মাই স্টোরি

[ভারতের বিখ্যাত লেখিকা কমলা দাশ ১৯৩৪ সালে কেরালার মালাবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০০৯ সালে মারা যান। অর্ধশতাধিক উপন্যাস ও বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা কমলা দাশ লেখালেখি করেছেন মালয়ালম ভাষায় এবং তিনি মালয়ালম ভাষার সেরা সাহিত্যিকদের অন্যতম।  তার বহু গ্রন্থ ইংরেজিসহ ভারতের প্রধান ভাষাগুলোতে অনুদিত হয়েছে। কমলা দাশ ভারতীয় নারীসমাজের মুক্তির নতুন পথপ্রদর্শন করেছেন তার লেখনীর মাধ্যমে। তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘মাই স্টোরি’ সত্যের প্রতি তার প্রেমের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। লক্ষ লক্ষ ভারতীয় পাঠক তার এই গ্রন্থ পাঠ করে তাদের তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। প্রশংসাও কুড়িয়েছেন তিনি। সমালোচনার কণ্টক তাকে বিদ্ধ করেছে, ক্ষতবিক্ষত করেছে। হুমকির মুখে পড়েছেন। এক পর্যায়ে হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করায় ভারতজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। তিনি নতুন নাম গ্রহণ করেন ‘কমলা সুরাইয়্।া’ তিনি বলেছেন যে ধর্মান্তুরিত হওয়ায় তার আত্মীয়স্বজনরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। মৌলবাদী হিন্দুরা তাকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছে। ইসলাম গ্রহণের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেছেন যে, ইসলামের সারল্য এবং এ ধর্মে নারীর নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা তাকে মুগ্ধ করেছে। সংবাদ মাধ্যমগুলো তার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘প্রকৃত সত্য আল্লাহই ভালো জানেন।’ ভারতীয় সমাজে নারীর অমর্যাদাকর অবস্থা সম্পর্কে তার আত্মোপলব্ধি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিটি শয্যা হচ্ছে এক একটি ক্রুশ, যে ক্রুশে নারীকে প্রতিনিয়ত বিদ্ধ করা হচ্ছে। মানুষ লালসার শিকার হয়, প্রেমে পড়ে না। আর নারী আত্মবিধ্বংসী প্রকৃত প্রেমে বিধ্বস্ত হয়।”

কমলা দাশ তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘মাই স্টোরি’র ভূমিকায় লিখেছেন, “প্রথম বার হৃদরোগে আক্রান্তু হবার পর ডাক্তার ভেবেছিলেন, লেখার কাজ আকস্মিক মৃত্যুর ভয় থেকে আমার মনকে সরিয়ে রাখবে। অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভ আমার ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। আমার ধারাবাহিক লেখা সাময়িকীতে প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে কেরালার প্রতিটি বুকস্টলে প্রচুর বিক্রি হচ্ছিল। আমার আত্মীয়স্বজনরা খুব বিব্রত হচ্ছিলেন। আমার বিখ্যাত পরিবারকে আমি অপমানিত করেছি পাঠকদের একথা জানিয়ে যে, আইনগতভাবে বিবাহিত স্বামীর বাইরে এক পুরুষের সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কেন, আমি তো স্বীকার করেছি যে, উজ্জ্বল প্রতিভার একাধিক লোকের প্রেমে পড়েছি আমি। একবার আমার নিজ রাজ্য কেরালায় অবকাশ যাপনে গেলে কেউ আমাকে স্বাগত জানায় নি। তড়িঘড়ি আমাকে বোম্বে ফিরে আসতে হয়েছে বোম্বেতে। আমার অনেক প্রিয় জিনিসের বিনিময়ে, বহু ত্যাগ স্বীকার করে এ গ্রন্থ রচনা করেছি। কিন্তু মূহূর্তের জন্যেও মনে করি নি যে এটা লিখে আমি ভুল করেছি। কিন্তু ‘মাই স্টোরি’ লিখে যতটা আনন্দ পেয়েছি, আর কোনটা লিখে তা পাই নি।”

মাই স্টোরি’র একটি অংশ পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করা হলো:

ইউরোপীয় স্কুলে এক বাদামি শিশুর নিপীড়ন

কলকাতায় যখন আমি শৈশবে বেড়ে উঠছিলাম, তখনো বৃটিশরা ভারত শাসন করছিল। কিন্তু ভালো পারিপার্শ্বিকতায় তারা আমাদের সাথে সম আচরণ করত। একটি বৃটিশ পরিবারের জন্য ভারতীয়দের মধ্যে দু-একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব থাকা স্বাভাবিক ছিল যাদের মধ্যে যাতায়াতের সম্পর্ক থাকতো।

তখন আমার বাবার ঊর্ধতন কর্তা টাক মাথা, লালমুখো এক ভদ্রলোক ছিলেন, যার নাম ছিল রস, আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলেই তিনি বাবাকে বলতেন ‘আমার ভালো বন্ধু নায়ার।’ তার আগমনে আমরা সকলে উল্লসিত হতাম।

বছরে একবার আমরা যখন দাদিমার সঙ্গে কাটাতে এক মাসের জন্যে মালাবার যেতাম, তখন আমাদের বাবুর্চিকে মিসেস রসের কাছে রেখে যাওয়া হতো, যাতে তিনি তাকে ইউরোপীয় রান্না শেখাতে পারেন। প্রতিটি ছুটিতেই বাবুর্চি ইউরোপীয় রান্নায় অধিকতর হাত পাকাতো এবং আমাদের খাদ্যাভাস পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্তু তার রপ্ত করা রান্না আমাদের খেতে হতো।

ভাত ও তরকারি ছাড়াও সে পরিবেশন করত স্যুপ, কাটলেট ও স্ট্যু। আমার মার জন্যে সে রান্না করত ভাত ও ডাল, কারণ সে মনে করত মার খাদ্যভ্যাস পরিবর্তনের সময় আর নেই। বাবা খাওয়ার সময় কাঁটাচামচ ও ছুরি ব্যবহার করতেন। ছোটরা, আমার বড় ভাই ও আমি আগেভাগেই খেয়ে নিতাম কোন খবরদারি ছাড়াই। আমাদের ছোট ছোট আঙুলে পাশ্চাত্যের খাবার তুলে মুখে পুরতাম, আঙুল চেটে পরিষ্কার করতাম, প্লেটে যা পরিবেশন করা হতো মজা করে সব গোগ্রাসে খাওয়ার সময় বাবুর্চি পাশে-দাঁড়িয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকতো। সে আমাদের জংলি বলে ভাবতো।

বাবা তার কর্মস্থল অটোমোবাইল ফার্মে সবসময় ব্যস্ত থাকতেন। ভারতীয় যুবরাজ ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের কাছে রোলস রয়েস, হাম্বার, বেন্টলি গাড়ি বিক্রি করতেন। আমার মা অত্যন্তু নিরবিচ্ছিন্নভাবে একটি বড় খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে মালয়ালম কবিতা লিখে সময় কাটাতেন। তখন আমাদের স্থায়ী কোন পরিচারিকা ছিল না। বাবুর্চি এক ফার্লং (আট ফার্লং এ এক মাইল) দূরের স্কুলে আমাদের দিয়ে আসত এবং বিকেলে স্কুল থেকে নিয়ে আসত।

খুব স্নেহশীল প্রকৃতির ছিল না সে। বলা যায়, আমরা কমবেশি অবহেলার মধ্যে বেড়ে উঠছিলাম এবং যেহেতু একটি সামাজিক গণ্ডিতে নিজেরা যে অবহেলিত শিশু তা আমরা অনুভব করতাম, সেজন্যে আমাদের সমবয়সীদের মধ্যে গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল; এ ভালোবাসা ঠিক সে ধরনের যা একজন কুষ্ঠরোগী ঠেলায় বসে ভিক্ষা করতে বের হয়ে তার ঠেলা ধাক্কা দিয়ে নেয়ার সঙ্গীটি সম্পর্কে অনুভব করে।

আমার ভাইটি মোটা ও কালো। তার চোখ উজ্জ্বল গোলাকৃতির। যদিও তার ক্লাসে সে সবচেয়ে চতুর, শ্বেতাঙ্গ ছেলেরা তাকে নিয়ে মজা করত এবং একদিন তার নাকে একটি চোখা পেন্সিল ঢুকিয়ে দিয়েছিল। রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল তার সার্টের সামনের অংশ। শ্বেতাঙ্গদের নিষ্ঠুরতায় হতবাক হলেও সে একটুও কাঁদে নি। উইলিয়াম নামে একটি ছেলে বিস্ময় প্রকাশ করে বলে উঠে, ‘ব¬্যাকি, তোমার রক্তও লাল!’ আমি উন্মত্তের মতো মুখে খামচাতে শুরু করি। কিন্তু অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছেলেরা আমাকে ছাড়িয়ে দেয়। ওরা সবসময় শ্বেতাঙ্গদের অধিকারের পক্ষে ছিল। স্কুলের সাদা ইউনিফর্মের নিচে বাদামি চামড়ার কারণে যে নির্যাতন সহ্য করতে হতো আমরা বাড়ি ফিরে তা বাবা মাকে বলতাম না।

আমাদের স্কুলে কখনো কখনো কোন না কোন বিশেষ মর্যাদাবান অতিথির আগমন ঘটতো। কখনো গভর্ণরের স্ত্রী, সাদা গোঁফধারী এডমিরাল অথবা ধূসর সিল্কের জামা পরিহিত লেডি, যিনি বাকিংহাম প্যালেসে রাজপরিবারের সাথে তার সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করতেন।

আমি জানি না আমাদের লেডি প্রিন্সিপাল, যাকে আমরা ম্যাডাম বলি, তিনি কিভাবে এ ধরনের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বকে স্কুল পরিদর্শনে আসতে আকৃষ্ট করেন। আমাদের স্কুলটা খুব বড় ছিল না। সম্ভবত আমরা অন্যদের চেয়ে উচ্চস্বরে জাতীয় সঙ্গীত ‘রুল ব্রিটানিয়া’ গাইতে পারতাম। সকালে ম্যাডাম যখন বড় পিয়ানোর সামনে বসতেন, যার উপরে বৃটিশ রাজ পরিবারের রঙিন ছবি স্থাপন করা; আমরা পিয়ানোর সুরের সাথে গলা মেলাতাম, গাইতাম, ‘ব্রিটনস নেভার নেভার শ্যাল বি স্লেভস’ তখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া পোস্টম্যানও তার গতি মন্থর করত। উজ্জ্বল ফ্রেমে বাঁধানো ছবির মধ্য থেকে রাজা ষষ্ঠ জর্জ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন, যেন তিনি জানেন যে, ভারতে বৃটিশরা তাদের রূপকথার গানটি গাইছে। শার্লি টেম্পলের সোনার আংটি ও দেঁতো হাসির চেয়ে তার রেগে উঠাকে ছোট ছোট মেয়েরা অনুকরণ করত। পিয়ানোর পিছনের দেয়ালে তার একটি ছবি টানানো ছিল। আমাদের ক্লাসে আরেকজন শার্লি ছিল। সে স্কটিশ, তার গোলাপি গাল এবং আঙুলে হলুদ আংটি পরা। বিশিষ্ট অতিথিরা যখন আসতেন, সবসময় শার্লিই তাদেরকে ফুলের তোড়া তুলে দিতো।

একবার তাকে আমার রচিত একটি কবিতা পাঠ করার জন্যে বলা হলো এবং পাঠ শেষ হলে অতিথি জানতে চাইলেন, কে কবিতাটি লিখেছে, তখন প্রিন্সিপাল বললেন, নিশ্চয়ই শার্লি নিজেই লিখেছে। কারণ তার মাঝে সৌন্দর্য ও মেধার সমন¦য় ঘটেছে। এরপর গভর্ণরের স্ত্রী তাকে চুমু দিয়ে বলেন, কি সুন্দর ছোট্ট পুতুল।

কেউ স্কুল পরিদর্শনে এলে বাদামি শিশুদের সবসময় লুকিয়ে ফেলা হতো, কার্পেটের নিচে ঢেকে রাখার মতো। পায়খানার পিছনে করিডোরে অপেক্ষা করতে বলা হতো তাদের, যেখানে স্কুলের আয়ারা তাদের সঙ্গ দিতো। তখনকার দিনে আমাদের কেউই দেখতে খুব সুন্দর ছিল না। আমরা ছ’জন ছিলাম। কালো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান লুইস মনস্থির করতে পারত না যে, কোন পক্ষে যোগ দেবে। শ্বেতাঙ্গ শিশুরা আমাদের ঘৃণা করলে, লুইসকে আরো বেশি ঘৃণা করত, কিন্তু সে শ্বেতাঙ্গদের অনুসরণ করে ফিরতো, ভাঁড়ের অভিনয় করে তাদের হাসাতো, কুকুরের মতো ডাকতো, গাধার মতো চিৎকার করত …

২.

শৈশবের দুঃস্বপ্ন এবং একমাত্র ভালো বন্ধু

১৯২৮ সালে আমার বাবা যখন বিয়ে করেন তখন দেশে মহাÍা গান্ধীর প্রভাব তুঙ্গে। তিনি যে সহজ সরলতার কথা প্রচার করতেন মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। বাগদান সম্পন্ন হবার পর বাবা কঠোরভাবে চিন্তুা করতে থাকেন যে তার স্ত্রী খদ্দর ছাড়া আর কিছু পরবে না এবং তাও সাদা বা ঘিয়ে রং এর। বিয়ের পরই তাকে শুধুমাত্র তার ‘মঙ্গলসূত্র’ ছাড়া সকল সোনার অলংকার খুলে ফেলতে বাধ্য করেন। মার কাছে এটা বিধবার পোশাক পরিধানের মতো মনে হলেও তিনি কোন প্রতিবাদ করেন নি। একজন কালো আগন্তুক তাকে গ্রামের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, এজন্যে তিনি ভীত হন নি। তার বাবা ও চাচার কারণে ভীত ছিলেন— এই দুজনই তার পরিবারে এমন একজন বরকে আনার ব্যাপারে পরিকল্পনা করেছিলেন, যে বর কোন রাজপরিবারের সদস্য ছিল না, এমনকি ব্রাহ্মণও ছিল না।

নালাপাত পরিবারের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তখন অত্যন্তু অনিশ্চিত ছিল। দেউলিয়াত্ব কাটানোর জন্যে পরিবারের সব অলংকার বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। আমার বাবা অলস জমিদার ছিলেন না। জীবিকার জন্যে তিনি কলকাতায় কাজ করতেন। এটি তার ভালো দিক ছিলো।

তরুণ দম্পতি যখন কলকাতায় যায়, তখন আমার দাদিমাও তাদের সাথে যান যাতে তারা ভালোভাবে সংসার শুরু করতে পারে। আমার মা বাবার প্রেমে পড়েন নি। তারা বিপরীত চরিত্রের ছিলেন এবং সঠিক জুটি হয় নি। কিন্তু মা’র শান্তুভাব ঘরে শান্তিুর ছায়া ছড়িয়ে রেখেছিল যা আমাদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সন্তুষ্ট রাখত। তাদের প্রেমহীন বিশুষ্ক মিলনে প্রথম দুটি সন্তুানের জন্ম হয় — আমার ভাই ও আমি, কালো চামড়া এবং সাধারণ বৈশিষ্ট্যের।

আমরা নিশ্চয়ই বাবা মাকে নিদারুণভাবে হতাশ করেছি। যদিও তারা আমাদের তেমন বলেন নি, কিন্তু প্রতিটি আচরণ ও উচ্চারিত শব্দে তা স্পষ্ট ছিল। যেদিন বাবা আমাদের উদ্দেশে চিৎকার করতেন এবং প্রতিমাসে জোলাপের জন্যে খাঁটি ক্যাস্টর অয়েল খাওয়ানোর জন্যে জবরদস্তি করতেন তখন আমাদের প্রতি এই বিরূপতা প্রকট হতো।

ব্যাপারটি শৈশবে আমাদের দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিল। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠিয়ে ক্যাস্টর অয়েল ভরা ছোট গ্লাস মুখে ঢেলে শক্ত হাতে মুখ চেপে রাখা হতো, যাতে আমরা বিস্বাদ তরলটা গিলে ফেলি। এ প্রক্রিয়া শেষ হলে আমরা বালিশে মাথা গুঁজে কাঁদতাম, নিপীড়নের অশ্রু গড়িয়ে পড়ত দুচোখ থেকে।

ক্রমে আমরা নিজেরাই উপলব্ধি করতে শিখলাম যে, বাবা মা’র কাছ থেকে দূরে থাকাই নিরাপদ। কিচেনের কাছাকাছি লুকিয়ে থাকতাম এবং দুজন মিলে কথা বলতাম। সুইপার ও মালির সঙ্গে কথা বলতাম। মালি প্রতিদিন সকালে আমাদের বাড়ির পিছনে ইউরোপীয় কবরস্থান থেকে ফুল তুলে ড্রয়িংরুমের ফুলদানি সাজাতো।

মোটর কার কোম্পানির রিপেয়ার কারখানার উপরের তলায় আমরা থাকতাম। সেখানে উঠতে ছত্রিশটি সিঁড়ি ডিঙ্গাতে হতো। মাঝপথে ডানদিকে একটি দরজা সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে যাওয়ার জন্যে। যেখানে একটি ফুটো পাইপ দিয়ে শব্দ করে পানি ঝরতো। প্রস্রাবের কটু গন্ধ নাকে আসত, যা সিঁড়ি দিয়ে উঠানামার সময় প্রত্যেককে বিস্মিত করত যে গন্ধটা আসছে কোত্থেকে। কিন্তু উপরের তলায় ড্রয়িংরুমে ফুলের গন্ধ ভেসে বেড়াত। যদিও তখন আমাদের খুব অতিথি আসত না। আমাদের জানালায় সাদা খদ্দরের পর্দাগুলো প্রতি পনের দিনে বদলে দেয়া হতো। ছুটির দিনে আমার ভাই ও আমি বড় জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে দেখতাম এবং কখনো কখনো জানালা দিয়ে রাবারের খেলনা ঝুলিয়ে পথচারীদের আকৃষ্ট করতাম। কেউ খেলনার দিকে হাত বাড়ালে আমরা দ্রুত তা তুলে ফেলতাম এবং বেডরুমে আত্মগোপন করতাম এই ভয়ে যে, তারা আমাদের ধরতে আসছে। আমাদের জন্যে এ এক মজার খেলা ছিল।

আমাদের একজন মাত্র ভালো বন্ধু ছিল, তিনি আমাদের হাত স্পর্শ করতেন এবং সাধারণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। এই ভদ্রলোকের নাম মেনন। মোটর কার কোম্পানির স্টোর ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন তিনি। গরমের বিকেলে মা যখন ঘুমিয়ে পড়তেন তখন আমরা সন্তুর্পণে ঘর থেকে বের হয়ে তার সাথে দেখা করতাম। তিনি বড় কাপে চা-এর অর্ডার দিতেন এবং ফু দিতে দিতে গোঁফ ভিজিয়ে চা এ চুমুক দিতেন। কলকাতায় আরেকটি মালয়ালী পরিবারের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তাদের দুটি ছেলে এবং ছোটটি ক্ষীণ পাণ্ডুর—তার একটি পুতুলের ঘর ছিল, একবার আমরা তাদের বাড়ি গেলে আমাদের দেখিয়েছিল সে ঘরটি। আমাদের বন্ধু মেননকে ঘরটির ব্যাপারে বলায় তিনি বেশ উৎসাহিত হয়েছিলেন এবং এক মাসের মধ্যে তিনি আমার জন্যে পুরোপুরি সজ্জিত একটি বড়োসড়ো পুতুলের ঘর নিয়ে এলেন। গোল টেবিলটির উপর স্থাপন করা হলো পুতুলের ঘর এবং রাতের বেলা যখন ঘরের বাতিগুলোর সুইচ অন করা হতো তখন তাজমহলের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠতো এটি। আমাদেরটির তুলনায় বন্ধুর ঘর কুড়ের মতো। যখন তখন দৌড়ে গিয়ে আমরা পুতুল ঘরটির দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম অথবা ঘরের ছাদের লাল রং এর গন্ধ অনুভব করতাম।

ড্রয়িংরুমের পশ্চিম দিকের জানালাগুলো খুললে কারখানার ঢেউটিনের ছাদ দৃষ্টিতে পড়ত। ছাদের উপর বানরের লাফালাফির শব্দও কানে আসত। বানরগুলো বাস করত খ্রিস্টানদের কবরস্থানের গাছে। মাঝে মধ্যে দু-একটি বানর আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করে নারিকেল বা রান্নাঘর থেকে রুটি নিয়ে পালাতো। একদিন বাবুর্চি যখন চুরি করে পলায়নপর বানরকে নোংরা ভাষায় গালি দিচ্ছিল, তখন সুইপার তাকে সতর্ক করলো, ‘ঠাকুর, বানরকে এভাবে গালি দিও না, তিনি হয়তো ভগবান হনুমান, স্বয়ং তোমার ভক্তি পরীক্ষা করতে এসেছেন।’

বাবুর্চি মোটেও ধার্মিক ছিল না। সকল হিন্দু দেবতাকে সে ঠাট্টা করত, তাতে ঠিকা ঝি ও সুইপারের মনে আঘাত লাগতো। একদিন সুইপার বলল যে, বাবুর্চির বিলাত চলে গিয়ে সেখানেই থাকা উচিত, যেন সে একজন সাহেব। বাবুর্চি উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ, যাবোই তো। মিসেস রস, সেই সাদা মেসসাহেবকে বললেই আমাকে তার বাবুর্চি হিসেবে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাবে। আমিও এদেশ ছাড়তে চাই।” সুইপার সন্দেহের হাসি হাসে। বিড়বিড় করে, রাম! রাম!

৩.

আমার প্রতিটি কবিতা আমাকে কাঁদায়

স্কুলে যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে শুভ কোন দিনে বাবুর্চি আমাদেরকে নেসলে’র চকোলেট কিনে দিতো, যেগুলো লাল চকচকে কাগজে মোড়ানো থাকতো এবং মোড়কের দ্বিতীয় ভাঁজে থাকতো বৃটিশ রাজ পরিবারের একটি রঙিন ছবি। এই ছবি আমরা যথেষ্ট সংখ্যক সংগ্রহ করেছিলাম, যা জমা দিয়ে ডিলারের কাছে একটি অ্যালবাম দাবি করতে পারি।

একটি রাজনৈতিক অ্যালবামের জন্যে সংবাদপত্রের কাটিং সংগ্রহের অভ্যাস হয়েছিল আমাদের। এতে হিটলার ও মুসোলিনীর ছবিও ছিল, যারা সে সময় আমাদের চোখে সন্দেহাতীতভাবে মহান বীর ছিলেন। সংবাদপত্রগুলো তাদের বক্তৃতার বিস্তারিত বিবরণ ছাপতো এবং এভাবে তাদেরকে সুপারম্যান হিসেবে গড়ে তুলেছিল। আমরা মনে মনে তাদের মতো হওয়ার আশা পোষণ করতাম।

এ সময়ে আমার ভাই হাতে লিখে ম্যাগাজিন বের করার কথা ভাবলো। আমাদের সমবয়সী বন্ধুবান্ধব কেউ কোন প্রবন্ধ, গল্প বা কবিতা দিলো না। কারণ বানানের ব্যাপারে তারা ভিন্নরকম ভাবতো। অতএব পুরো দায়িত্ব পড়লো আমার কাঁধে।

আমার বয়স ছয় বছর এবং খুব আবেগপ্রবণ ছিলাম। আমার যেসব পুতুলের মাথা ছিল না এবং অবশিষ্ট সময় মাথাহীন অবস্থায় কাটাতে হবে তাদের নিয়ে আমি দুঃখের কবিতা লিখতাম। আমার প্রতিটি কবিতা আমাকে কাঁদাতো। আমার ভাই কবিতাগুলোকে চিত্রিত করত এবং নিজে রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখতো।

আমাদের দুজন শিক্ষক ছিলেন। ম্যাবেল, সুন্দরী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা এবং মালয়ালম শিক্ষক নামবিয়ার। লেডির প্রতি বাবুর্চির পক্ষপাতিত্ব ছিল। একটি ট্রেতে কোয়ার্টার প্লেটে স্যান্ডউইচ ও চা পরিবেশন করত। আর সন্ধ্যায় নামবিয়ার পড়াতে এলে শুধু এক গ্লাস গরম চা দেয়ার সাথে কিছু ব্যঙ্গোক্তি করত। নামবিয়ার আমাদের বাড়ি আসতেন অত্যন্তু হীনমন্যতাবোধ নিয়ে এবং ডাইনিং রুমে যেখানে আমরা পড়তাম বাবা সেদিক দিয়ে গেলে নামবিয়ার দ্রুত একটি বোর্ডের আড়ালে লুকাতেন। আমরা জানতাম যে, আমাদের মালয়ালম শিখতে হচ্ছে শুধুমাত্র দাদিমার সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুবিধার জন্যে, যিনি আমাদের খুব আদর করেন।

একবার আমাদের স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীকে বনভোজনে নেয়া হলো ভিক্টোরিয়া গার্ডেনে। আমাদেরকে আঁখের রস এবং শূকরের মাংসের স্যান্ডউইচ দেয়া হলো। নিরামিষভোজী হওয়ার আমি ফুলগাছের ঝোপের পিছনে স্যান্ডউইচ ছুড়ে দিলাম। তরুণী স্কুল মিস্ট্রেস শুধু চিৎকার করছিল, ‘ওহ আর্চি, ওহ্ আর্চি।’ কালো ইতিহাস শিক্ষক তার পিছু নিয়ে চুমু দেবার চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল। মিস্ট্রেস তার খপ্পর থেকে বাঁচতে গাছের আড়ালে লুকোচ্ছিল, যেন পুরো ব্যাপারটাই তামাশা।

আমি বাগানের সবচেয়ে দূরের প্রাচীরের কাছে মেহেদি গাছের নিচে শুয়ে ছিলাম। গাছে ছোট ছোট ফুল। দিনটি স্বচ্ছ, শীতের আকাশে সূর্যের উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আমি একা ছিলাম। সেদিন নিজেকে এতো নিঃসঙ্গ মনে হয়েছে। কেউ আমার সঙ্গ চাইছে বলে মনে হচ্ছিল না। এমনকি আমার ভাইও না। তার এক সহপাঠীর সঙ্গে বল খেলছিল সে। একমাত্র হেলেনই নাচতে পারত, সে অন্যদের বলছিল ‘দ্য ব্লু বার্ড’ ছায়াছবির কাহিনী। ভেবে অবাক হলাম যে, তাকে ঘিরে মেয়েদের ভিড়ে আমি যোগ দেই নি কেন?

আমার কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল যে, একটি শ্বেতাঙ্গ দম্পতির পরিবর্তে ভারতীয় দম্পতির ঘরে কেন আমার জন্ম হলো। আমার শ্বেতাঙ্গ বাবা মা হয়তো আমার কবিতা নিয়ে গর্ব অনুভব করতেন। সহসা কঠোর ভৎর্সনা আমার একাকিত্বের উপর হামলা করলো। শিক্ষকের চিৎকার কানে এলো, ‘মাটিতে শুয়ে তুমি কি করছো কমলা? অন্যদের সঙ্গে তুমি যোগ দিচ্ছো না কেন? কি আজব বাচ্চা তুমি।’ সাদা সূর্য তার একাকিত্ব নিয়ে আমার চোখকে পূর্ণ করলো। মেহেদি ফুলের গন্ধ আমাকে আপ্লুত করলো। কাঁদতে কাঁদতে আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং শিক্ষকের কাছে গেলাম। ছেলেমেয়েরা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। শিক্ষক হেসে উঠলেন, যেন এ হাসি অন্যদের হাসি শুরু করার সংকেত। তারাও উচ্চ হাসিতে যোগ দিলো। গাছের ডালে বসে থাকা পাখিরা উড়ে গেল …।

কোন কোন বিকেলে আমি আস্তে আস্তে গেট দিয়ে বের হয়ে যেতাম। মোটা প্রহরী খাটিয়ার উপর গভীর ঘুমে নিমগ্ন থাকতো। আমি হেঁটে পুরনো কবরস্থানে চলে যেতাম। কবরের গাত্রে প্রোথিত পাথরগুলো হলদে দাঁতের মতো বিবর্ণ এবং অর্ধশতাব্দীর বৃষ্টিপাতে লেখাগুলোও অস্পষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু পাথরে উৎকীর্ণ কথাগুলো পড়তে শিহরণ লাগে, যেগুলো অস্পষ্ট হয় নি। কি শিহরণ জাগানো তথ্য যে, এলিজাবেথ হার্ডিং ১৮১৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩৮ সালে মারা যান। এলিজাবেথ কে? কে রজার আপটন, যার মৃত্যু হয়েছিল ‘মাত্র’ তিরাশি বছর আগে? রোজামুন্ড কে? কবরস্থানে বানর ছাড়া আমিই একমাত্র জীবন্তু প্রাণী। কিন্তু রক্তের মতো লাল বোগেনভিলিয়া মিনার বেয়ে উঠে বাতাসের সাথে দুলছে। গাঁদা ফুল সৌজন্যে মাথা ঝুঁকিয়ে আছে। বানরগুলো আমার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাদের বাচ্চাকে দুধ পান করাচ্ছে। ভূত সম্পর্কে জানার বয়স আমার হয় নি। আমার জন্যে মৃতদের গভীরভাবে ভালোবাসা সম্ভব, ঠিক যেভাবে জীবিতদের ভালোবাসি। আমি অজ্ঞাত পরিচয় রোজামুন্ডের কাছে গিয়ে তার সাথে কথা বলতে পারি। মৃতদের নিকট থেকে কোন কঠোরতা আসবে না, কোন নিষ্ঠুরতাও নয় …

৪.

প্রণয়ী গোষ্ঠীপ্রধানের দান নালাপাত হাউজ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন ভয়ঙ্কর আতংক হিসেবে ছড়িয়ে পড়ার হুমকিতে পরিণত হলো তখন বাবা সিদ্ধান্তু নিলেন আমাদের মালাবারে  পৈতৃক বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে। বাড়িটির নাম নালাপাত হাউজ।

স্থানীয় মানে বাড়িটি বড় না হলেও বাড়ির ভিতরে একটি চত্বর এবং প্রধান হলরুমের দক্ষিণ দিক খোলা একটি মন্দির ছিল। গেট হাউজের মাঝ দিয়ে একটি খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে বিলাসবহুলভাবে সজ্জিত বেডরুমে, যেখানে রাতে বড় চাচা ঘুমাতেন। কয়েকটি স্তম্ভের উপর একটি পোর্টিকোর পর আরেকটি উঁচু পোর্টিকো, যেখানে বছরের বেশ ক’টি অনুষ্ঠানে নর্তকীরা নাচতো। একটি হলরুমে বসে পরিবারের পুরুষেরা তাদের খাবার খেতো এবং মহিলাদের জন্যেও আরেকটি ডাইনিং হল ছিল। এছাড়া ছিল সার্ভেন্ট কোয়ার্টার, নিচতলায় তিনটি ছোট বেডরুম, দোতলায় তিনটি বেডরুম, সরু একটি বারান্দা ও চিলেকোঠা। চিলেকোঠায় পুরনো বাক্স পেটরা ও পালকি রাখা হতো।

বাড়ির দক্ষিণ দিকে একটি সর্প-মন্দির, যেটি কমপক্ষে দুহাজার বছরের পুরনো। মন্দিরে রেনুকা ও তার পিতা বাসুকির মূর্তির পূজা হয়। মন্দির ছাড়িয়ে খানিক দূরে মৃতদের এলাকা—শ্রদ্ধাপুরা। মৃতদের মৃত্যুবার্ষিকীতে খাবার পাকানো হয় এখানে। এছাড়া নারিকেল বাগান, যেখানে প্রতিটি মৃতের দাহের পর তার স্মরণে একটি নারিকেল গাছ রোপন করা হয়। পুকুরের কাছে একটি ম্লানঘর। চাকরেরা বিকেলে ম্লান সেরে উঠে গেলে পানি থেকে উঠে আসত একটি কুমীর এবং রোদে শুয়ে হা করে থাকতো।

বাড়ির উত্তর দিকে গোশালা এবং ফসল উঠানোর খামার। সব কাঠামোকে ছেয়ে আছে অসংখ্য গাছের পাতায় সাজানো সবুজ চাঁদোয়া, যে গাছগুলো রোপণ করা হয়েছিল আমাদের এক মহিলা পূর্বসূরি কুঞ্জীর মধুচন্দ্রিমার সময়ে। ফুল বা ফলশোভিত বড় বড় গাছ বাড়ির চারদিকে সবুজ ছায়া বিস্তার করে রেখেছে, যেখানে আমরা সারাদিন খেলতাম।

আমাদের পূর্বসূরি কুঞ্জী যখন ১৫ বছর বয়সে বধু হিসেবে আসেন তখন তার স্বামী তাকে বাড়িটি উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। কোচিন থেকে পালিয়ে আসেন তিনি; শত্রু ম্লারা অক্রান্তু সে শহরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। কুঞ্জী তার চাচার সাথে গিয়েছিলেন এক আত্মীয়ের বিয়েতে। এক অভিজাত যুবককে তার সাথে সাক্ষাৎ করানোর কথা ছিল, যদি তিনি সেই যুবককে পছন্দ করেন এবং তার চাচা অনুমোদন করেন তাহলে বিয়ে হয়ে যাওয়াই স্থির ছিল।

কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এসব মধুর পরিকল্পনা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল না। ওলন্দাজদের শক্তিকে দুর্বল করার জন্যে কোম্পানি তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য বন্দর জ্বালিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তু নিয়েছিল। এর কিছুদিন আগে তারা শহরটিও দখল করে নিয়েছিল ওলন্দাজদের নিকট থেকে। কোচিন তখন সুন্দর উদ্যান ও রাস্তা ম্লারা সজ্জিত ছিল। ওলন্দাজরা পর্তুগিজ গির্জাগুলোকে গুদামে পরিণত করে। তারা ধার্মিক ছিল না, কিন্তু তাদের শিল্পবোধ ছিল চমৎকার। সঙ্গীতের সুরের মতো সুন্দর রাস্তার নাম দিয়েছিল তারা। যেমন, ডি লিন্ডে স্ট্রাট, ডি ব্লুমেনডাল স্ট্রাট।

ওলন্দাজ ও তাদের শেষ ভারতীয় গভর্ণর ভন স্পালের উপর আক্রোশ মিটানোর জন্যে বৃটিশ গভর্ণর বারুদ ব্যবহার করে চমৎকার গুদাম, ব্যবসায়ী ও নায়ার ব্যারনদের সুন্দর সুন্দর বাড়ি উড়িয়ে দেয়। নারী ও শিশুদের আগুনে পুড়ে মারা হয়। বৃটিশদের নিরব সমর্থন ও তাদের মিত্রদের সহযোগিতায় জ্বলন্তু নগরী থেকে প্রাণ নিয়ে যারা পালাতে সক্ষম হয়েছিল, ভয়ঙ্কর কাহিনী বলার মতো অবস্থা তাদের ছিল না।

কুঞ্জী একজন চাকরকে সঙ্গে নিয়ে লাল ও সোনালি রং এর দুটি ওলন্দাজ ট্রাংকসহ কোচিন থেকে পালিয়ে বাড়ির পথ ধরেছিলেন। কিন্তু অ্যালেঙ্গাদের এক গোষ্ঠীপ্রধান তার পথ পরিবর্তনে বাধ্য করে তাকে নিজের এলাকায় নিয়ে বিয়ে করেন। জ্যোতিষ শাস্ত্রে এবং স্থাপত্য বিদ্যায় তার প্রচুর জ্ঞান ছিল। তিনি নালাপাত হাউজের স্থান নির্বাচন এবং বাড়ির নকশা তৈরি করেন।

বাড়িটির উত্তর ও পূর্ব দিকে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। পশ্চিম দিকে নীল নিঃসীম আরব সাগর এবং রাতের বেলায় উত্তাল সাগরের অবিশ্রান্তু গর্জন ভেসে আসে। সর্প-মন্দিরের কাছে দুর্লভ নির্মাতলা গাছ। প্রতি গ্রীষ্মে বড় বড় মাখন রং এর ফুল ফুটে গাছটি অপূর্ব শোভা ধারণ করে। প্রতিটি কক্ষ ফুলের সুগন্ধে ভরে যায়।

শৈশবে আমরা যখন নালাপাত হাউজে যেতাম, তখন সেখানে চাকররা ছাড়া সাতজন লোক বাস করত। দাদিমা, পিসি আম্মিনি, বড় চাচা, বড় দাদিমা, তার দুই বোন ও মহাÍাজি। কোন কাজ শুরুর আগে বাড়ির বয়স্কা মহিলারা ফিসফিস করতেন, মহাÍাজি কি অনুমতি দেবেন? যেন তিনি মহাÍা গান্ধী, নালাপাত হাউজের প্রধান। প্রত্যেক রুমে তার ছবি টানানো। এমনকি চাকররাও তার উপস্থিতি অনুভব করে খদ্দর পরতে শুরু করেছিল।

দাদিমা বিকেলে একটি চরকায় খাদি সুতা কাটতেন। অন্যেরা তখন ঘুমাতো এবং পুরনো জানালাগুলো রোদে শব্দ করত। দাদিমা মোটা ছিলেন। তিনি ফর্সা ও দেখতে সুশ্রী। যখনই তাকে জড়িয়ে ধরেছি তখন তার গলায় চন্দন কাঠের সুবাস পেয়েছি। পরিবারের সব মহিলা একবার হরিজন তহবিলে তাদের অলংকার দান করতে গুরুভাউর গিয়েছিল। তিনি সে কাহিনী আমাকে বলেছিলেন।

মহাÍাজি হিন্দি ও ইংরেজিতে কথা বলেছেন, যা তাদের কেউই বুঝতে পারেন নি। কিন্তু তার হাসি তাদেরকে সম্মোহিত করেছে। সব অলংকার তাকে দিয়ে দিয়েছেন তারা। আমার মনে হলো, গান্ধীজী একজন দস্যু, যদিও আমি তখন মনের কথাটা বলি নি। আমার আরো মনে হলো যে, তার যাদুকরী লক্ষ্য হচ্ছে নারীদেহের সব সুন্দর আভরণ খুলে নেয়া, যাতে তারা সাদাসিদে ও নিরাসক্ত হয়ে যায়। আমার জীবনের সেই দিনগুলোতে কৃচ্ছতা অর্থহীন এবং নিষ্ঠুর তামাশা মনে হয়েছে।

আমার পিসি আম্মিনি অত্যন্তু আকর্ষণীয়া মহিলা ছিলেন, যিনি সব বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করে দিচ্ছিলেন। তিনি সবসময় সাদা খাদি পরতেন এবং তার দীঘল ঢেউ খেলানো চুলে তেল ব্যবহার করতেন না। তিনি সন্যাস জীবন বেছে নিয়েছিলেন, কিন্তু যখন তার কক্ষে একাকী সুগন্ধি পারিজাত গাছের মুখোমুখি জানালার পাশে বসতেন তখন কবি কুমারানাসানের প্রেমের কবিতা আবৃতি করতেন। সে সময় তার কবিতা জনপ্রিয় ছিল। তার কণ্ঠে প্রেমের কবিতা শুনেই প্রথমবারের মতো আমার মনে হয়েছে যে, প্রেম একটি মধুর যন্ত্রণা এবং এক ধরনের ‘তপস্যা’ …।

আমার বড় চাচা নারায়ণ মেনন একজন খ্যাতিমান দার্শনিক কবি। তিনি পোর্টিকোতে বসতেন। যেখানে কয়েকটি ইজি চেয়ার পাতা ছিল এবং টেবিলে বড় বড় বই। তার চেয়ারের উপর একটি টানা পাখা ঝুলানো। দূরে একজন চাকর দড়ি ধরে টানলে পাখা দুলতো। চেয়ারের পাশে একটি হুকা, যেটি প্রতিদিন সকালে চাচি পরিষ্কার করতেন। বড় চাচাকে দেখতে একজন রাজার মতো মনে হতো। যদিও তার পছন্দের বই কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। পোর্টিকোর দক্ষিণ পাশে লাইব্রেরি, যেখানে বিচিত্র সব বই এর সংগ্রহ। ব্লাভাটস্কি, গুরদজিয়েক, হ্যাভেলক এলিস, বরাহমিহির প্রমুখের বই। নালাপাত হাউজে তালপাতার পাণ্ডুলিপির চমৎকার সংগ্রহ ছিল, যার অধিকাংশই ভাট্টেজুথু অক্ষরে লিখিত, সম্ভবত এ ভাষা মালাবারে এসেছিল ফোনেসীয়দের থেকে।

বড় চাচা নিঃসঙ্গ মানুষ ছিলেন। কাছাকাছি তার কোন বন্ধু জীবিত ছিল না, যাদের সাথে তিনি তার আগ্রহের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। যারা আসত তাদের সাথে তিনি সাহিত্য জগতে যেসব নোংরা কাহিনী ভেসে বেড়াচ্ছে সেসব নিয়ে আলোচনা করতেন এবং প্রাণখুলে হাসতেন, করতালি দিতেন। তিনি রসিকতা করতেন এবং জীবনের শেষ পর্যায়ে যখন চোখে ছানি পড়ায় বই পড়া অসম্ভব হয়ে পড়লো তখনও তিনি উৎফুল্ল থাকতেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আলোচনায় ঝুঁকে পড়তে চেষ্টা করেছেন তখন।

বড় চাচার সান্ধ্য দরবারে মাঝে মধ্যে মেধাবী ব্যাকরণবিদ ও লেখকরা আসতেন দূর থেকে। তার সাথে আলোচনার সময় তাদের জিভ আড়ষ্ট থাকতো। তার উপস্থিতিতে সম্ভ্রমে সন্ত্রস্ত থাকতেন।