সাদি মোহাম্মদের আত্মহনন ও বিষন্নতা

শিল্পী সাদি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু খ্যাতি, অর্জন ও আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তাসত্বেও বিষন্নতা যে মানুষকে চরম পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে, তার প্রমাণ খ্যাতিমান রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সাদি মোহাম্মদের আত্মহননের ঘটনা। বিশ্বে বহু সফল ব্যক্তি বিষন্নতার কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। নোবেল পুরস্কার লাভ করেও আমেরিকান ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বিষন্নতা কাটেনি। মাথায় গুলি করে মরে গেছেন। ইংলিশ কবি ভার্জিনিয়া ওলফ বিষন্নতার শিকার হয়েছিলেন এবং সুইসাইড নোট লিখে পানিতে ডুবে মারা গেছেন। ফ্রাঞ্জ কাফকা বহুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। তিনি তার চিকিৎসককে পর্যন্ত বলেছিলেন, তাকে আফিমের ওভারডোজ দিতে, যাতে তিনি তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারেন। লিও টলস্টয় সম্পর্কেও বলা হয় যে তিনি জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু আত্মহত্যা করতে ভীত ছিলেন। জাপানের খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক ইওকিও মিশিমা আত্মহত্যা করেছেন। আমি সঙ্গীত প্রেমিক হলেও বলতে দ্বিধা নেই যে আমি বাংলা গান কমই শুনি। এই কম শোনার মধ্যেও সাদি মোহাম্মদের কণ্ঠে অনেক রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনেছি। গানের মধ্যে তার যে মগ্নতা থাকতো, যে কারণে মনে হতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝি গানগুলো তার জন্যই লিখেছেন। শেষ পর্যন্ত সঙ্গীতে মগ্নতাও সাদি মোহাম্মদের বিষন্নতায় তাকে আশ্রয় দেয়নি। সঙ্গীতের প্রতি তার প্রেম ও আবেগজাত যে আস্থা ছিল, সে আস্থাও তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। কেউ বিষন্ন হয়ে পড়লে তা যদি তার প্রিয়ভাজনদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে, তাহলে সেক্ষেত্রে তার উপযুক্ত চিকিৎসা ও পরিচর্যা এবং তাকে সঙ্গ দেওয়া জরুরী ছিল। সাদি মোহাম্মদের ক্ষেত্রে নি:সন্দেহে এসবের ব্যত্যয় ঘটেছে। ফলে তিনি জীবনকে আর উপভোগ্য বিবেচনা…

কবিদের মদ্যপান যৌনাচার: প্রসঙ্গ গিনসবার্গ ও মির্জা গালিব

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু মদপান ও যৌন সাহচর্য কি কবিদের অনিবার্য অনুসঙ্গ? বিশ্বের বহু সেরা কবির কবিতায় মদ ও মদ পরিবেশনকারিনী এবং অন্যান্য নারীর সদর্প উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। অনেক কবির কবিতায় দেখা যায় তারা কবি হয়েছেন শুধু নারীর কারণে। ভারতের বিখ্যাত গীতিকার আনন্দ বকশীর লেখা জনপ্রিয় এক গানের কথা হচ্ছে: “ম্যায় শায়ের তো নেহি/মগর এ্যয় হাসিন, জবসে দেখা ম্যায়নে তুঝকো/মুঝকো শায়েরি আ গেয়ি” (আমি তো কবি নই, কিন্তু ওগো সুন্দরী/যখন থেকে তোমাকে দেখেছি, আমার কবিত্ব এসে গেছে।) শুধু নারী নয়, অনেক বিখ্যাত কবির মাত্রাতিরক্ত টান ছিল শুধু পুরুষ সঙ্গ। তাদের মধ্যে বাঙালি কবিতাপ্রেমীদের অতি পরিচিত, বহু পুরস্কারে ভূষিত আমেরিকান কবির নাম অ্যালেন গিনসবার্গ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার কবিতা “সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড” এর কথা বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের পক্ষে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। গিনসবার্গের সমকামী কর্মকাণ্ডে কোনো রাখঢাক ছিল না। ১৯৭১ সালেই দিল্লিতে তিনি খুশবন্ত সিং এর সঙ্গে সাক্ষাতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তার যৌনাকাংখার পূরণের জন্য পুরুষ সঙ্গীর প্রয়োজনের কথা জানালে খুশবন্তু সিং গিনসবার্গের কুরুচিতে ঘৃণা প্রকাশ করেন এবং তাকে তড়িঘড়ি বিদায় করেন। অ্যালেন গিনসবার্গের প্রিয় যৌনসঙ্গী ছিলেন তার চেয়ে বয়সে সাত বছরের ছোটো রুশ বংশোদ্ভুত আমেরিকান কবি ও অভিনেতা পিটার ওরলভস্কি। এই দু’জনের দীর্ঘকালীন বন্ধুত্ব ও যৌন সম্পর্ক কাহিনি হয়ে আছে। একবার পিটারকে কবি গিনসবার্গ লেখেন: “আমি তোমার অনুপস্থিতি অনুভব করছি। তোমার হাত ও নগ্নতা এবং পরস্পরের জড়িয়ে থাকার অভাব বোধ করছি Ñ তোমাকে ছাড়া জীবন শূন্য…

বাঙালি মুসলমানদের ‘স্বাধীনতা’

সাঈদ তারেক প্রতিবেশী দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থানের প্রেক্ষাপটে ‘বা্ঙালি মুসলমান’ কথাটা আবার নতুন করে উঠে এসেছে। কতটা সমীচিন কতটা উচিত অনুচিত সে বিতর্ক ছাপিয়ে বাস্তবতা হচ্ছে নানা মহলে এ নিয়ে কানাঘুষা ফিসফাস আলোচনা সমালোচনা থেমে নেই। সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় নানা মত হতাশা ক্ষোভ। কেউ বলবেন ‘বা্ঙালি তো ‘বা্ঙালিই, তাকে আবার হিন্দু মুসলমান বলে ভাগ করা কেন। না, জাতিগতভাবে কোন বিভক্তি নেই। তবে ধর্মবিশ্বাষের ভিত্তিতে এমন একটা পরিচয় তো আছেই। এটা বাস্তবতা। এই বাস্তবতা কখনও কখনও প্রকট হয়ে ওঠে যখন সমাজে বৈষম্যের সৃস্টি হয়। এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে আমি কিছুটা আলোচনা করার চেষ্টা করেছি বাঙালির জাতিগত ও ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের উদ্ভব এবং বিকাশের। তাদের গড়ে ওঠা স্ব-অধীনতা এবং হাজার বছরের পথচলার। ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় বঙ্গ বাঙালা বা প্রাচীন চায়নীজ পূঁথিসাহিত্যে উল্লেখিত মাঙ্কালা অঞ্চলের ইতিহাস অনেক পুরনো হলেও বঙ্গ রাজ্য গঠনের শুরু মাত্র হাজার বছর আগে। আজকের যে বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ মিলে বৃহত্তর বাংলা- গোড়াতে এটা কোন একক দেশ বা এক রাজ্য ছিল না। অঙ্গ বঙ্গ সমতট হরিকেল পুন্ড্রবর্ধন তিরাভুক্তি রাধা প্রাগজোতিষি গঙ্গার্দী সুহমা- প্রভৃতি অঞ্চল ভিন্ন ভিন্ন রাজা বা শাষকরা শাষন করতেন। এদের মধ্যে প্রতিযোগীতা ছিল, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হতো, এক রাজা অন্য রাজ্য দখল করে নিতো। সপ্তম শতকে রাজা শশাঙ্ক এই রাজ্যগুলোকে একীভূত করে গৌড়িয় সাম্রাজ্য গঠনের মাধ্যমে বৃহত্তর বাংলা রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গোটা দেশে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃস্টি হয়। উদ্ভব ঘটে গৌড়িয় পাল সাম্রাজ্যের। কিন্তু…

আল্লাহ হারিয়ে গেছেন!

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু শিরোনামটি আমার নয়। বিখ্যাত সিন্ধি লেখক অমর জালীল (পুরো নাম কাজী আমির আবদুল জালীল) এর একটি ছোটগল্পের শিরোনাম সিন্ধি ভাষায় “খুদা গুম থি ওয়াইয়ো” যার উর্দু “খুদা গুম হো গ্যায়া হ্যায়” অর্থ্যাৎ “আল্লাহ হারিয়ে গেছেন।” অমর জালীলের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় আশির দশকের শুরুতে। খুশবন্ত সিং সম্পাদিত ভারতের বিড়লা গ্রুপের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘ইলাসট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’য় অমর জালীলের বেশ কিছু ছোট গল্পের ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করে মুগ্ধ হয়েছি। তার একটি গল্প ছিল “দ্য বাংলো ইন কুইন্স রোড” বা ‘কুইন্স রোডের বাংলো’। গল্পটির কাহিনি ছিল যে, করাচির কুইন্স রোডের একটি সুন্দর বাড়িতে বিদেশি পতিতারা অভিজাত খদ্দেরদের চিত্ত বিনোদনে বা দেহদানে নিয়োজিত ছিলেন। গল্পের নায়ক পতিতাদের ‘পিম্প’ বা ভাড়ুয়ার মাধ্যমে সেখানে যান। পতিতা তার খদ্দেরকে সেবা দিতে আসেন। সুন্দরী তরুণী পতিতা আরবি ভাষায় খদ্দেরকে স্বাগত জানিয়ে তার পরিচয় দেন যে, তিনি লেবানন থেকে আগত। কিন্তু খদ্দের তার মুখে আরবি শুনে চমকে উঠেন এবং তার সেবা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। উভয়ের বচসায় ভাড়ুয়ার আবির্ভাব ঘটে এবং কারণ জানতে চাইলে খদ্দের তাকে জানান যে, কোরআনের ভাষায় কথা বলে এমন নারীকে শয্যায় নিয়ে তিনি তার পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের অবমাননা করতে পারেন না এবং নিজের পাপের পাল্লা ভারি করতে চান না। লেবানিজ সুন্দরী তার ভাড়ুয়ার কাছে খদ্দেরের বক্তব্য তরজমা করে দিতে বলেন এবং ভাড়ুয়া তাকে খদ্দেরের আপত্তির কথা বুঝিয়ে বললে পতিতা ক্ষেপে খদ্দেরকে গালিগালাজ করে যা বলেন, তার মর্ম হচ্ছে, তিনি তার দেহ বিক্রি…

কিছু এর রেখে যাই

আলী আহমাদ রুশদী আলী আহমাদ রুশদী প্রায় বারো বছর আগে একবার মনে হয়েছিল দিন ফুরিয়ে আসছে, অথচ কোথাও কি তেমন করে আমার চিহ্ন থাকবে? বহু বছর পর কেউ কি জানবে যে আমিও ছিলাম? সে সময় প্রথম শুরু করেছিলাম এই স্মৃতিকথা লেখা। মনে হয়েছিল আমার জীবন থেকেও হয়তো কারো জানার কিছু থাকবে, অথবা নিছক সময় কাটানোর জন্যই কেউ হয়তো পড়ে দেখবে। কিন্তু তারপরে সাংসারিক নানা ব্যস্ততায় লেখাটা আর শেষ করা হয় নি। কিছুদিন ধরে আমার স্ত্রী, তিন মেয়ে এবং জামাতা আশিক জানতে চাইতো লেখাটা কতদূর হলো। তারা প্রায়ই উতসাহ দিত লেখাটা শেষ করার জন্য। আমি খুব একটা যে আমল দিতাম তা না, মনে হতো এই সাধারণ একটা জীবনের গল্প জেনে কার কি লাভ হবে? এই ব্যস্ত সময়ে কার অবসর আছে অবিখ্যাত অপরিচিত কাউকে জানবার? তবুও মানুষ তো নিজের ছায়া দেখতে ভালোবাসে। অন্যদের চোখে পরিচিতির আভাস দেখতে চায়। মাঝেমাঝেই আমার লেখার কিছু অংশ ফেসবুকে শেয়ার করেছি। কিছু কিছু প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল অথবা খবরের কাগজে। সবসময়েই দেখেছি বহু মানুষ লেখাগুলো আগ্রহের সাথে পড়ছেন, সুন্দর মন্তব্য করছেন। এতে করে খুব উতসাহ পেলাম, মনে হলো এবার ঠিকঠাকভাবে শেষ করি লেখাটা। আমার বড় নাতনি করিমুন্নেসা এখন মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। সে লেখাপড়া করছে সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে। আমার জীবন, আমার অতীত, আমার কাজ নিয়ে তার প্রবল আগ্রহ। তার জন্ম এই দেশে, এই সময়ে, অথচ তার পূর্বসূরীদের সময় নিয়ে সে জানতে চায়। আমার ছোট…

বিপজ্জনক সময়ের সামনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র

ডক্টর জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড জানুয়ারির সংসদীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি ‘একদলের আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা’র দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। বিরোধীরা নির্বাচন বয়কট করলেও, ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ আরও পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতা নিশ্চিত করেছে। এর ফলে শেখ হাসিনা শিগগিরই সমসাময়িক ইতিহাসের সবথেকে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা নারী সরকার প্রধান হয়ে উঠবেন। কিন্তু এমন রাজনৈতিক আধিপত্যের ঝুঁকিও রয়েছে। সারা বিশ্বেই এই এক দলের আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রায়ই এমন সব রোগের বিকাশ ঘটায়, যা দেশের শাসনব্যবস্থার ক্ষতি করে। তবে রাজনীতি, সরকার এবং অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা এই সমস্যাগুলি প্রতিরোধ করতে পারে।বাংলাদেশের এক দলের আধিপত্যবাদী ব্যবস্থাযদিও এই এক দলের আধিপত্যবাদী ব্যবস্থার কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। তবে এটিকে এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে, যেখানে একটি নির্দিষ্ট দল বড় একটি সময়ের জন্য রাজনীতি, সংসদ, সরকার এবং নীতিনির্ধারণে আধিপত্য বিস্তার করে। ৭ই জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ জয়ের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ হাসিনা। যদিও আওয়ামী লীগ এখন ২০১৮ সালের নির্বাচনের চেয়ে কম সংসদীয় আসন দখল করে আছে, তবে এর রাজনৈতিক আধিপত্য আসলে অনেক বেশি।গত তিনটি সাধারণ নির্বাচনের মধ্যে এবারেরটিসহ মোট দুটি নির্বাচন বয়কট করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। নির্বাচনে বিএনপি সদস্যদের যোগদানে প্ররোচিত করতে এবং পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগ ছাড়াও অন্য ব্যানারের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কিছু আসনে তার সদস্যদের দলের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র হিসাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলো আওয়ামী লীগ।ফলস্বরূপ নির্বাচনে কিছু সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা গেছে, বিশেষ করে স্বতন্ত্র এবং আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীদের…

কুয়াশা ফিরিয়ে দিল বিমান ফোবিয়া

শাকিল রিয়াজ এয়ারওয়েজের টিকেট কাটা ছিল ইকোনমি ক্লাসের। প্লেনে বোর্ডিং করার সময় ডেস্কের মেয়েটি বললো, স্যার আপনার টিকেট আপগ্রেড করে দেয়ার নোট এসেছে। আপনি বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণ করবেন। কোনও বাড়তি খরচ ছাড়াই। আমি অবাক হলাম। বিজনেস ক্লাসের টিকেটের দাম ইকোনমি ক্লাসের পাঁচ গুণ বেশি। স্টকহোম-ঢাকা ইকোনমি ক্লাসের দাম যদি ১২ হাজার ক্রাউন (১ লাখ ৩০ হাজার টাকা) হয় তবে বিজনেসের দাম প্রায় ৬০ হাজার ক্রাউন। জিজ্ঞাসা করলাম কেন এই বাড়তি সুবিধা। কম্পিউটারে আরেকবার চোখ বুলিয়ে জানালো, ২০ বছর ধরে আপনি কাতার এয়ারওয়েজের প্রিভিলেজ ক্লাবের মেম্বার। অনেক কিউ-মাইল এবং পয়েন্ট জমা আছে। এসব সহ আরো যেন কী কী বললো। শেষে জানালো, আমাদের বিজনেস ক্লাবের সিট খালি থাকলে এভাবে আমরা কাউকে কাউকে পিক করি যাদের সঙ্গে আমাদের আস্থার সম্পর্ক রয়েছে। অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে আপগ্রেডেড বোর্ডিং কার্ড নিয়ে প্লেনে উঠলাম। খরচ অনেক বেশি বলে জীবনে মাত্র ২/৩ বার বিজনেসে ভ্রমণ করেছি। তাও নিজের ইচ্ছায় নয়, অন্যের ইচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে। এবারের বাইরে আরও একবার ফাও ভ্রমণ করেছি বিজনেসে। সেবার ব্যাংকক থেকে স্টকহোমের পথে থাই এয়ারওয়েজ আমাকে ইকোনমি থেকে “তুলে” বিজনেসে সরিয়ে নেয় “চোখে চোখে” রাখার জন্য। শাপেবর হওয়া এই ঘটনার পেছনে ছিল বাংলাদেশের এক অসৎ ইমিগ্রেশন কর্তা। আমার যাত্রার শুরু ছিল ঢাকা। ঘুষ চেয়ে না পেয়ে নোট দিয়েছিল আমার ভিসা হয়তো প্রকৃত ভিসা নয় এই বলে। ব্যাংকক থেকে প্লেন ছাড়ার পরপরই এক অফিসার এসে আমাকে বিজনেস ক্লাসে নিয়ে যায় এবং পাসপোর্টটি নিজের কাছে…

একজন একনায়কের সঙ্গে বিমান ভ্রমণ

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু আমার সাত দশকের জীবনে চার জন সামরিক একনায়ক কর্তৃক শাসিত হয়েছি: — জেনারেল ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান, জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। শেষোক্ত দুই একনায়ককে দেখার ও তাদের সঙ্গে করমর্দনের এবং সর্বশেষ জনের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বিমান ভ্রমণের ও তিনি ক্ষমতার গগন থেকে ছিটকে পড়ার পর তার সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলাপচারিতার সুযোগ হয়েছে। ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে চারজনের জনের মধ্যে কোনো মিল ছিল না। জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি ব্রিটিশ রয়েল মিলিটারি কলেজ, স্যান্ডহার্স্টের ক্যাডেট ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মা-আসাম ফ্রন্টে জাপানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান অবিভক্ত ভারতে দেরাদুনে কর্নেল ব্রাউন কেমব্রিজ স্কুল ও পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইরাক, ইটালি ও উত্তর আফ্রিকায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৪২ সালে মুসোলিনীর নেতৃত্বাধীন ইটালির বাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে যুদ্ধবন্দি শিবিরে আটক থাকাকালে তৃতীয় প্রচেষ্টায় তিনি পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে কাশ্মিরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিচালনা করেন। লেফটেন্যান্ট জিয়াউর রহমান করাচির একাডেমি স্কুলে এবং ডি,জে সিন্ধ গভর্নমেন্ট সায়েন্স কলেজে পড়াশোনার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করায় পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক পদক “হিলাল-ই-জু’রাত”, তিনটি “সিতারা-ই-জু’রাত” ও আটটি “তমঘা-ই-জু’রাত” পদক লাভ করেন। ১৯৭১ সালের…

শতবর্ষে ট্রাকটেটাস: ও দার্শনিক ভিটগেনস্টাইনের জীবন

তীক্ষ্ণ ঈগলচঞ্চু নাসা, অল্পবয়সী ছোটখাটো একজন মানুষ যুদ্ধে যাচ্ছেন। তিনি সংস্কৃতিমনা অপরিমেয় ঐশ্বর্যের অধিকারী একটি অস্ট্রিয়ান পরিবারের সন্তান। তিনি কথা বলেন ভিয়েনা সার্কেলের দার্শনিকদের মতো করে উচ্চস্বরে, যদিও বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো খ্যাতনামা দার্শনিকের সঙ্গে তর্ক করার মতো ইংরেজিটাও তাঁর আয়ত্তে। এ-কারণেই তিনি আশা করেন যে, রাসেল তাঁকে দর্শনের জগতে পা রাখার জন্য জায়গা করে দেবেন। সদ্যপ্রয়াত একটি ইস্পাত সাম্রাজ্যের গোত্রপতি, যিনি আশা করতেন যে, তাঁর সন্তানেরা কর্তব্যের শক্তি দিয়ে চালিত হবে, সেই কার্ল ভিটগেনস্টাইনের এই কনিষ্ঠ পুত্রটির নাম ল্যুডভিগ জোসেফ জোহান ভিটগেনস্টাইন। পিতা ইউরোপের একজন ধনকুবের ইস্পাতসম্রাট হলেও ল্যুডভিগ নিজে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবেই গোলন্দাজ বাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দিয়ে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত হয়েছেন। তাঁর পিঠের ঝোলায় রয়েছে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে দর্শনশাস্ত্রের একটি বই, হাতে-লেখা কিছু নোট – যা প্রধানত প্রতিজ্ঞা বা বিবৃতির যৌক্তিক ভাষা (Logical form of proposition) সংক্রান্ত। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যখন তা প্রকাশিত হয়, তখন খুব কম লোকই তা পড়ে দেখে। অবশ্য এর লেখক নিজেও ঠিক এমনটাই হবে বলে নিশ্চিত ছিলেন। তবে মাত্র ৭৫ পৃষ্ঠার ক্ষীণকায় এই বইটি, যার নাম Tractatus Logicus Philosophicus – তাঁকে সুধীসমাজে পরিচিত করায় একজন জিনিয়াস হিসেবে। দর্শনজগতের অনেক বোদ্ধার মতে, ক্ষীণতনু এ-বইটি বিশ শতকের দর্শনবিদ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বই এবং ল্যুডভিগ ভিটগেনস্টাইন হচ্ছেন এ-শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন দার্শনিক। ভিটগেনস্টাইনের ট্রাকটেটাস জার্মান ভাষায় প্রথমবার প্রকাশ পায় ১৯২১ সালে, যা আধুনিক দর্শনের সবচেয়ে প্রভাবশালী একটি কাজ, হয়তো বা তারও চেয়ে আরো বেশি কিছু। এর…

সকলি গরল ভেল

আমার চোখের সমুখে অনেক মানুষের অনেক পরিবর্তন দেখেছি। অনেকে ছোট থেকে বড় হয়েছে। অনেকে কৃশকায় থেকে স্থুলকায় হয়েছে। অনেকে যুবক থেকে বৃদ্ধ হয়েছে। অনেকে ধনী থেকে দরিদ্র আবার অনেকে দরিদ্র থেকে প্রভূত বিত্তশালী হয়েছে। কতজন অসুস্থ থেকে সুস্থ জীবন ফিরে পেয়েছে আবার কত সুস্থ মানুষ সহসা অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। কিন্তু আমার চোখের দেখা দু-জন মানুষ তাদের মৃত্যুর আগ-পর্যন্ত কোন পরিবর্তন দেখিনি। দুই জনই আমার অত্যন্ত প্রিয়জন। একজন আমার দাদী। অপরজন আমার শাশুড়ি। আমার দাদী ও শাশুড়ির মাঝে অনেক বেশি মিল ছিল। আমার দাদীর চেহারা গোলগাল ছিল। মুখে কোন দাঁত ছিল না। বেঁটে-খাটো মানুষ ছিলেন। তিনি সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন এবং কথায় কথায় মানুষের জন্য দোয়া করতেন। তিনি মানুষকে খাওয়াতে ভালোবাসতেন। কোন ভিক্ষুককে খালি হাতে দরজা থেকে ফিরিয়ে দিতেন না। তিনি নিজে যেমন হাসতেন তেমন অপরকেও হাসাতে পারঙ্গম ছিলেন। অহংকার কাকে বলে তা তিনি জানতেন না। তবে বেশ অভিমানী ছিলেন। যে কোন মানুষের প্রতি তাঁর অগাধ মমত্ববোধ ছিল। জীবনের প্রথম দিন তাঁকে যেভাবে দেখেছি বলে মনে পড়ে মৃত্যুর পরও তাকে তেমনই দেখেছি। আমার শাশুড়ির চেহারা খানিকটা লম্বাটে ছিল। মুখে কোন দাঁত ছিল না। তিনিও বেঁটে-খাটো মানুষ ছিলেন। তবে তিনি সামনে ঝুঁকে হাঁটতেন। তিনি সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন এবং কথায় কথায় মানুষের জন্য দোয়া করতেন। তিনি মানুষকে খাওয়াতে ভালোবাসতেন। কোন ভিক্ষুককে খালি হাতে দরজা থেকে ফিরিয়ে দিতেন না। তিনি নিজে যেমন হাসতেন তেমন অপরকেও হাসাতে পারঙ্গম ছিলেন। তিনি নিরহংকারী…