সর্বকালের সেরা প্লেবয় কবি লর্ড বায়রন

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

শিষ্টাচার বর্জিত যৌনলিপ্সা, অপচয়, খামখেয়াল ও অগোছালো জীবন কাটানো সত্ত্বেও ইংরেজি ভাষার অন্যতম সেরা কবি লর্ড বায়রন কাব্য প্রতিভায় তাঁর সমসাময়িক সকল কবিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। এখনও তাঁর কবিতা বিশ্ব সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। অনিয়ন্ত্রিত যৌনাচারের কারণে তিনি বিতর্কিত; একই সঙ্গে রোমান্টিক কবি হিসেবে সমাদৃত। তিনি সকল যুগের সেরা প্লেবয় কবি হিসেবেও খ্যাত। তাঁর পুরো নাম জর্জ গর্ডন লর্ড বায়রন। ১৭৮৮ সালে তিনি লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮২৪ সালে ৩৫ বছর ৯ মাস বয়সে গ্রীসে মারা যান। “ম্যাড জ্যাক” নামে খ্যাত লর্ড বায়রনের পিতা জন বায়রনের মৃত্যুও ঘটে ৩৫ বছর বয়সে। পরবর্তী সময়ে লর্ড বায়রন বলেছিলেন যে তার পিতা নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করেছেন, যদিও তা প্রমাণিত হয়নি। বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়, লর্ড বায়রনের একমাত্র বৈধ সন্তান অ্যাডা লাভেলেস, বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার ছিলেন, পিতার মত তারও মৃত্যু হয় মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। ১৮২৪ সালে পিতার মৃত্যুর সময়ে অ্যাডার বয়স ছিল মাত্র আট বছর এবং মারা যান ১৮৫২ সালে। জীবনের শেষ বছরগুলোতে তিনিও পিতার মতই নানা আসক্তিতে জড়িয়ে পড়েন – যার মধ্যে ছিল কামুকতা, মাত্রাতিরিক্ত মদ্য ও আফিম সেবন এবং জুয়া খেলে ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়া।

অভিজাত পরিবারে জন্ম হয়েছিল লর্ড বায়রনের। এক ব্যারন পরিবারের ষষ্ঠ উত্তরাধিকারী ছিলেন তিনি। চাচার মৃত্যুর পর মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি “লর্ড” উপাধি লাভ করেন। বলা হয় যে তিনি উদগ্র যৌনলিপ্সার উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন তাঁর কামুক পিতার কাছ থেকে এবং শরীরের ওজনের সমস্যার উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন তাঁর মায়ের নিকট থেকে। সংক্ষিপ্ত জীবনের এক পর্যায়ে তাঁর ওজন দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২০০ পাউন্ড। গ্লাসের পর গ্লাস ভিনেগার পান, একদিন পাইন বৃক্ষের রস থেকে তৈরি চ্যুইং গাম ও আলু সেদ্ধ খেয়ে পরের দিন অভূক্ত থাকাসহ ওজন কমানোর কোনো চেষ্টাই কাজে লাগেনি।

লর্ড বায়রনের জীবন যৌন কাহিনিতে ভরপুর। যৌনকর্মে পুরুষ ও নারীর বাছবিচার ছিল না তাঁর। বরং সমকামে তিনি এত কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন যে, তাঁকে ১৮১৬ সালে ইংল্যান্ড ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য ইটালি চলে যেতে হয়েছিল। কারণ ওই যুগে ইংল্যান্ডে সমকামের অপরাধে শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড, গে ও লেসবিয়ান সকলের ক্ষেত্রে এ শাস্তি প্রযোজ্য ছিল। অতএব তিনি ইংল্যান্ডে অবস্থান করলে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলতে হতো। আসলেই তখনকার ইংল্যান্ড এ ধরনের যৌন বিকৃতদের জন্য ভয়াবহ স্থান ছিল ছিল। ইংল্যান্ড ত্যাগে বাধ্য হওয়ার পর ইংল্যান্ডের সবকিছুর ওপর তাঁর ঘৃণা জন্মে। কিন্তু আত্মনির্বাসিত জীবনেও তিনি তাঁর ইংলিশ ঠাঁটবাট, রসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখেছিলেন। দেশ ত্যাগ করেও কবি বায়রন তাঁর একাধিক পুরুষ যৌনসঙ্গীর সঙ্গে প্রেমের উচ্ছাস ব্যক্ত করেছেন। যদিও জন্ম থেকেই তাঁর একটি পা খোঁড়া ছিল, কিন্তু তিনি খেলাধূলায় সক্রিয় অংশ গ্রহণ করতেন। পায়ের খুঁত নিয়ে প্রচণ্ড আত্মসচেতন ছিলেন বায়ন এবং নিজেই নিজের নামকরণ করেছিলেন খোঁড়া শয়তান!” তা সত্ত্বেও তিনি মনে করতেন যে, তিনি এমন এক আকর্ষণীয় পুরুষ, যে আকর্ষণকে কোনো পুরুষ বা নারী প্রতিরোধ করতে পারতো না এবং তিনি তাদেরকে অবলীলায় তাঁর শয্যাসঙ্গী করতেন। তিনি তাঁর যৌন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ভাবতেন, “পুরুষ যৌনসঙ্গীরা চতুর, কিন্তু চুম্বনে নারী সেরা।”

কবির এক সময়ের প্রেমিকা লেডি ক্যারোলিন ল্যাম্ব লর্ড বায়রনের সমকামের বিষয়গুলোকে বেশি ছড়িয়েছেন বলে বলা হয় এবং তিনি তাঁকে “ম্যাড, ব্যাড এন্ড ডেঞ্জারাস টু নো” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

সৎ বোন অগাস্টা মারিয়া লী লর্ড বায়রনের পাঁচ বছরের বড় ছিলেন। দুই ভাইবোনের মধ্যে দীর্ঘদিন পর্যন্ত যৌন সম্পর্ক ছিল এবং বোনের গর্ভে তাঁর এক সন্তানের জন্ম হয়েছিল। শুধু তাই নয় অভিনেত্রী, উচ্চ বংশজাত বিবাহিতা নারী এবং অসংখ্য পুরুষের সঙ্গে তাঁর প্রণয় ও যৌন সম্পর্ক ছিল, এবং তা এত বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ছিল যে, ২১ বছর বয়সের মধ্যে তিনি গনোরিয়া ও সিফিলিসে আক্রান্ত হন। বায়রনের জন্য তাঁর কোনো সম্পর্কই ত্রিভূজ প্রেম হিসেবে আসেনি, বরং তাঁর প্রেমিকা (গার্লফ্রেন্ড) ও প্রেমিকদের (বয়ফ্রেন্ড) কাছে তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল অনেকটা যাদুকরী আকর্ষণ, অথবা আলোর প্রতি পতঙ্গের ছুটে আসার মত। খ্যাতি ও কুখ্যাতি উভয় অবস্থাই তাঁর প্রতি মানুষকে এমন আকর্ষণ করতো যে এটিকে ওই সময়ে বলা হতো ‘বায়রোম্যানিয়া’ (Byromania) বা বায়রন বাতিক; অনেকে বায়রনের সবকিছু অনুকরণ করার চেষ্টা করতো তাঁর অনুগামীরা, যা ষাটের দশকে সঙ্গীত শিল্পী এলভিস প্রিসলির ক্ষেত্রে ঘটেছিল।

তবে লর্ড বায়রনের জীবনে নি:শর্ত প্রেম ছিল প্রাণীর প্রতি। তিনি যখন ক্যামব্রিজে পড়াশোনা করছিলেন, তখন তিনি একটি কুকুর পুষতেন এবং সেটিকে ডরমিটরিতে তাঁর সঙ্গে রাখতে শুরু করলে কর্তৃপক্ষ কুকুর রাখা নিষিদ্ধ করে। বায়রন ক্ষুব্ধ হয়ে একটি শান্তশিষ্ট ভালুক কেনেন। তিনি বের করেছিলেন যে ডরমিটরিতে কুকুর পোষার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ভালুক পোষার উপর নিষেধাজ্ঞা নেই। ভালুকটিকে তিনি কুকুরের মত গলায় চেন বেঁধে সাথে নিয়ে ঘুরতেন এবং পথচারিদের ভীত প্রতিক্রিয়ায় আনন্দ অনুভব করতেন। পরবর্তী জীবনের তিনি যখন ভেনিসে ছিলেন তখন তাঁর বাড়িকে একটি ছোটখাট চিড়িয়াখানায় পরিণত করেছিলেন, যেখানে ছিল আটটি ঘোড়া, আটটি বৃহদাকৃতির কুকুর, পাঁচটি ময়ুর, দুটি গিনি মুরগী, তিনটি বানর, পাঁচটি বিড়াল, একটি ঈগল, একটি কাক ও একটি বাজ ও একটি মিশরীয় সারস।

ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে লর্ড বায়রনসহ তার সঙ্গীদের প্রিয় স্থানে পরিণত হয়েছিল নিউস্টেড অ্যাবে। এখানে যেসব খ্রিস্টান সাধু ও বায়রনের পূর্বপুরুষদের কবরস্থ করা হয়েছিল, তাদের মাথার খুলি দিয়ে ফুলদানি বানিয়ে দেয়াল বরাবর রাখা হয়েছিল। পান করার জন্য তার মগটি ছিল সাধুদের একজনের খুলি। পারসে স্যালির মৃতদেহ যখন দাহ করা হয়, তখন তিনি জানতে চেয়েছিলেন যে তিনি তার খুলিটি রাখতে পারেন কিনা, কিন্তু পানপাত্র হিসেবে খুলি ব্যবহারে তার পাগলামির কারণে তাকে খুলি দিতে অস্বীকার করা হয়।
আট বছর ইটালিতে নির্বাসিত জীবন পর লর্ড বায়রনের জীবনে একঘেঁয়েমির সৃষ্টি করেছিল। ১৮২৩ সালে গ্রীসে যান এবং অটোম্যান শাসনের বিরুদ্ধে গ্রীসের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১৮২৪ সালের ১৯ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মরদেহ ইংল্যাণ্ডে ফিরিয়ে এনে তাঁর পৈতৃক আবাস নটিংহ্যামশায়ারে কবরস্থ করা হয়। গ্রীসের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর ভূমিকার জন্য সেখানে তাঁকে বীর হিসেবে শ্রদ্ধা করা হয়।