গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সাক্ষাৎকার

 অনুবাদ: বিপাশা মন্‌ডল

নোবেল বিজয়ী কলাম্বিয়ান লেখক ও বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। ৮৭ বছর বয়সে মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটিতে জীবনাবসান ঘটে এই লেখকের। তার লেখা ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুড’ বিশ্বজুড়ে ৩০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। মার্কেজের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে প্যারিস রিভিউতে ছাপা হওয়া তার এই সাক্ষাৎকারটি বাংলানিউজের পাঠকের জন্য অনূদিত হলো। প্যারিস রিভিউ’র পক্ষে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন পিটার এইচ. স্টোন।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের এই সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছে তাঁর অফিস কাম স্টুডিওতে। মেক্সিকো শহরের দর্শনীয় বর্ণময় ফুলে পরিপূর্ণ একটি পুরনো কিন্তু অত্যন্ত আকর্ষণীয় দৃষ্টিনন্দন স্যান এঞ্জেল ইনের মধ্যে তার বসতবাড়ির ঠিক পেছনে এটা অবস্থিত। প্রধান বাড়ি থেকে স্টুডিওটি অল্প একটু হাঁটা পথের দূরত্বে। একটি বিস্তৃত নিচু দালানবাড়ি, এটাকে দেখে মনে হয় এটা আসলে একটি অতিথিশালা হিসেবে নকশা করা হয়েছিল। এর এক প্রান্তে, একটি পালঙ্ক, দুটো ইজি চেয়ার, এবং একটি কাজ চালানো গোছের বার— মাথার উপরে মিনারেল ওয়াটার সরবরাহের ব্যবস্থাসহ একটি ছোট সাদা ফ্রিজ।



এই কক্ষটির সবচেয়ে মনোযোগ আকর্ষণকারী হচ্ছে বিষয়টি সোফার উপরে রাখা একটি ফটোগ্রাফ, একাকী গার্সিয়া মার্কেজ, একটি স্টাইলিশ ক্যাপ পরে আছেন, বাগানের মধ্যে খসে পড়া পড়ন্ত পাতার উপরে দাঁড়িয়ে আছেন যেন তাকে ঠিক অ্যান্থনি কুইনের মতো লাগছে।

স্টুডিওর দূর প্রান্তে গার্সিয়া মার্কেজ তার ডেস্কে বসে ছিলেন। হালকা স্ফূর্তিযুক্ত পদক্ষেপে তিনি আমাকে অভিনন্দন জানাতে উঠে এলেন। নীরেট শরীরের অধিকারী তিনি, পাঁচ ফুট আট অথবা নয় ইঞ্চি লম্বা, যাকে আসলে মাঝারি ধরনের লড়াকুর মতো দেখাচ্ছিল— চওড়া বুক, তবে সম্ভবত তিনি পায়ের কাছে কিছুটা শীর্ণ। তিনি ঘরে পড়ার সাধারণ পোশাক পরে ছিলেন। সস্তা মোটা সুতি কাপড়ের পাজামা, বনঘুঘুর ঘাড়ের মতো সোয়েটার এবং কালো চামড়ার জুতো। তাঁর চুল ছিল ঘন কোঁকড়া বাদামী এবং ঠোঁটের উপরে দশাশই গোঁফ।

তিন দিন সন্ধ্যার পরে কমপক্ষে দু’ঘণ্টা করে এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছিল। যদিও গার্সিয়া মার্কেজের ইংরেজি যথেষ্ট ভালো, তাও বেশিরভাগ সময়েই তিনি স্পেনিশে বলছিলেন, এবং তাঁর দুই ছেলে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে সাহায্য করেছিল। যখন গার্সিয়া মার্কেজ বলছিলেন, তাঁর শরীর সামনে পিছনে দুলছিল। তাঁর হাতদুটোও কোন একটি বিশেষ বিষয়ে গুরুত্ব প্রদানের উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত ইঙ্গিত দেবার জন্য অল্প করে নড়ছিলো, অথবা তাঁর চিন্তার ক্ষেত্রে কোনো গতি দেবার জন্যও অঙ্গভঙ্গি প্রকাশ। তিনি ধারাবাহিকভাবে তাঁর শ্রোতার দিকে ঝুঁকেছিলেন, এবং যখন চিন্তাশীলভাবে কিছু বলছিলেন তখন তিনি পিছনে সরে গিয়ে পা দুটোকে আড়াআড়ি রেখে কথা বলছিলেন।

পিটার এইচ. স্টোন: টেপরেকর্ডার ব্যবহার করায় আপনি কেমন বোধ করছেন?
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ: সমস্যাটা হচ্ছে যখন তুমি জেনে যাও যে তোমার সাক্ষাৎকার রেকর্ড হচ্ছে, তোমার মনোভাব পরিবর্তিত হবে। আমার ক্ষেত্রে যেটা হয় আমি সাথে সাথে একটা প্রতিরক্ষামূলক মনোভাব তৈরি করে নিই। একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি অনুভব করি যে, একটি সাক্ষাৎকারে কিভাবে টেপ রেকর্ডার ব্যবহার করতে হয় তা আমরা এখনো শিখে উঠতে পারিনি। আমার মনে হয়, সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে একজন সাংবাদিক কোনো নোট না নিয়েই একটি দীর্ঘ কথোপকথন করবেন। এরপর পরে তিনি এই কথোপকথটির সম্বন্ধে স্মরণ করার চেষ্টা করবেন এবং তিনি যা অনুভব করেছেন তা এক ধাক্কায় লিখে ফেলবেন, এতে সাক্ষাৎকারের সময় বলা ঠিক সেই শব্দটিগুলোই ব্যবহার করার কোনো দরকার নেই। অন্য একটি দরকারি পদ্ধতি হচ্ছে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎকারের নোট নেয়া এবং এরপরে তা নিশ্চিত অনুরাগের সঙ্গে ভাবানুবাদ করা। আপনি দূর হতে যা যা চিহ্নিত করবেন রেকর্ড করা ক্যাসেটে তার সবই থাকবে, যার সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে এটা ঠিক সেই ব্যক্তির প্রতি অনুরাগ বহন করে না, কারণ এটা একইভাবে সংরক্ষিত এবং স্মরণকৃত কথোপকথন যখন আপনি নিজের কাছে নিজে নির্বোধ ব্যক্তি হিসেবে তৈরি করছেন। একারণে যখন কথোপকথনের মধ্যে টেপরেকর্ডার থাকে, তখন আমি সচেতন থাকি যে আমার সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে; যখন সেখানে কোন টেপ রেকর্ডার থাকে না, আমি আত্ম-সচেতনহীনভাবে এবং পরিপূর্ণ স্বাভাবিক পন্থায় কথা বলে থাকি।

পিটার: ঠিক আছে, আপনি আমাকে টেপ রেকর্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছুটা অপরাধী করে ফেললেন, কিন্তু আমার মনে হয় যে এধরনের সাক্ষাৎকারে আমাদের সম্ভবত এটা দরকার।
মার্কেজ: যা হোক, এইমাত্র আমি যা বললাম তার পুরো উদ্দেশ্য হলো আপনাকে আত্মসমর্থনের মধ্যে ফেলে দেয়া। 

পিটার: তো আপনার সাক্ষাৎকার গ্রহণের ক্ষেত্রে আপনি নিজে কখনোই টেপ রেকর্ডার ব্যবহার করেন নি?
মার্কেজ: একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি কখনোই এটা ব্যবহার করিনি। আমার খুব ভালো একটি টেপ রেকর্ডার আছে, কিন্তু আমি ওটাকে শুধুমাত্র গান শোনার জন্য ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি কখনোই কোন সাক্ষাৎকার গ্রহণ করিনি। আমি রিপোর্ট করেছি, কিন্তু প্রশ্ন করো উত্তর নাও এধরনের কোনো সাক্ষাৎকার গ্রহণ করিনি।

পিটার: আমি একটি বিখ্যাত সাক্ষাৎকার সম্পর্কে শুনেছি ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজের একজন নাবিকের সঙ্গের সাক্ষাৎকার।
মার্কেজ: এটা কোনো প্রশ্নোত্তরের সাক্ষাৎকার ছিল না। নাবিকটি আমাকে কেবল তার অভিযান সম্পর্কে বলেছেন এবং আমি তা পুনর্লিখন করেছি যাতে তাঁর নিজের বক্তব্য থাকে এবং উত্তম পুরুষে থাকে, এমন যেন যিনি লিখছেন তিনি সেই নাবিকই। যখন সেই কাজটা খবরের কাগজে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হলো, দুই সপ্তাহের জন্য একদিন একটা করে অংশ, সেটা সেই নাবিকের সাক্ষরকৃত ছিল, আমার নয়। বিশ বছর পরে সেটা পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল এবং লোকজন বের করেছিল যে আমিই ওটা লিখেছিলাম ততদিন পর্যন্ত, কোনো সম্পাদকই অনুভব করতে পারেনি এটা কতটা ভালোকাজ ছিল, যতদিন না পরবর্তীতে আমি একশ বছরের নিঃসঙ্গতা  লিখেছিলাম।

পিটার: আমরা সাংবাদিকতা সম্পর্কেই কথা বলছি শুরু থেকে, আবারও একজন সাংবাদিক হতে আপনার কেমন লাগবে, এত দীর্ঘ দিন ধরে উপন্যাস লেখার পরে? আপনি কি এ দুটোকে ভিন্নভাবে অনুভব করেন অথবা ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেন।
মার্কেজ: একজন সাংবাদিক হিসেবে কাজ করাই যে আমার প্রকৃত পেশা আমি সে বিষয়ে সবসময়েই স্থিরভাবে বিশ্বাস করতাম। আগে সাংবাদিকতা বিষয়ে আমি যা পছন্দ করতাম না তা ছিল কাজের শর্ত। পাশাপাশি, সংবাদপত্রের স্বার্থে আমার চিন্তা ও ধারণাকে শর্ত মেনে চলতে হতো। এখন, একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে কাজ করার পরে, এবং একজন ঔপন্যাসিক হিসেবেই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পরে, আমি সত্যিই সেই সব থিমকে বেছে নিতে পারছি যেটা আমার বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং এবং আমার ধারণার অনুরূপ। যে কোনো ক্ষেত্রে, আমি সবসময়েই সাংবাদিকতার মহান সুযোগকে উপভোগ করেছি।

পিটার: সাংবাদিকতার মহান কাজ আপনার জন্য কোনটি?
মার্কেজ: জন হেরাসির হিরোশিমা ছিল একটি ব্যতিক্রমধর্মী কাজ।

পিটার: এখনকার কোন ঘটনা যা আপনি বিশেষভাবে পছন্দ করছেন তা কি বলবেন?
মার্কেজ: এসব তো অনেক আছে, এবং বিচিত্র সব যা আমি ইতিমধ্যে লিখে ফেলেছি। আমি পর্তুগাল, কিউবা, এঙ্গোলা এবং ভিয়েতনাম সম্পর্কে লিখেছি। পোল্যান্ড সম্পর্কেও আমার লেখার খুব ইচ্ছে ছিল। আমার মনে হয়, যদি আমি ঠিকঠাক মতো বলতে পারতাম এখন কী ঘটছে, এটা খুব ভালো একটি ঘটনা হতো। কিন্তু পোল্যান্ডে এখন খুবই ঠাণ্ডা; আমি এমন একজন সাংবাদিক যে কিনা তার আরামকে পছন্দ করে।

পিটার: আপনার কি মনে হয় যে উপন্যাস সেইসব কাজগুলো করতে পারে যা সাংবাদিকতা পারে না?
মার্কেজ: কিচ্ছু না। আমার মনে হয় না এখানে আদৌ কোনো পার্থক্য আছে। উৎস একই, উপাদানও একই, উপায় এবং ভাষাও একই। ড্যানিয়েল ডিফোর প্লেগের বছরের দিন-পঞ্জী  একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস এবং সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে হিরোশিমা হচ্ছে একটি শ্রেষ্ঠ কাজ।

পিটার: সাংবাদিক এবং ঔপন্যাসিকেরা কি সত্য বনাম কল্পনার ভারসাম্যের ক্ষেত্রে ভিন্নতর দায়িত্ব পালন করেন?
মার্কেজ: সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে থাকে শুধুমাত্র একটা ঘটনা যেটা হচ্ছে পুরো কাজের কৃত্রিম পূর্বধারণা বা পক্ষপাত। এ দুয়ের মধ্যে, ফিকশনের মধ্যে একটা একক ঘটনা থাকে যেটা হচ্ছে সত্য, পুরো কাজটাকে বৈধতা দেয়। এটাই একমাত্র পার্থক্য, এবং এটা লেখকের প্রতিশ্রুতির মধ্যে নিহিত থাকে। একজন ঔপন্যাসিক যদি চান যে কোনো কিছু করতে পারেন তিনি এসময় পর্যন্ত লোকজনদের সেসবের ওপর বিশ্বাসও স্থাপন করাতে পারেন।

পিটার: কয়েক বছর আগের এক সাক্ষাৎকারে আপনাকে মনে হচ্ছিল যে আপনি শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয় ও বিস্ময়ের সঙ্গে আপনার সাংবাদিকতার কার্যক্রমের দিকে ফিরে তাকাতে চান তখন আপনি ঠিক কতটা দ্রুততর ছিলেন।
মার্কেজ: এখন উপন্যাস লেখা বা সাংবাদিকতার জন্য লেখা দুটোই আমার কাছে আগেকার চেয়ে কষ্টকর। যখন আমি দৈনিক পত্রিকার জন্য কাজ করতাম, আমি যা লিখতাম তার প্রত্যেকটি শব্দ সম্পর্কে ঠিক ততটা  সচেতন ছিলাম না, বাস্তবিকই এখন যেটা আমি। যখন আমি এল এসপেকতাদোর ইন বোগোতা এর জন্য কাজ কাজ করছি, আমি প্রায়ই এক সপ্তাহে তিনটি করে গল্প লিখতাম, প্রতিদিন দুটি অথবা তিনটি করে সম্পাদকীয় নোট লিখতাম, এবং আমি সিনেমারও রিভিউ করতাম। এরপর রাত্রিবেলা, প্রত্যেকে যখন বাড়ি চলে গেছে, আমি আমার উপন্যাসের পিছনে বসতাম। আমি লাইনোটাইপমেশিনের গোলমেলে শব্দ পছন্দ করতাম, যেটার শব্দ ঠিক যেন বৃষ্টি ঝরার শব্দের মতো। যদি ঐ মেশিন থেমে যেত, এবং আমি নৈঃশব্দ্যের মধ্যে রয়ে যেতাম, আমি কাজ করতে পারতাম না। এখন আমার কাজের ফসল অপেক্ষাকৃত কম। কোনো একটি বেশি করে কাজ করার দিনে সকাল নয়টা থেকে বিকেল দুটো বা তিনটে পর্যন্ত সময়ে আমি বড়জোর চার বা পাঁচ লাইনের একটি ছোট প্যারাগ্রাফ লিখতে পারি, যেটা আমি প্রায়ই পরের দিন ছিড়ে ফেলি।

পিটার: উচ্চ প্রশংসা অথবা কোনো ধরনের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কারণেই কী আপনার লেখায় এধরনের পরিবর্তন এসেছে?
মার্কেজ: এটা থেকেই এসেছে। এটা চিন্তা করি যে, যেসকল কল্পনা আমি অনেক অনেক লোকের জন্য লিখি এর থেকে আমি সবসময় কল্পনা করি যে এতে একটা নিশ্চিত সাধারণ দায়িত্ব বর্তায় যেটা সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক। সেখানে এমনকী গর্বও মিশ্রিত থাকে, আগে যেমন কম ভাবমূল্য বহন করেছে আমি ওরকম চাই না। 

পিটার: আপনি কিভাবে লেখা শুরু করেছিলেন?
মার্কেজ: এঁকে। কার্টুন ছবি এঁকে। আমি লিখতে ও পড়তে পারার আগে আমি প্রায়ই স্কুল এবং বাড়িতে কমিক আঁকতাম। সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা হলো যখন আমি হাইস্কুলের ছাত্র একজন লেখক হিসেবে আমার অনেক সম্মান ছিল, যদিও প্রকৃতপক্ষে আমি কখনোই কিছু লিখিনি। যদি সেখানে কোনো ক্ষুদ্র পুস্তিকা বা দরখাস্ত লিখতে হতো, আমিই ছিলাম সেই যে ওটা লিখে দিত কারণ আমি ছিলাম সেই ধরে নেওয়া লেখক। যখন আমি কলেজে প্রবেশ করলাম, সাধারণভাবেই আমার খুব ভালো একটা সাহিত্যিক  পশ্চাদপট এসে যায়, আমার প্রায় সকল বন্ধুরাই গড়ে বিবেচ্য। বোগোতার বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমি আমার নতুন বন্ধু এবং পরিচিত লোকজন বাড়াতে লাগলাম, যারা আমাকে সমসাময়িক লেখকদের সঙ্গে পরিচয় করাতো। একদিন রাতে আমার এক বন্ধু আমাকে ফ্রানৎজ কাফকার একটি ছোটগল্পের বই ধার দেয়। আমি অবসরের ফাঁকে ওটাকে নিয়ে দি মেটামরফসিস পড়তে শুরু করলাম। প্রথম লাইনটি আমাকে বিছানাতে একরকম টেনে তুললো। আমি এত বিস্মিত ছিলাম। প্রথম লাইন পড়লাম, ‘গ্রেগর সামসা ঐ সকালে একটা বাজে স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলো, সে নিজেকে তার বিছানায় দেখতে পেল  একটি দৈত্যাকার পোকায় পরিণত হয়ে গেছে…’। আমি যখন ওই পঙক্তিটা পড়লাম আমি নিজে নিজে ভাবলাম যে আমি এমন কাউকে চিনি না যে কিনা ওরকমটা লিখতে পারে। যদি আমি এমন কাউকে চিনতাম তবে আমি অনেক অনেক আগে থেকেই লেখালেখি শুরু করতে পারতাম। কাজেই আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছোটগল্প লেখা শুরু করলাম। ঐ গল্পগুলো পুরোপুরি বুদ্ধিবৃত্তিক ছোটগল্প কারণ আমি ওগুলো লিখেছিলাম আমার সাহিত্যিক অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে এবং তখন পর্যন্ত আমি সাহিত্য এবং জীবনের কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাইনি। বোগোতার এল এসপেকতাদোর দৈনিকের সাহিত্য পত্রিকায় ঐ গল্পগুলো ছাপা হয়েছিল এবং ওগুলো ঐ সময়ে নিশ্চিত সফলতা পেয়েছিল— সম্ভবত একারণে যে কলম্বিয়ার কেউই বুদ্ধিবৃত্তিক ছোটগল্প লেখেনি। তখন পর্যন্ত যা কিছু লেখা হয়েছিল তা ছিল গ্রাম্য জীবন এবং সামাজিক জীবনের জীবনচিত্র। যখন আমি আমার প্রথম দিককার ছোটগল্পগুলো লিখি আমি বলেছিলাম যে ওগুলোতে জয়েসের প্রভাব রয়েছে।

পিটার: আপনি কি তখন জয়েস পড়েছিলেন?
মার্কেজ: আমি কখনোই জয়েস পড়িনি সে পর্যন্ত, কাজেই আমি ইউলিসিস পড়তে শুরু করলাম। আমি ওটা তখনকার সহজপ্রাপ্য স্পেনীয় সংস্করণ থেকে পড়লাম। তখন থেকে, ইউলিসিস ইংরেজিতে পড়ে একইভাবে খুব চমৎকার এক ফরাসী অনুবাদ পড়ে, আমি এটা দেখেছি যে প্রকৃত স্পেনিশ অনুবাদ খুবই খারাপ ছিল। কিন্তু আমি কিছু জিনিস শিখতে পারলাম যেটা আমার পরবর্তী লেখালেখিতে খুবই উপকারী হয়েছিল— অর্ন্তগত স্বগত উক্তির কৌশল। পরবর্তীকালে আমি এটা ভার্জিনিয়া উলফের মধ্যেও দেখেছি, এবং জয়েসের চেয়েও আমি তাঁর ব্যবহৃত পদ্ধতিকে বেশি পছন্দ করি। যদিও আমি পরে অনুধাবন করি যে ব্যক্তি এই অর্ন্তগত স্বগত উক্তির উদ্ভাবন করেছেন তিনি হচ্ছেন লাজারিলো দে টোরমেস এর অজ্ঞাতনামা লেখক।

পিটার: প্রথম দিকে আপনাকে অনেক প্রভাবিত করেছে এমন কয়েকজনের নাম কি আপনি বলতে পারবেন?
মার্কেজ: যে সকল লোকেরা আমাকে আমার ছোটগল্পের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতা থেকে মুক্ত করতে প্রকৃতই সাহায্য করেছেন তারা হচ্ছেন আমেরিকার বিগত প্রজন্মের লেখককুল। আমি হৃদয়ঙ্গম করেছি যে তাদের সাহিত্যের সঙ্গে জীবনের একটা সম্পর্ক আছে যেটা আমার গল্পে ছিল না। এবং এরপর এমন একটি ঘটনা জায়গা করে নিল যেটা এই মনোভাবকে সম্মান করার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ওটা ছিল ১৯৪৮ সালের ৯ই এপ্রিলের বোগোতাজো, যখন একজন রাজনৈতিক নেতা, গেইতানকে যখন গুলি করে হত্যা করা হলো এবং বোগোতার জনগণ পাগল হয়ে প্রলাপ বকতে বকতে রাস্তায় নেমে এলো। আমি আমার দুপুরের খাবার জন্য অবসর নিয়েছি তখন আমি খবরটি শুনলাম। আমি দৌড়ে চলে গিয়েছিলাম ঐ জায়গাটায়, কিন্তু গেইতানকে তখন মাত্র একটি ট্যাক্সিতে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমার খাবারের বিশ্রামে ফেরার মধ্যে, লোকজন ইতোমধ্যে রাস্তায় নেমে গিয়েছে এবং তারা দোকানপাট লুট এবং দালানগুলোর জ্বলে যাওয়া দেখছে। আমি তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম। ঐ বিকেল এবং সন্ধ্যায়, আমি কী ধরনের দেশে বসবাস করছি এ বিষয়ে সচেতন হলাম, এবং আমার ছোটগল্পগুলো এর যে কোনো কিছুর সঙ্গে কত অল্প করতে পারে। এবং পরে আমাকে যখন জোর করে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ব্যারেনকুইলায় ফেরত পাঠানো হলো, যেখানে আমি আমার শৈশব কাটিয়েছি, আমি অনুধাবন করলাম যে এটাই সেই জীবন যেটা আমি যাপন করতাম, জানতাম, এবং আমি এ বিষয়ে লিখতে চেয়েছিলাম।
     ১৯৫০ বা ১৯৫১-এ অন্য আরেকটি এমন ঘটনা ঘটলো যেটা আমার সাহিত্যের প্রবণতাকে প্রভাবিত করলো। আমার মা আমাকে আরাকাটাকাতে তাঁর সঙ্গে থাকার জন্য বললেন, যেখানে আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম, এবং যে ঘরটিতে আমার জীবনের প্রথমবছরগুলো কাটিয়েছি সে ঘরটি বিক্রি করার জন্য বললেন। আমি যখন সেখানে গেলাম এটা আমার জন্য প্রথমেই খুব একটা চমকে যাবার মতো ব্যাপার ছিল কারণ তখন আমার বয়স ছিল বাইশ এবং আমি সেখানে আট বছর বয়স থেকে আর বসবাস করতাম না। প্রকৃতপক্ষে কিছুই পরিবর্তিত হয়নি, কিন্তু আমার মনে হলো যে আমি সত্যি সত্যিই এই গ্রামটিকে কখনো দেখিনি। কিন্তু এটার সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা আছে যেন আমি কোথাও এটার সম্পর্কে পড়েছি। এটা এমন ছিল যেন সবকিছু আমি যা দেখেছিলাম সবই কোথাও লেখা হয়ে গিয়েছিল, এবং আমি যেন কোথাও বসে পড়ে সব কিছু নকল করে নিয়েছি যা আমি পড়েছি এবং যা এখানে এর মধ্যেই আছে। সকল ব্যবহারিক উদ্দেশ্যের জন্য সবকিছুই যেন সাহিত্যের মধ্যে প্রকাশিত হয়ে গেছে; ঘরগুলো, লোকজন, এবং স্মৃতি। আমি নিশ্চিত নই ঐ সময় আমি ফকনার পড়ে ফেলেছি অথবা পড়িনি, কিন্তু এখন আমি জানি যে ফকনারের মতো এই কৌশলটা আমাকে আমি যা দেখেছিলাম তা লিখে ফেলতে সমর্থ করতো। ঐ পরিবেশ, অবক্ষয়, গ্রামের মধ্যের গরম খসড়া অবস্থায় যেন সেই একই যা আমি ফকনারে অনুভব করেছি। ওটা ছিল একটা কলা উৎপাদনকারী এলাকা, যেখানকার অধিবাসীরা ছিল ফল কোম্পানি থেকে আসা প্রচুর সংখ্যক আমেরিকান যেটা আমি খুঁজে পেয়েছি দক্ষিণের গভীরের লেখকদের মধ্যে। সমালোচকরা হয়তো বলবেন এটা ফকনারের সাহিত্যিক প্রভাব, কিন্তু আমি এটাকে একটি কাকতাল বলেই দেখেছি। আমি সাধারণভাবে সেই সব উপাদান খুঁজে পেয়েছি যেটা আলোচনায় এসেছে যে একইভাবে একই উপায়ে একই ধরনের উপাদান ফকনারও ব্যবহার করেছেন।
     গ্রামের সেই ভ্রমণ থেকে ফিরে আসার পর আমি আমার প্রথম উপন্যাস লিখলাম পাতা ঝড়। যেটা সত্যিই আমার আরাকাটাকার ভ্রমণে ঘটেছিল যাতে আমি অনুধাবন করতে পেরেছিলাম ঐসবকিছু যা আমার শৈশবে ঘটেছে তার একটি সাহিত্যিক মূল্য আছে যার মূল্য আমি শুধুমাত্র এখনই বুঝতে পারছি। যে মুহূর্তে আমি পাতা ঝড় লিখলাম আমি বুঝতে পারলাম আমি একজন লেখক হতেই চেয়েছি এবং এজন্য কেউই আমাকে থামাতে পারবে না এবং শুধুমাত্র একটি বিষয়ই আমার জন্য অবশিষ্ট আছে যে আমাকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক হবার জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে। ওটা ছিল ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ, কিন্তু ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের আগে আমি আমার প্রথম লেখক সম্মানী পাইনি আমার আটটি বইয়ের মধ্যে তখন পাঁচটি লেখা হয়ে গেছে।

পিটার: আপনি কি মনে করেন যে তরুণ লেখকদের মধ্যে এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার যে তারা তাদের শৈশবের মূল্য এবং অভিজ্ঞতাকে ফিরিয়ে দেয় এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়ের দিকে যায় যেটা আপনি শুরুতে করেছিলেন।
মার্কেজ: না, পদ্ধতিটা সাধারণত অন্যান্য উপায়ে জায়গা করে নেয়, কিন্তু যদি আমি কোনো তরুণ লেখককে উপদেশ দিই যে তার সঙ্গে যা ঘটেছে তাই যেন সে লেখে; এটা বলা সবসময়েই সহজ যে যখন একজন কোনো বিষয়ে লেখে সেটা হয়তো তার সঙ্গে ঘটেছে অথবা সেসময়ের কিছু একটা সে পড়েছে অথবা তাকে  বলা হয়েছে। পাবলো নেরুদার কবিতার একটি লাইন আছে যাতে তিনি বলেছেন, ‘ঈশ্বর, যখন আমি গান গাই আমাকে কল্পনা থেকে সাহায্য করো’। এটা সবসময়ই আমার জন্য আনন্দদায়ক হয়েছে যে আমার কাজের সবচেয়ে বেশি বেশি প্রশংসা এসেছে যে কাজগুলো আমার কল্পনা থেকে এসেছে, যেখানে আমার পুরো কাজের মধ্যে একটিমাত্র লাইনও সত্যি নয়, বা সেটা কোনো বাস্তবতার ভিত্তিকে করা হয়নি। সমস্যা হচ্ছে ঐটা যে ক্যারিবিয়ান বাস্তবতা হচ্ছে বন্যতম কল্পনার অনুরূপ।

পিটার: এখানে আপনি কাদের জন্য লেখেন? আপনার শ্রোতা কারা?
মার্কেজ: পাতা ঝড় লেখা হয়েছিল আমার বন্ধুদের জন্য, যারা আমাকে বই ধার দিয়েছিল এবং নানাভাবে সাহায্য করেছিল এবং আমার কাজ সম্পর্কে ভীষণ আগ্রহান্বিত ছিল। সাধারণভাবে আমি মনে করি আপনি অবশ্যই কারো জন্য লিখে থাকেন। যখন আমি লিখি, সবসময়েই এবিষয়ে সতর্ক থাকি যে এই বন্ধুরা এটা অবশ্যই পছন্দ করবে, অথবা অন্য কোনো বন্ধু এই অনুচ্ছেদটি অথবা অধ্যায়টি পছন্দ করবে, সবসময়েই কোনো বিশেষ লোকের কথা চিন্তা করতে থাকি। শেষ পর্যন্ত সকল বইই আপনার বন্ধুদের জন্য লেখা হবে। একশত বছরের নিঃসঙ্গতা লেখার পর যে সমস্যাটি এলো, যে সকল লক্ষ লক্ষ পাঠকের জন্য আমি ওটা লিখেছি আমি আর তাদের চিনি না; এটা আমাকে বিশৃঙ্খল করে এবং বাধা দেয়। এটা যেন ঠিক লক্ষ লক্ষ লোক আপনার দিকে তাকিয়ে আছে এবং কিন্তু আপনি সত্যিই জানতে পারছেন না যে তারা আসলে কী ভাবছে।

পিটার: আপনার ফিকশনে সাংবাদিকতার প্রভাব রয়েছে কি?
মার্কেজ: আমার মনে হয় এই প্রভাবটা খুবই পরস্পর সম্বন্ধবাচক। ফিকশন আমার সাংবাদিকতাকে সাহায্য করে কারণ এটা সংবাদকে একটা সাহিত্যিক মূল্য দেয়। সাংবাদিকতা আমার ফিকশনকে সাহায্য করে কারণ এটা আমাকে বাস্তবতার সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কে ধরে রাখে।

পিটার: পাতা ঝড় লেখার পরে আপনি যে বিশেষ লেখকরীতি অনুসন্ধান করেছেন এবং আপনি আপনার একশত বছরের নিঃসঙ্গতা লিখতে সফল হয়েছেন এই খোঁজকে আপনি কিভাবে বর্ণনা করবেন?
মার্কেজ: পাতা ঝড় লেখার পরে, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে গ্রাম সম্পর্কে ও নিজের শৈশব সম্পর্কে লেখালেখি আসলেই নিজের মুখোমুখি হওয়া থেকে এবং আমার দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে একধরনের পলায়ন। আমার আসলে একধরনের কৃত্রিম অস্পষ্ট বিশ্বাস ছিল, যেটা আমি চলতে থাকা রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে সাহসের সঙ্গে সম্মুখিন হবার বদলে, আমার এই ধরনের গৃহকাতরতার পেছনে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম। ওটা ছিল সেই সময় যখন রাজনীতি এবং সাহিত্যের মধ্যকার সম্পর্ক ছিল খুব বেশি বাদানুবাদের বিষয়। আমি এই দুয়ের মধ্যকার দূরত্বেকে কমানোর চেষ্টা করেছি। ফকনার আমাকে প্রভাবিত করেছিলেন; এখন প্রভাবিত করছিলেন হেমিংওয়ে। আমি লিখলাম, কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না, শয়তানের প্রহর, এবং বিগ মামার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, যেগুলো সবই কমবেশি একই সময়ে লেখা হয়েছিল এবং যাতে অনেক বিষয়ই একই রকম ছিল। এই গল্পগুলো পাতা ঝড় এবং একশত বছরের নিঃসঙ্গতার গল্পের থেকে ভিন্ন গ্রামে অবস্থান করে নিয়েছিল। এটা ছিল এমন গ্রাম যেখানে কোনো জাদু ছিল না। এটা হচ্ছে একটি সংবাদভিত্তিক সাহিত্য। কিন্তু আমি যখন শয়তানের প্রহর শেষ করলাম, আমি দেখলাম আমার সকল দর্শনই আবারও ভুল হচ্ছে। আমি দেখতে পেলাম যে আমি যা ভাবতাম তার চেয়ে আমার শৈশবকে নিয়ে আমার লেখা ছিল বেশি পরিমাণে রাজনৈতিক এবং আরো আমার দেশের প্রশ্নে অনেক বেশি বাস্তবতার কাছাকাছি। শয়তানের প্রহর লেখার পর পাঁচ বছর আমি আর কিছুই লিখিনি। আমি সবসময় যা করতে চাইতাম সে বিষয়ে আমার একটা পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু সেখানে কিছুর অভাব ছিল এবং সেটা যে কি সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম না, যতদিন পর্যন্ত না আমি সঠিক সুরটি আবিষ্কার করতে পারলাম— সেই সুর যা অবশেষে আমি একশত বছরের নিঃসঙ্গতা বইয়ে ব্যবহার করেছি। আমার দাদীমা গল্প বলতে যে ভঙ্গি ব্যবহার করতেন এটার ভিত্তি ছিল সেটা। তিনি যে বিষয়ে বলতেন সেটা শুনতে যেন অলৌকিক এবং অবাস্তব বলে মনে হতো, কিন্তু তিনি সেটাকেই একেবারে পরিপূর্ণ স্বাভাবিকতার সঙ্গে বলতেন। শেষ পর্যন্ত আমি যখন এই সুরটি আবিষ্কার করলাম ওটাকে আমাকে ব্যবহার করতে হলো, আমি আঠারো মাস একটানা প্রতিদিন কাজ করলাম।

পিটার: কী করে তিনি এই ‘অদ্ভুত’কে এত স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ করতেন?
মার্কেজ: যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হচ্ছে তাঁর মুখে যে অভিব্যক্তি ছিল সেটি। তিনি যখন গল্প বলে চলতেন তখন তিনি তাঁর মুখভঙ্গির এতটুকু পরিবর্তন ঘটাতেন না, এবং প্রত্যেকে বিস্মিত হয়ে যেত। একশ বছরের নিঃসঙ্গতা লেখার প্রথম দিককার প্রয়াসে আমি এই গল্পটিকে বিশ্বাস না করে বলতে চেয়েছিলাম। আমি আবিষ্কার করলাম যে আমি যা করতে চাই আমার নিজেকে তাকে বিশ্বাস করতে হবে এবং এগুলোকে সেই একই অভিব্যক্তিতে লিখতে হবে যে চেহারায় আমার দাদীমা তাদের বলতেন; পাথুরে চেহারায়।

পিটার: এখানেও মনে হয় যে একটি সাংবাদিকসুলভ ধরন রয়েছে এই কৌশল অথবা সুরে। আপনি আপাতদৃষ্টিতে এই বিস্ময়কর ঘটনাটাকে এই কয়েক মিনিটের মধ্যে বিশদ বর্ণনা করেছেন এতে এটায় তাদের নিজেদের বাস্তবতাকে তুলে ধরা হয়েছে। এটা কি কিছুটা এরকম যে আপনি সাংবাদিকতা থেকে সযত্নে বাছাই করেছেন এসব?
মার্কেজ: ওটা একটা সাংবাদিকসুলভ কৌশল যেটাকে আপনি সাহিত্যেও ব্যবহার করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি বলেন যে সেখানে আকাশে হাতিরা উড়ছে, লোকজন আপনাকে বিশ্বাস করতে যাবে না। কিন্তু যদি আপনি বলেন যে সেখানে চারশ পঁচিশটি হাতি আকাশে উড়ছে, লোকজন সম্ভবত আপনাকে বিশ্বাস করবে। একশত বছরের নিঃসঙ্গতা পরিপূর্ণভাবে এই ধরনের জিনিস। ওটা একেবারে সেই কৌশল যেটা আমার দাদীমা ব্যবহার করতেন। আমি বিশেষভাবে গল্পের সেই চরিত্রটির কথা স্মরণ করতে পারি যে কিনা হলুদ প্রজাপতি দ্বারা ঘেরা থাকতো। যখন আমি খুবই ছোট একজন ইলেকট্রিশিয়ান আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আমি খুবই কৌতুহলী হয়ে উঠেছিলাম তার ব্যাপারে, কারণ তার সাথে ছিল একটি হলুদ বেল্ট, যা দিয়ে তিনি ইলেকট্রিক পোস্টে ঝুলে থাকতেন। আমার দাদীমা প্রায়ই বলতেন যে প্রত্যেকবারই যখন এই লোকটি আসেন, তিনি ঘরটাকে প্রজাপতিতে পরিপূর্ণ করে রেখে যান। কিন্তু আমি যখন এটা লিখি, আবিষ্কার করি যদি আমি না বলি যে প্রজাপতিগুলো হলুদ ছিল, লোকজন ওটা বিশ্বাস করবে না। যখন আমি সুন্দরী রেমেডিওস স্বর্গে যাচ্ছে এই এপিসোডটি লিখি, এটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে দীর্ঘ সময় নিতে হয়। একদিন আমি বাগানে বেড়িয়ে আসি এবং দেখি একজন নারী যিনি প্রায়ই এ বাড়িতে আসতেন আর কাপড় ধুয়ে বাতাসবহুল জায়গায় মেলে দিতেন। তিনি বাতাসের সঙ্গে অনুযোগ করতেন বাতাস যেন কাপড়গুলো উড়িয়ে না নেয়। আমি আবিষ্কার করি আমি যদি সুন্দরী রেমেডিওসের জন্য এই কাপড়গুলো ব্যবহার করি, সে হয়তো স্বর্গে চলে যাবে। ব্যাপারটাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য এটা এভাবেই আমি করেছিলাম। প্রত্যেক লেখকের জন্যই বিশ্বাসযোগ্য করে তোলাটা একটা সমস্যা। যে কেউ যে কোনোকিছু লিখতে পারে যদি এটা বিশ্বাসযোগ্য হয়। 

পিটার: একশত বছরের নিঃসঙ্গতা’য় উল্লিখিত অনিদ্রার মহামারী বিষয়টির উৎপত্তির জায়গা কোনটি?
মার্কেজ: ওডিপাসের শুরু থেকে সবসময় আমি প্লেগ সম্পর্কে ভীষণ আগ্রহী ছিলাম। আমি মধ্যযুগীয় প্লেগ সম্পর্কে প্রচুর পড়াশোনা করেছি। আমার প্রিয় বইয়ের মধ্যে একটা হচ্ছে ড্যানিয়েল ডিফোর প্লেগের বছরের দিনপঞ্জী। অন্যান্য কারণের মধ্যে, যেহেতু ডিফো একজন সাংবাদিক, তিনি যা বলতেন পুরোপুরি অবাস্তব বলে মনে হতো। অনেক বছর ধরে আমি ভেবেছিলাম, ডিফো নিজে পরিদর্শন করে লন্ডনের প্লেগ সম্পর্কে লিখেছেন। কিন্তু পরে আমি আবিষ্কার করি এটা একটা উপন্যাস ছিল, কারণ লন্ডনে যখন প্লেগের আক্রমণ ঘটতো ডিফোর বয়স ছিল তখন সাত বছরেরও কম। প্লেগ সবসময়ই আমার কাছে একটি পুনরাবর্তক বিষয় হিসেবে বিভিন্ন আকারে ছিল। শয়তানের প্রহর গল্পে, ক্ষুদ্র পুস্তিকাগুলো ছিল প্লেগের। অনেক বছর ধরে আমি ভাবছিলাম কলম্বিয়ার রাজনৈতিক সহিংসতার সাধারণ দর্শন যেন ঠিক সেই প্লেগের মতো একই। একশত বছরের নিঃসঙ্গতা লেখার আগে ‘শনিবারের পরের এক দিন’ গল্পে প্লেগকে আমি পাখি মারার কাজে ব্যবহার করেছিলাম। একশত বছরের নিঃসঙ্গতা’য় অনিদ্রার মহামারীকে সাহিত্যিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করলাম, এখন পর্যন্ত এটা ঘুমানোর মহামারীর ঠিক উল্টো দিক। বস্তুত সাহিত্যচর্চা আসলে কাঠমিস্ত্রিগিরি ছাড়া আর কিচ্ছু নয়।

পিটার: সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ের মধ্যকার এই সাদৃশ্য বা বিরোধালংকারের ব্যাপারটাকে আরেকটু বিস্তৃতভাবে ব্যাখা করবেন কি?
মার্কেজ: এই দুটোই ভীষণ কঠিন কাজ। লেখালেখি করা ঠিক যেন একটি টেবিল তৈরির মতোই কঠিন কাজ। দুটোই আপনাকে করতে হবে বাস্তবতার নিরিখে, ঠিক কাঠের মতোই শক্ত নিরেট একটি উপাদান দিয়ে। দুটোই বিশেষ নৈপূণ্য এবং প্রয়োগকৌশলে পরিপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে খুব অল্প পরিমাণ জাদু এবং প্রচুর পরিমাণে পরিশ্রম এখানে সম্পৃক্ত থাকে। এবং ঠিক প্রুস্তের মতোই আমি ভাবি, বলি, এটা দশ ভাগ প্রণোদনা নেয় এবং নব্বই ভাগই ঘর্মনিঃসরণ করায়। আমি কখনো কাঠমিস্ত্রির কাজ করিনি কিন্তু আমার সবচেয়ে পছন্দের কাজ এটা, বিশেষ লক্ষ্যণীয় ব্যাপার এই যে, তুমি কাউকেই খুঁজে পাবে না যে তোমার জন্য এ কাজটা করে দেবে!

পিটার: একশত বছরের নিঃসঙ্গতা’র কলার জ্বর সম্পর্কে কী বলবেন? ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির ওপরে এর কতটা ভিত্তি ছিল?
মার্কেজ: বাস্তবতার একেবারে কাছ থেকে কলার জ্বরের প্রতীকটি নেয়া হয়েছে। অবশ্যই, আমি বিষয়গুলোর উপরে বিশেষ সাহিত্যিক নৈপূণ্য ব্যবহার করেছি যাতে সেটাকে ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণ করা না যায়। উদাহরণস্বরূপ, স্কয়ারের বেপরোয়া গণহত্যা একেবারে সঠিক তথ্য, কিন্তু আমি ওটা সাক্ষ্য-প্রমাণ সহকারে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে লিখি, এটা কখনোই জানা যায়নি ঠিক কতগুলো লোককে হত্যা করা হয়েছিল। আমি সংখ্যাটি দিয়েছি তিন হাজার, এটা অবশ্যই একটি অতিরঞ্জন। কিন্তু আমার শৈশবের স্মৃতিগুলোর একটিতে আমি দেখতে পাই একটি দীর্ঘ, ভীষণ দীর্ঘ রেলগাড়ি কলায় পরিপূর্ণ হয়ে এই চাষভূমি ছেড়ে যাচ্ছে। সেখানে কমপক্ষে তিনহাজার ওটার উপরে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। এটা খুবই বিস্ময়কর যে এখন তারা খুবই সাধারণভাবে স্বাভাবিকভাবে কংগ্রেসে এবং পত্রপত্রিকায় বলে ফেলে যে ‘তিন হাজার মারা গেছে’। আমি সন্দেহ করি যে আমাদের অর্ধেক ইতিহাসই এরকম অনুমানপ্রসূত। গোত্রপতির শরৎকাল-এ, এর নির্দেশক বলেছেন এটা কোনো বিষয় না যে এটা এখন সত্যি নয়, কারণ ভবিষ্যতে কোনো একদিন এটা সত্যি হয়ে উঠবে। অতি শীঘ্র হোক বা দেরিতে লোকজন সরকারের চাইতে লেখককেই বেশি বিশ্বাস করে।

পিটার: এটা লেখককে যথেষ্ট শক্তিশালী করে তোলে, তাই নয় কি?
মার্কেজ: হ্যাঁ, এবং আমিও এটা উপলব্ধি করি। এটা আমাকে দায়িত্বশীলতার এক মহান বোধে আচ্ছন্ন করে। আমি সাংবাদিকতার যে অংশটিতে কাজ করতে সত্যিই পছন্দ করি সেটা হচ্ছে পুরোপুরি সত্য এবং বাস্তবতায়, কিন্তু সেটা একশত বছরের নিঃসঙ্গতার মতো কল্পনাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। আমি যত বাস করতে থাকি এবং অতীত থেকে বিষয়গুলো স্মরণ করি, যত আমি চিন্তা করি দেখি যে সাহিত্য এবং সাংবাদিকতা ভীষণ নিকট সম্পর্কিত।

পিটার: একটি দেশ যদি তার বৈদেশিক ঋণের জন্য তার সমুদ্রকে দিয়ে দেয় তবে কী হবে, যেমনটা গোত্রপতির শরৎকাল-এ ঘটেছিল!
মার্কেজ: হ্যাঁ, কিন্তু ওটা সত্যিই ঘটেছিল। এটা ঘটেছিল এবং আরো অনেকবার ঘটবে। গোত্রপতির শরৎকাল— একটি সম্পূর্ণই ঐতিহাসিক বই। প্রকৃত ঘটনার বাইরে সম্ভাব্যকে খুঁজে বের করা সাংবাদিক এবং ঔপন্যাসিকদের কাজ, এবং এটা নবীদেরও কাজ। সমস্যাটা হচ্ছে প্রচুর মানুষ বিশ্বাস করে যে আমি কল্পনাশ্রয়ী ফিকশনের লেখক, তাই যখন আমি সত্যিই বাস্তববাদী ব্যক্তি এবং আমি যা বিশ্বাস করি সেটা লিখি এটাই হচ্ছে যথার্থ সামাজিক বাস্তবতা।

পিটার: এটা কি ইউটোপিয়ান?
মার্কেজ: যদি ইউটোপিয়ান শব্দটি দিয়ে বাস্তব অথবা আদর্শ বোঝায় সেক্ষেত্রে আমি এতে নিশ্চিত নই। কিন্তু আমি মনে করি যে এটাই হচ্ছে বাস্তব।

পিটার: উদাহরণস্বরূপ, গোত্রপতির শরৎকাল-এর চরিত্রসমূহ, পরিচালকগণ, এর ছাঁচ কি বাস্তব চরিত্র থেকে নেয়া হয়েছে? এদের ফ্রাঙ্কো, পেরণ এবং ত্রুজিলোর মতো মনে হয়।
মার্কেজ: প্রত্যেক উপন্যাসে, চরিত্র হচ্ছে একটি কোলাজ, পৃথক চরিত্রের কোলাজ, যেসব চরিত্রসমূহকে আপনি জানেন, অথবা সেসব চরিত্র সম্বন্ধে আপনি পড়েছেন অথবা আপনি শুনেছেন এসবের আলাদা চরিত্রের কোলাজ। আমি সবকিছু পড়েছি যেটা আমি পুরো গত শতাব্দীর এবং এই শতাব্দীর শুরুতে লাতিন আমেরিকার স্বৈরশাসকদের মধ্যেও খুঁজে পেয়েছি। এছাড়াও আমি প্রচুর লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি যারা স্বৈরশাসনের অধীনে বসবাস করতেন। কমপক্ষে দশ বছর আমি এটা করেছি। এবং যখন আমার একদম পরিষ্কার ধারণা হয়েছে যে চরিত্রগুলো ঠিক কী ধরনের হতে যাচ্ছে, আমি যা কিছু শুনেছি এবং পড়েছি সেসবের সবকিছু ভুলে যাবার জন্য একটা জোর চেষ্টা করেছি, এজন্য যে যেটা বাস্তব জীবনে ছিল সে সবের কোনো ধরনের কোনোটিকে ব্যবহার না করেই আমি যেন সবকিছু কল্পনা করে নিতে পারি। আমি একটা জিনিস অনুধাবন করতে পারছিলাম যে, আমি নিজে স্বৈরশাসনের অধীনে কখনো কোনো পর্যায়েই বসবাস করিনি, তাই আমি চিন্তা করলাম, যদি আমি বইটি স্পেনে লিখি, একটি প্রতিষ্ঠিত স্বৈরশাসনের পরিবেশ ঠিক কী ধরনের ছিল তা আমি দেখতে পারবো। কিন্তু আমি দেখতে পেলাম যে স্পেনে ফ্রাঙ্কোর অধীনের স্বৈরশাসন অন্যান্য ক্যারিবিয়ান স্বৈরশাসনের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। কাজেই প্রায় এক বছর বইটির কাজ একধরনের বন্ধই ছিল। সেখানে কিছু একটা বাদ পড়ে গিয়েছিল এবং আমি জানি না আসলে সেটা কী ছিল। এরপর একরাত্রের মধ্যেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত কাজটি হবে যদি আমরা ক্যারিবিয়ানেই ফিরে আসি। কাজেই আমরা সকলে কলম্বিয়ার ব্যারেনকুইলায় ফিরে এলাম। আমি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে একটি লিখিত বিবৃতি দিলাম যেটাকে তারা একটি কৌতুক হিসেবেই ধরে নিল। আমি বলেছিলাম আমি ফিরে এসেছি কারণ আমি পেয়ারার গন্ধ কেমন তা ভুলে গেছি। আসল সত্য হচ্ছে, এটা হচ্ছে তাই যেটা আমার বইটি সম্পূর্ণ করার জন্য দরকার। আমি ক্যারিবিয়ানের মধ্যে একটি ভ্রমণ উদ্যোগ নিলাম। যাতে আমি দ্বীপ থেকে দ্বীপে যেতে পারি, আমার উপন্যাসে যেটির ঘাটতি ছিল আমি সেই উপাদানটি খুঁজে পেলাম যেটা সেখানে ছিল।

পিটার: আপনি প্রায়ই নিঃসঙ্গতার ক্ষমতার প্রসঙ্গকে ব্যবহার করেন।
মার্কেজ: আপনার প্রচুর ক্ষমতা রয়েছে, কঠিনতর হচ্ছে এটা জানা যে কোন ক্ষমতাটি আপনার মধ্যে নিহিত রয়েছে এবং কোনটি নিহিত নয়। আপনি যখন সেই সুনিশ্চিত ক্ষমতাটির কাছে পৌঁছান, সেখানে বাস্তবতার সঙ্গে কোনো যোগসূত্র থাকে না, এবং সেখানে হতে পারে ঐটাই হচ্ছে জঘন্যতম ধরনের নিঃসঙ্গতা। একজন খুবই ক্ষমতাশালী ব্যক্তি, একজন স্বৈরশাসক, এমনসব স্বার্থপর লোক দ্বারা ঘেরা থাকে যাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো ওই লোকটিকে সকল ধরনের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা; সবকিছুই তার থেকে সকলে মিলে বিচ্ছিন্ন করে রাখে।

পিটার: একজন লেখকের নিঃসঙ্গতার বিষয়টি কী? এটা কি ভিন্ন কিছু?
মার্কেজ: এই নিঃসঙ্গতার ক্ষমতা দিয়ে করার মতো অনেক কিছু থাকে। লেখকের বাস্তবতার প্রতিকৃতি অঙ্কনের অত্যধিক প্রচেষ্টা তাকে প্রায়ই বাস্তবতার দর্শনকে বিকৃত করিয়ে ফেলার দিকে পরিচালিত করে। বাস্তবতার স্থান বদল করাতে গিয়ে সে এটার যোগসূত্র হারিয়ে ফেলে নিঃশেষ হয়ে পড়ে, একটি অবাস্তব কল্পনার মধ্যে, যেমন তারা বলে থাকে। সাংবাদিকতা এটার বিপরীতে একটি ভালো প্রতিরক্ষার কাজ করে। একারণেই আমি সবসময় সাংবাদিকতা করতে চেয়েছি, কারণ এটা আমাকে বাস্তব পৃথিবীর সঙ্গে যোগসূত্র ধরে রেখেছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক সাংবাদিকতা এবং রাজনীতি। একশত বছরের নিঃসঙ্গতা লেখার পরে আমাকে যে নিঃসঙ্গ জীবন ভয় দেখিয়েছে সেটা কোনো লেখকের নিঃসঙ্গ জীবন নয়; সেটা ছিল অত্যধিক খ্যাতির নিঃসঙ্গতা, যেটা ঠিক যেন ক্ষমতার নিঃসঙ্গতার অনুরূপ। আমার বন্ধুরা আমাকে প্রতিরক্ষা করেছে, আমার বন্ধুরাই তারা, যারা সবসময় সেখানে ছিল।

পিটার: কী করে?
মার্কেজ: কারণ আমি আমার সারা জীবন ধরে একই বন্ধুদের ধরে রেখেছি। আমি বোঝাতে চাইছি, আমি আমার পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে কখনো সম্পর্ক নষ্ট করিনি বা সম্পর্কচ্যুত হইনি, এবং তারাই ছিল যারা আমাকে আবার মাটির পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে; তারা সবসময়েই তাদের পা মাটিতে রাখে অর্থাৎ বাস্তব পৃথিবীতে বসবাস করে এবং তারা কিন্তু বিখ্যাত নয়।

পিটার: বিষয়গুলো কিভাবে শুরু হলো? গোত্রপতির শরৎকাল-এ বারবার ঘটা একটি কল্পনা আছে এরকম যে অনেক বিলাসবহুল প্রাসাদের মধ্যে গরুগুলো থাকছে। এটা কি কোনো সঠিক কল্পনা?
মার্কেজ: আমি একটি ছবির বই পেয়েছিলাম যেটা আমি এক্ষুণি আপনাকে দেখাচ্ছি। আমি বিভিন্ন উপলক্ষে এটা বলেছি যে আমার সকল বই-ই কোনো একটা কল্পনা বা ছবি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। গোত্রপতির শরৎকাল-এর কল্পনা আমি প্রথম পাই একজন খুবই বৃদ্ধ লোকের ভীষণ সমৃদ্ধশালী বিলাসবহুল একটি প্রাসাদে বসবাসের ঘটনায়। যেখানে গরুগুলো ঢুকে পড়ে এবং পর্দা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। কিন্তু যতদিন না আমি ছবি দেখেছি ততদিন পর্যন্ত এই কল্পনাটা জমাট বাঁধে নি। রোমে আমি বইয়ের দোকানে গেলাম এবং সেখানে আমি ছবির বইগুলি দেখতে শুরু করলাম, যেগুলোকে আমি সংগ্রহে রাখতে পছন্দ করি। আমি সেখানে এই ছবিটি দেখলাম, এবং ওটা ছিলো যাকে বলে একেবারে যথাযথ। আমি শুধু দেখলাম যে ওটা কিভাবে চলতে পারে। যতদিন না আমি একজন বিরাট বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠি, আমি আমার জীবনের প্রতিদিনকার বিষয়গুলোর মধ্যেই প্রাক্পরিচয় খুঁজতে পারি, এবং তা কোনো মহান শ্রেষ্ঠ শিল্পকৃতির মধ্যে নয়।

পিটার: আপনার উপন্যাস কি কখনো অপ্রত্যাশিতভাবে পাক খেয়ে গেছে?
মার্কেজ: লেখালেখির একেবারে শুরুর দিকে আমার সঙ্গে এটা প্রায়ই ঘটতো। প্রথম গল্পে আমি লিখেছি মেজাজ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা আছে, কিন্তু নিজেকে আমি সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য ছেড়ে দিই। সবচেয়ে ভালো যে উপদেশটি আমি আমার শুরুতেই পেয়েছি তাতে, মানে কাজ করার দিকে ঐ উপায়টা ঠিকই ছিল যখন আমি তরুণ ছিলাম, কারণ আমার উদ্দীপনার একটি বেগবান প্রবাহ ছিল। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছিল যদি আমি কৌশল আয়ত্ত করতে না পারি, পরে আমার অনেক অসুবিধা হবে যখন উদ্দীপনা চলে যাবে এবং কৌশলের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যদি এটা আমি এই সময়ের মধ্যেই শিখতে না পারতাম, তাহলে আমি আগেভাগেই একটি কাঠামোর রূপরেখা দাঁড় করাতে পারতাম না। কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে একটি নিরেট কৌশলগত সমস্যা এবং যদি আপনি ওটাকে শুরুতেই শিখে নিতে না পারেন আপনি এটা কখনোই শিখে উঠতে পারবেন না।

পিটার: তবে তো নিয়মানুবর্তিতা আপনার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়?
মার্কেজ: কোনো দিক দিয়ে অর্থময়তা বহন করে এমন একটি বই আপনি ভীষণরকম নিয়মানুবর্তিতা অনুসরণ না করে কখনোই লিখতে পারবেন বলে আমার মনে হয় না।

পিটার: কৃত্রিম উত্তেজনার বিষয়টি কী?
মার্কেজ: একটা বিষয় যেটা হেমিংওয়ে লিখে গেছেন যেটা আমাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে সেটা ছিল যে লেখালেখি নাকি তাঁর কাছে ছিল মুষ্টিযুদ্ধের মতোই। তিনি তাঁর শরীরের দিকে লক্ষ্য নিতেন এবং নিজের ভালো-থাকার দিকেও যত্ন নিতেন। ফকনারের মাতাল হবার ব্যাপারে একটা খ্যাতি ছিল, কিন্তু যতগুলো সাক্ষাৎকার তিনি দিয়েছেন তিনি বলেছেন মদ্যপান করে একটি মাত্র লাইন লেখাও অসম্ভব। হেমিংওয়েও সেটা বলেছেন। মন্দ পাঠকেরা আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমি কি মাদকাসক্ত হয়ে আমার কাজের কিছু লেখা লিখে থাকি। কিন্তু ওটা একেবারে ছবির মতো বুঝিয়ে দেয় যে তারা সাহিত্য অথবা মাদক সম্পর্কে কিছুই জানে না। একজন ভালো লেখক হতে গেলে আপনাকে আপনার লেখালেখির প্রত্যেকটি মুহূর্তে মানসিকভাবে সুস্থ ও উজ্জ্বল থাকতে হবে, এবং অবশ্যই ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। আমি লেখালেখি সম্পর্কে এরকম রোমান্টিক ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীতে, যেটাতে দৃঢ়তার সঙ্গে বলা হয় যে লেখালেখির কাজ একটা আত্মত্যাগের কাজ, এবং এটা অর্থনৈতিকভাবে খুব খারাপ অবস্থা অথবা মানসিকভাবে খুব খারাপ অবস্থা লেখালেখির জন্য বেশি ভালো। আমার মনে হয় লেখালেখি করতে গেলে আবেগীয় এবং শারীরিক দিক থেকে আপনাকে একেবারে ভালো থাকতে হবে। সাহিত্যিক সৃষ্টিশীলতা আমার কাছে ভালো স্বাস্থ্য দাবি করে, এবং গত প্রজন্ম এটা বুঝতে পেরেছিল। তাঁরা ছিলেন সেসমস্ত লোক, যারা জীবনকে ভালোবাসতেন।

পিটার: ব্লেইজে সেনড্রারাস বলেছেন লেখালেখি হচ্ছে বেশিরভাগ কাজের তুলনায় অনেক সুবিধাজনক কাজ, এবং তাই লেখকেরা তাদের পরিশ্রমের ব্যাপারে অত্যুক্তি করেন। আপনি কী মনে করেন?
মার্কেজ: আমি মনে করি লেখালেখি ভীষণ জটিল কাজ, কিন্তু যেকোনো কাজই সতর্কতার সঙ্গে সম্পাদন করলে এমনটাই হয়। এটার সুবিধাটা কী, যা হোক, এটা হচ্ছে এমন একটা কাজ যেটা আপনি করে থাকেন নিজের সন্তুষ্টির জন্য। আমার মনে হয় যে আমি নিজের কাছে এবং অন্যদের কাছেও অতিরিক্ত পরিমাণে দাবি করি কারণ আমি ভুল বরদাস্ত করতে পারি না; আমি মনে করি যে, যেকোনো কিছু একেবারে সঠিক মাত্রায় করার এটা একটা সুযোগ। যদিও এটা সত্য যে লেখকেরা প্রায়ই নিজেকে বড় বা শক্তিশালী হিসেবে ভাবার বাতিকে ভোগে এবং তারা নিজেদেরকে মহাবিশ্বের এবং সমাজের বিবেকের কেন্দ্র হিসেবেও ভাবে। কিন্তু আমি কোনো কিছু ভালোভাবে করতে পারাটাকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। যখন আমি ভ্রমণ করি এটা জেনে আমি সবসময় সুখী হই যে আমার মতো একজন লেখকের চেয়ে প্লেনের চালকরা আনেক ভালো চালক।

পিটার: কখন আপনি সর্বোত্তম কাজ করেন? আপনার কাজের কি কোনো পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচি থাকে?
মার্কেজ: যখন আমি একজন পেশাদার লেখক হয়ে গেলাম আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে গেল আমার পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচির বিষয়টি। একজন সাংবাদিক হওয়া মানে রাতে কাজ করা। যখন আমি পুরোসময়কাল ধরে লেখা শুরু করলাম তখন আমার বয়স চল্লিশ বছর, প্রকৃতপক্ষে আমার সময়টা ছিল সকাল নয়টা থেকে শুরু করে দুপুর দুইটা পর্যন্ত, যখন আমার ছেলেরা স্কুল থেকে ফেরে। আমি কঠোর পরিশ্রম করতাম, আমার অপরাধবোধ হতে লাগলো যে আমি শুধুমাত্র সকালের সময়টা কাজ করি; কাজেই আমি বিকেলেও কাজ করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমি আবিষ্কার করলাম, যে কাজ আমি বিকেলে করি সেটা আমাকে আবার পরের দিন সকালে করতে হয়। কাজেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি শুধুমাত্র সকাল নয়টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত কাজ করবো, এবং আর কিছুই করবো না। বিকেল বেলায় আমি মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করবো, গল্পগুজব করবো এবং অন্যান্য কাজ যেসব সামনে চলে আসে তাই করবো। আমার আরো একটি সমস্যা আছে, আমি শুধুমাত্র পরিচিত পরিবেশে এবং যে পরিবেশ আমার জন্য উষ্ণ সেসব পরিবেশেই কাজ করতে পারি। আমি কোনো ধার করা কক্ষ বা টাইপরাইটারে কিংবা হোটেলে কাজ করতে পারি না। এ অভ্যাস সমস্যার, কারণ আমি যখন কোথাও বেড়াতে যাই তখন আমি কাজ করতে পারি না। অবশ্যই আপনি কোনো একটা অজুহাত খুঁজে বের করতে থাকবেন কম কাজ করার জন্য। একারণেই যে শর্ত আপনিই আপনার ওপর আরোপ করবেন এবং সেটা সবসময়েই আরো কঠিন হয়ে উঠবে। আপনি আশপাশের পরিবেশ থেকেই বেশি প্রণোদোনা আশা করবেন। এটা হচ্ছে রোমান্টিক শব্দ যা প্রচুর পরিমাণে শোষণ করে নেবে। আমার মার্কসবাদী বন্ধুদের এই শব্দটি স্বীকার করে নিতে প্রচুর জটিলতায় পড়তে হয়, কিন্তু আমরা যেখানেই ওটাকে আহ্বান জানাই না কেন, আমি এ বিষয়ে পুরোপুরি একমত যে সেখানে মনের এক বিশেষ অবস্থান তৈরি হয় যেখানে আপনি বিষয়গুলোকে নিয়ে খুব সহজেই লিখতে পারবেন এবং বিষয়গুলো অত্যন্ত স্বচ্ছন্দভাবে বেড়িয়ে আসবে। সকল ধরনের ওজর-আপত্তি যেমন ধরেন, আপনি শুধু বাড়িতে বসেই লিখতে পারেন এসবকিছুই— অদৃশ্য হয়ে যাবে। মনের এইরকম অবস্থা ও মুহূর্ত শুধুমাত্র বোধহয় তখনই আসতে পারে যখন আপনি যথাযথ প্রসঙ্গ নিয়ে কাজ করেন এবং যথাযথ উপায়ে ওটাকে সম্পাদনা করেন। আপনি বিশেষভাবে পছন্দ করেন এমন কিছুও হতে হবে ওটাকে, কারণ আপনি পছন্দ করেন না এমন কিছু করার চেয়ে খারাপ কাজ আর কিচ্ছু নেই। আরেকটি কঠিন বিষয় হচ্ছে প্রথম প্যারাগ্রাফ। আমি শুধুমাত্র প্রথম অনুচ্ছেদ লেখার জন্য অনেক মাস ব্যয় করেছি, এবং তারপরে একসময় ওটাকে পেয়েছি, পরের বিষয়গুলো খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেড়িয়ে এসেছে। বইয়ের পরের অংশগুলো কেমন হতে যাচ্ছে তার নমুনা হচ্ছে বইয়ের প্রথম অনুচ্ছেদ। একারণেই একটি ছোটগল্পের বই লেখা একটি উপন্যাস লেখার চেয়ে অনেক বেশি জটিল। প্রত্যেকবার ছোটগল্প লেখার সময় আপনাকে আবারো পুরোটা বিষয় একেবারে প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।

পিটার: আপনি কি অনুপ্রেরণা এবং স্বজ্ঞার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখাতে পারেন?
মার্কেজ: অনুপ্রেরণা হচ্ছে তাই যখন আপনি সঠিক বিষয়টিকে খুঁজে বের করেন, এমন একটা জিনিস খুঁজে পান যেটা আপনি সত্যিই ভীষণ পছন্দ করেন; এটা আপনার কাজকে অনেক বেশি সহজ করে তোলে। স্বজ্ঞা— (স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান বা স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি) ও ফিকশন লেখার ক্ষেত্রে মৌলিক বিষয়ের কাজ করে, যেটা কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োজন ছাড়াই অথবা অন্য কোনো বিশেষ ধরনের জ্ঞান অর্জন ছাড়াই বাস্তবতার ক্ষেত্রে একটা বিশেষ উপায় যেটা আপনাকে অর্থ উদ্ধারে সাহায্য করে। মাধ্যাকর্ষণের রীতিকে যে কোনো কিছুর চেয়ে স্বজ্ঞার সাহায্যেই বেশি সহজে অবয়ব দেয়া সম্ভব। এটা কোনো ধরনের কোনো সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়া ছাড়াই অভিজ্ঞতা অর্জনের একটি উপায়। একজন ঔপন্যাসিকের জন্য, স্বজ্ঞা ভীষণরকম আবশ্যিক। প্রকৃতপক্ষে এটা বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি প্রতিকূলে, এটা হচ্ছে সম্ভবত এমন একটা বিষয় যেটাকে আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি— এই বোধে যে প্রকৃত পৃথিবী এক ধরনের অনড় তত্ত্বে পর্যবসিত। স্বজ্ঞা এর সুযোগ নেয় অথবা কখনো নেয় না। আপনি নিশ্চয়ই একটি বৃত্তাকার কীলক-কে একটি বর্গাকার ছিদ্রে রাখার চেষ্টা করবেন না।

পিটার: এটাই কি সেই ব্যাপারটা, যে জায়গা থেকে আপনি তাত্ত্বিকদের অপছন্দ করেন?
মার্কেজ: একেবারে ঠিক। প্রধান কারণ, আমি সত্যিই তাদের বুঝতে পারি না। এটাই প্রধান কারণ আমি কেন বেশিরভাগ জিনিস ক্ষুদ্র উপাখ্যান বা কাহিনীর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করি, কারণ আমার বিমূর্তায়নের কোনো ক্ষমতাই নেই। এজন্য অনেক সমালোচক বলে থাকেন যে আমি অসামাজিক ব্যক্তি। আমি অনেক বেশি উদ্ধৃতি দেই না।

পিটার: আপনি কি মনে করেন যে সমালোচকরা আপনাকে কোনো বিশেষ ধাচে ফেলতে চায়?
মার্কেজ: বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার তত্ত্ব যে কী, সমালোচকরা আমার কাছে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সবচেয়ে প্রথমে, একজন লেখকের কেমন হওয়া উচিত এ বিষয়ে তাদের একটা তত্ত্ব আছে। তারা লেখককে তাদের আদর্শের মধ্যে গুঁজে দিয়ে পেতে চেষ্টা করে, যদি সেই লেখক সেখানে মানিয়ে না যায়, তারা তখনও জোর করে তাকে পেতে চেষ্টা করে যায়। আমি এসব বিষয়ে উত্তর করছি কেবলমাত্র এ কারণে যে আপনি এ বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। আমার সত্যিই এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই যে সমালোচকরা আমার সম্পর্কে কী ভাবেন; আমি অনেক বছর ধরে কোনো সমালোচকের লেখা পড়িনি। তারা নিজেদেরকে লেখক ও পাঠকের মধ্যে অপরের দ্বারা কাজ চালানো একজন প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করেন। আমি সবসময় একজন অতি পরিচ্ছন্ন এবং যথাযথ লেখক হবার চেষ্টা করেছি, চেষ্টা করেছি কোনো সমালোচকের সাহায্য ছাড়াই সরাসরি পাঠকের কাছে পৌঁছাতে।

পিটার: অনুবাদকদের ব্যাপারে আপনার কোনো শ্রদ্ধা-ভক্তি আছে?
মার্কেজ: যারা অনুবাদ করতে গিয়ে শুধু ফুটনোট ব্যবহার করেন, তাদের বাদ দিয়ে অন্য অনুবাদকদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি ও ভালোবাসা রয়েছে। ফুটনোট দেয়া অনুবাদকরা সবসময় লেখক যা বোঝাতে চাননি সেসব বিষয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন; যতক্ষণ ওসব ওখানে থাকে পাঠকদের ওসবের মধ্যেই পড়ে থাকতে হয়। অনুবাদ করা একটি খুবই জটিল বিষয়, এতে একেবারেই কোনো সম্মান পাওয়া যায় না, এবং টাকাপয়সাও খুব কম আয় হয়। একটি ভালো অনুবাদ সবসময়েই অন্য ভাষার একটি পুনঃসৃষ্টি। এ কারণেই আমার গ্রেগরি রাবাসার প্রতি এত অনুরাগ। আমার বই একুশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং রাবাসা হচ্ছেন একমাত্র অনুবাদক যিনি কখনো কোনো বিষয় ব্যাখ্যা করার জন্য আমার কাছে কিছু জানতে চান নি, এজন্য যেন তিনি একটি ফুটনোট তিনি ঢোকাতে পারেন বইয়ে। আমার মনে হয় এটা আমার কাজকে সম্পূর্ণভাবে ইংরেজিতে পুনরায় সৃষ্টি করে। সেখানে বইয়ের কোনো একটা অংশ সাহিত্যিকভাবে অনুসরণ করা খুবই জটিল। পাঠকের এমন ধারণা হবে যেন অনুবাদক বইটি একবার পড়েছেন এবং এরপর তার স্মরণশক্তি দিয়ে পুর্নলিখন করেছেন। এ কারণে আমি অনুবাদকদের এত পছন্দ করি। তারা বুদ্ধিজীবীদের চেয়ে অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান বা অনুভূতির দ্বারা উপলব্ধি করে। প্রকাশকরা তাদের যে পারিশ্রমিক দেন তা সত্যিই অসহনীয় রকম কম এজন্যও যে তারা তাদের কাজকেই কখনো সাহিত্যিক সৃষ্টি হিসেবে গণ্য করেন না। এখানে কিছু বই রয়েছে যেগুলোকে আমি স্পেনিশে অনুবাদ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এগুলো করতে আমার নিজের বই লেখার চেয়ে অনেক অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয় এবং আমার নিজের খাবার খরচ চালানোর জন্য এ থেকে যথেষ্ট টাকা যোগাড় করতে পারবো না।

পিটার: আপনি কী কী অনুবাদ করতে চেয়েছিলেন?
মার্কেজ: সকল ম্যালরাক্সসহ, জোসেফ কনরাড এবং সেন্ট এক্সুপেরি আমি অনুবাদ করতে চেয়েছিলাম। যখন আমি এগুলো পড়েছি তখন আমার কখনো কখনো এমন মনে হয়েছে যে আমি এই বইগুলো অবশ্যই অনুবাদ করবো। মহান সব মাস্টারপিস বাদ দিয়ে, একটি বইয়ের মাঝামাঝি ধরনের অনুবাদ পড়তে পছন্দ করার চেয়ে আমি এটার মধ্য দিয়ে যেতে চাই প্রকৃত ভাষাটার মধ্যে। আমি সত্যিই ভেতরে স্পেনিশকে অনুভব করি। যদিও আমি ইতালিয়ান এবং ফরাসি ভাষা জানি, এবং আমি খুব ভালো ইংরেজি জানি টাইম ম্যাগাজিন আমাকে বিশ বছর ধরে প্রত্যেক সপ্তাহে দূষিত করে চলেছে।

পিটার: মেক্সিকো কি আপনার কাছে এখন বাড়ির মতো মনে হয়? আপনি কি নিজেকে বৃহৎ কোনো লেখক সম্প্রদায়ের অংশ বলে অনুভব করেন?
মার্কেজ: সাধারণভাবে, আমি কোনো লেখক বা শিল্পীর বন্ধু এজন্য নই যে তারা লেখক অথবা শিল্পী তাই। বিভিন্ন পেশায় আমার অনেক বন্ধুবর্গ রয়েছেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন লেখক ও শিল্পীরাও। সাধারণ অর্থবাচকতায়, আমি অনুভব করি, আমি লাতিন আমেরিকার যে কোনো দেশের নাগরিক কিন্তু সবজায়গার নয়। লাতিন আমেরিকা অনুভব করে, স্পেন হচ্ছে একমাত্র দেশ যার মধ্যে আমরা ভালোভাবে আপ্যায়িত হই, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এরকমটা মনে করি না আমি সেখান থেকেই এসেছি। লাতিন আমেরিকায় আমার কোনো সীমান্ত প্রদেশ অথবা শেষ প্রান্তের বোধ নেই। এক দেশ থেকে অন্য দেশের যে ব্যবধান রয়েছে আমি সে বিষয়ে সচেতন, কিন্তু আমার মনে ও হৃদয়ে এই সব দেশ একেবারেই এক। যেখানে আমি সত্যিই ক্যারিবিয়ানকে নিজের বাড়ি বলে মনে করি, হোক সেটা ফ্রেঞ্চ, ডাচ অথবা ইংলিশ ক্যারিবিয়ান। আমি সবসময় এটাতে প্রভাবিত হই যখন আমি ব্যারেনকুইলার কোনো প্লেনে উঠি, নীল পোশাক পরা একজন কালো নারী হয়তো আমার পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মারবে, এবং আমি যখন জ্যামাইকায় প্লেন থেকে নামি, নীল পোশাক পরা একজন কালো নারী আমার পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মারবে, কিন্তু তিনি ইংরেজ। আমি মনে করি না যে ভাষা এসবের মধ্যে খুব বেশি ব্যবধান তৈরি করতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় আমার নিজেকে বিদেশীর মতো অনুভব হয়, নিরাপত্তার বোধ থেকে একটা অনুভূতি যেন আমাকে লুণ্ঠন করে। এটা একটা ব্যক্তিগত অনুভূতি, কিন্তু যখনই আমি ভ্রমণ করি আমার এই অনুভূতিটা হয়। আমার একটি নাবালকসুলভ ন্যায়পরতা রয়েছে।

পিটার: আপনি কি মনে করেন যে লাতিন আমেরিকান লেখকদের কিছু সময়ের জন্য ইউরোপে বসবাস করা উচিত?
মার্কেজ: বাইরে থেকে একটি বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত বোঝার জন্য। ছোট গল্পের বইগুলোতে আমি মনে করেছিলাম যে লাতিন আমেরিকা ইউরোপের দিকে যাচ্ছে। আমি এ বিষয়টি নিয়ে বিশ বছর ধরে চিন্তা করেছি। আপনি যদি গল্পগুলোর একটি সর্বশেষ উপসংহার টানেন, এটা হবে যে লাতিন আমেরিকা খুব কমই ইউরোপকে পেয়েছে, বিশেষ করে মেক্সিকানরা, এবং নিশ্চিভাবে সেখানে অবস্থান করেনি। ইউরোপে আমি যত মেক্সিকানদের পেয়েছি তারা সব সময়েই পরবর্তী বুধবারে ইউরোপ ত্যাগ করছে।

পিটার: লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে কিউবার স্বাধীনতা যুদ্ধ কি পরিমাণ ফলাফল এনেছে বলে আপনি মনে করেন?
মার্কেজ: এখন পর্যন্ত এটা নেতিবাচক। অনেক লেখক যারা নিজেদের অনুগত অনুভব করে নিজেদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে ফেলে তারা যা চায় সে বিষয়ে গল্প লেখে না, বরং তাদের যা চাওয়া উচিত সে বিষয়ে গল্প লেখে। এটা নিশ্চিতভাবে কিছু হিসেবি সাহিত্য তৈরি করে, যেটাতে কোনো ধরনের কোনো অভিজ্ঞতা কিংবা স্বজ্ঞা থাকে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, লাতিন আমেরিকার ওপর কিউবার সাংস্কৃতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে ভীষণ লড়াই হয়েছে। কিউবার নিজের ক্ষেত্রে, প্রক্রিয়াটা ঐ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে অগ্রগতি হয়নি যেখানে কোনো নতুন ধরনের সাহিত্য কিংবা শিল্প তৈরি সৃষ্টি পারে। ওটা এমন কিছু যেটার সময় প্রয়োজন রয়েছে। লাতিন আমেরিকার ওপরে কিউবার সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক গুরুত্ব হচ্ছে এক ধরনের সেতুর দিকে, যেটা এমন একধরনের সাহিত্যকে প্রেরণ করে যেটা লাতিন আমেরিকায় বহু বছর ধরেই রয়েছে। এক কথায়, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে লাতিন আমেরিকার আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ হচ্ছে কিউবার স্বাধীনতা যুদ্ধ। ঐ প্রজন্মের সকল লাতিন আমেরিকার লেখক বিশ বছর ধরে লিখছেন, কিন্তু আমেরিকার এবং ইউরোপের প্রকাশকদের তাদের প্রতি খুব অল্প পরিমাণ আগ্রহই ছিল। যখন সেখানে কিউবার স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলো, লাতিন আমেরিকা এবং কিউবা সম্পর্কে আকস্মিকভাবেই এক বিশাল আগ্রহ তৈরি হলো। এই স্বাধীনতা যুদ্ধ একটি উপভোগের গল্পে পরিবর্তিত হলো। লাতিন আমেরিকা একটি আদর্শে পরিণত হলো। এটা আবিষ্কৃত হলো, যে সকল লাতিন আমেরিকার উপন্যাস রয়েছে সেগুলো অনুবাদের জন্য যথেষ্ট ভালো এবং অন্য সকল আর্ন্তজাতিক সাহিত্যের সঙ্গে বিবেচনার উপযুক্ত। যেটা সবচেয়ে দুঃখের বিষয় ছিল সেটা হচ্ছে এই সাংস্কৃতিক উপনিবেশ লাতিন আমেরিকায় এত খারাপ প্রভাব ফেলেছে যে, লাতিন আমেরিকানরদের নিজেদেরকে এটা বোঝানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে যে বাইরের লোকেরা তাদের ভালো বলার আগেও তাদের নিজেদের উপন্যাসগুলো ভালোই ছিল।

পিটার: কোনো কম পরিচিত লাতিন আমেরিকান লেখক কি রয়েছেন যাকে আপনি বিশেষভাবে পছন্দ করেন?
মার্কেজ: আমার সন্দেহ যে এখন আর তেমন কেউ আদৌ আছেন কিনা। লাতিন আমেরিকার লেখালেখির আকস্মিক গুরুত্ব বেড়ে যাবার অন্যতম একটি বাজে ফলাফল হচ্ছে প্রকাশকরা সবসময় এটা নিশ্চিত করতে চান যে তারা নতুন কোর্তাসারকে কিছুতেই মিস করবেন না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক নতুন লেখকই তাদের নতুন লেখার চেয়ে অনেক বেশি সুনামের জন্য সচেতন। তাউলাউস বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন নতুন ফরাসী ভাষার প্রফেসর রয়েছেন যিনি লাতিন আমেরিকার লেখকদের সম্পর্কে লিখে থাকেন; অনেক নতুন লেখক তাকে লিখে জানান যেন তিনি আমার সম্পর্কে আর এত বেশি না লেখেন কারণ আমার বিষয়ে আর এত বেশি লেখালেখির প্রয়োজন নেই এবং অন্যদের বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু তারা যা ভুলে গেছে তা হচ্ছে আমি যখন তাদের বয়সী ছিলাম সমালোচকেরা আমাকে নিয়ে লিখতেন না, বরং অনেক বেশি লিখতেন মিগুয়েল এঞ্জেল আস্তুরিয়াসকে নিয়ে। সে বিষয়টি আমি দাঁড় করাতে চাচ্ছি তা হচ্ছে এসকল তরুণ লেখকরা নিজেদের লেখার ওপরে কাজ না করে বরং সমালোচকদেরকে লিখে তাদের সময় অপচয় করছেন। ওরকম লেখানোর চাইতে লেখাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমার চল্লিশ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত আমার সাহিত্যিক পেশায় একটা বিষয়কে যেটা আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, আমি কখনো লেখক সম্মানী হিসেবে একটি সেন্টও পাইনি, যদিও ততদিনে আমার পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়ে গেছে।

পিটার: আপনি কি মনে করেন খ্যাতি এবং সফলতা একজন লেখকের পেশাগত জীবনে যদি খুব তাড়াতাড়ি এসে যায় সেটা তাঁর জন্য অমঙ্গলজনক?
মার্কেজ: যে কোনো বয়সে এটা খুবই খারাপ। আমার বইগুলো মরনোত্তর স্বীকৃত হলে আমি বেশি পছন্দ করতাম, কমপক্ষে এটা যদি পুঁজিবাদী শতকে হতো, যেখানে আপনি একধরনের পণ্যদ্রব্যে রূপান্তরিত হতেন।

পিটার: পছন্দের বইগুলোর পাশাপাশি আজকাল আর কী বই পড়ছেন?
মার্কেজ: আমি অদ্ভুত সব জিনিস পড়ছি। মুহাম্মদ আলীর স্মৃতিকথা পড়েছি গতকাল। ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা একটি চমৎকার বই, এবং অনেক বছর আগেই এটা আমি পড়িনি কারণ আমি ভাবতাম এসব বই পড়া সময়ের অপচয় মাত্র। কিন্তু ভরসা করার মতো কোন ব্যক্তি যদি না আমাকে কোনো বই পড়তে বলে, আমি কোনো বই পড়তে বসি না। আমি কোনো ফিকশন পড়ি না। আমি প্রচুর স্মৃতিকথা এবং তথ্য উপাত্ত পড়ে থাকি, এমনকী যদি সেগুলো কোনো বানানো তথ্যও হয়, তাও। এবং আমি প্রচুর বই পুনর্পাঠ করি। পুনর্পাঠের সুবিধা হচ্ছে আপনি যে কোনো পৃষ্ঠা খুলে বসবেন এবং সেই অংশটি পড়বেন যেটা আপনি সত্যিই পছন্দ করেন। শুধুমাত্র ‘সাহিত্য’ পড়ার সেই অলঙ্ঘনীয় মনোভাব আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমি একেবারে সমকালীন থাকতে পছন্দ করি। প্রতি সপ্তাহে সারা পৃথিবী থেকে প্রকাশিত সকল গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা আমি পড়ে ফেলি। টেলিটাইপ মেশিন থেকে খবর পড়ার অভ্যাস থেকে আমি সবসময় খবরের জন্য উৎসুক হয়ে খোঁজ করি। কিন্তু সব জায়গার সকল গুরুত্বপূর্ণ এবং চিন্তামূলক পত্রিকাগুলো পড়ার পরে আমার স্ত্রী সবসময়ে আমার আশেপাশে ঘোরে এবং সেসব খবর বলে যেগুলো আমি শুনিনি। যখন আমি ওকে জিজ্ঞেস করি যে ও কোথায় এসব পড়েছে, ও হয়তো বলে ফেলে যে সে ওটা বিউটি পার্লারের মেয়েদের পত্রিকা এবং জল্পনাকারী পত্রিকায় পড়েছে। কাজেই আমি ফ্যাশন ম্যাগাজিনও পড়ি এবং মেয়েদের জন্য যেসব পত্রিকা ও জল্পনাকারী পত্রিকাগুলোও পড়ি। এবং আমি অনেক কিছু শিখতে পারি যেগুলো শুধুমাত্র ওগুলো পড়েই শেখা যায়। এসব আমাকে ভীষণ ব্যস্ত রাখে।

পিটার: আপনি কি মনে করেন সুখ্যাতি একজন লেখকের জন্য ভীষণ রকম ধ্বংসাত্মক?
মার্কেজ: প্রাথমিক কারণ এটা আপনার ব্যক্তিগত জীবনকে আক্রমণ করে। আপনি বন্ধুদের সঙ্গে যে সময়টা কাটাতেন এটা সেখান থেকে সময় নিয়ে নেয়, এবং সময় নিয়ে নেয় আপনার কাজের সময় থেকেও। এটা বাস্তব পৃথিবী থেকে আপনাকে আলাদা জায়গার দিকে ঝুঁকিয়ে দেয়। একজন খ্যাতিমান লেখককে তাঁর লেখা চালিয়ে নেবার জন্য সর্বদা নিজের সুখ্যাতির বিরুদ্ধে নিজেকে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। আমি সত্যিই এসব বিষয়ে কথা বলতে পছন্দ করি না কারণ এটা কখনোই আন্তরিক বলে মনে হবে না, কিন্তু আমার বইগুলো যদি আমার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হলেই আমি পছন্দ করতাম, তবে আমাকে আর এসকল সুখ্যাতি এবং একজন মহান লেখক হবার বিষয়গুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হতো না। আমার ক্ষেত্রে, সুনামের একটা মাত্র সুবিধা আছে যে আমি এই সুনামকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছি। অন্যথায়, এটা যথেষ্ট অস্বস্তিকর। সমস্যা হচ্ছে আপনি দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই খ্যাতিমান ব্যক্তি এবং আপনি বলতে পারছেন না, ‘ঠিক আছে, আমি আগামীকাল থেকে আর খ্যাতিমান থাকবো না।’ অথবা একটি বোতাম চাপলেন এবং বললেন, ‘আমি এখানে অথবা এখন থেকে আর খ্যাতিমান নই।’

পিটার: একশত বছরের নিঃসঙ্গতা’র যে এত সফলতা অর্জন করবে আপনি কি আগে কোনোভাবেই তা অনুমান করতে পেরেছিলেন?
মার্কেজ: আমি জানতাম, এটা হচ্ছে সেই বই যেটা আমার বন্ধুদের আমার অন্যান্য বইয়ের থেকে বেশি সন্তুষ্ট করবে। কিন্তু, আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম যখন আমার স্পেনীয় প্রকাশক আমাকে বললেন যে তিনি বইটির আট হাজার কপি প্রকাশ করতে যাচ্ছেন , কারণ আমার অন্যান্য বইগুলো কখনো সাতশ কপির বেশি বিক্রি হয় নি। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ধীরে ধীরে কেন এগোচ্ছেন না, কিন্তু তিনি আমাকে বললেন তিনি এ বিষয়ে প্রমাণ পেয়েছেন যে এটা একটা অত্যন্ত চমৎকার বই এবং এই আট হাজার কপি বইয়ের সবই মে থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বিক্রি হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে এই সব বই-ই এক সপ্তাহের মধ্যেই বুয়েনস আয়ার্সে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।

পিটার: আপনি কি কল্পনা করতে পেরেছিলেন যে একশত বছরের নিঃসঙ্গতা মানুষের মধ্যে এতটা আলোড়ন তুলবে?
মার্কেজ: আমার কোনোরকম কোনো সুক্ষ্ম ধারণাও ছিল না, কারণ আমার লেখার আমি বড় বাজে সমালোচক। প্রায়ই একটা ব্যাখ্যা এর সম্বন্ধে আমি সবচেয়ে বেশি যা শুনেছি তা হচ্ছে এটা নাকি লাতিন আমেরিকার লোকদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে লেখা বই, এমন একটা বই যেটা ভেতর থেকে লেখা হয়েছে। এই ব্যাখ্যা আমাকে আশ্চর্যান্বিত করেছে কারণ আমার লেখার প্রথম উদ্যোগে এই বইয়ের নাম হতে যাচ্ছিল ঘর। এ উপন্যাসের সমস্ত উন্নয়ন ঘর থেকে জায়গা করে নিক আমি এরকমটাই চাচ্ছিলাম, এবং এর বাইরের যেকোনো কিছু সম্পর্কের ফলাফল হবে শুধুমাত্র ঐ ঘরের উপরে। পরে আমি ঘর শিরোনামটি ছেড়ে দেই, কিন্তু একসময় বইটি মাকোন্দো শহরে যায় এটা আরো দূরে কোথাও যেতে পারেনি। অন্য আরেকটি ব্যাখ্যা আমি শুনেছি যে প্রত্যেক পাঠক এই বইয়ের চরিত্র তৈরি করতে পারে যা সে চেয়েছে এবং তাদেরকে তার নিজের করে নিয়েছে। আমি কখনো চাইনি এটা সিনেমা হোক, যখনই একজন সিনেমা দর্শক একটি মুখ দেখবে যে হয়তো আর নিজেকে ঐ জায়গায় কল্পনা করে নিতে পারবে না।

পিটার: এটাকে সিনেমা করার ব্যাপারে কি কেউ আগ্রহ দেখিয়েছিল?
মার্কেজ: হ্যাঁ, আমার এজেন্ট এই প্রস্তাবকে নিরুৎসাহিত করার জন্য দশ লক্ষ ডলার হেঁকেছিল, এবং যেই তারা এটাকে প্রায় মেনে নিতে বসেছিল অমনি সে ভদ্রমহিলা ওটাকে বাড়িয়ে ত্রিশ লক্ষ ডলার করে ফেললো। কিন্তু সিনেমায় আমার কোনো আগ্রহ নেই, যতদূর সম্ভব আমি এটাকে সিনেমা হওয়া থেকে ঠেকানোর চেষ্টাই করবো, এটা হবে না। আমি এটাকে পাঠক ও বইয়ের এক গোপন ব্যক্তিগত সম্পর্ক হিসেবেই রাখার পক্ষে।

পিটার: আপনার কি মনে হয় যেকোনো বই-ই সফলভাবে সিনেমায় অনুবাদ করা সম্ভব?
মার্কেজ: আমার মনে হয় না যেকোনো সিনেমাই কোনো ভালো উপন্যাসের উন্নয়ন করতে পারে, কিন্তু, আমার মনে হয় যে অনেক ভালো সিনেমাই খুব বাজে উপন্যাস থেকে এসেছে।

পিটার: আপনি নিজে কি কখনো সিনেমা তৈরির কথা ভেবেছেন?
মার্কেজ: একটা সময় ছিল যখন আমি সিনেমার পরিচালক হতে চেয়েছিলাম। আমি রোমে পরিচালনা সম্পর্কে পড়েছি। আমি অনুভব করি যে সিনেমা এমন একটি মাধ্যম যার কোনো সীমাবদ্ধতা নেই এবং যার মাধ্যমে সব কিছু করা সম্ভব। আমি মেক্সিকোতে এসেছি কারণ আমি সিনেমায় কাজ করতে চাই, একজন পরিচালক হিসেবে নয় বরং সিনেমার একজন নাট্যকার হিসেবে। কিন্তু সিনেমার একটা অনেক বড় সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এটা একটা শিল্প-কারখানার শিল্পকলা, একটি পরিপূর্ণ শিল্পকারখানা। আপনি যা সত্যি সত্যিই বলতে চান সেটাকে সিনেমায় প্রকাশ করাটা ভীষণ রকম জটিল ব্যাপার। আমি এখনো এটা নিয়ে ভাবছি, কিন্তু এটাকে এখন বিলাসিতা বলেই মনে হচ্ছে, যেটা আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে করতে পছন্দ করবো কিন্তু নিজেকে যথাযথভাবে ব্যক্ত করার কোনো ধরনের কোন আশা ছাড়াই। কাজেই আমি সিনেমা থেকে দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে চলচ্চিত্রের সম্পর্ক হচ্ছে সেই দম্পতির মতো যারা আলাদা থাকতে পারে না, কিন্তু তারা আবার একত্রেও থাকতে পারে না। একটি সিনেমা কোম্পানি এবং একটি পত্রিকার মধ্যে আমি পত্রিকাকেই বেছে নেব।

পিটার: কিউবার ওপরে যে বইটির কাজ করছেন, সে বিষয়ে কিছু বলবেন? 
মার্কেজ: প্রকৃতপক্ষে, কিউবার বাড়িগুলোয় লোকদের জীবন কেমন, কিভাবে তারা ঘাটতিগুলো থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে সেসব নিয়ে একটি দীর্ঘ পত্রিকার প্রবন্ধের মতো হচ্ছে বইটি। গত দুই বছরের কিউবা ভ্রমণের সময় অনেকবার যে বিষয়টি আমাকে আকস্মিক আঘাত করেছে সেটা হচ্ছে এই অবরোধ কিউবায় একধরনের ‘প্রয়োজনীয়তার সংস্কৃতি’ তৈরি করে ফেলেছে, একটি সামাজিক অবস্থা লোকজন যার মধ্যে আবশ্যিক জিনিসগুলো ছাড়াই চলে যাচ্ছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে সত্যিই কৌতুহলী করে তুলেছে যে অবরোধ কিভাবে জনগণের মানসিকতাকে পরিবর্তন করতে ভূমিকা রাখছে। পৃথিবীর মধ্যে আমরা একটি সংঘর্ষ দেখি একটি ক্রয়-বিমুখ সমাজ এবং সর্বাধিক ক্রয়ইচ্ছু ধ্বংসাবিমুখী সমাজের মধ্যে। বইটি এখন এমন একটি পর্যায়ে যেখানে চিন্তা করার পরে এটা হয়তো একেবারে সহজ একটা ব্যাপার হবে, সাংবাদিকতার একটি ছোট অংশ হবে সুন্দরভাবে, এটা এখন একটি দীর্ঘ এবং জটিল বইয়ে রূপ নিতে যাচ্ছে। কিন্তু এতে কিছুই এসে যায় না, কারণ আমার সব বই-ই এরকম। এবং পাশাপাশি, বইটি ক্যারিবিয়ানদের বাস্তব পৃথিবীর ঐতিহাসিক বিষয়গুলোকে প্রমাণ করবে, একশত বছরের নিঃসঙ্গতা’র গল্পগুলোর মতো ঠিক তেমন-ই কাল্পনিকভাবে।

পিটার: লেখক হিসেবে আপনার কি কোনো দীর্ঘ-মাত্রার উচ্চাকাঙ্ক্ষা অথবা আক্ষেপ রয়েছে?
মার্কেজ: আমার মনে হয় খ্যাতি সম্পর্কে আমি আপনাকে যে জবাব দিয়েছি এ প্রশ্নের জবাবটাও সেই একই। আমাকে আরেক দিন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আমি যদি নোবেল পুরস্কার বিষয়ে আগ্রহী হই, কিন্তু আমার মনে হয় সেটা আমার জন্য সন্দেহাতীতভাবে একটি অনর্থপাতই হবে। আমি নিশ্চিতভাবেই পুরস্কারের উপযুক্ত হবার জন্য আগ্রহী, কিন্তু ওটা গ্রহণ করা হবে একেবারে ভয়ানক ব্যাপার। এটা সুখ্যাতির সমস্যার চেয়েও জটিল একটা সমস্যা হবে। জীবনে একমাত্র যে বিষয়টিতে আমার আক্ষেপ রয়েছে তা হচ্ছে আমার কোনো কন্যাসন্তান নেই।

পিটার: কোনো কর্মপরিকল্পনা অর্ধপথে রয়েছে কি? 
মার্কেজ: আমি সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে আমি আমার জীবনের সবথেকে ভালো বইটি লিখতে যাচ্ছি, কিন্তু আমি জানি না সেটি কোনটি হবে অথবা কখন হবে। যখন আমি এরকম কিছু অনুভব করবো— যেটা আমি এখুনি কিছু সময়ের জন্য মাত্র অনুভব করেছিলাম— আমি ভীষণ শান্ত হয়ে যাবো, এজন্য, যদি ওটা পার হয়ে যেতে থাকে আমি যেন ওটাকে ধরতে পারি।