শেরে বাংলা উর্দুকে বাঙালি মুসলমানদের শিক্ষার মাধ্যম করতে চেয়েছিলেন

(১৯৩৯ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্সে প্রদত্ত ভাষণ)

উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বক্তব্য দেওয়ার কারণে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মুসলিম লীগ নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেছিল এবং বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন শুরু করেছিল, তা ক্রমে পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে এবং শেষপর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচণ্ড সংগ্রামের রূপ নিয়েছিল। কিন্তু শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ১৯৩৯ সালে যখন বঙ্গীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষা মন্ত্রী ছিলেন, তখন অবিভক্ত বাংলায় বাঙালি মুসলমানদের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে উর্দু চালু করার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন।  
১৯৩৯ সালের ২৯-৩১ সেপ্টেম্বর কলকাতার মোহাম্মদ আলী পার্কে অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের ৫২তম বার্ষিক অধিবেশনে প্রদত্ত সভাপতির ভাষণে শেরে বাংলা ফজলুল হক বলেন, “আমি জানি, বাংলার মুসলমানসহ অনেকে চান যে স্কুলে উর্দু বাধ্যতামূলক করা হোক। কিন্তু বর্ণহিন্দুদের একাধিপত্যবাদী গোষ্ঠী, যারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে পৈতৃক উত্তরাধিকারে পরিণত করেছে এবং বাঙ্গলার স্কুলের পাঠ্যক্রমের উপর আধিপত্য বিস্তার করে আছে, তারা চায় না মুসলমানদের এই ইচ্ছা পূরণ হোক। যেখান থেকে উর্দুর বিরোধিতা হচ্ছে তা দূর করা হলে বাংলায় মুসলমানদের জন্য উর্দুকে একটি বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে জারি করার পথে আর কোনো বাধা থাকবে না।”

উর্দুতে দেওয়া শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের ভাষণের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হলো। তাঁর ভাষণ বাংলায় অনুবাদ করেছেন কাজী একরাম

 

ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, 

আমি, বাংলার মুসলমানদের পক্ষ থেকে, অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের এই ৫২ তম বার্ষিক সভার সমস্ত সদস্য, প্রতিনিধি এবং মন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করছি। গত বছর, ১৯৩৮ সালে পাটনায় অনুষ্ঠিত মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার সময়, কনফারেন্সের পরবর্তী অধিবেশন বাংলায় অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। আলীগড়ে অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের স্থায়ী কমিটি আমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং ১৯৩৮ সালের ১২ নভেম্বর কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, এই অধিবেশন ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরের ২৯-৩০- ৩১ তারিখে কলকাতার মোহাম্মদ আলী পার্কে অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। প্রয়োজনীয় আয়োজনের জন্য যথারীতি একটি সংবর্ধনা সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে কনফারেন্সকে সফল করার জন্য সম্ভাব্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়। কলকাতার এই অধিবেশন সর্বদিক থেকে সফল ও ফলপ্রসূূ হোক এটাই আমাদের কামনা।

অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের এটি বাংলায় চতুর্থ, কলকাতায় তৃতীয় এবং মোহাম্মদ আলী পার্কে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় অধিবেশন। কনফারেন্সের প্রথম অধিবেশন ১৮৯৯ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সভাপতিত্ব করেন ফখরে বাঙ্গাল এবং ফখরে মিল্লাত মাননীয় সৈয়দ আমীর আলী। দ্বিতীয় অধিবেশন ১৯০৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সভাপতিত্ব করেন প্রয়াত বিচারপতি শরফুদ্দীন এবং যার মূল আহ্বায়ক ও অনুপ্রেরণা ছিলেন প্রয়াত নবাব খাজা স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুর। ঢাকার অধিবেশন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, কারণ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ঢাকার এই প্ল্যাটফর্মেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল,  যেখানে নবাব ভিকারুল মুলক বাহাদুর, নবাব মহসিনু মুলক বাহাদুর, মাওলানা মুহম্মদ আলী জওহরের ন্যায় জাতির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ শরিক ছিলেন এবং এই অধমও এর প্রধান সেবকদের একজন ছিল। কনফারেন্সের তৃতীয় অধিবেশন ১৯১৭ সালে মোহাম্মদ আলী পার্কের মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এর মূল চেতনা ছিলেন আমার প্রয়াত বন্ধু, কলকাতা হাইকোটের অ্যাডভোকেট মৌলভী ওয়াহিদ হোসেন সাহেব, যিনি ছিলেন মুসলিম শিক্ষার একজন মহান সেবক। সেই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন আমার বন্ধু স্যার আকবর হায়দারি, নবাব হায়দার নওয়াজ জং বাহাদুর, দাক্ষিণাত্যের আসফিয়া হায়দরাবাদ দওলতে ইসলামিয়া’র সরকারের প্রধানমন্ত্রী।

অধম এই সব অধিবেশনে কেবল অংশগ্রহণই করেনি; বরং সর্বপ্রকার বাস্তব সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে আজ বাংলার রাজধানীতে এই অধিবেশন উপলক্ষে আমি বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করছি। আমি কনফারেন্সের নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে কাফেলার অগ্রসেনানী স্যার সৈয়দ আহমদ, মুসলমানদের শিক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ মাওলানা হাবিবুর রহমান খান শেরওয়ানী, নবাব সদর ইয়ার জং বাহাদুর সাহেবের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই, তাঁরা বাংলার মুসলমানদের স্বরণ করেছেন এবং এই অঞ্চলের মুসলমানদেরকে অন্যান্য প্রদেশের মুসলমানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার, আলোচনা ও মত-বিনিময় করার এবং সামগ্রিকভাবে ইসলামি ভারতের কল্যাণ বিবেচনা করার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন।

অতীতের এই উল্লেখে আমি যেমন খুশি, তেমনি একটি দুঃখ আমার হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে রেখেছে। বাংলা ও ভারতের এই প্রবীণদের চেহারা আজ আমাদের চোখে ভাসছে, যারা গতকালও এই কনফারেন্সের আকাশের সূর্য-চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র ছিলেন এবং যারা দুর্ভাগ্যবশত আজ অস্তমিত হয়েছেন। তাদের ছড়িয়ে দেওয়া আলোয় জাতির বর্তমান উজ্জ্বল এবং ভবিষ্যত উজ্জ্বলতর হবে। আল্লাহ তাঁদের কঠোর পরিশ্রম এবং ভালবাসাকে কবুল করুন আর মুসলিম মিল্লাতের তরুণদের তাঁদের আত্মদান, আন্তরিকতা, নৈতিকতা ও অন্তর্দহন দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করুন এবং জাতির স্বার্থে সর্বস্ব ত্যাগ করে কাজ করার উদ্যম দান করুন!

কনফারেন্সের অতীত ইতিহাসের স্মরণ আমাদের সামনে আরো এক বেদনাবহ বাস্তবতাকে স্পষ্ট করছে। অল্পকাল আগে, বাংলা, শিক্ষাগত অনগ্রসরতা এবং অর্থনৈতিক দারিদ্র সত্ত্বেও ইসলামি ভারতের জাগরণ ও উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, যা ১৯০৬ সালে ঢাকার নিখিল ভারতীয় মুসলিম লীগের ভিত্তি স্থাপনের সভা থেকে স্পষ্ট হয় এবং এর প্রতিষ্ঠাতাদের তালিকায় বাংলার মুসলিম নেতাদের নাম খুবই বিশিষ্ট। এমনকি অতীতে বাংলা ইসলামি ভারতের সাথে সম্পূর্ণভাবে যুক্ত ছিল, বাংলার শিক্ষিত মুসলমানরা ইসলামি ভারত ও ইসলামি বিশ্বের আন্দোলন, গতিবিধি ও চাহিদা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক যে, কিছু সাংস্কৃতিক কারণে এই সংযোগ ও শৃঙ্খলা মানসিক ও শিক্ষাগত উভয় দিক থেকে ক্রমশ ক্ষীণ ও দুর্বল হয়ে পড়েছে। আজ আমরা অনুভব করছি যে, বাংলার মুসলিম শিক্ষিত শ্রেণী মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অন্যান্য প্রদেশের শিক্ষিত মুসলমানদের থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং পুরনো প্রজন্মের মনীষীদের হাতে বাংলা ও ইসলামি ভারতের মধ্যে যে সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল, তা ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তন গত ৩০-৪০ বছরের মধ্যে কীভাবে এবং কেন ঘটে গেল এবং কীভাবে এই মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংযোগহীনতা ও বিচ্ছিন্নতাকে পারস্পরিক সংযোগ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা যায়, তা এই কনফারেন্সের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মহান আল্লাহ আমাদের এই মানসিক ব্যবধান পূরণ করার এবং একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করার সামর্থ্য দান করুন!

কিন্তু বেদনাদায়ক স্মৃতিকথা শোনাতে আজ আমি এখানে দাঁড়াইনি, বরং আধুনিক ইসলামি হিন্দুস্তানের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল, আশাব্যঞ্জক এবং আনন্দদায়ক আন্দোলন সম্পর্কে একটি পর্যালোচনা করতে চাই। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পরে, আলীগড় আন্দোলনই একমাত্র আন্দোলন, যে আন্দোলনকে বাস্তবতার নিরিখে ভারতীয় মুসলমানদের সবচেয়ে সফল ও গঠনমূলক সর্বভারতীয় আন্দোলন বলা যেতে পারে। ভারতীয় মুসলমানদের আর কোনো সংগঠিত আন্দোলন এত দীর্ঘস্থায়ী বা এত সফল হয়নি, এবং যদি শুধুমাত্র এর সফলতা বিবেচনা করা হয়, তবে নিঃসন্দেহে এটিকে সঙ্গত কারণেই আধুনিক ভারতের আধুনিক ইতিহাসের একটি মহান স্বর্ণ-অধ্যায় হিসেবে বর্ণনা করতে পারি।

আলীগড় আন্দোলনের সূচনা এবং আলীগড়ে মাদ্রাসাতুল উলূম প্রতিষ্ঠার কিছু সময় পর ভারতীয় ইসলামি জাতীয়তার মহান সংস্কারক, জাতীয় নেতা, মিল্লাতের উদ্ধারকর্তা স্যার সৈয়দ আহমদ কর্তৃক অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স প্রতিষ্ঠিত হয়। স্যার সৈয়দ অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের প্রথম অধিবেশনে, যা ১৮৮৬ সালের ডিসেম্বরের ২৭-২৮-২৯ তারিখে আলীগড়ে মৌলভী সামিউল্লাহ খান বাহা দরসি এম. জি. এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, অল ইন্ডিয়া মজলিস প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে সর্বপ্রথম প্রস্তাব পেশ করতে গিয়ে তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল এবং ইসলামি হিন্দুস্থানের আধুনিক জাতীয়তা, জাগরণ ও বিকাশের ইতিহাসের অগ্রভাগ হিসেবে অভিহিত হওয়ার যোগ্য। এই ভাষণটি বিদ্রোহ-পরবর্তী হিন্দুস্তানের মুসলমানদের জাতীয় ভাঙন ও ধ্বংস এবং বর্তমান উন্নয়ন ও অবস্থার তুলনা করার সুযোগ করে দেয়। এবং এতে এটাও জানা যায় যে, আলীগড়ে প্রতিষ্ঠিত এডুকেশনাল কনফারেন্স ভারতর্ষে ইসলামি জাতীয়তার পুনর্গঠন ও সংস্কারে কত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এবং ১৮৫৭ এর বিদ্রোহের পরে জাতি হিসেবে আমরা কোথায় এবং কোন অবস্থানে ছিলাম এবং আজ ১৯৩৯ সালে, আল্লাহর অনুগ্রহ এবং স্যার সৈয়দ এবং কাসিম নানুতুবিদের মতো আধুনিক ভারতের ইসলামি জাতীয়তার স্থপতিদের আধ্যাত্মিক বিজয়ের বদৌলতে কোথায় এবং কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি? কোন দিকে যাচ্ছি এবং কোন দিকে যাওয়া উচিত?

সামগ্রিক বিচারে ভারতের ইসলামি জাতির সাম্প্রতিক অতীত কী ছিল, বর্তমান কী এবং ভবিষ্যৎ কী হওয়া উচিত? এই সামষ্টিক দৃষ্টিকোণ থেকে জাতির সার্বিক অবস্থার পর্যালোচনা করা জাতীয় আত্মবোধ ও জাতীয় চেতনার জাগরণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, বরং জাতি নির্মাণের জন্য ‘আত্মদর্শনে’র এই শর্ত এক অপরিহার্য পূর্বশর্ত।

হিন্দুস্তানি মুসলিম জাতির সংস্কারক স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলিম অল ইন্ডিয়া এডুকেশনাল কনফারেন্স প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করার সময় ১৮৮৬ সালে, নিম্নলিখিত ভাষণ প্রদান করেন :

ভদ্রমহোদয়গণ,

এই কংগ্রেসে জাতীয় শিক্ষা বিবেচনা করার জন্য একত্রিত হওয়া এই কংগ্রেসে প্রথম প্রস্তাব উত্থাপন করার সম্মান আমাকে দেওয়া হয়েছে, এবং তা হলো, মুসলমানদের অবস্থার অবনতি এখন এমন স্তরে পৌঁছেছে যে, সারা ভারতজুড়ে এমন একজন লোকও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে এটা স্বীকার করবে না এবং অনুশোচনা করবে না। আমাদের দশা এখন এমন হয়েছে যে, অন্য জাতির লোকেরাও আমাদের জন্য অশ্রু ফেলে এবং আমাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য দান-খয়রাতের অর্থ সংগ্রহ করার চেষ্টা করে। নিঃসন্দেহে, আমাদের সেই স্বদেশী হিন্দু ভাইদের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া দরকার, যারা দাক্ষিণাত্য প্রদেশে এমন একটি অভিপ্রায় করেছেন। কিন্তু আমাদের জাতির মধ্যে কিÑ যাদের পূর্বপুরুষদের কৃতিত্বের খ্যাতি পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল এবং যাদের কলম ও তরবারির গৌরব-চিহ্ন ইতিহাস জুড়ে এবং বিশ্বের একটি বড় অংশে এখনও পাওয়া যায়- স্বজাতির বিধ্বস্তঅবস্থার সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেওয়ার মতো যথেষ্ট সম্মান ও সাহস অবিশিষ্ট নেই? যারা মনে করেন যে, রাজনৈতিক বিষয়ে বিতর্ক ও আলোচনা করলে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন হবে, আমি এর সাথে একমত নই, বরং আমি বিশ্বাস করি শিক্ষা এবং একমাত্র শিক্ষাই জাতীয় উন্নয়নের মাধ্যম। আমাদের জাতির এই সময়ে শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া আর কিছুর জন্য সংগ্রাম করার প্রয়োজন নেই। আমাদের জাতির শিক্ষার যথেষ্ট উন্নয়ন হলে সেটাই অবনতির অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে যথেষ্ট হবে। সুতরাং ভাবনার বিষয় হচ্ছে এটাই যে শিক্ষার উন্নয়ন কীভাবে হবে? এই সময়ে আমাদের অবস্থা এমন যে, আমাদেরকে ‘মুসলিম জাতি’ বলা হলেও, এক জায়গায় বসবাসকারী লোকেরা অন্য জায়গায় বসবাসকারীদের সাথে তেমনই অপরিচিত, যেমন একটি বিদেশী জাতি অন্যের অবস্থা সম্পর্কে অনবগত। আমরা জানি না, পাঞ্জাবের জনগণ তাদের জাতীয় শিক্ষা ও জাতীয় উন্নয়ন সম্পর্কে কী ভাবছে এবং তারা কী করেছে এবং কী করা উচিত। পাঞ্জাব তো অন্য একটি প্রদেশ। আমরা নিজের প্রদেশেরই এক জেলার বাসিন্দা অন্য জেলার বাসিন্দার পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। এমন কোনো মাধ্যম আমাদের কাছে নেই যে, বিভিন্ন জেলার মানুষ কোনো উপলক্ষে পরস্পরে এক জায়গায় একত্রিত হবে, একজনের অবস্থা সম্পর্কে অন্যজন অবগত হবে, আমরা একত্র হয়ে জাতীয় শিক্ষা ও জাতীয় উন্নয়ন সম্পর্কিত আমাদের ধারণাগুলো অন্যদের সাথে শেয়ার করতে পারবো এবং একে অপরের সাথে মত-বিনিময় করবো। আমাদের ভাবনা-চিন্তায় যে ভুল-বিচ্যুতি থাকবে, তা অন্যের চিন্তা-ভাবনার আলোকে ভালোভাবে সংশোধন করে নেবো। বিভিন্ন জেলার মানুষের জড়ো হওয়ার দ্বারা পারস্পরিক বোঝাপড়া, পারস্পরিক ভালবাসা ও আন্তরিকতা, পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ঐক্য গড়ে উঠবে। আমরা একক মুসলিম জাতি হওয়া সত্ত্বেও, বিভিন্ন জাতি হয়ে আছি, আমাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য বরং আমার বলা উচিত ‘জাতীয়তা’ সৃষ্টি করতে হবে। এই অনবগতি ও বিচ্ছিন্নতা আমাদের থেকে জাতীয় সহানুভূতি মুছে দিয়েছে। তাই আমাদের একত্রিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে জাতীয় সহানুভূতি তৈরি হবে বা যতটা আছে তার মধ্যে আরও বিকাশ ঘটবে।

এসব অভিমত এই প্রস্তাব পেশ করে যে, মুসলমানদের শিক্ষা ও উন্নয়ন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার জন্য প্রতি বছর বিভিন্ন স্থান ও বিভিন্ন প্রদশের মানুষ এক জায়গায় জড়ো হওয়া উচিত, যাতে এক প্রদেশ ও জেলার মাধ্যমে অন্য প্রদেশ ও জেলার মুসলমানরা পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হয় এবং যেসব পদক্ষেপ ও কর্মসূচি তাদের কল্যাণ ও উন্নয়নের বিষয়ে প্রস্তাব করা হয়, আলোচনা-পর্যালোচনার পর তা গ্রহণ করা যায়, যা ভালো বলে বিবেচিত হয়।”

(স্যার সৈয়দ আহমদ ১৮৮৬ খ্রি.)

স্যার সৈয়দের বক্তব্যের সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে:

১. ৫৭- এর বিদ্রোহের পর, মুসলমানদের রাজনৈতিক ও জাগতিক বিপর্যয়ের দশা এমন ছিল যে, স্যার সৈয়দের ভাষায়, বিজাতীয়রাও আমাদের জন্য অশ্রু বিসর্জন করতো এবং দান-খয়রাতের মাধ্যমে আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য অর্থ সংগ্রহ করত।

২. এক প্রদেশের মানুষ অন্য প্রদেশের লোকদের সম্পর্কে, এক জেলার মানুষ অন্য জেলার লোকদের সম্পর্কে এবং এক শহরের মানুষ অন্য শহরের মানুষ সম্পর্কেছিল অজ্ঞ, উদাসীন এবং সম্পর্কহীন।

৩. হিন্দুস্তানের মুসলমানরা নামমাত্র একটি জাতি ছিল। তাদের সঙ্গে ইসলামি জাতীয়তার সকল বন্ধন ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। জাতীয় ঐক্য ও সংহতির অনুভূতি সাধারণ বিপর্যয়ের ধ্বংস-বন্যায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ভৌগলিক, মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক সর্বতোভাবে জাতির সংযোগ-সূত্র বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল। বিশৃঙ্খলা, বিপর্যয় ও বিভ্রান্তির এই কেয়ামতসদৃশ সমস্যায় কারো জিজ্ঞাসার কেউ ছিল না। মুসলমানদের ‘ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি’র অবস্থা বিরাজ করছিল। ভারতবর্ষের ইসলামি জাতির ভিত্তি নড়বড় হয়ে গিয়েছিল, ঐক্যের প্রাচীরগুলো ভেঙ্গে পড়েছিল এবং মুসলমান জাতি ধ্বংসের গহব্বরে রূদ্ধ-নিশ্বাস হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল।

ভারতীয় ইসলামি জাতীয়তার নির্মাণ আন্দোলন

এই হতাশাজনক পরিস্থিতিতে জাতির উদ্ধারকর্তা স্যার সৈয়দ আহমদ খান আল্লাহর নাম নিয়ে উঠে দাঁড়ান এবং আলীগড় থেকে ভারতীয় ইসলামি জাতীয়তার ঢাক বাজিয়ে মুসলমানদেরকে কালের বিপদ থেকে রক্ষা করে শিক্ষা ও প্রগতির পথে নিয়ে আসেন। তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স প্রতিষ্ঠা করেন এবং জাতির সবচেয়ে যোগ্য, সহানুভূতিশীল, পণ্ডিত, আলিম, ওয়ায়েজ, কবি-সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদদের এক প্লাটফর্মে একত্রিত করেন। এরপর হিন্দুস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ ও শহরে এর বার্ষিক সম্মেলন করার ব্যবস্থা করেন, বিশেষ পত্রপত্রিকা বের করেন, উন্নত মানের জাতীয় বা ইসলামি সাহিত্য সৃষ্টিতে উৎসাহ দেন। মুসলমানদের অবস্থার যথাযথ মূল্যায়ন করার জন্য সম্মেলন-সভা উপলক্ষে বিভিন্ন প্রদেশ ও জেলার মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন সংগ্রহ করেন এবং সমগ্র ভারতের মুসলমানদের মধ্যে সাধারণ শিক্ষা ও উন্নয়নের আন্দোলন শুরু করেন এবং তাদের সুপ্ত জাতীয়তার বোধকে জাগ্রত করেন।

জাতিবাদী এই আত্ম-সচেতন ব্যক্তির গড়ে তোলা আলীগড় আন্দোলন সমগ্র ইসলামি হিন্দুস্তান এবং বার্মাকে তার আঁচলে ধারণ করে নিয়েছিল। এমনকি সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব ও সিন্ধু থেকে রেঙ্গুন এবং খাইবার থেকে মালাবার ও মাদ্রাজ এবং ব্রিটিশ ভারত থেকে ভারত রাজ্য পর্যন্ত এর কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয়ে পৌঁছে যায়। উর্দু আন্দোলনের জন্ম হয় এবং একটি মহান বিপ্লবের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স, ৫৭-এর বিদ্রোহের পরে, ইসলামি ভারতের প্রথম যৌথ সংগঠন ও আন্দোলন, যা মাসীহুল মিল্লাত স্যার সৈয়দ আহমদ ১৮৮৬ সালে শুরু করেন। আজ, ডিসেম্বর ১৯৩৯ সালে, এই কনফারেন্সের বয়স বায়ান্ন বছর হবে। বিদ্রোহের পর ভারতের মুসলমানরা বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল, তাদের সরকার ও রাষ্ট্রের অবসান হয়েছিল, তাদের জাতিগত শৃঙ্খলা বিপর্যস্ত হয়েছিল, তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছিল এবং একটি স্থায়ী সাংগঠনিক সত্তা ও জাতীয়তা হিসেবে তাদের অস্তিত্ব ছিল ধ্বংসের কাছাকাছি, সেই সংকটময় সময়ে, স্যার সৈয়দের মহান ব্যক্তিত্ব এবং মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স আলীগড়ের অধীনে উত্থিত সংস্কার আন্দোলন, যা সময়ের বিপ্লবাত্মক বিপদাপদ ও উত্থান-পতন থেকে মুসলমানদের রক্ষা করেছিল এবং শিক্ষা, অগ্রগতি এবং জাতি গঠনের নতুন পথে এনে দাঁড় করিয়েছিল এবং মুসলমানদের মধ্যে মানসিক ও সাংগঠনিকভাবে এক নবপ্রাণের সঞ্চার করেছিল। যার ফল আজ আমরা ইসলামি ভারতের প্রতিটি ক্ষেত্রে সচেতনতা, অগ্রগতি এবং একটি সাধারণ নবজাগরণের আকারে দেখতে পাচ্ছি। হিন্দুস্তানি মুসলমানদের এই নবজাগরণে, নিঃসন্দেহে আলীগড় আন্দোলনের রয়েছে সবচেয়ে বিশিষ্ট অংশ।

স্যার সৈয়দ ১৮৮৬ সালে, আলীগড়ে অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলমানদের মধ্যে ইসলামি ঐতিহ্যের পাশাপাশি আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞান ও শিল্পকলার প্রসার এবং ইসলামি উলূমের নতুন গবেষণা এবং মুসলমানদের সংস্কার ও উন্নয়ন-প্রচেষ্টা ছিল এর লক্ষ্য। ১৮৮৬ সালের পর ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ও শহরে এর বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। দেশে এর প্রাদেশিক শাখা স্থাপিত হয় এবং তাঁর প্রচেষ্টার কল্যাণে, আলীগড় শীঘ্রই ইসলামি ভারতবর্ষের মানসিক কেন্দ্রেপরিণত হয়। যার পরিদর্শনকে জর্জ পঞ্চম, গ্রেট ব্রিটেনের সম্রাট এবং আফগানিস্তানের আমির হাবিবুল্লাহ শাহের মতো রাজা ও সম্রাটগণ প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করেন এবং যার হাতে মুসলিম মিল্লাতের হারানো বিশ্বাস ও মর্যাদা পুনরুদ্ধার হয়। তাঁর সম্মেলনে রাজ্যের গভর্নর থেকে শুরু করে সাধারণ মুসলমান সকলে সমভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং এটি তাঁর অর্ধশতাব্দীর নিরন্তর প্রচেষ্টা এবং আন্দোলনের ফল যে, হিন্দুস্তানের মুসলমানরা ১৮৮৬ এর তুলনায়, আজ নিজেদের জাতীয় দেহে অনেক বেশি স্বাধীনতা, স্বকীয়তা এবং শক্তি অনুভব করছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রগতি করছে এবং আজ তারা তাদের ইসলামি জাতীয়তার শিকড় ও ভিত্তি ভারতবর্ষের মাটিতে স্থিতিশীল ও শক্তিশালী পাচ্ছে এবং আধুনিক বিজ্ঞান ও শিল্পের অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কালের বিপ্লবী পরিবর্তনে মোকাবিলার যোগ্য হয়ে উঠছে। যদি আলীগড় আন্দোলনের উদ্ভব না হত, তাহলে বর্তমান ফিতনাপূর্ণ এই বিপ্লবাত্মক যুগে মুসলমানদের খোদা-ই ছিলেন একমাত্র রক্ষাকর্তা।

১৯০৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, ইসলামি ভারতের একমাত্র সর্বভারতীয় পার্টি প্ল্যাটফর্ম ছিল অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স। এখানেই জাতির সকল সহমর্মীরা প্রদেশ, ফেরকা, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে, মুসলমান হিসেবে একত্রিত হয়ে জাতির উন্নয়ন ও সংস্কারের পরামর্শ ও প্রস্তাবনাসমূহ বিবেচনা করতেন এবং সকল মুসলমানের সাংগঠনিক নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করতেন। এর সেবা ও অবদানের অনুমান করার জন্য এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, ১৮৮৬ সালে যখন এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তখন ভারতে সবেমাত্র ৪৪ জন মুসলমান ছিল যারা উচ্চ ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করছিল এবং তাদের মধ্যে বিশজন ছিল আলীগড়ের। আর আজ এই আলিগড় আন্দোলনের ফল হচ্ছেÑ

১. আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি যা সমগ্র এশিয়া ও প্রাচ্যে তার ধারার প্রধান আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয। এই কনফারেন্স এবং ভারতবর্ষের মুসলমানেরা এর জন্য যত গর্ব করুক না কেন তা কম হবে।

২. আলিগড়ে, মুসলিম নারীদের জন্য একটি বিশেষ ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

৩. সমগ্র দেশে ইসলামি স্কুল, মুসলিম হোটেল, মকতব, শিক্ষা ও জ্ঞানমূলক সমিতির ব্যবস্থা কমবেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আধুনিক পশ্চিমা শিক্ষার প্রতি বিদ্বেষ দূর হয়েছে।

৪. অধিকাংশ প্রদেশে মুসলিম কলেজ গড়ে উঠেছে।

৫. এই আলীগড় আন্দোলন আধুনিক উর্দুর জন্ম দিয়েছে। ‘আঞ্জুমানে তরক্কি উর্দু’, যা উর্দুকে মহান সেবা দিয়েছে, তা মূলত এই এডুকেশনাল কনফারেন্সেরই একটি বিভাগ ছিল। স্যার সৈয়দ আধুনিক উর্দু গদ্যের আদি পিতা এবং মাওলানা আলতাফ হোসেন হালি আধুনিক জাতীয় উর্দু কবিতার প্রথম শিক্ষক ছিলেন। আধুনিক উর্দু জাতীয় সাংবাদিকতার ভিত্তিও আলীগড়ে স্থাপিত হয়। আর এসবই আলীগড় আন্দোলনের আশীর্বাদ।

৬. হায়দরাবাদে ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও রয়েছে আলীগড়ের উর্দু আন্দোলনের সবচেয়ে বিশিষ্ট অবদান, এতটাই বলা যায় যে, আলীগড় না হলে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও হত না।

৭. গ্রীক চিকিৎসার, যা আসলে ইসলামি এবং আরবি চিকিৎসা, এই প্ল্যাটফর্ম থেকে সংস্কার ও পুনর্নবীকরণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যার ফলশ্রুতি আজকের তিব্বিয়া কলেজ (মেডিকেল কলেজ) আলিগড়, তিব্বিয়া কলেজ দিল্লি এবং তিব্বিয়া কলেজ, হায়দরাাবাদ। মসিহুল মুলক হাকিম আজমল খান ছিলেন আলীগড় কনফারেন্স এবং আন্দোলনের একজন মহান নেতা।

৮. জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া দিল্লির প্রতিষ্ঠাতারাও ছিলেন আলীগড়ের সন্তান।

৯. দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামা লখনৌ, যা মাদারিসে আরবিয়ার নবায়ন ও সংস্কার আন্দোলনের একটি কেন্দ্র, এই আলীগড়েরই এক আলিম ও অধ্যাপকের প্রচেষ্টার ফল। এটি ইসলামি মাদ্রাসাগুলিতে আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার প্রচার এবং নতুন গবেষণা নীতি অনুসারে ইসলামি উলূমের প্রকাশ করার চেষ্টায় নিয়োজিত।

১০. এই কনফারেন্স, এর শাখা-প্রশাখা এবং নেতাদের প্রচেষ্টা এবং অবিরাম সংগ্রামের মাধ্যমে, বিভিন্ন প্রবেশে, বিশেষ করে মুসলমানদের শিক্ষাগত চাহিদা এবং সমস্যা সমাধানের জন্য পৃথক শিক্ষামূলক প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়, যাতে ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামি ধর্মতত্ত্ব, সাহিত্য, ইতিহাস এবং সভ্যতার শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। ইউপিতে মিসিটন স্কিম এবং বাংলায় নিউ মাদরাসা স্কিম তার উদাহরণ।

১১.আলীগড় আন্দোলনের নেতারা ছিলেন তাদের সময়ে ভারতীয় মুসলমানদের স্বীকৃত নেতা এবং ছিলেন মুসলমানদের রাজনৈতিক সংগঠনের সূচনাকারী। অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের ঢাকায় অনুষ্ঠিত সভাতেই (ডিসেম্বর ১৯০৬) অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সুতরাং, মুসলিম লীগ প্রকৃতপক্ষে মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের সন্তান এবং এর প্ল্যাটফর্মে জন্মগ্রহণ করেছে।

১২. এই আলীগড় আন্দোলনই ইসলামি ভারতকে ওয়াকারুল মুলক, মহসিনুল মুলক, ইমাদুল মুলক, হালি, শিবলি এবং আলি ভ্রাতৃদ্বয়ের মতো জাতিপ্রেমিক ও মুজাহিদ নেতাদের উপহার দিয়েছে, যারা ভারতীয় মুসলমানদের আধুনিক জাতিসত্তার নির্মাণে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। ১৭৫৭ এর বিদ্রোহের পর, ইসলামি ভারতের জাতীয় শৃঙ্খলা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সামাজিক সংযোগের বন্ধন ভেঙে গিয়েছিল। জাতীয় জীবনের ব্যবস্থা-কাঠামো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ভারতীয় মুসলিম মিল্লাত, তার জাতীয় জীবনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সাংগঠনিক ধারণা এবং সামগ্রিক জীবনের সংঘবদ্ধ চেতনা হারিয়ে ফেলেছিল। এমন একটি সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে আবির্ভূত হয় এই অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স আলীগড় আন্দোলন, যা গত অর্ধ শতাব্দীতে ভারতীয় মুসলমানদের সমষ্টিগত জীবনের ঐতিহ্যকে নিরবচ্ছিন্ন ধারায় বজায় রাখে এবং স্থিতিশীল করে।

নতুন বৈপ্লবিক পরিস্থিতি এবং এর দাবি

ভারতীয় মুসলমানদের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং সুদৃঢ় পরিষেবা আঞ্জাম দেওয়া জাতীয় সম্মিলন হলো এই অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স আলীগড়। মুঘল সাম্রাজ্যের অবসানের পর, বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে ভারতীয় মুসলমানদের কোনো আন্দোলন যদি ধারাবাহিকতা ও বাস্তব সাফল্যের সঙ্গে অব্যাহত থাকে, তা হলো আলীগড় আন্দোলন, যা হিন্দুস্তানের ইসলামি জাতির বিপর্যস্ত শরীরে এক নতুন তরঙ্গ বয়ে এনেছে। কিন্তু স্বরাজ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং বস্তুবাদের আধুনিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে, এই কনফারেন্সের প্রয়োজন আরও জটিল ও বৈপ্লবিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করা, নতুন শিক্ষাগত সমস্যা সমাধান করা এবং নতুন নতুন সাংস্কৃতিক প্রচারণা চালানো, আর এই কারণে এর প্রয়োজনীয়তা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।

আজ আল্লাহর রহমতে, ভারতবর্ষের মুসলমানদের মধ্যে একটি সর্বভারতীয় ঐক্য এবং সংগঠন রয়েছে। নবাব স্যার মুহাম্মদ মুজাম্মিলুল্লাহ খান রহ. মুম্বাই মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স ১৯৩৭-এর অধিবেশনে তাঁর স্বাগত বক্তব্যে লিখেছেন:

“যেভাবে মুসলমানদের জন্য একটি পলিটিক্যাল কনফারেন্স বা মুসলিম লীগের প্রয়োজন, তেমনি একটি এডুকেশনাল কনফারেন্সের প্রয়োজন। আজ ভারতবর্ষে এমন সংগঠিত দল তৈরি হয়ে গেছে যারা তাদের নির্দিষ্ট শিক্ষাপদ্ধতি, নির্দিষ্ট চিন্তা ও কর্মপন্থা এবং নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ধারাকে বিশেষ শিক্ষামূলক প্রকল্প, গভর্মেন্ট কাউন্সিল এবং আইনের ক্ষমতার মাধ্যমে মুসলিম ও অন্যান্য দলের উপর চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পিত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই পরিস্থিতির ভেতর, সর্বভারতীয় ভিত্তিতে হিন্দুস্তানের ইসলামি জাতির শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা সংক্রান্তএকটি ঐক্যবদ্ধ লক্ষ্য ও নীতি গ্রহণ করা এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এবং জাতীয় ব্যক্তিত্বকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্বাধীন ও সুরক্ষিত রাখার জন্য একটি কর্মসূচী নির্ধারণ করা আবশ্যক, যার বাস্তবায়নে বাঙ্গাল, আসাম, পাঞ্জাব, সীমান্তও সিন্ধুর ক্ষমতাসীন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠরা অংশ নেবে, এবং ইউপি, বিহার, মুম্বাই ও মাদ্রাজের মুসলিম সংখ্যালঘুরাও এতে অংশগ্রহণ করবে, যাতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ যেমন একটি ঐক্যবদ্ধ লক্ষ্য ও কর্মসূচি নিয়ে ভারতের মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও উন্নয়নের জন্য সচেষ্ট, তেমনিভাবে অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স একটি ঐক্যবদ্ধ লক্ষ্য এবং কর্মসূচি অনুসারে, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, কালচার ও সভ্যতার ক্ষেত্রে মুসলিম ভারতের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা করবে এবং এই কাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ সংখ্যালঘু প্রদেশকে সহযোগিতা করবে এবং ভারতের মুসলমানদের একে অপরের শিক্ষাগত অসুবিধা, বাধা এবং সমস্যা সম্পর্কে অবগত হবে এবং তাদের প্রতিনিধিরা বছরে একবার এক জায়গায় জড়ো হয়ে অতীতের উপর পর্যালোচনা করবে, বিদ্যমান অবস্থার পুন:নিরীক্ষণ করবে এবং ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল নিয়ে ভাববে এবং বাস্তবায়ন করবে। হিন্দুস্তানি ইসলামি মিল্লাতের জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্তশাসন যতটা জরুরী, ততটা বরং ততোধিক জরুরী শিক্ষাগত স্বাধীনতা এবং সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন। কারণ জাতি তার রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারিয়ে বাঁচতে পারে, কিন্তু শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন হারিয়ে জাতি বেঁচে থাকতে পারে না, মিল্লাত ঐতিহ্যেরই অপর নাম এবং কওম জাতিগত সংস্কৃতিরই অভিব্যক্তি।”

এই কারণে, ভারতীয় মুসলমানদের তাদের জাতীয় স্থিতিশীলতা এবং অধিকার ও স্বার্থের সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য, স্যার সৈয়দ প্রতিষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের ব্যবস্থাপনাকে অটুট রাখা আগের চেয়ে বেশি প্রয়োজন, বরং আধুনিক বৈপ্লবিক পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করার জন্য এটাকে আরও সুদৃঢ় করতে হবে এবং সর্বাত্মকভাবে ইসলামি শিক্ষা, ইসলামি কালচার এবং ইসলামি সভ্যতার স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা রক্ষার যোগ্য করে তুলতে হবে।

ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ,

১৮৮৬ সালের ২৭-২৮-২৯ ডিসেম্বর আলীগড়ে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের প্রথম সভায় নিম্নলিখিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল :

১. মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য জ্ঞান ও কলা এবং উচ্চ স্তরের আধুনিক শিক্ষার বিস্তার করা এবং এর বিরুদ্ধে অযাচিত কুসংস্কার দূর করা।

২. ইংরেজি স্কুল ও কলেজে মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চাহিদা ও ঐতিহ্য পূরণের ব্যবস্থাগ্রহণ করা। ৩. প্রাচ্য জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং ইসলামি উলূমের উচ্চ শিক্ষার সংরক্ষণ ও বিকাশের চেষ্টা করা।

৪. প্রাচীন মক্তব্য ব্যবস্থার সংস্কার, বিকাশ ও সুরক্ষার চেষ্টা করা এবং সেগুলির মাধ্যমে সাধারণ প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার করা।

৫. কুরআনিক স্কুলগুলির সুরক্ষা ও উন্নয়ন এবং কুরআন হিফজের অবনতিশীল পদ্ধতির পুনর্নবীকরণ করা।

আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা যে, পশ্চিমা শিক্ষার বিরুদ্ধে যে কুসংস্কার আলীগড় আন্দোলনের শুরুর দিকে খুব প্রবল এবং সাধারণ ছিল, তা এখন দূর হয়ে গেছে। পাশ্চাত্য জ্ঞান ও শিল্পকলার উচ্চশিক্ষা মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে। লর্ড ম্যাকোলে কর্তৃক জারি করা শিক্ষাব্যবস্থা অনুসারে, এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে, স্কুল-কলেজে মুসলমানদের প্রাচীন জাতীয় ও ধর্মীয় সাহিত্যের অবসান ঘটবে, কিন্তু আলীগড় আন্দোলনের আশীর্বাদে আজ ইংরেজি স্কুল ও কলেজে আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষার ব্যবস্থাপনা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছু পরিমাণে দীনিয়াত শিক্ষার আয়োজনও করা হয়েছে, তথাপি এর জন্য এখনও অনেক কিছু করার বাকি আছে।

প্রাচ্য জ্ঞান-কলা এবং দীনিয়াতের উচ্চশিক্ষার আয়োজন আরবি-ইসলামি মাদ্রাসা ছাড়াও, আলিগড়, পাটনা, এলাহাবাদ, লখনৌ, লাহোর, হায়দ্রাবাদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ পাঠ্যক্রম, ডিগ্রিকোর্স এবং সার্টিফিকেট এবং পরীক্ষার মাধ্যমেও পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য এখন পর্যন্তযা কিছু হয়েছে, তা ইসলামি উলূমের গুরুত্ব ও মহত্ত্বের পরিপেক্ষিতে নিতান্তই করা হয়েছে এবং কিছু বাধা এবং অসুবিধার কারণে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যা ভারতবর্ষের বৃহত্তম ইসলামি প্রদেশের রাজধানীর ইউনিভার্সিটির জন্য অতটুকুও করেনি, যতটা পাটনা, এলাহাবাদ এবং লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে করা হয়েছে। প্রাচীন মকতব ব্যবস্থার সংস্কার ও পুনর্নবীকরণের জন্য সারা দেশে কিছু না কিছু করা হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে, ইংরেজ শাসনের শুরুতে লর্ড ম্যাকলে কর্তৃক প্রবর্তিত পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবে প্রাচীন মকতব-ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে মর্মে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, আলীগড় আন্দোলনের অধীনে মুসলমানদের ক্রমাগত চেষ্টা ও প্রচেষ্টার কল্যাণে শেষ পর্যন্ত মকতব-ব্যবস্থা বিলুপ্তির ঝুঁকি থেকে বেঁচে যায়। এটির সংস্কারের জন্য এত বেশি কাজ করা হয়েছিল যে, কুরআন এবং দীনিয়াতের মৌলিক শিক্ষার সাথে সাথে, প্রাইমারি স্কুলের প্রচলিত পাঠ্যক্রম এবং বিষয়গুলিকে পাশাপাশি জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। নতুন বিষয়ের সংযোজনে প্রাচীন মকতব-ব্যবস্থায় নব প্রাণের সঞ্চার হয়। আলীগড় কনফারেন্সের ক্রমাগত দাবিতে মকতবের জন্য মৌলভি-ট্রেনিং স্কুলও প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সরকারি স্কুলগুলিতে মুসলিম শিক্ষকের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়। কুরআন হিফজের চর্চা পুনরুজ্জীবিত হয়। বিশুদ্ধ ধর্মীয় মাদ্রাসার সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। হাজার হাজার কুরআন-হাফিজ, শত শত ধর্মীয় আলেম এবং গ্রাজুয়েটের জন্ম হয়।

যে সকল উদ্দেশ্যে এডুকেশনাল কনফারেন্স প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এর প্রথম অধিবেশনে যে উদ্দেশ্যগুলি ঘোষিত হয়েছিল, আলীগড় কনফারেন্স কমবেশি এতে সফল হয়েছে। তবে জ্ঞান এবং শিল্প সর্বদাই বিকশমান জিনিস। যখন মুসলমানরা নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর হয়েছে, নতুন জ্ঞান ও শিল্পক্ষেত্রও বিস্তৃত থেকে বিস্তৃত হয়েছে। এই কারণে, যদিও আজ মুসলমানদের শিক্ষাগত অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভালো, কিন্তুঅন্যান্য ভারতীয় জাতিগোষ্ঠীর তুলনায়, কি সাক্ষরতার অনুপাতে, কি উচ্চশিক্ষা লাভের অনুপাতে এবং কি আধুনিক শিল্পকলায় দক্ষতার পরিপ্রেক্ষিতে, কি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিচারে, ভারতের মুসলমানরা এখনও পিছিয়ে আছে এবং তারা যদি জীবনের ময়দানে অন্যান্য দলের সাথে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে চায়, তবে তাদের কর্তব্য হলো, তারা আগের চেয়ে আরও বেশি উৎসাহ-উদ্দীপনা, ধৈর্য-স্থৈর্য ও কঠোর সাধনার সাথে বর্তমান বিজ্ঞান ও শিল্পে দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করবে এবং যে-কোনও জ্ঞানে, যে- কোনও শিল্পে, যে-কোনও পেশায় কোনো জাতির থেকে পিছিয়ে থাকবে না, বরং গৌরবময় পূর্বপুরুষদের মতো, যারা ছিলেন সমকালের শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক, জগত-জাতির ইমাম ও নেতা হওয়ার চেষ্টা করবে।

ওয়ার্ধা প্রকল্প

সাধারণ বাধ্যতামূলক শিক্ষাকে রেওয়াজ দেয়ার প্রকল্প নিজস্ব বিরলতার কারণে ‘ওয়ার্ধা প্রকল্প’টি দেশের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। যার মূল প্রবর্তক হলেন মিস্টার গান্ধী, কিন্তু যার সম্পাদক ও সংকলক ড. জাকির হুসেন খান এবং গান্ধীজী কর্তৃক অনুমোদিত শিক্ষা কমিটি। আমি গত বছর পাটনা সভার সভাপতিত্বের ভাষণে ওয়ার্ধা প্রকল্প সম্পর্কে আমার মতামত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছি। আমি এখনও আমার মতের উপর অটল আছি। সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার সাধারণ রেওয়াজ দেওয়ার লক্ষ্যকে আমি এবং প্রতিটি মুসলমান সমর্থন করি, কিন্তু আমি চাই না এই প্রয়াসের কারণে দেশ বর্তমান সভ্যতার যুগ থেকে, উল্টা অগ্রগতি করে পিছনের দিকে ফিরে যাক। আমি ওয়ার্ধা স্কিমে সন্ন্যাসবাদ এবং গান্ধীবাদের একটি সুস্পষ্ট আভাস দেখতে পাচ্ছি, বরং এটা খোলাখুলিভাবে বলা হচ্ছে যে, ওয়ার্ধা হলো একটি নতুন ধর্মের কেবলা এবং ওয়ার্ধা প্রকল্প হলো এই নতুন ধর্মের সাধারণ প্রচার-প্রসারের একটি প্রণালী। দেবয়াত সিদ্ধার প্রকল্পের পাঠ্যক্রমে গান্ধীবাদকে ঢুকিয়ে এবং অহিংসা ও সত্যাগ্রহ ধর্মের শিক্ষাকে নৈতিক শিক্ষার মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করে, প্রকাশ্যভাবে মুসলিম শিশুদের ধর্মত্যাগী (মুরতাদ) বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। একদিকে, মি. গান্ধী পাঠ্যক্রম থেকে ধর্মীয় শিক্ষা অপসারণকে সমর্থন করেছেন এই বলে যে, এর দরুন সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত বৈরিতা বৃদ্ধি পায়, এবং অন্যদিকে, তার নিজস্ব নব-উদ্ভাবিত অহিংসা ও সত্যাগ্রহ ধর্মের শিক্ষাকে ওয়ার্ধা প্রকল্পের ব্যবহারিক শিক্ষার ভিত্তি বানিয়েছেন। আমি হিন্দুস্তানের মিল্লাতে ইসলামিয়ার পক্ষ থেকে ঘোষণা করতে চাই যে, মুসলিমরা এমন কোনো প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে এক মুহূর্তের জন্যও সহ্য করতে পারে না, যা ইসলামি দীনিয়াত (ধর্মতত্ত্ব) ও ইসলামি রেওয়ায়েতের (ঐতিহ্য) উপর প্রতিষ্ঠিত নয় এবং যার ভাষা ও লিপি মুসলমানদের দ্বারা অনুমোদিত নয় এবং যার কাঠামোর মধ্যে মুসলমানদের পূর্ণ ক্ষমতা ও প্রতিনিধিত্ব নেই। মুসলমানরা কোনো মূল্যেই বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে তাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনকে বিক্রি ও বিনিময় করতে রাজি হবে না। ইসলামি শিক্ষা, ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান, জাতীয় শিল্প ও জাতীয় সংস্কৃতির স্বাধীনতা ও বিকাশই আমাদের লক্ষ্য এবং মূলমন্ত্র।

ওয়ার্ধা প্রকল্প, কালচারাল, টেকনিক্যাল এবং আর্থিক অসুবিধা এবং দুর্বলতার বাইরেও, মৌলিকভাবে ত্রুটিযুক্ত। কারণ, এটি সর্বজনীন এবং অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার আকর্ষণীয় এবং প্রতারণামূলক নামের আড়ালে, আইন ও সরকারের বল প্রয়োগ করে, ভারতের সাধারণ মানুষকে হিন্দু-ইজমের নতুন রূপে রাঙাতে চায়। হিন্দু-ইজমের এই নতুন রূপের নাম গান্ধী-ইজম বা গান্ধী-ধর্ম, যা টলস্টয়ের খ্রিস্টধর্ম, মনুর বর্ণাশ্রম ধর্ম, কৃষ্ণের গীতা এবং জৈনমতের অহিংসার সংমিশ্রণ; যাকে ‘সত্যাগ্রহ ধর্মে’র নতুন নাম দেওয়া হয়েছে। এটি একটি নতুন হিন্দু-সভ্যতা নির্মাণের স্বপ্নের বাস্তবায়ন, কিন্তু যতদিন হিন্দুস্তানে ইসলামের জ্ঞান বিরাজ করবে, ততদিন এই স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যাবে। এটি দেশকে ৫,০০০ বছর আগের রামরাজের যুগের দিকে ঠেলে দেওয়া একটি রক্ষণশীল প্রকল্প, যা বিশুদ্ধ গান্ধীবাদ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের নতুন ধর্মের উপর প্রতষ্ঠিত। ওয়ার্ধা প্রকল্পের এই শিক্ষা- ‘প্রতিটি ধর্মই সত্য এবং অন্য ধর্মের উপর কোনো ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নেই’- ইসলামকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করে।

বিভিন্ন হিন্দু রাজ্য এবং কংগ্রেসী মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্বের অধীনে যে সুপরিকল্পিতভাবে মুসলিম শিক্ষা, ভাষা, লিপি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক এবং বৈরী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, তাতে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের একটি ক্ষমতাসীন দল মুসলিম মিল্লাতের ধর্মীয় জাতীয় স্বাতন্ত্র্য-স্বকীয়তাকে বিনষ্ট করতে চাইছে। ১৮৬৭ সালে স্যার সৈয়দ রহ. যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা বর্তমান হিন্দুস্তানে গান্ধী ও মালভি দলের প্রভাবে বর্ণে বর্ণে সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

স্যার সৈয়দ আহমদের ভবিষ্যদ্বাণী

শামসুল উলামা মাওলানা আলতাফ হোসেন হালি মরহুম লিখেছেন : ১৯৬৭ সালে, বেনারসের কিছু বিশিষ্ট হিন্দুর মনে এই খেয়াল চেপে বসলো যে, যতটা সম্ভব, সমস্ত সরকারি আদালতে উর্দু ভাষা এবং ফারসি লিপি বর্জনের চেষ্টা করা উচিত এবং তার পরিবর্তে সেই ভাষা’র প্রচলন হওয়া উচিত, যা দেবনাগরীতে লেখা। স্যার সৈয়দ বলতেন, এটা ছিল প্রথম সুযোগ, যখন আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, ‘এখন থেকে ভারতের হিন্দু-মুসলমানের পক্ষে এক জাতি হিসেবে একসাথে বাস করা এবং উভয়কে মিলিয়ে সকলের জন্য একসাথে চেষ্টা করা অসম্ভব।’

স্যার সৈয়দ লিখেছেন : “সেই সময়ে, যখন বেনারসে হিন্দি দেবনাগরীর এই চর্চা ছড়িয়ে পড়েছিল, একদিন মি. শেক্সপিয়ারের সঙ্গে, যিনি তখন বেনারসে কমিশনার ছিলেন, আমি মুসলমানদের শিক্ষা নিয়ে আলাপ করছিলাম এবং তিনি অবাক হয়ে আমার কথাগুলো শুনছিলেন। সবশেষে তিনি বললেন, আজকে এই প্রথমবারের মতো আমি আপনার কাছ থেকে মুসলমানদের উন্নয়নের কথা শুনলাম। এর আগে আপনি সর্বদা সাধারণ ভারতীয়দের কল্যাণের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আমি তখন বলেছিলাম, এখন আমি নিশ্চিত হয়ে গেছি যে, উভয় জাতি কোনো কাজে আন্তরিকভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এখন খুব কমই আছে, সামনে এর চেয়ে বেশি বিরোধিতা ও বিদ্বেষ তথাকথিত শিক্ষিতদের কারণে বাড়তে থাকবে, যারা বেঁচে থাকবে তারা দেখতে পাবে। মিস্টার শেক্সপিয়ার বললেন, আপনার ভবিষ্যদ্বাণী যদি সঠিক হয়, তবে এটি খুবই দুঃখজনক। আমি বললাম, আমিও এতে অত্যন্তদুঃখিত, কিন্তু আমার ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত!’

হিন্দু সংস্কৃতি ও শিক্ষাগত ফ্যাসিবাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা

আজ কে আছে যে স্যার সৈয়দ আহমদের এই ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতে পারি। আজ যেভাবে উর্দুকে মুছে ফেলা, বিকৃত করা এবং তার জায়গায় এক অবোধ্য ভাষা প্রতিস্থাপিত করা এবং আইন ও সরকারের জোরে জবরদস্তি করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা এই সমাবেশের উপস্থিত সকলের কাছে স্পষ্ট। হিন্দুত্ব-হিন্দুস্তানি এবং মেহেন্দি পরচার ও দেবনাগরী পরচার আন্দোলনগুলির পটভূমিতে, একদিকে হিন্দু সভ্যতা ও হিন্দু সাম্রাজ্যকে পুনরুজ্জীবিত করার আকাঙ্খা কাজ করছে, অন্যদিকে ভারতবর্ষের ইসলামি যুগের সকল ইসলামি চিহ্ন ও নিদর্শন মুছে ফেলার এবং হিন্দু সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ চাপিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল। এসব ইসলাম বিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্রেরই ফলশ্রুতি যে, আলওয়ারের সাবেক মহারাজা সরকারি আদেশের মাধ্যমে তার রাজ্যের সকলের উপর জোরপূর্বক হিন্দি ভাষা এবং নাগরী লিপি চাপিয়ে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। সকল মকতব এবং মাদ্রাসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং তার রাজ্যের সীমানার মধ্যে ফার্সি এবং উর্দু লিপির ব্যবহারকে বে-আইনি বলে ঘোষণা করেছিলেন। মহারাজা আলওয়ারকে এলাহাবাদ ইত্তেহাদ কনফারেন্সে জোটের দূত হিসেবে স্বাগত জানানো হয় এবং কংগ্রেসী এবং মহাসভাই হিন্দুরা তাঁকে ‘রাজ-ঋষি’ উপাধিতে ভূষিত করে। রাজ-ঋষি’র ঐক্যের তত্ত্বটি ছিল হিন্দু ফ্যাসিবাদের তত্ত্ব, যার অধীনে কোনও অ-হিন্দু গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, লিপি, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সমাজ ব্যবস্থার স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা বহাল ও বজায় রাখার অধিকার থাকবে না, বরং প্রতিটি জাতিকে হিন্দু-ইজমের রঙে রঙিন হওয়া, হিন্দুদের ভাষায় কথা বলা, উঁচুবর্ণের হিন্দুদের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করা এবং তাদের রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে থাকতে হবে।

আপনারা জানেন আলওয়ারের রাজ-ঋষির এই হিন্দু-ফ্যাসিবাদী স্বপ্নের কতটা বেদনাদায়ক এবং দুঃখজনক রূপায়ণ ঘটেছিল! সাহসী মেওয়াটি মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় শিক্ষা, উর্দু ভাষা এবং উর্দু লিপির স্বাধীনতার জন্য রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী এবং সফল যুদ্ধ করেন। হাজার হাজার মুসলমান হিজরত করে। পরিবার ও প্রিয় মাতৃভূমি ত্যাগের নজরানা পেশ করে। অনেক মুসলমান এমনকি তাঁদের জীবন উৎসর্গ করে এবং আলওয়ার রাজ্যের গদি এবং এর ফ্যাসিবাদী কংগ্রেস নীতিকে উৎখাত করে ক্ষান্ত হয়। রাজ ঋষিকে রাজ্য ত্যাগ করতে হয় এবং মাতৃভূমিহীন মরতে হয়। সরকার বিপ্লবের ঘটনা ঘটে। অবশেষে ইসলামি স্কুল, মাদ্রাসা ও মসজিদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার হয় এবং উর্দু ভাষা ও লিপির শিক্ষার উপর থেকে সমস্তবি-ধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয় এবং মুসলমানদেরকে একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে রাজ্য-ব্যবস্থায় স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

সম্মানিত সুধীবৃন্দ,

আলওয়ার-এর সরকার বিপ্লবের ঘটনা শুধু স্যার সৈয়দের ভবিষ্যদ্বাণীরই সত্যায়ন নয়, বরং ভারতবর্ষের দেশপ্রেমিকদের জন্য একটি বিরাট সতর্কবার্তাও বটে। আলওয়ার স্পষ্ট দেখিয়ে দিলেন যে, ভারতবর্ষে মুসলমানদের ভাষা, লিপি, শিক্ষাব্যবস্থা ও সভ্যতার ধ্বংসের উপর, হিন্দু সভ্যতা ও ভাষার নির্মাণের প্রচেষ্টা দেশকে একটি রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ এবং জঘন্যতম বিপ্লবের দিকে নিয়ে যাবে।

মাত্র কয়েক বছর আগে, রাজপুতানা এবং মধ্য ভারতের সকল রাজ্যের দরবারি, আদালতি এবং সাংস্কৃতিক ভাষা ছিল ফার্সি এবং উর্দু, কিন্তু এখন হিন্দুসভার নব-উদ্ভাবিত ন্যাশনালিজমের প্রভাবে উর্দুর পরিবর্তে হিন্দি এবং নাগরী জারি করা হয়েছে। ক্ষমতায় আসার পর, কংগ্রেস ঈৎরসরহধষ খধি অসবহফসবহঃ অপঃ এর মাধ্যমে জোরপূর্বক হিন্দিভাষা জারি করার চেষ্টা করেছে, তা অতি-সাম্প্রতিক ঘটনা, যার ওপর কোনো ব্যাখ্যার অবকাশ নেই।

একক জাতীয়তার নির্মাণে হতাশাবোধ

এই পরিস্থিতির ভেতর, মুসলমানদের মধ্যে বিশেষ করে হিন্দু প্রদেশের মুসলমানদের মধ্যে এই ধারণাটি দ্রুত শক্তিশালী হয়ে উঠছে যে, মুসলমানদের মুক্তির একমাত্র উপায় মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষা বাজেটের পৃথকতার মধ্যে নিহিত এবং এক জাতীয়তার ধারণা বা আকাঙ্খার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কোনো শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব অর্থ হলো বিংশ শতাব্দীতে আর্যাবর্ত নির্মাণ এবং ভারতের মুসলমানদের শুদ্ধ করার প্রয়াসে অংশগ্রহণ। হিন্দুদের বর্তমান দল ও নেতাদের মনোভাব বিবেচনা করে, ন্যাশনালিজমের ভিত্তিতে, শিক্ষা ও সভ্যতার ভিত্তি নির্মাণের ব্যাপারে আমি হতাশ হচ্ছি, ঠিক যেভাবে স্যার সৈয়দ তাঁর দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা এবং খোদাপ্রদত্ত অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে সেই ১৮৬৭ সালে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন।

ইসলামি ভারতের শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত লক্ষ্যমূখ

এসব বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে, ইসলামি হিন্দুস্তানের শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে লক্ষ্য কী হওয়া উচিত? এটি অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্নএবং আমি এই কনফারেন্সের প্রতিটি দূরদর্শী মুসলিম পুরুষ এবং মুসলিম নারীকে ভারতবর্ষের পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে অনুরোধ করব। আমার দৃষ্টিতে, ইসলামি ভারতের শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত লক্ষ্য বা মূলমন্ত্র তিনটি শব্দে ব্যক্ত করা যেতে পারে, যথা: ১. স্বাধীনতা ২. ঐক্য ৩. উন্নয়ন স্বাধীনতা বলতে বোঝায় ইসলামি কালচার, মুসলিম ভাষা ও সাহিত্য, মুসলিম লিপি, মুসলিম শিক্ষা ও প্রচারব্যবস্থা, মুসলিম সমাজ এবং ইসলামি শরীয়াহ, ঐতিহ্য, রীতিনীতির সম্পূর্ণ সাংবিধানিক স্বাধীনতা এবং ব্যবহারিক স্বায়ত্তশাসন। যে শিক্ষাব্যবস্থায় মুসলমানদের সংস্কৃতি, শরীয়াহ, ভাষা, লিপি, ঐতিহ্য ও সভ্যতার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার গ্যারান্টি ও নিশ্চয়তা নেই, তা মুসলমান কাছে চোখ তুলে তাকাবার যোগ্য নয়। আমি মুসলমানদের জাতীয় কালচারের স্বাধীনতাকে তাদের ইসলামি জাতীয়তার স্বাধীনতার ভিত্তি বলে মনে করি। ঐক্য বলতে যা বোঝায় তা হলো, ভারতবর্ষের ইসলামি মিল্লাত একটি অবিভাজ্য ঐক্য। বিগত এক হাজার বছরের ইতিহাস, আলীগড় আন্দোলন এবং উর্দু ভাষা দশ কোটি মুসলমানের মধ্যে ইসলামি শরীয়ার ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী জাতীয়তার বোধ তৈরি করে দিয়েছে। জরুরী হলো মুসলমানদের তার শিক্ষাব্যবস্থাকে সর্বভারতীয় ভিত্তিতে এমনভাবে গড়ে তোলা যে, বিভিন্ন প্রদেশের নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তাগুলি মেটানোর পাশাপাশি, ভারতীয় মহাদেশে তারা নিজেদের জাতিগত ঐক্য এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে শুধু বহাল ও বজায় রাখবে না, বরং আরও স্থিতিশীল এবং শক্তিশালী করবে। যে শিক্ষাব্যবস্থা ভারতবর্ষের মুসলমানদেরকে গোত্র, বর্ণ, প্রদেশ কিংবা ফেরকার ভিত্তিতে বিভক্ত করে, সেটা ভারতীয় ইসলামি জাতীয়তার ভিত্তিকে বিপর্যস্তকারী ব্যবস্থা এবং মুসলমানরা কোনো মূল্যেই মিল্লাতের সম্মিলিত অস্তিত্বের ক্ষয়- ক্ষতিকে সহ্য করতে পারে না। উন্নয়ন অর্থ হলো, মুসলমান তার ইসলামি ঐতিহ্য ও বিধি-বিধানের দৃঢ় ভিত্তির উপর, তার নির্দিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা বজায় রেখে, দ্বীন ও দুনিয়ার উপকারী জ্ঞান-বিজ্ঞান, শাস্ত্র ও শিল্পে উন্নতি সাধন করা এবং গবেষণা ও উদ্ভাবনের স্তর অর্জন করা। কোনো জাতি বা জামাত থেকে কোনো জ্ঞান বা শিল্পের ক্ষেত্রে পেছনে না থাকা। কারণ, মুসলমান কোনো জাতি থেকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, শিল্প ও কারিগরি, ধর্ম ও রাজনীতি, জীবিকা ও স্বার্থ, অর্থাৎ কোনো বিষয়েই পিছিয়ে থাকার জন্য নয়, বরং বিশ্বের জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য খোদার দরবার থেকে আদিষ্ট ও দায়বদ্ধ। অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের সাংগঠনিক নববিন্যাস ভারতীয় ইসলামি মিল্লাতের শিক্ষাগত স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং জ্ঞান ও শিল্পগত উন্নয়নের লক্ষ্যকে অর্জন করার জন্য কেবলমাত্র অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের অল ইন্ডিয়া সংগঠনকে, যা স্যার য়ৈদ আহমদ প্রতিষ্ঠা করেন, বহাল ও বজায় রাখলেই হবে না, বরং প্রতিষ্ঠানটিকে একটি সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল এবং সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান রূপে গড়ে তোলা এবং আলীগড়ীয় ঐতিহ্য বজায় রেখে, এর মধ্যে নতুন অবস্থা ও বাস্তবতাকে মোকাবিলার শক্তি সৃষ্টি করা প্রয়োজন, যাতে মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স ইসলামি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের প্রতিনিধি ও ভাষ্যকার হয়ে ওঠে। আমি এই কনফারেন্সে বর্তমান পশ্চিমা গণতন্ত্র এবং দলাদলির দোষ-ত্রুটি মোটেই দেখতে চাই না, আমি দলাদলি থেকে মুক্তি এবং অবিচ্ছিন্নধারাবাহিকতায় আলিগড়ের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়াই এর সবচেয়ে বড়গুণ বলে বিশ্বাস করি। তবে এটিকে অবশ্যই মুসলিম জনজীবনের স্রোতের সাথে সংযুক্ত হতে হবে এবং প্রতি তিন বছরের জন্য একটি নির্দিষ্ট অনুপাত অনুসারে ইসলামি শিক্ষাগার, মাদ্রাসা, ইসলামিয়া কলেজ, জ্ঞান ও শিক্ষামূলক সমিতি এবং শক্তিশালী মুসলিম দলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়োগ করা উচিত এবং এই কনফারেন্সের বার্ষিক সভায় অংশহণের ব্যবস্থা করা উচিত। আমার মতে, এডুকেশনাল কনফারেন্সের জন্য একটি নতুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের উদ্দেশ্যে, পাঁচ সদস্যের একটি ছোট কমিটি গঠন করা উচিত, যারা কনফারেন্সের ভবিষ্যত সংবিধান, ম্যানুয়াল এবং সম্মেলনের উপায়-সংস্থান সম্পর্কে গবেষণা ও তদন্তের পর, কনফারেন্সের স্থায়ী কমিটির সামনে প্রতিবেদন পেশ করবে। এই কমিটিকে স্পষ্ট ও পরিষ্কার ভাষায় নির্দেশনা দিতে হবে যে, স্বাধীন ভারতের ভেতর স্বাধীন ইসলামের নির্মাণ এবং ভারতের মুসলিম মিল্লাতের জাতীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও আইনি, শিক্ষাগত ও প্রচারগত, সভ্যতা ও সংস্কৃতিগত স্বকীয়তার প্রতিষ্ঠাই হিন্দুস্তানি মুসলমানদের সম্মিলিত সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। এবং আবশ্যকভাবে অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স ভবিষ্যতে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, কর্ম-বন্টনের নীতি অনুসারে সেই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করবে তারা, যেভাবে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে, দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থা এবং সম্পদ উৎপাদন ব্যবস্থায় মুসলমানদের অধিকার, অংশ এবং স্বাধীন মর্যাদাকে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করতে সচেষ্ট। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ ওয়ার্ধা স্কিমের মোকাবিলায় একটি মুসলিম শিক্ষামূলক স্কিম প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে। আমাদের অনুরোধ হলো, ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের উল্লিখিত প্রস্তাবিত কমিটি মুসলিম লীগ শিক্ষা কমিটির সাথে সহযোগিতায় কাজ করবে, যাতে করে মুসলমানদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত প্রয়োজনীয়তায় একটি সর্বসম্মত প্রকল্প তৈরি করা যেতে পারে। আরবি মাদ্রাসাসমূহের সংস্কার ও উন্নয়নের প্রশ্ন অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের প্রধান পাঁচটি লক্ষ্য, যা ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। তম্মধ্যে তৃতীয় লক্ষ্যটি ছিল প্রাচ্যীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং ইসলামি উলূম ও ফুনূন তথা জ্ঞান-কলার উচ্চ শিক্ষার বিকাশের প্রচেষ্টা। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আলীগড় আন্দোলনের প্রভাবে দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামা, মজলিসে নদওয়াতুল উলামা এবং হায়দরাবাদের দায়েরাতুল মাআরিফ আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং আরবি মাদ্রাসাসমূহের নবায়ন ও সংস্কারের কিছু কাজ হয়েছিল, কিন্তু বিভিন্ন কারণে কনফারেন্স এই লক্ষ্য অর্জনের দিকে মনোযোগ দিতে পারেনি। ইসলামি আরবি মাদরাসাগুলোয়, আজও হাদিস, তাফসীর এবং আধুনিক আরবি ভাষা ও সাহিত্যের পঠন-পাঠনের চেয়ে, সেকেলে গ্রীক দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা এবং ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যার শিক্ষার ওপর অধিক জোর দেওয়া হয় এবং মুসলমানদের আধুনিক প্রজন্মের বয়স খোয়া হয় এবং মস্তিষ্কগুলোকে বন্ধ্যা ও ভোঁতা করা হয়। এই আরবি মাদ্রাসাগুলি বর্তমান আরবি ভাষায় রূপান্তরিত উন্নত জ্ঞান-শাস্ত্রসম্পর্কেও সম্পূর্ণরূপে বেখবর, এতটাই যে, সারাজীবন আরবি পড়ার পরেও, ছাত্ররা আরবি ভাষায় একজন আরব ভাষাভাষীর সাথে আলাপ করতে পারে না, বুঝতে পারে না আরবি কোনো পত্রিকা বা ম্যাগাজিন। স্নাতক শেষ করার পরেও, এই আরবি মাদ্রাসার ছাত্ররা ভারত ও আরবের সীমানা, ভূগোল, ইতিহাস, প্রাথমিক বিজ্ঞান, স্বাস্থ্যবিধি এবং গণিতের মূলনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যায়। এই সত্যটি ভারতীয় মুসলমানদের শিক্ষাগত মানচিত্রে সবচেয়ে কুৎসিত দাগ। ইসলামি উলূম ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুরক্ষা এবং বিকাশ মুসলমানদের জন্য অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ। আরবি-ইসলামি মাদ্রাসাগুলোকে ইসলামি উলূম এবং গুরুত্বপূর্ণ সমসাময়িক জ্ঞানসমূহের কেন্দ্র হওয়া উচিত। নেসাব (পাঠ্যক্রম) থেকে অপ্রচলিত ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে খারিজ করে প্রয়োজনীয় বিষয়ের পাঠদান এতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত এবং সর্বোপরি, কুরআন ও হাদিস এবং শরয়ি উলূমের উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা, প্রচার ও প্রসারের উপর জোর দেওয়া উচিত। আমরা জানি যে, মাদরাসার একদল শিক্ষক ও ব্যবস্থাপক, যারা প্রাচীন পাঠ্যক্রম অনুসারে শিক্ষা লাভ করেছেন, যারা কোনো আধুনিক পাঠ্যক্রম অনুসরণ করতে অক্ষম, তারা স্বভাবতই নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ অর্থাৎ ভেস্টেড ইন্টারেস্টের কারণে মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম নবায়নের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করবে, কিন্তু কতদিন কিছু লোকের খাতির-স্বার্থ এবং কায়েমী স্বার্থের অজুহাতে জাতির নতুন প্রজন্মের ধর্মীয় ও পার্থিব জীবন এবং শিক্ষাগত ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দেওয়া হবে। আমি কনফারেন্সের নীতিনির্ধারকদের অনুরোধ করব তারা সংস্কারপন্থী বিজ্ঞ আলেমদের পরামর্শ নিয়ে ইসলামি মাদ্রাসাগুলোর সংস্কার ও উন্নয়নে দ্রুত মনোযোগ দিন এবং যে কাজটি আল্লামা শিবলি নুমানি এবং নদওয়াতুল উলামা শুরু করেছিল, তা পুনরায় জারি করুন। আমি আশা করি এখন মুসলমানদের অবস্থা ও চিন্তা-চেতনায় অনেক পরিবর্তন এসেছে এবং সংস্কার আন্দোলন আগের চেয়ে অনেক বেশি সফল হবে। দ্বীনি মাদ্রাসা ও দুনিয়াবি বিদ্যালয়ের মধ্যে যে পার্থক্য ও ব্যবধান, যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করা প্রয়োজন, কারণ ইসলামে দ্বীন ও দুনিয়া, আত্মা ও বস্তুর দ্বৈততা ও বিরোধের ধারণা অসম্ভব। ইংরেজি প্রতিষ্ঠানে দীনিয়াত ইংরেজি স্কুল ও কলেজে দীনিয়াত এবং ইসলামি ঐতিহ্য ও ইতিহাসের শিক্ষার উপর এই কনফারেন্সের শুরু থেকেই জোর দেওয়া হয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে এটিই এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। পরিতাপের বিষয় যে, এখন পর্যন্ত এই লক্ষ্যে যতটা সাফল্য পাওয়া উচিত ছিল, তা পাওয়া যায়নি। দীনিয়াতের শিক্ষা ছাড়া মুসলমানের কোনো শিক্ষাই পূর্ণাঙ্গ বলা যায় না। কারণ, মুসলমানের সমগ্রজীবন, অর্থনীতি, রাজনীতি, নৈতিকতা, সকল লেনদেন এবং নগর-সংস্কৃতির ভিত্তি তার দীনিয়াতের উপর। অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে, প্রকৃত দীনিয়াত ছাড়া নৈতিকতা, মানবতা এবং সভ্যতার জীবন অসম্ভব। ইসলাম বান্দা ও আল্লাহর মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে চায় এবং আল্লাহ ও আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে অধিকার ও কর্তব্যবোধের একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা পেশ করে। এই উদ্দেশ্যে সফলতার জন্য ইসলামি আকিদা ও আমাল, রাসূল সা. এবং তাঁর সাহাবি ও খলিফাগণের পবিত্র জীবনী ও ইতিহাস অধ্যয়ন করা অপরিহার্য প্রয়োজন। ইসলামি ইতিহাসের অধ্যয়ন, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণবন্ত, মন ছুঁয়ে-যাওয়া এবং মানবতা-সঞ্চারী অধ্যয়ন। আমাদের মতে, দীনিয়াতের শিক্ষায় সীরাতুন্নবি, খোলাফায়ে রাশিদীন ও সাহাবিগণের ইতিহাসকে কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দেওয়া উচিত এবং আমার অনুরোধ, কনফারেন্স এই বিষয়গুলিকে প্রাথমিক শ্রেণী থেকে উচ্চ ডিগ্রি শ্রেণী পর্যন্ত কার্যকর করার ব্যবহারিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মুসলমানদের আরেকটি গুরুত্ব¡পূর্ণ প্রয়োজন হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রগতি অর্জন করা। বিশ্বের ধর্মীয় গ্রন্থাবলীর মধ্যে, কুরআনই একমাত্র জ্ঞানময় গ্রন্থ যা আকাশ ও পৃথিবীর তাদাব্বুর, তাফাক্কুর ও তাআক্কুল তথা সুনিবিড় চিন্তাভাবনার সাথে বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন এবং পর্যবেক্ষণের উপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে এবং মুসলমানরাই প্রথম জাতি, যারা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা এবং গাণিতিক নীতিমালা নিযুক্ত করেছে এবং আধুনিক সায়েন্স এবং আধুনিক ইন্ডাকটিভ যুক্তির (استقرائی منطق (ভিত্তি স্থাপন করেছে। অত্যন্তপরিতাপের বিষয় যে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষা ও গবেষণায় মুসলমানরা অন্যান্য সম্প্রদায়ের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। সমসাময়িক বিজ্ঞান ও কলা-বিদ্যায় মুসলমানদের অন্যান্য দল-গোষ্ঠীর চেয়ে পশ্চাৎপদ বলে গণ্য হওয়া বড়ই অপমানের বিষয়। অতএব, জরুরী হলো সাইন্স ও গণিতের প্রতি আগ্রহী যোগ্য তরুণদের বিশেষ বৃত্তির মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া এবং এই প্রচেষ্টা প্রতিটি প্রদেশ, প্রতিটি শহর এবং প্রতিটি রাজ্যে একটি বিশেষ পরিকল্পনা অনুসারে করা উচিত। বিজ্ঞানের উচ্চশিক্ষায় অগ্রগতির পাশাপাশি প্রযুক্তি অর্থাৎ শিল্প ও কারিগরির বৈজ্ঞানিক ও ব্যবহারিক শিক্ষায়ও অগ্রগতি ও দক্ষতা প্রয়োজন। এটা দুঃখের বিষয় যে, সমগ্রভারতে মুসলমানরা তাদের যুবকদের জন্য একটি পলিটেকনিক অর্থাৎ টেকনিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেনি এবং অন্যান্য জাতি ও সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত যে টেকনিক্যাল শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে, সেসবে মুসলিম ছাত্রদের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। দারিদ্র্য ও প্রস্তুতির অভাব এর কারণ। যাদবপুরে আমাদের ভাইয়েরা যে কলেজ অফ টেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা একটি প্রশংসনীয় অর্জন। আমাদের প্রত্যাশা যে, মুসলমানগণ অন্ততপক্ষে বাংলা, পাঞ্জাব, মুম্বাই, আলিগড় ও হায়দ্রাবাদে এমন কেন্দীয় টেকনোলজিক্যাল কলেজ এবং স্কুল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবেন। যতদিন পর্যন্ত মুসলমানরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং সর্বাধুনিক শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন না করবে, ততদিন তাদের অবস্থা পার্থিব ও বৈষয়িক দিক থেকে সুষ্ঠু হবে না এবং তারা কখনো অপরের তাবেদারি ও দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে না। বর্তমান যুগ প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান ও শিল্পের যুগ। এই যুগে সে জাতি টিকে থাকতে পারে না, যে জাতি বিজ্ঞান ও আধুনিক শিল্পের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকবে। মুসলমানদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে এবং নিজেদের পশ্চাদপদতা ও দুর্বলতাকে দূর করতে হবে। অন্যথায় জীবনের এই প্রতিযোগিতায় তাদের টিকে থাকা অসম্ভব। সামরিক বিদ্যালয় এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিন্দুস্তানের মুসলমানরা এ নিয়ে যথার্থই গর্ব করে যে, তারা এক সাহসী, সৈনিক এবং বিজয়ী জাতির মহান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। আজও তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় উপাদান এবং মেরুদণ্ড। মুসলমানরা ভারতের সীমান্তরক্ষী ও রক্ষক। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, মুসলমানরা আধুনিক সামরিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি। মুসলমানরা যদি অন্যান্য দলের তুলনায় জীবনের দৌড়ে তার অবস্থান বজায় রাখতে চায়, তাহলে এটা অপরিহার্য যে তারা : (১) একটি প্রথম শ্রেণীর সামরিক স্কুল এবং প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করবে। (২) ইংলিশ পাবলিক স্কুলের আদলে একটি পাবলিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করবে। (৩) মুসলমানদের সুপ্ত ‘নেতৃত্ব-প্রতিভা’কে আবিষ্কার ও গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে। জন্মগতভাবে নেতৃত্বগুণের ধারক এমন তরুণদের সর্বাত্মকভাবে উৎসাহিত করবে। এডুকেশনাল কনফারেন্সের সম্মানিত প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভারতীয়করণ আন্দোলনের প্রধান প্রবর্তক। তিনি হিন্দুস্তানে হাশেমি রেজিমেন্ট এবং কুরাইশি রেজিমেন্ট দেখতে চাইতেন এবং ইসলামের মহান সামরিক ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্ন দেখতেন। এটি গুরুত্ব¡পূর্ণ যে এই কনফারেন্স তার প্রতিষ্ঠাতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে।

সাংবাদিকতা ও প্রেসের শিক্ষা কিন্তু বর্তমান যুগে যুদ্ধ শুধুমাত্র তোপ-কামান, নৌশক্তি ও বিমান শক্তি দিয়েই হয় না, আধুনিক যুগে যুদ্ধের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হলো ‘প্রেস পাওয়ার’। এই সাংবাদিকতা ও প্রেস পাওয়ারের দিক থেকে মুসলমানরা শূন্যহস্ত। আজ সমগ্রভারতে মুসলমানদের এমন একটিও ইংরেজি দৈনিক নেই, যাকে ইসলামি ও স্বাধীন বলা যেতে পারে। এটা ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য লজ্জার কারণ। এই কনফারেন্স মুসলিম যুবকদের সাংবাদিকতা, জার্নালিজম এবং প্রেসের কার্যক্রমের ব্যবহারিক শিক্ষার দিকে আকৃষ্ট করতে অনেক কিছু করতে পারে। প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্র ও প্রেস চালাতে পুঁজির যতটা প্রয়োজন, এর চেয়েও বেশি প্রয়োজন উচ্চতর ব্যবসায়িক ও প্রশাসনিক দক্ষতা এবং সাংবাদিকতার দক্ষতা। এবং এটিই সেই ক্ষেত্র, যার জন্য এডুকেশনাল কনফারেন্স মুসলমানদের গঠনমূলক সেবা দিতে পারে। অল ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল বায়তুল মাল বা এডুকেশন ফান্ড এইসব প্রকল্প এবং প্রয়োজনীয়তাগুলো পূরণ করতে দুটি জিনিসের সরবরাহ আবশ্যক। প্রথমত, একদল মনোযোগী, যোগ্য ও নিষ্ঠাবান সেবক, যারা প্রশংসা-সমালোচনার পরোয়া না করে, এসব লক্ষ্যে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার জন্য এবং ধর্মীয় উদ্যম-উদ্যোগে জাতি গঠনের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হবে। দ্বিতীয় অপরিহার্য শর্ত হলো, একটি শক্তিশালী তালীমী বায়তুল মাল বা শিক্ষা তহবিল। মুসলমানদের জন্য এডুকেশনাল কনফারেন্সের তত্ত্বাবধানে একটি শক্তিশালী শিক্ষা তহবিল (এডুকেশন ফান্ড) প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে এবং মুসলমানরা নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিয়ে-শাদী ও অন্যান্য অনুষ্ঠান উপলক্ষে নিজেদের উপর একটি বিশেষ শিক্ষা কর আরোপ করে এর জন্য মূলধন সরবরাহ করবে। প্রাদেশিক সরকারগুলির কর আদায়কারী মিশনারীদের মাধ্যমে তারা এই বায়তুল-মালের জন্য একটি বিশেষ তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করবে। মুসলমানদের যে অর্থ সঞ্চয় ব্যাংক বা অন্যান্য ব্যাংকে জমা আছে এবং যে অর্থগুলির সুদকে তারা অবৈধ বলে মনে করে, সে-সব খ্রিস্টান মিশনারীদের কাছে হস্তান্তর করার চেয়ে এই শিক্ষা কোষাগারে হস্তান্তর করা ভালো। অনুরূপভাবে, যে মুসলমান নিঃসন্তান হয়ে, কোনোরকম ওছিয়ত ছাড়াই চলে যায়, তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়, অথচ ইসলামি শরিয়া অনুসারে, এ ধরনের মুসলমানদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি মুসলিম জাতির কওমি তারকাহ বা জাতীয় সম্পত্তি। আইনত এইসব সম্পত্তি অল ইন্ডিয়া মুসলিম শিক্ষা তহবিলে স্থানান্তর করার চেষ্টা করা প্রয়োজন। শিক্ষা এনডাওমেন্ট আয়ের একটি অংশও এই শিক্ষা তহবিলে উল্লেখ করা উচিত। মুসলিম বণিক, ব্যবসায়ী, কৃষক এবং দপ্তর কর্মচারীরা বিভিন্ন নামে যে কমিশন নেয়, তাতে শিক্ষা তহবিলের একটি কমিশনও যোগ করা উচিত। আশা করা যায় এই শিক্ষা তহবিল একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে দেশের মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং ধীরে ধীরে মুসলমানদের শিক্ষাগত প্রয়োজনে একটি বিরাট জাতীয় পুঁজি সঞ্চিত হবে। শিক্ষাগত ‘শুদ্ধি’ থেকে মুসলিম সংখ্যালঘুদের রক্ষার প্রশ্ন বর্তমান ও ভবিষ্যত ভারতবর্ষে ইসলামি শিক্ষা ও সভ্যতার পক্ষে প্রকৃত হুমকি দেখা দেবে সেই সব প্রদেশ ও রাজ্যে, যেখানে মুসলিম সংখ্যালঘু। ভারতের এই হিন্দু অঞ্চলগুলির মধ্যে এমন কিছু অঞ্চল রয়েছে, যেখানে মুসলমানরা ইতোমধ্যেই ইরতিদাদ (ধর্মত্যাগ) এবং শিক্ষাগত শুদ্ধি’র হুমকিতে ভুগছে। রাজপুতানা, সাঁওতাল পরগণা, মালকান রাজপুতদের অঞ্চল এবং মধ্য ভারতের অঞ্চলগুলি এর উদাহরণ। এই দরিদ্র, পশ্চাদপদ, পীড়িত, নিপীড়িত ও পরাধীন মুসলমানদের সম্পর্কে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে, তারা চিরতরে মিল্লাতের বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং কুফর ও অবিশ্বাসের বন্যায় ভেসে যাবে! মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিতে, আজ না হলে কাল, পরিস্থিতি সংশোধন হবে। তাদের জন্য আশার একটি জায়গা আছে। প্রশ্ন হচ্ছে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ ও হিন্দু রাজ্যের মুসলমানদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে, যাদের অবস্থান দিন দিন দুর্বল থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং যাদের জন্য ক্রমবর্ধমান হিন্দু-শক্তি ও জাতি-বিদ্বেষের পরিপ্রেক্ষিতে পরিত্রাণের কোনো আশা নেই এবং যাদের ভবিষ্যৎ দৃশ্যত সম্পূর্ণ অন্ধকার। ভারতবর্ষের মুসলমানরা কি এই প্রশ্ন নিয়ে ভেবেছেন? এটা স্পষ্ট যে, এই দরিদ্র, পশ্চাৎপদ ও সুবিধাবঞ্চিত মুসলিম সংখ্যালঘুদের শিক্ষাগত সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য বছরে লক্ষ লক্ষ টাকার প্রয়োজন, এবং ভারতবর্ষে এমন কোনো ইসলামি সাম্রাজ্য নেই যে এই উদ্দেশ্যে বাৎসরিক তহবিল বরাদ্দ করতে পারে এবং জাতিও এর জন্য অন্য কোনো সমাধান বের করেনি। এই কঠিন সমস্যাটি সমাধান করার জন্য আমি যে প্রস্তাবটি ভেবেছি, তা এখন বিবেচনার জন্য আমি আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি। কুরআন ও হাদীসের মুদ্রণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যগত সমস্যা মুসলিম সংখ্যালঘুদের ‘শুদ্ধি’ এবং শিক্ষা-সংস্কৃতিগত ইরতিদাদ ও ধর্মত্যাগের হাত থেকে রক্ষার প্রকল্প ইসলামের ভাই ও বোনেরা! আমি বেশ কিছুদিন ধরে অনুভব করছি যে, ভারতবর্ষে ইসলামি সাম্রাজ্যের অনুপস্থিতির কারণে, মুসলমান এবং অমুসলমান পবিত্র কুরআন এবং হাদিসের মুদ্রণ এবং বিক্রি করার সাধারণ, নিরঙ্কুশ এবং অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে গেছে। এর দরুন কুরআনুল কারীমের অসম্মান ছাড়াও, অনেকগুলি ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। অধিকাংশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক ব্যক্তিরা শুধু পার্থিব মুনাফালাভ ও সম্পদ অর্জনের জন্য পবিত্র কুরআনকে যাচ্ছেতাই ছাপিয়ে বিক্রি করছে এবং লাখ লাখ রুপি কামাই করছে। এছাড়াও ছাপা ও বেচা-বিক্রির অবস্থায় তারা অনেক সময় পবিত্র কুরআনের সম্মান ও পবিত্রতার লেহাজ মোটেও রাখে না, বরং তারা কুরআনের অবমাননার জন্য দোষী হয়। বাণিজ্যিক লোকদের থেকে পবিত্র কুরআন ও পবিত্র ধর্মগ্রন্থাবলীর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের আশা করা ভুল। আমি মনে করি যে, অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স পবিত্র কুরআনের সঠিক মুদ্রণ ও বিতরণের গুরুত্বপূর্ণ কাজটির তত্ত্ববধান করবে এবং এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে। পবিত্র কুরআনের সুরক্ষা ও প্রসার এই কনফারেন্সের প্রধান পঞ্চলক্ষ্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষ্য, যা ১৮৮৬ সালে এর প্রথম সভায় অনুমোদিত হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত, কনফারেন্স এর জন্য খুব কম কাজই করতে পেরেছে। আমার প্রস্তাব হলো, মুসলিম নেতৃবৃন্দ এবং আলিমদের এবং কনফারেন্স প্রতিনিধিদের একটি শক্তিশালী প্রতিনিধিদল ভাইসরয় বাহাদুরের নিকটে উপস্থিত হওয়া উচিত এবং এমন একটি সাংবিধানিক বিলের জন্য তাদের সমর্থন তলব করা উচিত, যার মাধ্যমে হিন্দুস্তানে অমুসলিমদের জন্য পবিত্র কুরআন, হাদীস এবং ফিকহের কিতাবাদির প্রকাশ ও ব্যবসা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে এবং কেন্দ্রীয় পরিষদের মুসলিম লীগ পার্টিকে এ বিষয়ে একটি বিল পেশ করার জন্য অনুরোধ করা উচিত। আমার আরও পস্তাব হলো, সমগ্রভারতে পবিত্র কুরআন, হাদিস এবং ফিকহশাস্ত্রের প্রাচীন ক্লাসিক্যাল কিতাবসমূহের মুদ্রণ, বিতরণ এবং বাণিজ্যের মনোপলি ইসলামি জাতির পক্ষে সংরক্ষণ করা উচিত এবং ভারতবর্ষের ইসলামি মিল্লাতের পক্ষ থেকে এই কিতাবগুলো বিভিন্ন আকারে এবং সংস্করণে মুদ্রণের এবং বিতরণের কাজটি, একটি উলামা পরিষদের হাতে হস্তান্তর করা উচিত, যারা অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স আলীগড়ের অধীনে এই কাজটির একাডেমিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্বাবধান করবে। এই পরিষদের সভাপতি হবেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের দীনিয়াত বিভাগের প্রধান এবং সেক্রেটারি, ট্রাস্টি মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের নবাব সদর ইয়ার জং মৌলনা হাবিবুর রহমান খান শারওয়ানি এবং পরিষদের সদস্যবর্গ হবেন হিন্দুস্তানের ক্ষমতাবান আলিম ও বিশেষজ্ঞগণ। পবিত্র কুরআন, হাদীস, ফিকহ, তাফসীর প্রভৃতি বিষয়ের সেই সকল প্রাচীন ক্লাসিকাল শাস্ত্রীয় কিতাবের একটি তালিকা তৈরি করা হবে, যেগুলির মুদ্রণ ও প্রচারস্বত্ব জাতিকর্তৃক সংরক্ষিত হওয়া জরুরী বলে বিবেচিত হবে। তাফসীর, ব্যাখ্যাগ্রন্থ, ফিকহ প্রভৃতির নতুন বই-পুস্তক এই সংরক্ষণ ও বিধিবদ্ধতা থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত হবে। অর্থাৎ, প্রাচীন ক্লাসিকাল কিতাবের বাইরে নতুন ধর্মীয় বইপুস্তকর মুদ্রণ ও বিতরণের অধিকার ইসলামি জাতির প্রতিনিধি হিসেবে এই কনফারেন্সের জন্য আইনত সুরক্ষিত থাকবে। এই বাণিজ্য থেকে যে লাভ হবে, তা শিক্ষা তহবিলের ইসলামিয়াত বিভাগের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। আমার মতে, তালিকাভুক্ত পবিত্র গ্রন্থাদির মুদ্রণ ও বাণিজ্য থেকে প্রাপ্ত মুনাফা এই কনফারেন্সের ২, ৩ এবং ৪ নম্বর উদ্দেশ্যের কাজে ব্যয় করা উচিত। অর্থাৎ, (১) প্রথমত এই ফান্ডকে সাধারণ স্কুলগুলিতে দীনিয়াত শিক্ষার ব্যবস্থায়, (২) প্রাচ্যীয় জ্ঞানকলা এবং দীনিয়াতের উচ্চতর ইসলামি মাদ্রাসাগুলির উন্নয়ন ও সহায়তায়, এবং (৩) আধুনিক মকতব সিস্টেমের মাধ্যমে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে, বিশেষ করে সেসব অঞ্চল, প্রদেশ ও রাজ্যের মুসলমানদের মধ্যে যেখানে মুসলিম সংখ্যালঘুরা অবহেলিত এবং শিক্ষাগত ও ধর্মীয় ইরতিদাদের ঝুঁকিতে রয়েছে, সেখানে ইসলামি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে ব্যয় করা হবে। সারমর্ম হলো, এই দীনি কিতাবসমূহের ব্যবসা থেকে যে লাভ হয়, তা দীনিয়াতের সাধারণ প্রাথমিক ও উচ্চতর ইসলামি শিক্ষার বিকাশে ব্যবহার করা হবে এবং এই আয় অন্য কোনো কাজে ব্যয় করা উচিত নয়। আপনারা অবগত আছেন যে, রাজপুতানা, সাঁওতাল পরগনা, মধ্য ভারতের অনেক এলাকার মুসলিম সংখ্যালঘুরা ইসলামি শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকার কারণে মালকানদের মতো ইরতিদাদ ও ইসলাম ত্যাগের ঝুঁকিতে রয়েছে। আপনারা এও অবগত যে, হিন্দু রাজ্যগুলিতে, শিক্ষাগত শুদ্ধি’র এই পলিসি কমবেশি অনুসৃত হচ্ছে এবং উর্দু ও ইসলামি শিক্ষার চিহ্নগুলি মুছে ফেলা হচ্ছে, ঠিক যেমন মহারাজা আলওয়ার তার রাজ্যে আইন করে মিটিয়ে ফেলতে চেয়েছিল। আপনারা আরও জানেন যে, ভারতের যেসব প্রদেশে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং যেখানে কনগ্রেস ক্ষমতায় আছে, সেখানে উর্দু স্কুল এবং মুসলিম মাদ্রাসা এবং সাধারণ শিক্ষাগত উদ্দেশ্য এবং ইসলামি কালচারের সাথে অত্যন্ত অনভিপ্রেত আচরণ করা হচ্ছে। মুসলমানরা যদি তাদের মোকাবিলাকে সংগঠিত ও সুদৃঢ় না করে, তবে এসব এলাকায় তারা মারাত্মক বিপদে পড়বে এমন আশঙ্কা রয়েছে। আপনারা এ ব্যাপারেও অবগত আছেন যে, এই মহা হুমকি মোকাবেলার জন্য বিপুল অর্থ এবং স্থায়ী কর্মীর একটি বাহিনী প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের প্রস্তাব যদি বাস্তবায়িত হয় এবং কুরআনহাদিসের মুদ্রণ ও ব্যবসাকে এই কনফারেন্সের জন্য আইনত সংরক্ষিত করে নেওয়া যায়, তাহলে, আল্লাহর ইচ্ছায়, আমাদের শিক্ষা তহবিলে পর্যাপ্ত অর্থের স্থায়ী আয় দীনিয়াত এবং ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের জন্য খুব সহজেই পাওয়া যাবে, যা কংগ্রেসী প্রদেশ এবং হিন্দু রাজ্যগুলিতে বিশেষভাবে, এবং সমগ্রদেশে সাধারণভাবে প্রাথমিক ইসলামি শিক্ষা এবং ইসলাম-অধ্যয়ন এবং দীনি উলূম ও ফুনূনের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য একটি বিরাট সমর্থন প্রমাণিত হবে। যদি মুসলমানরা তাদের আন্তরিক ও নিরন্তর সংগ্রামর মাধ্যমে এই অভিযানে সফলতা অর্জন করতে পারে, তবে জাতি হিসেবে এই প্রকল্প থেকে অনেক সুফল পাব এবং সাধারণ প্রাথমিক ইসলামি শিক্ষার সুরক্ষা ও সম্প্রসারণ ছাড়াও, উচ্চতর ইসলামি মাদ্রাসাগুলোকেও শক্তিশালী করা যাবে। এতে অমুসলিমদের ক্ষতিসাধন হয় না, মুসলমানদের উপকার হয় মাত্র। তাই আমাদের এই জাতীয় দাবি ও চাহিদার বিরোধিতা করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ অন্য দলগুলোর নেই। জাতির প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদেরকে এই প্রস্তাবটি বিবেচনা করার আরজি জানাচ্ছি। আমি এই উদ্দেশ্যে আমার সামান্য সেবা পেশ করছি, আর আমি বিশ্বাস রাখি, মুসলমানরা ঐক্য ও স্থৈর্যের সাথে কাজ করলে তারা এ উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় আইন পাস করতে সফল হবে। উর্দু ভাষা ও লিপি উর্দু ভাষা ও লিপির গুরুত্ব¡ কোনো ব্যাখ্যার মুখাপেক্ষী নয়। উর্দু হিন্দুস্তানের অতীত ইতিহাসের উজ্জ্বলতম এবং ঐক্যবাদী স্মারক। আজ থেকে সামান্য ক’দিন আগেও বাঙ্গলা ছিল উর্দুভাষার বিকাশভূমি। বর্তমান উর্দু গদ্য রচনার সূচনা হয়েছিল এই কলকাতায়। উর্দু ভাষার মহান লেখক ও কবিদের জন্ম হয়েছে বাঙ্গলায় এবং তাদের অবিশিষ্ট ঐশ্বর্য এখনও সর্বত্র পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে স্কুলগুলির আধুনিক ব্যবস্থার বদৌলতে অবস্থা এই হয়েছে যে, উর্দু থেকে দূরত্ব ও বৈরিতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এই বিপদ অনুভব করা হচ্ছে যে, যদি পুরোনো প্রজন্ম শেষ হয়ে যায় এবং অবস্থার সংস্কার না করা হয়, তবে বাঙ্গলায় উর্দু বোঝে এমন কেউ থাকবে না। স্কুলে উর্দুকে পরীক্ষার বাধ্যতামূলক দ্বিতীয় ভাষা ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে এর প্রতিকার করা যেতে পারে, অন্তত মুসলমানদের জন্য। বাঙ্গলায় এই প্রস্তাবটি এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত না হওয়ার একটি প্রধান কারণ হলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসহযোগিতা, যেটি বাংলার স্কুল, কলেজ এবং পাঠ্যক্রমের উপর অসাধারণ এক্তিয়ার রাখে, অথচ বিশ্ববিদ্যালয়টি না প্রদেশের হিন্দুদের নিয়মতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের দাবি করতে পারে, না মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বের সাথে এর দুরতম কোনো সম্পর্ক আছে। তদুপরি বর্তমানে এটি সমগ্রবাঙ্গলার মুসলমান, অচ্ছুৎ এবং অন্যান্য দল এবং স্বয়ং সাধারণ হিন্দুদের শিক্ষাগত স্বার্থের বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি এই সমস্যাটি নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করব। এখন আমি শুধু এটুকুই আরজ করব যে, আমি অন্তত বাঙ্গলার মুসলমানদের জন্য উর্দুকে একটি বাধ্যতামূলক বিষয় করার সিদ্ধান্তনিয়েছি এবং সাধারণ মুসলমানদের সমর্থনে আমি এতে সফল হব। উর্দু লিপির বিকাশ ও সংরক্ষণও একটি অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহর রহমতে এই লিপির সুবাদে মুসলমানদের অনেক স্বাচ্ছন্দ্য ও সুবিধা হয়েছে। ফার্সি, পশতু, কাশ্মীরি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি ও উর্দু একই লিপিতেই লেখা হয় এবং এই লিপির সার্বজনীনতার কারণে আমরা বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে একে অপরের খুব কাছাকাছি। আমরা এই লিপির সংস্কার এবং বিকাশের যে কোনও প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই, কিন্তু অন্য কোনও লিপির সাথে এটি প্রতিস্থাপন করার যে কোনও পরামর্শের তীব্রবিরোধিতা করি। ভাষার সমস্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মুদ্রণ সমস্যা। নানা কারণে, বর্তমান যুগে প্রতিটি ভাষার জন্য যত দ্রুত সম্ভব, কম খরচে মুদ্রণের ব্যবস্থা করা সেই ভাষাটির টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন। এই যুগে, মুদ্রণের সুবিধালাভ করা ছাড়া কোনো ভাষা বিকশিত হওয়া দূরের কথা, টিকে থাকতেও পারে না। তাই ইংরেজি ভাষার সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে লিনোটাইপ মেশিন উদ্ভাবন করা হয়েছে, যার সাহায্যে স্বল্প খরচে এবং অল্প সময়ে ইংরেজি ভাষার মুদ্রণ খুব ভালোভাবে করা যায় এবং ইংরেজি ভাষা প্রতিনিয়ত প্রসার এবং বিকাশ লাভ করতে থাকে। এটা ছিল উর্দু ভাষার দুর্ভাগ্য যে এ পর্যন্ত খুব কম লোকই এই সমস্যার সঠিক সমাধানের দিকে মনোযোগ দিয়েছে, যার ফলে প্রাচীন পদ্ধতিতে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে উর্দু মুদ্রণ করা হচ্ছে, যার ত্রুটি ও জটিলতা সম্পর্কে মুদ্রণ সংশ্লিষ্ট কাজের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি মাত্রই অবগত। একটি বৈপ্লবিক উদ্ভাবন ‘কাদরী খত’ এবং উর্দু-লিনোটাইপ আমাদের জাতীয় ভাষার বিকাশের পথে এই একটি বড় বাধা ছিল এবং আছে, তবে মনে হচ্ছে আল্লাহ আমাদের এই সমস্যা সমাধানের পথ তৈরি করতে চলেছেন। উর্দু ভক্তরা বহুদিন ধরেই এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে আসছিলেন।

তবে আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, আমাদের শহরের একজন যুবক জনাব আব্দুল ওয়াদুদ বিএ মাওলানা হাকিম আবুল বারাকাত আব্দুর রউফ কাদরী’র (সভাপতি কলকাতা জেলা মুসলিম লীগ) মহান উত্তরসূরী, বছরের পর বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর একটি বিশেষ লিপি ও টাইপ উদ্ভাবন করেছেন। এই লিপির নাম দেওয়া হয়েছে ‘কাদরী খত’। এর কিছু বৈশিষ্ট্য এমন যে, আশা করা যায়, এটি উর্দু টাইপরাইটার এবং উর্দু কম্পোজিং ও মুদ্রণ ইত্যাদি সমস্যার সমাধান করবে। আমি শ্রদ্ধেয় ভদ্রলোক ও ভাষাপ্রেমীদের ‘কাদরী লিপি’র সম্ভাব্য বিকাশকে কাজে লাগাতে এবং এর মাধ্যমে ভাষার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে অনুরোধ করছি। নারী শিক্ষা ও ‘মুহসানাত’ এর মূল লক্ষ্য মুসলমানদের এমন একটি সমাবেশে নারী শিক্ষা নিয়ে আমার বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই। যাদের রাসূল (আল্লাহর রহমত ও আশীর্বাদ তাঁর উপর বর্ষিত হোক) জ্ঞান অর্জনকে প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য সমান কর্তব্য করেছেন এবং দোলনা থেকে কবর পর্যন্তজ্ঞান শিক্ষার উপর জোর দিয়েছেন এবং উলামা ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের ‘রোশনাই’কে শহীদদের রক্তের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করেছেন এবং আল্লাহর সৃষ্টি-কারিগরি নিয়ে ধ্যান-মননকে উপাসনা ও সাধনার চেয়ে উত্তম বলেছেন, খুবই দুঃখের বিষয় যে আজ আমরা নারী শিক্ষায় সমস্তভারতীয় জাতির চেয়ে পিছিয়ে। কোনো জাতিই জীবনে সফলভাবে অন্য দলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে না, যদি তার অর্ধেক অংশ অজ্ঞ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে অসচেতন এবং জীবনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উদাসীন হয় এবং বিপদের সময় তার পুরুষদের সাহায্য করার অযোগ্য হয়। এর একটি বাস্তব উদাহরণ আপনি বর্তমান ইউরোপের প্রভাবশালী দেশগুলির বর্তমান যুদ্ধ-সংগ্রামে দেখতে পাবেন, যেখানে নারীরা পুরুষদের প্রায় সকল দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এবং তারা অফিস, কারখানা এবং জটিল-কঠিন বিষয় সফলভাবে সম্পন্ন করছে। প্রতিটি স্বাধীন ও সভ্য জাতির নারীর এই অবস্থা। জ্ঞান ও শিল্পে সজ্জিত তুরস্কের নারীরা দেশের নির্মাণ ও প্রতিরক্ষায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। এমনকি তুর্কি নারীরা সামরিক ও বিমান বাহিনীতেও তাদের বিশেষ জায়গা গড়ে তুলেছে। হিন্দুস্তানের মুসলমানদের তাদের নারীদের জ্ঞান ও শিল্পদক্ষতায় সজ্জিত করার জন্য এবং জাতি ও মিল্লাতের নতুন নতুন দায়িত্ব গ্রহণের উপযোগী করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তবে তারা এই বিষয়টিকে সর্বদাই প্রধান নীতি হিসেবে নিজের সামনে রাখবে যে, মুসলিম নারীর মূল লক্ষ্য হলো একজন ভালো এবং ‘মুসলিম’ মা হওয়া। তার পরিবারকে রক্ষা করা এবং ইসলামি সমাজের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা। পবিত্র কুরআন এমন মুসলিম নারীদের, যারা তাদের নারীত্ব, মাতৃত্ব, পরিবার ও ইসলামি সমাজ ও শরীয়াকে রক্ষা করতে সচেষ্ট, তাদেরকে ‘মুহসানাত’ নামে অত্যন্তঅর্থপূর্ণ উপাধি দিয়ে স্মরণ ও বরণ করেছে এবং কুরআনের একটি অংশকে এই নামে নামকরণ করার বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। ‘মুহসানাতে’র আসল অর্থ দুর্গ। আমাদের নারীরা আমাদের জাতির প্রতিরক্ষার দুর্গ। আমাদের নারীরা আমাদের পারিবারিক জীবন, আমাদের জাতীয় ও ইসলামি সমাজ, আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও ইতিহাস, আমাদের ভাষা ও সাহিত্য, আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং আমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এবং আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ইস্পাত-দৃঢ় প্রাচীর। এই কারণেই উম্মত এবং উমুমতের (মাতৃত্ব) মধ্যে শব্দ এবং অর্থগত একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এই মূল লক্ষ্যের অধীনে আমি মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার জন্য কলকাতায় বিশেষ পর্দা-রক্ষী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছি। আমাদের প্রত্যাশা, কলেজটি মুসলিম নারীদের জন্য ইসলামি প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার কেন্দ্র হয়ে উঠবে এবং আমাদের মেয়েদেরকে, কুরআনের ভাষায়, দ্বীন ও জাতির ‘মুহসানাত’ হিসেবে গড়ে তোলাই এর উদ্দেশ্য।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাগণ,

 আমি ইচ্ছাকৃতভাবে এ পর্যন্ত বাংলার মুসলমানদের শিক্ষাগত জরুরত ও চাহিদার কোনো উল্লেখ করিনি। কারণ, এই বিষয়টি বাংলার শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে আমার ব্যক্তিগত দায়িত্বের বিষয়। বাংলার মুসলমানদের শিক্ষাগত উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত, অন্যায্য ও অগণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশন। এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বলা হয় সমস্ত বাংলার বিশ্ববিদ্যালয় এবং এটি সমস্ত বাংলার স্কুল ও কলেজগুলির অধিভুক্তি, পরিদর্শন ও নিয়ন্ত্রণ এবং পাঠ্যক্রমের উপর ক্ষমতা রাখে, কিন্তু বাস্তবে এর মধ্যে বাংলার ৫৫ শতাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ৩০ শতাংশেরও বেশি অচ্ছুৎ ও পশ্চাদপদ জাতিগুলির একেবারেই কোনও প্রতিনিধিত্ব এবং কোনও কণ্ঠস্বর নেই। সত্য হলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো জাতি বা দলের প্রকৃত প্রতিনিধি নয় এবং প্রদেশের কোনো বিশেষ জাতির পক্ষে কথা বলার অধিকারও নেই, এবং এর সিনেট এবং সিন্ডিকেটের সদস্যদের এই নির্বাচনটিও এমনভাবে করা হয় না, যাতে বাংলার বিভিন্ন বাসিন্দা এতে কিছুটা প্রতিনিধিত্ব এবং কণ্ঠস্বর পায়। এর শিক্ষাগত, জ্ঞানগত এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রগুলিতে মুসলমানদের অস্তিত্ব শূন্যের কোঠায়, তবুও এটি এই প্রদেশের শিক্ষা-নীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে, যার জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশ মুসলমান এবং ৩০ শতাংশের অধিক অনগ্রসর জাতি-গোষ্ঠী। কলকাতা ইউনিভার্সিটি হলো একটি স্ব-নির্বাচনী পরিষদ, যা কিছু কায়েমি স্বাথের্র দুর্গে পরিণত হয়েছে এবং সরকারের সমর্থনে মুসলমান ও অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠি এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদের শিক্ষাগত একাধিপত্য বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর এবং একেই তারা গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার বলে। আমি এমন মন্তব্যে পুরোপুরি ন্যায়সঙ্গত হবো যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র ভারতের প্রথম এবং বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়-ই নয়, বরং আইন ও সরকারের নামে গোটা জাতির উপর গুটিকয়েক লোকের একাডেমিক এবং শিক্ষাগত একনায়কত্বের জগত জোড়া এক নিকৃষ্ট উদাহরণ। বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এণ্ড ইন্টারমিডিয়েট এডুকেশন বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন দীর্ঘদিন ধরে এর সংস্কারের সুপারিশ করেছিল এবং সেকেন্ডারি এণ্ড ইন্টারমিডিয়েট এডুকেশন বোর্ড গঠনের অভিমত দিয়েছিল, যাতে করে স্কুল ও ইন্টারমিডিয়েট কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এখতিয়ার থেকে মুক্ত করে, জাতির ইচ্ছা ও চাহিদার অনুকূলে এগুলোর ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করা যায়। ইনশাআল্লাহ, আমি কলকাতা ইউনিভার্সিটি এ্যাক্টের সংশোধন এবং সেকেন্ডারি এণ্ড ইন্টারমিডিয়েট এডুকেশন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করে ছাড়ব এবং দেশের মানুয়ের সহযোগিতায় এর পথের সব বাধা শেষ পর্যন্ত দূর হয়ে যাবে। উর্দুর বিরোধিতা কোথা থেকে হচ্ছে এই সমস্যার নিরসন হলে বাঙ্গলায় মুসলমানদের জন্য উর্দুকে একটি বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে জারি করার পথে যে বাধা ছিল, তাও দূর হবে। আমি জানি যে বাংলার মুসলমান এবং অন্যান্য অনেক গোষ্ঠী চায় স্কুলে উর্দুকে বাধ্যতামূলক বিষয় করা হোক, কিন্তু বর্ণহিন্দুদের একাধিপত্যবাদী গোষ্ঠী, যারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে পৈতৃক উত্তরাধিকারে পরিণত করেছে এবং বাংলার সমস্ত স্কুলের পাঠ্যক্রমের উপর আধিপত্য বিস্তার করে আছে, তারা চায় না মুসলমানদের এই ইচ্ছা পূরণ হোক, যদিও এতে তাদের কোনো লাভ বা ক্ষতি নেই কিংবা এর সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। কারণ, আমাদের সরকার, মাদ্রাজের কংগ্রেস মন্ত্রণালয়ের মত, ক্রিমিনাল এ্যক্ট বলবৎ করে হিন্দিকে জোরপূর্বক জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে চায় না। বরং, এটিকে অন্যান্য জাতির জন্য একটি ঐচ্ছিক বিষয় এবং মুসলমানদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক বিষয় করতে চায়। কিন্তু এই কট্টর কুসংস্কারাচ্ছন্ন সংকীর্ণমনা দলটির মতে, যে কোনো আন্দোলন যা মুসলমানদের উপকার করে বা তাদের জাতীয় ঐক্যকে শক্তিশালী করে, তা নিন্দনীয় আন্দোলন এবং এটিই আদর্শিক মানদণ্ড, যার দ্বারা তার ন্যাশনালিজমের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও গুণ-মান পরিমাপ করা যায়। বাংলার মুসলমানরা ইসলামি হিন্দুস্তানের বৃহত্তম অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলার দেওয়ানি প্রদান (১৭৬৫), লর্ড কর্ণওয়ালিস এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩), লাখেরাজ সম্পত্তি বাজয়াপ্ত অভিযান (১৮২৯), লর্ড ম্যাকলের বিশুদ্ধ পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার এবং প্রাচ্যীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতায় মুলতবি (১৮৩৫) এবং আদালতের ভাষা হিসেবে ফার্সি ও উর্দু বর্জন (১৮৩৭) এবং ৫৭-এর পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে, আজ অবধি ব্রিটিশ সরকারের মুসলমানদের শিক্ষা বিষয়ে অপরাধমূলক অবহেলা, বরং মুসলমানদের ধ্বংস ও বিপর্যয়ের উপর অন্য দলগুলোর উন্নতি চরিতার্থ করার পলিসি বাঙ্গলার মুসলমানদেরকে সরকার ও রাষ্ট্রের আকাশ থেকে নামিয়ে অপমান ও লাঞ্ছনার ধুলোয় নিক্ষেপ করেছে। যার ফলে আজ পর্যন্ত বাংলার মুসলমানরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। বর্তমান মন্ত্রণালয় চরম সমস্যায় ভুগলেও, বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে, যারা হিন্দুস্তানের বিগত দুই শতাব্দীর সরকার বিপ্লব এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিপ্লবের ধ্বংসলীলার সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে, তাদেরকে চরম দারিদ্র্য ও অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে বের করে আনতে এবং এটিকে ইসলামি ভারতের একটি জীবন্তও গর্বিত অংশ করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রার্থনা করুন যেন আল্লাহ আমাদের এই প্রচেষ্টা ও সেবা-আকাঙ্খাকে পূরণ করেন। পরিশেষে, আবারও বাঙ্গলার সমস্তমুসলমান এবং কলকাতার মুসলমানদের পক্ষ থেকে আমি আপনাদেকে আন্তরিক স্বাগত জানাই। আল্লাহ আপনাদের সাথে থাকুন, আপনাদেরকে হিন্দুস্তানের ইসলামি মিল্লাতের সর্বোত্তম গঠনমূলক পরিষেবা প্রদানের তওফীক দান করুন এবং আলীগড় কনফারেন্সকে ভারতবর্ষের ইসলামি সংস্কৃতি ও শিক্ষার বিকাশ ও স্বাধীনতার জন্য আশার আলোকবর্তিকা করুন।