Category ধর্ম-দর্শন

শতবর্ষে ট্রাকটেটাস: ও দার্শনিক ভিটগেনস্টাইনের জীবন

তীক্ষ্ণ ঈগলচঞ্চু নাসা, অল্পবয়সী ছোটখাটো একজন মানুষ যুদ্ধে যাচ্ছেন। তিনি সংস্কৃতিমনা অপরিমেয় ঐশ্বর্যের অধিকারী একটি অস্ট্রিয়ান পরিবারের সন্তান। তিনি কথা বলেন ভিয়েনা সার্কেলের দার্শনিকদের মতো করে উচ্চস্বরে, যদিও বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো খ্যাতনামা দার্শনিকের সঙ্গে তর্ক করার মতো ইংরেজিটাও তাঁর আয়ত্তে। এ-কারণেই তিনি আশা করেন যে, রাসেল তাঁকে দর্শনের জগতে পা রাখার জন্য জায়গা করে দেবেন। সদ্যপ্রয়াত একটি ইস্পাত সাম্রাজ্যের গোত্রপতি, যিনি আশা করতেন যে, তাঁর সন্তানেরা কর্তব্যের শক্তি দিয়ে চালিত হবে, সেই কার্ল ভিটগেনস্টাইনের এই কনিষ্ঠ পুত্রটির নাম ল্যুডভিগ জোসেফ জোহান ভিটগেনস্টাইন। পিতা ইউরোপের একজন ধনকুবের ইস্পাতসম্রাট হলেও ল্যুডভিগ নিজে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবেই গোলন্দাজ বাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দিয়ে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত হয়েছেন। তাঁর পিঠের ঝোলায় রয়েছে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে দর্শনশাস্ত্রের একটি বই, হাতে-লেখা কিছু নোট – যা প্রধানত প্রতিজ্ঞা বা বিবৃতির যৌক্তিক ভাষা (Logical form of proposition) সংক্রান্ত। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যখন তা প্রকাশিত হয়, তখন খুব কম লোকই তা পড়ে দেখে। অবশ্য এর লেখক নিজেও ঠিক এমনটাই হবে বলে নিশ্চিত ছিলেন। তবে মাত্র ৭৫ পৃষ্ঠার ক্ষীণকায় এই বইটি, যার নাম Tractatus Logicus Philosophicus – তাঁকে সুধীসমাজে পরিচিত করায় একজন জিনিয়াস হিসেবে। দর্শনজগতের অনেক বোদ্ধার মতে, ক্ষীণতনু এ-বইটি বিশ শতকের দর্শনবিদ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বই এবং ল্যুডভিগ ভিটগেনস্টাইন হচ্ছেন এ-শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন দার্শনিক। ভিটগেনস্টাইনের ট্রাকটেটাস জার্মান ভাষায় প্রথমবার প্রকাশ পায় ১৯২১ সালে, যা আধুনিক দর্শনের সবচেয়ে প্রভাবশালী একটি কাজ, হয়তো বা তারও চেয়ে আরো বেশি কিছু। এর…

মুমিনের নিদ্রা

মুহাম্মাদ আনওয়ার হুসাইন ঘুম আল্লাহতায়ালার অনেক বড় নেয়ামত। বান্দার প্রতি আল্লাহতায়ালার এক বিশেষ অনুগ্রহ ও দান। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য ঘুমের বিকল্প নেই। শারীরিক-মানসিক ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করতে এই পৃথিবীতে আল্লাহতায়ালা ঘুমকে অন্যতম প্রধান মাধ্যম বানিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন : আর আমি তোমাদের নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী। রাত্রিকে করেছি আবরণ। (সূরা নাবা : ৯-১০)। অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে : তিনিই তোমাদের জন্য রাত্রিকে করেছেন আবরণ, নিদ্রাকে বিশ্রাম এবং দিনকে করেছেন বাইরে গমনের জন্যে। (সূরা ফুরকান : ৪৭)। দিনভর ক্লান্তিকর চলাফেরার পর মানুষ যখন নিস্তেজ হয়ে পড়ে; কর্মক্ষম মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে, শক্তিমান মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে, সে সময় এ নেয়ামতই হয়ে ওঠে তার একমাত্র অবলম্বন, যার মাধ্যমে সে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করে। ফিরে পায় পরবর্তী দিবসের জন্যে নতুন প্রাণশক্তি ও নবতর উদ্যম।কোনো ব্যক্তি যত প্রখর মেধারই অধিকারী হোক, যত শক্তিশালীই হোক শুধু দু’একটি রাত বিনিদ্র কাটলে বা নিয়মতান্ত্রিক ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে মেধাশক্তি অকেজো হয়ে যায়। আচার-আচরণে, চলাফেরায় এবং কথাবার্তা ও কাজকর্মে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। বস্তুত এ নিআমতের কদর সেই সর্বাধিক বুঝতে পেরেছে, যার রাত কাটে নিদ্রাহীন; বিভিন্ন ব্যবস্থাপত্র গ্রহণের পরও আরামের বিছানায় এপাশওপাশ করে যার রাত ভোর হয়। আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, আল্লাহতায়ালার কী মহান নেয়ামত নিয়মিত ভোগ করে যাচ্ছি? অবিরত তাঁর কত বড় অনুগ্রহ লাভ করে যাচ্ছি! কুরআন মাজীদে ঘুমকে বান্দার প্রতি আল্লাহতায়ালার রহমতের বহিঃপ্রকাশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন :…

মৃত্যু নিয়ে রুমির ভাবনা

(মৃত্যু অনন্তের সঙ্গে আমাদের বিয়ের মতো) আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু জীবজগতে একমাত্র মৃত্যুই অনিবার্য সত্য। জীবনের অংশ এবং আমাদের জীবনের কোনো এক পর্যায়ে মৃত্যু আসবে। কোরআনে বলা হয়েছে, “কুল্ল নাফসিন যায়িকাতুল মওত,” (প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।” ভগবদ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “মৃত্যুকে আমাদের নিত্যসঙ্গী বলেই মনে হয়, আমাদের জীবনে আমরা প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছি।” মৃত্যু সম্পর্কে পৃথিবীর সকল ধর্মবিশ্বাসে মোটামুটি অভিন্ন কথাই বলা হয়েছে, তা সত্বেও অধিকাংশ মানুষের কাছে মৃত্যু এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এতটাই ভয়ের যে আমরা মৃত্যু নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে চলি। মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়ার সকল জাগতিক উপায় ব্যর্থ হওয়ার পরও মানুষ মৃত্যু থেকে পালানোর চেষ্টা করতে ছাড়ে না। এমনকি যারা কোনো স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না, তারা সৃষ্টিকর্তার “শাহী” দরবারে রোনাজারি করে: “আল্লাহ বাঁচাও! ভগবান রক্ষা করো! ইশ্বর পরিত্রাণ দাও!” কিন্তু মৃত্যু পিছু ছাড়ে না। মৃত্যু যেহেতু অবশ্যম্ভাবী, অতএব প্রত্যেকের যা প্রয়োজন তা হলো, সেই অনিবার্যতার জন্য প্রস্তুত থাকা। আমরা মৃত্যুকে এড়াতে পারি না, কিন্তু মৃত্যুর জন্য নিজেদের ভালোভাবে প্রস্তুত করতে পারি। আটশ বছর আগের সুফি কবি জালালুদ্দীন রুমি তাঁর অসংখ্য কবিতায় মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, মৃত্যু ভয়ভীতির কোনো ব্যাপার নয়, মৃত্যু অনন্তের সঙ্গে মিলন। তাঁর উদ্ধৃতি মৃত্যু ভয়ে কাতর মানুষের অন্তর্দৃষ্টিকে খুলে হৃদয়কে ভীতিমুক্ত করে আত্মাকে প্রশান্ত করার উৎস হতে পারে। মৃত্যু নিয়ে রুমির উদ্ধৃতি পাঠ করুন, মতামত দিন ও শেয়ার করুন: ১, “আমাদের মৃত্যু অনন্তের সঙ্গে আমাদের বিয়ের মতো।” ২. “সুখে মৃত্যুবরণ করো এবং সামনে…

জালালুদ্দীন রুমির মসনবী’র গল্প

জালালুদ্দীন রুমি অনুবাদ : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু জ্ঞানী পাগলএক তরুণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে এখন তার বিয়ে করার সময়, কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলেন না। যেহেতু তিনি গুরুতর কোনো ভুল করতে চান না এবং যেহেতু তিনি জানেন যে বিয়ে করার জন্য একজন কনে নির্বাচন করা কারও জীবনের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, অতএব তিনি এ ব্যাপারে তার চেয়ে বিজ্ঞ কারও সঙ্গে পরামর্শ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তিনি পুরো শহর অনুসন্ধান করলেন এবং পরিচিত সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। অবশেষে একজন তাকে বললেন: “আমাদের শহরে মাত্র একজন জ্ঞানী ব্যক্তি আছেন এবং তিনি বৃদ্ধ মানুষ, যিনি বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধূলা করেন!”লোকটিকে খুঁজে পেতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়নি, তাকে না পাওয়া গেলেই বরং কঠিন মনে হতো। শহরের কেন্দ্রস্থলের মূল চত্তরে তিনি একটি দীর্ঘ বাঁশের লাঠিতে ওঠে, যেন বুনো ও উচ্ছৃঙ্খল ঘোড়া দাবড়ে বেড়াচ্ছেন এমন ভান করে একদল ছোট বাচ্চাকে তাড়া করে তার দিন কাটিয়ে দেন। তরুণ তাকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে সতর্কতার সঙ্গে তার কাছে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবলেন। “হে মহান ঘোড়সওয়ার, আপনি কি মেহেরবানি করে আপনার ঘোড়াটি মুহূর্তের জন্য আমার কাছে আনবেন,” অনেকটা মরিয়া হয়েই তিনি অনুনয় করলেন।“জলদি করো এবং তোমার কাজের কথা বলো,” লোকটি আনুষ্ঠানিকতার সুরে উত্তর দিলেন। “তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো যে, আমার ঘোড়া বুনো এবং বেপরোয়া। তুমি যদি সামান্য নড়াচড়া করো, তাহলে ঘোড়াটি তোমাকে লাথি মারবে,” তিনি সতর্ক করলেন।“আমি বিয়ে করতে চাই, কিন্তু এ সম্পর্কে আমি অনভিজ্ঞ, সেজন্য আমার…