সূর্যের মতো উজ্জ্বল তরবারির মতো শানিত

অনিতা আমিরেজওয়ানি

মূল: অনিতা আমিরেজওয়ানি

অনুবাদ: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

[ইরানের সাফাভি রাজবংশের প্রথম পর্যায়ের ইতিহাসের আলোকে লেখা অনিতা আমিরেজওয়ানির উপন্যাস ‘ইক্যুয়াল অফ দ্যা সান’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। সাফাভি রাজবংশের (স্থায়িত্ব: ১৫০১-১৭২২) অন্যতম সম্রাট তাহমাস শাহের (১৫১৪-১৫৭৬) কন্যা শাহজাদি পারী খান খানুম ১৫৪৮ সাল থেকে ১৫৭৮ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তিনি তাঁর সৎ ভাই ইসমাইল শাহকে বিষয় প্রয়োগে হত্যা করেছিলেন বলে সমসাময়িক ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর কয়েক মাস পর পারীকে তাঁর সৎ ভাই মোহাম্মদ শাহ ও তাঁর স্ত্রী মাহদ-এ-ওলিয়া’র আদেশে হত্যা করা হয়। পারীর মৃত্যুর পর মাহদ-এ-ওলিয়া ইরানের কার্যত শাসকে পরিণত হন এবং দেড় বছর পর তিনিও নিহত হন। ]

শাহজাদি পারী খানম চৌদ্দ বছর বয়সেই তেজস্বী, উদারতার গুণসম্পন্ন হওয়ার পাশাপাশি তীরন্দাজীসহ যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেছিলেন। তিনি ইরান শাহের বিশ্বস্ত পরামর্শকে পরিণত হন। তাঁর মাঝে কবি প্রতিভাও ছিল, কথার জাদুতে তিনি সকলকে মুগ্ধ করতে পারতেন। মহান এক রাজবংশে তাঁর জন্ম, যে বংশে বহু সাহসী নারীর জন্ম হয়েছে। তাঁর দাদি তাজলু খানুম মোসেলু, তাঁর দশ বছর বয়সী পুত্র তাহমাসকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করতে ভূমিকা রেখেছেন এবং ফুফু মাহিন বানু আমৃত্যু শাহ আহমাসকে পরামর্শ দিয়েছেন। চৌদ্দ বছর বয়সে পারী তাঁর ফুফুর স্থলে পিতা তাহমাসকে পরামর্শ দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন এবং পরবর্তী চৌদ্দ বছরে পিতার মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন তাঁর সকল সৎমাকে পেছনে ফেলে। পারীর তৎপরতা তাঁর বংশের সকল নারীর ভূমিকাকে ম্লান করে দিয়েছিল, কারণ তাঁর সাহসিকতার সীমা পরিসীমা ছিল না। শাহজাদি পরীর ঘনিষ্ট ভৃত্য হিসেবে আমি শুধু তাঁর কাজকর্ম প্রত্যক্ষ করেছি, আদেশ প্রতিপালন করেছি। আমি তাঁর সকল গোপনীয়তা সংরক্ষণ করেছি, কারণ আমি জানতাম এর অন্যথা হলে আমাকে হত্যা করা হবে।

আমি যখন তাঁর কথা ভাবি, আমি শুধু তাঁর ক্ষমতা নয়, কবিতার প্রতি তাঁর আবেগের কথাও স্মরণ করি। তিনি স্বভাবসুলভ কবি ছিলেন এবং প্রিয় কবিদের উপঢৌকন প্রদানে উদার হস্ত ছিলেন। ইরানের অনন্য সাহিত্য সম্ভার তাঁর সংগ্রহে ছিল এবং প্রিয় কবিদের কবিতার দীর্ঘ অংশ আবৃত্তি করতে পারতেন। কবি ফেরদৌসির শাহনামা তাঁর প্রিয় গ্রন্থ ছিল। আমি তাঁর সেবায় নিয়োজিত থাকার সময়ে তাঁর কাছে ‘শাহনামা’র জাহাক ও বীর কাবেহ এর কাহিনি শুনে আমাদের জীবন সেই কাহিনির অংশে পরিণত হয়েছিল।

পারীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের আগে আমার সবচেয়ে ভালো পোশাক পরে, সাহসে ভর করে এক সকালে আমি তাঁর কারুকার্যখচিত দিওয়ানখানায় উপস্থিত হই। আমাকে প্রমাণ করতে হবে এই রাজবংশের ঐশ্বর্যমণ্ডিত নারীর সেবায় নিয়োজিত হওয়ার উপযুক্ততা আমার আছে কিনা। সকল প্রস্তুতি সত্ত্বেও জুতা খুলে অপেক্ষা করার সময়ে আমি ঘামছিলাম। লাল প্রান্তের সোনালি সূতার কাজ করা নীল রঙের রেশমি জামা পরিহিতা পারী চিঠি লিখছিলেন। তাঁর দীর্ঘ কালো চুল সূচিকর্মে উজ্জ্বল সাদা ওড়নায় কিছুটা আবৃত, গলায় মুক্তার মালা। বলা হয়, জন্মের সময় মানুষের কপালে লেখা থাকে তাদের ভবিষ্যৎ Ñ শাহজাদি পারীর কপালে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের কথা উৎকীর্ণ ছিল। লেখার সময় মাঝে মাঝে তাঁর ভ্রু কুঞ্চিত হচ্ছিল। লেখা শেষে কোলের ওর থেকে ডেস্ক সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরখ করলেন। আমি মাথা ঝুঁকিয়ে রাখলাম। আমার সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর পিতা আমাকে তাঁর কন্যার কাছে পাঠিয়েছেন পুরস্কার হিসেবে। কিন্তু আমাকে রাখা না রাখা শাহজাদি পরীর এখতিয়ার। আমি তাঁর জন্য কী করতে পারি তা আমাকেই প্রমাণ করতে হবে।

“তুমি আসলে কী?” তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন শাহজাদি। “তোমার পাগড়ির নিচ থেকে ঝুলছে কালো চুল, তোমার ঘাড় ভালুকের ঘাড়ের মত পুরু। তুমি খুবই সাধারণ মানুষ।”

তাঁর প্রশ্নে হতবাক হলেও আমি দ্রুত উত্তর দেই, “সাধারণ থাকার অনেব সুবিধা। উপযুক্ত পোশাকে আমি একজন দর্জি, পণ্ডিত, অথবা ইমামের মত হতে পারি। আমি সাধারণ মানুষ ও অভিজাতদের কাছে সমভাবে গ্রহণযোগ্য।”

“কিন্তু তুমি হারেমের নারীদের অশান্ত করেছো, কারণ তারা সুদর্শন পুরুষের জন্য ক্ষুধার্ত থাকে।”

আমি আল্লাহর আশ্রয় কামনা করি, ‘পানাহ বর খোদা!’ শাহজাদি কি আমার এবং খাদিজা সম্পর্কে জানতে পেরেছেন? সন্দ্বিগ্ধভাবে বলি, “এটা কোনো সমস্যা নয়, কারণ তারা যা আকাক্সক্ষা করে আমার তা নেই।”

তাঁর মুখের হাসি বিস্তৃত হয়, “যা হোক, গোপন খবর সংগ্রহে তোমার দক্ষতা সম্পর্কে আমি জেনেছি। তুমি আর কোন্ ভাষা জানো?”

আমি ফারসি ছেড়ে তুর্কি ভাষায় উত্তর দেই, “আমি আপনার পূর্বপুরুষদের ভাষায় কথা বলতে পারি।” তাঁকে সন্তুষ্ট মনে হলো, তাঁর মা তুর্কি বলতেন, পিতা ফারসিভাষী ছিলেন। উভয়েই ছিলেন ধর্মনিষ্ঠ। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আমি কবিতা পছন্দ করি কিনা তা জানতে চাইলে আমি ‘শাহনামা’র কথা বলি এবং নিজে থেকেই আবৃত্তি করি। আবৃত্তি শেষ হলে শাহজাদি পারী হাসেন এবং তাঁর সন্দেহ পোষণ করেন যে এটি ‘শাহনামা’ থেকে কিনা। আমি স্বীকার করি যে, এটি ফেরদৌসির ‘শাহনামা’র অনুকরণে নাসেরের লেখা কবিতার অংশ। আমি বিস্ময় বোধ করি যে ষাট হাজার লাইনের মহাকাব্যের কোনো অংশ থেকে উদ্ধৃতি দিলে তিনি তা বলতে পারেন। তিনি একথাও বলেন যে নিজামি আল-আরুদি আল-সমরকন্দি’র ‘চাহার মাক্ালা’ অর্থ্যাৎ ‘চার সংলাপ’ এ বলেছেন যে একজন কবির উচিত ত্রিশ হাজার লাইন কবিতা মুখস্থ করা ও বোঝা।

তিনি আমার আনুগত্যের কথা জানেন এবং আমার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইলে শৈশবেই আমার মা-বাবা হারানো থেকে শুরু করে সকল বঞ্চনার কথা বলি। আমার হারানোর আর কিছু নেই। আমি শাহজাদির কল্যাণ কামনা করি। তাঁর সেবায় আমাকে নিয়োজিত করা হলে আমি তাঁর প্রতি বা শাহের প্রতি নিবেদিত থাকবো জানতে চাইলে আমি বিব্রতবোধ করি। অন্যান্যের মত প্রথমে আমি শাহের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে বাধ্য। কিন্তু আমি “ধাপনার প্রতি” উত্তর দেওয়ায় তাঁর চোখে প্রশ্ন দেখা যায়। আমি তাঁর সন্দেহ দূর করার জন্য বলি, “আমি জানি, আপনার প্রতিটি সিদ্ধান্ত শাহ গ্রহণ করেন। আমি বহু বছর আপনার সৎ ভাই মাহমুদের অধীনে কাজ করেছি, এবং তাঁর মায়ের সেবা করেছি। এখন তিনি দরবারের কেউ নন, কিন্তু আমি আরও দায়িত্ব পালন করতে চাই।”

এটা অবশ্যই আসল কারণ ছিল না। বহু উচ্চাভিলাষী মানুষ শাহী রমণীদের সেবায় থেকে উচ্চপদে আসীন হয়েছে এবং আমি তা চাই। পারীর সেবায় থাকতে হলে আমাকে সাহসী হতে হবে। আমি মাহমুদের কাছে থাকতে দেখেছি তিনি পড়তে বা লিখতে পারতেন না। আমি তাঁকে পাঠ দেই, লিখতে শেখাই এবং আবৃত্তিতে দক্ষ করে তুলি। পারী জানেন শাহ কেন আমাকে তাঁর সেবায় ন্যস্ত করেছেন। তিনি আমার খোজা হওয়ার কাহিনি জানার আগ্রহ ব্যক্ত করলে আমি চমকে উঠি। কোথা থেকে শুরু করবো ভেবে গলা পরিস্কার করি: “আমার পিতাকে চক্রান্তকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে হত্যা করার পর আমার মা আমাকে ও আমার তিন বছর বয়সী বোনকে নিয়ে পারস্য উপসাগরের কাছে এক ছোট শহরে আত্মীয়দের কাছে যান। কেউ আমাদের কোনো সহায়তা করেনি। আমি সিদ্ধান্ত নেই যে আমি খোজা হয়ে দরবারে আমার আনুগত্যের প্রমাণ দেব। আমার বয়স তখন সতেরো বছর।”

আমি তাঁকে বলি যে কীভাবে আরও দু’জন খোজার সন্ধান পেয়ে তাদের সহায়তায় এক ব্যক্তিকে পাই যিনি কাউকে খোজা করতে পারদর্শী ছিলেন। খোজা দু’জন আমাকে একটি পাটাতনে শায়িত করে হাত বেঁধে ফেলে এবং আমার দুই পা শক্ত করে ধরে রাখে। অস্ত্রোপচারকারী আমাকে আফিম খেতে দিয়ে দুই উরুর সন্ধিস্থলে এক ধরনের পাউডার মেখে দেয়, যা আমার বেদনা উপশম করবে। তার হাতের চকচকে ধারাল ক্ষুর দেখে আমি ভীত হয়ে পড়লে আমি খোজা হতে অসম্মতি জানাই। তিনি আমাকে ছেড়ে দিলে আমি আবারও বিষয়টি নিয়ে ভাবি। কিন্তু দরবারে গিয়ে পর্যাপ্ত আয় করার আশায় এবং বিশেষ করে আমার ঘাতকদের শনাক্ত করে তাদের অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য আমি খোজা হওয়ার জন্য সম্মতি প্রদান করি।

এবার চোখ বাঁধেন, যাতে আমি ক্ষুর দেখতে নাই পাই। আমি অনুভব করি লোকটি আমার মধ্যাঙ্গ একটি সরু রশি দিয়ে বাঁধছেন এবং মুহূর্তের মধ্যে ধারাল ক্ষুর সেটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আমি ব্যথা অনুভব করছিলাম না, কিন্তু তিনি কী করেছেন তা দেখার জন্য চোখের বাঁধন খুলে ফেললাম। আমার মধ্যাঙ্গ নেই। কাজটি এত সহজ! আমি দুই খোজার সঙ্গে রসিকতা করি। সহসা এমন প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করি, যেন আমাকে দুই টুকরা করে ফেলা হয়েছে। আমি চিৎকার করি এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে জানতে পারি লোকটি ক্ষতস্থানে মলম লাগিয়ে পটি বেঁধে দিয়েছেন। ক্ষত সারতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল। আমি পানি পান করতে চাইতাম, কিন্তু বেশি প্রস্রাব করলে ক্ষত সারতে বিলম্ব হতে পারে বলে আমাকে কাপড়ে ভিজিয়ে সামান্য পানি পান করতে দেওয়া হয়েছে শুধু গলা ভেজানোর জন্য। পিপাসায় আমি মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করতাম।

পারীর কৌতুহল শেষ হয়নি। তিনি নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য জানতে চান, যেহেতু আমি পুরুষ থেকে খোজায় পরিণত হয়েছি, সেজন্য অন্য কোনো পুরুষের চেয়ে আমার উত্তর নিরপেক্ষ হবে। আমি তাঁকে বলি,  “এমন কথা প্রচলিত আছে যে, পুরুষ ক্ষমতা চায় এবং নারী চায় শান্তি। কিন্তু বাস্তবে সবাই সবকিছু চায়। কোন্টা সত্য তা আপনি ভালো জানেন। আপনি আদেশ দিন আমি কীভাবে আপনার কাজে আসতে পারি।”

শাহজাদি হাসেন, “হ্যাঁ, আমি অবশ্যই জানি। প্রাসাদের ভেতরের ও বাইরের খবর সংগ্রহ করতে পারবে আমার এমন একজনকে প্রয়োজন। তার বিশ্বাসযোগ্যতা ও আনুগত্য হতে হবে প্রশ্নাতীত, উচ্চ চেতনা ও সাহসের অধিকারী, যার ঘুম ও বিনোদনের প্রয়োজন হবে ন্যূনতম, কর্তব্যের বাইরে আমার জন্য তার কোনো আকাক্সক্ষা থাকবে না। আমার কাজের ক্ষেত্রে তাঁর নীরবতা বাধ্যতামূলক। এসব কাজের জন্য আমি পর্যাপ্ত পারিতোষিক দিতে প্রস্তুত। আমার অধীনে তুমি প্রাসাদ রাজনীতির অভ্যন্তরে থাকবে। সফল হওয়ার দৃঢ়তা থাকতে হবে তোমার। কঠিন দায়িত্ব, ব্যর্থ হলে তোমাকে চাকুরি হারাতে হবে।” তিনি আমার বেতনের দ্বিগুণ অর্থ দেবেন। আমার সন্দেহ হয়, কেনে তিনি এমন প্রস্তাব করছেন। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। প্রাসাদে বারো বছর কাজ করার পর অবশেষে আমি আমার উদ্দেশ সাধনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। পরদিন আমাকে পারীর কাজে যোগ দিতে হবে। 

শাহজাদি পারীর প্রশ্ন এবং তাঁর সৌন্দর্যের চমৎকারিত্ব আমারকে স্মরণ করিয়ে দিল যে আমি একজন পুরুষ, শুধু খোজা নই। আমি তো পুরুষই ছিলাম, অন্তত আমার নিজের চোখে। পারীর কখনও জানার কথা নয় যে হারেমে নারীদের আমি ভালোবাসতাম এবং আকাক্সক্ষা করতাম। খোজা হওয়ার আগে আমি প্রায় প্রতি রাতে ফেরেশতেহ নামে এক নারীর সঙ্গে শয়ন করতাম। আমার মা ও ও বোন জালিলেহ যখন কাজভিন শহর ত্যাগ করে সেদিন আমি প্রথম সেই নারীর সঙ্গে মিলিত হই। পথে মাঝরাতের পর আমার নতুন বন্ধু ফেরেশতেহ, যে এই ব্যবসায়ে নতুন ছিল সে আমাকে এক নির্জন কক্ষে নিয়ে যায় এবং আমি প্রথমবারের মত আমার নিজের দেহ আবিস্কার করি এবং মরুভূমিতে কোনো তৃষ্ণার্ত পথিক যেভাবে ঝরনায় মাথা ডুবিয়ে দেয় ঠিক সেভাবে আমি তার দেহে ডুবে গিয়েছিলাম। তার সৎমা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন তার পুত্রের প্রতি অনুরাগ পোষণ করার চেষ্টা করছে অভিযোগে। তাকে রক্ষা করার জন্য কেউ ছিল না। পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে আমি তার বাহুবন্ধনে থাকা ছাড়া আর কিছু চাইনি। প্রতিরাতে আমি তার সঙ্গে কাটিয়েছি। হায়, আমি আর কখনও সেই বেদনা এবং আনন্দ উপভোগ করতে পারব না।

খোজা হওয়ার পর আমি আমার একমাত্র প্রেমিকাকে খুঁজে আমার কী ঘটেছে তাকে জানাতে চেয়েছি। কিন্তু অপর এক বেশ্যা জানিয়েছে সে শহর ছেড়ে গেছে। কিন্তু আমার ঠোঁট ফেরেশতেহ’র ঠোঁট অনুভব করেছে, আমার বুক তার আলিঙ্গন কামনা করেছে। হতাশা আমাকে অভিশাপ দিয়েছে।

পারীর চাকুরিতে নিয়োজিত হওয়ার প্রথম দিন সকালে ফজর নামাজের পর আমি হারেমে তার আবাস ‘কাপু’র দিকে দিকে যাচ্ছিলাম। আমি ফটকে টোকা দেওয়ার পর এক ভৃত্য ফটক খুলে দেয় এবং আমি ভেতরে আঙিনায় প্রবেশ করি। আমাকে প্রহরা দিয়ে হারেমে পারীর অংশে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি দর্শনাথীদের সাক্ষাৎ দান করেন। পদমর্যাদা অনুযায়ী সবাই অপেক্ষা করছিলেন। “জওয়াহের, তুমি বিলম্ব করেছ। এসো কাজ শুরু করি।” আমাকে কোথায় দাঁড়াতে হবে তিনি ইশারায় দেখিয়ে দেন। পুরুষ দর্শনার্থী, যারা শাহজাদির সঙ্গে আত্মীয়তা সূত্রে জড়িত নয়, তারা একটি ঝাঁজরিকাটা কাঠের পর্দার আড়ালে দাঁড়ায়। নীল মখমলের আলখেল্লা পরিহিত এক যুবককে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। পারী তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মাজিদ, আমি আমার প্রধান খবরী (গুপ্তচর প্রধান) জওয়াহের আগাকে আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।” বংশ পরম্পরায় ইরান শাহের সেবায় নিয়োজিত শিরাজ নগরীর এক পুরোনো পরিবারের সদস্য মাজিদ উচ্চ পদ লাভের আশায় এসেছেন। তিনি শাহী দরবারের অভিজাত ও পারীর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখার দায়িত্বে ন্যস্ত। আমার পিতা যদি চক্রান্তের জন্য অভিযুক্ত ও নিহত না হতেন তাহলে মাজিদের কাছে পারী হয়তো আমার আভিজাত্য সম্পর্কে বলতেন।

নবী মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমা’র জীবনের ওপর উৎসবের প্রস্তুতিতে পারী সকালের অবশিষ্ট সময় ব্যয় করলেন। বিকেল কাটালেন প্রাসাদ রমণীদের বিভিন্ন ধরনের নিবেদন নিস্পতি করে: কোনো দরবেশের দরগাহ’র জন্য দান, আত্মীয়-স্বজনকে প্রাসাদের উচ্চপদে নিয়োগ ইত্যাদি। বিকেলে ধূলিমলিন চেহারা বিশিষ্ট দূরের খুই শহরের এক নারীর আগমণ ঘটলো, তার কোলে ঘুমন্ত শিশু। তার অভিযোগ, স্বামী তাকে তালাক দিয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে তার পিতার কাছে প্রাপ্ত বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, তিনি তার বাড়ি ফেরত পেতে চান। পারী যখন জানতে চাইলেন যে তিনি বিষয়টি তার শহরের কাজীর কাছে উত্থাপন করেননি কেন, সেই নারীর উত্তর ছিল যে, তিনি কাজীর কাছে গিয়েছিলেন, কিন্তু তারা তাকে বলেছেন যে ্বাড়ির ওপর আমার কোনো দাবী নেই। রাজধানীতে আসা ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না। সব শুনে পারী জাওয়াহের আগাকে দায়িত্ব দিলেন ওই নারীর সঙ্গে তার শহরে গিয়ে কাজীর সঙ্গে বিষয়টি ফায়সালা করতে।

বালামণি নামে হিন্দুস্থানের মালাবার থেকে আগত প্রবীণ এক খোজা আমাকে প্রাসাদের রীতি, কাকে কী সম্বোধন করতে হবে, কীভাবে প্রাসাদের খবরাখবর সংগ্রহ করতে হবে এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন। প্রতিটি খবরকে মুক্তার মত মূল্যবান ভাবতে হবে। শেখার জন্য আমি তার সেবা করতাম। তার কাছে যা শিখতাম তা শাহজাদি পারীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতাম এবং প্রাসাদের পরিচারিকা, মহলের নারী ও খোজাদের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক স্থাপনের কারণে আমি অনেক গোপন খবর সহজে পেয়ে যেতাম। একদিন পারী ও তাঁর বিশালদেহী চাচা শামকাল চেরকেস কথা বলছিলেন। পারীকে নিচু কণ্ঠে বলতে শুনলাম, “যা ঘটে সেজন্য প্রস্তুত থাকবেন।” কে তাদের পক্ষে এবং কে বিপক্ষে তারা সে সম্পর্কে কথা বলছিলেন।

কয়েকদিন পর সুযোগ পেয়ে আমি পারীকে জানালাম যে শাহের প্রথম স্ত্রী সুলতানুম তাঁর পুত্র ইসমাইলের জন্য স্ত্রীর সন্ধান করছিেেলন, যদিও তাঁর পুত্র প্রাসাদ চক্রান্তের অংশ হিসেবে কয়েদখানায় ছিলেন। সুলতানুম চান যে তাঁর পুত্র পরবর্তী শাহ হবেন। এ ব্যাপারে দরবারের অভিজাতরা বিভক্ত হলেও পারী চান যে উত্তরাধিকার নিয়ে কোনো রক্তক্ষয় না হোক। উত্তরাধিকারী হিসেবে আরেকজন ছিলেন হায়দার। জওয়াহেরের ধারণা পারী সুলায়মানের পক্ষে এবং উত্তরাধিকারী নির্বাচনে তাঁর ভূমিকা থাকবে। পারী প্রাসাদের লড়াইয়ে হেরে গেলে আমার ভাগ্যেও বিড়ম্বনা ঘটবে।

প্রাসাদে আসার পর থেকে, পারীর সেবায় নিয়োজিত হওয়ার আগে যারা আমার ঘনিষ্ট হয়েছিল আমি তাদের কাছে আমার পিতা সম্পর্কে জানতে চাই। মাহমুদের মা তাকে স্মরণ করতে পারেন না। সুলতানুম জানেন না যে আমার বাবার ভাগ্যে কী ঘটেছিল। বালামণি এবং খোজা আনোয়ার বাবার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কিছু জানতো না। দরবারে দিনপঞ্জী বা ইতিহাস লেখকদের কাছে কৌশলে জানার চেষ্টা করলে তারা আমাকে সতর্ক করেন যে আমার পর্যায়ের কোনো কর্মচারির জন্য প্রাসাদের দলিলপত্রে চোখ ফেলাও অপরাধ। তারা দরবার ও সাম্রাজ্যের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লিপিবদ্ধ করতেন। কয়েক বছর কেটে গেলেও আমি বাবার ভাগ্য সম্পর্কে কিছু জানতে সক্ষম হইনি। অতএব আমি আমার পদমর্যাদার উন্নয়নের চেষ্টা করছিলাম, যাতে আমি যে তথ্য চাই তা সংগ্রহ করতে পারি। পারীর সেবায় নিয়োজিত হওয়ার পর আমি দিনপঞ্জী লেখকদের কাছে নিজেকে শাহজাদির প্রধান ‘খবরী’ বা তথ্য সংগ্রহকারী হিসেবে পরিচয় দিলে তাদের প্রধান রাশীদ খান আমার প্রতি সামান্য মনোযোগ দেন। কিন্তু আমি তাঁকে আমার মনিব শাহজাদি পারীর সাহিত্য ও ইতিহাসে আগ্রহের কথা জানাই এবং সে কারণে আমাকে হয়তো কখনও দরবারের ইতিহাসের ওপর চোখ বুলানোর প্রয়োজন হতে পারে, এমনকি বর্তমানে তাহমাস শাহের দীর্ঘ শাসনামল সম্পর্কে জানার আগ্রহ তার হতে পারে। তিনি সম্মত হন, তবে সেজন্য পারীর লিখিত অনুমতি লাগবে। তিনি চাইলে তার কাছে পাণ্ডুলিপিও পাঠানো হবে। শাহজাদির নামে জাদুর মতো কাজ হলো।

এক রাতে বালক ভৃত্য মাসুদ আলী আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুললো। সে ফিসফিসিয়ে বললো, “শাহ ইন্তেকাল করেছেন।” তার চোখে ভীতির ছাপ। আমি বালামণিকে ডাকলাম। তাহমাস শাহ, যিনি পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে ইরান শাসন করেছেন, তিনি মারা গেছেন। এর আগে বেশ কয়েকবার তাঁকে বিষ প্রয়োগ করা হলেও তিনি রক্ষা পেয়েছেন। কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি আমাকে তাঁর কন্যার সেবায় নিয়োজিত থাকার কারণে পুরস্কৃত করেছেন এবং কন্যার জন্য প্রয়োজনে আমার জীবন কোরবানি করার শপথ উচ্চারণ করিয়েছেন।

আমি দৌড়ে উদ্যানে গেলাম। কেবল পাখির কিচিরমিচির শুরু হয়েছে। আমি ভাবছিলাম, প্রাসাদে এখন সবকিছু বদলে যাবে। নতুন শাহের ইচ্ছায় নিয়োজিত হবে উজির, নারী, খোজা ও ভৃত্য Ñ সবকিছু। পারীর কী হবে? তিনি কী তাঁর অবস্থানে থাকবেন? মৃদু আলোকিত রুমে পারীকে দেখতে পেলাম। কান্নায় তাঁর চোখ লাল এবং সহসা যেন তাঁর বয়স বেড়ে গেছে। মারিয়াম ও আজার নামে দুই মহিলা রুমাল দিয়ে তাঁর অশ্রু মুছে দিচ্ছেন। আমি সালাম দিয়ে আমার শোক জানালাম এবং বললাম যে আমি যদি তাঁর দু:খের বিষ দূর করতে পারতাম তাহলে আমি সেই বিষ হালুয়া মনে করে আনন্দে গ্রহণ করতাম। তিনি আমার শোকবাণী গ্রহণ করেন।

তিনি জানালেন যে কাল তিনি তাঁর পিতার সামান্য জ্বর দেখেছেন। হাম্মামে তিনি সহসা পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন। কিন্তু দুই পা রক্তবর্ণ ধারণ না করা পর্যন্ত তিনি গ্রাহ্য করেননি। তিনি পানিতে লাফ দেন, তার সেবায় নিয়োজিত দাসরাও তাঁর সঙ্গে পানিতে নামে। কিন্তু তাঁর পায়ের জ্বলুনি কমেনি। তিনি বিষের প্রতিক্রিয়া সন্দেহ করেছিলেন। হেকিমরা এসে মলম প্রয়োগ করেন এবং তিনি সেরে ওঠবেন বলে আশ্বাস দেন। যন্ত্রণা নিয়ে তিনি দরবারে হাজির হন, কিন্তু সন্ধ্যার মধ্যে তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। তাকে শয্যায় নেওয়া হয় এবং তিনি শাহজাদিকে তলব করেন। রাত গভীর হলে তাঁর সারা শরীর আগুনের জ্বলছিল বলে কন্যাকে জানান। কিন্দু কথা বলার সামর্থ ছিল না তাঁর। অন্য কেউ হলে চল্লিশ দিন পর্যন্ত অশ্রু বিসর্জন করতেন ও পিতার কবর জিয়ারত করতেন। কিন্তু পারীর আরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। তাঁকেই উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

ফজর নামাজের পর আমি সুলতানুমের মহলে শোক সমাবেশে উপস্থিত হলাম, যেখানে হেরেমের নারী শাহের জন্য শোক প্রকাশের জন্য সমবেত হয়েছিলেন। মরহুম তাহমাস শাহের আরও তিন স্ত্রী ডাকা চেরকেস, সুলতান-জাদেহ ও জোহরা বাজি’ও এবং শাহের আট বা ন’জন বয়স্কা কন্যা ও তাদের সন্তানরাও উপস্থিত। বেশ কিছু সংখ্যক নারী, যারা প্রাসাদে বাস করতেন, কিন্তু শাহ কখনও তাদেরকে শয্যায় নেননি, তারাও সমাবেশে এসেছেন।

শাহজাদি পারী তাঁর মা ডাকা চেরকেস এর পাশে বসেছেন। শাহজাদা হায়দারের মা সুলতান-জাদেহ শোকে তার চুল ছিঁড়তে শুরু করেন। বয়স্কা নারীরা তাকে অপছন্দ করেন, কারণ শাহ তাকে বেশি পছন্দ করতেন। পারী তাঁর মায়ের কানে কিছু বলে প্রাসাদের অভ্যন্তরে হারিয়ে যান, আমি তাঁকে অনুসরণ করি। সেখানে কমবয়স্কা নারীদের সমাবেশে গিয়ে বসলে আমি তাঁর পাশে বসে জানতে চাই যে আমি তাঁর জন্য কিছু করতে পারি কিনা। তিনি আমাকে মূল সমাবেশে গিয়ে সবকিছু লক্ষ্য করার নির্দেশ দেন। সেখানে বালামণি ছিলেন, আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়াই এবং নিচু কণ্ঠে জানতে চাই, কে উত্তরাধিকারী হচ্ছেন। তাসমাস শাহ যেহেতু উত্তরাধিকারী নিয়োগ করেননি সেজন্য এ নিয়ে ঝামেলা অনিবার্য। সে মুহূর্তেও আমার পিতার দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু, আমার মা ও বোনের আর্তনাদের কথা মনে পড়ছিল। সকলে একে একে বিদায় নিলেন। সুলতান-জাদেহ বিদায় নেওয়ার আগে পারীর কাছে তাঁর পুত্র হায়দারের পক্ষে সমর্থন কামনা করলেন। পারী তাঁকে জানালেন যে তাঁর পিতা সদ্য মৃত, এখন এ প্রসঙ্গ আলোচনার সময় নয়।

আমার মতে প্রমোদ বিলাসী হায়দার কখনও রাজকার্যে মনোযোগী ছিলেন না এবং কেউ তাকে সিংহাসনের যোগ্য বিবেচনা করে না। পারী যখন সম্পূর্ণ একা তখন আমি তাকে আমার সারাদিনের অভিজ্ঞতার কথা জানালাম। তিনি এরই মধ্যে কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে ওঠেছেন। তাঁর মা হয়তো তাকে বিয়ে দিতে চাইবেন। কিন্তু তিনি নিরাপদ জীবন চান না। মাসুদ এসে জানাল যে অভিজাতরা চল্লিশ স্তম্ভের মূল দরবার কক্ষে জড়ো হয়েছেন নতুন শাহ সম্পর্কে আলোচনার জন্য। পারী খোজা জাওয়হেরকে নির্দেশ দিলেন সেখানে যাওয়ার জন্য। কারণ পারী পুরুষদের সমাবেশে যাওয়ার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত নন। আমি খোজা বালামণির পাশে বসলাম। কে পরবর্তী শাহ হবেন তা নিয়ে সবাই কৌতুহলি ও উৎকণ্ঠিত। বিভিন্ন উপজাতীয় অভিজাত নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছেন। আমার বাবাও অনুরূপ একজন ছিলেন। মুহূর্তের জন্য কল্পনা করলাম যে আমরা দু’জন রেশমি পোশাকে মঞ্চে শাহের সিংহাসনের কাছে বসে আছি।

দরবারের শিষ্টাচার রক্ষার প্রধান সালীম খান উপস্থিত হলে গুঞ্জন থেমে গেল। রীতিমাফিক মরহুম শাহের রুহের মাগফিরাতের দোয়া উচ্চারণ করলেন কাজভিনের প্রধান ইমাম। সাফাভি বংশের এক সদস্য অভিজাতদের উদ্দেশে কথা বলবেন ঘোষণা করার পর পর্দা অপসারিত হলো এবং সামনে এগিয়ে এলেন তরুণ শাহজাদা হায়দার মির্জা। সকলকে সম্বোধন করে তিনি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর পিতার যে ইচ্ছা ছিল তা পূরণে সকলের সহায়তা কামনা করেন। মুহূর্তের জন্য তিনি পর্দার অন্তরালে গেলেন এবং সাফাভি বংশের অলঙ্কৃত তরবারি হাতে ফিরে ঘোষণা করলেন, “আমি আপনাদের নতুন শাহ এবং আপনাদের আমৃত্যু আনুগত্য দাবী করছি। যারা আমার সেবায় নিয়োজিত থাকবেন তারা পুরস্কৃত হবেন, যারা বিরোধিতা করবেন তারা যথাযথ পরিণতি ভোগ করবেন।”

অভিজাতরা ওঠে দাঁড়ালেন, কারও কণ্ঠে অবিশ্বাসের বিস্ময়ধ্বনি, অন্যেরা সমর্থনের ধ্বনি উচ্চারণ করলেন। হায়দারের মামা খাকাবেরি খান তাঁর ভাগনেকে সমর্থন করার জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে নাটকীয়তার সঙ্গে হায়দারের দাবীর পক্ষে প্রমাণ দাবী করলেন।

শাহজাদা হায়দার হাতের তরবারি সালীম খানকে দিয়ে আলখেল্লার ভেতরের পকেট থেকে গোল করে ভাঁজ করা একটি দলিল বের করে দাবী করলেন যে, এটি তাঁর পিতার ইচ্ছাপত্র। অধিকাংশ অভিজাত নিচু কণ্ঠে হলেও প্রবল অবিশ্বাস ব্যক্ত করলে হায়দার দলিলটি খুলে কণ্ঠ উঁচুতে তুলে পাঠ করলেন। এতে লেখা হয়েছে যে তাহমাস শাহ তাঁর বৈধ উত্তরাধিকারী হিসেবে শাহজাদা হায়দারকে মনোনীত করে দরবারীদের আহবান জানিয়েছে তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে। শাহী বায়তুল মালের প্রধান বয়োবৃদ্ধ মির্জা শোকরুল্লাহ দলিলটি দেখতে চাইলেন, কারণ তিনি শাহের হাতের লেখার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত। তিনি দলিলে চোখ বুলিয়ে বিস্মিত উচ্চারণ করলেন যে এটি যে শাহের লেখা তা তিনি শপথ করে বলতে পারেন। কিন্তু পারীর মামা শামকাল চেরকেস আপত্তি উঠিয়ে বললেন যে প্রাসাদে একজন নারী আছেন, যার হাতের লেখা শাহের লেখার অনুরূপ, অতএব দলিলটি তাঁর হাতে লেখানো হয়ে থাকতে পারে। শাহজাদা দলিলে যুক্ত তাঁর পিতার সিলমোহরের কথা বললে শামকাল তাতেও সন্দেহ পোষণ করেন। শাহ অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্রে সিলমোহর ব্যবহার করতেন এবং সেটি তাঁর গলায় ঝোলানো থাকতো। শাহী প্রহরীদের প্রধান মির্জা সালমান জুবেরি খানকে পাঠানো হলো যে কক্ষে শাহ মৃত্যুবরণ করেছেন সেখান থেকে সিলমোহরটি খুঁজে একটি সাদা কাগজে সিলমোহর লাগিয়ে আনার জন্য।

বালামণি আমার দিকে তাকালে আমি নিচু স্বরে বললাম যে শাহজাদা হায়দার মিথ্যাচার করছেন। শাহ যদি তাঁকে উত্তরাধিকারী করতে চাইতেন তাহলে তিনি মৃত্যুর আগেই তা ঘোষণা করতে পারতেন। বালামণি অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, তিনি বললেন, তাহমাস শাহ আগে তা করলে ঘাতকের হাতে তাঁর উত্তরাধিকারীর নিহত হওয়ার আশঙ্কা থাকতো। এখনও তাঁর ঝুঁকি আছে।

প্রহরী প্রধান মির্জা সালমান সিলমোহরযুক্ত সাদা কাগজ হাতে ফিরে এসে সেটি সালীম খানের কাছে দেন এবং সালীম খান ঘোষণা করেন শাহের ইচ্ছাপত্রে ব্যবহৃত সিলামোহরের সঙ্গে এটির কোনো পার্থক্য নেই এবং সকলকে তা দেখার জন্য বলা হয়। শাহের সিলমোহর ব্যবহারের পক্ষে আরও সাক্ষী পাওয়া গেল। তা সত্ত্বেও অভিজাতদের অনেকে নিশ্চিত যে শাহজাদা হায়দারের মা সুলতান-জাদেহ তাঁর পুত্রের পক্ষ সমর্থনের জন্য প্রাসাদের সকল পর্যায়ে পর্যাপ্ত ঘুষ দিয়েছেন। প্রত্যেকে নিজের সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত, কে ইরানের জন্য সুশাসক হতে পারেন তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। ইরানের সকল যুগের সেরা উজির নিজাম-উল-মুলক তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সিয়াসতনামা’য় লিখে গেছেন: “মৃত্যুর পর সকল শাসককে হাত বাঁধা অবস্থায় আল্লাহর সামনে নেওয়া হবে। যারা ন্যায়পরায়ণ ছিলেন তাদের হাত শৃঙ্খলমুক্ত করে বেহেশতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, অবশিষ্টদের সোজা দোজখে পাঠানো হবে এবং তাদের হাত সবসময়ের জন্য শৃঙ্খলিত থাকবে।”

আমার মনে হলো, হায়দারের চেয়ে শাহজাদা মাহমুদ উত্তম শাসক হতে পারতেন, কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা এত কম যে তিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেননি। কিন্তু পারীর সেবক হিসেবে আমাকে তাঁর পছন্দের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। হায়দার আবারও তাঁর শাসনের প্রতি সকলের সমর্থন কামনা করে অভিজাতদের মাঝে উপঢৌকন বন্টন করলেন। প্রত্যেক অভিজাতের মনোভাব কোমল অনুভূত হলো। একে একে সকল গোত্র ও উপজাতি প্রধান নতুন শাহ হায়দারের আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করলেন। উপায়ও ছিল না, উত্তরাধিকারের প্রশ্ন নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কেউ যাতে প্রাসাদের বাইরে যেতে বা ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য হায়দারের অনুগত পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রহরী মোতায়েন করা হয়েছিল। প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর সালীম খান সমাবেশের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।

হায়দারের প্রতি পারীর সমর্থন আছে কিনা জানার জন্য আমি দ্রুত তাঁর মহলে গেলে পারী জানালেন যে তাাঁর সমর্থন আদায়ের জন্য হায়দার ও তাঁর মা এসে তাঁকে হুমকি দিয়েছেন, সমর্থন না করলে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হবে। নিরুপায় হয়ে তিনি হায়দারকে শাহ হিসেবে স্বীকৃতি প্রমাণ হিসেবে তাঁর পদচুম্বন করেছেন। তিনি আমাকে নগরীতে গিয়ে জনগণের প্রতিক্রিয়া জানালেন। কিন্তু কীভাবে আমি বের হবো, প্রাসাদের সকল ফটকে তাক্কালু উপজাতির প্রহরী বসানো হয়েছে, অনুমতিপ্রাপ্তদের ছাড়া তারা কাউকে বের হতে দেবে না। কিন্তু পারী প্রহরী প্রধানকে ঘুষ দিয়েছেন, যাতে তাঁর অনুগতদের গমণাগমনে বাধা দেওয়া না হয়। আমি প্রধান বাজারে গেলাম। রাস্তা জনশূন্য, বাজার বন্ধ। আমার জীবনে কোনো বৃহস্পতিবার বাজার বন্ধ দেখিনি। আমি দ্রুত এক পুরোনো পরিত্যক্ত মিনারে চারদিকে তাকালাম। নগরী নিস্তব্ধ, শাহী প্রাসাদ শত শত তাক্কালু প্রহরী দ্বারা বেষ্টিত। কিন্তু নগরীতে হায়দারের সমর্থকরা কোথায়? তারা ইরানের তখতে নতুন শাহের অধিষ্ঠান উদযাপনে তারা রাস্তায় নেমে আসেনি কেন? ওস্তাজলু তাক্কালু উপজাতির প্রধান হোসেন বেগ ওস্তাজলু’র বাড়ি পৌঁছে দেখতে পেলাম একদল লোক তরবারি ও তীর-ধনুক হাতে তাঁর বাড়ির আঙিনায় জড়ো হয়েছে। তারা সাফাভি বংশের অনুগত কিজিলবাসী যোদ্ধা। আমি কে জানতে চাইলে আমার পরিচয় জানালাম, তারা আমাকে অর্ধ-মানব বলে রসিকতা করার চেষ্টা করলেও একজন সৈনিক আমাকে বললো যে শাহজাদা ইসমাইল তাঁর হাজার হাজার অনুগতকে নগরীতে উপস্থিত হয়েছেন বলে গুজব শোনা যাচ্ছে। হোসেন বেগ গুজবে কান দিতে রাজী নন। তিনি তাঁর উপজাতির লোকজনকে জড়ো হতে বলেছেন, যাদের নিয়ে তিনি প্রাসাদের উত্তর দিকে ফটকে যাবেন। অন্যান্য উপজাতির লোকজনও প্রাসাদ অভিমুখে রওয়ানা হলে নগরবাসী দৃশ্য দেখার জন্য বাইরে বের হয়ে এলো। হায়দার ও ইসমাইলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

প্রাসাদে ফিরে আমি শাহজাদি পারীকে জানালাম যে হোসেন বেগের নেতৃত্বে হায়দারের সৈন্যরা প্রাসাদের দিকে আসছে। তিনি বিচলিত হয়ে তাঁর চাচাকে বিষয়টি জানাতে ইচ্ছা ব্যক্ত করে সৈন্যরা হোসেন বেগের সৈন্যদের হটিয়ে দিতে পারবে কিনা জানতে চাইলে আমি ইতিবাচক উত্তর দিলাম। তিনি আমাকে হেরেমের দিকের দরজার একটি চাবি দিয়ে প্রয়োজনে হায়দারকে সেদিক দিয়ে প্রাসাদের বাইরে বের করে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে রাখতে বললেন। শামকালের বাড়িতে গিয়ে আমি তাঁকে চাবি হস্তান্তর করলাম এবং পারীর ইচ্ছার কথা জানালাম যে তিনি চেয়েছেন হায়দারের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়। তিনি ভৃত্যদের আদেশ দিলে তাঁর সমর্থকদের কাছে গিয়ে শাহজাদা ইসমাইলের পক্ষে বাহিনীকে জড়ো করতে। প্রাসাদে ফিরে আমি পারীকে বিস্তারিত জানালাম।

প্রাসাদ রক্ষীরা প্রস্তুতি নিয়েছে, ইসমাইলের সৈন্যরা উদ্যানে জড়ো হয়েছে। শামকাল এসে হায়দারের অবস্থান জানতে চাইলেন। তিনি সম্ভবত তাঁর মায়ের মহলে ছিলেন। তিনি তাঁর সৈন্যদের নিয়ে সুলতান-জাদেহ’র মহলের দিকে এগিয়ে গেলেন। হেরেমের নারীরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা তাদের শাহী মর্যাদা হারাতে চান না। হায়দারের আবির্ভাব ঘটলে শামকাল তাঁকে আশ্বাস দিলেন যে তার ভীত হওয়ার কারণ নেই। ইতোমধ্যে হায়দারের সৈন্যরা উপস্থিত হয়েছে। শামকাল দেখতে পেলেন যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠেছে। একজন হায়দারের পেটে তরবারির আঘাত করলো। তিনি ভূপাতিত হওয়ার পর শামকাল তাঁর অনুগতদের প্রাসাদের বাইরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পর আমি পারীর মহলে গিয়ে হায়দারের নিহত হওয়ার ঘটনা অবহিত করলাম। তিনি আর্তনাদ করে ওঠলেন। আমি খোজাদের আবাসে চলে এলাম। হায়দারের মৃত্যুতে আমি মনে মনে খুশি হয়েছি।

গভীর রাতে আমার ঘুম ভাঙলে আমি সুলতানুমের মহলে গিয়ে কর্তব্যরত খোজাকে একটি মুদ্রা দিয়ে শাহজাদা ইসমাইলের কৃষ্ণাঙ্গ স্ত্রী খাদিজেহ’র মহলে গেলাম। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, আমার নাকে চুম্বন করলেন। মরহুম শাহ যদি জানতে পারতেন যে তাঁর এক নারী একজন খোজাকে বাহুবন্ধনে গ্রহণ করেছেন তাহলে তিনি মর্মাহত হতেন। তিনি আমার কাছে দিনের বেলায় ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী শুনে দীর্ঘনি:শ্বাস ফেললেন। তাঁর শৈশবে তাঁকে ও তাঁর ভাই মহসীনকে আফ্রিকা উপকূল থেকে অপহরণ করে এক সাফাভি প্রতিনিধির কাছে বিক্রয় করা হয়েছিল। তাঁকে নিয়োগ করা হয়েছিল প্রাসাদের রন্ধনশালায়। তাঁর রন্ধনশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে সুলতানুম তাঁকে তাঁর মহলে নিয়োগ করেন এবং মহসীনকে নিয়োগ করা হয় শাহী আস্তাবলে।

শাহজাদি পারী এত বড় ঝুঁকি গ্রহণ করায় তিনি বিস্মিত হয়েছেন। আমি তাঁকে বলি, “এটি এক ধরনের জুয়া, পারী ইরানের ইতিহাসের গতি পাল্টে দিয়েছেন। এখন আর কোনো হায়দার শাহ নেই।” খাদিজেহ আমাকে সতর্ক করলেন যাতে পারী আমাকে সিংহের মুখে ঠেলে না দেয়। আমি তাঁকে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিলাম। এ সম্পর্ক যতদিন গোপন থাকবে ততদিন আমার দু’জন নিরাপদ। তিনি জানালেন, ইসমাইলকে শিগগির তলব করে তাঁর মাথায় মুকূট পরানো হবে। তাঁর প্রস্ফুটিত ঠোঁটের ফাঁকে আমার জিহ্বা প্রবেশ করিয়ে আমার আলখেল্লা খুলে ফেললাম এবং এরপর তাঁকে বস্ত্রমুক্ত করলাম। কে বলে যে খোজাদের দৈহিক আকাক্সক্ষা নেই! তুলনামূলকভাবে বেশি বয়সে আমি খোজা হয়েছি এবং নারীর প্রতি আমার অনুভূতি হ্রাস পায়নি। খোজা হওয়ার আগে আমার বিশেষ অঙ্গের উত্থান ও পতনের অভিজ্ঞতা আমি ভুলে যাইনি। আমি তাঁর শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোর সন্ধান করছিলাম। আমি আমার নাক তাঁর অন্ধকার সিক্ত স্থানে স্থাপন করলাম, তাঁর স্তনে চিমটি কাটলাম ও চুষলাম। আমার সকল আঙুল তাঁর দেহে সক্রিয় ছিল। আমার জিহ্বা প্রখর রৌদ্রোজ্জ্বল মরুতে ভেজা মরুদ্যানে ঘুরছিল। তিনি ভারি নি:শ্বাস নিতে শুরু করেছিলেন। এক পর্যায়ে তাঁর শরীর প্রবলভাবে কেঁপে ওঠলো।

কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়ার পর আমার শরীরের ওপর তাঁর শরীর স্থাপন করলেন। সুখের বেহেশতের দরজা আমার ঠোঁট দিয়ে খেললেন। আমার কানে জিহ্বার সুড়সুড়ি দিলেন। আমি তাঁর আবেগে সাড়া দিতে কাপণ্য করিনি। তিনি জান্তব হয়ে ওঠেছেন। আমার দুই পায়ের সংযোগস্থলে মুখ রাখলেন। আমি যে খোজা সেই চেতনা আমার মাঝে ছিল না। আমি দুই বছরের অধিক সময় যাবত তাঁর গোপন সঙ্গী। রাতের অন্ধকার থাকতে আমি আমার আবাসে চলে এলাম।

সকালে আমি পারীর মহলে উপস্থিত হলে তিনি বললেন যে প্রাসাদে দুটি মৃতদেহের অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছেন, একটি পুত্রের, যিনি তার পিতাকে হত্যা করতে পারতেন, আরেকটি তাঁর পিতার, যার সাবেক মিত্ররা তাঁর পুত্রকে হত্যা করেছে। তিনি সান্তনার বাণী খুঁজতে ‘শাহনামা’র আশ্রয় নিয়েছেন। ইসমাইল সিংহাসনে আসীন হবে, কিন্তু কতটা মূল্যে? ইসমাইল তো তাঁর পিতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাকতা করেছিল। আমি তাঁকে সান্তনা দান করি যে রক্তপাত ঠেকাতে তিনি তাঁর সাধ্যের মধ্যে সবকিছু করেছেন। তাঁর হয়ে আমার তৎপরতার জন্য তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। আমার ওপর তাঁর আস্থার কারণে আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে মাথা অবনত করে ভাবতে থাকি কীভাবে খোঁজা বাগোয়াস নির্মমভাবে প্রাচীন ইরান সাম্রাজ্য, এমনকি শক্তিশালী মিশরকে ধ্বংস করেছিল।

পারী বলেন, “ইসমাইল না আসা পর্যন্ত কোনোকিছু নিশ্চিত নয়। হতাশ অভিজাতরা বিদ্রোহীতে পরিণত হওয়ার আগে তাঁকে দ্রুত আসার জন্য আমি তাঁকে লিখেছি, তুমি এটি দ্রুত পাঠানোর ব্যবস্থা করো।” তিনি তাঁর অভ্যর্থনা কক্ষে কাঠের পর্দার এক পাশে বসে আরেক পাশে উজির মাজিদকে স্বাগত জানালেন, তিনি বললেন, “সম্মানিত শাহজাদি, দরবারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। হায়দারের সমর্থক অনেক অভিজাত জীবনের ভয়ে পালিয়ে গেছে। যারা আছেন তারা জানেন না কার কাছে তারা আনুগত্য প্রকাশ করবেন। রন্ধনশালার লোকজন পালিয়ে গেছে।” পারী নির্দেশ দিলে অবিলম্বে শাহী রন্ধনশালা চালু করতে। উজির দ্বিধা প্রকাশ করলে পারী তাঁকে বললেন, ইসমাইলকে সিংহাসনে আসীন করার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর নিকট থেকে আদেশ গ্রহণ করতে। বায়তুল মালের প্রধানকে না পাওয়া গেলে তিনি তাঁর নিজ তহবিল থেকে ব্যয় নির্বাহ করবেন।

ভিড় বেড়ে চলেছিল, পারী কি তাঁর পিতার জানাজা পরিচালনা করবেন? হায়দারের মৃতদেহ কোথায় কবরস্থ করা হবে? উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্বে যেসব অভিজাত কোনো পক্ষ নেননি, কীভাবে তিনি তাদের পক্ষ নেবেন? সংঘর্ষে নিহতদের স্ত্রী ও সন্তানদের কী হবে? বিকেলের মধ্যে পারী ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। শাহী প্রহরী প্রধান মির্জা সালমান জুবেরি শাহজাদি পারীকে সহযোগিতা দানের ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। তাঁর নিজের কোনো অভিযোগ বা অনুরোধ নেই। তিনি মির্জা সালমানকে বললেন যে ইসমাইল উপস্থিত হওয়ার আগেই সরকারি কার্যকলাপ চালু করার জন্য অভিজাতদের নিজ নিজ দায়িত্বে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে এবং একটি বৈঠকের আয়োজন করতে। কিন্তু এ ধরনের বৈঠক আহবান করতে পারেন প্রধান উজির। তাহমাস শাহ তাঁর উজিরদের নিয়ে হতাশ ছিলেন, কিন্তু নতুন উজির নিয়োগের কথা ভাবেননি। অতএব সাফাভি বংশের উচ্চপদস্থ কোনো সদস্য বৈঠক আহবান করতে পারেন। পারীর চাচা এ দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কিন্তু বায়তুল মালের প্রধান ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারেন।

মির্জা সালমানের ব্যাপারে শাহজাদি পারী এবং আমি নিজেও সন্দিহান নই। আর্থিক বিষয়ে তিনি অতীতে সততার পরিচয় দিয়েছেন। তবে তাঁর ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে বিদ্রোহের সৃষ্টি না হয় সেজন্য বৈঠক আহবান জরুরী। তিনি তাঁর চাচা শামকালের কাছে পৌছানোর জন্য আমাকে একটি বার্তা দেন, যাতে পরবর্তী দিবসের বৈঠকে তিনি নেতৃত্ব দান করেন। হায়দারের মৃত্যুর জন্য চাচা শামকাল দায়ী হলেও তাঁকে পারীর প্রয়োজন।

সাফাভি বংশের ইতিহাসে কোনো নারী প্রত্যক্ষভাবে পুরুষদের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করেননি। বৈঠক চলাকালে তিনি ভারি পর্দার আড়ালে অবস্থান নেবেন, যাতে তাঁর পক্ষে সকলের কথা শোনা সম্ভব হয়। শামকাল উপস্থিত হয়ে সকলকে অভ্যর্থনা জানান। যুদ্ধের মুখোমুখি হওয়া লোকজনকে খুব কষ্টে শাহ নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ওস্তাজলু ও তাক্কালু উপজারি সদস্যরা তিক্ত গৃহযুদ্ধ লড়েছে এবং দ্বন্দ্বের অবসান ঘটেনি। যেকোনো মূল্যে তাদের দমন করার উপায় বের করতে হবে। পারী জোরালো কণ্ঠে অভিজাতদের সম্বোধন করে প্রাসাদে এক ঘৃণ্য চক্রের তাণ্ডবের কথা বলেন, যা প্রাসাদ দখলের নামান্তর ছিল। অনেককে সন্ত্রস্ত মনে হলো। বায়তুল মালের প্রধান মির্জা শোকরুল্লাহও কম্পিত।

শাহজাদি পারী বললেন, “এই সন্ত্রাস সত্ত্বেও সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। প্রত্যেককে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। তার আগে নিশ্চিত হতে হবে যে ঘঁনার সময় কে কোথায় ছিল।” কেউ উত্তর দিলেন না। তিনি আরও বললেন, “যা ঘাঁর ঘটে গেছে, আমি ইসমাইলকে শাহ হিসেবে অধিষ্ঠিত করার পক্ষে সকলের সমর্থন কামনা করছি।” অনেকে সমর্থন করলেন, অনেকে সমর্থন না করে হাত নেড়ে তাদের আপত্তি জানালেন। পারী আশ্বাস দিলেন, যারা ভুল করে হায়দারের পক্ষ নিয়েছিলেন তাদের ক্ষমা করা হবে। কিন্তু আপত্তি উত্থাপনকারীদের মধ্য থেকে ইসমাইলে উপস্থিতির দাবী জোরালো হয়ে ওঠলো যে তাঁর উচিত দরবারে এসে তাঁর উত্তরাধিকার দাবী করা।

পারীর কণ্ঠ দৃঢ় হয়ে ওঠেছে, “আপনাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে আমি কে। ক’দিন আগেও আমি আমার পিতার কানের মত ছিলাম। আমি আমার বংশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারব না বলে মনে করবেন না। প্রত্যেকে যার যার দায়িত্বে ফিরে যান। নতুন শাহের আগমণের সময়ের মধ্যে আমি সকল বিশৃঙ্খলা ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান দেখতে চাই।” শামকাল অভিজাতদের সমাবেশ সমাপ্তির ঘোষণা করলেন। আমরা কাজ শুরু করলাম।

আমি ভাবছিলাম, শাহজাদি পারী যদি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তাহলে কি তিনি স্বামীর অধীনস্থ থাকবেন। তাঁর মা তাঁকে বুঝিয়েছেন, কিন্তু তিনি সম্মত হননি। সাম্রাজ্যের জন্য তিনি কিছু করতে চান, নারীর অনুভূতি তা বিঘ্নিত করবে। তাঁর ফুফু মাহীন বানু তাহমাস শাহে বিজ্ঞ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর পরামর্শে তাহমাস ইরানে আশ্রয় নেওয়া মোগল বাদশাহ হুমায়ুনকে সৈন্য সরবরাহ করেছেন। বিনিময়ে হুমায়ুন কান্দাহার জয় করে ইরানের কাছে সমর্পণ করেছেন। ভাগ্যে যা আছে তাই ঘটবে, কিন্তুু তিনি আপাতত বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে অটল।

সেই সন্ধ্যায় আমি আমার বোন জালিলেহ’র চিঠি পেলাম, তার বয়স এখন চৌদ্দ বছর। সে মায়ের সঙ্গে ইরানের দক্ষিণ প্রান্তে সাগরের তীরে এক ছোট শহরে বাস করছে। সে আমার কাছে কোনো কাজে নিয়োজিত হওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়েছে। আমি যদি সত্যিই ওর জন্য কিছু করতে পারতাম। শাহজাদি পারীকে বলবো যাতে তিনি জালিলেহ’র জন্য কিছু করেন। আমি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে উত্তর লিখলাম। সন্ধ্যা নেমে আসার আগে আমি নগরী ঘুরে পরিস্থিতি যাচাই করতে বের হলাম। এক পানশালায় গেলাম, যেখানে স্থানীয় লোকজন ছাড়াও দূরের বণিকরা আসেন। নগরীতে ঘাতকরা ছড়িয়ে পড়েছে। পরদিনের দরবার নগরী ও দেশের অন্যত্র শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বলপ্রয়োগ করার বিষয়ে আলোচনা করলো। অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে শান্তি আনয়ণ করা সম্ভব। শাহের একান্ত বাহিনীর প্রধান খলিল খান আফসার একমত পোষণ করলেন।

পারী দ্রুত অভিজ্ঞতা অর্জন করছিলেন। বায়তুল মালের প্রধান মির্জা শোকরুল্লাহ পারীর আদেশ মানতে রাজী নন, কারণ তিনি শাহ নন। পারী তাঁকে তিরস্কার করে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, নতুন শাহ অধিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করবেন এবং সকলকে তাঁর আদেশ পালন করতে হবে। সকলে শান্ত হলেন। আমি আশা করছিলাম ইসমাইল দ্রুত রাজধানীতে উপস্থিত হোক। আমি তাঁর ওপর পারীর নিয়ন্ত্রণ আশা করি।

আমি রাশীদ খানে সঙ্গে কথা বলার জন্য শাহী মহাজেখানায় গেলাম, যেখানে দিনপঞ্জী ও সাফাভি বংশের ইতিহাস লেখকরা কাজ করেন। তিনি ছিলেন না। তাঁর সহকারী আবতীন আগার কাছে ‘তাহমাস শাহের গৌরবময় শাসনে ইতিহাস’ দেখতে চাইলাম এবং এজন্য পারীর আগ্রহের কথা জানালে তিনি পারীর অনুমোদন পত্র দেখলেন, যা কয়েকদিন আগে তিনি পাঠিয়েছেন। পারীর সঙ্গে কথা বলার সময় আমার বাবার প্রসঙ্গ তুলতে চেয়েও আমি পারিনি। আবতিন জানতে চান যে আমি ইতিহাসের ঠিক কোন্ বিষয়টি জানতে চাই। তাহলে তিনি আমাকে সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠাাগুলো দেখতে পারেন। আমি তাঁর হাতে একটি মুদ্রা গুঁজে দিয়ে বলি যে তাহমাস শাহকে যারা সেবা করেছেন তাদের নেতৃস্থানীয়য়ের সম্পর্কে পড়তে চাই। তিনি আমাকে পরদিন আসতে বললেন, পৃষ্ঠাগুলো তিনি বেছে রাখবেন। আবতিনে মত লোকেরা নিজেদের গুরুত্ব প্রমাণের জন্য এভাবে প্রত্যেককে অপেক্ষায় রাখেন।

পরদিন আবতিনের জন্য আরেকটি উপহার নিয়ে হাজির হলাম। তিনি পৃষ্ঠাগুলো আমার সামনে রাখলেন। শাহের চাকুরিতে নিয়োজিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী সংকলন। শাহ কাউকে পুরস্কার ও পদবীতে ভূষিত করেছেন, ধর্মদ্রোহের কারণে কাউকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। অপরাধে দন্ডিতদের কীভাবে অবমাননা করা হয়েছে Ñ এসব কাহিনি আমার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করছিল। আমার পিতার মত পরিণতি ঘটেছে বহু মানুষের। আমি নিশ্চিত নই আমার পিতা এই তালিকায় লিপিবদ্ধ হওয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন কিনা। এরপর বুকের মধ্যে আমার হৃদপিণ্ড থেমে যাওয়ার উপক্রম হলো:

মোহাম্মদ আমীর শিরাজি: কাজভিনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিশ বছর শাহের চাকুরিতে ছিলেন এবং তার অন্যতম  হিসাবরক্ষক হিসেবে উন্নীত হন। তাঁর অনেক সহকর্মী তাঁর নির্ভুল হিসাবরক্ষণের কাজ ও দরবারের কাজে দ্রুত হিসাব সরবরাহের দক্ষতার জন্য তাঁকে প্রশংসা করতেন। বিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে তিনি আরও উচ্চপদে উন্নীত হওয়ার আশা পোষণ করতেন বলে মনে হয়। কিন্তু এক পর্যায়ে শাহের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য তিনি অভিযুক্ত হন এবং তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। পরে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। শাহ তাঁর বিশ্ব-উজ্জ্বলকারী ক্ষমাশীলতার কারণে তার অভিযোগকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেননি, কিন্তু এটিও সম্ভব হতে পারে যে অভিযোগকারীর ক্ষমতাবান মিত্র থাকার ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি তাকে চটাতে চাননি। একমাত্র আল্লাহই সকল বিষয় নিশ্চিতভাবে জানেন।

ইতিহাসবিদ অভিযোগকারী দরবারীর নাম কেন উল্লেখ করেননি? তিনি কোন্ পদে ছিলেন যে শাহ তাকে শাস্তি দেননি। আমি সাহসী হয়ে আবতিনকে প্রশ্ন করলাম, “কে এই দরবারী?” তার উত্তর ছিল, যেহেতু লেখা নেই অতএব তিনি জানেন না। নিচু পদের কারও জন্য এত যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন পড়ে না। আমি জোর দিয়ে জানতে চাই। তিনি আমাকে সতর্ক থাকতে বলেন।

ইসমাইল যখন তাঁর পিতা ও ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শোনেন তখন তাকে কারাগার থেকে বের হতে দেওয়া হয়নি। খবর সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং পারীকে জানান যে তিনি কাহকালেহ’র থেকে রওয়ানা হচ্ছেন। কিন্তু ইসমাইলের মা সুলতানুম জানিয়েছেন স্থানীয় অভিজাতদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তিনি কিছুদিন সেখানে অবস্থান করবেন। সেখান থেকে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের মাজার জিয়ারত করতে আরদাবিল যাবেন। রাজধানীতে কবে পৌছবেন নিশ্চিত না হতে পেরে শাহজাদি পারী প্রশাসনের পুরো দায়িত্ব সামাল দিতে শুরু করলেন। সবকিছু শান্ত হয়ে আসতে শুরু করেছে। আমরা স্থির হতে পারছিলাম না। হায়দারের মৃত্যুতে তাঁর মা সুলতান-জাদেহ ক্ষুব্ধ হয়ে ইসমাইলের বিরোধিতাকারীদের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তুলতে চেষ্টা করছিলেন। কিছু অভিজাত তাহমাস শাহের পঞ্চম পুত্র মোস্তফা মির্জাকে সমর্থন জানাতে প্রস্তুত ছিল।

শাহজাদি পারী ইসমাইলের বিলম্বে অস্থির হয়ে ওঠলেও অভিজাতদের সন্তুষ্ট রাখতে তাঁর চেষ্টা ছাড়েননি। আমরা দু’জন একটি চিঠি তৈরি করেছিলাম, তিনি সেটি দরবারে পাঠ করলেন, যেন সেটি ইসমাইল প্রেরণ করেছেন: “আমার প্রাণপ্রিয় বোন, বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে আমি কাজভিনে আসছি। তোমাকে কর্তৃত্ব দান করছি আমি না আসা পর্যন্ত শাসনকাজ পরিচালনা করার জন্য। আমার বিরোধিতাকারীদের আল্লাহর নির্দেশিত উপায়ে শাস্তি বিধানে পিছপা হয়ো না।” তাঁর কণ্ঠে কর্তৃত্বের সুর। তিনি শাহী কোষাগারের হিসাব দাবী করলেন। পরদিনই তা পেশ করতে হবে।

অবশেষে গ্রীস্মেও শুরুতে শাহজাদা ইসমাইল কাজভিনের উপকণ্ঠে পৌঁছে শিবির স্থাপন করলেন এবং রাজধানীরতে প্রবেশ করার শুভ মুহূর্তের জন্য জৌাতিষীদের বাণীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। ইতোমধ্যে পারী সাম্রাজ্যের শৃঙ্খলা পুন:প্রতিষ্ঠিত করেছেন, নগরীতে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়েছে, ব্যবসায়ীরা দোকানপাট খুলেছেন এবং প্রাসাদ বিদ্রোহের আশঙ্কা দূর হয়েছে। তিনি নিশ্চিত করেছেন যে ইসমাইলের আগমণের সকল বাধা অপসারিত হয়েছে। জেšতিষীরা পনেরো দিন পর শুভ সময়ের বার্তা দেওয়ার পর তিনি কাজভিনের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। আমাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন। পারী নিজেও চমৎকার সাজে নিজেকে সাজানোর জন্য উপযুক্ত পোশাক ও অলঙ্কার বাছাই করেছেন।

পরদিন সকালে সুদর্শন আরবীয় ঘোড়ার পিঠে ইসমাইল কাজভিনে প্রবেশ করলেন। নগরবাসী রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে স্বাগত জানাচ্ছেন। ইসমাইল প্রথমে রুমলুর নেতা খোলাফা’র বাড়িতে উঠলেন। হায়দারকে হত্যা করার ক্ষেত্রে খোলাফা’র ভূমিকা ছিল এবং ইসমাইলের কাছে তিনি পুরস্কৃত হবেন বলে আশা করছেন। জেšতিষীরা পুনরায় শুভক্ষণের ইঙ্গিত দিলে তিনি প্রাসাদে যাবেন। খোলাফা’র বাড়িতে তিনি দর্শনার্থীদের সাক্ষাৎ দিচ্ছিলেন। অভিজাত ও প্রাসাদের পদাধিকারীরা তাদের আনুগত্য জানাতে আসছিলেন। পারীও এলেন, আমি শাহজাদির সঙ্গে ছিলাম। তাঁকে নিয়ে আমি ইর্ষান্বিত। আমার বোন জালিলেহ আসবে, বহু বছর পর তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হবে। সমবেত নারীদের পারী শুভেচ্ছা জানালেন। অনুচর পরিবৃত হয়ে ইসমাইল প্রবেশ করলেন। মাঝারি গড়নের ইসমাইলের চোখে মুখে আস্থা। তাঁর বয়স আটত্রিশ বছর হলে পঞ্চাশ বছর বয়সীদের মত মনে হয়। তাহমাস শাহের স্ত্রীদের শুভেচ্ছা জানানোর পর বোন পারীর প্রতি মনোযোগী হলেন ইসমাইল। বললেন, “আমি তোমাকে ছোট্টটি দেখেছি। সবকিছু বদলে গেছে। পথে আমি শুধু তোমার সাহসী কার্যকলাপ সম্পর্কে শুনেছি। তোমার সুখ্যাতি তোমার বয়সকে অতিক্রম করেছে। তোমার কাছে আমার অনেককিছু শেখার রয়েছে।” তিনি তাঁকে উপঢৌকন প্রদান করলেন।

কয়েকদিন অতিবাহিত হলো। পারী সকালে দরবার অনুষ্ঠান করছেন, কিন্তু হঠাৎ কিছু ব্যতিক্রম দেখা দিল। তার চাচা বার্তা পাঠিয়েছেন তিনি অসুস্থ, মির্জা শোকরুল্লাহ অনুপস্থিত। মির্জা সালমান জানালেন যে তাকে প্রধান উজির করা হয়েছে। পারী এবং আমি বিস্মিত যে পারী সালমান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেওয়া সত্ত্বেও ইসমাইল তাকে পছন্দ করেছেন। একদিন খুই এলাকার যে মহিলা তার বাড়ি ফিরে পাওয়ার জন্য সহায়তা কামনা করেছিলেন, তিনি পারীকে চিঠিতে জানিয়েছেন যে আজারবাইজান প্রদেশে বিদ্রোহের কথা শোনা যাচ্ছে, তারা অটোম্যানদের সঙ্গে যোগ দিতে চায়। আজারবাইজানিরা সৈন্য সংগ্রহ করছে। পারী নতুন প্রধান উজির সালমানকে খবর পাঠালেন বিদ্রোহ দমনের জন্য তহবিল সংস্থান করতে। কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে ইসমাইলের সঙ্গে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত নিলেন। অটোম্যানদের সঙ্গে তাহমাস শাহের শান্তি চুক্তি বিশ বছর স্থায়ী ছিল। পারী ভয় করছেন যে চুক্তি ভেঙে যাবে। আমি পারীকে পরামর্শ দিলাম ভাইয়ের বীরত্বের প্রশংসা করে একটি কবিতা লিখে তাঁর কাছে পাঠাতে। তিনি দীর্ঘ একটি কবিতা রচনা করলেন। আমি পাঠ করে সন্তুষ্ট হলাম। পরদিন তার সঙ্গে খোলাফা’র বাসভবনে গেলাম, কিন্তু ইসমাইল বোনকে সাক্ষাৎ দিতে দীর্ঘ সময় নিলেন এবং অভ্যর্থনা কক্ষে আসার পর পারী তাকে কবিতাটি দিলেন। তিনি রুদ্ধশাসে কবিতা পাঠ করে মা সুলতান-জাদেহ’কে দিলেন সেটি জোরে পাঠ করার জন্য এবং তিনি চমৎকৃত হলেন। শাহজাদা ইসমাইলও একসময় ‘অ্যাডেলি’ ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন, যে নামের অর্থ ‘ন্যায়বান’।

পারী সাম্রাজ্যের বিষয় নিয়ে আলোচনার অবতারণা করে প্রাদেশিক গভর্নরদের পদ পূরণের জন্য নাম সুপারিশ করতে চাইলে ইসমাইল বলেন যে প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব ব্যক্তির নাম সুপারিশ করেন এবং তিনি কাকে বিশ্বাস করবেন তা স্থির করতে পারছেন না। পারী তাঁকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন। ইসমাইল তাঁর বোনকে জানান যে বেশ ক’টি হত্যা চক্রান্ত ব্যর্থ করে মুহূর্তের সিদ্ধান্তে পরিকল্পনা বদলাতে হয়েছে বলে তাঁর কাজভিনে পৌঁছতে বিলম্ব হয়েছে। শাহ হিসেবে তাঁর অভিষেক না হওয়া পর্যন্ত তিনি নিরাপদ বোধ করতে পারছেন না। জ্যোতিষীদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী সপ্তাহে অভিষেকের দিনক্ষণ স্থির করা হয়েছে। পারী তাঁকে বলেন যে তিনি প্রতিদিন সকালে দরবার অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন, যাতে ইসমাইলের মনে সন্দেহের সৃষ্টি না হয় যে তিনি ভাইয়ের অজ্ঞাতে কিছু করছেন।

সবকিছু সত্ত্বেও শাহজাদি পারীর মনে হয় তিনি যে ভাইয়ের আগমণের জন্য এত উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করেছেন, সেই ভাই অচেনা মানুষের মত কথা বলছে। আমি পারীকে বললাম, “মনে হয় তিনি আপনাকে ভয় করছেন। তিনি দ্বিধায় ভুগছেন, আর আপনি যুক্তির সূর্যের মত অবস্থান নিয়েছেন।”

“এর অর্থ হচ্ছে, তাঁর কাছে আমাকে প্রমাণ করতে হবে যে আমার উদ্দেশ্যগুলো তাঁর প্রতি আনুগত্যের কারণে।” অভিষেক হওয়ার পরও কিছুদিন পর্যন্ত ইসমাইল অতি ঘনিষ্ট উপদেষ্টা ছাড়া আর কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন না। ঘোষণাটি পারীর কাছে আঘাতের মত ছিল, ইসমাইল কীভাবে তাঁর আপন বোনকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে? কেউ তাঁর নামে ভাইয়ের কাছে কিছু রটনা করেছে?

পরদিন সকালে আমি একটি রৌপ্যমুদ্রা ভর্তি একটি ছোট থলে নিয়ে পারীর চাচা শামকাল চেরকেস এর বাড়ি গিয়ে তাঁর এক খোজাকে মুদ্রার থলেটি দিয়ে জানতে চাইলাম শামকাল অসুস্থ ছিলেন কিনা। সে জানালো শামকাল প্রতিদিন ইসমাইলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। ফিরে এসে পারীকে জানালাম। পারী অনুশোচনা করার পাত্রী নন, তবে তিনি বিস্মিত হলেন যে কীভাবে তাঁর চাচা তাঁর সঙ্গে বেইমানি করতে পারেন।

অভিষেকের দিন ধার্য হয়েছে বছরের সবচেয়ে উত্তপ্ত মাসে। অভিষেকের দিন প্রাসাদ, উদ্যানহ আশপাশের এলাকা সুসজ্জিত। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই তাদের পদমর্যাদা অনুযায়ী আসন গ্রহণ করেছেন। শাহী দামামা ইসমাইলের আগমণ ঘোষণা করলে সকলে ওঠে দাঁড়ালেন। ঘোড়ার পিঠ থেকে অবতরণ করে শাহ চল্লিশ স্তম্ভের দরবার কক্ষে এসে মঞ্চের ওপর স্থাপিত মনিমুক্তা-খচিত সিংহাসনে উপবেশন করার পর ঘোষক সাফাভি রাজবংশের ইতিহাস, তাদের কীর্তি, শিয়া মতবাদকে ইরানের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণাসহ বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরার পর একজন ইসমাইলের সামনে মুকূট নিয়ে এলেন এবং তিনি পাগড়ি খুলে নিজেই মুকূট ধারণ করলেন। প্রাপ্তবয়স্ক কোনো শাহকে কেউ মুকূট পরিয়ে দিতে পারে না, কারণ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া তাঁর ওপর কর্তৃত্ব করার কেউ নেই। ঘোষক উপস্থিত সকলকে দ্বিতীয় ইসমাইল শাহ’র (তাঁর দাদা ছিলেন প্রথম ইসমাইল শাহ) আনুগত্যের শপথ নেওয়ার আহবান জানালেন। এই শপথ আইনগত চুক্তির মত, যার লঙ্ঘনের শাস্তি মৃত্যু। একে একে সকলে আনুগত্যের নির্দশন হিসেবে শাহের পদচুম্বন করলেন।

অটোম্যান সাম্রাজ্যের সম্রাট তৃতীয় মুরাদ, হিন্দুস্থানের মোগল সম্রাট আকবর, চীনের মিং রাজবংশের ঝু ইজুন, উজবেক শাসক আবদুল্লাহ খান, স্পেনের দ্বিতীয় ফিলিপ, ইংল্যাণ্ডের প্রথম এলিজাবেথ এর রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিরা শাহকে অভিনন্দন জানিয়ে তাদের শাসকের পক্ষে থেকে বাণী পাঠ ও মূল্যবান উপহার সামগ্রী প্রদান করলেন। অভিষেকের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও প্রাসাদে সান্ধ্য ভোজ এবং সঙ্গীত ও নৃত্যানুষ্ঠান ছিল, যা আমি প্রাসাদে আমার বারো বছরের কর্মজীবনে দেখিনি। আমি চাকুরিতে নিয়োজিত হওয়ার অনেক আগে তাহমাস শাহ ধার্মিকুার দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং সাফাভি দরবার থেকে সঙ্গীত শিল্পী ও নর্তকিদের বিদায় করেন।

অভিষেকের পর শাহ ইসমাইল হেরেমের নারীদের নিয়ে কাজভিন থেকে সামান্য দূরে অবসর কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। খাদিজেহ এবং ইসমাইল শাহ আরবীয় ঘোড়ায় পাশাপাশি ছিলেন। দুপুরে ইসমাইল পারীকে আহবান করলেন তাঁর সঙ্গে তীর ছোঁড়ার জন্য এবং পারী তীরন্দাজিতে ভাইয়ের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করলেন। কিন্তু শাহী দরবারে দক্ষতার চেয়ে বেশি মূল্যবান শাহের ঘনিষ্ট থাকা।

তাহমাস শাহের শাসনামলে যারা তাঁর আনুকূল্য বঞ্চিত হয়ে রাজধানী ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন ইসমাইলের অভিষেকের পর তারা কাজভিনে ফিরে আসতে শুরু করলেন। তাদের একজন ছিলেন লালু নামে এক রাজ-জ্যোতিষী, যিনি আমাকে লিখেছেন যে তিনি আমার পিতাকে জানতেন। এক বিকেলে আমি আমি নগরীর দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত তার বাড়িতে গেলাম। আমি লালুর বাড়ি খুঁজে  পেলাম। তিনি আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। তাঁর একটি ভবিষ্যদ্বাণী শাহকে ক্ষুব্ধ করেছিল এবং শাহ তাকে বিতাড়ন করেছিলেন। আমি তার কাছে আমার পিতার কথা জানতে চাই, তাঁকে অপরাধের অভিযোগ থেকে মুক্ত করা আমার দায়িত্ব। তিনি জানান, “তোমার পিতা ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাকে হত্যা করার কারণ তিনি বায়তুল মাল থেকে অর্থ সরিয়েছিলেন।”

“তা হতে পারে না। আমাদের যথেষ্ট অর্থবিত্ত ছিল। আমার পিতা সাধারণ চোর হতে পারেন না।”

“তিনি তা ছিলেন না, তিনি নিজের জন্য অর্থ নেননি একথা সত্য, কিন্তু বিদ্রোহের জন্য তহবিল সংস্থান করেছিলেন।”

আমি জোর দিয়ে বলি যে আমার পিতা শাহের অনুগত ছিলেন। কিন্তু লালু বলেন যে অনেক সময় অনুগত মানুষও বিদ্রোহী হয়ে ওঠতে পারেন। কী করে আমার বাবা বিদ্রোহী হতে পারেন? আমাকে আবারও তাহমাস শাহের শাসনামলের ইতিহাসের পাতা পাঠ করতে হবে।

ক’দিন পর এক সন্ধ্যায় পারী আমাকে তলব করলেন তাঁর গুরুত্বপূর্ণ একটি চিঠি বিশেষ বাহকের মাধ্যমে যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। পারীর পরামর্শক মাজীদও এসেছেন। তিনি ভীত, তার কণ্ঠ কম্পিত। তিনি জানান যে সন্ধ্যায় তিনি তার বাড়িতে গেলে একদল সৈন্য তাকে নিজ বাড়িতে প্রবেশ করতে দেয়নি, বরং জানিয়েছে বাড়িটি শাহের আদেশে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। পারী তাকে বাড়ি ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নতুন কোনো বাড়িতে বসবাসের জন্য অর্থ দান করেন। আমি ইসমাইলের স্ত্রী খাদিজেহ’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, যার কাছে ইসমাইলের মনে কী আছে তা জানা সম্ভব হতে পারে। পারী সম্মত হন এবং মাজীদের অবর্তমানে আমাকে তাঁর পরামর্শকের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন। আমি তাঁকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।

তাহমাস শাহ তাঁর প্রিয় নারীদের যে ভবনগুলোতে রাখতেন খাদিজেহ সেগুলোর একটি ওঠেছেন। পারী আমাকে পাঠিয়েছেন এক খোজাকে জানানোর পর তিনি আমাকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। খাদিজেহ আমাকে স্বাগত জানালেন। আমি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে কথা বলতে এসেছি শুনে তিনি তাঁর প্রধান সেবিকা নাসরিন খাতুনকে কক্ষের দূরবর্তী কোণায় চলে যেতে বললেন, যেখান থেকে তিনি আমাদের দেখতে পাবেন, কিন্তু আমাদের কথা শুনতে পারবেন না। মাজীদের বাড়ি দখল করে নেওয়া সম্পর্কে তিনি ইসমাইল শাহের কাছে কিছু শুনেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি অজ্ঞতা প্রকাশ করেন। পারী সম্পর্কে ইসমাইলের মন্তব্য জানতে পারি যে পারী নিজেকে একজন শাহ বলে মনে করেন, যা তিনি পছন্দ করতে পারেননি। তাঁর ক্ষোভের প্রধান কারণ হলো তাঁর পিতার তাঁর যৌবনকালকে ধ্বংস করেছেন। পারীর বিরুদ্ধে কি ইসমাইল কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন?

খাদিজেহ আমাকে জানান যে খুই এ যে বিদ্রোহ সূচিত হয়েছিল তা দমন করতে শাহের অগোচরে সেখানে একদল সৈন্য পাঠিয়েছিলেন, যা শাহকে অত্যন্ত ক্রদ্ধ করেছে। শাহ জানেন না কে পাঠিয়েছিলেন। পারী আমাকে তাঁর প্রধান পরামর্শক নিয়োগ করেছেন, তিনি শাহের বিরাগভাজন হলে আমার কাজ বিপজ্জনক হয়ে ওঠবে। খাদিজেহ’র কাছে বিদায় নিয়ে আমি পারীর মহলে এসে আমার পক্ষে কেন তাঁর প্রধান পরামর্শক হওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব নয় তা বলার পর তাঁকে বললাম, “শাহজাদি, দরবারের ষড়যন্ত্রের জাল ইরানি গালিচার নকশার মতই জটিল। একজন উজির ও একজন সেনাপতির সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মত হওয়া উচিত, তা না হলে তাদের সবকিছু হারাতে হবে। আমার দৃষ্টিতে সর্বোত্তম প্রস্তাবের ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস ও আস্থা।”

“আমাদের মধ্যে স্বামী কে?” পারী প্রশ্ন করেন। আমি উত্তর দেই, “অবশ্যই আপনি।” তিনি হাসলেন, “আমার ক্ষেত্রে এাঁই প্রযোজ্য। সেক্ষেত্রে আমাকে পাগড়ি ধারণ করতে হবে, মুদ্রা ব্যয় করতে হবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তুমি কী করবে?”

“আমি আপনাকে উপযুক্ত পরামর্শ দেব এবং ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখবো। আমি জানতে পেরেছি যে আমাদের উত্তর সীমান্তে সৈন্যদের সহায়তার জন্য অর্থ প্রেরণের খবর ইসমাইল পেয়েছেন এবং অত্যন্ত ত্রুদ্ধ হয়েছেন।”

পারীর চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। রুমাল দিয়ে তিনি মুখ মুছলেন, মুখে বললেন, “তুমি আমাকে জানাওনি কেন? জওয়াহের, তুমি জানো, প্রাসাদের সর্বত্র গুপ্তচর রয়েছে। কাউকে বিশ্বাস করার ব্যাপারে আমাকে সতর্ক থাকতে হয়।”

“আমি তা জানি বলেই আপনার আস্থা কামনা করছি। প্রয়োজনে আপনার জন্য জীবন দেব। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে না পারলে আমি আপনার প্রধান পরামর্শক না হয়ে শুধু আপনার সেবক হয়ে থাকব। আপনি অনুমতি দিলে আমি বলতে পারি যে, শাহের ওপর জয়ী হতে হলে আপনার আবেগ-অনুভূতিকে খাঁচাবদ্ধ করে রাখতে হবে।”

পারী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেছেন, “কিন্তু সাম্রাজ্যের জন্য ইসমাইল কিছুই করেননি। আমার মরহুম পিতার কঠোর পরিশ্রমে গড়া ইরানের ধ্বংস কীভাবে আমার পক্ষে দেখা সম্ভব? আমার পক্ষে কীভাবে খুই এর জনগণকে বিদ্রোহী হয়ে ওাা দেখা সম্ভব? কী করতে হবে তা আমি তাঁর চেয়ে ভালো জানি। কোনটি সঠিক আমি আর শাহকে তা বলতে চাই না। আমি আমার নিজস্ব উপায়ে শাসন করব।” আমার মনে হলো, দুর্ঘটনাবশত বোতলের মুখ খুলে যাওয়ায়  একটি ক্রুদ্ধ জ্বিন বের হয়ে এসেছে।

আমি তাঁকে পরামর্শ দিলাম যে তিনি যদি শাসনের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে চান তাহলে তাহলে তাঁকে সতর্কতার সঙ্গে একজন সাহসী, বিশ্বস্ত শরীক খুঁজে বের করতে হবে। শাহ তাঁর ভুল ধরে তাঁকে শাস্তি প্রদানের জন্য ওৎ পেতে আছেন। পারী মনে করেন না যে তিনি কোনো ভুল করেছেন। তবে আমাকে তাঁর পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত রাখবেন বলে জানালেন। কিন্তু সবসময় আমার পরামর্শ গ্রহণ করবেন না তা স্পষ্ট।

পরদিন আমরা জানতে পারলাম যে ইসমাইল শাহ দুটি বিয়ে করেছেন — একজন ওস্তাজলু উপজাতির, যা প্রমাণ করে যে তিনি সমগ্র উপজাতিকে ক্ষমা করে অভিজাতদের স্বাগত জানিয়েছেন। অপরজন শামকাল চেরকেসের কন্যা কোদেনেত চেরকেস। পারী রাগান্বিত হয়ে তাঁর মামাকে তলব করলে তিনি সন্ধ্যার পর চোরের মত লুকিয়ে আসেন। পারী আমাকে আড়াল থেকে সবকিছু লক্ষ্য করার নির্দেশ দেন। পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর পারী ইসমাইল শাহের সঙ্গে শামকালের কন্যার বিয়ে, তাঁর সঙ্গে শামকালের প্রতিদিন সাক্ষাৎ করার ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, “শাহ আপনাকে আনুকূল্য দেখাচ্ছেন, অন্যদিকে আমাকে সাজা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কেন? আমরা সবাই কি একই রক্তের নই?” পারীর কণ্ঠ তীক্ষ্ম হয়ে ওঠলো, “প্রিয় মামা, আপনি জানেন যে একজন শাহ একই রক্তের কারও কন্যাকে বিয়ে করতে পারেন না, যদি না সেই ব্যক্তি সাম্রাজ্য বা রাজবংশের জন্য মহান কোনো কর্ম সম্পাদন করে অথবা তা করার প্রতিশ্রুতি দেয়।”

নীরবতা বিরাজ করছিল, শামকালের কপাল ঘেমে ওঠেছে। পারী আরও বলেন যে কেউ তাঁর ব্যাপারে শাহের অন্তর বিষিয়েছে। শামকালের সাম্প্রতিক সাফল্য দেখে পারীর সন্দেহ না করার কোনো কারণ ছিল না যে এজন্য তাঁর মামাই দায়ী। এই পর্যায়ে শামকাল হেসে ওঠেন এবং বলেন যে পারী স্বয়ং তাঁর নিজের সমস্যা সৃষ্টির জন্য দায়ী। পারী মামার যুক্তি দাবী করলে তিনি বলেন যে বিদ্রোহ দমনে পারীর সিদ্ধান্ত সঠিক হলেও বোকার মত কাজ করেছেন। তিনি জানতে চান, “তুমি ইসমাইলের জন্য কী করেছো? হায়দারকে যখন কেউ চায়নি তখন তুমি তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছো। অন্যেরা তাকে হত্যা করে ইসমাইলের শাহ হওয়ার পথ সুগম করেছে।”

“আমি যা করেছি তা ইসমাইলের কথা অনুযায়ী করেছি। আপনি শুধু আপনার নিজের সাফল্যের কথা ভেবেছেন। অথচ আমি আপনাকে আমার মিত্র ভেবেছি।”

“আমি সবসময় তোমার মিত্র। তুমি আমার প্রিয় বোনের কন্যা এবং তোমার মত নারী ইরানে নেই। কিন্তু তোমার শাসন করার আকাংখা তোমার বিপদ ডেকে আনবে। ইসমাইল মনে করেন না যে তোমার কাছে তিনি কোনোভাবে ঋণী। তিনি তোমার ক্ষমতায় সন্দ্বিগ্ধ। তুমি তাঁর সামনে নত না হলে কোথাও তোমার স্থান হবে না।” শামকাল বিদায় নিলেন।

পারীর সঙ্গে আলোচনা করে স্থির করলাম, ইসমাইলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো করতে হবে। আমরা একটি  চিঠি লিখলাম যাতে পারী তাঁর পক্ষ থেকে বাড়াবাড়ি হয়ে থাকলে ক্ষমা করার জন্য এবং তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের অনুরোধ জানালেন। কয়েকদিন পর শাহ পারীকে তলব করলেন। প্রথমেই সাক্ষাৎ হলো ইসমাইলের মা সুলতানুমের সঙ্গে। শাহ তাঁর আসনে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। আমি আড়ালে চলে গেলাম। পারী বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “প্রিয় ভাই, আপনি হয়তো জানেন না যে আমি আপনার পক্ষে কী কী করেছি। আমি মামাকে হেরেমের চাবি দিয়েছি যাতে তাঁর সৈন্যরা হায়দারের সমর্থকদের পরাজিত করতে পারে।” শাহ পারী অবদান স্বীকার করেন। কিন্তু খুই এর বিদ্রোহে সেনাবাহিনীকে অর্থ সরবরাহের জন্য তাঁকে দায়ী করেন। পারী অভিযোগ অস্বীকার করেন না। শাহকে ক্রদ্ধ মনে হচ্ছিল। “আমরা পাশাপাশি দুটি সরকার চালাতে পারি না। আমাদের পিতা, যিনি তোমাকে এত ভালোবাসতেন, তিনিও এই অনুমতি দিতেন না।” পারী পিতার প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও ইসমাইলকে কারামুক্ত করার জন্য কোনো ভূমিকা না রাখায় তিনি পারীকে দোষারূপ করেন। এ ব্যাপারে পিতার সামনে যে তিনি অসহায় ছিলেন ইসমাইল তা মানতে রাজি নন। তিনি প্রায় নিশ্চিতভাবেই বললেন যে পারীর নিজের উচ্চাভিলাষ ছিল ইরান শাসন করার।

ক্রুদ্ধ ইসমাইল বললেন, “এখন আমি ইরানের শাহ। তুমি নিজে থেকে সাম্রাজ্যের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। এর অন্যথা হলে অবাধ্যতা ও আনুগত্যহীনতার কাজ বলে বিবেচিত হবে।” 

কথা না বাড়িয়ে পারী তাঁর আসন থেকে ওঠে ইসমাইলের সামনে অবনত হয়ে তাঁর পদচুম্বন করে বললেন, “আপনার জন্য আমি অনেক কিছু করতে পারি। সর্বোত্তম আঞ্চলিক শাসকদের ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারি, আপনার অনুপস্থিতিতে যেসব খান তাদের মর্জি অনুযায়ী কাজ করেছে, তাদের কর্মকাণ্ডের হিসাব যাচাই করতে আপনাকে সহায়তা করতে পারি।”

ইসমাইল তাঁর বোনের জন্য উপযুক্ত স্বামীর সন্ধান করার প্রস্তাব দিলে পারী শীতল কণ্ঠে তাঁকে জানালেন যে তিনি একাকী থাকতেই পছন্দ করবেন এবং পিতার আরাধ্য কাজে নিবেদিত থাকবেন। আমরা ইসমাইলের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। পারীর ভেতর আগুন এমন টগবগ করছিল যেন কেউ কাছে থাকলে আগুন তাকে গ্রাস করবে। প্রাসাদ উদ্যানে পৌঁছার পর পারী মুখ খুললেন, “শাহী মুকূট দাবী করার কী সাধ্য তাঁর ছিল। যার যোগ্যতা বেশি এটি তার প্রাপ্য। সেটি কে তার আমরা স্থির করব।”

এই যোগ্যতা স্বয়ং শাহজাদি পারীর। চেঙ্গিস খান তাঁর সাম্রাজ্যের কোণায় কোণায় তাঁর কন্যাদের সিংহাসনে আসীন করেছিলেন, যেখানে তারা পিতার নামে শাসন করেছেন। কিজিলবাসীদের পূর্বপুরুষরা তাদের নারীদের আরও স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তাদের যাযাবর জীবনের কারণে। সেইসব ঐতিহ্য কবরস্থ হওয়ার সাথে আমাদের নারীরাও মর্যাদাহীন হয়েছে। আমি তাঁর হৃদয়ের কথা বুঝতে পারি এবং তাঁকে সান্তনা দেই। তিনি আমার হাতের ওপর হাত রেখে বলেন, “আমি পিতার কাছে কৃতজ্ঞ যে তিনি তোমার মত বিচক্ষণ একজনকে আমার জন্য প্রেরণ করেছিলেন। আমি কখনও কল্পনা করতে পারিনি যে একজন খোজার সঙ্গে আমি এতটা আন্তরিকতা অনুভব করব।”

আমার হৃদয়ে একটি কোমল কুঁড়ি ফুটে ওঠেছে, শিগগির আমার বুকে পাঁপড়িগুলো ছড়িয়ে পড়বে।

সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে হেরেমেও পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। ইসমাইল শাহের নতুন স্ত্রীরা শাহের মা সুলতানুমের পরই তাদের এখতিয়ার নিশ্চিত করার চেষ্টা করছিলেন। পারী তাঁর মরহুম পিতার চালু করা রীতি অনুসরণ করায় তাঁকে নিরপেক্ষ অবস্থানে রাখা হয়েছিল। পিতার উপদেষ্টাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি করার সক্রিয় প্রচেষ্টা ছিল। তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে যে তাঁর ভাইয়ের শাসনামল কত দীর্ঘ হয়। আমি পারীকে পরামর্শ দিলাম তাঁর মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য, যাতে তারা প্রয়োজনের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসেন। এতে আমার নিজের স্বার্থও জড়িত ছিল। পারী যখন শাহের আনুকূল্য থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হবেন তাঁর পরামর্শক হিসেবে আমারও ভাগ্যের বিপর্যয় ঘটবে।

এসময়ে পারী সাম্রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা অভিজাত ও দরবারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন চিঠি বিনিময়ের মাধ্যমে। তিনি তাঁর বোন গওহরের সাহায্য কামনা করেন, যিনি ইব্রাহিম মির্জাকে বিয়ে করেছিলেন। ইব্রাহিম যদিও হায়দারের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, ইসমাইল শাহ তাঁকে প্রতিদিন স্বাগত জানাচ্ছিলেন। ইব্রাহিম চেষ্টা করছিলেন মির্জা শোকরুল্লাহকে প্রধান উজির নিয়োগের জন্য শাহকে নমনীয় করতে। পারীর সঙ্গে আমি একমত হলাম যে বেইমান শোকরুল্লাহ প্রধান উজির হলে তিনি পারীর জন্য প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবেন এবং সাম্রাজ্যের ক্ষতি সাধন করবেন। শাহের উচিত এমন একজন ব্যক্তি, যিনি তাঁর দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে ভূমিকা রাখবেন। সেজন্য পারী চান যে আপাতত মির্জা সালমানকে প্রধান উজির পদে থাকুক। এরই মধ্যে সালমান পারীকে বার্তা পাঠালেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতে পারী মির্জা সালমানের প্রতি তাঁর সমর্থনের কথা জানানোর পর তিনি ইতোমধ্যে সাম্রাজ্যে সৃষ্ট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সম্পর্কে বললেন।

পারীর প্রতি শাহের আনুকূল্য হ্রাস পাওয়ায় তাঁর মহলে এখন আর লোকজন ভিড় করে না। আমি তাঁর সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর সুযোগ পাই, তাঁকে চিঠি লিখতে সহায়তা করি এবং সম্ভাব্য কৌশল নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা করি। অনেক সময় শীতের রাতে আমরা কম্বলের নিচে পা দিয়ে কবিতা আবৃত্তি করি। আমি তাঁকে আমার বোন জাীরলেহ’র চিঠি দেখাই। তিনি তা পাঠ করে মুগ্ধ হন। তাকে হেরেমের কোনো নিয়োগ করার জন্য অনুরোধ জানাই, যাতে আমার প্রিয় বোন আমার কাছে থাকতে পারে। শাহের আনুকূল্য ফিরে আসা পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে বলেন। আমি আশায় বুক বাঁধি।

ইসমাইল রাজধানীতে ফিরে আসার পর আমার পক্ষে রাতের বেলায় গোপনে খাদিজেহ’র উষ্ণ শয্যায় গমণ করা সম্ভব না হলেও তাঁর প্রতি আমার আকাক্সক্ষা হ্রাস পায়নি। পুরোনো স্মৃতি জেগে ওঠায় আমি সাহসী হয়ে উঠি। তাঁর মহলে যাওয়ার পথে এক নারীকে অতিক্রম করার সময় আমার সাবেক প্রেমিকা ফেরেশতেহ’র কথা মনে পড়ে। খাজিদেহ আমাকে স্বাগত জানান, “জওয়াহের আগা, তোমার আগমণ আমাকে সুখী করে।” আমার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়। তিনি তাঁর প্রধান সেবিকা নাসরীনকে কক্ষ ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। খাদিজেহ তাঁর দু:খ প্রকাশ করলেন যে ইসমাইল শাহ দু’জন নতুন স্ত্রী পাওয়ার পর তাঁর সন্তান ধারণের সম্ভাবনা হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া ইতোমধ্যে শাহের সঙ্গে সাময়িক বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ মাহাস্তি নামে এক দাসী গর্ভধারণ করায় সে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে।

পারী সম্পর্কে শাহ কিছু বলেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন যে ইসমাইল পারীর প্রসঙ্গ না তুললেও তিনি সবসময় ভয়ের মধ্যে থাকেন যে কেউ তাঁকে সিংহাসনচ্যূত, এমনকি হত্যা করার চেষ্টা করবে। এই ভীতি তাঁকে কারাগারেও সন্ত্রস্ত রাখতো, যা তিনি কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করি যে, সাম্রাজ্যে এখন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, দস্যুরা পথচারিদের লুণ্ঠণ করছে না, এমনকি অস্থিরচিত্তের কিজিলবাসীরাও এখন বিদ্রোহ করতে সাহসী হবে না।

মির্জা সালমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমি তাঁকে জানাই যে ইব্রাহিমের ভাই হোসেন কর্তৃক নিজের মর্জিমত কান্দাহার শাসন করায় শাহজাদি পারী উদ্বিগ্ন ছিলেন যে তিনি পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে উজবেকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিদ্রোহ ঘটাতে পারতেন। হোসেন এখন মৃত, ইব্রাহিমের প্রতি শাহের সহানুভূতিশীল হওয়ার কোনো কারণ না থাকায় পারী আশা করছেন যে তিনি যাতে ইব্রাহিমকে সহায়তা করেন। তিনি আমার প্রশংসা করেন। আমি তাঁকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহের আশ্বাস প্রদান করি যে আমার পিতার ভাগ্য বিপর্যয়ের পর থেকে আমি সবসময় তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার ইচ্ছা পোষণ করে আসছি। মির্জা সালমান যখন স্বীকার করলেন যে আমার পিতার কথা তাঁর মনে আছে, যিনি ভালো মানুষ ও সিংহাসনের প্রতি অনুগত ছিলেন। তাঁর কথায় আমি ঘামতে শুরু করেছি, হৃদস্পন্দন দ্রুততর হয়েছে, মনে ভিড় করেছে বহু প্রশ্ন। কিন্তু আমি আমার অনুভূতি গোপন করলাম। তবুও জানতে চাইলাম, তাঁর ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য কে দায়ী। তিনি তা জানেন না।

আমি দরবারের ইতিহাস সম্পর্কে তাঁকে মিথ্যা বলি যে সেখানে শুধু উল্লেখ রয়েছে যে একজন হিসাবরক্ষক তাঁকে হত্যা করেছেন। “আপনি নিশ্চয়ই জানবেন যে ওই ব্যক্তিটি কে ছিল। আমি আপনার স্মৃতিশক্তির প্রশংসা শুনেছি।” মির্জা সালমান এক মুহূর্ত ভাবলেন, “সাধারণ একটা নাম ÑÑ ইস্ফাহানি? কিরমানি? ÑÑÑ হ্যাঁ, মনে পড়েছে, আমার যদি ভুল না হয়, তাহলে লোকটির নাম কোফরানি এবং নামের প্রথম অংশ কামিয়ার।”

শেষ পর্যন্ত আমি ঘাতকের নামটি পেয়েছি।  কামিয়ার কোফরানি। কুৎসিত নাম, এবং সে নিশ্চয়ই তার নামের মতই গঘন্য দর্শন ছিল। কিন্তু তাহমাস শাহের চাকুরি ছাড়ার কয়েক বছর পর লোকটির মৃত্যু হয়েছে। সালমান জানতে চান যে লোকটি বেঁচে থাকলে আমি প্রতিশোধ গ্রহণ করতাম কিনা, আমি তাঁকে বললাম যে আমি তাকে হত্যা করতাম। লোকটি যদি ভুল করে আমার পিতাকে হত্যা করত, তাহলে আমি শুধু তার পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলতাম। মির্জা সালমান আমার পিতার অপরাধ নিশ্চিত করেছেন। সেক্ষেত্রে আমি তাঁর নির্দোষিতা প্রমাণ করার জন্য যুক্তি দেখাতে পারি না, ঘাতকের ওপর প্রতিশোধও নিতে পারি না।

শাহের এক দাসীর গর্ভপাত হওয়ায় আমার মনে হয়েছিল খাদেজেহ’র কাছে মাহাস্তি নামে যে উপপত্নীর গর্ভধারণের কথা শুনেছিলাম তিনি হতে পারেন। কিন্তু এটি অপর এক দাসী। বালামণি এ ঘটনাায় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছেন। তাঁর মায়ের মৃত্যুর কথা মনে পড়েছে, তখন বালামণির বয়স ছিল মাত্র চার বছর। কিছু বোঝার মত বয়স হয়নি তার, কিন্তু এখন তার মনে হয় সন্তান প্রসবের সময় তিনি মারা গেছেন। আমি বালামণিকে আমার পিতার ঘাতকের নাম বললে তিনি সন্দেহ পোষণ করেন যে মির্জা সুলতান সত্য বলেছেন কিনা। কারণ তিনি কামিয়ার কোফরানিকে ভালো মানুষ বলে জানতেন। তার তিন পুত্রের একজন মারা গেছে, অপর দু’জন শিরাজে সরকারি কাজে নিয়োজিত। তাদের স্ত্রী সন্তান আছে।

আমি ক্রদ্ধ ও ইর্ষা বোধ করি। আমি তাদের সর্বণাশ চাই। বালামণি আমাকে সান্তনা দেন।

প্রতি বৃহস্পতিবার একদল সুফি সমবেত হয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় ঘূর্ণির মত নৃত্য করেন, যাকে বলা হয় ‘সামা’। আমি মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে শামিল হতাম। আমার পিতার ঘাতক সম্পর্কে জানার পর আমি ‘সামা’য় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখানে গেলাম। আমি সূফি নৃত্য দেখছিলাম, কিন্তু আমি অস্থিরতায় ভুগছি। আমার পিতার আত্মা ন্যায়বিচারের জন্য কাঁদছে। পরিবারের সম্মান পুনরুদ্ধার না দেখে আমার মা মারা গেছেন। আমার বোন মা-বাবা ও ভাইয়ের ভালোবাসা বঞ্চিত হয়ে বড় হয়েছে। আমার কখনও কোনো পরিবার হবে না। আমি কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি? আমি কি আমার পিতাকে হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করতে সক্ষম হবো না? সূফি নৃত্য কি আমাকে যাতনা মুক্ত করতে পারবে?

আমি পারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কথা শুরু করার পর তাঁর মা এসে জানালেন যে পারীকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন শিস্তানের বদি আল-জামান। কেউ তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে, তার এক বছর বয়স্ক শিশুপুত্রকে গলা টিপে মারা হয়েছে। পারী সন্দেহ প্রকাশ করলেন যে এটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হতে পারে। কিজিলবাসীরা এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। তারা শিস্তানে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আরেকটি বিদ্রোহের পূর্বাভাস বলে মনে হলো। পারী আমাকে নির্দেশ দেন ইব্রাহিম ও গরহর এর অবস্থা জানার জন্য। আমি তাদের বাসভবনে গেলে সৈন্যরা আমাকে প্রবেশের অনুমতি না দিয়ে জানালো যে ইব্রাহিমকে গৃহবন্দী করা হয়েছে।

পারীর মহলে ফিরে আসতেই বিলাপের শব্দ কানে এলো। পারীর ভাই সোলায়মান নিহত। তাঁর দুই কিশোর সৎ ভাই ইমামকুলি মির্জা ও আহমদ মির্জাকে তাদের শয্যায় নিহত পাওয়া গেছে। ইসমাইল শাহ কিজিলবাসীদের নির্দেশ দিয়েছেন তার অনুগত নয় এমন অভিজাতদের হত্যা করতে। আমার ভয় হলো তারা তাহমাস শাহের উপপত্নীর পুত্র মাহমুদকেও হত্যা করবে। তাকে সতর্ক করা প্রয়োজন। পারী নিজেকে দোষারূপ করছে আগে সতর্ক না হওয়ার জন্য এবং ইসমাইলের মা সুলতানুমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলেন।

সুলতানুমকে পারী গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “পাঁচজন শাহজাকে হত্যা করা হয়েছে, একজন গৃহবন্দী, অন্যদের ভাগ্য অস্পষ্ট। আপনার পুত্র কি পুরো রাজবংশকে ধ্বংস করতে চায়?”

“তাঁর হৃদয়ে কী আছে তা যদি আমি জানতে পারতাম! শাহজাদাদের মৃত্যুর ঘটনা জানার পর আমি বিকেলে তাঁর কাছে তার সামনে হাঁটু গেড়ে অনুনয় করেছি আমার পুত্র খোদাবান্দেহ ও তার পাঁচ সন্তানকে রক্ষা করতে। ইসমাইল বলেছে, সর্বত্র বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে এবং সে বিদ্রোহীদের নির্মূল করবে। তবে সে মোহাম্মদ ও তার সন্তানদের রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু কাজভিন থেকে তাদের দূরে অবস্থান করতে হবে।”

পারী তাহমাস শাহের বোনদের ভাগ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে সুলতানুম তাকে আশ্বস্ত করেন যে ইসমাইল কোনো নারীর ক্ষতি করবে বলে তিনি মনে করেন না, কারণ তারা সিংহাসনের দাবীদার নন। সুলতানুম তার ভূমিকা পালন না করায় পারী তিরস্কারের সঙ্গে কথা বলে ক্ষুব্ধভাবে বিদায় নিলেন। সুলতানুম নিজেও পারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক শব্দ উচ্চারণ করলেন যে পারী যদি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে তাকেও তার মাথা হারাতে হতে পারে।

পারী জীবিত শাহজাদাদের কাছে অবিলম্বে সতর্ক বার্তা পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। তিনি সারারাত চিঠি লিখলেন। ফজরের আজানের সময় তাঁর লেখা বন্ধ হলো। মৃত্যু সবসময় কদর্য, পরিবারের সদস্য হারানো আরও ভয়াবহ।

আমি সকালে আরেকবার ইব্রাহিমের বাসভবনে গিয়ে দেখতে পেলাম প্রহরীদের প্রত্যাহার করা হয়েছে। গওহরের এক ভৃত্য দরজা খুলে দিল। আঙিনায় জ্বালানো আগুনের পাশে গওহর বসে ছিলেন। তাঁর চোখ অশ্রুতে ভরা, আমাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন, “সকালে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।” আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। হঠাৎ হেসে ওঠলেন গওহর, আগুনে পুড়িয়ে ফেলছেন সকল দলিল, মূল্যবান গ্রন্থ। তাঁকে অপ্রকৃতিস্থ মনে হলো। আমি দৌড়ে পারীর কাছে এসে ঘটনা জানালাম এবং বেশ ক’জন খোজা ও একজন নারী হেকিমকে নিয়ে গেলাম, যাতে তারা গওহরের ঘুমের ব্যবস্থা করতে পারেন।

এ পরিস্থিতির মধ্যে মির্জা সালমান আমাকে তলব করে জানালেন যে শামকাল চেরকেসকে ইব্রাহিমের স্থলে নিয়োগ করা হয়েছে। পারী তাঁর মামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জীবিত শাহজাদাদের রক্ষা করার জন্য তাঁর সহায়তা কামনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে গোপনে যেতে হবে। ধরা পড়লে মৃত্যু অনিবার্য। প্রাসাদের গোপন এক দরজা দিয়ে আমরা বের হলাম, যে দরজার অস্তিত্ব আমার জানা ছিল না। শামকালের বাড়িতে পৌছে আমরা প্রহরীদের কাছে তার বোন পরিচয় দেওয়ার পর তারা প্রবেশের অনুমতি দিল। পারী কথা বলার আগে শামকাল আমাদের চিনতে পারেননি। তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন যাতে কেউ পারীকে শনাক্ত করতে না পারে। তিনি তাঁকে বললেন যে ইসমাইলের নির্দেশে শাহজাদাদের হত্যা করা হয়েছে।

শামকাল হত্যার যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করেন, “তারা ইসমাইলের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। কোনো আদেশ শাহের পক্ষ থেকে জারি করা হলে তা অন্যায় নয়। সাম্রাজ্যের প্রশাসন নিয়ে অভিজাতরাও সন্তুষ্ট নয়। ইসমাইলের গুপ্তচরেরা সর্বত্র ঘুরছে, কেউ নি:শ্বাস নিলেও ইসমাইল শাহের কানে পৌঁছবে।”

পারী বলেন, “ইসমাইলকে কারারুদ্ধ করতে আমাদের পিতার সিদ্ধান্ত যথার্থ ছিল। তিনি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি। মামা, আপনার কী হয়েছে। এ কোন্ কলুষিত পথে আপনি বাঁচতে চান? আপনি কিছু না করলে আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও এই অরাজকতার অবসান ঘটাতে চেষ্টা করবো।”

আমরা নিরাপদে প্রাসাদে ফিরে এলাম।

প্রসাদে কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। সর্বত্র গুমোট অবস্থা। এ পরিস্থিতির কি অবসান ঘটেছে? এর পর কে? আমার মায়ের জ্ঞাতি বোন জানতে চেয়েছেন কখন তিনি আমার বোন জালিলেহ’কে কাজভিন পাঠাবেন। পারী আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন। কিন্তু আমি আমার বোনকে প্রাসাদ রাজনীতির জটিলতার মধ্যে আনার ঝুঁকি নিতে চাই না। অতএব আমি তাকে জানাই যে কাজভিনের পরিস্থিতি নিরাপদ নয়। শোকের দিনগুলো অতিবাহিত হওয়ার পর পারী আমাকে তলব করলেন। আমি তাঁকে ‘শাহনামা’র পৃষ্ঠায় মগ্ন দেখতে পেলাম। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি মুখ তুলে বললেন, “শাহনামা’র চরিত্র জাহাক সকল যুবকের মাথা কাঠবাদামের মত ভাঙতে বলেছিলেন, যাতে তার সাপেরা তাদের মস্তিস্ক আহার করতে পারে। আমরাও একই ধরণের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছি। আমাদের শাহ দরবারের উজ্জ্বলতম তারকাগুলোকে ধ্বংস করেছে। ইব্রাহিমের মত সূর্য বহু প্রজন্মে এশবারই জন্মগ্রহণ করে।” তিনি দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলেন।

শাহজাদি পারী আমার আনুগত্য ও সহযোগিতা কামনা করলেন এবং নিচু কণ্ঠে বললেন, “তাঁকে অপসারণ করতে হবে।” আমার হৃদপিণ্ড ঢাকের মত বাজছে। তিনি আমার কাছে যা চাইছেন আমার পক্ষে কীভাবে তাতে সম্মত হওয়া সম্ভব? একজন বোনের পক্ষ নিয়ে তার ভাই ও শাসকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার অর্থ মৃত্যুকে আমন্ত্রণ করা। আমরা এখনও ‘শাহনামা’র চরিত্র কাবেহ এর মত কিছু করতে পারিনি, কারণ আমাদের শাহ কবিতার কোনো চরিত্র নয়। তার শাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করলে তিনি আমাদের সোজা হত্যা করবেন। পারী আমাকে পরখ করছেন, “জওয়াহের, এই সাম্রাজ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?”

“আমি এই রাজবংশের জন্য আমার জীবন বাজি রেখেছি। আমি এই বংশের মর্যাদা রক্ষা করতে না পারলে ভৃত্য হিসেবে আমার অবস্থান কোথায় থাকে?”

তিনি আমাকে নিশ্চিত করেন যে, ন্যায়ের কারণ ছাড়া অন্য কোনো কারণে তাঁর সহায়তার প্রয়োজন নেই। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কিছু করতে চাইলে আমি তাকে সহায়তা করতে অস্বীকার করতাম। ইসমাইল যে দানব হয়ে উঠেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা তাকে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যেতে দিতে পারি না। তাঁকে বাঁিচয়ে রাখলে তিনি আমাদের সকলকে হত্যা করবেন।

পারীর অনুরোধ আমাকে অস্থির করে তুলেছে। শাহজাদা মাহমুদের ভাগ্যে কী ঘটেছে আমরা তা জানি না। খাদিজেহ হয়তো জানাতে পারবেন যে শাহের হত্যাযজ্ঞ সমাপ্ত হয়েছে কিনা। আমি তাঁর মহলে গিয়ে তাকে কালো শোকবস্ত্র পরিহিতা দেখতে পাই। তার ভাই মোহসীনকে মৃত পাওয়া গেছে। আমি তাকে শোক জানানোর পর জানতে চাই শাহ হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার ব্যাপারে তাকে কিছু বলেছেন কিনা। কিন্তু তিনি আমার কথায় চমকে ওঠায় আমার মনে হয় এ প্রসঙ্গ হুট করে তোলা ঠিক হয়নি। তবুও আমরা কথা বলি। খাদিজেহ’র বিশ্বাস তার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে শাহজাদা মাহমুদকে সহায়তা করার জন্য। আমার মনে হলো কোনো লোহার হাত আমার হৃদপিণ্ডকে চেপে ধরেছে।

তিনি আমাকে ঘটনার বিস্তারিত জানালেন। মোহসীন এক শিকার অভিযানে মাহমুদের সঙ্গে ছিলেন। শাহের লোকজন তাদের সন্ধান পেয়ে তাদের ওপর হামলা করে। মোহসীনের এক বন্ধু পালাতে সক্ষম হয় এবং সে জানিয়েছে যে মাহমুদকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা হয় এবং মোহসীনকে হত্যা করা হয় ছুরিকাঘাতে। তাদের মৃতদেহ মাহমুদের বাড়িতে নেওয়া হলে মাহমুদ গোঙানি দিয়ে জেগে ওঠেন। তিনি মারা যাননি। আমি স্বস্থি বোধ করলাম। খাদিজেহ’র কাহিনি শেষ হয়নি। ঘাতকরা মাহমুদকে হত্যা করতে পারেনি জানার পর তাদের নেতা নতুন আদেশ দেন তাকে শেষ করে দেওয়ার জন্য। এবার তারা হত্যা করতে সফল হয়। আমি রাগে কাঁপতে কাঁপতে খাদিজেহ’র বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম। পারীকে ঘটনা অবহিত করলাম।

আল্লাহ শাসকদের ন্যায়বিচার দেখতে চান, কিন্তু তারা তা না করলে কী হবে? আমরা কি স্বেচ্ছাচার সহ্য করে যাব? আমরা কী শিশুদের হত্যার অনুমতি দেব? আমরা কি নি:শ্বাস নিতে ভয় করবো? আমার ভেতরের কণ্ঠ চিৎকার করে ওঠলো, ‘না! না!’ আমরা ইসমাইলের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নিলে আমাদের মরতে হবে। তাকে থামাতে চেষ্টা করলে কি আল্লাহ আমাকে দোজখে পাঠাবেন? আমি জানি না। আমি পারীর কাছে গিয়ে তাঁর কাজে আমার সহায়তার শপথ উচ্চারণ করলাম, তাতে আমাদের জীবন গেলেও পরোয়া করব না। কিন্তু কীভাবে তা করব তা নিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। তিনি প্রকাশ্যে আসছেন না। তাঁর বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে সন্দেহের সৃষ্টি হবে। শাহের চেয়ে চতুর হতে হবে আমাদের।

আমরা ইসমাইলের প্রতি মুহূর্তের খবর নিতে তৎপর হলাম। পারী ইসমাইলের স্ত্রী কোদেনেত এর সঙ্গে দেখা করবেন। মাহাস্তির সঙ্গেও দেখা করবেন। খোদেজেহ’র ব্যাপারে পারীকে কিছু বললাম না, তাকে বিপদে ফেলতে চাই না। শাহের সবচেয়ে ঘনিষ্ট হোসেন বেগের সঙ্গে আমাকে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে হবে।

আমি খাদিজেহ’র পরামর্শ চাইলাম। তিনি ক্ষুব্ধ হলেও শাহের সামনে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন যে তিনি শত্রু বিনাশ করছেন। বিশ বছরের কারাবাস শাহের যুক্তিকে ভোতা করে দিয়েছে। সর্বত্র তিনি তার দুশমন দেখতে পান। এক ভীতির রাজ্যে তিনি বসবাস করছেন। তাঁর খাদ্য, পানীয় সবকিছু পরীক্ষা করার পর তিনি তা মুখে তোলেন। খাদিজেহ’র সঙ্গে কথা বলে আমি ফিরে আসি। আমার চিন্তার জগতে আমার বোন জালিলেহ আসে।

বালামণি আমাকে গোপন তথ্য জানান যে শাহ গোপনে একজন সুন্নি। সেজন্য শিয়া ধর্মবিদরা তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ। কিন্তু শাহ ইরানের আধ্যাত্মিক নেতা হওয়ায় তাদের তেমন কিছু করার নেই। পারীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি পারীকে শাহের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানাই। বাজারের এক মিষ্টি বিক্রেতা শাহের হালুয়া সরবরাহ করে। তার স্থলে আমাদের নিজস্ব লোক নিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলি।

আমি আরেকবার শাহী মহাফেজখানায় গিয়ে তাহমাস শাহের ইতিহাস পাঠ করি। আমি কামিয়ার কোফরানির বিবরণ পাঠ করি। তার জন্ম শিরাজে। অবসর নেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি হিসাবরক্ষক ছিলেন। তা চারটি পুত্র ছিল, সম্ভবত দু’জন মারা গেছে। সব আছে, শুধু আমার পিতাকে হত্যা করার বিবরণ নেই। আমার পিতার বিবরণে রয়েছে যে তিনি বিশ বছর শাহের কাজে নিয়োজিত থাকাকালে প্রধান হিসাবরক্ষক হন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠলে শাহ তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। পরে অভিযোগে সত্যতা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হলেও শাহ অভিযোগকারীকে হত্যা করেননি। হয়তো অভিযোগকারী প্রভাবশালী মিত্র ছিল বলে তিনি রেহাই পান। অভিযোগকারী কি এখনও জীবিত?

পরদিন সকালে শাহজাদি পারীর সঙ্গে কথা বলার সময়ে আর্ত-চিৎকার, দৌড়াদৌড়ির শব্দ শুনে আমার ছুরি হাতে লাফ দিয়ে বাইরে গেলাম। পারীর প্রধান পরিচারিকা আজর খাতুন রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে এলো। তাকে থামালে সে বললো যে সুলতানুমে অবস্থা ভয়াবহ। গোঙানির শব্দ তুলে সুলতানুম পারীর কক্ষে অবিন্যস্ত অবস্থায় পারীর কক্ষে প্রবেশ করলেন। তিনি আর্তনাদ করে পারীর কাছে ন্যায়বিচার কামনা করছেন। ইসমাইলের লোকজন তাঁর বড় ছেলে মোহাম্মত খোদাবান্দেহ’র প্রথম স্ত্রীর পুত্র সুলতান হাসান মির্জাকে তেহরানে হত্যা করা হয়েছে। কিছু কিজিলবাসী অভিজাত সুলতান হাসান মির্জাকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করার জন্য চক্রান্ত করছিল বলে ইসমাইল সন্দেহ করেছে। তাছাড়া মোহাম্মদ খোদাবান্দেহ ও তাঁর অন্যান্য পুত্রকে ইসমাইল শিরাজ ও হিরাতে গৃহবন্দী করে রেখেছে এবং যেকোনো সময় সকলকে হত্যা করতে পারে।

সুলতানুম পারীকে সুনির্দিষ্টভাবে বললেন, “তোমার কাছে আমি সুবিচার আশা করি। সাম্রাজ্যে কল্যাণের জন্য আমার পুত্রকে সিংহাসনচ্যুত করতে হবে।” তাঁর মুখে অবিশ্বাস্য উচ্চারণ! তাঁর সঙ্গে পারী যখন সাক্ষাৎ করেন তখন তিনি এর উল্টো বলেছেন। এখন তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, কোনো মা তাঁর সন্তানকে সিংহাসনচ্যুত করতে চাইবেন না, যতক্ষণ না তিনি তাঁর পুত্রকে একজন দানব হিসেবে আবিস্কার করবেন। তিনি পারীকে দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানান।

পারী তাঁর সংশয়ের কথা জানান যে অভিজাতরা সমর্থন করবেন না। সুলতানুম তাকে অন্য উপায় ভাবতে বলেন। ইসমাইল যদি মোহাম্মদ ও তার পুত্রদের হত্যা করে তাহলে সাফাভি রাজবংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য ইসমাইলকে অপসারণ করার কোনো বিকল্প নেই। হোসেন বেগ সহায়ক হতে পারেন। এজন্য শিরিন নামে হোসেন বেগের প্রিয় বেশ্যাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। সুলতানুমকে আশ্বস্ত করলে তিনি তাঁর মহলে চলে গেলেন। পারী আমাকে বললেন, “কী অদ্ভুত! একটি সন্তান ধারণের অর্থ হচ্ছে তাকে ধ্বংস করা। আমার কাজ হলো আমার দেশের মা হওয়া, কোনো সন্তান ধারণ করা নয়। তোমার অবস্থাও আমার মত।” আমি আনন্দিত যে, আমাদের দু’জনের মাঝে একটি সুন্দর ইরানের জন্মের বেদনা কাজ করে।

এখন আমার দায়িত্ব শিরিনকে খুঁজে বের করা এবং তা খুব কঠিন কাজ ছিল না। তাঁর ছোট্ট বাড়ি দরজায় পৌঁছে আমি মৃগনাভির সুগন্ধ পেলাম। শাহী বংশের এক সদস্য আমাকে পাঠিয়েছে বলার পর ভৃত্য আমাকে ভেতরে নিয়ে বৈঠকখানায় নিয়ে গেল। শিরিন আসতেই আমি চমকে ওঠলাম, “ফেরেশতেহ!” কী করে আমার পক্ষে তাকে বিস্মৃত হওয়া সম্ভব! তাঁর সুন্দর চোখ আমাকে পরখ করছিল, সে বললো, “ভৃত্যের উপস্থিতিতে আমার শিরিন নামে ডেকো। আমি আমার আসল নাম আর ব্যবহার করি না।”

“সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর! আমি ভাবিনি যে তোমার সঙ্গে আর কখনও আমার দেখা হবে। বিশেষ করে যখন শুনেছি যে তুমি মাশাদ চলে গেছো।”

“হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। পায়াম, তুমি নিজের যা করেছো, তাতে আমি দু:খিত। আসলে কি তা সত্য?”

আমার পুরোনো না শুনে অবাক হলাম। আমার জীবনে সে একমাত্র নারী, যে আমার অতীত জানে। একমাত্র সে আমার শরীরের পুরুষ অংশ দেখেছে। এক বছর আগে সে কাজভিনে ফিরে এসেছে। এর আগে মক্কায় গিয়েছিল হজ্ব পালন করতে। মাশাদে তার খদ্দেররা তাকে প্রাসাদ সদস্যদের জন্য সুপারিশ করেছিল। পর্যাপ্ত অর্থ আয় করার পর সে তার পেশা ত্যাগ করার শপথ নিয়েছে।

আমি আমার প্রথম যৌবনের দিনগুলো, আমার স্বপ্ন, আমার উন্নতির কথা ভাবছিলাম। তার কথা আমাকে প্রীত করে যে সে আমার কথা ভেবেছে। আমি তাকে দেখছিলাম। সে একই ফেরেশতেহ কিন্তু আরও সুন্দরী হয়েছে। এখন পরিপক্ক নারী। সে বিয়ে করেনি, কে একজন বেশ্যাকে তার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবে? আমার সঙ্গে সম্পর্কে গর্ভধারণ করার পর  তাকে মাশাদ ত্যাগ করতে হয়েছে। আমার কন্যার জন্ম দিয়েছে ফেরেশতেহ, যার বয়স এখন ছয় বছর।

তার এক খদ্দের এসে পড়েছে। আমাকে বিদায় নিতে হবে। আবারও আমি আসবো প্রতিশ্রুতি দিলাম এবং জানালাম যে সুলতানুম আমাকে তার কাছে পাঠিয়েছেন। সে ইতোমধ্যে তাঁর একটি বার্তা পেয়েছে। হোসেন বেগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সে বললো হোসেন বেগ ভালো মানুষ, কিন্তু সাহসী নন। শাহ তাঁর ওপর বিরক্ত হলেই তাকে হত্যা করা হতে পারে বলে সারাক্ষণ ভীতির মধ্যে থাকেন। তিনি অনুগত এবং নারীর প্রতি দুর্বল। ফেরেশতেহ প্রতিশ্রুতি দিল সে হোসেন বেগ এর মাধ্যমে ইসমাইলের দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে আমাকে জানাবে।

কয়েকদিন পর আমি ফেরেশতেহ’র কাছ থেকে একটি সাংকেতিক চিঠি পেলাম। নি:সন্দেহে কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে। আমি যখন তাকে জানতাম তখন সে পড়তে বা লিখতে পারতো না। সে লিখেছে:

“আমি যে সমস্যার কথা বলেছিলাম তা মনে রেখো। আমার এক বলেছে এটি বিশেষভাবে প্রস্তুত হজমি দাওয়াই। তুমি কি আমার মায়ের জন্য কিছুটা সংগ্রহ করতে সাহায্য করতে পারবে? আল্লাহর ইচ্ছায় এই দাওয়াই তার সমস্যা লাঘবে ভালো কাজ করবে।”

আমি শাহজাদি পারীকে বিষয়টি জানালে তিনি উচ্ছাস প্রকাশ করলেন। ইসমাইলের সম্ভবত কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা আছে। এজন্য আফিম মিশ্রিত ওষুধ কার্যকর। পরদিন আমি পুনরায় খাদিজেহ’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। আমি তাকে হজমি দাওয়াই সম্পর্কে বললাম। কিন্তু কীভাবে শাহকে প্রয়োগ করা হবে তা নিয়ে খাদিজেহ’র সংশয় ছিল।

শাহজাদির সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি আমাকে হজমি দেখালেন, যা তিনি হেকিমের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন। হেকিম মূলত শাহের জন্যই বিশেষভাবে এই হজমি তৈরি করেন। এর সঙ্গে বিষ মিশিয়ে শাহের বিশ্বস্ত কোনো নারীর সহায়তায় এটি তাঁর কাছে পৌছাতে হবে। কাজটি সহজ নয়। কার মাধ্যমে এ মিশ্রণের কাজ করা সম্ভব! আমিন খান হালাকি নামে এক হেকিমের কথা মনে পড়লো। হায়দারকে হত্যা করার সময় যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তখন আমি তাকে রক্ষা করেছিলাম।

নদীর ধারে হালাকির বাড়ি গেলে তিনি আঁচ করলেন যে আমি তার জীবন রক্ষার বিনিময় হিসেবে কোনো আনুকূল্য চাই। আমি অস্বীকার করলাম না। তাঁর বাড়ি দাওয়াই তৈরির জড়িবুটিসহ নানা সামগ্রী, ইবনে সিনা ও প্রাচীন গ্রীক চিকিৎসা পাণ্ডুলিপিতে পূর্ণ। আমি কোনো কৌশল না খাটিয়ে তার কাছে বিষ চাইলাম আমার পিতার খুনিকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করার জন্য। আমি তার কাছে স্বাদহীন ও দ্রুত কার্যকর বিষ চাইলাম। আমি হজমি সঙ্গে এনেছিলাম, তিনি তা পরীক্ষা করলেন। এর সঙ্গে বিষ মেশাতে হবে। তিনি অর্থ দাবী করলে আমি আমি পারীর দেওয়া রৌপ্য মুদ্রার থলে তাকে দিয়ে বললাম, “আপনাকে এ অর্থ দিচ্ছি কার্যকর মাত্রা ও আপনার মুখ বন্ধ রাখার জন্য।” তার মিশ্রণ তৈরি শেষ হলে তিনি একটি ছেলেকে দাওয়াইসহ এমন জায়গায় পাঠাবেন যেখান থেকে সংগ্রহ করলে কারও সন্দেহের সৃষ্টি হবে না।

পারীর নির্দেশে আমি মির্জা সালমানের কাছে গেলাম ইসমাইলের পরিকল্পনা সম্পর্কে তাঁর কাছে কোনো তথ্য আছে কিনা জানতে। মোহাম্মদ খোদাবান্দেহ’র পরিবারের নিরাপত্তার ব্যাপারে শাহজাদির শঙ্কার কথা তাঁকে জানালাম। আমার পিতার ঘাতক সম্পর্কেও তাঁর সঙ্গে কথা বললাম।

পারী সময় নষ্ট করতে রাজি নন। তিনি গওহরের কাছে খোঁজ নিলেন এমন কাউকে পাওয়া সম্ভব কিনা শাহের কাছে যার সহজ যাতায়াত রয়েছে। গওহর এক খোজার নাম বললেন, ফরিদ আগা, যিনি ইসমাইলের সেবায় নিয়োজিত হওয়ার আগে বেশ কয়েক বছর পারীর সেবক ছিল। গওহর তাকে তলব করে বিশেষ দায়িত্ব পালনের প্রস্তাব দিলেন, যা তাঁকে ধনবান ব্যক্তিতে পরিণত করতে পারে। খোজা সম্মত হলো। হেরেমের উদ্যানে আমি মধ্যরাতে ফরিদ আগার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম এবং তাকে পারীর কাছে নিয়ে এলাম। পারী তার সামনে রৌপ্য মুদ্র ভর্তি থলের মুখ খুললেন। সে বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলো তাকে কী করতে হবে? পারী তাকে বললেন সে কাজটি করতে সম্মত না হলে তাকে বলা অনাবশ্যক। সে সম্মত হলে শাহজাদি বললেন যে প্রাসাদে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।

দীর্ঘ নীরবতা বিরাজ করলো এবং শেষপর্যন্ত সে বললো, “অত্যন্ত নোংরা কাজ।” পারী উত্তর দিলেন, “শাজটি অপরিহার্য এবং এ কাজ করতে তোমার মত একজন বিশ্বস্ত লোক প্রয়োজন।”

ফরিদ আগা স্বীকার করলো, “এখন প্রাসাদ ভীতিকর এক স্থানে পরিণত হয়েছে। আজ যিনি উচ্চপদে আসীন, কাল তার মাথা তেহরান গেটে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। এর পেছনে কোনো যুক্তি নেই।” আমরা এ সমস্যাই সমাধান করতে চাই। ফরিদ আগা ছাড়া আর কারও পক্ষে শাহের কাছে পৌছতে পারবে না। কারণ সে ইসমাইলকে খাবার পরিবেশন করে। আমরা তার নিরাপত্তার আশ্বাস দিলাম। কাজ শেষ করলে তাকে প্রতিশ্রুত অর্থসহ একটি ঘোড়ায় উঠিয়ে নগরীর বাইরে দূরের কোনো নগরীতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সে একবার পারীকে, আরেকবার অর্থ ভর্তি থলে দেখছে। তাকে যথাসময়ে বিষমিশ্রিত দাওয়াই সরবরাহ করা হবে।

এক রাতে আমি কোলাহলের শব্দে ঘুম থেকে ওঠে দেখলাম আমার কক্ষের দরজা ভেঙে তরবারি হাতে শাহের চার খোজা প্রবেশ করেছে। একজন বললো, শাহ আমাকে তলব করেছেন। আমি বুঝে ওঠতে পারছিলাম না কী ঘটে থাকতে পারে। আমাদের মনে নানা প্রশ্ন ওঠলো: হেকিম কি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন? সুলতানুম কি আমাদের জন্য ফাঁদ পেতেছিলেন? ফরিদ আগা কি মুখ ফসকে কিছু বলে ফেলেছে? আমি কি আমার পিতার বিষয়ে এত বেশি সংখ্যক মানুষের সঙ্গে কথা বলে ভুল করেছি?

আমি অস্ত্রধারী খোজাদের অনুসরণ করলাম। শাহের মহলে পৌছার পর আমি তাঁর অভ্যর্থনা কক্ষে শাহজাদি পারীকে দেখে চমকে ওঠলাম, আমি ঘামতে শুরু করেছি। শাহ একটি ছোট সিংহাসনে আসীন। তাকে কুর্ণিশ করলাম। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কী কারণে আমার দাসী খাদিজেহ’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করো? এনে রেখো, মিথ্যা বললে তুমি প্রাণ হারাবে?”

“আমি তার সঙ্গে দেখা বেশ ক’বার করেছি তার কাছে সাহায্য লাভের আশায়। তিনি অত্যন্ত উদার।” কার জন্য সাহায্যের প্রয়োজন জানতে চাইলে আমি উত্তর দিলাম, “শাহজাদি পারী খান খানুমের কাছে আগত ভাগ্যহত মহিলাদের জন্য।”

“সম্পূর্ণ উদ্ভট যুক্তি, আমার বোনের যথেষ্ট অর্থ রয়েছে, যা থেকে তিনি যে কাউকে সাহায্য করতে পারেন।” আমি বলি যে প্রয়োজন অনেক বেশি, অনেক মহিলা তাদের অন্য মুসলিম নারীদেও জন্যও সাহায্য পেতে চান। তিনি প্রতিবারের সাক্ষাতের বিবরণ দাবী করলে আমি ব্যাখ্যা করি, প্রথম বার এক মহিলা বাড়িঘর হারানোর পর শাহজাদির কাছে আসেন তার ও তার সন্তানদের জন্য বস্ত্র চাইতে আসেন। তিনি খুই থেকে এসেছিলেন। দ্বিতীয় বার মহিলাটি আসেন তার বাড়ি উদ্ধারে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য একটি সূচিকর্ম উপহার দেওয়ার জন্য, আমি সেটি শাহের দাসীর কাছে পৌছে দেই। তৃতীয় বার আমাকে আসতে হয়েছিল শাহজাদির পরিচিতা এক মহিলা অসুস্থ ছিলেন, যার হৃদরোগের দাওয়াই এর প্রয়োজন ছিল, আমি শুনেছিলাম মহান শাহের দাসী এ ধরনের দাওয়াই সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখেন।

তিনি আমার চতুর্থ বার আগমণের কারণ জানতে চাইলেন। সেদিন খাদিজেহ’র সেবিকা নাসরীন খাতুন আমাকে পারীর পাঠানো উপহার দিতে দেখেছিল। আমি বিব্রত বোধ করি, কারণ পারীর সঙ্গে খাদিজেহ’র পরিচয় ছিল না। তাঁকে জানালাম যে, আমি নিজে অসুস্থ ছিলাম এবং তিনি দাওয়াই নির্ণয়ে খ্যাত বলে আমি তার শরণাপন্ন হযেছিলাম। ইসমাইল শাহ ক্ষুব্ধ যে আমি প্রাসাদকে দাওয়াখানা হিসেবে ব্যবহার করেছি।

তিনি পারীকেও জেরা করলেন। শাহজাদি ক্রুদ্ধ। আমি তার ঘনিষ্ট নারীর কাছে ব্যক্তিগত অনুরোধ নিয়ে গেছি বলে আমাকে শাসন করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আম ভীত হওয়ার ভান করে শাহের পদপ্রান্তে পড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। তিনি তাঁর খোজা, যারা আমাকে ধরে আনতে গিয়েছিল তাদের প্রধানকে জেরা করলেন, আমার ঘরে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেছে কিনা। তিনি জানালেন একটি কবিতার বই ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। তিনি শাহকে একজন হেকিমের বার্তাবাহকের আগমণের কথা জানালেন।

আমার ধারণা হলো, হেকিম আমিন খান হালাকির পক্ষ থেকে কেউ এসেছে আমাকে বাজারের কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে, যেখানে তার প্রতিশ্রুত বিষ আমাকে দেওয়া হবে। আমি জমে গেলাম, বিষ কেনার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে আমি কী বলতে পারি এবং সিদ্ধান্ত নিলাম পারী ও খাদিজেহকে রক্ষা করার জন্য আমি শাহকে হত্যা করার জন্য বিষ সংগ্রহ করতে চেয়েছি বলে আমার জীবন দেব। কিন্তু বার্তাবাহক এসেছে শাহের দাওয়াই প্রস্তুতের খবর নিয়ে। তিনি পারীকে আমার বিশ্বাসঘাকতার কথা বলে সতর্ক করলেন যে কোনো খুনি তার জীবন নাশের কারণ হতে পারে তা তিনি উপলব্ধি করেন না। শাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করলেন যে প্রাসাদ থেকে তিনি সকল সম্ভাব্য খুনিকে নির্মূল করবেন।

কক্ষে শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ। শাহ আমাকে কক্ষ থেকে বের করে দিয়ে পারীকে সতর্ক থাকতে বললেন। আমি পারীর মহলে চলে এলাম। পারী এসে দরজা বন্ধ করে আমাকে তিরস্কার করলেন যে কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়েছি। আমার পক্ষে কী করে বলা সম্ভব যে শাহের মহিলাদের একজনকে আমি ভালোবাসি। তাহলে পারীও আমার অপরাধকে ক্ষমার অযোগ্য বিবেচনা কববেন এবং শাহ আমাকে ও খাদিজেহকে হত্যা করতে দ্বিধা করবেন না। পারীকেও শাহ হত্যা করতে পারেন। আমাদের পরিকল্পনা জানেন শুধু গওহর ও সুলতানুম। ফরিদ আমাদের পক্ষে, তার প্রয়োজন অর্থ, হেকিম আমিন হালাকি তার অতীতের সঙ্গে সমঝোতা করেছেন। তারা কি আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন?

পারী কোনো ক্রীতদাসে মাধ্যমে শাহকে বিষ প্রয়োগে লিপ্ত করতে সম্মত নন। তাঁর মাঝে রাজরক্তের অহঙ্কার রয়েছে। আমাকে স্বীকার করতে হয় যে খাদিজেহ’র সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এখন তাকে মৃত ধরে নিচ্ছি, কারণ তিনি আমাদের সহায়তা করতে চেয়েছিলেন। খাদিজেহ দাসী হতে পারেন, কিন্তু তিনি সিংহীর মতো সাহসী।

খাদিজেহকে অবশেষে প্রাণ দিতে হলো। আমার অসহায়ত্বে আমি মর্মবেদনায় ভুগছিলাম, নিজেকে শিশুর মতো মনে হচ্ছিল। কিন্তু শিগগির আমার মাঝে জীবনের বিনিময়ে হলেও শাহকে হত্যা করা দৃঢ়তা ফিরে এসেছে। আমি শাহী ব্যায়ামাগারে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে শুরু করলাম। পারীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক গভীর করতেও তৎপর ছিলাম। এক রাতে আমি স্বপ্নে দেখতে পেলাম ইসমাইল শাহ আমাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত হয়েছেন এবং হত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন। আমি জেগে ওঠলাম। পরদিন পারীকে আমার স্বপ্নের কথা বললাম। প্রাসাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা হয়েছে। আমাদের আশাপাশের  যে কেউ শাহের লোক হতে পারে। কিন্তু আমরা দু’জন জানতাম যে আমাদের লক্ষ্য অভিন্ন।

ছয় মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। সবকিছু নিয়ম অনুসারে চলছে। ধীরে ধীরে প্রাসাদের পদগুলো আমাদের অনুকূলে আসতে শুরু করেছে। শামকাল চেরকেস উচ্চপদ লাভ করেছেন। মির্জা সালমান প্রধান উজির পদ পাকাপোক্ত করেছেন। পারীও হয়তো মর্যাদায় পুনর্বাসিত হবেন, সেক্ষেত্রে তাকে আমার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

ইতোমধ্যে আমি হেকিমের কাছে খবর পাঠিয়েছি যে তাঁর দাওয়াই গ্রহণের জন্য আমি প্রস্তুত। তাঁর প্রেরিত ব্যক্তির কাছ তা গ্রহণ করে গোপনীয়তার সঙ্গে সংরক্ষণ করলাম। শাহজাদি পারী ফরিদকে তলব করলেন। আমাদের শঙ্কা কাটেনি। ফরিদ তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবে তো। সে যদি ধরা পড়ে তাহলে কত দ্রুত সে আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে?

ফরিদ যথাস্থানে উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে বিষ হস্তান্ত করার পর তার প্রাপ্য অর্থ দাবী করলো। আমি তাকে মুদ্রা ভর্তি থলে প্রদান করে তার চোখ বাঁধলাম। চারদিকে মৃত্যুর স্তব্ধতা। মৃত্যু ভীতি তাকে আড়ষ্ট করেছে এবং কোরআনের আয়াত জপতে শুরু করেছে। আমি তাকে সান্তনা দিয়ে বললাম, “তোমার জন্য ঘোড়া তৈরি, তোমার কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং এখন তুমি মুক্ত।” তাঁকে তেহরান গেটে নিয়ে নিশ্চিত করলাম যাতে সে নিরাপদে নগরীর বাইরে চলে যেতে পারে।

আমি পারীর কাছে সব জানালাম। কেউ যদি আমাদের গত দুই দিনের গতিবিধি সম্পর্কে জানতে চায় তাহলে আমরা বলবো যে পারী দরবারে তাঁর নারী সহযোগীদের কাছে চিঠি লেখার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, আর আমি তাঁকে সহযোগিতা করেছি। অটোম্যানরা ইসমাইল শাহের সিংহাসনে আরোহণে তখন পর্যন্ত কোনো দূত প্রেরণ করে অভিনন্দন জানায়নি। পারী তৃতীয় মুরাদের স্ত্রী শাফিয়েহ সুলতানকে চিঠি লিখেছেন রীতি ভঙ্গ করায় দু:খ প্রকাশ করে।

রাতে আমরা ভাবছিলাম, হোসেন বেগ এর বাড়ির দরজা খোলা হলে বোঝা যাবে যে শাহ রক্ষা পেয়েছেন। চাঁদ মধ্যাকাশে ওঠার পর দরজা খুললো এবং হোসেন ও ইসমাইল শাহকে কয়েকজন সশস্ত্র দেহরক্ষীর সঙ্গে দরজা দিয়ে বের হতে দেখে আমি হতাশ হলাম। শাহ যে বিষাক্ত হজমি দাওয়াই খাননি তা স্পষ্ট। তারা চোখের আড়াল হলে আমি পারীর মহলে এসে তাঁকে শাহ সম্পর্কে জানালে তিনি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখালেন। অনেকটা নির্বিকার।

পরদিন দুপুরে পারীর মহলে গিয়ে তাঁকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখলাম। রাতে তিনি ঘুমোতে পারেননি। মির্জা সালমান তাঁকে খবর পাঠিয়েছেন জরুরী বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। আমাকে কারণ জানতে হবে। প্রধান উজিরের প্রচলিত দেহরক্ষী পরিবৃত না হয়ে একজন মাত্র ভৃত্যকে সাথে নিয়ে মির্জা সালমান এলেন। শাহজাদি পারী তাঁকে পর্দার আড়াল থেকে স্বাগত জানালেন। মির্জা সালমান গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “শাহজাদি, প্রাসাদে নজীরবিহীন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর আলো সম আপনার ভাই আজ সকালে তাঁর মুখ প্রদর্শন করেননি, প্রাসাদে সকলে উদ্বিগ্ন।” আমার হৃদয় আশায় পূর্ণ হলো। পারী উৎকণ্ঠার সঙ্গে জানতে চাইলেন শাহ কখন ঘুমিয়েছেন। মির্জা জানালেন ভোরের কয়েক ঘন্টা আগে, কিন্তু তিনি তাঁর জেগে ওঠার সময়ে কক্ষ থেকে বের না হওয়ায় ভৃত্যেরা তাঁর কক্ষের সামনে জড়ো হয়েছে, কিন্তু কেউ দরজার কড়া নাড়তে সাহস করছে না।

পারী তাঁর কণ্ঠে উদ্বেগ ফুটিয়ে শাহের কক্ষের দরজায় আঘাত করার এবং তাতেও যদি সাড়া না পাওয়া যায় দরজা ভেঙে ফেলার পরামর্শ দিলেন। মির্জা সালমানের সঙ্গে আমিও গেলাম। তিনি বলেননি যে শাহ কোথায় ঘুমিয়েছেন, কিন্তু হোসেন বেগ এর বাড়িতে গিয়ে দরজায় আঘাত করতে  দেখলাম। ভৃত্য দরজা খুলে আমাদের এক কক্ষে নিয়ে এলো, যেখানে হেকিম তাবরিজি অপেক্ষা করছিলেন। এছাড়া ছিলেন দু’জন কিজিলবাসী আমির, ইসমাইলের মামা আমির খান মোসেলু ও নতুন ওস্তাজলু প্রধান পীর মোহাম্মদ খান। দরজায় আঘাত করার পর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। হঠাৎ ভেতর থেকে কাতর ধ্বনি শোনা গেল। মির্জা সালমান দরজা ভেঙে ফেলার আদেশ দিলে প্রহরীরা দরজা ভেঙে ফেললো এবং মির্জা ও হেকিম তাবরিজি প্রবেশ করলেন। শয্যায় চাদরে ঢাকা দুটি অবয়ব। নত হয়ে হেকিম বোঝার চেষ্টা করছেন এবং একসময় চাদর সরিয়ে ফেললেন, শাহের চোখ বন্ধ। তিনি তাঁর বুকে কান রাখলেন। ক্ষীণ স্পন্দন অনুভব করলেন। আমি ভীত, বিষ কি পুরোপুরি কাজ করেনি? তার পাশে শায়িত হোসেন বেগ। মির্জা সামলমান জানতে চাইলেন কী ঘটেছে? তিনি পা নড়াতে পারছেন না।

হোসেন বেগ কোনোমতে যা বললেন, তাতে বোঝা গেল রাতে তারা দু’জন বরাবরের মত ছদ্মবেশে বাইরে গিয়ে আফিম সেবন করেছেন, অন্যান্য খাবার খেয়ে বাড়ি ফেরার পর হজমি দাওয়াই খেয়ে শয্যায় গেছেন। আর কিছু বলতে পারেন না হোসেন। মির্জা সালমান তাঁর কোমর থেকে ছুরি হাতে নিয়ে হোসেনের উরুতে আঘাত করলেন, ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হলেও হোসেন অনুভব করছিল না। হেকিম তাবরিজি বললেন যে হোসেন বেগ সঠিক বলেছেন। শাহের জন্য দোয়া করা ছাড়া কোনো দাওয়াই কাজে লাগবে না।

তারা হজমি দাওয়াই এর বাক্স খুঁজে বের করলেন। একটি বিড়ালকে একটি বটিকা খেতে দেওয়া হলে বিড়ালটি তা শুঁকে চলে গেল। আমি কপাল থেকে ঘাম মুছলাম। তাবরিজি শাহের নাড়ি ধরে আছেন। হঠাৎ তিনি বলে ওঠলেন, “আল্লাহ ক্ষমাশীল, তাঁর নাড়ি চলছে।” মৃদু নি:শ্বাস নিতে শুরু করেছেন শাহ। হেকিম তাঁর মুখে মৃদু আঘাত করছেন, কোনো সাড়া নেই। এরপর তিনি বললেন যে তিনি আর শাহের নি:শ্বাস অনুভব করছেন না। তিনি ঘোষণা করলেন, “জীবন শাহের দেহ ত্যাগ করেছে।”

পীর মোহাম্মদ কোরআনের আয়াত উচ্চারণ শুরু করেছেন। আমীর খান চিৎকার করে বললেন, “কে বিষ প্রয়োগ করেছে? আমি নিজ হাতে তাকে হত্যা করবো।” আমার হাঁটু কাঁপতে শুরু করেছে। সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে মির্জা সালমান বললেন যে শাহের মৃত্যুর খবর সহসা প্রচার করা সঙ্গত হবে না। তাহমাস শাহের মৃত্যুর পর নগরীর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। মির্জা সালমান প্রাসাদের সকল দরজা বন্ধ রাখা নিশ্চিত করবেন। ঘটনা সম্পর্কে অভিজাতদের অবহিত করতে হবে। হেকিম তাবরিজি কক্ষে রয়ে গেলেন। মির্জা সালমানের কাছে যখন বললাম যে আমার পক্ষে শাহজাদি পারীকে কীভাবে এই দু:খজনক খবর দেওয়া সম্ভব, তিনি বললেন, দুই ভাই বোনের মধ্যে কোনো ভালোবাসা ছিল না। তাঁর কথায় আমি বিস্মিত হলাম। আমি বললাম যে, ভাইবোনের কলহ সত্ত্বেও পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা থাকে। কিন্তু মির্জা সালমান বিশ্বাস করেন পারী তাঁর আনুগত্যে সন্দেহ করেন না।

আমি রুদ্ধশ্বাসে পারীর মহলে গিয়ে তাঁকে ঘটনার বিস্তারিত জানালাম। একথাও বললাম যে হেকিম তাবরিজির বিশ্বাস অতিরিক্ত আফিম সেবনে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর ঘটনা যথাশীঘ্র সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া কথাও ভাবলাম। আর্তনাদ করে পারী পড়ে গেলেন। তাঁর সেবিকারা এগিয়ে এলো। প্রতি মুহূর্তে আমি ধারণা করছিলাম শাহের প্রহরীরা যেকোনো সময়ে আমার খোঁজ করবে, কেউ আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, ফরিদ ধরা পড়লে সহজে সে সব স্বীকার করবে অথবা হেকিম জড়িয়ে পড়লে নি:সন্দেহে আমি ও শাহজাদি দু’জনের ভয়াবহ  বিপর্যয় অনিবার্য। 

সন্ধ্যায় হোসেন বেগ এর বাড়ির জানালাগুলো কালো পর্দায় আবৃত অবস্থায় দেখা গেল। শাহের স্ত্রীরা বিলাপ করছেন। সুলতানুমের দু:খ প্রকৃত মনে হলো। হায়দারের মা সুলতান-জাদেহ অশ্রু মোছার ভান করছেন। ইসমাইলের মৃত্যুতে তাঁর ভূমিকা না থাকলেও কোনোভাবে তাঁর প্রতিশোধ পূরণ হওয়ায় তিনি নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট।

পারীর কাছে ফিরে গেলে তিনি আমাকে তাঁর একান্ত কক্ষে নিয়ে দরজা বন্ধ করলেন। হেকিম তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন শাহ প্রচুর আফিম সেবন করার পর এত বেশি পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করেছিলেন যে তিনি নি:শ্বাস নিতে পারছিলেন না, অথবা তাঁকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে।

পারী নিশ্চিত যে ইরানের পরবর্তী শাহ নির্বাচনে তাঁকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। সাফাভি বংশের অবশিষ্ট শাহজাদারা অল্প বয়সী, অনভিজ্ঞ। সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য তিনিই একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি, কিন্তু কোনো নারীর সাম্রাজ্য শাসনের অধিকার নেই। অতএব তিনি ইসমাইলের ছেলে সুজা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করবেন।

শামকাল চেরকেস এর আগমণ ঘটলো। আমি আড়ালে চলে গেলাম, যাতে তারা একান্তে কথা বলতে পারেন এবং আমি তাদের কথা শুনতে পারি। তিনি পারীর কাছে এসেছেন তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুতে আনুষ্ঠানিক শোক জানাতে ও তাঁর সাহসের প্রশংসা করতে। তিনি শাসন পরিচালনায় সহায়তা করার আশ্বাসও প্রদান করলেন। ইসমাইল তাঁকেও হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন দাবী করে তিনি পারীর আনুকূল্য লাভের আশা করছেন। তিনি পারীর সামনে অবনত হয়ে তাঁর পদচুম্বন করলেন।

মির্জা সালমান এসে জানালেন প্রতিটি উপজাতি গ্রুপ তাদের প্রভাব সৃষ্টি চেষ্টা করছে। তিনি তাদের পরবর্তী শাহের নাম ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত শান্ত থাকার আহবান জানিয়েছেন। পারী মির্জা সালমানকে বলে সকল অঞ্চলের আমীরদের তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তারা পারীকে ইসমাইলের পুত্রের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চান না। তারা তাহমাস শাহের পুত্র মোহাম্মদ খোদাবান্দেহকে সিংহাসনে দেখতে চান। কিন্তু খোদাবান্দেহ অন্ধ। তাঁর কিজিলবাস হওয়ায় কিজিলবাসীরা খোদাবান্দেহকে তাদের নিজস্ব লোক বিবেচনা করেন এবং সেক্ষেত্রেও পারীই হবেন তাদের তাঁর ্প্রধান উপদেষ্টা।

মির্জা সালমানকে পারী বোঝালেন আমীররা খোদাবান্দেহকে তাদের শাসক হিসেবে দেখতে চায়, কারণ এর ফলে তারা তার ওপর প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করবে। যাহোক, তারা সকলে একমত যে উত্তরাধিকারী দ্রুত নিয়োগ করা না হলে সাম্রাজ্য জুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। একই পিতার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও খোদাবান্দেহ সম্পর্কে পারীর ধারণা ভালো নয়, তিনি ইসমাইলের চেয়ে দুর্বল।

ইসমাইলকে কবরস্থ করা ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার পর বালামণি আমাকে আমার পিতার ঘাতক সম্পর্কে ইঙ্গিত দিলেন যে কামিয়ারকে নির্দেশ দিয়ে থাকতে পারেন মির্জা সালমান। তবে এর পেছনে ইসমাইলের হাতও ছিল, তিনি কারাগার থেকে মির্জা সালমানকে নির্দেশনা দিতে তাহমাস শাহের বিশ্বস্ত লোকজনকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য। এখন ইসমাইল মৃত, আমি স্বস্থি বোধ করলাম যে অবশেষে আমি আমার পিতার ঘাতককে নির্মূল করার ক্ষেত্রে আংশিক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছি। আমি আমার পিতার কবর জিয়ারত করলাম। তাঁর কবরে গোলাপ জল ছিটিয়ে দিলাম।

ইসমাইল শাহ পদে আসীন হওয়ার পর খোদাবান্দেহকে শিরাজে গৃহবন্দী করে রেখেছিলেন। তাঁর কাছে যখন বার্তা পৌছানো হলো যে তাঁকে ইরানের পরবর্তী শাহ নির্বাচন করা হয়েছে, তিনি তা বিশ্বাস করতে পারেননি। সন্দেহ দূর হলে তিনি রাজধানী কাজভিনে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন। শোকের দিনগুলোর পর অভিজাতগণ শাহজাদি পারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর আগে শামকাল চেরকেস তাঁকে সহায়তার প্রস্তাব দিলে তিনি তা নাকচ করেন। সমাবেশ পরিচালনার জন্য পারী আমাকে দায়িত্ব প্রদান করেন। আমি আনুষ্ঠানিকতা ঘোষণা করার পর পারী অভিজাতদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে শুরু করেন।

তিনি নতুন শাহের আগমণের খবর দিলেন, যিনি কোম এ তাঁর মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শীঘ্রই রাজধানীতে উপনীত হবেন। ইতোমধ্যে তাঁর অভিষেকের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। মির্জা সালমান অভিজাতদের নিয়ে কোম এ খোদাবান্দেহকে স্বাগত জানানোর জন্য যাওয়ার আগ্রহ দেখালে পারী তাঁর আদেশ ছাড়া কাউকে প্রাসাদ ছেড়ে কোথাও যেতে নিষেধ করলেন। তিনি বললেন, “আমাদের প্রথম কাজ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।” তিনি ইসমাইলের আদেশে কারারুদ্ধ অভিজাতদের মুক্তির আদেশ দিলেন। সকলের মাঝে সন্তুষ্টি দেখা গেল। পারী তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।

রমজান মাস শেষ হলে আমি শাহজাদি পারীর কাছে ্অনুমতি চাইলাম আমার বোন জালিলেহ’কে কাজভিনে আনার জন্য এবং তিনি নওরোজের (ইরানি নববর্ষ) পর যখন হেরেমের নতুন সেবিকাদের প্রশিক্ষণ শুরু হবে তার আগে তাকে রাজধানীতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে বললেন। তিন মাসের বেশি সময় পর নওরোজ উৎসব উদযাপিত হবে।

সকল প্রস্তুতি শেষে কাজভিনে আসার আগে মোহাম্মদ খোদাবান্দেহ তাঁর বিশ্বস্ত লোকজন ও একদল সৈন্যকে পাঠালেন সবকিছু যাচাই করতে এবং বিভিন্ন স্থানে সৈন্যদের মোতায়েন করে তাঁর নিরাপত্তার চাদর নিñিদ্র করলেন। আমি পারীকে বললাম যে খোদবান্দেহ প্রথমেই শাহজাদির আনুগত্য চাইবেন, যার অন্যথা হলে তাঁর ওপর বিপদ নেমে আসতে পারে। শামকাল ও পারীকে আরও কুশলী হতে হবে। পারী মোহাম্মদ খোদাবান্দেহ’র লোকজনকে বিদায় করতে চান। তিনি নতুন শাহকে তাঁর সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে দেবেন না। মির্জা সালমান তাঁকে শাহের বিরুদ্ধাচরণের পরিণতি স্মরণ করিয়ে দিলে পারী ক্ষুব্ধ হন। তিনি নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে প্রস্তুত।

কোম নগরীতে খোদাবান্দেহ তাঁর শিবির স্থাপন করে কাজভিনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার শুভক্ষণের প্রতীক্ষার সময়ে পারীকে তলব করলেন।

যথাসময়ে আমরা রওয়ানা হলাম। শাহী রীতি পরিহার করে পারী তাঁর প্রিয় আরবীয় ঘোড়ায় ওঠে যেতে পছন্দ করেছেন। আমরা বিশাল একটি দলের নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। কোম নগরীর উপকণ্ঠে পৌছালে খোদাবান্দেহ’র প্রহরীরা পারীকে স্বাগত জানালো। পরদিন সকালে ইরানের ভবিষ্যৎ শাহ পারীকে তাঁর তাবুতে আহবান করলেন, আমি তাঁকে অনুসরণ করলাম। খোদাবান্দেহ’র পাশে তাঁর স্ত্রী খায়ের উন-নিসাও উপবিষ্ট। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর খোদাবান্দেহ রাজধানী ও প্রাসাদের পরিস্থিতি জানতে চাইলেন বোনের কাছে। পারী জানালেন ইসমাইলের মৃত্যুর পরবর্তী সময়ের ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণসহ তিনি মির্জা সালমানকে তাঁর খেদমতে পাঠানোর পর তিনি আর রাজধানীতে ফিরে যাননি।

খোদাবান্দেহ’র পরিবর্তে সাড়া দিলেন তাঁর স্ত্রী। তারা সব জানেন। পারী ভাইকে বললেন যে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করলে শাহের আদেশ প্রতিপালন করতে দিনরাত ব্যয় করবেন। খায়ের উন-নিসা সাড়া দিলেন পারীর এত কিছু করার প্রয়োজন পড়বে না। পারী ছেড়ে দেওয়ার নারী নন, তিনি বললেন যে খায়ের উন-নিসা প্রাসাদ রাজনীতি সম্পর্কে অবহিত নন। খায়ের উন-নিসা তাঁর পদচুম্বন করে পারীর আনুগত্যের প্রমাণ দাবী করলে পারী রেগে ওঠে দাঁড়ালেন এবং রাজরক্তের অধিকারী নারীকে এভাবে অপমান করার ধৃষ্টতার জন্য তিরস্কার করলেন।

পারী তাঁর ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে তাহমাস শাহের মৃত্যুর পর তাকে কীভাবে বিভিন্ন প্রদেশে বিদ্রোহ দমন করতে হয়েছে এবং একই সঙ্গে প্রাসাদ চক্রান্তের মোকাবিলা করতে হয়েছে।

আমরা আমাদের তাবুতে ফিরে এলাম। পারী আমাকে বললেন যে তাঁর ভাই যদি তাঁর সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হন তাহলে তিনি শামকালের সহায়তা নিয়ে শাসন পরিচালনা করবেন।

তাবুতে পৌছার পর আমার মায়ের জ্ঞাতি বোনের চিঠি পেলাম, আমার বোন জালিলেহ’র বিয়ে ঠিক হয়েছে, তিনি আমার সম্মতি চেয়েছেন। আমি লজ্জা ও ক্ষোভ অনুভব করলাম। কিছু সময় পর আরও একটি চিঠি পেলাম, এটি জালিলেহ’র চিঠি। সে লিখেছে যে এক বৃদ্ধের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে, যার চারটি দাত অবশিষ্ট রয়েছে, তার দুটি স্ত্রী বিদ্যমান এবং তার সন্তানরা তার চেয়েও বয়সে বড়। তাদের প্রয়োজন একজন চাকরানির। সে তাকে উদ্ধার করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে।

আমার বুকে আগুন জ্বলছে, আমি আমার বোনকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারিনি। আমি আমার মায়ের জ্ঞাতি বোনকে লিখলাম যে আমি তার জন্য অর্থ পাঠাচ্ছি, তবুও তিনি যাতে আমার বোনকে বিয়ে না দেন। আমি তার জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজবো। পারীকেও আমি বিষয়টি জানালাম, যাতে তিনি আমার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থান করেন এবং আমি বোনকে যথা শীঘ্র কাজভিনে আমার কাছে আনতে পারি।

মোহাম্মদ খোদাবান্দেহ রাজধানীতে প্রবেশের শুভ মুহূর্তের অপেক্ষা করছেন। আমরাও তার যাত্রারম্ভের অপেক্ষা করছি। এ সময়ে ফেরেশতেহ’র পাঠানো একটি খবর এত জরুরী ছিল যে আমি সঙ্গে সঙ্গে শাহজাদি পারীর তাবুতে গিয়ে জানালাম যে আমার দ্রুত কাজভিনে ফেরা প্রয়োজন, সম্ভবত ফেরেশতেহ’র কাছে সালমানের কোনো খবর আছে। তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন। আমি কাজভিনে সোজা ফেরেশতেহ’র বাড়ি যাওয়ার পর সে জানালো মির্জা সালমান কোম নগরীতে তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছেন। মির্জার বন্ধু ফেরেশতেহ’র একজন খদ্দের, মির্জা তাকে বলেছেন, রাজবংশের লোকজন যদিও মনে করে তারাই সেরা, কিন্তু অন্য যে কারও মত তাদের পতনও সহজে আনা যায়। লোকটি ছদ্মবেশে খোদাবান্দেহ’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পারী খান খানুমের সঙ্গে সতর্কতার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার পরামর্শ দিয়েছেন, কারণ ইসমাইলের মৃত্যুর জন্য পারী দায়ী।

এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা? আমি ধারণা করেছিলাম, খোদাবান্দেহ মির্জা সালমানকে প্রধান উজির পদে বহাল রাখবেন। আরও বিস্ময়কর খবর হলো, খোদাবান্দেহ তাঁর অভিষেকের আগেই শামকালকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা কার্যকর হয়েছে।

আর বিলম্ব না করে আস্তাবল থেকে আমার ঘোড়া নিয়ে নগরী থেকে দ্রুত বের হয়ে গেলাম। শামকালেল মৃত্যু পারী কীভাবে সহ্য করবেন? আমরা এখন কী করবো? মির্জা সালমান যে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন তা স্পষ্ট ছিল। শিবিরের কাছে পৌছে আমার মনে হলো নিশ্চয়ই আমি পথ ভুল করেছি, মাত্র গুটিকয়েক তাবু টানানো রয়েছে, অবশিষ্টগুলো গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। একজন বললো, খোদাবান্দেহ রাজধানীর উদ্দেশে রওয়ানা হবেন। আমরা কাজভিনে পৌছার আগেই নগরবাসী রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করছিল নতুন শাহকে স্বাগত জানানোর জন্য।

ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো পারীকে জানানো প্রয়োজন, তা না হলে তিনি শাহের ফাঁদে পড়বেন। আমি পারীর পালকির কাছে গিয়ে কোনোমতে বললাম যে ভয়ঙ্কর খবর আছে। তিনি আমাকে পালকিতে ওঠতে বললেন। তাঁকে মির্জা সালমানের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানানোর পর তিনি বিস্মিত ও শঙ্কিত হলেন। হঠাৎ পালকিতে ঝাঁকুনি অনুভব করলাম এবং মনে হলো আমাদের ভিন্ন পথে নেওয়া হচ্ছে। আমি চিৎকার করে জানতে চাইলেও উত্তর পাওয়া গেল না। ্পর্দা তুলে নিশ্চিত হলাম, আমাদের পারীর বাড়িতে নেওয়া হচ্ছে না। আমি চিৎকার করে শামকালের অনুগত রক্ষীদের তলব করার পর তারা পালকির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে পালকি মাটিতে নামিয়ে শাহজাদি পারীকে নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করলো।

পারী আমাকে বললেন, “আমাদের খেলা শেষ, এখন চুপ করে রুমির কবিতা শোনো:

‘মাকড়শার মত বিষাদের লালা দিয়ে জাল বুনো না,

যিনি দু:খদাতা তার কাছেই দু:খগুলো ফিরিয়ে দাও,

এবং এরপর আর কখনও দু:খের কথা বলো না।

তুমি নীরব হলে তাঁর কথাই হবে তোমার কথা

তুমি তুমি জাল না বুনলে তিনি নিজেই বুনবেন।’”

শামকাল চেরকেস এর যেসব প্রহরী পারীর পালকি বহন করছে ও প্রহরা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তারা জানে না যে শামকালকে হত্যা করা হয়েছে। হঠাৎ প্রহরীদের মধ্যে গোলযোগ বাধলো। পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সেজন্য আমি ছুরি বের করে একজনের বুকে আঘাত করলাম। কিন্তু তার এক সঙ্গী আমার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করেছে। আমি পিছিয়ে গেলাম। মাথা থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। অন্যেরা আমাকে স্থির হতে সহায়তা করলো, আমি প্রাসাদের উদ্দেশ্যে দৌড় দিলাম। পারীকে আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল। আমি তাঁর ভাগ্য সম্পর্র্কে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছি।

ঘুষের বিনিয়ে একজন খবর নিয়ে এলো, পারীকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর চোখ বিস্ফারিত, যে রশি তাঁর গলায় পেচিয়ে তাঁকে শ্বাসরুদ্ধ করা হয়েছে, সেটি তখনও তাঁর গলায় পেচানো ছিল। আমি দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থায় নেই। পারীর মৃত্যু কীভাবে আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব? সাফাভি বংশের এই সুযোগ্যা শাহজাদির এমন করুণ মৃত্যু কারও কারও কাম্য হতে পারে না।

আমি নগরীর এক প্রান্তে পানশালায় প্রবেশ করে পান করতে শুরু করলাম এবং মেঝের ওপর পড়ে গিয়ে ফেরেশতার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। ফেরেশতা আমার ওপর দিয়ে ঘুরছিল এবং আমি আবৃত ও স্বর্গীয় আলিঙ্গন অনুভব করলাম।

সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর। পারী আমাকে ভালোবাসতেন ভেবে আমার চোখে অশ্রুধারা বইতে শুরু করলো। সহসা আমার নীরক কান্না আর্তনাদে পরিণত হলো এবং পানশালার সুরাসেবীরা আমাকে ঘিরে ধরে আমার দু:খের কারণ জানতে চাইলো। আমি যখন বললাম যে আমি এক মহান নারীকে হারিয়েছি, তখন তারাও বিলাপে অংশ নিলো। কারণ কে তাদের কোনো না কোনো নারীকে হারায়নি — মা, বোন, স্ত্রী ও কন্যাকে — আমরা সবাই আমাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছি।

সকালে ঘুম ভাঙলে আমি প্রাসাদের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম এবং খোজাদের অংশে আমার কক্ষে এলাম। সবার এক কথা, আমাদের কী হবে? আমরা কোথায় যাবো? প্রাসাদে বহু ঘটনা ঘটে গেছে, সুলতানুমকে হত্যা করা হয়েছে, ইসমাইলের শিশুপুত্র সুজাকেও ঘাতকেরা মেরে ফেলেছে। এমনকি মাহাস্তির সদ্যজাত সন্তানকেও ছাড়া হয়নি।

শাহজাদি পারীর জন্য কোনো শোক অনুষ্ঠান আয়োজন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন খোদাবান্দেহ। তাঁর লাশ কোথায় কবরস্থ হবে তা কেউ জানবে না।

যেদিন খোদাবান্দেহ’র অভিষেক হলো, সেদিন তিনি নিজের নতুন নাম ধারণ করলেন ‘মোহাম্মদ শাহ’। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি শূন্য ও অনুভূতিহীন। মির্জা সালমান তাঁর ক্ষমতাধর অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। বালামণির পরামর্শ লংঘন করে আমি মির্জা সালমানের সঙ্গে দেখা করে পারী যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন সে সম্পর্কে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলাম। তিনি শাহজাদির জন্য কৃত্রিম শোক প্রদর্শন করলেন। আমি একজন খোজাকে শেখানো প্রাসাদ রীতির তোয়াক্কা না করে তাঁর প্রতি আমার ক্ষোভ প্রকাশ করতে দ্বিধা করিনি। কারণ তিনিই পারী সম্পর্কে মোহাম্মদ শাহের কান ভারি করে তার মৃত্যু ত্বরান্বিত করেছেন। তিনি আমাকে বললেন যে নতুন শাহ আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তিনি বিস্মিত হবেন না। তাঁর সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন। আমি চলে এলাম। আমি আমার বিপদ সম্পর্কে অবগত।

আমার অপেক্ষার সময়ে মোহাম্মদ শাহ আমাকে তলব করলেন। আমি তখনও পারীর চিঠি পাঠ ও উত্তর দেওয়ার কাজ করছিলাম, যেন তিনি বেঁচে আছেন। এক সকালে আমার চোখে কাজভিনের এক ভূ-মালিক, পারীর আইনি পরামর্শকদের একজনকে লেখা একটি চিঠি পেলাম, যাতে তিনি তেহরান গেটের কাছে কারখানাসহ একটি সম্পত্তি আমার নামে দলিল করে দিয়েছেন, যার আয় আমার হবে। আমি বিস্মিত হলাম। তাকে হত্য্ াকরার দিন সকালে দলিলটি লিখেছেন বলে মনে হলো। আমি আমার আলখেল্লার পকেটে দলিল লুকিয়ে রাখলাম এবং সম্পত্তি দেখতে চলে গেলাম। সত্যিই সৌভাগ্য আসমান থেকে বর্ষিত হয়।

সম্পত্তি আমার নামে স্থায়ী দলিল করিয়ে নিতে মির্জা সালমানের সহায়তা প্রয়োজন। তিনি আমাকে সাক্ষাৎ দিতে সম্মত হননি। আমি ফেরেশতেহ’র কাছে গেলাম নতুন শাহের দরবারে নুতন ব্যক্তিত্ব ও শাহের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানার জন্য। মির্জা সালমান তাঁর ক্ষমতা সংহত করতে বদ্ধপরিকর। তিনি একটি বিয়ে করেছেন।

কয়েকদিন পর ফেরেশতেহ খবর পাঠালো তার সঙ্গে জরুরী ভিত্তিতে দেখা করার জন্য। সে জানালো মির্জা সালমান শাহের পুত্র হামজাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার জন্য চেষ্টা করছে। আমি পুনরায় মির্জা সালমানের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি সম্মত হন। আমি কারখানাসহ জমির মালিকানা দাবী করলে তিনি চমকে ওঠলেন। আমি হামজার প্রসঙ্গ উল্লেখ করলে তাকে বিচলিত মনে হলো।

মোহাম্মদ শাহের তলবে সাড়া দিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমি ভাবছিলাম যে মির্জা সুলতান আমাকে বরখাস্ত করার ব্যবস্থা করে থাকতে পারেন। আমি পারীর আইনি পরামর্শকের কাছে একটি চিঠি লিখলাম যে আমার মৃত্যু হলে তিনি যাতে আমার বোন জালিলেহকে কারখানাসহ আমার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করেন। বালামণির কাছে চিঠির একটি অনুলিপি দিলাম। আমি প্রাসাদে দরবার কক্ষে প্রবেশ করে মোহাম্মদ শাহকে দেখতে পেলাম না, সোনালি সূচিকর্মে মোড়া আসনে বসে আছেন শাহের স্ত্রী খায়ের উন-নিসা। তিনি ইরান সাস্রাজ্যের রানি। তিনি আমার সম্পর্কে তার মূল্যায়ন জানান, আমি সুযোগ বুঝে আমার বোন জালিলেহ সম্পর্কে বলি যে তিনি এ ব্যপারে কোনো আনুকূল্য দেখাতে পারেন কিনা। তিনি তাকে হেরেমে স্থান দিতে সম্মত হন।

বালামণি তার কর্মজীবন শেষ করে হিন্দুস্থানে চলে যান। আমি মহাফেজখানায় লিপিকারদের সঙ্গে কর্তব্য পালনের জন্য নিয়োজিত হই। আরও কয়েক সপ্তাহ পর আমি খবর পাই য়ে জালিলেহ কাজভিনের পথে রওয়ানা হয়েছে এবং দশ দিনের মধ্যে পৌছবে। নির্দিষ্ট দিনে শহরের বাইরে এক সরাইখানায় এক কাফিলা এসেছে জেনে আমি সেখানে গিয়ে ভিড়ের মাঝে জালিলেহকে খুঁজতে থাকি। হঠাৎ আমি আমার নাম উচ্চারিত হতে শুনলাম “পায়াম! পায়াম!” আমি ফিরে জালিলেহকে শণাক্ত করার আগেই সে শীর্ণ হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি আল্লাহর প্রশংসা করলাম। আমি আবেগে আপ্লুত। বারো বছর যাবত আমরা বিচ্ছিন্ন ছিলাম।

জালিলেহকে নিয়ে আমি তেহরান গেটের কাছে কারখানাসহ আমার সম্পত্তিতে পৌছলাম। কারখানায় গম থেকে আটা তৈরি হতে দেখে সে হতবাক হয়েছে। ওকে বললাম যে কারখানটি আমাদের। সে আরও বিস্মিত হলো।

পরদিন আমি জালিলেহকে হেরেমের নারীদের কাছে হস্তান্তর করলাম। ধীরে ধীরে সে প্রশিক্ষণ লাভ করবে, প্রাসাদের নিয়মরীতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠবে। আমার মাঝে পারীর স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে। আমি পারীর জীবন কাহিনি লেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম। তাঁর সঙ্গে জড়িত প্রতিটি ঘটনা সততার সঙ্গে তুলে ধরবো, যাতে ইরানবাসীরা প্রজন্ম পরম্পরায় তাদের সাম্রাজ্যের মহান এক নারীর কথা জানতে পারে, যিনি সবকিছুর উর্ধে বিবেচনা করতেন সাম্রাজ্যের স্বার্থ। তিনি নিখূঁত হীরকখণ্ডের মত ছিলেন। যিনি ছিলেন সূর্যের মত উজ্জ্বল।

(লেখক পরিচিতি: অনিতা আমিরেজওয়ানি ইরানি বংশোদ্ভুত আমেরিকান। তাঁর বাবা ইরানি এবং মা লিথুয়ানিয়ান-আমেরিকান। ১৩ বছর বয়স থেকে ইরানে তার বাবার পরিবারে কাটাতে শুরু করেন এবং ইরান, বিশেষ করে ইস্ফাহানের প্রেমে পড়েন। ১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবের সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন এবং ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করার পর সাংবাদিকতা শুরু করেন। বর্তমানে তিনি স্যান ফ্রান্সিসকোর ক্যালিফোর্নিয়া কলেজ ও সনোমা ষ্টেট ইউনিভাসির্টিতে শিক্ষকতায় নিয়োজিত।)