুসলিম গোঁড়া উর্দুভাষী। আমি যেহেতু এই ছেলেগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন বয়সের ও ভিন্ন উচ্চতা বিশিষ্ট চেয়েছিলাম, অতএব একজন দীর্ঘ ও সুদর্শন তরুণের স্থান শূন্য ছিল। তাকে ছিপছিপে গড়নের হতে হবে। একদিন কেউ এক দীর্ঘ তরুণের ছবি এনে আমাকে দেখালো। আমি বললাম, “আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে দেখতে চাই।”
“তিনি আগামী পরশু সন্ধ্যায় এখানে আসবেন।” আমার আবারও ধারণা হলো যে লোকটি বোম্বেতেই (মুম্বাই) আছেন, নিশ্চয়ই কোথাও চাকুরি করেন এবং সন্ধ্যার আগে কাজ থেকে অবসর পান না।
তৃতীয় দিবসে সন্ধ্যা ঠিক ছ’টায় এক জন দীর্ঘদেহী তরুণ উপস্থিত হলেন। চুড়িদার পাজামা ও জওহর জ্যাকেট পরিধান করার কারণে তাকে দীর্ঘ দেখাচ্ছিল। কিন্তু আমি তখন তার নাম জানতাম না। আমাদের মধ্যে যে আলোচনা হয়, তা মোটামুটি এমন:
“মেহেরবানি করে বসুন। আপনার নাম?”
“অমিতাভ।” (বাচচান বলেননি)।
এটি ব্যতিক্রমী নাম ছিল, সেজন্য আমি জানতে চাইলাম, “এর অর্থ কী?”
“সূর্য। এটি গৌতম বুদ্ধের একটি নামের সমার্থক।”
“পড়াশোনা?”
“দিল্লি ইউনিভার্সিটি থেকে বি,এ।”
“আপনি কি আগে ছায়াছবিতে কাজ করেছেন?”
“না, আমাকে কেউ নেয়নি।”
“তারা কে?”
তিনি অত্যন্ত খ্যাতিমান কয়েকজনের নাম বললেন।
“আপনার মধ্যে তারা কী ত্রুটি দেখেছেন?”
তিনি অনেকটা খোলামেলা বললেন, “তারা সবাই বলেছেন যে তাদের নায়িকদের জন্য আমি অনেক বেশি লম্বা।”
“ঠিক আছে, আমাদের তেমন কোনো সমস্যা নেই। সেই অর্থে আমাদের ছবিতে কোনো নায়িকা নেই। থাকলেও আপনাকে নিতে আপত্তি করতাম না।”
“আমাকে নেবেন? আপনি কি আসলেই আমাকে নিতে যাচ্ছেন? কোনো অডিশন ছাড়াই?”
“সেটা নির্ভর করে। প্রথমে আমি আপনাকে কাহিনিটি বলবো। এরপর আপনাকে আপনার ভূমিকার কথা বলবো এবং দেখবো আপনি সেই ভূমিকায় অভিনয়ের ব্যাপারে আগ্রহী কিনা। সবশেষে আপনাকে বলবো যে আমরা আপনাকে কত অর্থ দিতে পারবো। আপনি সম্মত হলেই শুধু আপনার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করবো।”
তাকে পুরো কাহিনি পড়ে শোনালাম। আগ্রহে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠতে দেখলাম। আমি তাকে সংস্কৃতিবান, মার্জিত ভারতীয় হিসেবে দেখতে পেলাম, যার মাঝে দেশপ্রেমের অনুভূতি প্রবল। আমি জানতে চাইলাম তিনি কোন চরিত্রে অভিনয় করতে পছন্দ করবেন। তিনি দুটি চরিত্রের কথা বললেন যে দুটি চরিত্র তাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছে। পাঞ্জাবির চরিত্র এবং মুসলিমের চরিত্র। আমি তাকে বললাম যে তিনি সম্ভবত একজন পাঞ্জাবি, সেজন্য পাঞ্জাবির ভূমিকায় অভিনয় করতে পারবেন না। কারণ জানতে চাইলে বললাম অভিনেতা নির্বাচন করা হচ্ছে মিশ্র ধরনের লোকদের মধ্য থেকে। তিনি বললেন, “আমার মনে হয়, আপনি যা বোঝাতে চাইছেন আমি তা জানি। তাহলে আমি মুসলিমের চরিত্রে অভিনয় করবো, কারণ কাহিনির মুসলিম ব্যক্তিটি সন্দেহের মাঝে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। শেষ পর্যন্ত সন্দেহ দূর হয়ে প্রমাণিত হবে যে, তিনি একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক।”
এরপর আমি তাকে বললাম যে আমরা তাকে পাঁচ হাজার রুপির বেশি দিতে পারবো না, যা সকল ভূমিকার জন্য নির্ধারিত পারিশ্রমিক।
তাকে একটু দ্বিধাগ্রস্ত মনে হলো এবং আমি জানতে চাইলাম, “আপনি কি এর চেয়ে বেশি আয় করছেন?”
“জি, করছি,” তিনি বললেন।
তিনি কী বোঝাতে চাইছেন জানতে চাইলে বললেন কলকাতার এক প্রতিষ্ঠানে তিনি মাসে ষোলো’শ রুপি করে পাচ্ছিলেন।
“আমি চাকুরি ছেড়ে চলে এসেছি,” তিনি বললেন।
আমি অবাক হলাম, “আপনি বলতে চাইছেন যে এই ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার জন্য আপনি মাসিক ষোলো’শ রুপি বেতনের চাকুরি ছেড়ে দিয়েছেন? ধরুন আমরা যদি আপনাকে অভিনয়ের জন্য না নেই?”
“কাউকে তো এ ধরনের ঝুঁকি গ্রহণ করতে হবে,” এমন দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বললেন, “ভূমিকা আপনার।”
আমি আমার সেক্রেটারি আবদুর রহমানকে ডেকে চুক্তির কথাগুলো বলে দীর্ঘ তরুণ লোকটিকে তার নাম ও ঠিকানা বলতে বললাম।
“অমিতাভ —” একটু দ্বিধার পর আবার বললেন, “অমিতাভ বাচচান, কেয়ার/অফ ড. এইচ, আর বাচচান —”
“থামুন,” আমি বললাম।
“আমি আপনার পিতার সম্মতি পাওয়ার আগে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে না। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে ‘নেহরু অ্যাওয়ার্ড কমিটি’তে আমার সহকর্মী। আমি চাই না যে তার সঙ্গে আমার কোনো ভুল বোঝাবুঝি হোক। আপনাকে আরও তিন দিন অপেক্ষা করতে হবে।”
“আপনি আমার বাবাকে খোলামেলা বলতে পারেন। আমাকে কী আপনার ঘর পালানো ছেলে মনে হয়?”
তাকে বললাম ঘর পালানোদের বিশেষ কোনো চেহারা থাকে না।
অতএব, আমি চুক্তির পরিবর্তে নয়া দিল্লিতে ড. বাচচানকে একটি চিঠির ডিকটেশন দিলাম এবং জানতে চাইলাম তিনি কি তার ছেলেকে একজন অভিনেতা হওয়ার অনুমতি দিতে সম্মত কি না। তিন দিন পর একটি টেলিগ্রাম পেলাম, যাতে লেখা ছিল, “যেখানে আপনি আছেন, সেখানে কোনো আপত্তি নেই।” এটাই হলো, অভিতাভ বাচচানের চলচ্চিত্র জগতে আগমণের পুরো কাহিনি। এক মাস বা আরও কিছু সময় পর্যন্ত আমাকে উর্দু ভাষার কঠিন শব্দগুলোর উচ্চারণ তাকে শেখাতে হয়, যা তার কাব্যিক সংলাপে ছিল।
একটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন বলে মনে করি, কারণ অমিতাভ ও আমার সম্পর্কে প্রচুর বাজে গুজব ছড়ানো হচ্ছিল। যেমন, বলা হচ্ছিল যে আমার ছবিতে অমিতাভকে ভূমিকা দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী সুপারিশ করে চিঠি পাঠিয়েছেন। কেউ কোনো সুপারিশ পত্র নিয়ে এলে আমি তাদের কোনো ভূমিকা দেই না। তাছাড়া অমিতাভ বাচচানকে আমার ছবিতে নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী কোনোভাবেই আমাকে লিখেননি অথবা আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি।
আমাদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করার পর তিনি সুনীল দত্তের ‘রেশমা আউর শেরা’ ছবিতে একটি ছোট, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পান। আমি তাকে হৃষিকেশ মুখার্জির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম, যা তাকে ‘আনন্দ’ ছবিতে নির্বাচিত হওয়ার পথ করে দেয়। এতে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। শিল্পী নির্বাচনে হৃষিদা’র নিজস্ব পদ্ধতি ছিল। আমি যদি তাকে পরিচয় করিয়ে নাও দিতাম, তাহলে অন্য কেউ তা করতো। আমি অমিতাভের সাফল্যে আনন্দিত, কারণ আমি জানি, তিনি অনেক ম্যাটিনি শো তারকার চেয়েও ভালো অভিনেতা।”