যেদিন নেতাকে হত্যা করা হয়

নাগিব মাহফুজ

অনুবাদ: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

[নাগিব মাহফুজ: আরবি সাহিত্যে একমাত্র নোবেল বিজয়ী নাগিব মাহফুজ আরব জগতে শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যিক। ১৯১১ সালে তিনি মিশরের রাজধানী কায়রোতে জন্মগ্রহণ করেন। সতেরো বছর বয়স থেকে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। তিনি উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেছেন দর্শন শাস্ত্রে। ১৯৩৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি সরকারি চাকুরিতে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৩৯ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘হিকমাহ খুফু (খুফু’স উইজডম) প্রকাশিত হয়। তাঁর ‘কায়রো ট্রিলজি’ সাহিত্যিক হিসেবে তাঁকে বিশ্বখ্যাতি এনে দেয়। ১৯৮৮ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৬ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।]

মুহতাশিমি জায়েদ

সামান্য ঘুম হয়েছে। এরপর ভারি চাদরের নিচে উষ্ণতায় ভরা আকাক্সক্ষার মুহূর্ত। জানালা দিয়ে আসা ম্লান আলো রুমের গাঢ় নিষিদ্ধ অন্ধকারকে প্রবলভাবে ভেদ করেছে। হে প্রভু, আমি তোমার আদেশেই নিদ্রা যাই এবং তোমার আদেশেই জাগ্রত হই! তুমিই সবকিছুর মালিক। ফজর নামাজের আজান আমার জন্য একটি নতুন দিন সূচনার ঘোষণা করে। নীরবতার গভীর থেকে ডাকা হয় তোমার নাম। হে প্রভু, আমাকে সাহায্য করো, যাতে আমি আমার উষ্ণ শয্যা থেকে নিজেকে ছিন্ন করতে এবং এই দীর্ঘ শীতের কনকনে শীতলতার মুখোমুখি হতে পারি! আমার প্রিয়জন অন্য বিছানায় গভীর নিদ্রায় ডুবে আছে। অন্ধকারে আস্তে পা ফেলবো যাতে সে জেগে না ওঠে। ওজুর পানি কী ঠাণ্ডা! কিন্তু তোমার অনুগ্রহ থেকে আমি উষ্ণতা আহরণ করেছি। নামাজ হচ্ছে মিলন এবং নির্বাণ। আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা তাঁর সঙ্গে মিলিত হতে ভালোবাসে। যেদিন আমি আল্লাহর নিকটতর হতে না পারি, সেদিন আমার জন্য অনুগ্রহের দিন নয়।

অবশেষে আমি ওঠলাম, যারা ঘুমিয়ে আছে তাদের জাগানোর জন্য। বাড়ির ক্লান্ত মানুষগুলোর জন্য আমি অ্যালার্ম। আমার মতো বয়সীদের জন্য কোনো কাজ থাকা ভালো। বৃদ্ধ হলেও আল্লাহর রহমতে আমার স্বাস্থ্য এখনও ভালো। এখন আমি বাতি জ্বালিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে ডাকতে পারি, ‘ফাওয়াজ,’ তার কণ্ঠে, “শুভ সকাল, আব্বা,” শুনতে না পাওয়া পর্যন্ত আমি ওর দরজায় টোকা দেই।

আমার রুমে ফিরে আমি বাতি জ্বালাই। আমার নাতি গভীর ঘুমে। ওর মুখ ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। ওকে টেনে তুলতে হবে। আমি ওর ওপর ঝুঁকে ফিস ফিস করে ডাকি, “এলওয়ান, ওঠো।” সে চোখ খুলে, হেসে হাই তুলে উচ্চারণ করে, “শুভ সকাল দাদাজি।”

এরপর জীবন শুরু হয় বাথরুম ও ডাইনিং রুমের মধ্যে ছুটাছুটি করে। আমি বসে রেডিওতে কোরআন তিলাওয়াত শুনতে থাকি, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার পুত্রবধু হানা আমাকে নাশতা টেবিলে ডাকে। জীবনের উপভোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে একমাত্র খাদ্যই আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে রয়ে গেছে। আমাদের জীবনে বৈচিত্র অবশ্যই আল্লাহর অপার অনুগ্রহ। হে প্রভু, রোগব্যাধি ও দৈহিক অক্ষমতা থেকে আমাকে রক্ষা করো। কেউ আর কারও সেবা করার মতো অবস্থায় নেই এবং অসুস্থতায় চিকিৎসা করার মতো অর্থও অবশিষ্ট নেই। নাশতার জন্য আছে সিম ও ফালাফেল এবং এ দুটি বস্তু এখন সুয়েজ খালের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। ডিম, পনির, পাস্তরামি এবং জ্যাম খাওয়ার দিনগুলো অতীত হয়েছে। ওসব ছিল আনোয়ার সাদাত এর ‘ওপেন ডোর’ অর্থনৈতিক নীতির আগের কথা। বহু আগে থেকে জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বি, সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। শুধু রুটি খেয়ে ফাওয়াজের ওজন বাড়ছে, হানা’র শরীরও মোটা হয়েছে, অকালে বুড়িয়ে যাচ্ছে। পঞ্চাশ বছর বয়সে তাকে ষাট বছরের মনে হয়। 

ফাওয়াজ চেঁচিয়ে বলে, “এখন থেকে কোনো কোনো দিন আমাদের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করতে হবে। অতএব, আমি আমার চাকুরি ছেড়ে দেব।”

আমি অস্বস্থি বোধ করি। সে এবং তার স্ত্রী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। ওদের আয়, আমার পেনশন, এলওয়ানের বেতন মিলিয়ে কোনোমতে আমাদের প্রয়োজন মেটে। সে চাকুরি ছেড়ে দিলে কীভাবে চলবে?

“এটা হয়তো অল্প সময়ের জন্য,” আমি কণ্ঠে আশাবাদ এনে বলি।

“আমি তোমার হয়ে কিছু কাজ করবো। তাছাড়া তোমার বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে কথা বলবো,” হানা বলে।

“এর মানে হচ্ছে, আমাকে ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত কাজ করতে হবে,” ফাওয়াজ রেগে সাড়া দেয়।

আমরা সবসময় চেয়েছি খাওয়ার সময় আমরা কোনো আলোচনা না করতে চেষ্টা করবো। কিন্তু কীভাবে?

এলওয়ান বলে ওঠে, “আমার প্রফেসরের বাবা অবসর সময়ে ট্যাক্সি চালিয়ে বেশ ভালো আয় করেন।”

“তিনিই কি ট্যাক্সিটির মালিক?” ওর বাবা জানতে চায়।

“আমার তাই মনে হয়।”

“কিন্তু আমি কী করে একটি ট্যাক্সি কিনবো? তোমার প্রফেসরের বাবা কী ধনী অথবা তিনি কি ঘুষ খান?”

সবাই যার যার কাজে চলে যাওয়ার পর বরাবরের মতো ছোট্ট ফ্ল্যাটে আমি একা কাটাই। প্রভু, সময়ের পরিবর্তন থেকে ওদের সকলকে রক্ষা করো। আমাকে তোমার নিরাপত্তা দান করো। আমি বেডরুম, লিভিং রুম গোছাই এবং রেডিও এবং টেলিভিশনে তিলাওয়াত, গান এবং খবর শুনি।  ফ্ল্যাটে যদি চারটি রুম থাকতো, তাহলে এলওয়ান একটিতে থাকতে পারতো। সকল প্রশংসা আল্লাহর, আমি তাঁর কর্তৃত্বের ওপর প্রশ্ন তুলতে পারি না।

যে বছর দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, তখন একদিন বিখ্যাত ধর্মীয় নেতা আবু আল-আব্বাস আল-মুরসি কায়রোর এক বেকারির সামনে ভিড় দেখতে পান এবং তার মন তাদের কাছে চলে যায়। তিনি ভাবেন, যদি তাঁর কাছে কিছু খুচরা মুদ্রা থাকতো, তাহলে তিনি লোকগুলোকে সাহায্য করতে পারতেন। তিনি পকেট ভারি অনুভব করেন, পকেটে হাত দিয়ে কয়েকটি মুদ্রা পান এবং বেকারি মালিককে রুটির রুটির দাম দেন, যে রুটি তিনি লোকগুলোর মধ্যে বিতরণ করবেন। তিনি চলে যাওয়ার পর বেকারি মালিক দেখেন মুদ্রাগুলো নকল। লোকটিকে ধরতে পারার পূর্ব পর্যন্ত বেকারি মালিক সাহায্যের জন্য চিৎকার করেন। লোকটি উপলব্ধি করেন মানুষগুলোর জন্য তার করুণার অনুভূতি আসলে মানুষের কাছে আল্লাহর উপায়ের ক্ষেত্রে তার পক্ষ থেকে এক ধরনের আপত্তি। অনুতপ্ত হয়ে তিনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং শুধু এর পরই বেকারির মালিক বুঝতে পারেন যে মুদ্রাগুলো আদৌ নকল নয় এবং লোকটি আসলেই আল্লাহর খাঁটি বান্দা। যারা পৃথিবীকে পরিহার করে তাদেরকেই পবিত্রতা দান করা হয়। আমার বয়স প্রায় আশি বছর, কিন্তু পৃথিবীকে বর্জন করতে অক্ষম। আমি পৃথিবীকে ভালোবাসি।

আমি কোরআন ও হাদিসে আগ্রহী, ঠিক যেভাবে আমি ‘ওপেন ডোর পলিসি,’ তেল, জিরা ও লেবুর রস মিশ্রিত শিম খেতে আগ্রহী। আমি কখন আল্লাহর ক্ষমাশীলতায় ধন্য হবো, যাতে আমি দূর থেকে আলো দেখতে সক্ষম হই এবং সুইচ স্পর্শ না করেই বাতি জ্বালাতে পারি। আমার একজন মাত্র ভালো বন্ধু আছেন এবং আমাদের মধ্যে ঘুরে ফিরে বার্ধক্যের কথাই আসে। শেষবার আমি পড়েছি, তা এক বছর আগে। আমার ঘুম হয় সামান্য, কিন্তু আমি মৃত্যু নিয়ে ভীত নই। মৃত্যু যখন আসবে, আমি স্বাগত জানাবো।

বাদশাহ ফুয়াদ যখন আমাদের স্কুল উদ্বোধন করতে আসেন তখন শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমাকে ডাকা হয়েছিল। কী ঐশ্বর্যময় একটি দিন ছিল! ছাত্ররা যখন শ্লোগান দিয়েছে, “বাদশাহ ফুয়াদ জিন্দাবাদ, সা’দ জগলুল জিন্দাবাদ!” সেই আনন্দধ্বনি, সেই সঙ্গীত পরিবর্তিত হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি লাগামহীন হয়ে গেছে। জানালা দিয়ে আমি নীল নদ ও গাছের সারি দেখতে পাই। নীল ষ্ট্রিটে অবস্থিত আমাদের বাড়িটি সবচেয়ে পুরোনো ও সবচেয়ে ছোট: আধুনিক ভবন সারির মাঝখানে খর্বাকৃতির। আমাদের দুর্দশাও অভিন্ন। দারিদ্র সীমাহীন, কত প্রিয়জন মারা গেছেন। বর্ষণের সম্ভাবনা নিয়ে আকাশে যখন মেঘ ঘণীভূত হওয়ার দিনগুলোতে আমরা কানাতের উদ্যানে চলে যেতাম। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে একত্রে উপাদেয় খাবার ও পানীয় উপভোগ করতাম, রেকর্ড প্লেয়ারে বাজতো পুরোনো দিনের গান। সেই দিনগুলো এখন কঙ্কাল। আমার বিয়ের রাতে তারা সবাই আমার পেছনে সার বেঁধে দাঁড়িয়েছিল, ওই রাতেই আমি প্রথমবারের মতো ফাতমা’র নেকাব তুলেছিলাম। শেষবার তোমার কবর জিয়ারতের পর পাঁচ বছর কেটে গেছে।

এলওয়ান ফাওয়াজ মুহতাশিমি

নতুন একটি দিনের সূচনা হয়েছে। যদি পুরোনো কোনোকিছু ভালো না হতে পারে, তাহলে নতুন করে মন্দ কিছু না হোক। একেবারে না থাকার চেয়ে কোনো কিছু থাকা ভালো। মৃত্যু স্বয়ং এক নতুনত্ব। হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য উত্তম এবং মিতব্যয়িতার উপায়। কিন্তু হাঁটতে পা ক্লান্ত হয়, জুতায় পা কাটে। সহ্য করো এবং ধৈর্য্য ধারণ করো। হে আমার প্রিয়, আগুন ও নিষ্ঠুরতার এই দিনগুলোতে শুধু তুমি ছাড়া  কোনো বাতাস হৃদয়কে শীতল করতে পারে না। তা সত্ত্বেও এইসব রাজসিক বৃক্ষ এবং সর্বোপরি নীল নদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। ওপরের দিকে তাকিয়ে সাদা মেঘ এবং বৃক্ষগুলোর অগ্রভাগ দেখো, তাহলে তুমি মাটির এবড়ো-থেবড়ো ওপরিভাগ ভুলে যাবে। একদিন কোনো নিরীহ শয়তানের সঙ্গে তোমার দেখা হবে এবং তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে। আমি সকল শক্তিসম্পন্ন মন, চারিত্রিক মহত্ব এবং গভীর ভাবনার কাছে মাথা নত করি।

এই পুরোনো বাড়িতে আমি বাস করেছি, যেটি এখন উঁচু উঁচু অট্টালিকার মাঝে হারিয়ে গেছে বাড়িটি, যেন বিত্তবানদের মাঝখানে একজন অনুপ্রবেশকারী। এখানে আমার শৈশব, কৈশোর ও প্রাপ্তবয়স্ক যৌবন কেটেছে। বেড়ে চলা দুর্নীতির মাঝেও প্রেম টিকে থাকা উচিত। ভাঙাচোরা ফুটপাত জুড়ে বিমান হামলার সময় আশ্রয় গ্রহণের নিশানা এখনও বিদ্যমান। আবর্জনার স্তুপ আড়াল করে রেখেছে প্রেমিক-প্রেমিকাকে। সকাল বেলায় যাত্রীতে পূর্ণ বাসের ভাঙা কাঁচের ভেতর দিয়ে মুখগুলো দেখে কারাগারে দর্শনার্থীদের জন্য লোহার গ্রিলের সামনে ভিড় করে থাকা বন্দীদের মতো দেখায়। পথচারিতে ব্রিজটি পূর্ণ। সাইকেল চালকরা বিন স্যাণ্ডউইচে কামড় দিতে দিতে প্যাডেলে পায়ের চাপ দিচ্ছে।

আমার দাদা বললেন, “তোমার প্রতিটি সমস্যার সঙ্গে স্বস্থিও আসে।” প্রিয় দাদা, কতদিন পর্যন্ত এসব কথা মুখস্থ করবো এবং অন্যদের বলবো? সে আমার ভালো বন্ধু এবং আমি একজন এতিম। তারা যখন সামান্য উপায়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে ছোটাছুটি করে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টানা কাজের মধ্যে নিজেদের হারিয়ে ফেলেছে, তখন আমি আমার মা-বাবাকে হারিয়েছি। আমাদের হঠাৎ দেখা হয়, তাও খুব স্বল্প সময়ের জন্য।

“অলস দর্শন ফলানোর সময় নেই। তোমরা কী দেখতে পাও না যে আমরা ঘুমানোর সময় পর্যন্ত পাই না?”

আমার কোনো বোন যদি তাদের স্বামীদের সঙ্গে ঝগড়া করে, তখন শুধু আমাকেই পাঠানো হতে ঝগড়া মেটানোর চেষ্টা করতে। আজকাল কেউ আর সহায়তার জন্য কাউকে পায় না। আমাদের সকলকে লড়তে হবে এবং শেষ পর্যন্ত এটা তোমার আর তোমার ভাগ্যের ব্যাপার! এখানে আবার সেই সরকারি খাতের খাদ্যজাত পন্য প্রস্তুতকারী কোম্পানি, ফটকে বড় করে লেখা, “এখানে প্রবেশ করুন, কিন্তু কোনো আশা করবেন না।” এবং অবশেষে আমার অফিস ‘জনসংযোগ ও অনুবাদ’ বিভাগে বসে থাকতে দেখি আমার প্রেমিকাকে। আমাকে দেখে সে প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে হাসে।

“তুমি যদি আর কয়েকটা মিনিট অপেক্ষা করতে, তাহলে আমরা একত্রে আসতে পারতাম,” তিরস্কারের সুরে আমি বলি।

“তোমাকে বিরক্ত না করার কারণ ছিল। আমাকে ব্রাজিলিয়ান কফি স্টোর ক্যাফেতে নাশতা করতে হয়েছে,” উৎফুল্লভাবে সে উত্তর দেয়।

আমার দাদাকে ধন্যবাদ যে আমরা একই কোম্পানিতে এবং একই বিভাগে কাজ করতে সক্ষম হয়েছি। আমার কী আসলে অফিসারদের একজনকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত, যিনি একসময় দাদার ছাত্রদের একজন ছিলেন? যারা সাধারণত তাদের পূর্বসূরীদের অবদান মনে রাখতে অভ্যস্ত নয়, তারাও আমার দাদার কাছে তাদের ঋণ স্বীকার করেন। আমাদের বিভাগে অনেক নারী কর্মী আছেন। কাগজের স্তুপ অফিস জুড়ে, কিন্তু সেদিকে আমাদের মনোযোগ নেই। আমি একটু সময় কাজ করি, এরপর আড়চোখে রান্দাকে দেখি। আমি স্বপ্ন দেখি, স্মৃতিচারণ করি। যখন আমরা শিশু ছিলাম তখন একসাথে খেলতাম। আমরা একই বয়সের। কিন্তু মা বলতেন সে আমার চেয়ে বড়, কিন্তু এর কোনো প্রমাণ তার কাছে ছিল না। কৈশোর আসে, আমাদের মাঝে লাজুকতা ও সন্দেহ স্থান করে নেয়। আমার বিবেক আমাকে খোঁচা দেয়, আমার সকল আনন্দ নষ্ট করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভালোবাসা এগিয়ে যায়। মাধ্যমিক স্কুলে সিড়ি দিয়ে ওঠানামার সময়, দুপুরে ক্লাসের বিরতির সময় আমরা কথা বলি। একদিন আমার ভালোবাসার সব কথা লিখে তার হাতে গুঁজে দেই। উত্তরে সে আমাকে ‘দুই প্রজন্মের আনুগত্য’ (দ্য লয়্যালিটি অফ টু জেনারেশনস) নামে একটি উপন্যাস উপহার দেয়। আমরা যখন একই বছর মাধ্যমিক স্কুলের পরীক্ষায় পাস করি তখন দাদাকে বলি যে আমি আমাদের প্রতিবেশি রান্দা সুলায়মানকে বিয়ে করতে চাই।

দাদা আমাকে বলেন যে তার সময়ে কেউ পুরোপুরি নিজের ওপর নির্ভরশীল না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করার কথা বলতে পারতো না। কিন্তু তিনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দেন যে বিষয়টি নিয়ে তিনি আমার বাবা ও মায়ের সঙ্গে কথা বলবেন। মা বলেন যে সুলায়মান মুবারকের পরিবার আমাদের নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের চেয়েও বেশি ঘনিষ্ট এবং রান্দাকে তিনি তার আপন কন্যার মতো দেখেন। বাবা বলেন, “কিন্তু সে তোমার চেয়ে বয়সে বড় না হলেও তোমার সমবয়সী।”

আমাদের বিয়ের কথা পাকা হয়। তখনকার দিনে স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হতো। কিন্তু যখন থেকে আমরা কাজ করতে শুরু করলাম তখন বেশ কিছু নতুন সমস্যা সামনে এলো। তিন বছর পর আমাদের বয়স ছাব্বিশ বছরে পড়লো। আমি তখন প্রেমে পাগল ছিলাম, কিন্তু দায়িত্বের বোঝায় এখন ক্লান্ত ও অসহায় হয়ে পড়েছি। আমরা এখন আর শুধু কথা বলার জন্য দেখা করি না, বরং আর্থিকভাবে নিজেদের সমর্থ করা, ফ্ল্যাট, ফার্নিচার, একত্রে জীবনযাপনের বোঝা নিয়ে সীমাহীন আলোচনা করি। আমরা কোনো সমাধানে পৌছতে পারি না। আমাদের শুধু প্রেম ও দৃঢ়তা রয়েছে। আমাদের বাগদান হয়েছে নাসেরের যুগে এবং এখন আমরা ‘ওপেন ডোর পলিসি’র বাস্তবতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আমরা এক উন্মাদনাপূর্ণ পৃথিবীর ঘূণিপাকের মধ্যে ডুবে গেছি। আমরা অন্য কোনো স্থানে চলে যাওয়ার যোগ্যও নই। দর্শন বা ইতিহাসে পড়ুয়াদের কোনো চাহিদা নেই। আমাদের কর্মচ্যুত হতে হলো। কত বেকার লোক! কীভাবে আমরা এমন এক অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হলাম, যেখান থকে ফেরার পথ নেই? আমি দায়িত্ব ও সন্দেহের বোঝায় পিষ্ট, রান্দা এখনও সুন্দরী ও কাক্সিক্ষত। আমি তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছি।

আমি তার বাবা-মা’র ক্রুদ্ধ দৃষ্টি খেয়াল করি। আমার পেছনে কী বলা হচ্ছে তা যেন আমি শুনতে পাই। আমার স্বপ্ন ভেসে যেতে থাকে। কিন্তু দুর্নীতির কথা কে বলবে? আলিয়া সামিহ এবং মাহমুদ আল-মাহরুকি যা বলেন তা বিরক্তিকর। কোন্ কথাটি সঠিক? ১৯৬৭ সালের জুন মাসে আমার প্রিয় নেতার পতনের পর আমি সবকিছু নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছি কেন? লোকজন অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল বিত্তের মালিক হওয়ার জাদুকরী তত্ত্ব কোথায় পায়? দুর্নীতি ছাড়া কি এত সম্পদ লাভ সম্ভব? আমি যে এতটা নীতিবান চেষ্টা করছি তার রহস্য কী? এর একটি মাত্র কারণ আমি রান্দাকে বিয়ে করার সামর্থ অর্জন করতে চাই।

আমাকে ও রান্দাকে বলা হয়েছে বিভাগীয় প্রধান আনোয়ার আলমের সঙ্গে দেখা করতে। যেহেতু আমরা একসাথে অনুবাদ বিভাগে কাজ করি, সেজন্য দু’জনকে একসাথেই ডাকা হয়েছে। তিনি অমায়িক ব্যক্তি, তবে নিজেকে প্রদর্শন করতে ভালোবাসেন। দীর্ঘ, শীর্ণ, কালো রঙের অন্তর্ভেদী দৃষ্টিসম্পন্ন লোকটির বয়স পঞ্চাশ হতে চলেছে, কিন্তু এখনও বিয়ে করেননি।

আনোয়ার আলম তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, “স্বাগতম বর ও কনে।” তিনি দ্রুততার সঙ্গে আমাদের কাজ দেখার পাশাপাশি মন্তব্য করছিলেন। আমাদের বিয়ে কবে সম্পন্ন হচ্ছে তাও জানতে চাইলেন। এটিকে আমি ধরে নিলাম কর্মচারিদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ করার ব্যাপারে তার নীতি হিসেবে। তাঁর চোখের চাউনিতে স্বস্থি বোধ করছিলাম না। আমি বললাম, “এখন পর্যন্ত আমরা আমাদের সমস্যার কোনো সমাধান খুঁজে পাইনি।”

“সমাধান ছাড়া কোনো সমস্যা নেই,” তিনি বিরক্তিকর ভঙ্গিতে হেসে বললেন। “অসহায় লোকজন কী বলে, তা আমাকে বলবেন না। সমাধানের জন্য কারও মুখাপেক্ষী হবেন না।”

টেবিলে ফিরে এসে আমার বার বার মনে হচ্ছিল যে রান্দার সামনে আমাকে সম্পূর্ণ এক অসহায় মানুষে পরিণত করতে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কথাগুলো বলেছেন। অফিস ছাড়ার পূর্ব পর্যন্ত তার কথা আমাকে পীড়া দিচ্ছিল। আমরা একসাথে নীল স্ট্রিটে আসার পর আমি রান্দাকে বললাম, “লোকটির কথা আমার স্নায়ুতে বসে গেছে। তিনি নিজেকে খুব স্মার্ট মনে করেন। তোমার কি মনে হয় যে আমরা এখনও যে সমস্যার মধ্যে পড়িনি, সেই সমস্যার সমাধান রয়েছে?”

রান্দা হেসে বললো, “আল্লাহর ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস রয়েছে, তবুও আমরা বিশ্বাস করতে থাকি যে সবকিছু চিরদিন একভাবে থাকবে।”

আমি দ্বিধাগ্রস্থের মতো বললাম, “কিন্তু সময় দ্রুত অতিক্রান্ত হচ্ছে।”

“হয়তো, কিন্তু প্রেম স্থির!” সে হেসে উত্তর দিল।

রান্দা সুলায়মান মুবারক

আমি অ্যাপার্টমেন্টের সিঁড়ি বেয়ে ওঠছিলাম, আর সে তার ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত হতে চাইছিল যে আমি নিরাপদে দরজা পর্যন্ত পৌঁছৈছি। নিজের ভাবনায় মগ্ন থেকে উদ্বিগ্নভাবে আমার দিকে চুম্বন ছুঁড়ে বিদায় জানালো। আনোয়ার আলমের কথায় তার বিরক্ত হওয়ার কারণ আছে। তাছাড়া সে সবসময় চিন্তার মধ্যে ডুবে থাকে। আমি তার অবস্থা বুঝতে পারি, কিন্তু সে কি আমাকে বিশ্বাস করে না? দু:শ্চিন্তা করার আর কোনো সুযোগ নেই। অ্যাপার্টমেন্টে মুলুখিয়া স্যুপের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে, এবং এতে আমার ক্ষুধার তীব্রতা বৃদ্ধি করেছে।

বাবা কি সোফার ওপরই ঘুমিয়ে পড়েছেন? না, আমাকে দেখে তিনি হাসলেন। মা জানালেন, খাবার রেডি। আমি মুলুখিয়া স্যুপ পছন্দ করি, ক্ষুধার কথা তেমন ভাবি না। মা প্রায়ই বলেন, “কেউ যখন হালকা-পাতলা থাকে, সে রোগ-ব্যাধির সঙ্গে লড়তে পারে না।”

আমি উত্তর দেই, “মোটা হওয়া আরও বিপজ্জনক।” মা সবসময় মোটা ছিলেন এবং মোটা হওয়ার কারণে তাকে সোফায় বসে নামাজ পড়তে হয়। আমি খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক। মা নিজেকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল মনে করেন, কারণ তাঁর মাসিক আয় পঁচিশ পাউণ্ড। কাহিনিতূল্য দিনগুলোর কথা বলার অধিকার তাঁর আছে। কিন্তু এখন তাঁর আয়, বাবার পেনসন এবং আমার বেতন মিলিয়ে কী হয়!

খাওয়ার সময় বাবা তাঁর নকল দাত ব্যবহার করেন। তিনি ধীরে শুরু করেন, প্রচণ্ড ঠাণ্ডার ব্যাপারে অভিযোগ করেন। আমার তালাকপ্রাপ্তা বোন সানা আমার রুমে থাকে। সে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেক্রেটারিয়েল কোর্স করছে, যাতে সে একটি কাজ জোগাড় করতে পারে। কারও ওপর বোঝা হতে চায় না সে। খেয়ে আমি বিছানায় শুয়ে আবারও ছুঁড়ে দেওয়া চুমুর কথা ভাবি। এটা আমি পছন্দ করি না। আমার কাছে অপমানজনক মনে হয়। সে যদি এমন করতে থাকে তাহলে আমি খোলাখুলি তাকে বলবো, যে যদি আসলেই চুম্বন অনুভব না করে এবং আমার প্রতি প্রেমের অনুভূতি ছাড়া অন্য চিন্তায় মগ্ন থাকে, তাহলে যাতে এভাবে আমাকে চুম্বন ছুঁড়ে না দেয়। প্রেম ছাড়া আমাদের আর কী আছে? আমি এমনভাবে তার খেয়াল করি, যেন আমি তার মা এবং সে বখাটে, ক্রদ্ধ সন্তান। আহা, সে যদি শুধু একজন ইঞ্জিনিয়ার হতো! তাহলে সে ‘ওপেন ডোর পলিসি’র শিকার না হয়ে হয়তো সামনের সারির কেউ হতে পারতো। সে ১৯৬৭ সালের জুন মাসের ঘটনা এবং পরাজিত বীরের নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনারও শিকার। এখন সে দ্বিধাগ্রস্থ এবং নির্বিকার। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে? যারা তাকে অতিক্রম করে গেছে, তাদের প্রতি সে ক্ষুব্ধ এবং সে বিশ্বাস করে যে তার সঙ্গে অন্য যারা কাজ করে তাদের সবার চেয়ে সে বেশি যোগ্যতার অধিকারী। কেন? কখন থেকে সে নিজেকে এভাবে দেখতে শুরু করেছে?

হতে পারে যে এটাই আমার কাজ, কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন বোধ করি, তা হলো আমাদের প্রেম। আমি তাকে ভালোবাসি এবং ভালোবাসা কোনো যুক্তি মানে না। আমি আমার হৃদয় ও আত্মা দিয়ে তাকে চাই। কীভাবে? কখন? আমার বোন সানা প্রেম করে বিয়ে করেছিল, সে তার মাধ্যমিক স্কুলের সার্টিফিকেটে, একজন গৃহবধু হিসেবে এবং একজন বিত্তবান তরুণ ভদ্রলোককে নিয়ে সুখী ছিল। কিন্তু এসবে কাজ হয়নি এবং প্রেম নি:শেষ হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে যা ঘটে, অভিযোগের আঙুল ওঠে প্রতিপক্ষের দিকে। আমার বোন তুচ্ছ বিষয়েও আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হয়। কে এসব সহ্য করতে পারে? সেজন্য আমি আমার খাদ্যাভ্যাসে সতর্ক থাকার মতোই চেষ্টা করি যাতে আমার মেজাজ খারাপ না হয়। সময়ের চাকুকের আঘাতের বিরুদ্ধে সৌন্দর্য কতক্ষণ প্রেমকে আটকে রাখতে পারবে?

আমার স্বপ্ন আমাকে ঘুমের জগতে নিয়ে গিয়েছিল। বিকেলে ঘুম ভাঙলে আমি জোহর ও আসর নামাজ একসাথে পড়লাম। এজন্য আমি মায়ের কাছে কৃতজ্ঞ, তিনি আমার ধর্মীয় শিক্ষক। বয়সের অনেক ব্যবধান এবং নাস্তিক হওয়া সত্বেও বাবার সঙ্গে মা অত্যন্ত সুখী? তোমার কি মনে আছে যে যখন তুমি ছোট ছিলে তখন কীভাবে তোমার বাবাকে তিরস্কার করতে?

“বাবা, আপনি আমাদের সবার মতো রোজা রাখেন না কেন? আল্লাহকে কি আপনি ভয় করেন না?”

“স্বাস্থ্যগত কারণে, আমার প্রিয় কন্যা। এ ব্যাপারে অন্য কিছু ভেবো না।”

“নামাজের কথা কী বলবেন?”

“তুমি যখন বড় হবে তখন আমি তোমাকে এ সম্পর্কে বলবো।”

আমার প্রেমিকের সঙ্গে বিষয়গুলো এমন নয়। তার দাদা, বাবা ও মা নামাজ পড়েন ও রোজা রাখেন। আমার বাবার নাস্তিকতা আগের মতোই আছে। তিনি কোনো সন্দেহবাদী কথা বলেন না, কিন্তু তার আচরণেই নাস্তিকতা সুস্পষ্ট। তিনি যখন রেগে যান তখন ধর্মকে অভিশাপ দেন। তিনি হয়তো আমার কারণে অথবা আমার মায়ের কারণে কখনও আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, কিন্তু সেটিও তার অন্তর থেকে আসে না। একেবারেই শূন্যগর্ভ উচ্চারণ। আমার প্রেমিকের অবস্থা কী? সে কি ধার্মিক? অধার্মিক? প্রতিশ্রুতিশীল? আলিয়া সামিহ? এাহমুদ আল-মাহরুকি? সে আমার প্রেমিক এবং সেটুকুই যথেষ্ট। বাদবাকি আমার ভাগ্যের ব্যাপার। সে সবসময় হারানো কিছু খুঁজে বেড়ায়। আমাদের সমস্যার কি কোনো সমাধান আছে?

আমরা একসাথে ড্রয়িং রুমে বসি। আমার বাবা তাঁর দুর্বল শরীর, তাঁর বয়সের সমস্যা ও তাঁর নাস্তিকতার পথ নিয়ে, মা তাঁর মেদ-বাহুল্য এবং অন্যদের ব্যাপারে উৎকণ্ঠা নিয়ে, সানা তার ভাগ্য ও বিচ্ছিন্নতার বেদনার অনুভূতির অসন্তুষ্টি নিয়ে এবং আমি আমার স্থায়ী সমস্যা নিয়ে। আমার বাগদানের এগারো বছর কেটে গেছে। এখনও কি আশা করার মতো কিছু অবশিষ্ট রয়েছে?

“এভাবেই বিধবা না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, তখনও তাকে বাগদত্তাই থাকতে হবে,” সানা তীক্ষ্ম কণ্ঠে বলে।

“এ ব্যাপারে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে,” আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলি।

“রান্দা, ওকে সবসময় স্মরণ করিয়ে দেবে, তা না হলে সে ভুলে যাবে,” মা বলেন।

“আমরা সবসময় আমাদের চিন্তা নিয়ে কাটাই, অতএব ওকে মনে করিয়ে দেওয়ার কারণ নেই।” আমি তীক্ষ্ম কণ্ঠে উত্তর দেই। “আমারও বয়স হয়েছে এবং আমি নিজের ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি কোনোকিছু নিয়ে অনুশোচনা করি না।”

“নিজের ভালো বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স রান্দার হয়েছে, সে নিজের খেয়াল রাখতে পারবে,” বিরক্তির সুরে বাবা বলেন।

মা অনুতাপ করে বলেন, “আমরা অনেক ভালো সুযোগ হারিয়েছি।”

আমি অহঙ্কারের সঙ্গে বলি, “আমি বাজারে বিক্রয় করার মতো কোনো দাসী নই।”

“আমি তোমার মা এবং ত্রুটিহীন। পুরোনো ধারায় আমার বিয়ে হয়েছে এবং টিকে আছে, সেজন্য আল্লাহর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ যে আমি একজন ভালো স্বামী পেয়েছি,” মা বলেন।

আমাকে আবারও বলতে হয়, “মা, দেখুন, প্রতিটি যুগের আলাদা একটি ধরণ থাকে, কিন্তু সকল সময়ের চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি।”

“এমন একটি সময় ছিল যখন মানুষ কুকুর, গাধা, এমনকি নিজের সন্তানদের খেয়ে ফেলতো,” বাবা হেসে বলেন। “এরপর মানুষ একজন আরেকজনকে খেতে শুরু করে।”

আমি তিরস্কারের কণ্ঠে বলি, “আমরা মানুষ খাওয়ার যুগ পার হয়ে এসেছি, ভালো কিছু আশা করতে পারি।”

প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বাবা আমাদের থামিয়ে দেন। তার প্রিয় টিভি সিরিজ শুরু হয়েছে। আমার ভাবনায় আমার প্রেমিক ফিরে আসে। আমি স্বপ্নভরা চোখের নারীতে রূপান্তরিত হই, যেন আমার মাঝে বিবাহিত জীবনে গভীর উপলব্ধি রয়েছে। আমি অশ্রু দমন করি। তাকে ছাড়া কি আমার জীবন সম্ভব? টিভি সিরিজের নায়কেরা আসলেই ভাগ্যবান। তারা তাদের যেকোনো সমস্যার সমাধান খুঁজে পায়।

মুহতাশিমি জায়েদ

আমি নি:সঙ্গতার সময়ে আমি অপেক্ষা করি। আমার ক্ষীণ শরীরে ভালো করে আলখিল্লা জড়িয়ে নেই এবং আমার চুলশূন্য মাথায় টুপি ঠিক করি। আমি আমার গোঁফে তা দেই এবং আমার নি:সঙ্গতার সময়ে আমি অপেক্ষা করি। আল্লাহ একজন মানুষকে যতটা দিতে পারেন তার চাইতে বেশি চাইতে বলেন না। দরজায় বেল বাজে, দরজা খুলে দিলে মোটাসোটা গড়নের উম্মে আলী প্রবেশ করে আমি কেমন আছি জানতে চান।

“আল্লাহর ইচ্ছায় আমি ভালো আছি, উম্মে আলী।”

“মনে হয়, এবার শীতকাল আমাদের ছেড়ে যাবে না।”

যার কাছে সময় মানেই অর্থ, তিনি তার ওভারকোট খুলে দরজার কাছে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে ফাওয়াজ ও হানা’র রুমে যায়। আমি তাকে অনুসরণ করি, আমাকে তাই করতে বলা হয়েছে। একটি চেয়ারে বসে তার মেঝে ঝাড়ু দেওয়া, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা এবং সবকিছু গুছিয়ে রাখা লক্ষ্য করি। মোটা হলেও মহিলা কর্মঠ এবং চটপটে। সে চুরি করতে পারে বলে সবাই সন্ত্রস্ত থাকে। অতীতের কোনো কারণে অযৌক্তিক সন্দেহ। উম্মে আলীর ঘন্টাগুলো অর্থের মতো মূল্যবান। সে মৌমাছির মতো এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যায়। আমাদের সকলের মিলিত আয়ের চেয়ে তার একার আয় অনেক বেশি। কিন্তু আমি তার সঙ্গে একা কাটানো উপভোগ করি। এটি সাপ্তাহিক একটি পরিবর্তন, যা আমাকে অতীত দিনের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তার সঙ্গে একা কাটাতে আমার দৈনিক কর্মসূচিতে বিঘ্ন ঘটে।

অতএব আমাকে সময় ভাগ করতে হয়েছে, পুরোনো ‘আমি’ মুখোমুখি হয় বর্তমান ‘আমি’র, কিন্তু দুটি ভিন্ন ভাষায় যোগসূত্র স্থাপনে ব্যর্থ হয়। পুরোনো চেতনা ফিরে এলে মুহূর্তের জন্য হৃদস্পন্দন থেমে যায়। উম্মে আলী যখন কার্পেট মেলার জন্য সামনের দিকে ঝুঁকে, তখন আমি কল্পনা করি যে আমি তাকে আলতোভাবে একটি চিমটি কেটেছি; এটি শুধু কল্পনা, কারণ আমি নিজের ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ রেখেছি। আমার ব্যাপারে তার কোনো ধরনের সন্দেহ নেই। কারণ শক্তি, সামর্থ ও একগুঁয়েমির দিক থেকে সে অনেকটা পুরুষের মতো। হে খোদা, আমরা ভুলে গেলে বা ভুল করলে তুমি ক্ষমা করো।

তার সঙ্গে একা সময় কাটানো উপভোগের সময় তার স্বামী ও সন্তানদের খোঁজখবর নেই। সে আমার খোঁজ নেয়।

কী করে তাকে বলি যে তার সঙ্গে একা কাটানো আমি কতটা পছন্দ করি। আল্লাহ ক্ষমা করুন। দুই পাশে গাছের সারি শোভি খয়রাত স্ট্রিটের কথা মনে পড়ে, কেমন চমৎকার ছিল দিনগুলো। ফিকরিয়া ও রাতিবা নামের দুই নার্সের কথা ভাবি। মওসুম অনুযায়ী জীবন উপভোগ করতাম, প্রতিটি ঋতুর বিশেষ বৈচিত্র ছিল। যারা জীবন যেমন ঠিক সেভাবে উপভোগ করেছে আল্লাহ তাদের আশির্বাদ ধন্য করেছেন। একদিন রান্দা’র পিতা সুলায়মান মুবারকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বলেন, “মুহতাশিমি, আপনি এখনও সুঠাম দেহের অধিকারী, আমি আপনাকে ইর্ষা করি।”

“জনাব সুলায়মান, এটি বংশধারা ও বিশ্বাস থেকে পেয়েছি,” আমি আস্থার সঙ্গে বলি। তিনি কুশলীর মতো প্রশ্ন করেন, “আমাকে কি বুঝতে হবে যে আপনার মতো ব্যক্তিরা রূপকথায় বিশ্বাস করেন?

“আল্লাহ যাকে খুশি তাকে তাঁর নির্দেশনা প্রদান করেন।”

“এ কথা দ্বারা কি এমন বোঝা যায় যে অতীত দিনে আপনি নাস্তিক ছিলেন?”

“উত্তরাধিকার হিসেবে বিশ্বাস, সন্দেহ, নাস্তিকতা, যুক্তিবাদ, সন্দেহবাদ পেয়েছি এবং অবশেষে আবার বিশ্বাসে ফিরে এসেছি। এ ছাড়া জীবন পরিপূর্ণ হতো না।”

আমি আমার অটলতায় গর্বিত, কোনোকিছু না পেলেও সুখী এবং সত্যের উপাসক। আমি জয়নাবকে অনুরোধ করেছিলাম যে যখন সময় আসবে, তখন কোনো মৃত্যু সংবাদ দেওয়া উচিত নয়, কোনো জানাজা, দাফন নয়, এবং কোনো শোক জ্ঞাপন নয়।

“সব কথার মর্ম হলো, তুমি বার্ধক্যে উপনীত হয়েছো এবং মৃত্যু এখন নিকটে।” নিস্ফল একটি বক্তব্য: বলো, সত্য সমাগত এবং মিথ্যা দূরীভূত। মিথ্যাকে মুছে ফেলার জন্য তাড়া করা হয়েছে। আমার বন্ধু এক শূন্য জগতে বাস করছেন, আর আমি ভালোবাসা দ্বারা পরিপূর্ণ এক জগতে। আল্লাহ না করুন! উম্মে আলীর আগমণ হলেই বা কী লাভ। এলওয়ানের কী হবে? সে তো বদমাশদের তামাশার মধ্যে হারিয়ে গেছে।

আমি তার সঙ্গে এই আশায় পুরোনো সুখকর দিনগুলো কথা বলি যে শেষপর্যন্ত কৌতুকাভিনেতার শ্লোগান পরিহার করবে। কী সব অর্থহীন শ্লোগান! উম্মে আলী তার কাজে ব্যস্ত। সে তার হাত মুখ ধুয়ে ওভারকোট পরে এবং হাতঘড়িতে সময় দেখে তার পাওনা হিসাব করে। আমি তাকে প্রাপ্য অর্থ বুঝিয়ে দেই এবং আমার কল্যাণ কামনা করে চলে যায়।

আমি আমার একাকীত্বে ফিরে আসি। বাইরে বের হওয়া আমার জন্য ঘরের মধ্যে পায়চারি করি। রেডিও-টেলিভিশনে কোরআন তিলাওয়াত ও গান শুনি। যে রেডিও ও টেলিভিশন আবিস্কার করেছে, আল্লাহ তার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিত হোক। ঢেড়শ ও নুডলস দিয়ে লাঞ্চ সেরে নেই। আল্লাহ আমাকে নামাজ পড়ার মধ্যে আনন্দ দিয়েছেন। আহার্য গ্রহণের মধ্যেও আমাকে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেননি। চারপাশে লাখো মানুষের ভিড়ে আমি কোন্ নি:সঙ্গতার কথা বলছি? আমি জীবনকে ভালোবাসি, কিন্তু যখন মৃত্যু আসবে তখন মৃত্যুকে স্বাগত জানাবো। আমার অনেক সাবেক ছাত্র এখন মন্ত্রী হয়েছে! ইসলামে সন্যাস নেই। জীবন তো গ্রীস্মে তাপদগ্ধ দিনে গাছের ছায়ায় হাঁটার চেয়ে বেশি কিছু নয়। আমি অনেক সময় আমার প্রিয় নাতিকে অতীতের কাহিনি বলি এবং আশা করি যে মুহূর্তের জন্য হলেও সে তার দু:খগুলো ভুলে থাকবে। আমি তাকে পড়তে উৎসাহিত করতে চেষ্টা করি, কিন্তু সে সামান্য পড়াশোনা করে। আমার কথা সে অবাক হয়ে শোনে, যেন আমার কথা সে বিশ্বাস করছে। পরিস্থিতি কি তোমাকে তোমার দেশ ও গণতন্ত্রের ওপর তোমার বিশ্বাসকে হ্রাস করেনি? যে বীরের মৃত্যু ঘটেছে এবং নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে তার প্রতি এত সংলগ্নতার অর্থ কী?

“দাদাজি, এর কারণ হলো, পৃথিবীকে যাতে আমার কাছে শূন্য মনে না হয়,” সে বলে। অথচ আমি তার মনোযোগ আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করি পরম সৌন্দর্যের প্রতি।

সে হাসে এবং বলে, “আমি এখন শুধু একটি অ্যাপার্টমেন্ট এবং ভালো যৌতুক লাভ।”

আমি যখন আমার প্রিয় নাতির কথা ভাবি তখন কীভাবে আমার পক্ষে পৃথিবীর দু:খ-যাতনাগুলো ভুলে যাওয়া সম্ভব? পবিত্র মানুষের অলৌকিকত্ব সত্যি বিস্ময়কর জিনিস!

এলওয়ান ফাওয়াজ মুহতাশিমি

আমাদের সময়ই আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে। সবকিছুর ব্যাপারে নির্বিকার হতে এবং সবকিছুতে সন্দেহ পোষণ করতেও শিখিয়েছে আমাদের সময়। চেতনা জাগ্রত করে বা আশাবাদ জাগায়, এমন কোনো বিষয়ে কখনও পাঠ করলে কিছুদিন পরই দেখা গেছে সত্য কোনো নোংরা কৌশলের মতোই তিক্ত। কারও কি উচিত জাহাজ ডুবতে দেওয়া? আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে মাফিয়ারা। সুন্দর পুরোনো দিনগুলো কোথায়? আমি নিজেও ভালো দিন দেখেছি, যখন আমার বোনেরা আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে থাকতো এবং জীবন পরিপূর্ণ ও উষ্ণতায় ভরা ছিল। বাড়িতে বাবা মার উপস্থিতিও অনুভব করতে পারি। ওই সময়ে পড়াশোনায় উত্তেজনা এবং বীরত্বের প্রতি মোহমুগ্ধতা ছিল। আমরা মানুষের হৃদয় থেকে বন্ধু বাছাই করতাম। ভালোবাসা ছিল আশায় মোড়ানো গোলাপের তোড়া। আমরা আমাদের প্রথম নেতা, প্রথম জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পীকে হারিয়েছি। আরেকজন নেতা, যিনি সম্পূর্ণ বিরোধী আসেন পরাজয় থেকে আমাদের মুক্ত করতে এবং তা করতে গিয়ে আমাদের জন্য তার আনন্দকে ধ্বংস করেন। দুটি পরাজয়ের জন্য একটি বিজয়। মানুষের হৃদয় থেকে আমরা আপনাকে নির্বাচন করেছিলাম।

আমার প্রেমিকা পানি থেকে বড়শি টেনে তোলে, বড়শি শূন্য, কিন্তু তা আমার বৃদ্ধাঙ্গুলিতে বিঁধে যায়। সেই ক্ষতচিহ্ন এখনও রয়ে গেছে। আমাদের বাড়ির সামনে নীল নদের তীরে আমি তাকে বলেছিলাম যে বড়শিতে মাছ ধরতে দক্ষ নয়, কিন্তু আগেই মতোই আমাকে বড়শিতে গেথে ফেলে এবং আমার রক্তক্ষরণ ঘটে। বন্ধুত্ব প্রেমে রূপান্তরিত হওয়ার ধীরে পরিবর্তন আসে, বসন্তের সূচনায় সহসা গাছে পাতা গজানোর মতো, যা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলেই শুধু চোখে পড়ে। নারীত্ব হচ্ছে গালের লালিমা, অন্তর্বাসে সূক্ষ্ম সূচিকর্ম; একটি ভাষা, যা শব্দে এক অর্থ, কিন্তু মর্মার্থ ভিন্ন। অনভিজ্ঞতা পথ করে কথা বলা ও অনুনয়ে। আমাদের দুই পরিবার অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে। তোমার সৌন্দর্যের সঙ্গে মানানসই জামা পরিধানে তোমার অসামর্থে আমার দু:খ হতো। সামনে আরও কত দায়িত্ব পড়ে আছে।

একদিন পিরামিড রেস্টহাউজে তাকে বলি, “চলো আমরা আমাদের দুশমনের সংখ্যা গণনা করে মজা করি।”

“ওপেন ডোর পলিসির দানব এবং এক্সপার্ট নামের বদমাশগুলো,” খেলায় অংশ নিয়ে সে বলে।

“দশ লাখ মানুষ মেরে ফেলতে পারলে কি ভালো হয়?”

“মাত্র একজন লোককে হত্যা করাই যথেষ্ট!” সে হেসে বলে।

“আজ তুমি রান্দা আল-মাহরুকি,” আমিও তার হাসিতে যোগ দেই।

আমার উর্ধতন অফিসার আনোয়ার আলম আমাকে তার রুমে ডেকে বিকেল পাঁচটায় তার বাড়িতে যেতে বলেন, বার্ষিক হিসাব চূড়ান্ত করার আগে চুলচেরা যাচাই করার জন্য। আমি রান্দাকে বলার পর সে কোনো মন্তব্য করেনি।

ডোককি’তে সেতুর মুখোমুখি নতুন এক ভবনে তার অ্যাপার্টমেন্ট। তিনি আমাকে স্বাগত জানান। “আমার ফ্ল্যাটের জাঁকজমক দেখে চমকে যাবেন না। আমার বোন আমার সঙ্গে থাকে এবং সে একজন বিত্তবান বিধবা,” তিনি আমার সম্ভাব্য সন্দেহ দূর করতে চেষ্টা করেন। এখন সবাই সন্দেহভাজন। আমরা রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করি। তার বিধবা বোন চা পরিবেশন করেন। তিনি পরিচয় করিয়ে দেন, “আমার বোন গুলিস্তান।” চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সী হবেন, দেখতে মন্দ নন, একটি মুটিয়ে যেতে শুরু করলেও আকর্ষণীয়া। তিনি তার ভাইকে উদ্দেশ করে বলেন, “আপনার মেহমানকে ডিনার করে যেতে বলুন।” আনোয়ার আলম বলেন, “এটি একটি আদেশ।”

ডিনারের সময় আনোয়ার আলম বলেন, “আমি তার বিষয়-সম্পত্তি দেখাশোনা করি, স্বামীর কাছ থেকে দুটি বিল্ডিং এবং শেয়ার সার্টিফিকেট পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে।”

তার বোনের মালিকানায় কী আছে তা তিনি আমাকে জানাতে চান। এর একাধিক কারণ থাকতে পারে বলে কল্পনা করলাম। এরপর তিনি তাকে আমার বাগদানের সম্পর্কি সমস্যাগুলো বর্ণনা করে বললেন, “বিষয়টি আরও জটিল হয়েছে, কারণ এলওয়ান একজন নীতিপরায়ণ মানুষ!”

“শুনে ভালো লাগলো। পৃথিবীতে নীতিবান হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ,” তার বোন প্রশংসার সুরে সাড়া দিলেন। তার কণ্ঠে আন্তরিকতা রয়েছে। তাকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় মনে হলো। আনন্দিত হলে আমি বারুদে পরিণত হই। আমার তো আসলেই সমস্যা রয়েছে। আনোয়ার বলেন, “আমার বোন একটি দিক ছাড়া সকল দিক থোকে খাঁটি, এবং তা বিয়ে বিয়ের একাধিক ভালো প্রস্তাব সে নাকচ করে দিয়েছে।”

“আমি কেনাবেচার বস্তু হওয়ার মতো নই, তাছাড়া ওদের কেউ মানুষ ছিল না, এখন কোনো পুরুষকে বিশ্বাস করা যায় না,” তিনি শান্তভাবে বলেন।

প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য আমি আনোয়ার আলমকে বলি, “কিন্তু স্যার, আপনি এখনও বিয়ে করছেন না কেন?” তিনি উত্তর দেন, “এর পেছনে অনেক কারণ আছে।” এরপর তিনি আমার ও রান্দা’র পরিবার সম্পর্কে জানতে চান। আমি খোলামেলা হলেও তার প্রশ্ন আমার ভালো লাগেনি।

তিনি বলেন, “রান্দা চমৎকার মেয়ে, তার জন্য ভালো সময় আসছে।” আমার কাছে ছুরিকাঘাতের মতো মনে হলো। তার কথা কি ইচ্ছাকৃত অথবা আকস্মিক। আমার সন্ধ্যাটা বরবাদ হয়ে গেল। আমি বিদায় নিলাম।

রান্দা সুলায়মান মুবারক

আমার অনুবাদ করা চিঠিগুলোতে আনোয়ার আলম স্বাক্ষর করেছেন। আমি যখন ফিরে আসছিলাম তখন তিনি তার রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, “মিস রান্দা, আমি একটি কথা বলবো, তাতে আপনি আগ্রহী হতে পারেন।” আমি অবাক হলাম, কী কথা হতে পারে।

“মেয়েটি তরুণী ডাক্তার, বহু বছর আগে তার বাগদান হয়েছিল তারই সহকর্মী এক ডাক্তারের সঙ্গে। কিন্তু একসময় বিয়ের ব্যাপারে হতাশ হয়েছে তারা সিদ্ধান্ত পাল্টায়। এরপর মেয়েটি উইকালাত আল-বালাহ’র এক ধনী ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে এবং বাড়িতে সাধারণ গৃহবধু হিসেবে থাকবে বলে সম্মত হয়,” তিনি বললেন।

“আপনার কেন মনে হলো যে এই কাহিনি আমার ভালো লাগবে?” আমি শান্তভাবে বললেও তিনি গল্পটি আমাকে বলায় আমি বিস্মিত ও বিরক্তি বোধ করেছিলাম।

আমার প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “মহিলা ডাক্তার সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়?”

“যার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি কিছু জানি না, আমার পক্ষে তার ব্যাপারে মন্তব্য করা সম্ভব নয়,” আমি উত্তর দেই।

“আমি তাকে স্মার্ট মনে করি। একজন অবিবাহিতা ডাক্তার হিসেবে থাকার চেয়ে গৃহবধূ হওয়া অনেক ভালো সিদ্ধান্ত।”

চরম বিরক্তির মাঝে বিদায় নিলাম। তিনি আমাকে এমন দৃষ্টিতে দেখেন, যা সহ্য করা যায় না। লোকটি আমার ও এলওয়ানের জন্য বোঝা।

শুক্রবার সকালে আমরা পিরামিড রেস্টহাউজে গেলাম। সেটি আনোয়ার আলমের বাড়িতে এলওয়ানের যাওয়ার পর। চা পান করার সময় আমি প্রশ্ন করি, “মহামান্য ডাইরেক্টরের বাড়িতে তোমার কেমন সময় কাটলো?” সে আমাকে বিস্তারিত বললো, যা আমার সুন্দর সকালটি নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ছিল। আনোয়ার আলম তাকে কাজের অছিলায় ডাকলেও অন্য উদ্দেশ ছিল। আমি বিদ্রƒপের সঙ্গে প্রশ্ন করি তার বোনটি কেমন?”

“মর্যাদাবান এবং বাস্তববাদী। একজন সন্তান যেমন তার নিজ মাকে শ্রদ্ধা করে, আমিও তাকে অনুরূপ শ্রদ্ধা করি।”

“এবং তিনি তোমার সঙ্গে তার সন্তানের মতো আচরণ করেছেন,” আমি শীতল কণ্ঠে বলি।

সে প্রতিবাদ করে, “রান্দা, তুমি আমাকে অভিযুক্ত করে বিচার করছো।”

এরপর আমি তাকে অফিসে আমাদের মধ্যে কী কথা হয়েছে তা বললাম। সে চিৎকার করে ওঠলো, “আমি তাকে বলবো আমাদের কোনো বিষয়ে নাক না গলাতে।” আমি তাকে অগ্রাহ্য করতে বলি। লোকটি আমাদের দু’জনের অসহায় পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করতে চাইছে।

আমরা একজন আরেকজনতে অত্যন্ত ভালোবাসি এবং আমাদের আকাক্সক্ষা আমাদের কথায় প্রতিধ্বনিত হয়। খুব কম বয়সেই আমার মাঝে প্রচণ্ড আত্মনিয়ন্ত্রণ বোধ সৃষ্টি হয়েছে। আমি আমার অদম্য ইচ্ছাগুলো পূরণে সবসময় জয়ী হয়েছি।

মুহতাশিমি জায়েদ

গত রাতে আমি আমাদের ওস্তাদ আবু দারকে স্বপ্ন দেখেছি। ইবাদত আমার দৃষ্টিকে একপি সুনির্দিষ্ট স্বচ্ছতা দিয়ে ধন্য করেছে। কিন্তু আমি যেহেতু পৃথিবীকে ভালোবাসি, সেজন্য আমি নিজেকে অপর পাশে নিয়ে যেতে পারি না। হঠাৎ একটি গল্প মনে পড়লো: মুহাম্মদ ইবনের আল-আত্তার বলেছেন, “একদিন শেখ মুহাম্মদ রাহিন আমাকে বলেন, ‘আপনার হৃদয়টা কেমন?’ কথাটি যখন সেখানে উপস্থিত আমাদের ওস্তাদ শাহ নকশবন্দকে বলি, তিনি হঠাৎ আমার পা মাড়িযে দেন এবং আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। অচেতন অবস্থায় আমার হৃদয়ে ঘনীভূত সকল অস্তিত্বকে দেখানো হয়। আমি যখন চেতনায় ফিরে আসি, তখন তিনি বলেন, ‘হৃদয় যদি এমন হয়, তাহলে কীভাবে এর পরিমাপ পৌছা সম্ভব?’ সেজন্য হাদিসে আমাদের বলা হয়েছে, ‘পৃথিবী অথবা আকাশ আমাকে ধারণ করতে পারে না। কিন্তু বিশ্বাসী নামাজির হৃদয় তা ধারণ করতে পারে।’”

এই গল্প মনে পড়লে দরবেশদের প্রতি আমার ইর্ষা জাগে এবং আমি কামনা করি যে অলৌকিক কিছু ঘটুক। কিন্তু আমি সুফিবাদের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি, ইবাদতের আনন্দ আঁকড়ে ধরে পরিতৃপ্ত বোধ করছি যে এখানেই আল্লাহর পৃথিবীর হৃদয়। আমার কল্পনা পরম দাতার আলোতে স্নাত। আমি যে জীবন অতিক্রম করে এসেছি তাতে আমার অনুশোচনা করার কিছু নেই, কারণ জীবনের প্রতিটি পর্যায় আমাকে এর নিজস্ব আলো দান করা হয়েছে। পৃথিবীতে তুমি এমন ভাব দেখাও যেন তুমি চিরকাল বেঁচে থাকবে এবং পরকালের কথায় এমন করো যেন তুমি আগামীকালই মারা যাবে।

দুপুরের দিকে দরজার ঘন্টি বাজে। কে হতে পারে? আজ তো উম্মে আলীর আসার কথা নয়। দরজা খোলার পর রান্দার মা জয়নাব হানিম ঘরে প্রবেশ করে। সোফায় বসে তিনি বলেন, “মুহতাশিমি বে, আপনি ছাড়া আমাকে উদ্ধার করার কেউ নেই।” আমি অবাক হয়ে বলি, “আমরা সবাই আল্লাহর হাতে।”

তিনি এলওয়ান ও রান্দার সমস্যা নিয়ে কথা বলতে এসেছেন, “আপনিই বলুন মুহতাশিমি বে, মেয়েটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আপনারা আমাদের অতি পছন্দের মানুষ। কিন্তু রান্দাকে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে?” আমার প্রিয় নাতিকে কেন্দ্র করে যে বিপদ আমি তা আঁচ করতে পারি। কিন্তু রান্দা ভালো মন্দ বিচার করার জন্য যথেষ্ট বয়স্ক এবং যথেষ্ট শিক্ষিত, আমি তাকে সেকথা বলি।

“কিন্তু মুহতাশিমি বে, প্রেম বিভ্রান্ত করে এবং আজকাল প্রেম ইশ্বরে পরিণত হয়েছে। আপনি কি প্রেম করে বিয়ে করেছেন? ফাওয়াজ বে কি প্রেম করে বিয়ে করেছে?” তিনি জানতে চান। আমার দীর্ঘনি:শ্বাসে অসহায়ত্ব প্রকাশ পায়। তিনি পুনরায় বলেন, “ওদের রক্ষা করতে আমাদের কিছু করা উচিত।”

তার কাছে সুলায়মান বে’র মতামত জানতে চাই। তিনি বলেন যে তাদের দু’জনের একই অভিমত এবং তারা এলওয়ানের জন্য দু:খবোধ করেন। তিনি বিদায় নেন। সবাই বাড়িতে ফিরে এলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় এবং সকলে হতাশা ব্যক্ত করে।

এলওয়ান ফাওয়াজ মুহতাশিমি

শীতকাল শেষ হয়েছে, পরিস্কার উপভোগ্য দিন। আমার ভেতরে অশুভ কিছু লুকিয়ে আছে কিনা! আমার উচিত ছিল পিরামিড রেস্টহাউজ ছাড়া অন্য কোনো স্থান করা। কিন্তু আমরা এখানে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। রান্দার শান্ত দৃষ্টি আমাকে অপরাধী করে তোলে। কেউ শ্রদ্ধার পাত্র নয়, কোনোকিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়, কোনো প্রতিশ্রুতিই রাখার মতো নয়। ইতিহাস অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে, এক হাতে বুলবুল, আরেক হাতে কাক রাখার গুরুত্ব কী? রান্দার কাছে জানতে চাই, “তুমি কি জানো যে, তোমার মা আমার দাদাজির সঙ্গে দেখা করেছেন?” আলোচনা যে ভালোভাবে গড়ায়নি তা সে জানে এবং বিশ্বস করে যে এ ধরনের কথাবার্তা নতুন কিছু নয়।

“তাই যদি হয়, তাহলে বহু বছর আগেই আমাদের বিয়ে করা উচিত ছিল,” আমি বললাম।

“আমি লক্ষ্য করছি, এটা নিয়ে তুমি আমার চেয়ে বেশি বিচলিত।”

“আমার দম বন্ধ হয়ে ্আসছে।”

“কিন্তু ্আমরা তো এমন বৈপরীত্যের প্রতিরোধ করতে অভ্যস্ত।”

“কিন্তু আর কতদিন?

“সময় খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়।”

“আমরা পছন্দ করি বা না করি, সময় আসলে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমার ওপর অনেক দায়দায়িত্বের বোঝা চেয়ে আছে।”

“আমারও অনেক দায়িত্ব আছে। আমাদের দু’জনের অবস্থা অভিন্ন,” দৃঢ়তার সঙ্গে বলে রান্দা।

“আমাকে স্বীকার করতে হবে যে আমি তোমার ভবিষ্যৎ নষ্ট করছি।”

“তোমার নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী বলবে?”

“এটা ভিন্ন। একজন পুরুষ মানুষের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলেও তার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব।”

“এলওয়ান, প্রথম বারের মতো নিজেকে পরাজিত মনে হচ্ছে,” রান্দা বিড় বিড় করে, তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে।

“হয়তো এর কারণ আমি প্রথমবারের মতো নিজের স্বার্থপরতাকে প্রাধান্য দিয়েছি,” দ্বিধার সঙ্গে আমি বললাম।

“হায় খোদা, আমার কথাকে কি তুমি ভিন্নভাবে নিয়েছো? আমি তো ÑÑÑ” সে আর্তনাদের মতো বললো।

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি নিজের ক্ষত খুঁচিয়ে বললাম, “এখন আমি তোমাকে আমার বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিচ্ছি।”

“এলওয়ান, আমি তোমার কাছ থেকে এ ধরনের কথা শুনতে পারি না, চাইও না,” গভীর আবেগে সে বললো। “তুমি শুধু বলো যে, তুমি আমাকে তোমার পথে কোনো বাধা বলে অনুভব করবে না। আমার জন্য তোমাকে কোনো ত্যাগ করতে হবে না।”

আমরা নীরবতায় বিভক্ত হয়েছি। আসন্ন রাতের চেয়েও এই নীরবতা ভারি। আমরা দু’জনই আমাদের খোলসে প্রবেশ করেছি। আমরা অপরিচিত মানুষের মতো ওঠে দাঁড়ালাম। ভালোবাসার চেয়ে যাতনা প্রবল।। ফেরার পথে আমরা কোনো কথা বলিনি। কোনো বিদায় না জানিয়ে আমরা যার যার পুরোনো ভবনে চলে গেলাম।

বাবা-মা তাদের রুমে, দাদা একা টেলিভিশন দেখছেন, আমি তাঁর পাশে বসলাম। তিনি শুধু একবার আমাকে দেখলেন। একসময় তাঁকে বললাম, “আমরা আমাদের বাগদান ভেঙে দিয়েছি।” তাঁর চোখে হতাশা, “এ দুর্দশায় আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করুন। আমি অপরাধবোধে ভুগছি।”

রান্দা সুলায়মান মুবারক

আমার হতাশ, করুণ চেহারা দেখে মা কিছুটা আঁচ করে থাকবেন, আমাকে তার শুভেচ্ছা জানানোর ধরন দেখে আমি উপলব্ধি করেছি। তার কাছে গিয়ে তিক্ততার সঙ্গে বলি, যাতে বাবাও শুনতে পান, “মা, আপনার চেষ্টা সফল হয়েছে।” তিনি নীরব হলেন, তাঁর চোখ অশ্রুপূর্ণ হতে শুরু করেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “তুমি সত্যিকার অর্থে একজন বিশ্বাসী। অতএব তোমার দু:শ্চিন্তা করার কারণ নেই।”

এখন থেকে আমাকে সম্পূর্ণ নতুন এক জীবন শুরু করতে হবে, যেখানে এলওয়ানের কোনো নিশানাও থাকবে না, কিন্তু আমৃত্যু ধৈর্য্যরে সঙ্গে এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। হঠাৎ আমার মাঝে একটি তিক্ত বোধ জাগ্রত হয়েছে যে আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। সবকিছু আমার কাছে পুরোনো ও বিরক্তি লাগতে শুরু করেছে। এমনকি আমরা বোন সানা যেন নোংরা হয়ে গেছে। সে শীতলভাবে আমাকে বলে, “তুমি অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। এলওয়ানের ওপর আমি ক্ষুব্ধ। আমার ধারণার চেয়েও সে নিজেকে দুর্বল বলে প্রমাণ করেছে। সে দ্বিধাগ্রস্থ ও লক্ষ্যহীন থাকুক। এমনকি আমি তার মধ্যে যেন দেখতে পেয়েছি যে সে গুলিস্তানের মতো মহিলার কাছে নিজেকে বিক্রয় করে দিচ্ছে। দায়িত্ব পালনের অসমার্থ এবং অপর্যাপ্ততার বোধ থেকে সে পালাতে চেষ্টা করছিল। আমি আমার নতুন স্বাধীনতার জন্য নিজেকেই অভিনন্দন জানাতে চাই। অনেক হালকা বোধ করছি। সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে, আমাকে পরিত্যাগ করেছে। আনোয়ার আলম যখন আমার সঙ্গে কথা বলেছেন তখন তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন? সময় কি আসলেই কাউকে প্রেমের বেদনা থেকে মুক্ত করতে পারে? সাহসের সঙ্গে এই যাতনার চিকিৎসা করতে হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না নিরাময় আসে।

এলওয়ান সকালে যখন অফিসে আসে, অন্য সহকর্মীর মতো আমিও তাকে সালাম দেই, যেন আমাদের মাঝে কিছু ঘটেনি। আমি নির্বিকার হতে চেষ্টা করেও পারি না, তার দিকে না তাকানোর অর্থ নিজের নিরানন্দ ভাব প্রকাশ করা। অবাক হয়ে ভাবি সে কীভাবে রাত কাটায়। আমার কথা ভেবে কি সে নির্ঘূম থাকে অথবা শান্তিতে ঘুমায়।

আনোয়ার আলম আমাকে তলব করে অফিসের কথার পর বলেন, “এমন পরিসমাপ্তি অনিবার্য ছিল। আপনার মতো একজন মানুষের ভবিষ্যৎ শূন্যগর্ভ প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করতে পারে না। আপনার প্রকৃত গুরুত্ব সম্পর্কে আপনার নিজের ধারণা নেই।” আমি কোনো শব্দ উচ্চারণ করি না। তিনি বলে যাচ্ছেন, “একদিন আমি বলেছিলাম, প্রতিটি সমস্যার সমাধান রয়েছে। এই পরিসমাপ্তি আমার জানা ছিল।” ফাইল দেখতে দেখতে তিনি আবারও বলেন, “মিস রান্দা, আমি আপনাকে পরামর্শ দেব, সবসময় মনে রাখবেন যে আমরা যুক্তির যুগে বসবাস করছি। অন্ধভাবে এটি বিশ্বাস করতে পারেন!” কথা বলার সময় তিনি সাহসের সঙ্গে আমাকে দেখছিলেন। আগে যে প্রতিবন্ধক ছিল, এখন আর সেটি সেখানে নেই। কিন্তু আমি সাহস হারাই না। তার আচরণ আমার কাছে আর আজব লাগে না।

সেদিন সন্ধ্যায় আমার বাবা বলেন, “সে যদি আসলেই আন্তরিক হয়, তাহলে সে কখনও তোমাকে ছেড়ে দিতো না।” বাবা বিদ্রƒপ করতে পছন্দ করেন এবং সন্দেহ পরায়ণ ব্যক্তি। সবকিছুর বাজে ব্যাখ্যা থাকে তার কাছে। আমি জোর দিয়ে বলি, “তাকে বেদনাময় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, কারণ সে আর তাকে দোষারূপ করা সহ্য করতে পারছিল না। আমি তাকে আপনার চেয়ে ভালো জানি, বাবা।”

প্রেম থেকে আমরা নিজেদেরকে মুক্ত করার পর যুক্তির ওপর বিশ্বাস স্থাপন করি। কিন্তু মানুষের কথার আঘাত থেকে পালাতে পারি না। বিষয়টি আমার একার হলেও পরিবারের সবার জন্য উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবন অসহনীয় হয়ে ওঠছে। এলওয়ান দূরে, বহুদূরে হারিয়ে যাচ্ছে এবং এখানে আমরা নতুন জীবনের কথা বলছি।

মুহতাশিমি জায়েদ

সকল প্রশংসা আল্লাহর! এলওয়ানের দু:খ ছাড়া সবকিছু ভালো ছিল। এ বছর বসন্তকাল উপভোগ্য। কিন্তু এলওয়ান কি তার সঙ্কট কাটিয়ে ওঠতে পারবে? দিন কেটে যাচ্ছে নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, খাবার খেয়ে, সঙ্গীত শুনে ও মুভি দেখে। কারও বয়স যখন আশি বছর তখন তার পক্ষে যেকোনো সময় অনিবার্য অতিথির আগমণের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কী করার থাকে। হে খোদা, বার্ধক্যের যন্ত্রণা ও বেদনা থেকে আমাদের রক্ষা করো এবং এই পুরোনো বাড়ির ওপর থেকে অশুভ ছায়া দূর করো। আল্লাহর পৃথিবী কত সুন্দর। আকাশ, নীল নদ, বৃক্ষ সারি, কবুতর এবং এই কণ্ঠে কী জাদু! 

“নিশ্চয়ই আসমান ও যমীনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং নদীতে নৌকাসমূহের চলাচলে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর আল্লাহ তা’ আলা আকাশ থেকে যে পানি নাযিল করেছেন, তদ্দ্বারা মৃত যমীনকে সজীব করে তুলেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সবরকম জীব-জন্তু। আর আবহাওয়া পরিবর্তনে এবং মেঘমালার যা তাঁরই হুকুমের অধীনে আসমান ও যমীনের মাঝে বিচরণ করে, নিশ্চয়ই সে সমস্ত বিষয়ের মাঝে নিদর্শন রয়েছে বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্যে।” (আল-কোরআনÑ ২:১৬৪)

আমার বার্ধক্যে আমি যদি শুধু একা থাকতে পারতাম, তাহলে আমি সত্যিই সুখী হতাম। কিন্তু আমি শান্তিতে নেই। আমি পুরোনো দিনের কথা স্মরণ করে সুখী হই এবং বিশ্বাস ও আশার দিনগুলোর স্মরণ আমাকে আনন্দ দান করে। এখন প্রতিশ্রুত শেষ কথা হচ্ছে মৃত্যু, যে অনুভূতির প্রাধান্য যে কারও বোঝা লাঘব করে। এক পর্যায়ে এটি কোমলভাবে বলে: “এখন ফল আহরণের উপযুক্ত সময়।”

একদিন টেলিভিশনে নতুন ধারাবাহিক নিয়ে কথা বলার সময় এলওয়ান বলে, “দাদাজি, আপনার মনের শান্তির জন্য আপনাকে অভিনন্দন।” তার কথা আমার চিন্তা স্রোতকে বিঘ্নিত করে। আমি বলি, “তোমার কণ্ঠে প্রতিবাদ আঁচ করছি।” সে হাসে, কিন্তু কিছু বলে না।

আমি বলি, “জীবনের শেষ পর্যায়ের নাম বার্ধক্য। আমি আমার শেষ দিনগুলোর কথা ভাবি, দেশের দুর্দশাকে তার সন্তানদের কাছে রেখে আমাকে বিদায় নিতে হবে। আমার দিনগুলোতে আমি আমার সাধ্যমতো আমার দায়িত্ব প্রতিপালন করেছি। আমার সাধ্যমতো তোমার মাঝে প্রতিশ্রুতির বোধ জাগ্রত করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তোমার অভিধানে শুধু একজন বীর স্থান পেয়েছে, একজন শহীদ। তুমি দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে তোমার সময় অপচয় করছো। আমি তো বলতে অন্তত পারি যে আমি আমার তিনজন ছাত্রকে মন্ত্রী হতে দেখার জন্য জীবিত ছিলাম।”

এলওয়ান হেসে বলে, “দাদাজি, আপনি কি এটিকেই আপনার একমাত্র অর্জন বলে মনে করেন?”

আমিও না হেসে পারি না, “ইতিহাস এর বিচার করবে। তুমি নিশ্চয়ই একটি হারানো প্রজন্ম চাও না! তুমি তোমাার কর্তব্য পালন করো, যাতে তুমি স্বচ্ছ বিবেকে নিজের আল্লাহর প্রতি নিবেদিত করতে সক্ষম হও।”

আল্লাহ যদি আমাকে শুধু অলৌকিকত্ব সাধনের ক্ষমতা দান করতেন, তাহলে আমি এলওয়ানের জন্য একটি অ্যাপার্টমেন্ট এবং যৌতুকের যাবতীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা করতাম। মানুষ যত কামনা করুক, সিদ্ধান্ত আল্লাহর। এলওয়ানের দু:খ লাঘবের জন্য আমি শুধু দোয়া করতে পারি। রান্দার পিতা সুলায়মান মুবারকের সন্দেহবাদের কথা আমার মনে পড়ে। কিন্তু আসল সমস্যা স্বয়ং এলওয়ান। আমি ভাবি যে সে তার অসুখী অবস্থার জন্য আমাকে দায়ী বলে ভাবে কিনা। আমি তাকে বলি, “দেশ ও দেশের বীরদের নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। দেশ একদিন অবশ্যই নিরাপত্তার তীরে পৌছবে।”

সে উত্তর দেয়, “তার আগেই আমি বৃদ্ধ ব্যক্তিতে পরিণত হবো। দাদাজি, আপনি সুন্দর কথার মধ্যে সহজে সমাধান খুঁজে পান বলে মনে হয়।”

“এলওয়ান, আমি ত্রিশোর্ধ বয়সে আমাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছিল ছাত্রদের ধর্মঘট করার জন্য প্ররোচিত করার অভিযোগে। তখন আমার ওপর পরিবার ও সন্তানদের দায়দায়িত্ব ছিল এবং আমি চরম দারিদ্রের মধ্যে ছিলাম। আমি জাতীয় মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলাম অতি সামান্য বেতনে। আমি আমার এক বন্ধুর মুদি দোকানে হিসাব দেখাশোনা করতাম। পুরো একটি বছর আমরা ডাল ছাড়া আর কিছু খাইনি। তোমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারবে।”

“আমি নিজেকে ঘৃণা করতে শুরু করেছি,” রাগত কণ্ঠে সে বললো।

আমি রসিকতার সুরে, “এটি নতুন জন্মের লক্ষণ হতে পারে।”

“অথবা নতুন মৃত্যুর,” সে বিদ্রƒপ করে। “মৃত্যুও এক ধরনের জীবন।”

এলওয়ানের কথার মধ্যে আমি কোরআনের আয়াতের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই: “যে কেউ সৎ পথে চলে তারা নিজের কল্যাণের জন্যই সৎ পথে চলে, আর যে পথভ্রষ্ট হয়, তারা নিজের অকল্যাণের জন্য পথভ্রষ্ট হয়, (১৭:১৫)

এলওয়ান ফাওয়াজ মুহতাশিমি

আমার অহঙ্কার বিক্ষত এবং আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। আমি বেওয়ারিশ কুকুরের মতো লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরছি। ক্যাফে রিচে নি:সঙ্গতার যন্ত্রণা থেকে বাঁচার এক আশ্রয়। আমি বসে এক কাপ কফির অর্ডার দেই। এটি একটি মন্দির, যেখানে মরহুম বীরদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়, যারা হারানো আশা, দরিদ্র এবং বিচ্ছিন্ন মানুষের আশার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। এ ধরনের কথা যদি কারও ভালো না লাগে, তাহলে তিনি রাস্তার দিকে তাকিয়ে পথচারিদের দেখতে পারেন: কত রকম চেহারা, প্রত্যেকের অভিব্যক্তি ভিন্ন। তারা কী আড়াল করতে চায়? ঈুরুষ, নারী, শিশু, এমনকি গর্ভবতী নারীও আর বাড়িতে থাকে না। ফার্নিচারের দোকান, বুটিক শপ জিনিসপত্রে ঠাসা। এই একটি জাতির মধ্যে পাশাপাশি কতগুলো জাতি বাস করে? ট্যুরিষ্টদের টেবিলে মিনারেল ওয়াটারের বোতল। আমরা কী পান করবো? ট্যাক্সির রেডিওতে কান ফাটানো আজব সব গান বাজে। মিথ্যায় বাতাস পূর্ণ এবং তা ধূলিতে মিশে যায়। ক্লান্তি, ক্লান্তি ÑÑÑ এর চেয়ে গুজব শোনা ভালো। ধ্বংসস্তুপে পরিণত একটি বাড়ি এক লক্ষ পাউণ্ডে বিক্রি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা নিয়ে দুর্নীতির কথা কে না জানে। দেশে কত সংখ্যক কোটিপতি আছে? তাদের কাহিনি আরব্য উপন্যাসের চেয়ে উত্তম। ওয়েটারের যেমন কাহিনি আছে, তেমনি মুচিরও কাহিনি আছে। কখন দুর্ভিক্ষ শুরু হবে? যারা প্রকাশ্যে ঘুষ নেয় তারাই সরব। আইনসভা সঙ্গীতের জায়গায় পরিণত হয়েছে। নতুন ব্যাংক হচ্ছে, অর্থ স্থানান্তর ছাড়া আমদানি হচ্ছে। এখন ডিমের দাম কত? পিরামিড রোডের নাইট ক্লাবগুলোতে গায়িকা ও নর্তকিদের ওপর নোট বর্ষণ চলছে। অন্যদিকে বাগদান ভেঙে যাচ্ছে। সেন্ট্রাল সিকিউরিটি ফোর্সের সৈন্যদের কানে শোনার দূরত্ব থেকে মসজিদের ইমাম সাহেবরা কী বলছেন? পুরো এলাকায় কোনো গণশৌচাগার নেই। কিসিঞ্জার আমার বন্ধু! মেনাহেম বেগিন আমার বন্ধু! ইউনিফর্ম হিটলারের। ক্যাফের পেছনে বেশ্যালয়ের দিকে যে রাস্তাটি গেছে সে রাস্তা দিয়ে একজন মহিলা আসার সময় পুরো নীরবতা বিরাজ করে। তার স্ফীত নিতম্ব এবং মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে একটি সমান্তরাল টানা যেতে পারে। একজন আশাবাদী বলেন যে সে বেশ্যার কাজ নিয়েছে তার পিএইডি’র থিসিসের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহের জন্য এবং তার হৃদয় স্বর্ণের মতো খাঁটি। একজন সমকামী দাবী করে যে তার সমকাম হচ্ছে নির্দিষ্ট আয়ের লোকদের মধ্যে প্রেমের সঙ্কট সমাধানের উপায় এবং পরিবার পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জনেরও উপায়। আরবদের যুদ্ধের আলোচনায় এলে বলতে হয়, এটি চিরস্থায়ী যুদ্ধ এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার এজেন্টদের জন্য দু:খ হয়। যথেষ্ট হয়েছে, সময় নষ্ট করার আর সুযোগ নেই। রান্দা, তোমার কাছ থেকে পলায়ন প্রচেষ্টা অর্থহীন। প্রেম এমন এক ব্যাধি, যার নিরাময় অতি ধীর এবং আমি ভীত যে, এটি দুরারোগ্য ব্যাধিগুলোর একটি।

রাতে খাবার টেবিলে বাবা-মাকে দেখে ইর্ষা লাগে। কর্মব্যস্ততা তাদেরকে অনেক উদ্বেগ থেকে মুক্ত রেখেছে। তারা আমাকে তাদের কাছে আমার নিজের ও দেশের কথা বলা বন্ধ করে নিজের সমস্যা নিজে সমাধান করতে এবং দেশকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করতে বলেন। আমি বাবাকে বিপ্লবের প্রশংসা করতে শুনেছি, বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ায় দু:খ করতে দেখেছি, এখন ‘ওপেন ডোর পলিসি’ তাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

আমার দ্বিধাগ্রস্থতা নিয়ে আমি গ্রাজুয়েটস ক্লাবে আমার শিক্ষক প্রফেসর আলিয়ার কাছে গিয়ে আমার বাগদান ভেঙে যাওয়ার কথা বলি, তিনি মনে করেন এটা ভুল এবং আমাকে বলেন তার ও আমাদের দু’জনের মধ্যে আলোচনার ব্যবস্থা করতে। বিদায় প্রফেসর, অলস আলোচনার দিন আর নেই। আমি কথা দিচ্ছি, জীবনের অবশিষ্ট সময় আমি শব্দের ঘোরতর শত্রু থাকবো। আমার মনে হয়, সব ছেড়েছুড়ে আল-মাহরুকি নিজের সমস্যা সমাধান করেছে। সে স্যানিটারি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে শিক্ষাগত সার্টিফিকেটগুলো নিকটস্থ ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সে ‘প্লাম্বার, প্লাম্বার’ বলে আওয়াজ দেয়, যার মেরামত প্রয়োজন তাকে ডেকে নেয়। সে মনে করে যে শিগগিরই সে সাইয়িদিনা জুবায়ের এর চেয়ে বেশি বিত্তের অধিকারী হবে। আমি তাকে বলি, “ইসলাম নামে নতুন এক ধর্মে তোমাকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানাই, তা হলো, ‘আত্মসমর্পণ’।

রান্দর সঙ্গে আমার বাগদান ভেঙে দেওয়াকে আনোয়ার আলম সঠিক মনে করেন। কয়েক সপ্তাহ পর জরুরী কাজে তিনি আমাকে তার বাড়িতে ডাকেন। কাজ শেষে ডিনার করতে বলেন। গুলিস্তান আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ইঙ্গিত দেন যে আমার বাগদান ভেঙে যাওয়ায় তিনি দু:খিত। আমরা এক সাথে গান শুনি, গান নিয়ে আলোচনা করি। গুলিস্তানের সঙ্গে চকিত দৃষ্টি বিনিময় হতে থাকে। তিনি মুগ্ধ করার মতো নারী। তরুণদের ফুসলানোর তাড়না তার মাঝে কতটা সক্রিয়? আমার ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান বিষয় হলো ক্ষুধা। তিনি আমাকে একটি ভেড়া ভাবতে পারেন, কিন্তু আমি তাকে দেখি নেকড়ে হিসেবে। তিনি যদি শুধু আমার প্রেমিকা হতে সম্মত হন, তাহলে কী যে স্বস্থি লাভ করবো! কিন্তু কীভাবে, কখন ও কোথায়?

আনোয়ার আলম বলেন, “এক মাসের মধ্যে গুলিস্তানের ভিলা রেডি হয়ে গেলে সে আমাকে এখানে একা রেখে চলে যাবে।” তিনিও কেন তার সঙ্গে যাবেন না প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন যে তার নিজের ফ্ল্যাট রেডি হলে তিনি বিয়ে করার কথা ভাববেন।

রান্দা সুলায়মান মুবারক

সময় আশা জাগায় এবং সময় মৃত্যু ও জীবন দুটিই আনে। একদিন ভাইরাসের বিনাশ ঘটে নিরাময় আসবে। প্রকৃত বিশ্বাসীকে আল্লাহ পরিত্যাগ করেন না। এখন আমরা একই অফিসে সহকর্মীর মতো পরস্পরের সঙ্গে কথা বলি, সহকর্মীর মতো একজন আরেকজনকে সহযোগিতা করি এবং অপরিচিতের মতোও থাকি থাকি, যারা কখনও চুম্বনের মধুর স্বাদ গ্রহণ করেনি। আমি তার নিন্দা করি না, শ্রদ্ধাও করি না। আমি এখন নতুন এক অভিজ্ঞতার মাঝে জড়িত। আনোয়ার আলম। তিনি বন্ধুসুলভ, আমাকে প্রেমভাবে সম্বোধন করেন, প্রশংসা করেন, সহানুভূতি দেখান। আমার অহঙ্কার আমাকে পরাজিত হতে দেবে না। মা বলেন, “আমি শুনেছি, ইব্রাহিম আবারও প্রস্তাব পাঠাতে প্রস্তুত।” লোকটি বয়োবৃদ্ধ, খনির মালিক, যিনি দুই বছর আগে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন, যা আমি নাকচ করেছি। তিনি বিপত্নীক এবং সন্তানের পিতা। বাবা পুরো সময় চুপচাপ থাকেন। আমি আমার মর্যাদাহানির মতো কিছু করতে পারি না। কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থ ও সম্মান থাকা উচিত। আনোয়ার আলমের দুটিই আছে। তিনি সন্দেহভাজন হলে ইতোমধ্যে তা জানাজানি হতো। আমাদের বয়সের যে ব্যবধান তা অযৌক্তিক নয়। ভালোবাসা নিয়ে এখনও ভাবার সময় আসেনি। আমাকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হলো না। একদিন ফাইল দেখার পর তিনি বললেন, “আমি এখন আপনার মতামত আশা করি।”

“কী ব্যাপারে স্যার?” আকাক্সক্ষায় কম্পিত হৃদয়ে আমি জানতে চাই।

“আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই, আপনার কেমন মনে হয়?”

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। তিনি আবারও বলেন, “ভালোবাসার কথা কীভাবে বলতে হবে তা হয়তো আমি জানি না, কিন্তু ভালোবাসা আছে। আমি হয়তো ত্রুটিমুক্ত নই, কিন্তু সাহস করে বলতে পারি, আপনার সকল প্রয়োজন হয়তো আমি পূরণ করতে পারবো।”

বিষয়টি নিয়ে সন্ধ্যায় বাবা-মা’র সঙ্গে কথা বলি। বাবা বললেন, “তুমি যা বলবে, আমরা তা মেনে নেব।” মা বিয়ের ব্যয় সংস্থানের জন্য তার অলঙ্কার বিক্রয় করে দেওয়ার কথা বলেন। তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো দূর হয়ে গেল। আনোয়ার আলম আমার সমস্যা সম্পর্কে ইতোমধ্যে সচেতন। যথাসময়ে পারিবারিক পরিমণ্ডলে আমাদের বাগদান সম্পন্ন হলো। জীবনভর যারা বন্ধু ও প্রতিবেশি তারাও আমন্ত্রিত হননি। গুলিস্তান আমাকে হীরাখচিত একটি মূল্যবান নেকলেস উপহার দিলেন। বিচলিত হলেও আমি আমার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করলাম। সবাই বিদায় নেওয়ার পর আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হারিয়েছি।

মুহতাশিমি জায়েদ

স্বল্প দূরত্বে রান্দার বাগদান অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে। এলওয়ানের চেহারায় বিষাদ। তিক্ততার অভিজ্ঞতা আমি শুধু কবিতায় দেখেছি। সে আমাকে হাত তুলে বিদায় জানালো। সহসা আমার মনে হলো আমি এক কিলোগ্রাম লাল ও গোলমরিচের গুড়া খেয়েছি। নামাজের কথা মন থেকে দূর করে দিলাম। প্রিয়জনেরা কবরে শুয়ে আছে। কোনো দৃশ্যমান কারণ ছাড়াই আমার মনে তাদের স্মৃতি ভিড় করলো। তোমাদের আগে কত হাজার হাজার নবী, দরবেশ কবরে গেছেন। বিপ্লবের শোরগোল নতুন করে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, পূর্ণ স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু, জনগণ বাদশাহ’র উর্ধে, কায়রো জ্বলছে। সর্বত্র বেপরোয়া পাগলামি, যা দুর্ভিক্ষ ও ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। তোমরা মৃত্যু নিয়ে ভাবছো না। তোমরা উৎসবে মদ পান করছো, নারীর পেছনে ধাওয়া করছো, অনেকে আজান শুনে জুয়ার টেবিল ছেড়ে ফজরের নামাজ পড়তে যাচ্ছে। গাঁজা সেবন করে নীল নদে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো আছে, এছাড়াও রয়েছে তরুণের দল, যারা সংবিধান বাতিল করার বার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্বাস ও পাথরে সজ্জিত হয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। এখনও আমি গুলি ও বুটের শব্দ শুনতে পাই। কত প্রিয় মানুষ চলে গেছে, কত কবর তোমাদের ভাগ্যকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। আমার ব্যাকরণ শিক্ষক দাদার কথা মনে পড়ছে, যিনি আমার অশিক্ষিত দাদিকে প্রাচীন আরবিতে সম্বোধন করতেন। তিনি সুস্থ ও পাগল বংশধর রেখে গেছেন, যারা যুক্তি ও পাগলামি চর্চা করে। বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে আপনার জন্য আনন্দ এবং আমাদের জন্য দু:খ আনতে। আমি আর কতদিন অনতিক্রম্য অলৌকিকত্বের আকাক্সক্ষা করতে হবে? কবে আমি নিপীড়ণকারীকে থাপ্পড় মারার সক্ষমতা অর্জন করবো? অভিজ্ঞতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। আমরা আল্লাহর অনুগ্রহকে চক্রান্ত, অহঙ্কার, ও বেইমানি দ্বারা কলঙ্কিত করেছি। জেনে এসেছি, ‘ধৈর্য্যই গুণ’, হে খোদা, আমরা কোন্ ধৈর্য্যরে কথা বলছি? হাজার হাজার বছর ধরে আমরা ধৈর্য্য ধারণের বিনিময়ে অকল্যাণ ও অসুস্থতা পেয়েছি। আমার অসামর্থ আমার মুখে হাসি ফোটায়। প্রায় নগ্ন নর্তকি জুমুরুদা গাইছে, ‘আমি হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছি,’ কোনো কারণ ছাড়াই বেশ্যাদের সঙ্গে এমন কত রাত কাটিয়েছি। জুমুরুদা, লাহলুবা, উম্মে তাক্কিয়া এবং তোমাদের আরও কত বিনোদিনীর সঙ্গে আমরা অকৃতজ্ঞ ছিলাম। ভাগ্যগত বীরেরা আমাদেরকে দারিদ্রে নিপতীত ও পরাজিত না করলে এমন হতো না। ওই রাতগুলো ধূঁয়া ও ভাবাচ্ছন্নতায় আচ্ছন্ন। অনুশোচনা করা ও ক্ষমা লাভের আকাক্সক্ষা

ফাওয়াজ এবং হানা ঘুমোতে যাওয়ার আগে এলওয়ানের ভাগ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ফাওয়াজ আশাবাদী যে এলওয়ান তার সঙ্কট কাটিয়ে ওঠতে পারবে। হানাও একমত যে সে এখন তার পছন্দমতো সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। আমি আশা করছিলাম যে আমার ঘুমানোর আগে সে আসুক।

এলওয়ান ফাওয়াজ মুহতাশিমি

অফিসে আমি রান্দার টেবিলের সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলি, “আন্তরিক অভিনন্দন।” সে নিচু কণ্ঠে সাড়া দেয়, “ধন্যবাদ, তোমারও সৌভাগ্য কামনা করি।”

আশপাশে কেউ নেই দেখে আমি সুযোগ গ্রহণ করি, “আমাকে স্বীকার করতে হয় যে, তোমার জন্য আরও ভালো কিছু আশা করেছিলাম।”

“আমার এই সিদ্ধান্তে সমস্যা কোথায়?”

“আসলে আমি বলতে চাই যে তুমি সেরা পাওয়ার যোগ্য।”

আনোয়ার আলম চলে আসেন এবং আমি দ্রুত তার কাছে গিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাই। তিনি বলেন, “আপনি যদি বাগদান ভেঙে না দিতেন, তাহলে আমি এ নিয়ে ভাবতাম না।”

“আপনি সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন,” তার প্রতি প্রশংসা ছুঁড়ে দেই।

“এখন থেকে আপনাকে আপনার নিজের স্বার্থ দেখতে হবে।”

“স্যার, আমাকে চমৎকার উপদেশ দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।”

“আমার বোন তার নতুন ভিলায় চলে যাচ্ছে, সেজন্য একটি ছোট টি পার্টির আয়োজন করা হয়েছে এবং আমার বোন আপনাকে দাওয়াত দিয়েছেন।”

বুঝতে পারছি যে পথ পরিস্কার। আমি দাওয়াত গ্রহণ করি, যদিও নিজেকে বিক্রি করে দেওয়ার ধারণাটি তখনও আমার মাঝে স্থান করে নেয়নি। আমি সন্ধ্যায় যাই, ভিলাটি আনোয়ার আলমের ভবন থেকে খুব দূরে নয়। ছোট হলেও রাজসিক, গোলাপি ও লাল গোলাপে পূর্ণ উদ্যান। ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসি, সাদা পোশাকে সজ্জিত গুলিস্তান আমাদের মাঝখানে বসেন।

“আমাদের নিজেদের জন্য ছোট্ট আয়োজন,” আনোয়ার আলম বলেন, “আপনাকে দাওয়াত করা হয়েছে পরিবারের সদস্য হিসেবে।”

গুলিস্তান কোমল কণ্ঠে বলেন, “আপনার সহকর্মীদের মধ্যে একমাত্র তার ব্যবহার আমি পছন্দ করি।” আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই।

আমরা খাওয়ার ফাঁকে দেশের পরিস্থিতি ও সরকারের অনিশ্চিত অবস্থা নিয়ে আলোচনা করি। জরুরী টেলিফোন করার কথা বলে আমাকে গুলিস্তানের সঙ্গে রেখে আনোয়ার আলম ওঠে যান। গুলিস্তান মৃদু কণ্ঠে বলেন, “আপনার মতো লোক উত্তম কিছুর যোগ্য।” কী বোঝাতে চান তিনি? রাজনীতি অথবা আমার ব্যক্তিগত দু:খ? তার চমৎকার আকর্ষণীয় দেহের নৈকট্য আমাকে সহসা জাগিয়ে তোলে। আমি লজ্জা ঝেড়ে তার শরীর দেখি। সে মুহূর্তে আমি যা চেয়েছি তা হলো তাকে আমার প্রেমিকা হিসেবে পাওয়া। “আপনার সঙ্গে একা কাটাতে আমার ভালো লাগবে,” আমি ফিসফিসিয়ে বলি, এটুকুতেই আমার গলা শুকিয়ে গেছে।

“আপনার মতো ভদ্রলোকের সঙ্গে একা কাটাতে পারলে আমি আনন্দিত হবো,” তিনি শান্তভাবে বলেন। আমার শরীরে বিদ্যুতের প্রবাহ সহসা থেমে গেল। মনে হলো একহাতে তিনি আমার বেপরোয়া স্বপ্নগুলো ধরেছেন, আরেক হাত দিয়ে আমাকে ডাকছেন। তিনি নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন, “আমি নিজেকে শ্রদ্ধা করি এবং যারা নিজেদের শ্রদ্ধা করে তাদের প্রশংসা করি। আপনি যেকোনো সময় এখানে আসতে পারেন। আমি আপনার সম্পর্কে অনেক শুনেছি, কিন্তু আমার সম্পর্কে আপনি তেমন কিছু জানেন না।”

রান্দা সুলায়মান মুবারক

যত শিগগির সম্ভব তিনি বিয়ে করতে চান এবং আমি বিলম্ব করার কোনো অজুহাত দেখাতে পারি না। আমরা গুলিস্তান হানিমের ভিলায় অনুষ্ঠান আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। বাবা উপস্থিত থাকতে পারবেন না, এটি নীরব এক অনুষ্ঠান ছিল। খাবার ব্যবস্থা ছিল চমৎকার এবং এতে অংশগ্রহণ করেন কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাবৃন্দ ও একদল ব্যবসায়ী। আমি আনন্দের মুখোশ পরে ছিলাম। আমি বহু প্রার্থনা করেছি এবং সাফল্য লাভের জন্য সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। আমার সবচেয়ে ভয় ছিল যে এলওয়ান উপস্থিত থাকতে পারে, কিন্তু ছিল না। আজ রাতে এলওয়ান যদি বর থাকতো, তাহলে সে কী করতো। সারা জীবন আমি কল্পনার মধ্যে কাটিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে, আমি আনোয়ার আলমকে ভালোবাসতে পারবো।

বিয়ের পর বেশ কিছুদিন পর্যন্ত লোকজন উপহার সামগ্রী নিয়ে আসে, আমরা তাদের আপ্যায়ন করি। আনোয়ার আলমকে বলি, “ব্যবসায়িক মহলে তোমার এত বন্ধু!”

তিনি খোলামেলা উত্তর দেন, “প্রকৃতপক্ষে তারাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তরুণকে চোখে আমার চাকুরি গুরুত্বপূর্ণ হলেও আসলে এই চাকুরির কোনো মূল্য নেই। আমাদের ভবিষ্যৎ বেসরকারি খাতে, যেখানে বিচক্ষণতার জুয়ায় একজন ব্যক্তি একটি শ্রেনি থেকে আরেকটি শ্রেনিতে ওঠে যায়। অতএব তাদেরকে এখানে স্বস্থি লাভ করতে দেওয়ার মধ্যে কার্পন্য করো না।”

যখন তখন ব্যবসা সংক্রান্ত ফোন আসে, আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করি না। তাকে বলি, “আমার ধারণা হয়েছিল, তুমি অর্থনৈতিকভাবে নিরাপদ।”

“অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বোধ আসে স্থায়ীভাবে পন্য মূল্য বৃদ্ধিতে,” সে দৃঢ়তার সঙ্গে বলে এবং আরও যোগ করে, “এ পরিস্থিতিতে তুমি যদি সম্পদ আহরণ না করো, তাহলে আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন না।” আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। আমি নতুন এক ব্যক্তিকে আবির্ভূত হতে দেখি। ওপরে ওঠার ক্ষমাহীন প্রতিযোগিতায় সে ধৈর্য্য ধরবে না। সে শুধু নিজের উচ্চাভিলাষ পূর্ণ করতে চায়। অভিলাষের সামনে সে দিনে শতবার অবনত হয়। তার ব্যাপক কৌশলের মধ্যে আমার যেন কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি সম্পূর্ণ বিস্মিত হয়ে পড়েছি। তার কাছে প্রেম শুধু মহূর্তের বস্তু। শিগগিরই আমার মাঝে হতাশার সৃষ্টি হয়। কোনোকিছুর বিনিময় ছাড়াই আমি নিজেকে বিক্রয় করে দিয়েছি। হতাশা স্বীকার করতেও আমি লজ্জিত। এখানে আমার কাজ সৌজন্য প্রকাশ করা, বিনোদনের পাত্রী হয়ে থাকা এবং পানীয় পরিবেশন করা। তাতেও সে সন্তুষ্ট নয় এবং আমাকে জানায় যে, তার পক্ষে তার সান্ধ্য কর্তব্যগুলো বাতিল করা সম্ভব নয় এবং আমাকেই তার  অতিথিদের স্বাগত জানাতে ও আপ্যায়ন করতে হবে। আমার আপত্তিতে কাজ হয় না। আমি নিজেকে মদ্যপায়ী এবং সকল সীমা লংঘনকারী পুরুষদের মাঝে দেখতে পাই।

একদিন আমি তার অতিথিদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করি, তারা অবাক হয়। তারা চলে যায়। মাঝরাতে আনোয়ার আলম আসে এবং আমি তীক্ষèভাবে বলি, “এটি একটি বাড়ি, শুড়িখানা নয়। আমি তাদের বের করে দিয়েছি। তুমি যেভাবে খুশি ব্যাখ্যা করতে পারো।”

সে আমার মুখোমুখি হলো, “তুমি সর্বণাশ করেছো। আমি ভেবেছিলাম, তুমি সবকিছু ভালো বোঝো।”

“আসলে আমি তোমাকেই বুঝতে পারছি না। তুমি অদ্ভুত এবং ঘৃণ্য এক লোক,” আমি ক্ষুব্ধভাবে বলি।

হাতের ইশারায় সে বোঝায় আমার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন এবং বলে, “এ নিয়ে কথা বাড়ানো অনাবশ্যক। আমি রাগ না করে সারা জীবন কাটিয়েছি। কোনো ভুল হয়েছে, যা শুধরানো যেতে পারে।”

“আমি যাচ্ছি, এ বাড়িতে আমি আর এক মুহূর্ত থাকবো না।”

 তোমার যা ভালো মনে হয় তুমি তা করো, কিন্তু রাগ করার কোনো প্রয়োজন নেই,” সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব সে আমার ওপর ছেড়ে দিল।

মুহতাশিমি জায়েদ

যারা অন্যায় করে এমন লোকজনকে তিনি পছন্দ করেন না। আপনারা ৫ মে বিপ্লব ঘোষণা করেন এবং ৫ সেপ্টেম্বর বাতিল করেন। সকল শ্রেনির মিশরীয়কে আপনারা কারাগারে নিক্ষেপ করেন Ñ মুসলিম, কপটিক, রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং বুদ্ধিজীবীদের। সুযোগসন্ধানীরাই শুধু মুক্ত থাকে। আল্লাহ, তুমি মিশরকে রক্ষা করো! আমার মনে আছে যেদিন সা’দ জগলুলকে বায়ত আল-উম্মা’য় গৃহবন্দি করা হয়, সেদিন সুযোগসন্ধানীরা মিছিল করে প্রাসাদে যায় তাদের আনুগত্য প্রদর্শন করতে। আপনি পুরোনো নাটকের পুনমঞ্চায়ন করছেন কেন, যা মিশরীয়দের ক্ষতে আরও আঘাত দেবে? নির্যাতনের কালো দিনগুলো আমার মনে আছে। তাহলে ১৯১৯ সাল কি স্বপ্ন অথবা কল্পকাহিনি ছিল? আমি জানি না আগামীকাল ভাগ্যে কী আছে। আমি আমার ঘনিষ্ট বন্দিদের হারিয়েছি এবং আমার শেষ বন্ধু গতকাল মারা গেছে। পঁচাত্তর বছর যাবত আমরা বন্ধু ছিলাম, যেদিন প্রাইমারি স্কুলে পা দিয়েছিলাম, সেদিন থেকে। আমি তার জানাজায় গেছি, এই যাওয়া হজ্বে যাওয়ার মতো কষ্টকর। অএলওয়ানের কাঁধে ভর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। এরপর শোকসভায় আমি স্মৃতচারণ করেছি। কত স্মৃতি! সেই মুখ, সেই হাসি! ফুটবল ছাড়া আমরা সবকিছুতে একমত ছিলাম। তর্ক হতো Ñ তুমি কি জামালেক টিম, না ন্যাশনাল টিমের সমর্থখ! পরামর্শ দিত খালি পেটে এক গ্লাস পানি পান করো, স্মৃতির জন্য ওষুধ খেতে ভুলে যেয়ো না। আমি তোমার ৫ সেপ্টেম্বরের কথা শুনিনি, কিন্তু আমি জানি তুমি কী বলতে পারো। কোরআনের একটি আয়াত আছে: “প্রতিটি সৃষ্টিকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।” শিগগির মৃত্যু এসেছে এবং আমার পাশে বসেছে। বন্ধুর মৃত্যু আমার নিজের মৃত্যুর জন্য রিহার্সাল। যেন আমি সব দেখতে পাচ্ছি: লাশকে গোসল করানো, খাটিয়া বহন করা, জানাজা, দাফন। এরপর শোকবাণী পঠিত হবে: মুহতাশিমি জায়েদ একসময় শিক্ষক ছিলেন এবং তিনি তার যৌবনে ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্টের সমর্থক ছিলেন, ইত্যাদি। দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত করেছি, কিন্তু এখন মনে হয়, যেন স্বল্প মুহূর্ত কাটিয়েছি। প্রেম, রাগ, আশা Ñ এসব বহু আগে চলে গেছে। এখন আর তোমার কফিনে থাকা এবং কফিনের পেছনে আমার হাঁটার মধ্যে খুব পার্থক্য নেই। তার ছেলে আমাকে আন্তরিকভাবে সালাম জানিয়ে বলে যে মারা যাওয়ার সময় সে আমাকে মনে রাখার জন্য বলতে বলেছে।

সেই সন্ধ্যায় আমার ছেলে ফাওয়াজ আমাকে তিরস্কার করে: “আপনার বয়সে আপনাকে এ ধরনের দায়িত্ব থেকে হয়তো ছাড় দেওয়া যেতে পারে।” তার স্ত্রী হানা বলে, “আজ আমি একটি বই কিনেছি, কীভাবে বাড়ির ছোটখাট মেরামতের কাজ করা যায়। আশা করি বইটি আমাদের স্যানিটারি মিস্ত্রি ও ইলেট্রিশিয়ান থেকে মুক্তি দেবে।”

লোকজনকে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। এই আলোচনা ছাড়া মানুষের মুখে আর কোনো কথা নেই। এলওয়ান জানায়, প্রফেসর আলিয়া এবং তার বন্দু মাহমুদ আল-মাহরুকিও কারাগারে। সরকার দ্রুত বিচার সম্পন্ন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যাতে যারা নির্দোষ তাদের কোনো ক্ষতি না হয়। কিন্তু জনগণ এসব প্রতিশ্রুতিতে মিথ্যাচার বিবেচনা করে।

এলওয়ান বন্দি হয়নি এজন্য আমি আনন্দিত। কিন্তু যারা বন্দি তাদের জন্য দু:খিত। এলওয়ান একান্তে রান্দার স্বামী আনোয়ার আলমের বোনের সঙ্গে তার সম্ভাব্য বিয়ের কথা বলে। আমি খুটিনাটি জানতে চাই এবং সে জানায়: মহিলাটি বিধবা, ওর চেয়ে বিশ বছরের বড়, অত্যন্ত বিত্তবান, তেমন সুন্দরী না হলে গ্রহণযোগ্য। আমার মতামত চাইলে ওকে বলি এ ধরনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত পুরোপুরি ব্যক্তিগত। আমি শুধু জানতে চাই সে মহিলাকে ভালোবাসে কিনা। কিন্তু সে ভালো না বাসলেও ঘৃণা করে না। আমি বলি, “মহিলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো অধিকার আমার নেই। আমি আরেক জগতের বাসিন্দা এবং আমার পৃথিবীকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বিজ্ঞতাপ্রসূত নয়। এটুকু বলতে পারি, এই সম্পর্কে সুবিধা ও অসুবিধা দুটোই আছে এবং তোমার ক্ষেত্রে সুবিধার পাল্লা ভারি।”

“আমি নিজেকে বিক্রয় করতে অস্বীকার করছি,” অস্পষ্ট হেসে সে দ্রুত বলে। আমি স্বস্থি বোধ করি এবং জানতে চাই যে এ ব্যাপারে মনস্থির করার আগে সে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেছে কিনা এবং সে জানায় প্রয়োজনের চেয়েও সে বেশি ভেবেছে। আমি তার শুভ কামনা করি।

এলওয়ান ফাওয়াজ মুহতাশিমি

আমার বের হওয়ার সময় দাদাজি জানতে চাইলেন দাদাজি বললেন যে রান্দা তার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছে। তিনি আমার মায়ের কাছে খবরটি শুনেছেন। আমি বিস্মিত হলাম, সে তো এখনও তার মধুচন্দ্রিমা কাটাচ্ছে।

অফিসে গিয়ে আমার নিজের ভাবনা ও আবেগের মাঝে সবকিছু জড়িয়ে রেখেছিলাম, শুধু আমার দু:খ ও আনন্দ সম্পর্কে সতর্ক ছিলাম। বিষাদের অনুভূতি রান্দাকে ঘিরে রেখেছে এবং শিগগিরই ঘটনাটি পুরো অফিসে ছড়িয়ে পড়লো। আমি তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আন্তরিকভাবে বললাম, “তোমার ক্ষেত্রে এমন ঘটা ঠিক হয়নি।

সে আমাকে ধন্যবাদ জানালো এবং শান্তভাবে বললো, “এখন পর্যন্ত এটা যথেষ্ট।”

রান্দার অনুপস্থিতিতে অনেক গুজব শোনা যাচ্ছিল। অবাক করার মতো কথা কানে আসছিল। আনোয়ার আলমের ব্যর্থতার কারণেই এমন ঘটেছে, যা বিলম্বে বিয়ে করা পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রায়ই ঘটে থাকে। না, না, তার ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক। তার ভাবভঙ্গির দিকে খেয়াল করে দেখো। না, নিশ্চয়ই রান্দার শীতল মনোভাবের কারণে; দৃশ্যত সৌন্দর্যই সবকিছু নয়। এছাড়াও গুজব আছে যে এলওয়ান তার বোনের সঙ্গে প্রেম করছে। সবই আমার কানে এলো এবং আমি আহত বোধ করলাম। রান্দা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। খুব বেশি না হলেও আমি যেভাবে তোমাকে ভালোবেসে অভ্যস্ত। তোমাকে এভাবে হেরে যেতে দেখে আমি মর্মাহত। আমার হৃদয় তোমার আহত অহঙ্কারের কাছে।

আমার মনে হলো আনোয়ার আলমের কাছেই আমি সত্যটা জানতে পারি। আমার দু:খ প্রকাশে তিনি ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বললেন, “ধন্যবাদ।”

আমার আন্তরিকতায় সন্দেহ করছেন ভেবে আমি বললাম, “আমি আপনাদের দু’জনের জন্যই দু:খিত।”

“দু:খ প্রকাশের মতো কোনো ব্যাপার ঘটেনি,” শীতল কণ্ঠে বলে তিনি কাজে মন দিলেন।

গুলিস্তান হানিম আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি দ্বিধা না করেই তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। আমি প্রায় নিশ্চিত যে তিনি আমাকে সত্য কথাটিই বলবেন। তিনি নববধুর মতো সেজেছেন। তিরস্কারের সুরে বললেন, “আমি দাওয়াত করলেই শুধু আপনি আসেন। আমার কাছে আসতে বিব্রত বোধ করার কোনো অজুহাত দেবেন না।” আমি আগ্রহ ভরে তার দিকে তাকালাম। তিনি আবারও বললেন, “আমার ভাই মনে হয় আমার কথা বেশি ভাবেন। আমার বিষয়গুলো দেখাশোনা করার কথা কী ভাবছেন?” মনে হলো আমার নিচে তলাহীন এক গর্ত উন্মুক্ত হচ্ছে।

দ্বিধার সঙ্গে বলি, “আপনার ভাই বিচলিত বোধ করবেন। আমাকে একটু ভাবার সময় দিন। কারণ, আমি মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার কথা ভাবছি।”

“কাজ খুব সামান্য, কিন্তু একজন সৎ মানুষকে প্রয়োজন,” তিনি বলেন। আমি আবারও ভাবার জন্য সময়ের কথা বলি। হঠাৎ তিনি তার অতীতের কথা তোলেন, “আমার বিয়ে আমাকে সবসময় লোভের বস্তুতে পরিণত করেছে। আসলে আমার বাবা আমার চেয়ে ত্রিশ বছরের বেশি বয়সের এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। তা সত্ত্বে আমি সততার সঙ্গে সম্মানজনক জীবন কাটিয়েছি। আমার সুনাম সোনার মতো খাঁটিই আছে।”

আমি চাতুর্যের সঙ্গে বলি, “আপনার ভাই আনেয়ার আলমও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, তবুও তিনি কত ভাগ্যহত।”

“আপনি কি তার জন্য, অথবা তার স্ত্রীর জন্য দু:খ অনুভব করছেন?” আমার দিকে সন্দ্বিগ্ধ দৃষ্টিতে বললেন।”

“যা ঘটে গেছে, তা শুধরানো যায় না। ব্যাপারটি সত্য, স্বাভাবিক এবং সাধারণ।”

“আপনিও বোঝেন, আমিও বুঝি। আমার মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে আমার নিজের সুখ অন্বেষণের অধিকার আমার অবশ্যই রয়েছে। আপনাকে কোনো দু:খ করতে হবে না। আমি অপেক্ষা করবো।”

রান্দা সুলায়মান মুবারক

ছয় জোড়া চোখ বিভ্রান্তির এক গর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে: আমার চোখ আমার মায়ের চোখে, আমার চোখ আমার বাবার চোখে এবং আমার মায়ের চোখ আমার বাবার চোখে Ñ সবাই একে অপরের কাছ থেকে গোপনে দূরে সরে যাচ্ছে। আমার মায়ের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আমার নিজের মুখের রং প্রতিফলিত হচ্ছে। বাবা চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি মাকে আমার ডিভোর্সের সম্ভাবনার কথা খুলে বললাম। সকালের নাশতার পর বাবাকে বলার পর তার মুখে রাগের রেখা দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, “আমার যদি শক্তি থাকতো তাহলে আমি তাকে দেখিয়ে দিতাম।”

আমি বললাম, “সবার কিছু গোপনীয়তা থাকে তা সত্য, কিন্তু সে পুরোপুরি গোপন করেছে এবং আমি বোকা বনেছি।” বাবা একজন আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়ার কথা বললে আমি আপত্তি জানালাম, কারণ এর ফলে কেলেঙ্কারি ছড়াবে। ডিভোর্সে কোনো সমস্যা নেই, কারণ আনোয়ার আলম কোনো আপত্তি না জানিয়ে আমার অধিকার স্বীকার করেছে। তা সত্ত্বেও এত দ্রুত ডিভোর্সের ঘটনা অবশ্যই গুজব সৃষ্টির কারণ ঘটাবে।

আমার সহকর্মীরা যদিও কিছু বলেনি, কিন্তু আমি অনুভব করতে পারছি যে অফিস জুড়ে চাপা গুঞ্জন চলছে এবং বিশেষ করে এলওয়ানের মনে হাজারটি প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। তার ওপর আমার চরম ক্ষোভ। একদিন সে অপরাধ বোধের কথা বলে দু:খ প্রকাশ করলো। আমি তাকে বললাম যে এ ব্যাপারে তার কিছুই করণীয় নেই। আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে সে এখনও আমাকে ভালোবাসে বলে জানালে আমি কঠোর হয়ে বললাম যে এ ধরনের কথা আমি শুনতে চাই না।

সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজের ওপর ক্ষুব্ধ হতে শুরু করলাম। এলওয়ানের কথা ভেবে দু:খবোধ হলো। এমনকি গুলিস্তান হানিমের কথাও মনে হলো তিনি এলওয়ানকে কী বলতে পারেন। সে কি তাকে বিেেয় করবে? তাতে সমস্যা কোথায়? গুলিস্তান নি:সন্দেহে তাকে চান। তিনি কি তাকে ভালোবাসেন! কে জানতো যে আমরা একদিন বিচ্ছিন্ন হয পড়বো? কে জানতো যে আমাদের আশা ধূলায় মিশে যাবে? অফিস শেষ হওয়ার আগে সে ফিসফিসিয়ে বললো, “তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলার জন্য আমি মরিয়া হয়ে আছি।” আমিও কথা বলতে আগ্রহী।

আমরা পিরামিড রেস্টহাউজে গেলাম এবং স্যান্ডউইচ খেয়ে চা পান করার সময় একে অপরের দিকে বোকার মতো দেখছিলাম। সে আমার পরিকল্পনা জানতে চাইলে আমি বললাম, “আমি কোনো পরিকল্পনা ও স্বপ্ন ছাড়া বাস করছি এবং তাতে আমার মনে শান্তি অনুভব করছি।” সে তার দাদার উপদেশ বলতে চেষ্টা করলে আমি বাধা দিয়ে আবারও বললাম, “দাদাজি ও তার উদ্ধৃতি ভুলে যাও। ওগুলো আমাদের কাজে আসবে না। তুমি কবে গুলিস্তান হানিমকে বিয়ে করছো?”

সে অবাক হয়ে বললো, “কে একথা বলেছে?”

“কেউ বলেনি, এটি একটি প্রশ্ন মাত্র।”

“আমি নিজেকে বিক্রয় করবো না।”

“তাহলে তুমি কি মনে করছো যে আমি নিজেকে বিক্রয় করেছিলাম?”

“এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। একজন মেয়ের পক্ষে তার চেয়ে বেশি বয়সের পুরুষকে বিয়ে করা অস্বাভাবিক নয়,” আমাকে সতর্কতার সঙ্গে দেখে সে দ্রুত বললো।

আমার বিয়ে কেন ভাঙলো জানতে চাইলে আমি তাকে সত্য কথাটাই বলতে চাইলাম। আমি আমার অনুভূতিগুলো তার কাছে প্রকাশ করলাম। সে আনোয়ার আলমকে কষে গালি দিল। আমি তাকে ক্রদ্ধ হতে নিষেধ করলাম।

মুহতাশিমি জায়েদ

আমি আমার বাবা, মা এবং আমার বোন মাহাসিনকে স্বপ্নে দেখি। এমনকি একবার আমি তাদেরকে প্যারাশ্যুটে আমার মাথার ওপর ভাসতে দেখেছি। বিদায় নেওয়ার সময় কি ঘনিয়ে এসেছে? সুলায়মান মুবারকের অশুভ দৃষ্টি সত্ত্বেও আমার স্বাস্থ্য ভালো আছে। আল্লাহর নবী যেকোনো মুহূর্তে বিচ্ছেদের দিনের আওয়াজ শুনবেন এবং যথাযথ শ্রদ্ধার সঙ্গে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া ব্যক্তিকে স্বাগত জানাবেন। হে খোদা, সবকিছু ঠিকভাবে সম্পন্ন হোক। যন্ত্রণা এবং রোগব্যাধি থেকে আমাকে রক্ষা করো। আমাকে দীর্ঘ জীবন দান করার জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। পৃথিবীতে একজন মানুষেরও আমি ক্ষতি করিনি। আমার বার্ধক্যে তোমার, তোমার নবী ও দরবেশদের কথা মেনে চলেছি। আগে তোমার পৃথিবীর পরিবর্তনে সাহসী হয়ে ওঠেছিলাম। এখন নামাজ আমার ব্যয়াম, সঙ্গীত আমার বিনোদন এবং হালাল খাদ্য আমার উপভোগ। আমি রসিকতা করে বলি, “কোনোকিছু একভাবে থাকে না। পৃথিবীতে সবকিছু সবসময় পরিবর্তিত হয়।”

ফাওয়াজ রসিকতায় যোগ দেয়, “ধৈর্য্য দীর্ঘজীবী হোক, আর আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। তেলের একটি নতুন খনি খনন করা হোক অথবা মরুভূমিতে অজ্ঞাত এক নদী আবিস্কৃত হোক।”

“অথবা বিপ্লব শুরু হোক,” এলওয়ান বলে ওঠে।

“বিপ্লবের অর্থ কি ধ্বংস ও বিপর্যয় বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোনো কিছু যোগ করে?” ফাওয়াজ সন্দেহ পোষণ করে। এলওয়ান বিদ্রƒপের ভঙ্গিতে বলে, “স্বাভাবিক অবস্থাকে আরও খারাপ পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।”

বিপ্লবের কিছু ওরা জানে না। ভাড়াটে গল্পকারেররা বিপ্লব সম্পর্কে ওদেরকে মিথ্যা ও অসত্য কাহিনি বলেছে। বেচারা শিক্ষক উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্নের মধ্য দিয়ে পাঠ দান করেন: ‘১৯১৯ সালের বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণগুলো কী?’ জঘন্য হারামজাদারা! শালীনতা কোনোকিছু কি তোদের মাঝে অবশিষ্ট নেই? কারারক্ষীরা নিরোর পূজারি। ওই যে এলওয়ান হাত নেড়ে চলে যাচ্ছে, তার হতাশার বোঝা ও তার প্রজন্মের বোঝা তাকে ন্যুব্জ করে ফেলেছে।

টেলিভিশন খুলে হানা বলে, ‘আমরা উৎসব উদযাপন দেখতে পারি।” সাধারণ পরিবেশ জাঁকজমকপূর্ণ ও বিপুল আনন্দের। সেনাবাহিনীর কমাণ্ডারের ইউনিফর্ম পরে ও হাতে বাদশাহ’র দণ্ড ধারণ করে প্রেসিডেন্ট এগিয়ে যাচ্ছেন, তাকে অনুসরণ করছে পদাধিকারীগণ। আজ তারই দিন। তারা আসন গ্রহণ করেন। আকাশে বিমানের প্যারেড দুর্লভ এক দৃশ্য। সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলো অতিক্রম করে। সময় অতিক্রান্ত হতে থাকে। আমি অলস ও তন্দ্রা অনুভব করতে শুরু করি। সহসা ঝাঁকুনি দিয়ে আমার তন্দ্রা ছুটে যায়। ইতিহাস ও সময় আমাকে কোণঠাসা করে ফেলে। টেলিভিশনের স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে যায় এবং অদ্ভুত এক শোরগোল ওঠে। টেলিভিশন স্ক্রিন স্থির হয়ে যায়। আমি জানতে চাই, “টেলিভিশন সেটে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?”

“টেলিভিশনের কিছু হয়নি। বুঝতে পারছি না কি ঘটলো,” ফাওয়াজ বললো।

“অদ্ভুত কোনোকিছু মনে হচ্ছে, আমি স্বস্থি বোধ করছি না,” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে হানা বললো।

“কেবল আল্লাহ জানেন, শিগগিরই আমরা সবকিছু জানতে পারবো,” ফাওয়াজ সাড়া দিলো।

আমি আমার অন্তরের গভীর থেকে বললাম, “আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।”

এলওয়ান ফাওয়াজ মুহতাশিমি

এটি আনন্দমুখর একটি উৎসব হোক এবং আমরা এক ঘন্টা বা আরও বেশি সময় আমাদের দু:খগুলো ভুলে থাকি। কিন্তু কীভাবে ও কখন দরজায় একশ’টি ফাটল সৃষ্টি হয়েছে? নীল নদ বা বৃক্ষগুলো কিসের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে চেষ্টা করছে? মনোযোগ দিয়ে শোনো। তারা বলছে: বেচারা এলওয়ান, তুমি চার দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়েছো। বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে ও অল্পস্বল্প কথা বলে, ইস্পাত ও নৈরাশ্যের দুটি স্তম্ভেও ওপর ভর দিয়ে অঘোষিত প্রেমের আড়ালে এবং অস্পষ্ট স্বপ্নে আচ্ছাদিত হয়ে রান্দা তোমার কাছে ফিরে আসছে। মার্চ মাস সামরিত তৎপরতার মাস, কারণ আজ ‘সেনা দিবস’। ক্যাফে চাপাবাজদের দ্বারা পূর্ণ। অনুষ্ঠান উপলক্ষে একটি রেডিও আনা হয়েছে, সেটি একটি টেবিলে রাখা হলো। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে মরহুম প্রেসিডেন্ট বেতার ভাষণে তার পরাজয় ঘোষণা করেছিলেন। মরহুম প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে আমি প্রথম যে কথাটি শুনেছিলাম তা হলো, তিনি তাঁর নিজের মহত্বের চেয়ে বরং তাঁর পরাজয় মহান ছিলেন। এ প্রসঙ্গে দাদাজি যা বলেছিলেন, তা মনে পড়ে: ‘আমরা এমন এক জাতি, যাদের বিজয়ের চেয়ে পরাজয় বেশি দেওয়া হয়েছে। আমরা যে অসংখ্য পরাজয় সহ্য করেছি তা থেকে সৃষ্ট হতাশার ক্ষত আমাদের মাঝে গভীরভাবে খোদিত। সেজন্য আমরা বিষাদের, বিয়োগ ব্যথার গান এবং যারা শহীদ হয়েছে সেইসব বীরদের ভালোবাসতে শিখেছি। আমাদের সকল নেতা শহীদ হয়েছেন: মোস্তফা কামাল, মুহাম্মদ ফরিদ ও সা’দ জগলুল, মোস্তফা আল-নাহাস, জামাল আবদ আল-নাসের Ñ তারা কোনো না কোনোভাবে শহীদ। এই আত্ম-তুষ্ট বিজয়ীর কথা বলতে হয়, তিনি সকল বিধি ভঙ্গ করেছেন, তাঁর বিজয় এমন এক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে, যার ফলে নতুন অনুভূতি, আবেগ সৃষ্টি হয়েছে, যার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। এজন্য আমরা তাঁকে অভিশাপ দেই এবং আমাদের হৃদয় বিদ্বেষে পূর্ণ। বিজয়ের ফল তিনি নিজে রেখে আমাদের জন্য রেখেছেন ‘ওপেন ডোর পলিসি’, যা আমাদেরকে দারিদ্র ও দুর্নীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

আমরা যখন তর্কে লিপ্ত তখন রাউডস্পিকারে বিজয় দিবসের বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করা হচ্ছিল। ক্তিু সহসা অদ্ভুত কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল। ঘোষক চিৎকার করে বলছিলেন: “বেইমানের দল ÑÑÑ বেইমান। সকল জিহ্বা আড়ষ্ট হযে গেছে, সকলেই রেডিও ঘিরে দাঁড়িয়েছে। উৎসবের ঘোষণা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল এবং গান বাজতে লাগলো। সবাই কানাঘুষা শুরু করেছে, নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে, বা হামলা হয়েছে।

কিছু সময় পর ঘোষকের কণ্ঠ আবার শোনা গেল, তিনি বললেন যে প্রেসিডেন্টের জীবনের ওপর ব্যর্থ হামলা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট চলে গেছেন এবং পরিস্থিতি নিরাপত্তার রক্ষীদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আবারও গান বাজতে লাগলো।

তাহলে এটাই সত্য। যা অনিবার্য তা চেপে রাখা যায় না। বড় জোর কালক্ষেপণ করা যায়। কারা হামলা করতে পারে ? ধর্মীয় আন্দোলনের যারা জড়িত তারা ছাড়া আর কে হতে পারে? প্রেসিডেন্ট তো সৈন্য ও রক্ষীদের মাঝ বরাবর বসে ছিলেন Ñ প্রত্যেকে কোনো না কোনো কথা বলছে। লাউডস্পিকারে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন শুরু হলো।

সহসা নতুন ঘোষণা করা হলো যে প্রেসিডেন্ট সামান্য আহত হয়েছেন, হাসপাতালে তাঁকে প্রয়োজনীয় সকল চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের মনে নতুন সম্ভাবনার ভাবনা প্রবল হলো। সময় থেমে গেছে এবং নতুন রূপ নিয়ে আসছে। লোকটি আহত, এরপর কী হবে? কারাগারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও। সন্ত্রাস যে ফিরে আসছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তিনি টিকে যাবেন এবং প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন।

গানের পর কোরআন থেকে তিলাওয়াত শুরু হলো। প্রথমে আমাদের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। তাহলে ঘটনা সত্য! লোকটির অবসান ঘটেছে। এ কথা কার বিশ্বাস হবে? অনেক সময় আমরা কেন এমন ভাবি যে অসম্ভবই আসলে সম্ভব? আমরা কেন কল্পনা করি যে, এই পৃথিবীতে মৃত্যু ছাড়াও আরেকটি বাস্তবতা আছে? মৃত্যুই প্রকৃত একনায়ক। আমরা সরকারের চূড়ান্ত বিবৃতি শুনতে পাই। ক্যাফের লোকজনের কথা আমার কানকে বিদ্ধ করতে থাকে Ñ আল্লাহ ছাড়া আর কারও ক্ষমতা বা শক্তি নেই। একমাত্র তিনিই স্থায়ী। দেশ চরম বিপদের মধ্যে। তিনি যত মন্দ কাজই করে থাকুন না কে তার এমন মৃত্যু কাম্য হতে পারে না। এর পেছনে নিশ্চয়ই বড় কোনো ষড়যন্ত্র আছে। মৃত্যু তাঁকে উন্মাদনা থেকে রক্ষা করেছে। যাহোক, তাকে তো যেতেই হতো। যারা মনে করে যে দেশ একটি মৃতদেহ ছাড়া কিছু নয়, তাদের ক্ষেত্রে এমন ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। না, এটি বিদেশি চক্রান্ত। যিনি হত্যা করেন, শেষাবধি তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। মুহূর্তের মধ্যে দস্যুদের এক সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছে।

সন্ধ্যার  মধ্যে ্আমার মনে হলো, ক্লান্তিতে আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন বোধ করছি। নানা ধরনের কথাবার্তা আমাকে নি:শেষ করে ফেলেছে। ক্যাফে থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম, প্রতিটি পথচারির মুখে মৃত্যুর ছায়া। হঠাৎ নিজেকে গুলিস্তান হানিমের ভিলার সামনে আবিস্কার করলাম। আনোয়ার আলমের গাড়ি পার্ক করা। সব ধরনের যৌন তাড়না আমার ওপর ভর করলো এবং এর সঙ্গে হত্যা করার অপ্রতিরোধ্য তাগিদ বোধ করলাম।

রান্দা সুলায়মান মুবারক

কী ভয়াবহ! হত্যাই কী এর একমাত্র উপায়? তাঁর স্ত্রী ও কন্যারা এখন কী করবে? আমি তাঁর পক্ষে নই, কিন্তু তাঁর এই পরিসমাপ্তি আশা করা যেতে পারে না। আমার নিজস্ব সমস্যার মধ্যে আমি দীর্ঘদিন যাবত এত জড়িয়ে আছি যে জনগণের সমস্যা নিয়ে কোনো ভাবনা আমাকে কম্পিত করে। হত্যা করা জঘন্য ব্যাপার এবং আল্লাহ তা পছন্দ করেন না। আমার মা খুব কাঁদছেন এবং ড্রয়িং রুম স্বাভাবিক সময়ে চেয়ে অস্বাভাবিক বিষন্নতায় আচ্ছন্ন। আমি জানতে চাই যে আমার বাবা এ সম্পর্কে কী ভাবেন। তিনি বললেন, “আমার মতামতে নিশ্চয়ই মৃত পুরুজ্জীবিত হবে না। দেশ ধর্মান্ধতায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তারা আমাদের চৌদ্দশ’ বছর পেছনে টেনে নিতে চায়। আমি জানি, তুমি আমার সঙ্গে পুরোপুরি একমত হবে না। কিন্তু আমরা নীতিগতভাবে একমত পোষণ করি যে হত্যা করা ভুল।”

আমি এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারি। আমি ভাবছি, এলওয়ান তুমি কোথায়? তুমি তাঁকে পছন্দ করতে না। তাহলে তুমি কি এভাবে তাঁর জীবনাবসানে সুখী? হঠাৎ দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার পর সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষতভাবে এলওয়ান আমাদের ফ্ল্যাটে উপস্থিত হলো। তাকে বিক্ষিপ্ত লাগছিল। ডাইনিং রুমে আমরা যখন একা, আমি জানতে চাইলাম, “ঘটনাটি যখন ঘটে তখন তুমি কোথায় ছিলে?”

“ওসব ভুলে যাও! নতুন কিছু ঘটেনি। রান্দা, আমার কথা মন দিয়ে শোনো,” সে বললো। “আজ সন্ধ্যায় আমি গুলিস্তানের ভিলার সামনে ছিলাম। সেখানে আনোয়ার আলমের গাড়ি ছিল। আমন্ত্রণ ছাড়াই আমি ভিলায় প্রবেশ করি। তাকেই প্রথম দেখতে পাই এবং তিনি আমাকে স্বাগত জানান। আমি অসচেতনভাইে চিৎকার করে বলি, “আপনি অত্যন্ত জঘন্য লোক!” আমি তার বুকে প্রচণ্ড ঘুষি মারি এবং তিনি মেঝের ওপর পড়ে যান। গুলিস্তানের আবির্ভাব ঘটে, তিনি চিৎকার করে আমাকে থামতে বলেন। আমি আনোয়ার আলমকে তুলে বেডরুমে দিয়ে আসি।

“আমি প্রায় অচেতন অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। গুলিস্তান পনেরো মিনিট পর আসেন, তার মুখ ফ্যাকাসে। তিনি বিড় বিড় করে বলে, “তুমি এক মুর্খ, কী করেছো তুমি? তুমি তাকে খুন করেছো। কেন তাকে খুন করলে।” তার চোখ অশ্রুতে ভরা। আমি চেতনা ফিরে পাওয়ার পর আমার কাজের ভয়াবহতা টের পেলাম এবং বললাম, “পুলিশ ডাকুন, এটাই আমার ভাগ্য।” তিনি নড়ছিলেন না। আমি এই পরিস্থিতির জট থেকে নিজেকে মুক্ত করার তাগিদ অনুভব করলাম এবং বললাম, “আমি নিজেই পুলিশের কাছে যাচ্ছি।” তিনি হাতে অস্পষ্ট ইশারা করে আস্তে বললেন, “যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন।” আমি বললাম, “সময় আমার প্রতিকূলে চলে গেছে, আমার স্নায়ুর ওপর বুলডোজারের মতো আঘাত করছে। আমার অপেক্ষা করার কোনো অর্থ হয় না।”

তিনি আমার চোখ এড়িয়ে অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, “অপেক্ষা করুন। তিনি দীর্ঘদিন থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন।” আমি বুঝতে পারছিলাম না যে তিনি কী ভাবছেন। প্রথমে সন্দেহ হলো, এরপর আশার মৃদু রেখা দেখা গেল, আমি বললাম, “কিন্তু আমিই কাজটি করেছি।”

“আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই,” তিনি শান্তভাবে বললেন, বোঝা গেল তার বিঘ্নিত মন নতুন করে কাজ করতে শুরু করেছে। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি অপরাধের সঙ্গীতে পরিণত হলেন। হতবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী অদ্ভুত এক নারী! আমার মাঝে ডুবন্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার লাভের  আনন্দ জাগলেও বললাম, “কিন্তু ডাক্তারের পরীক্ষায় কোনোকিছু গোপন থাকবে না।

তিনি আস্থার সঙ্গে উত্তর দিলেন, “তা নিয়ে আপনার মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই।” আমাদের দৃষ্টি যেন চক্রান্তকারীর, তিনি বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আমি কেন আপনাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছি।” আমি অবিশ্বাসে মাথা নাড়লাম। তিনি আবারও বললেন, “আমি কি আপনার কথার মর্যাদায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারি?” আমি তাকে আমার কথা দিলাম।”

এলওয়ানের কথা শেষ হলে আমি প্রশ্ন করলাম, “কিন্তু তুমি এসব গোপনীয় বিষয় আমাকে বলছো কেন?”

“আমাদের মাঝে কোনো গোপনীয়তা নেই, রান্দা।”

“আমার ওপর যা ঘটেছে, তাতে প্ররোচিত হয়ে তুমি একটি অপরাধ করেছো, তোমাকে রক্ষা করা প্রয়োজন,” আমি তিক্ততার সঙ্গে বললাম। আমি তোমাকে সম্ভবত নিন্দা করতে পারি না।”

“আসলে আমি তোমাকে পুরো সত্য বলিনি। কারণ আমি ভিলা ত্যাগ করার পর নিজের ওপর বিতৃষ্ণ হয়ে পড়েছিলাম। দ্বিধা নিয়ে এখানে এসেছি তোমার কাছে সবকিছু স্বীকার করার জন্য,” এলওয়ান বললো। আমি কখনো কোনোকিছুর জন্য অনুতাপ করবো না। আমি গুলিস্তানের কাছে গিয়ে পুরো বিষয় ব্যাখ্যা করবো।”

“আমার মনে হয় না যে তোমার তা করা উচিত,” আমি পরামর্শ দিলাম।

মুহতাশিমি জায়েদ

এলওয়ান গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে আমি সম্পূর্ণ নি:সঙ্গ হয়ে পড়েছি। চারপাশের পৃথিবীতে নতুন আশার সৃষ্টি হচ্ছে। রান্দা কতটা সাহসীতে পরিণত হয়েছে: সে শালীনতা বজায় রেখে মর্যাদার সঙ্গে আদালতে যাচ্ছে এক তরুণ ব্যক্তির পক্ষে সাক্ষ্য দিতে। বছরের পর বছর কেটে যাবে, এলওয়ান একদিন কারামুক্ত হয়ে আসবে এবং কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করবে, জীবনের সব সমস্যা সমাধানের জন্য উপযুক্ত পদে অধিষ্ঠিত হবে এবং তার আশাগুলোকে বাস্তবে রূপ দেবে। আমার মনে হয় না যে আমি তাকে আর দেখতে পাবো। সে আমার শূন্য কক্ষের অধিকার লাভ করবে এবং তার প্রেমিকাকে বিয়ে করবে। আমি কি আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবো? যদি বেঁচে থাকি, তাহলে কি নিজের অজ্ঞাতেই তার সমস্যাকে আরও জটিল করতে ভূমিকা পালন করবো?

আমার জন্য তাদের কাতারে যোগ দেওয়ার সময় এসেছে, যারা মহান আল্লাহর অনন্ত জগতে প্রবেশের আশায় নিজেদের নিবেদন করেছেন।