বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দুর্যোগের ঘনঘটা

আবদুল আউয়াল মিন্টু যেকোনো দেশের অর্থনীতির বর্তমান হালচাল বিচার করতে গেলে, প্রথমেই যেসব বিষয় সামনে চলে আসে তা হলো- সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন নির্দেশক, বাজার ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক নীতিমালাসমূহ। সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো ‘সার্বিক চাহিদা’ বা অর্থনৈতিক পরিভাষায় ‘জিডিপি’ অথবা ‘সার্বিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন’ বৃদ্ধি করা। অতপর এ লক্ষ্য অর্জনে যথাযথ নীতি প্রণয়ন, প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানো। বেসরকারি ভোগ ও সরকারের ব্যয় সার্বিক চাহিদার সাথে সম্পর্কিত দু’টি অপরিহার্য অঙ্গ-উপাদান। সামষ্টিক অর্থনীতির আরো একটি অন্যতম প্রধান ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো- মূল্যস্ফীতিকে স্থিতিশীল, নিম্নমুখী ও নিয়ন্ত্রণে রাখা। এ উদ্দেশ্য অর্জনে জরুরি বিষয় হলো, সার্বিক মোট চাহিদাকে একটি নির্দিষ্ট সীমা বা গণ্ডির মধ্যে ধরে রাখা। তবে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এসব অঙ্গ-উপাদানের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন। এর অর্থ হলো, পরিকল্পনামাফিক চাহিদা বাড়ানো, যাতে করে দেশের অব্যবহৃত সম্পদের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার করা যায়। একই সাথে, দেশের সম্ভাব্য উৎপাদন সামর্থ্যকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায়। মোটকথা হলো, সামষ্টিক অর্থনীতির নির্দেশকগুলোকে একটির সাথে অপরটির সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার করে দেশের জন্য ক্রমাগত ভাবে সম্পদ সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করা। মূল্যস্ফীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতির অন্য সব নির্দেশকই নিরন্তর পরিবর্তনশীল। এগুলো একটির সাথে অপরটি পরস্পর সম্পর্কিত ও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই সরকার যদি সামষ্টিক অর্থনীতির কোনো বিশেষ নির্দেশকের লক্ষ্য অর্জন করতে চায়, যেমন- জিডিপির দ্রুত প্রবৃদ্ধি, তাহলে অন্য নির্দেশকগুলোকে অবশ্যই যুগপৎ বিবেচনায় নিতে হবে। তবে সামষ্টিক অর্থনীতির হালচাল বিশদভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে…

পানি-অস্তিত্বের এক দৈব উপাদান

আবদুল আউয়াল মিন্টু দৈব, অদ্ভুত ও বিচিত্রতা হলো পানির অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের গ্রহের বিবর্তনের মৌলিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। পানির ভৌত এবং রাসায়নিক প্রকৃতি, আকৃতি, আচরণ ও চরিত্র এবং এর বহুমুখী ব্যবহার আমাদের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য। তাই পানি, প্রাণের জন্ম ও বিকাশ এবং বাস্তুতন্ত্রের (Ecosystems) জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ। অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের কারণেই প্রাণের সাথে পানির একটি মিথোজীবী (Symbiotic) সম্পর্ক আছে। প্রতিটি জীবের প্রতিটি জীবন্ত কোষের (Cell) অন্ত:স্থলের কাজ থেকে শুরু করে, গোটা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র সৃষ্টি ও টিকিয়ে রাখা, এ সবই পানির ওপর নির্ভরশীল। জীবনের অস্তিত্ব রক্ষার চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, মহাবিশ্বের সাধারণ দু’টি উপাদান যেমন; হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মিলে পানির সৃষ্টি। পানি এক অনন্য, অসাধারণ ও নিখুঁত পদার্থ, যা আমাদের জীবনকে টিকিয়ে রাখে। পানির বৈশিষ্ট্যপানির বৈশিষ্ট্য একেবারেই অনন্য। এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্য অন্য সব পদার্থ থেকে একেবারেই আলাদা। এই বৈশিষ্ট্যগুলো পানিকে তরল অবস্থা থেকে বরফের কঠিন অবস্থা; বরফ থেকে তরলে পরিণত; আবার তরল থেকে বাষ্পে পরিণত করতে পারে। তারপর আবার বাষ্প থেকে তরল অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। আর এই তরল পানি হলো; আমাদের পৃথিবীর সব জীবের প্রাণের কেন্দ্রবিন্দু। মূলত এই “একক, অসাধারণ ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের শক্তিগুণে” একদিকে যেমন পানির প্রতিটি অণু (Molecule) এককভাবে কাজ করতে পারে, আবার একইসাথে অন্য পদার্থের অণুর সাথে ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় লিপ্ত হয়ে একত্রে কাজ করার ক্ষমতা রাখে। পানির এই অনন্য বৈশিষ্ট্য অন্য যেকোনো পদার্থ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বতন্ত্র।…

শেরে বাংলা উর্দুকে বাঙালি মুসলমানদের শিক্ষার মাধ্যম করতে চেয়েছিলেন

(১৯৩৯ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্সে প্রদত্ত ভাষণ) উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বক্তব্য দেওয়ার কারণে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মুসলিম লীগ নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেছিল এবং বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন শুরু করেছিল, তা ক্রমে পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে এবং শেষপর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচণ্ড সংগ্রামের রূপ নিয়েছিল। কিন্তু শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ১৯৩৯ সালে যখন বঙ্গীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষা মন্ত্রী ছিলেন, তখন অবিভক্ত বাংলায় বাঙালি মুসলমানদের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে উর্দু চালু করার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন।  ১৯৩৯ সালের ২৯-৩১ সেপ্টেম্বর কলকাতার মোহাম্মদ আলী পার্কে অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের ৫২তম বার্ষিক অধিবেশনে প্রদত্ত সভাপতির ভাষণে শেরে বাংলা ফজলুল হক বলেন, “আমি জানি, বাংলার মুসলমানসহ অনেকে চান যে স্কুলে উর্দু বাধ্যতামূলক করা হোক। কিন্তু বর্ণহিন্দুদের একাধিপত্যবাদী গোষ্ঠী, যারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে পৈতৃক উত্তরাধিকারে পরিণত করেছে এবং বাঙ্গলার স্কুলের পাঠ্যক্রমের উপর আধিপত্য বিস্তার করে আছে, তারা চায় না মুসলমানদের এই ইচ্ছা পূরণ হোক। যেখান থেকে উর্দুর বিরোধিতা হচ্ছে তা দূর করা হলে বাংলায় মুসলমানদের জন্য উর্দুকে একটি বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে জারি করার পথে আর কোনো বাধা থাকবে না।” উর্দুতে দেওয়া শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের ভাষণের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হলো। তাঁর ভাষণ বাংলায় অনুবাদ করেছেন কাজী একরাম   ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ,  আমি, বাংলার মুসলমানদের পক্ষ থেকে, অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের এই ৫২ তম…

মুলায়েম সিং যাদবের রাজনীতি এবং মুসলমান

মাসুম মুরাদাবাদী  ভারতের সমাজবাদী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মুলায়েম সিং যাদব ১০ অক্টোবর ৮২ বছর বয়সে মারা গেছেন। তিনি তিনবার ভারতের সবচেয়ে বড় জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এবং একবার দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯৭ সালে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড হরকিষেণ সিং সুরজিতের সাহায্যে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারের খুব কাছাকাছি চলে গেছিলেন তিনি; কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং ও লালুপ্রসাদ যাদব তার এ ইচ্ছা পূরণ হতে দেননি। একজন স্কুলশিক্ষক হিসেবে জীবন শুরু করা মুলায়েম সিং রাজনীতির শিখরে কিভাবে পৌঁছলেন, সে কাহিনী যেমন চিত্তাকর্ষক, তেমনি শিক্ষণীয়। তার জীবনের সবচেয়ে কষ্টদায়ক মুহূর্ত ছিল, যখন তার পুত্র অখিলেশ যাদব তাকে অক্ষম করে দিয়ে সমাজবাদী পার্টির নেতৃত্ব হাতিয়ে নেন। এ পরিস্থিতিতে তীব্রভাবে অস্থির হয়ে তিনি তার এক ঘনিষ্ঠ কর্মীকে বলেছিলেন, ‘আমি কি এখন আত্মহত্যা করব’? তিনি সমাজবাদী পার্টিকে বেশ কষ্ট ও পরিশ্রম করে গড়ে তোলেন। আর ইউপির মুসলমান তার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পুঁজি ছিল। মুসলিম ভোটের বদৌলতে তিনি তিনবার মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছেন এবং ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ২২টি আসনে জয়লাভ করেন। আমি একজন সাংবাদিক হিসেবে যেসব রাজনীতিবিদকে খুব কাছে থেকে দেখেছি, তাদের মধ্যে মুলায়েম সিংয়ের নাম সবার শীর্ষে। এটি সম্ভবত ১৯৯৪ সালের ঘটনা। দিল্লিতে মুলায়েম সিং যাদব এমন একজন ব্যক্তির সন্ধানে ছিলেন, যিনি উর্দু ভাষায় পারদর্শী হওয়ার পাশাপাশি সুন্দর হস্তলিপিতে লিখতেও পারেন। মূলত তৎকালীন শাহী ইমাম সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ বুখারি তাকে মুসলিম সমস্যার ওপর উর্দুতে একটি পত্র লিখেছিলেন। ওই পত্রের জবাব তিনি উর্দুতে দিতে চাচ্ছিলেন। কেউ এ কাজে অধমের নাম প্রস্তাব করেন। এক দিন সকালে সমাজবাদী পার্টির অফিস…

ভোট কিংবা ব্যাংক লোপাট: ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান  সাম্প্রতিক ও অতীতের কিছু ঘটনা আমাকে ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’ প্রবাদবাক্যটির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। প্রথম ঘটনাটি বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য ও এর পরবর্তী ঘটনা নিয়ে। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এবং ফ্রেডরিক এবারট স্টিফটুং (এফইএস) আয়োজিত ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ অনুষ্ঠানে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে দেখতে চায় জাপান। তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে আমরা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কথা শুনেছি, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও শুনিনি। আমি আশা করব, এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না।’ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রদূত নাওকিকে ডেকে পররাষ্ট্র সচিব সাক্ষাৎ করেন। উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূতকে ডেকেছিলাম। তাঁকে যা যা বলা দরকার আমরা বলেছি।’ ঘটনার ওপর প্রলেপ দেওয়ার জন্য জাপানের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের ভোট নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা দুষ্ট লোকের ভুল তথ্যে ‘সাদামনে’ বলেছেন বলে দাবি করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘কিন্তু তিনি আসলে বাংলাদেশের একজন ভালো বন্ধু।’ তত দিনে জাপানের শিনানো নদীতে অনেক জল গড়িয়ে গেছে, খবর আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন জাপান সফর স্থগিত করা হয়েছে। গত ২৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে যাওয়ার কথা ছিল। ওপরের ঘটনাপ্রবাহ আমাকে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে গুলশানে একটি নৈশভোজ-পূর্ব ককটেলসে আমাদের একজন ঝানু কূটনীতিবিদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের আলোচনার কথা মনে করিয়ে দেয়। স্মৃতি থেকে বলছি। কূটনীতিবিদটি ছিলেন পররাষ্ট্র…

প্রেমের তালায় জর্জরিত বিশ্বের বিখ্যাত সব সেতু

জবরদস্তি করে কি প্রেম হয়? জাদু-টোনা করেই বা কে কবে প্রেমে সফল হয়েছে? তবুও প্রেমের খাতিরে প্রেমিক-প্রেমিকা কি না করে। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে জীবন দেওয়ার ঘটনা অনেক। প্রেম হয়ে গেলে তা অটুট রাখার পদ্ধতিও অনেক। ইউরোপ আমেরিকায় গত দুই দশকে প্রণয়রতদের প্রেম অটুট রাখা, অথবা অন্তত প্রেমের স্মারক হিসেবে বিখ্যাত সব সেতুতে তালা লাগিয়ে তালার চাপি পানিতে নিক্ষেপ করার ঘটনা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল এবং এর সেরা সাক্ষীতে পরিণত হয়েছিল ‘সেইন’ বা ‘সিন’ নদীর ওপর বিখ্যাত সেতু ‘ পন ডিজ আ” (Pont des Arts) যে সেতুর রেলিং, বেস্টনি জুড়ে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে প্রেমপাগল যুগলেরা ৭ লক্ষাধিক তালা লাগিয়ে সেতুটির অস্তিত্ব বিপন্ন করে ফেলেছিল। নগর কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপে ২০১৪ সালে সেতুটি তালামুক্ত হয়ে স্বস্তির দম ফেলেছে। তালা সরানোর কাজ করতে সেতুটি এক সপ্তাহের জন্য লোকজনের চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল। পরে ব্রিজে নিরাপত্তামূলক কাচের প্যানেল লাগানো হয়েছে, যাতে তালা লাগানোর কোনো সুবিধা নেই। বহু ভাষায় কবিতা ও গানে তালা-চাবি প্রেমের ক্ষেত্রে রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও ইউরোপ আমেরিকায় প্রেমে তালা-চাবির প্রয়োগ ব্যাপক এবং অনেকটা সংক্রামক। শেষ পর্যন্ত প্রেমের পরিণতি যাই হোক না কেন, যখন একটি যুগল প্রেমে মত্ত তখন প্রেমকে আটকে রাখতে সেতুতে তালা ঝুলায়। শুধু প্রেমিক প্রেমিকা যুগল, বিবাহিত দম্পতিরাও এত তালা লাগায় যে নতুনরা আর তালা লাগানোর ঠাঁই পায় না। তারা তালার ওপর তালা লাগায়। তারা বিশ্বাস করে তাদের প্রেম সুপার গ্লুর মতো আটকে যাবে। কিন্তু ব্রিজ কর্তৃপক্ষ বা নগর…

মসজিদে বসে মদ পান করতে দাও (মির্জা গালিব)

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষার সকল বিখ্যাত মুসলিম কবি তাদের অসংখ্য কবিতায় মদ (শরাব) ও মদ পরিবেশনকারী বালিকাদের (সাকি) কথা বলেছেন। সূফি কবিতায় দুটিরই উপস্থিতি আরো বেশি। অথচ শরাব ও সাকির সঙ্গে ইসলামের দূরতম সম্পর্কও নেই। কবিরা মদ ও মাতাল হওয়াকে রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন, প্রকৃত মদ ও মাতলামির কথা বলেননি। প্রেমের মদ বা সুরা পানকে উল্লেখ করা হয়েছে আধ্যাত্মিকতার উন্মোচন এবং চিরন্তন সত্তাকে স্বীকার করার উপায় হিসেবে, যা আল্লাহর প্রতি পরম ভালোবাসার অভিব্যক্তি। আমি বেশ ক’জন বিখ্যাত উর্দু কবির কবিতাংশ তুলে ধরছি। আশা করি পাঠকদের ভালো লাগবে। ১“জাহিদ, শরাব পিনে দে মসজিদ মে বৈঠ কর,ইয়া ও জাগাহ বাতা’ জাহা পর খুদা না হো।” — মির্জা গালিব(পরহেজগার, মসজিদে বসে মদিরা সেবন করতে দাও,তা না হলে বলো, কোথায় খোদা নেই?) ২“গো হাথ কোন জামবিশ নেহি আখোঁ মে তো দম হ্যায়,রেহনে দো আভি সাগর-ও-মীনা মেরে আগে।” —- মির্জা গালিব(আমার হাত স্থবির হয়ে গেলেও আমার চোখ এখনো দেখতে পায়,আমার সামনে এখন রেখে দাও সুরাভর্তি সোরাহি ও পানপাত্র।) ৩“ওহ চিজ জিস কে লিয়ে হাম কো বেহিশ হ্যায় আজিজসিবায়ে বাদা-এ-গুফতাম-এ-মুশক-বু ক্যয়া হ্যায়। — মির্জা গালিব(যে বস্তুর জন্য এমনকি বেহেশত আমাদের এত প্রিয়,সুরার এই সুগন্ধির কাছে মৃগনাভির সুবাসও ম্রিয়মান।) ৪.“পিয়োঁ শরাব আগার খুম ভি দেখ লু দো চার,ইয়ে শিসা-ও-কাদা-ও-কুজা-ও-সুবু ক্যয়া হ্যায়।” —- মির্জা গালিব(মদিরা পান করো, এবং দু’চার কলসি পান করে ফেলো,কাঁচের ছোট্ট পানপাত্র, সোরাহির কথা বলে কী লাভ?) ৫“গালিব ছুট্টি শরাব পর…

উম্মে তাসবিহ’র দিনলিপি

উম্মে তাসবিহ ২৭ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার ২০২২ ইদানীং ভাই-বোনে একটা মজার খেলা পেয়েছি। গুগল ম্যাপ দিয়ে নানান জায়গা জুম করে করে খুঁজে দেখি। আমাদের নানী বাড়ি, দাদা বাড়ি, আমাদের বাসা, আমার দাদার বাড়ির নদী, আমার নানার বাড়ির কাছে স্টেডিয়ামে যেখানে প্রতি বছর বৈদ্যরা আসে, এমনকি পেয়ারাবাগ রেইলগেট! আজ সন্ধ্যায় আমার ভাই এক বিহ্বল সংবাদ নিয়ে এলো। স্ক্রিণের দিকে তাকিয়ে দেখি সেই ছোট, শান্ত দেলদুয়ার বাজারে আমার খালুর দোকান দেখা যায়। সেখানে সব দৃশ্য স্বাভাবিক, দোকানে মালের স্তুপ, কিছু গাঠরি গামছা দিয়ে ঢাকা, বোধহয় নতুন মাল কেনা হয়েছিল তখন কিন্তু গোছানো হয়ে ওঠেনি। দোকানে আমার খালু তখন অনুপস্থিত। কে জানে কোথায় গিয়েছেন! সব কিছু স্বাভাবিক। আশেপাশে গুটিকয়েক মানুষ দেখা যায়, আরেকটু জুম করলে বৈদ্যুতিক খাম্বার গায়ে আমার খালুর চাচা, মেম্বার পদপ্রার্থী ‘মেনহাজ খান সাহেব’ এর নির্বাচনী পোস্টারও দেখতে পাওয়া যায়- এই সবের মাঝে শুধু বুকের মধ্যে খচ করে লাগে একটা বাজারের ব্যাগ। জায়েদ আল- সাবিদ ফ্যাশন, আমার খালুর দোকানে সারি করে রাখা লাল রঙের টুলগুলোর একটার উপর রাখা আমার নানার বাজারের ব্যাগ। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিটা দশ মাস আগের। আমার নানা মারা গেছেন প্রায় চার মাস হয়ে এলো। দশ মাস আগে কি আমার নানা বাজারে যেতে পারতেন? না! এই ব্যাগটা নিয়ে আমার নানা যখন সুস্থ ছিলেন, বাজার করতে যেতেন। অর্ধেক বাজার হলে আমার খালুর দোকানে ব্যাগ রেখে কখনো বাকি বাজার করতে যেতেন, কখনো বসে জিরোতেন। দশ মাস আগে যখন এই ছবি তোলা…

মৃত্যু নিয়ে রুমির ভাবনা

(মৃত্যু অনন্তের সঙ্গে আমাদের বিয়ের মতো) আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু জীবজগতে একমাত্র মৃত্যুই অনিবার্য সত্য। জীবনের অংশ এবং আমাদের জীবনের কোনো এক পর্যায়ে মৃত্যু আসবে। কোরআনে বলা হয়েছে, “কুল্ল নাফসিন যায়িকাতুল মওত,” (প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।” ভগবদ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “মৃত্যুকে আমাদের নিত্যসঙ্গী বলেই মনে হয়, আমাদের জীবনে আমরা প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছি।” মৃত্যু সম্পর্কে পৃথিবীর সকল ধর্মবিশ্বাসে মোটামুটি অভিন্ন কথাই বলা হয়েছে, তা সত্বেও অধিকাংশ মানুষের কাছে মৃত্যু এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এতটাই ভয়ের যে আমরা মৃত্যু নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে চলি। মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়ার সকল জাগতিক উপায় ব্যর্থ হওয়ার পরও মানুষ মৃত্যু থেকে পালানোর চেষ্টা করতে ছাড়ে না। এমনকি যারা কোনো স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না, তারা সৃষ্টিকর্তার “শাহী” দরবারে রোনাজারি করে: “আল্লাহ বাঁচাও! ভগবান রক্ষা করো! ইশ্বর পরিত্রাণ দাও!” কিন্তু মৃত্যু পিছু ছাড়ে না। মৃত্যু যেহেতু অবশ্যম্ভাবী, অতএব প্রত্যেকের যা প্রয়োজন তা হলো, সেই অনিবার্যতার জন্য প্রস্তুত থাকা। আমরা মৃত্যুকে এড়াতে পারি না, কিন্তু মৃত্যুর জন্য নিজেদের ভালোভাবে প্রস্তুত করতে পারি। আটশ বছর আগের সুফি কবি জালালুদ্দীন রুমি তাঁর অসংখ্য কবিতায় মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, মৃত্যু ভয়ভীতির কোনো ব্যাপার নয়, মৃত্যু অনন্তের সঙ্গে মিলন। তাঁর উদ্ধৃতি মৃত্যু ভয়ে কাতর মানুষের অন্তর্দৃষ্টিকে খুলে হৃদয়কে ভীতিমুক্ত করে আত্মাকে প্রশান্ত করার উৎস হতে পারে। মৃত্যু নিয়ে রুমির উদ্ধৃতি পাঠ করুন, মতামত দিন ও শেয়ার করুন: ১, “আমাদের মৃত্যু অনন্তের সঙ্গে আমাদের বিয়ের মতো।” ২. “সুখে মৃত্যুবরণ করো এবং সামনে…