আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

একজন একনায়কের সঙ্গে বিমান ভ্রমণ

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু আমার সাত দশকের জীবনে চার জন সামরিক একনায়ক কর্তৃক শাসিত হয়েছি: — জেনারেল ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান, জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। শেষোক্ত দুই একনায়ককে দেখার ও তাদের সঙ্গে করমর্দনের এবং সর্বশেষ জনের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বিমান ভ্রমণের ও তিনি ক্ষমতার গগন থেকে ছিটকে পড়ার পর তার সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলাপচারিতার সুযোগ হয়েছে। ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে চারজনের জনের মধ্যে কোনো মিল ছিল না। জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি ব্রিটিশ রয়েল মিলিটারি কলেজ, স্যান্ডহার্স্টের ক্যাডেট ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মা-আসাম ফ্রন্টে জাপানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান অবিভক্ত ভারতে দেরাদুনে কর্নেল ব্রাউন কেমব্রিজ স্কুল ও পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইরাক, ইটালি ও উত্তর আফ্রিকায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৪২ সালে মুসোলিনীর নেতৃত্বাধীন ইটালির বাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে যুদ্ধবন্দি শিবিরে আটক থাকাকালে তৃতীয় প্রচেষ্টায় তিনি পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে কাশ্মিরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিচালনা করেন। লেফটেন্যান্ট জিয়াউর রহমান করাচির একাডেমি স্কুলে এবং ডি,জে সিন্ধ গভর্নমেন্ট সায়েন্স কলেজে পড়াশোনার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করায় পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক পদক “হিলাল-ই-জু’রাত”, তিনটি “সিতারা-ই-জু’রাত” ও আটটি “তমঘা-ই-জু’রাত” পদক লাভ করেন। ১৯৭১ সালের…

শেখ সা’দীর বাণী

(মধ্য যুগে ফারসি ভাষার অন্যতম সেরা কবি শেখ সা’দীর পুরো নাম আবু মুহাম্মদ মোসলেহ আল-দীন বিন আবদুল্লাহ শিরাজি (জন্মধ ১২১০-মৃত্যু: ১২৯১)। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তিনি তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘গুলিস্তান’ ও ‘বুস্তান’ এর জন্য বিখ্যাত। তিনি “শব্দের কারিগর” হিসেবেও খ্যাত। নবীকরিম সা: এর শানে তাঁর লেখা “বালাগাল উলাবি জামালিহী —’ এক অনন্য সৃষ্টি।) ****“একবার বাগদাদের প্রধান বাজারে আগুন লাগলে এক লোক আমার কাছে এসে বললো যে আমার দোকান আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছে। আমি উত্তরে বললাম, “আলহামদুলিল্লাহ!” — সকল প্রশংসা আল্লাহর। সেই মুহূর্তে আমি মানুষের সামনে লজ্জাবোধ করেছি যে আমি স্বার্থপরের মতো নিজের সুবিধা খুঁজেছি। আমি মাত্র একবার “আলহামদুলিল্লাহ” বলার জন্য আমাকে ক্ষমা করতে ত্রিশ বছর যাবত আল্লাহকে খুঁজছি।” ****“এক দুরাচারী বাদশাহ তার এক অনুরাগীর কাছে জানতে চাইলেন যে বাদশাহ’র জন্য উত্তম ইবাদাত কি! লোকটি উত্তর দিলেন, “আপনার জন্য সেরা ইবাদাত হচ্ছে দিনের অর্ধেক সময় নিদ্রিত থাকা, তাহলে অন্তত কিছু সময় জনগণ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া থেকে রক্ষা পাবে।” ****“দশ জন দরবেশ একটি কম্বলের নিচে ঘুমাতে পারেন, কিন্তু দু’জন বাদশাহ একটি রাজ্য শাসন করতে পারেন না।” ****“একটি মণির টুকরা কাদায় পড়ে গেলেও সেটি অমূল্য। কিন্তু ধূলি যদি বেহেশত থেকে পতিত হলেও তা মূল্যহীন।” ****“সমুদ্রের গভীরে এত সম্পদ রয়েছে, যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। কিন্তু তুমি যদি নিরাপত্তা খোঁজো, তা পাবে সমুদ্র সৈকতে।” ****“এক ছাত্র তার ওস্তাদকে বললো: “লোকজন আমাকে খুব বিরক্ত করে, অনেকে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে। তাদের আসা-যাওয়ায় আমার মূল্যবান সময় নষ্ট…

দাম্ভিকতা ও রাশিচক্র

কারও দাম্ভিক বা আত্মম্ভরী মনোভাব কি আসলে নিজের প্রতি তার অবিচল আস্থার অভিব্যক্তি? বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত। অনেকে বলেন, এটি মানুষের ব্যক্তিত্বের বৈকল্য, এক ধরনের মানসিক ব্যাধি। একটি বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই যে ওইসব লোকজনই দাম্ভিক বা নার্সিসটিক (Narcissistic), যারা নিজেদের ভালোবাসেন এবং নিজেদের বিষয়াবলী ছাড়া অন্য কারও বিষয়ে তারা শুধু অমনোযোগীই নন, নিজের ওপর চরম আস্থার মুখোশের আড়ালে তারা তাদের সামান্য সমালোচনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ব্যাপারটি বেশ জটিল। দাম্ভিক লোকজন দৃশ্যত আন্তরিক হলেও আবেগশূন্য; ‘ইয়েস,’ ‘নো,’ ‘ভেরিগুড’ এর বাইরে অগ্রসর হন না; তারা আত্মমগ্নতা ও আত্মতৃপ্তির মাঝে থাকেন। দাম্ভিকতা বা আত্ম-অহমিকার প্রধান লক্ষণগুলোর একটি হলো, এ ধরনের মানুষ তাদের আচরণ সম্পর্কে অবহিত, কিন্তু তারা এটা নিয়ে মাথা ঘামান না, কারণ তারা তাদের বৈশিষ্ট বা স্বভাবকে অস্বাভাবিক বা অবাঞ্ছিত বলে মনে করেন না।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সাবেক শিক্ষক প্রিয়ভাজন প্রফেসর আশরাফ আহমেদ, যিনি বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির মহাপচিালকের দায়িত্বও পালন করেছেন, তাঁর ‘আত্মঅহমিকা’ নিবন্ধটি সম্পাদনা করতে গিয়ে বিষয়টির ওপর আরও কিছুটা আলোকপাত করার ইচ্ছা জাগ্রত হলো। কারণ আমি ‘খুদী’ বা ‘আমিত্ব’ নিয়ে কবি আল্লামা ইকবালের কবিতার নিচের অংশটুকু আমি প্রায়ই উচ্চারণ করি, চর্চা করি এবং আমার ঘনিষ্টজনদের আমল করতে বলি। কবিতাংশ হচ্ছে: “খুদী কো কর বুলন্দ ইতনা,কে হর তকদীর সে পেহলে,খুদা বান্দা সে খুদ পুছে,বাতা তেরি রেজা ক্যয়া হ্যায়?” (তোমার আমিত্বকে এত দৃঢ় করো,যাতে প্রতিবার ভাগ্য নির্ধারণের আগেআল্লাহ স্বয়ং তোমার কাছে জানতে চানবলো, তুমি কি চাও?) আমি জানি না,…

গোলাম আলীর কণ্ঠে দুটি গজল ও নুসরত ফতেহ আলী খানের দুটি কাওয়ালি

উপমহাদেশের বিখ্যাত গজল শিল্পী গোলাম আলী ও কাওয়ালি পরিবেশক নুসরত ফতেহ আলী খানের কণ্ঠে বেশ কিছু খ্যাতিমান কবি ও গীতিকারের কবিতা গজল ও কাওয়ালি প্রেমিকদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। অনেকে হয়তো গজল ও কাওয়ালির কথাগুলো যথাযথভাবে বুঝতে পারেন না, তা সত্বেও তারা আবেগ-তাড়িত হন। অনেকে আমাকে অনুরোধ করেন এগুলোর বাংলা তরজমা করে দিতে। আমি স্বউদ্যোগে তা করি, কেউ অনুরোধ করলে আরও অনুপ্রাণিত হই। এখানো গোলাম আলীর গাওয়া দুটি জনপ্রিয় গজল ও নুসরত ফতেহ আলী খানের দুটি জনপ্রিয় কাওয়ালির উর্দু উচ্চারণসহ বাংলা তরজমা উপস্থাপন করলাম। সাথে এগুলোর রচয়িতাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও যোগ করেছি। আশা করি পাঠকরা সাদরে গ্রহণ করবেন। আকবর ইলাহাবাদী (১৮৪৬-১৯২১) বিখ্যাত উর্দু কবি আকবর ইলাহাবাদী ১৮৪৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে আইন পেশায় যোগ দেন। এক পর্যায়ে তিনি তহশিলদার ও মুন্সেফ হিসেবেও কাজ করেন এবং তাঁর চাকুরি জীবন শেষ হয় একজন দায়রা জজ হিসেবে। ১৯২১ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর রচিত একটি কবিতা গোলাম আলীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। হাঙ্গামা কিউ বাড়পা “হাঙ্গামা হ্যায় কিউ বাড়পা, থোড়ি সি জো পী লি হ্যায়,ডাকা তো নেহি ডালা, চোরি তো নেহি কিয়া ÑÑউস মায় সে নেহি মতলব দিল জিস সে হো বেগানামাকসুদ হ্যায় উস মায় সে,সুরজ মে লাগে ধাবা ফিতরাত কে কারিশমে হ্যায়বুত হামকো কাহে কাফির,বুত হামকো কাহে কাফির আল্লাহ কি মরজি হ্যায়,না তজরুবা কারি যে ওয়াইজ কি ইয়ে বাতেঁ…

মসজিদে বসে মদ পান করতে দাও (মির্জা গালিব)

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষার সকল বিখ্যাত মুসলিম কবি তাদের অসংখ্য কবিতায় মদ (শরাব) ও মদ পরিবেশনকারী বালিকাদের (সাকি) কথা বলেছেন। সূফি কবিতায় দুটিরই উপস্থিতি আরো বেশি। অথচ শরাব ও সাকির সঙ্গে ইসলামের দূরতম সম্পর্কও নেই। কবিরা মদ ও মাতাল হওয়াকে রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন, প্রকৃত মদ ও মাতলামির কথা বলেননি। প্রেমের মদ বা সুরা পানকে উল্লেখ করা হয়েছে আধ্যাত্মিকতার উন্মোচন এবং চিরন্তন সত্তাকে স্বীকার করার উপায় হিসেবে, যা আল্লাহর প্রতি পরম ভালোবাসার অভিব্যক্তি। আমি বেশ ক’জন বিখ্যাত উর্দু কবির কবিতাংশ তুলে ধরছি। আশা করি পাঠকদের ভালো লাগবে। ১“জাহিদ, শরাব পিনে দে মসজিদ মে বৈঠ কর,ইয়া ও জাগাহ বাতা’ জাহা পর খুদা না হো।” — মির্জা গালিব(পরহেজগার, মসজিদে বসে মদিরা সেবন করতে দাও,তা না হলে বলো, কোথায় খোদা নেই?) ২“গো হাথ কোন জামবিশ নেহি আখোঁ মে তো দম হ্যায়,রেহনে দো আভি সাগর-ও-মীনা মেরে আগে।” —- মির্জা গালিব(আমার হাত স্থবির হয়ে গেলেও আমার চোখ এখনো দেখতে পায়,আমার সামনে এখন রেখে দাও সুরাভর্তি সোরাহি ও পানপাত্র।) ৩“ওহ চিজ জিস কে লিয়ে হাম কো বেহিশ হ্যায় আজিজসিবায়ে বাদা-এ-গুফতাম-এ-মুশক-বু ক্যয়া হ্যায়। — মির্জা গালিব(যে বস্তুর জন্য এমনকি বেহেশত আমাদের এত প্রিয়,সুরার এই সুগন্ধির কাছে মৃগনাভির সুবাসও ম্রিয়মান।) ৪.“পিয়োঁ শরাব আগার খুম ভি দেখ লু দো চার,ইয়ে শিসা-ও-কাদা-ও-কুজা-ও-সুবু ক্যয়া হ্যায়।” —- মির্জা গালিব(মদিরা পান করো, এবং দু’চার কলসি পান করে ফেলো,কাঁচের ছোট্ট পানপাত্র, সোরাহির কথা বলে কী লাভ?) ৫“গালিব ছুট্টি শরাব পর…

মৃত্যু নিয়ে রুমির ভাবনা

(মৃত্যু অনন্তের সঙ্গে আমাদের বিয়ের মতো) আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু জীবজগতে একমাত্র মৃত্যুই অনিবার্য সত্য। জীবনের অংশ এবং আমাদের জীবনের কোনো এক পর্যায়ে মৃত্যু আসবে। কোরআনে বলা হয়েছে, “কুল্ল নাফসিন যায়িকাতুল মওত,” (প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।” ভগবদ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “মৃত্যুকে আমাদের নিত্যসঙ্গী বলেই মনে হয়, আমাদের জীবনে আমরা প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছি।” মৃত্যু সম্পর্কে পৃথিবীর সকল ধর্মবিশ্বাসে মোটামুটি অভিন্ন কথাই বলা হয়েছে, তা সত্বেও অধিকাংশ মানুষের কাছে মৃত্যু এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এতটাই ভয়ের যে আমরা মৃত্যু নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে চলি। মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়ার সকল জাগতিক উপায় ব্যর্থ হওয়ার পরও মানুষ মৃত্যু থেকে পালানোর চেষ্টা করতে ছাড়ে না। এমনকি যারা কোনো স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না, তারা সৃষ্টিকর্তার “শাহী” দরবারে রোনাজারি করে: “আল্লাহ বাঁচাও! ভগবান রক্ষা করো! ইশ্বর পরিত্রাণ দাও!” কিন্তু মৃত্যু পিছু ছাড়ে না। মৃত্যু যেহেতু অবশ্যম্ভাবী, অতএব প্রত্যেকের যা প্রয়োজন তা হলো, সেই অনিবার্যতার জন্য প্রস্তুত থাকা। আমরা মৃত্যুকে এড়াতে পারি না, কিন্তু মৃত্যুর জন্য নিজেদের ভালোভাবে প্রস্তুত করতে পারি। আটশ বছর আগের সুফি কবি জালালুদ্দীন রুমি তাঁর অসংখ্য কবিতায় মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, মৃত্যু ভয়ভীতির কোনো ব্যাপার নয়, মৃত্যু অনন্তের সঙ্গে মিলন। তাঁর উদ্ধৃতি মৃত্যু ভয়ে কাতর মানুষের অন্তর্দৃষ্টিকে খুলে হৃদয়কে ভীতিমুক্ত করে আত্মাকে প্রশান্ত করার উৎস হতে পারে। মৃত্যু নিয়ে রুমির উদ্ধৃতি পাঠ করুন, মতামত দিন ও শেয়ার করুন: ১, “আমাদের মৃত্যু অনন্তের সঙ্গে আমাদের বিয়ের মতো।” ২. “সুখে মৃত্যুবরণ করো এবং সামনে…

আমি বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নই”

খাজা আহমদ আব্বাস (ক’দিন আগেই আশি বছর বয়স পূর্ণ করলেন বলিউডের ‘শাহেনশাহ’ অমিতাভ বাচচান। ছায়াছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার ঘটনাও বেশ নাটকীয়। দৈহিক উচ্চতা তাঁর অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেসব পরিচালকের কাছেই গেছেন, তারা তাকে বিদায় করেছেন যে নায়িকাদের জন্য তিনি অতি দীর্ঘ। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি কথা সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক খাজা আহমদ আব্বাসের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। পরিচালক তখন “সাত হিন্দুস্থানি” নামে একটি ছায়াছবি নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁকে কীভাবে “সাত হিন্দুস্থানি’র মধ্যে মুসলিম চরিত্রের একজনের অভিনয়ের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে খাজা আহমদ আব্বাস তাঁর আত্মজীবনী “আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ড” এ বর্ণনা করেছেন। এ ছায়াছবি দিয়ে অমিতাভ বাচচানের চলচ্চিত্রাভিনয়ের শুরু। এর আগে তিনি মৃণাল সেনের একটি ছবিতে শুধু কণ্ঠ দিয়েছিলেন। —আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু) খাজা আহমদ আব্বাস আত্মজীবনীতে লিখেছেন: “—- একজন ‘হিন্দুস্থানি’ রয়ে গেল, মুসলিম গোঁড়া উর্দুভাষী। আমি যেহেতু এই ছেলেগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন বয়সের ও ভিন্ন উচ্চতা বিশিষ্ট চেয়েছিলাম, অতএব একজন দীর্ঘ ও সুদর্শন তরুণের স্থান শূন্য ছিল। তাকে ছিপছিপে গড়নের হতে হবে। একদিন কেউ এক দীর্ঘ তরুণের ছবি এনে আমাকে দেখালো। আমি বললাম, “আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে দেখতে চাই।” “তিনি আগামী পরশু সন্ধ্যায় এখানে আসবেন।” আমার আবারও ধারণা হলো যে লোকটি বোম্বেতেই (মুম্বাই) আছেন, নিশ্চয়ই কোথাও চাকুরি করেন এবং সন্ধ্যার আগে কাজ থেকে অবসর পান না। তৃতীয় দিবসে সন্ধ্যা ঠিক ছ’টায় এক জন দীর্ঘদেহী তরুণ উপস্থিত হলেন। চুড়িদার পাজামা ও জওহর জ্যাকেট পরিধান…

কোথায় যাবো, কী হবে, কী খাবো

গোলাম মাওলা রনি ব্যক্তিগত জীবনে আমি খুবই আশাবাদী মানুষ। হতাশা-ভয়-আতঙ্ক আমাকে সচরাচর তাড়া করে না। সব পরিস্থিতি মেনে নেয়া ও সর্বদা সন্তুষ্ট থাকার যে নীতিকথা আমি সারাটি জীবন অনুসরণ করেছি তা হাল আমলে এসে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা খাচ্ছে। প্রকৃতি-পরিবেশ-অর্থনীতি-রাজনীতি-সমাজ-পরিবার ও নিজের শরীর স্বাস্থ্যের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রবল চেষ্টা প্রায় প্রতিদিন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জীবন-জীবিকার প্রতিটি উপসর্গ ও অনুসর্গ পরস্পরবিরোধী হয়ে পড়েছে। আহার-বিশ্রাম-নিদ্রা ও কাজকর্মের মধ্যে সমন্বয় হচ্ছে না। আয়ের সাথে ব্যয়ের অমিল ও নিজের পাঁচটি ইন্দ্রিয় যেভাবে ক্ষমতাধর মিথ্যুকদের দিয়ে হররোজ বলাৎকারের শিকার হচ্ছে তাতে করে আমার মনুষ্য জীবন ও বনবাদাড়ের অন্য প্রাণীদের জীবনের মৌলিক পার্থক্যগুলো ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। আমি আমার ব্যক্তিগত সমস্যার সাথে প্রায়ই পাড়া প্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যাগুলো মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। কাঁচাবাজারের মুদির দোকানি, ফুটপাথের হকার, রিকশাওয়ালা, সরকারি কর্মচারী, সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী-আমলা-সাংবাদিক-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীসহ অন্যান্য শ্রেণিপেশার মানুষের সাথে যতই মতবিনিময় করি ততই ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। কারো মুখে কোনো সান্ত্বনার বাণী অথবা সাম্প্রতিক সময়ে কারো চমকপ্রদ সফলতার কথা শুনতে পাই না। সবার মনে সীমাহীন বেদনা-অজানা আশঙ্কা। অনিশ্চয়তা ও ক্ষোভ ক্রমেই বাড়তে বাড়তে এখন প্রতিটি আদম সন্তানকে দেখলে মনে হয়- তারা জীবন্ত ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের ওপর বসে আছে। কয়েক দিন আগে রিকশায় বাসায় ফিরছিলাম। মাত্র মাসখানেক আগে রিকশা ভাড়া ছিল সর্বোচ্চ ৭০ টাকা। কিন্তু সেদিন যে ক’জন রিকশাওয়ালার সাথে দরাদরি করছিলাম তারা সবাই বললেন, ১২০ টাকার নিচে কেউ যাবেন না। রংপুর…


যে কল্পকাহিনি নিছক কল্পনা নয়

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বিশ শতকে লেখা দুটি কল্পকাহিনির নাম আমরা অনেকেই জানি। একটি জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ এবং আরেকটি অল্ডাস হাক্সলির ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’। দুটিই ডিসটোপিয়া অর্থাৎ আমরা যাকে ইউটোপিয়া বা স্বর্গরাজ্য বলি, তার উল্টোটা। তবে এই দুটি বইয়ের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। এর কারণ, অরওয়েলের মাথায় ছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র আর হাক্সলি ভেবেছেন প্রযুক্তিশাসিত রাষ্ট্রের কথা। সেই হিসেবে হাক্সলিই এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। এর ঘটনাগুলো ঘটে ভবিষ্যতের প্রযুক্তিশাসিত লন্ডন শহরে। সেখানে মানুষের জন্মটাও নিয়ন্ত্রিত। কে কোন জাতের মানুষ হবে, সেটা জন্ম থেকেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয় বৈজ্ঞানিকভাবে। সে অনুযায়ী, তাদের বুদ্ধিমত্তা, চাকরি-বাকরি, ভোগবিলাসের ধরনও ঠিক হয়ে যায়। সেই সমাজে একগামিতা অবৈধ এবং শারীরিক সুখভোগই সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বার্নার্ড মার্ক্স একজন আলফা প্লাস মানের উচ্চ শ্রেণির বিশেষজ্ঞ। একসময় তার আর এ সমাজকে ভালো লাগে না। সে শহর থেকে বেরিয়ে ‘স্যাভেজ রিজার্ভেশন’ বলে একটা জায়গায় যায়। ওখানে জন নামের একজন তরুণের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে সে জানতে পারে, সে তাদের ডিরেক্টরের সন্তান। একগামিতা অবৈধ বলে জনকে ডিরেক্টর তার সন্তান বলে পরিচয় না দিয়ে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে। জনকে বার্নার্ড তাদের মূল সমাজ ‘ওয়ার্ল্ড স্টেট’-এ নিয়ে আসে। জন এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না এবং সে এমন কিছু কাজ করে, যার কারণে বার্নার্ড ও তার বন্ধুকে নির্বাসনে যেতে হয়। আর সে নিজে আত্মহত্যা করে। বলাবাহুল্য, এই সামান্য বর্ণনা বই দুটো বোঝার জন্য…

ফেরাউনের আমলা আর বাংলাদেশের আমলা

ডা. জাহেদ উর রহমান আমলা প্রসঙ্গে ফেরাউনের কথা আমাদের সামনে এনেছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী, মনে আছে আমাদের? মন্ত্রীর এই উক্তি প্রসঙ্গে আলোচনায় আসবো কলামের শেষদিকে। আমলাদের প্রসঙ্গে তার উক্তি মাথায় এলো কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে আমলারা নানা কারণে আলোচনায় আসছেন, আলোচনায় থাকছেন। ৪৩ কোটি টাকা দিয়ে দু’টি বাড়ি তৈরি করার প্রস্তাব সার দেশে অকল্পনীয় রকম সাড়া ফেলেছিল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বারংবার দেয়া দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাসকে সামনে রেখে বাড়ি দু’টির যে বর্ণনা আমাদের সামনে এসেছে, সেটাকে ছোটখাটো প্রাসাদ বলাই যায়। না, আমার এই কলামে এই প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করছি না। প্রসঙ্গটি নিয়ে নানা বিশ্লেষণ এবং মতামত প্রকাশিত হয়েছে নানা পত্রিকায়। আমি বরং এই বাহানায় গত বেশ কয়েক বছরে মূলত প্রশাসনের আমলাদের কিছু প্রবণতা এবং তাদের বিষয়ে রাজনৈতিক সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলাপ করতে চাই। বছর দেড়েক আগে বেশ হাঁকডাক করে ৫০টি মডেল মসজিদ উদ্বোধন করা হয়েছিল। এই রকম মসজিদ নির্মাণ করা হবে সর্বমোট ৫৬০টি। মসজিদগুলো নির্মিত হচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে। সে সময়ে এগুলো পরিচালনার জন্য ‘মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সংস্কৃতি কেন্দ্র পরিচালনা নীতিমালা-২০২১’ তৈরি করা হয়। এতে দেখা যায় উপজেলা, জেলা পর্যায়ে অবস্থান অনুযায়ী মসজিদ পরিচালনা কমিটির প্রধান হবেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা প্রশাসক। তারাই মসজিদ পরিচালনা করবেন এবং তারাই মসজিদের জনবল নিয়োগ দেবেন। এই সিদ্ধান্তে তখন তীব্র নাখোশ  হয়েছিল ইসলামিক ফাউন্ডেশন। স্বভাবতই সংস্থাটির লোকজন ভেবেছিলেন মসজিদগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব তারাই পেতে যাচ্ছেন। তারা দাবি করেছিলেন দেশের প্রতি জেলায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অফিসের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। ইসলামিক মিশন,…