কিংবদন্তি তুর্কি স্থপতি মিমার সিনান

জুইফা পারভীন

(কিংবদন্তি তূল্য তুর্কি স্থপতি মিমার সিনান সাড়ে তিনশ’র অধিক ভবনের নকশা তৈরি ও সেসব নকশা অনুসরণে স্থাপনা নির্মাণ তদারকি করেছেন। তাঁর পুরো নাম কোকা মিমার সিনান আগা। তিনি ১৪৮৯ অথবা ১৪৯০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫৮৮ সালের ১৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। অটোম্যান সুলতান সুলায়মানের শাসনামলে তিনি তাঁর অধিকাংশ স্থাপত্যকর্মের নকশা তৈরি করেন। এর মধ্যে রয়েছে ৮২টি গ্র্যান্ড মসজিদ, ৫২টি ছোট মসজিদ, ৫৫টি মাদ্রাসা, ৭টি দারুল কুররা বা গবেষণা কেন্দ্র, ২০টি মাযার, ১৭টি ইমারেত বা উসমানীয় লঙ্গরখানা, ৩টি দারুস শিফা বা হাসপাতাল, ৬টি জলপথ, ১০টি ব্রিজ, ২০টি কারাভানসেরাই বা সরাইখানা, ৩৬টি প্রাসাদ, ৮টি ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার, ৪৮টি গোসলখানা বা হাম্মাম।)

অটোমান বা উসমানীয় স্থাপত্যশিল্পের দুনিয়ায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম হল মিমার সিনান যাকে অনেকেই ‘স্থপতি সিনান’ বলে চেনেন। স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে উসমানীয় সুলতানদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিভা তাঁর সুনামকে সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিল। সিনানের ৪৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করছেন তুরস্কসহ আরও বহু দেশের আধুনিক স্থপতি ও ইতিহাসবিদরা।

জানা যায়, ১৪৯০ খ্রিস্টাধে তুরস্কের কায়সেরি প্রদেশের আগিরনাস গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সিনান। এরপর ইয়াভুজ সুলতান সেলিমের শাসনামলে তাঁকে ‘দেভশিরমে’ বা সুলতানের সেবক হিসাবে ইস্তান্বুলে নিয়ে আসা হয়। সুলতান ইয়াভুজের সঙ্গে মিশর অভিযানে গিয়ে সিনান স্থাপত্য ও শহরের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, সেলজুক ও সাফাবিদ আমলের স্থাপনা ও ভবনগুলি পরীক্ষা করে দেখে তাঁর জ্ঞানের বহর বাড়তে থাকে। ১৫২০ সালে ‘সুলেইমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট’ বা উসমানীয় সুলতান প্রথম সুলেইমানের শাসনকাল শুরু হয়, যিনি ছিলেন একজন তুর্কিযোদ্ধা।  ১৫২১ সালে বেলগ্রেড ও ১৫২২ সালে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের রোডস অঞ্চলে সুলতান সুলেইমানের অভিযান সফল হলে তাঁর প্রভাব ও প্রতিপত্তি আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠে।

সুলতান সুলেইমানের আমলেই নিজের পূর্ণ প্রতিভা বিশ্বের কাছে মেলে ধরেন স্থপতি সিনান। লুফতি পাশার নির্দেশে তুরস্কের তাতভান শহরে ৩টি পালতোলা যুদ্ধনৌকা বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সিনান। সেই নৌকায় পারদর্শিতার সঙ্গে কামান ও রাইফেল বসিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এই নৌকায় করে লুফতি পাশা ১৫৩৪ সালে ইরাক অভিযানে গিয়ে সাফাবিদ সেনাবাহিনী সম্পর্কে বহু তথ্য উদ্ধার করেছিলেন।

যাই হোক না কেন, সিনানের মূল লক্ষ্য ছিল সুলতান সুলেইমানের (কানুনি সুলতান) পাশে থেকে কাজ করা ও একজন পরিপূর্ণ স্থপতি হয়ে ওঠা। এই উসমানীয় সম্রাটের অধীনে বিভিন্ন উচ্চপদে চাকরিও করেছেন সিনান। তবে জেনারেল পদে লুফতি পাশার নিয়োগের পর প্রথমবারের মতো সুলতান সুলেইমান সিনানের প্রশংসা করেছিলেন।

১৫৩৮ সালে কারাবাখে (মলদোভা) উসমানীয় সৈন্যদের যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ১৩ দিনের মধ্যে একটি শক্তপোক্ত সেতু বানিয়ে দিয়েছিলেন সিনান। এর ফলে সিনানকে উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রধান স্থপতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন সুলতান সুলেইমান। পরবর্তীকালে সিনান সামরিক চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্থাপত্যবিদ্যার দিকে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন। সুলতান সুলেইমান, সুলতান দ্বিতীয় সেলিম ও সুলতান দ্বিতীয় মুরাত-এর শাসনকালে অন্তত ৪৯ বছর ধরে উসমানীয় সালতানাতের প্রধান স্থপতি ছিলেন তিনি।
জীবনের শেষভাগ পর্যন্ত দেশ ও জাতির জন্য উদ্ভাবনমূলক কাজ করে গিয়েছেন তিনি। ১৫৮৮ সালে ইস্তান্বুলে ইন্তেকাল করেন সিনান। তাঁর সমাধিটি রয়েছে সুলেমানিয়ে কমেপ্লক্সে, যেটি ওপর দিক থেকে দেখতে ঠিক একটি কম্পাসের মতো। সিনানের নামে তৈরি প্রতিষ্ঠানের তরফে জানানো হয়, উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রধান এই স্থপতির স্ত্রীর নাম ছিল মিহরি হাতুন। তাঁদের তিন সন্তান ছিল। এদের মধ্যে সিনানের একমাত্র সন্তান মুহাম্মদ যুদ্ধে শহিদ হন। তাঁদের দুই কন্যার নাম নেসলিহান ও উম্মুহান।

প্রবাদপ্রতিম এই উসমানীয় স্থপতি তাঁর ৫০ বছরের পেশাদারি জীবনে শত শত ছোট-বড় বিল্ডিং নির্মাণ ও মেরামত করেছেন। তিনি ৩৫০টিরও বেশি ভবনের নকশা বানিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ৮২টি গ্র্যান্ড মসজিদ, ৫২টি ছোট মসজিদ, ৫৫টি মাদ্রাসা, ৭টি দারুল কুররা বা গবেষণা কেন্দ্র, ২০টি মাযার, ১৭টি ইমারেত বা উসমানীয় লঙ্গরখানা, ৩টি দারুস শিফা বা হাসপাতাল, ৬টি জলপথ, ১০টি ব্রিজ, ২০টি কারাভানসেরাই বা সরাইখানা, ৩৬টি প্রাসাদ, ৮টি ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার, ৪৮টি গোসলখানা বা হাম্মাম। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজগুলির মধ্যে মসজিদ ও ভবন নির্মাণ থাকলেও ব্রিজ ও কৃত্রিম জল-প্রণালী তৈরি করে তিনি সবক্ষেত্রেই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। শুধুমাত্র তাই নয়, ১৬ শতকে স্থাপত্যবিদ্যা চর্চার পাশাপাশি উসমানীয় টালি, ক্যালিগ্র্যাফি, খোদাইকাজ ও অলঙ্কার শিল্পের প্রতিও তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল।

প্রধান স্থপতি হিসেবে সিনান শুধু মসজিদ, কমপ্লেক্স বা সেতুই নির্মাণ করেননি, তিনি বিভিন্ন এলাকায় কাজ করেছেন এবং কিছু পুরনো ভবন পুনরুদ্ধার করেছেন। আয়া সোফিয়া মসজিদকে অক্ষত রাখতে বিশেষ অবদান ছিল সিনানের। ১৫৭৩ সালে তিনি এই ঐতিহাসিক মসজিদের গম্বুজটি মেরামত করেছিলেন এবং এর চারপাশের প্রাচীরকে আরও শক্তিশালী করেছিলেন। প্রাচীন উসমানীয় স্মৃতিস্তম্ভের কাছাকাছি থাকা ক্ষয়প্রাপ্ত ও অপ্রয়োজনীয় কাঠামোগুলিকে ভেঙে ফেলাও তাঁর কাজের মধ্যে ছিল। উসমানীয় স্থাপত্যের সৌন্দর্য রক্ষায় জেইরেক মসজিদ ও রুমেলি দুর্গের আশপাশ থেকে বহু দোকান ও ঘর তাঁর নির্দেশে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তিনি জলপথ নির্মাণ, ইস্তান্বুলের রাস্তার প্রস্থ বৃদ্ধি, বাড়ি-ঘর নির্মাণ এবং শহরের নর্দমা ব্যবস্থা তৈরির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ইস্তান্বুলের রাস্তার সংকীর্ণতার কারণে আগুনের ঝুঁকির কথা প্রথম তাঁর মাথাতেই এসেছিল। রাস্তা সংস্কার সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করেছিলেন তিনি।

নিজের পেশাদারি জীবনকে সিনান তাঁর তিনটি বিশিষ্ট কাজ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। ১৫৪৮ সালে তাঁর নির্মিত শেহজাদে মস্ককে তিনি ‘শিক্ষার কাজ’ (ওয়ার্ক অফ অ্যাপ্রেন্টিসশিপ) বলে উল্লেখ করেন, ১৫৫৭ সালে সুলেমানিয়ে মস্ক বানিয়ে তিনি বলেন, এটি হল (জার্নিম্যানশিপ) বা শিক্ষিত ও দক্ষ লোকের কাজ এবং ১৫৭৫ সালে সেলিমিয়ে মস্ক বানিয়ে তিনি বলেন, এটি হল (ওয়ার্ক অফ মাস্টারি) বা ওস্তাদের কাজ। এর মধ্যে শেহজাদে মসজিদটি সুলেইমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট তাঁর ২২ বছরের মরহুম ছেলে শেহজাদে মুহাম্মদের স্মৃতি হিসেবে চালু করেছিলেন। ১৫৫১-১৫৫৭ সালের মধ্যে সুলেমানিয়ে মসজিদটি সুলতান প্রথম সুলেইমানের নির্দেশে স্থপতি সিনান দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।
ইস্তান্বুলে অবস্থিত সুলেমানিয়ে কমপ্লেক্সটিও উসমানীয় স্থাপত্যকলার এক অনন্য নিদর্শন। দশকের পর দশক ধরে বহু প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহ্য করে তা এখনও একই রকম রয়েছে। তবে স্থপতি সিনানের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম হিসাবে বিবেচনা করা হয় এদিরনে প্রদেশের সেলিমিয়ে মসজিদকে। এই মসজিদটি উসমানীয় সাম্রাজ্যের পাশাপাশি বিশ্বের স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসেও এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। সুলতান দ্বিতীয় সেলিমের নির্দেশে নির্মিত চারটি মিনার বিশিষ্ট মসজিদটি দেখে বোঝা যায় যে, সিনান একজন দক্ষ নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ ছিলেন।


(কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূবের কলম এর সৌজন্যে)